বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত গদ্য 'কবিতা' থেকে; ২য় খণ্ড : রবীন্দ্রনাথ; সম্পাদনা : দময়ন্তী বসু সিং; প্রথম প্রকাশ : বইমেলা ২০১২, বিকল্প - কলকাতা
এ বড় দুঃসময়! নানা অর্থেই। আইন-শৃঙ্খলা, ভ্রষ্টাচার, নৈতিকতা, কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যের কথা বলছিনা, তার জন্য মন্ত্রীরা আছেন, নেতারা আছেন, বিশেষজ্ঞেরা তো আছেনই বিশাল সংখ্যায়। আমার আক্ষেপ বাংলাভাষা ও সাহিত্য নিয়ে, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে। যদিও জানি ভীরুদের হাতে ভুবনের ভার থাকেনা, তবুও। বিশেষ করে যখন এমন একটি গ্রন্থ হাতে আসে যা পড়তে পড়তে অনুভব করি অতীতের খনি থেকে কী অমূল্য সব রত্ন তুলে এনে প্রয়াত বুদ্ধদেব বসুর আত্মজা দময়ন্তী (বসু সিং) দুই মলাটের পত্রপুটে সাজিয়েছেন। বিষয় রবীন্দ্রনাথ, এবং অবশ্যম্ভাবীভাবেই রবীন্দ্রসাহিত্য! তার নির্মোহ এবং নির্মম আলোচনায় ব্রতী তন্নিষ্ঠ বুদ্ধদেব। এবং প্রায় ধারাবিবরণীর মতো যেমন যেমন কবির গ্রন্থ, সঙ্কলন বা রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে .... বীথিকা, পত্রপুট, শ্যামলী, সে, কাব্যপরিচয়, রচনাবলীর খণ্ডগুলি 'কবিতা' পত্রিকার পাতায় তার পর্যালোচনা/রিভিয়্যু বেরিয়ে চলেছে। 'কবিতা' পত্রিকার কথা শুনেছি ও পড়েছি প্রচুর, কিন্তু কোনো সংখ্যা চাক্ষুষ-দর্শনের সুযোগ হয়নি। অনুজ-প্রতিম এক হিতৈষী অধ্যাপক হাতে করে গ্রন্থটি আমায় তুলে না দিলে এই ভাণ্ডারও অজানাই থেকে যেত। আফ্শোষ সেখানেই। সাহিত্য ভালোবাসে, বই কিনুক না কিনুক, বই পড়ে এবং পড়ায়, বই নিয়ে লেখালেখি না করুক, বই নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসে — জনসংখ্যার এই অংশটা বোধহয় শঙ্কাজনকহারে ক্রমহ্রস্বমাণ। আর ১৫ থেকে ২৫ বা ৩০ বছর বয়সের যে অংশটিকে পরবর্তী প্রজন্ম বলে অভিহিত করা যেতে পারে তাদের মধ্যে এই 'বিজাতীয়' অভ্যাস বিশেষ দৃষ্টিগোচর হয় না। দুঃসময়ের দুঃখ সেইখানেই।
নাসিরুদ্দিন মোল্লার যে কয়েকটি গল্প অধিকপ্রচলিত, তার মধ্যে সুরুয়া খাবার গল্পটি স্মরণ করার লোভ হচ্ছে! নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে মাংসের সুরুয়া খেতে যখন একের পর এক লোক আসছে আত্মীয় সেজে, বা আত্মীয়ের আত্মীয় সেজে, তখন সুরুয়াও ক্রমাগত পাতলা থেকে আরো পাতলা হয়ে চলেছে, শেষ পর্যন্ত তা প্রায় জলে পরিণত। কারণ আত্মীয়ের আত্মীয়র আত্মীয়র কপালে সুরুয়ার সুরুয়ার সুরুয়াই প্রাপ্য। এ'কথা বলার উদ্দেশ্য ধানভানতে শিবের গীত গাওয়া নয়। রবীন্দ্ররচনা ও রবীন্দ্রপ্রতিভা নিয়ে রবীন্দ্রোত্তর যুগের প্রবাদ-প্রতিম প্রতিভাবান অধ্যাপক সাহিত্যিকের সমালোচনাগ্রন্থের সমালোচনা বা পুস্তক পর্যালোচনার 'ঘনত্ব' প্রায় বায়বীয় স্তরে পৌঁছে গেলেও যাতে দোষভাগী না হতে হয়, সে উদ্দেশ্যেই এই caveat এর প্রার্থনা!
গ্রন্থটি সুশোভন; প্রচ্ছদটি মনোহর না হলেও পরিশীলিত, অযথা উচ্চারিত নয়। Blurb-এর ভিতরে গ্রন্থপরিচিতি এবং বইয়ের পিছনের মলাটে মোটামুটি দুশো শব্দের একটি 'আলাপ' বইটিকে কাছে টেনে নেবার কাজ করবে, যদিও রং বা contrast এর ব্যবহার নিয়ে বোধহয় আরেকটু অন্যরকম ভাবার অবকাশ ছিল।
একটি আলোকচিত্র বা একটি চিত্র (painting অর্থে) মোটামুটিভাবে একটি থিম বা চিন্তাকে প্রকাশ করে বা করতে চায়। শিল্পী তখনই সার্থক, যখন তাঁর ভাবনা বা বোধ তাঁর ছবির মধ্যে দিয়ে সঞ্চারিত হয় দর্শকের মনে। বিমূর্ত শিল্পে এ নিয়ে মতদ্বৈত বা বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে, যেটা শিল্পেরই অঙ্গ! এ'কথা খাটে সাহিত্যকর্ম সম্পর্কেও। একটি উপন্যাস বা কোনো কবিতার বই, বা একটি গল্প বা একটি সম্পূর্ণ গল্প-সঙ্কলনেরও যখন পর্যালোচনা করা হয়, তখন অনেকসময়ই একটি মূল ভাবনা তার কেন্দ্রে থাকে, তার ডালপালা-ফলফুলেরও পরিচয় দিয়ে সমালোচক তাঁর কার্য সমাধা করেন। কিন্তু উপজীব্য যখন 'কবিতা' পত্রিকায় প্রকাশিত কিন্তু অগ্রন্থিত বুদ্ধদেব, তখন আলোচক-এর কাজ দুরূহ থেকে দুরূহতর হয়ে পড়ে। বিশেষ করে যখন বিষয় রবীন্দ্রনাথ!
দময়ন্তীর 'নিবেদন' এর পরে 'পূর্ণতর বুদ্ধদেব' নামে কমবেশি দশ-পৃষ্ঠার যে অসামান্য মুখবন্ধটি আমরা পাই শঙ্খ ঘোষের কলম থেকে, তাতে যে তৃপ্তির আস্বাদ পাঠকের অনুভবে ধরা দেয়, তার পরেই ঠিক পাতা উল্টে মূল গ্রন্থে প্রবেশ করা যায় না। লেখাটি ভাষার সৌকর্যে, শব্দচয়নের অসামান্যতায়, চিন্তাক্রমের ঘন বুনটে এবং সর্বোপরি পক্ষপাতশূন্যতায় বোধহয় 'প্রাক্কথনের' পরাকাষ্ঠা হয়ে থেকে যাবে। লেখাটি ভাবায় এবং পাঠককে বাধ্য করে পাতা উল্টে ফিরে যেতে। টুকরো যে কয়েকটি phrasal usage আমাকে মুগ্ধ করেছে তার কয়েকটা 'বুলেট-বিদ্ধ' করে এখানে তুলে আনার লোভ সামলাতে পারছিনা, যদিও জানি প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে উদ্ধৃতির ব্যবহার সভ্য সাহিত্যসমাজে স্বীকৃত নয়; তবু --
গ্রন্থটিকে পুস্তক পর্যালোচনা পর্যায়ভুক্ত করায় আমার কিঞ্চিৎ আপত্তি আছে। দোষগুণ, প্রাসঙ্গিকতা, সদৃশ অন্যান্য রচনার সঙ্গে তুলনামূলক বিচার ছাড়াও গবেষণা সন্দর্ভে যেমন ভবিষ্যতের জন্য পথনির্দেশ থাকে, scopes for further research, তেমনই এই গ্রন্থেরও বিভিন্ন পরিচ্ছেদে বুদ্ধদেব শুধু আশা প্রকাশ করে থেমে থাকেননি, রীতিমতো জবাবদিহি দাবী করেছেন, অবশ্যই সশ্রদ্ধভাবে; প্রত্যাশা যেখানে গগনচুম্বী সেখানে আশাভঙ্গের বেদনাও যে গভীর। কয়েকটি উদ্ধৃত করা যাক —
"...যে ভাষা চিত্রা-তে, সোনারতরী-তে সঙ্গত ছিল, সেটাই কি হতে পারে গদ্যছন্দের উপযুক্ত বাহন, না কি গদ্যছন্দের জন্য নতুনরকমের ভাষা সৃষ্টি করে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, কবির দরবারে এই প্রশ্নটি আমি উত্থাপন করছি। এর জবাব পাওয়া প্রয়োজন—কেননা রবীন্দ্রনাথ এখন যা করছেন বা কি করবেন তার উপর গদ্যছন্দের ভবিষ্যৎ পরিণতি অনেকখানিই নির্ভর করছে।" (পৃ. ৫)
"...এ ধরনের বই শুধু শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের নয়, বাংলার সমস্ত ছেলেমেয়েদের লক্ষ্য করে রচিত হওয়া বাঞ্ছনীয় মনে হয়, কারণ এর বহুল প্রচারে সমস্ত দেশের লাভ।" (পৃ. ১৪০)
"...আশা করি রবীন্দ্রনাথের চিঠি যাদের কাছে আছে তাঁরা কিম্বা তাঁদের উত্তরাধিকারীরা চিঠিগুলি বিশ্বভারতীর অধিগম্য করতে কৃপণতা করবেন না। বিদেশি বন্ধুদের কাছে লেখা রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য ইংরেজি চিঠিও নিশ্চয়ই আছে — যুদ্ধাবসানে সেগুলিও সংগ্রহ ও প্রকাশ করা বিশ্বভারতীর অন্যতম কর্তব্য।" (পৃ. ১৭৯)
"রবীন্দ্রনাথ এখন নতুন অনুবাদের মুখাপেক্ষী।" (পৃ. ২১৩)
কয়েকটি ছোটোখাটো অস্বস্তির কথা এই যাত্রায় বলে নেওয়া ভালো। প্রথমটি বানান নিয়ে। সস্তা যদি বা শস্তা হয়, সুড়ঙ্গ হয় সুরঙ্গ, খুশি কেন খুসি হবে, বা জিনিষ/জিনিস হবে জিনিশ? 'হিশেব' কেও তো আমরা হিসেব হিসেবেই দেখে অভ্যস্ত। দ্বিতীয়টি, ধৃষ্টতা মার্জনীয়, শব্দচয়ন নিয়ে: পাঠ্যপুস্তক বা পাঠ্যবই আমরা পড়ে অভ্যস্ত, পাঠ্যকেতাব (পৃ. ১৩৯) চোখে ও কানে পীড়া দেয়। 'শ্যামলী'র সমালোচনায় 'কাপুরুষ কপটতা'য় সামান্য ধাক্কা লেগেছিল কাপুরুষ-এর বিশেষণ রূপে, কিন্তু অভিধানের অঙ্গুলিসঙ্কেতে সামলে নেওয়া গেল। শুধু অর্থে শুদ্ধ বা শুদ্ধু যদি বা ব্যবহৃত হয়, 'সুদ্ধু'কে কোথাও খুঁজে পাইনা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাকি উত্তরজীবনে শুধু অর্থে 'সুদ্ধ' ব্যবহার করতেন (পৃ. ২২৭) কিন্তু শ্রী বসু তাতে একটি হ্রস্ব-উ যুক্ত করে সমস্যাটাকে একটু জটিল করে দিয়ে গেলেন কেন?
এইসব অকিঞ্চিৎকর চ্যুতি-বিচ্যুতি বাদ দিলে হীরকদ্যুতির বিচ্ছুরণের কিছু নিদর্শন তুলে ধরা যাক—বাকিটা তোলা থাক উদ্যমী পাঠকের জন্য।
(১) রবীন্দ্রনাথের গানের অবিসম্বাদিত সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখছেন গানগুলির মধ্যে একটি "আদিম অনির্বচনীয়তা" আছে, বিশ্বপ্রকৃতির বিভিন্ন ভঙ্গির মতো।
(২) মহাভারতের প্রসঙ্গ এসেছে রচনাবলীর পঞ্চম খণ্ডে পুরাণাশ্রিত রবীন্দ্ররচনার কথা বলতে গিয়ে। সেখানে fundamental detachment কে তিনি বলেছেন 'মেলি অনাসক্তি', আর মানবচরিত্রের নানান shades বোঝাতে গিয়ে সৃষ্টি করেছেন অপরূপ এক বাক্যবন্ধ, যা বাংলা সাহিত্যে অনাস্বাদিতপূর্ব: 'মানুষের মনের অসংখ্য ছায়াময় ভগ্নাংশ' যদিও দুটি ব্যবহারই অভিধান-সিদ্ধ।
(৩) নিজের নাস্তিক্যকে কি অপরূপ 'নির্বহুল নম্রতা'য় প্রকাশ করেছেন যখন লিখেছেন "আমি ভারতীয় অধ্যাত্ম-ঐতিহ্যের প্রসাদবঞ্চিত ...."
(৪) অনুবাদ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা এই বইয়ে রয়েছে, সে প্রসঙ্গে পরে আসা যেতে পারে, কিন্তু অনুবাদে মূলের স্বাদ আনা বা পাওয়া রীতিমত কঠিন—এই কথাকে কি নিটোলভাবে বসিয়েছেন " .... যা অনুবাদের অগ্নি-স্নান পর্যন্ত সহ্য করতে পারে।"
(৫) তৎসম এইসব উদাহরণ যদি কোনো পাঠকের কাছে কিঞ্চিৎ দূরবর্তী প্রতীয়মান হয়, তাহলে 'বোবা বই' বা 'বঙ্কিমের তাজ্জব গল্প' বা 'হাম্বড়া অক্ষমতা' নিশ্চয়ই তাকে চমকে দেবে। আর এই প্রসঙ্গেই আসবে ইংরিজি বিশেষণকে 'বাংলায়িত' করে নেওয়া, যেখানে শ্রেষ্ঠতম বাংলা প্রতিশব্দও প্রত্যাশিত বিরক্তি বা তিক্ততা উদ্রেক করতো না: "অক্ষমের হাতে তিনমাত্রার ছন্দ শুধু স্তিমিত নয়, অসহ্যরকম ভালগার হয়ে ওঠে।" (পৃ. ৭) ইংরেজ না হলে যে তাকে 'অনিরেংজ'ও বলা যায়, এও তো এক ঝলকে পাঠককে চমকে দিয়ে যায়!
আমরা, সাধারণ পাঠকেরা এসব পড়ি, পড়ে বুঝি, বুঝে পুলকিত হই, বিস্মিত হই এই ভেবে যে 'যে পারে সে আপনি পারে, পারে সে ফুল ফোটাতে'। অথবা অনুভব করি পুরাণোক্ত সেই অমোঘ বচন "শস্ত্রংশাস্ত্রং বীণা বাণী পুরুষবিশেষং প্রাপ্তা ভবতি যোগ্যশ্চ অযোগ্যশ্চ": যার অর্থ অস্ত্র, শাস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র বা বাণী ঠিক লোকের হাতে পড়লেই সার্থক হয়ে ওঠে। 'অগ্রন্থিত গদ্য'-র পাতায় পাতায় তার অগণিত উদাহরণ। 'পঞ্চভূত' প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে শ্রী বসু উদ্ধৃত করেছেন আশালতা সিংহকে "ফুল ফুটিয়ে তর্ক করতে এক রবীন্দ্রনাথই পারেন"। আর তারপরেই তাঁর অকপট সমর্থন "কি সমাজ, কি স্বদেশ, কি সাহিত্য যে-কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখনী ফুল ফোটায়, এ আমরা বার-বার দেখেছি।" বর্তমান গ্রন্থের পাঠকরা সেই ফুলের শোভার উপরি কিছু বোধ এবং দৃষ্টিনন্দন ফুলকিও পেয়ে যাবেন, আমার স্থির বিশ্বাস।
রবীন্দ্রপুরস্কার প্রসঙ্গে দু'জায়গায় বুদ্ধদেবের লেখনী প্রায় তরবারিতে পরিণত হয়েছে দেখতে পাচ্ছি: প্রথমটি পুরস্কার প্রদানের প্রকাশিত ইস্তাহারটি নিয়ে (পৃ. ১৪৬), দ্বিতীয়টি পুরস্কারের পদ্ধতি নিয়ে। জীবনানন্দ যে-সব অধ্যাপক বা সমালোচক-গবেষকের মাসমাহিনা হাজার টাকা জানিয়েছিলেন, তাদের আরো হাজার দেড়েক আসতো "মৃত সব কবিদের মাংস-কৃমি খুঁটি"। আর এখানেই শ্রী বসু একটি অতিপ্রয়োজনীয় বিভাজনের কথা বলেছেন কারণ নতুন সাহিত্যের সৃষ্টিশীল পথে যেসব সাহিত্যিকদের পদচারণা, তাদের উৎসাহ এবং পরিশ্রমকে পুরস্কৃত করার কোনো প্রচেষ্টাই এদেশে পরিলক্ষিত হয়নি বলে তিনি সঙ্গতভাবে ক্ষুব্ধ। অথচ পাশ্চাত্যে এই প্রথা পুরানো এবং প্রচলিত। সাহিত্যসমাজে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য এই জাতীয় পুরস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, অথচ বিদেশের এই অনুকরণীয় উদাহরণ এতদিন অবহেলিতই রয়ে গেল আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে। কারণ "নিজেদের সম্বন্ধে আমাদের শ্রদ্ধা এতই অল্প ...., যদিও বিদেশের বাহবায় সর্বদাই উচ্ছ্বসিত।" বহুব্যবহৃত সেই পংক্তিটি "বিদেশের কুকুর পূজি স্বদেশের ঠাকুর ফেলি" কেমন ছায়া ফেলে যায় না কি?
আত্মসম্মানবোধের প্রশ্নে দ্বিতীয় উল্লেখে চলে আসি (পৃ. ২২১) যেখানে 'সাময়িক প্রসঙ্গ' শীর্ষক রচনায় বুদ্ধদেব শেল হেনেছেন পুরস্কার-প্রদান বা নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়েই। যা হওয়া উচিত সসম্মান অভিনন্দন, দেশ বা সমাজের থেকে স্বতোৎসারিত শ্রদ্ধাঞ্জলি, সরকারি ইস্তাহারে তাকে টেনে নামানো হয়েছে এক উদ্ধত ভিক্ষাবৃত্তিতে, শংসাপত্রসহ আবেদনের নিগড়ে তাকে বেঁধে সাহিত্যিককে নিজেকে নিজেই অপমানের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে এই তথাকথিত স্মৃতি-পুরস্কারের শিরোপার মাধ্যমে। বুদ্ধদেব যেন রবীন্দ্রনাথেরই সেই অবিস্মরণীয় গানের তুলনারহিত পংক্তিটির বাঙ্ময় রূপ এঁকেছেন "নিজেরে করিতে গৌরবদান / নিজেরে কেবলই করি অপমান"।
হয়তো সমালোচকের এই শাণিত তরবারি সরকারি হুকুমের নিরেট পাথরে আঘাত করে ফিরে গেছে, কিন্তু সাহিত্যিক-সমালোচকের সম্মান তাতে সামান্যও ক্ষুণ্ণ হয়নি। যে লেখা আমাদের ভাবায়, আমরা সে লেখা পড়তেই তো বেশি ভালোবাসি।
রবীন্দ্রনাথের 'ছড়া'র সমালোচনা বুদ্ধদেব করেছেন মোটামুটি তিনপাতার একটি লম্বা ছড়ায় বা চটুলছন্দের কবিতায়; (পৃ. ১৪৩) এতবড় কবিতাকে ছড়া বলতে আমার কিঞ্চিৎ আপত্তি থাকলেও দৈর্ঘ্য বিষয়ে অভিধান কিন্তু আমার সন্দেহকে সমর্থন করছে না। রবীন্দ্রনাথের ছড়ায় অল্প কটি জায়গায় বাংলা শব্দের সঙ্গে ইংরিজি শব্দের সিলেব্ল্ ভেঙে মজার মিল দেখতে পাওয়া যায়, যেমন — ".... ক্রমবিকাশ থিওরি / .... জমছে কি ওরই" "নাই বেল / লাইবেল "..... লেজ গেছে মিউজিয়মে / .... আইনের নিয়মে"
বুদ্ধদেব কেমন যোগ্য সঙ্গত করেছেন 'ছড়া' কবিতায়, দেখা যাক — "... গর্জে বি.বি.সি / .... শূন্য উদীচী" "... কোথায় allegory / ... ঘটলো গলা দড়ি"
কিন্তু এসব টুকরো মজার মিল ছাপিয়ে ওঠে বুদ্ধদেবের কবিতায় ধরা-পড়া রবীন্দ্রনাথের লেখায় 'বাতাসভরে বাংলাদেশের গন্ধ' বা 'পড়ছি তোমার ছড়া / বাংলাদেশের প্রাণের গন্ধে ভরা'। সংবেদী মনের তন্ত্রীতে যে সুর বাজে, সেটা আনখশির বাংলা ও বাঙালির, যে সুরে আমরা অন্য গানও শুনেছি আরেক অলোকসামান্য প্রতিভার সৃষ্টিতে, তবে চলচ্চিত্রে —
আর বুদ্ধদেবের ছড়া বা কবিতাটি শেষ হয় এক চিরন্তনতার চিত্রে, যেখানে ঘটমান বা পুরাঘটিত অতীত/বর্তমান লোপ পেয়ে যায় স্নিগ্ধ present indefinite-এ, যখন লেখেন —
তাঁর গান নিয়ে বিশদ, এমন কি সংক্ষিপ্ত আলোচনারও অবকাশ এখানে নেই। সন ১৩৪৮ (ইং ১৯৪১)-এ তাঁর প্রয়াণের মাস দেড়েক আগে 'রবীন্দ্রনাথের গান' নামে যে আলোচনাটি 'কবিতা'য় প্রকাশিত হয়েছিল (পৃ. ১০১-১০৮, আলোচ্যগ্রন্থ), তার মূল বক্তব্য এইরকম—প্রথম শ্রেণীর প্রতিভা সর্বদাই অজস্রপ্রসবী। তাই রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘজীবন আমাদের সৌভাগ্য। তাঁর শরীর জীর্ণ হলেও মন অক্লান্ত, কারণ তিনি তাঁর শিল্প-সৃষ্টির আনন্দে চিরনিমগ্ন, ক্লান্তির প্রশ্ন সেখানে অবান্তর। তবে বুদ্ধদেবের আশঙ্কা যে সেই সৃষ্টির উৎসমুখ বোধহয় রুদ্ধপ্রায়, যদিও তাঁর গানের সামগ্রিক অবদানে, পরিমাণে ও উৎকর্ষে তিনি বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয়। বিদেশী কোনো গীতিকার বা কবির সাফল্য রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিসম্ভারের ধারেকাছেও আসে না। এর মৌলিক কারণ সম্ভবতঃ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে "বিরাট কবিপ্রতিভা ও গীতপ্রতিভা"র এক অভূতপূর্ব এবং অদ্ভুত মিলন, যা এই scale এ আর কোনো কবির ক্ষেত্রে ঘটেনি। তাঁর গানগুলি, বুদ্ধদেবের মতে, শ্রেষ্ঠ কবিতা, যা না হলে গান কখনোই কালজয়ী হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই অনেকখানি 'জায়গা' জুড়ে / নিয়ে বেঁচেছেন, লিখেছেন গানের ক্ষুদ্রপরিসরেও তিনি স্বমহিমায় বিরাজমান, কেননা "কথার স্বল্পতার ক্ষতিপূরণ করেছে সুরের বিস্তার"। তবু সুর ছাড়াও তাঁর গানগুলি এক একটি রসোত্তীর্ণ কবিতা, যা অনূদিত হয়েও আপন সৌরভ-বিস্তারে সক্ষম। ফুলের ফুটে ওঠার মতো স্বতঃস্ফূর্ততার পরাকাষ্ঠা তাঁর গান, যা ছন্দ-বৈচিত্র্যে, ধ্বনি-বিন্যাসে কখনও কখনও কারিগরি কুশলতায় "সমগ্র জিনিসটি এক ধাক্কায় একসঙ্গে হৃদয়ে এসে ঢোকে, ব্যাপারটা কী হলো, তা বোঝবার সময় পাওয়া যায়না", কিম্বা "কিছু বলেনা; কিন্তু সব বলে"। শ্রী বসুর মতে ঋতু-পর্যায়ের গানই রাবীন্দ্রিক সৌরভে সবচেয়ে বেশি সুবাসিত; ভক্তি, প্রেম, প্রকৃতি বা দেশপ্রেম জাতীয় অন্যান্য 'থিম' "উপলক্ষ্য মাত্র, লক্ষ্য নয়"। প্রবন্ধটি শেষ হচ্ছে সেই অমোঘ এবং অবিসম্বাদিত উচ্চারণে, যা মননশীল সংবেদী বাঙালির মর্মবাণী: "তাঁর গান মনে না করে আমরা দেখতে, শুনতে, ভালোবাসতে, ব্যথা পেতে পারিনা, আমাদের নিগূঢ় মনের বিরাট মহাদেশের কোথায় কী আছে হয়তো স্পষ্ট জানিনে, তবে এটা জানি যে সে-মহাদেশের মানচিত্র আগাগোড়াই তাঁর গানের রঙে রঙিন।"
"একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুইজনে"—গানের সম্পর্কে সেই নিদারুণ কবিতায় যে সত্য কবি উচ্চারণ করেছিলেন, আমার মতে চিঠিপত্র-প্রসঙ্গে এ'কথা আরও প্রকটভাবে প্রযোজ্য। যে লেখে তার ভূমিকা সবসময়ই মুখ্য, কিন্তু যে লেখায় তার ভূমিকা গৌণ হলেও নগণ্য নয়— ব্যাকরণের ব্যাখ্যাতার বিরক্তি হতেই পারে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পত্রাবলীর অধিকাংশই "প্রায় সবই যে-কোনো লোককেই লেখা হতে পারতো, একে লেখা না-হয়ে ওকে লেখা হলে খামের ওপর নাম-ঠিকানা ছাড়া তার কিছুই প্রায় বদলাতে হয় না।" (বুদ্ধদেব বসু : পৃ. ১৭৩) শ্রী বসুর মতে রবীন্দ্রনাথের চিঠির সিংহভাগই 'সরকারি চিঠি', "সবই প্রকাশিত হবার জন্যই লেখা।" তাঁর এই মত বা মন্তব্যের বিরোধিতা করা বা আংশিক আপত্তি করারও অবকাশ আছে বলে মনে করিনা। তাঁর চিঠির এই বিশিষ্ট ধর্মে সাহিত্যের বা পাঠকের ক্ষতি হয়নি, বরং দুইই সমৃদ্ধতর হয়েছে, কারণ উপমায়, অলংকারে, কবিত্বে, কৌতুকে, রূপকল্পে, সজীব ভাববিনিময়ে তারা বাংলাভাষার অতুলনীয় সম্পদে সঞ্চিত হয়ে রয়ে গেছে। তবু, এখানে যেন একটা মনখারাপ করা কিন্তু-র কাঁটা এসে যায়। 'সরকারি' না হয়ে যে চিঠিগুলি সত্যিকারের 'ব্যক্তিগত' চিঠি, যেখানে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজয়ী মহাকবি নন, যেখানে তিনি একজন বাঙালি ভদ্রলোক, নিপাট গৃহস্থ, পত্নীপ্রেমিক, উদ্বিগ্ন পিতা, কর্তব্যপরায়ণ ও বিবেকবান একজন নাগরিক, সেইসব চিঠির সংখ্যা নিতান্তই কম। তবু তারাই যেন "পলকেরই ঝলক দিয়ে পুলক জাগায় মনে"। সরকারি বা নৈর্ব্যক্তিক পত্রসম্ভারকে যদি সরিয়েও রাখি, ব্যক্তিগত চিঠির মধ্যেও কবি-সাহিত্যিকের মানস-পরিচয় দুর্লভ নয়। তাঁর হৃদয় যে সদাসর্বদাই সরলতার সন্ধানী, উপকরণের বাহুল্যকে যে তিনি বিড়ম্বনাই মনে করেন, প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে ও আপনজনদের না নিয়ে আসা পর্যন্ত যে তাঁর মন অস্থির বা অশান্ত, টুকরো টুকরো উক্তিতে তা এখানে-ওখানে পরিস্ফুট। বুদ্ধদেব তাঁর আলোচনায় আলো ফেলেছেন এই বৈশিষ্ট্যের ওপর। সব মিলিয়ে বিশ্বভারতীর নির্বাচনকে তিনি অভিনন্দিত করেছেন, কেননা নির্বাচিত চিঠিগুলি যথার্থই representative, যার থেকে 'আজকের' সমাজ-সংসার আশা, সাহস ও শক্তি সংগ্রহ করতে পারবে।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে স্কুলের পরীক্ষায় ভালো ফল করে যে বইটি পুরস্কার পেয়েছিলাম, সেই 'গল্পসল্পে'র সমালোচনা (পৃ. ১২০) পড়ে পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল অনেক। সত্যি কথা বলতে দোষ নেই, দশ বছর বয়সে গল্প-সল্পের রসাস্বাদন আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না; আজ সিংহাবলোকনে বুঝতে পারি যে শুধু গল্প-সল্প নয়, 'সে' বা 'খাপছাড়া'তেও 'ঠাট্টার ইঙ্গিতগুলি এমন তির্যক ছাঁদে বিচ্ছুরিত যে কোনো শিশু যে তা পড়ে হাসতে পারবে এমন সম্ভাবনা অল্পই। ...... সম্পূর্ণ রসটা বয়স্ক মনেরই উপভোগ্য।" (বু.ব) একটু অবাক হই 'সে' প্রসঙ্গে আষাঢ় ১৩৪৫-এর সমালোচনায় এই কথা লিখে আশ্বিন ১৩৪৮-এ 'গল্পসল্প' প্রসঙ্গে কীভাবে শ্রী বসু লেখেন রবীন্দ্রনাথের ছেলেমানুষি "কনিষ্ঠদের তা মোহিত করে ...." বা এই বই "শিশুরা হাতে পেয়ে আত্মহারা হবে"? বাচস্পতিমশায়ের 'বুগবুলবুলি' ভাষার অর্থহীন ঝঙ্কারকে বুদ্ধদেব জয়েসীয় সমীকরণে বিশ্লেষণ করার প্রয়াস করেছেন, যথা তিড়িং+আতঙ্ক = তিড়িতঙ্ক, বা পঞ্জর = পাঁজঞ্জুরি, কিন্তু বাচস্পতির সম্পূর্ণ শব্দসম্ভারকে ঐ বিশ্লেষণের অপারেশন টেবিলে তোলা যায়না। বরং ব্যুৎপত্তিগত সমর্থন ছাড়াও ভাষা যে দাঁড়াতে পারে, "পিঠে কিল মেরে সেটাকে কিল প্রমাণ করতে মহামহোপাধ্যায়ের দরকার হয়না", তার প্রভূত উদাহরণ এই গল্পে ছড়ানো আছে। ইংরিজি সাহিত্যের তন্নিষ্ঠ পাঠক ও অধ্যাপকের কলমে গল্পসল্পের আলোচনায় এড্ওয়র্ড লিয়র আর জেম্স্ জয়েসের রচনাশৈলীর reference রচনাটিকে এবং পাঠককুলকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করে।
এ বইয়ের যেহেতু কোনো মূল গল্প নেই, ধারাবাহিকতার কোনো প্রশ্ন এখানে উঠবে না। বিভিন্ন রবীন্দ্ররচনা নিয়ে শ্রীবসুর যে টুকরো প্রবন্ধগুলি, তাদেরি কয়েকটিকে নিয়ে এই বর্তমান পর্যালোচনার প্রয়াস। তাই অনেক কথা বলেও মনে হয় বলা হলনা আরও বেশি। সেই না-বলা বাণীর মধ্যে থেকে দুটি প্রসঙ্গের উল্লেখমাত্রা করে এই রচবার ইতি টানবার বাসনা।
'ছন্দ' গ্রন্থের আলোচনায় (পৃ. ৫) ছান্দসিক শ্রীবসু রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ছন্দের প্রয়োগ, ক্রমবিবর্তন এবং ভবিষ্যতের পথনির্দেশ করেছেন নিপুণ বৈদগ্ধ্যে। আরেকটু এগিয়ে আবার পাই (পৃ. ৫২) 'সোনার তরী' গ্রন্থে ছন্দ নিয়ে কবির পরীক্ষা-নিরীক্ষার চুলচেরা বিশ্লেষণ। চৌদ্দ (১৪) কে যে কতরকমভাবে ভাঙা যায়, ৩-৪-৪-৩ / ৩-৪-৩-৪ / ৫-৪-৫, বা ৩-৩-৩-২, অঙ্কের হিসেবে আমরা তা বুঝি, কিন্তু একের পর এক উদাহরণ সাজিয়ে ১৪, ১৩ বা ১২ মাত্রার ছন্দের প্রকারভেদ যে ভাবে শ্রীবসু বুঝিয়েছেন, তাতে ছন্দজ্ঞ না হয়ে উঠলেও ছন্দ-উপভোগে পাঠকের আনন্দ যে বৃদ্ধি পাবে এতে সন্দেহ নেই। অন্য একটি লেখা থেকে উদ্ধৃত করি "এখানে দিলুম উপভোগের অল্প আভাস, আশা করি কোনও পাঠকেরই এতে তৃপ্তি হবে না, বরং তৃষ্ণা বাড়বে সবটুকু পড়বার।"
দ্বিতীয় ও সর্বশেষ প্রসঙ্গে আসছে "বাংলা কাব্য পরিচয়"-এর সামালোচনা। রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত এই গ্রন্থটির আলোচনা সম্ভবত এই অগ্রন্থিত বুদ্ধদেবে দীর্ঘতম প্রবন্ধ। এবং যদিও "ভিন্নরুচির্হি লোকাঃ" বলে প্রাক্কথনে তিনি 'আচমন' করেছেন, কিন্তু পরবর্তী নিঃশ্বাসেই লিখেছেন "কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই স্বীকারের সীমাকে অস্বীকার করাই মনুষ্যধর্ম।" তারপরে, ন্যূনাধিক ষোলোপৃষ্ঠায় তিনি যেভাবে শাণিত লেখনীতে গ্রন্থটির সঙ্কলনের ব্যর্থতাকে প্রকট করেছেন, অন্ততঃ এই গ্রন্থে তার তুলনা মেলেনা। শুরু করেছেন প্রায় মন্ত্রসপ্তকের ধীরলয় আলাপে, যেখানে তিনি গড়ে নিচ্ছেন পরবর্তী স্তরের প্রস্তুতি: সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ ফল যে নির্ভরযোগ্য ও নিত্যগতিশীল রুচি, সেটা সর্বদাই শিক্ষণীয়, কখনোই স্বয়ম্ভূ নয়; গুরুমুখী শিক্ষায় ও নিয়মিত চর্চায় সাহিত্যে ও শিল্পে ভালো লাগবার ক্ষমতা গড়ে ওঠে। সংকলক বা সম্পাদকের ভূমিকা তাই অনেকটাই এই পথ-প্রদর্শকের মতো।
ইংরিজি সাহিত্য থেকে উদাহরণ দিয়ে শ্রীবসু বুঝিয়েছেন যে "প্রচুরতায় ও শক্তিতে বাংলা ভাষায় কবিতাই অগ্রণী" হলেও "ইংরেজি কবিতা বাংলা কবিতার চাইতে পরিমাণেও অনেক বেশি, উৎকর্ষেও অনেক উঁচুতে।" সংকলন ঐতিহাসিক (chronological) হোক, কিংবা ব্যক্তিগত, "সাহিত্যের প্রতি, কবিতার পাঠকের প্রতি, কাব্যসংগ্রহ সম্পাদকের কর্তব্য ও দায়িত্ব বহুবিধ।" আর না বিন্যাসের শৃঙ্খলায়, না নির্বাচনের গুণগত বা পরিমাণগত উৎকর্ষে এই কাব্যপরিচয় আমাদের "বুদ্ধিকে উদ্দীপ্ত কি রুচিকে বিকশিত" করে। কবি নির্বাচনে এবং নির্বাচিত কবির কবিতা চয়নে (এমন কি নিজেরও) আশাহত বুদ্ধদেব এমন সন্দেহও প্রকাশ করেছেন, যে "বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না, যে রবীন্দ্রনাথই এ বইয়ের সম্পাদক!" কিন্তু বজ্র-বিদ্যুৎসহ বৃষ্টির পর শান্ত-স্নিগ্ধ প্রকৃতির মতো তাঁর ঐকান্তিক প্রার্থনা নবতর ও সম্পূর্ণতর একটি কাব্য-সঙ্কলনের জন্য, এবং তা সেই একমেবাদ্বিতীয়ম্ রবীন্দ্রনাথের কাছেই।
মোটামুটি দেড়বছর আগে, পরবাস-৪৬ সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত গদ্য প্রথম খণ্ডের গ্রন্থ-পরিচয়ে শ্রীনিরুপম চক্রবর্তীর রচনা থেকে তিনটি বাক্য উদ্ধৃত করলে আশা করি কুম্ভীলকবৃত্তির অপরাধ ঘটবে না, বিশেষ করে দ্বিতীয় খণ্ডের বেলাতেও যখন উক্তিত্রয় সমানভাবে প্রাযোজ্য: (১) বহুদিন বাদে এমন একটি বই হাতে এলো যাতে মগ্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর রইলো না (২) বুদ্ধদেবের সমালোচনার সততা আমাদের তাই গর্বিত করে এবং (৩) পাঠকের কাছে এই বইটি উপস্থিত করে দময়ন্তী বসু সিং আমাদের কৃতজ্ঞতা অর্জন করলেন।
"দু'চারটে রং-দার ইয়ারকি করতে পারাটাই" যে সমালোচনা নয়, "গভীর শ্রদ্ধা ও আনন্দই" যে সমালোচনার উৎস, আমার ভালোবাসা এবং ভালোলাগা "অন্যের মনে সঞ্চারিত করাই" যে "সমালোচনার মহত্তম কাজ" — এই পুস্তক পর্যালোচনা করতে গিয়ে সেই চেতনাতে যেন পুনর্জন্ম হল। কোন্ এক নুনের পুতুল গিয়েছিল না, সমুদ্র মাপতে?
Published in Parabaas June, 2012 Send us your feedback
|