• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮১ | জানুয়ারি ২০২১ | গল্প
    Share
  • ঘরবাসী : তাহমিদ হোসেন


    থায় আছে মানুষ অভ্যাসের দাস। একবার যা স্বভাবে ঢুকে যায় তা একবারে নেশার মত, যেমনঃ বাসার বাইরে যাওয়া; হোক কাজে বা এমনিই। এদিকে আবার নাকি একঘেয়েমি জিনিসটা মানুষ সহ্য করতে পারে না। সম্ভবত মানুষ একঘেয়েমি থেকেই প্রথম নিজের বুদ্ধি ইস্তেমাল করা শুরু করছে, এমনকি বুদ্ধি দিয়ে পৃথিবীর সব সমস্যা সমাধা করে ফেললেও মানুষ বোধহয় এই একঘেয়েমি থেকেই আবার নতুন সমস্যা বানাবে। মহামারী শুরু হলে এই দুই আপাত-বিরোধী চরিত্রের দুইটাই একসাথে মানুষের সহ্যসীমার পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে। লকডাউনে কিছুদিন ঘরে আটকে থাকলে অভ্যাস তাও না হয় একটু পালটায়, বোরডম থেকে একদম মুক্তি নাই।

    এইরকম চূড়ান্ত বিরক্তির একটা সময় নিয়ে আমাদের এই গল্পটার সিংহভাগ দুটো রুমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। একটা ঘর ধরুন সাদা রঙের দেয়ালওয়ালা চৌকা, একপাশে বিশাল পর্দাঘেরা জানালা, আরেকপাশে বারান্দার দরজা আর তার উল্টোপাশে অন্য ঘরে যাবার দরজা। ঘরের মধ্যে একটা মোটামুটি বড় খাট। খাটের পাশে বুকসেলফ আর একটা পড়ার টেবিল। এই তিনরকম আসবাব কেবল একটা প্রধান দায়িত্ব পালন করছে; তা হল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বই আর কাগজপত্রকে ঠাঁই দেয়া। ওদিকে অন্য রুমটা হলো হালকা সবুজ দেয়ালঘেরা, দরজা-জানালা আর আসবাবের দিক থেকেও অনেকটা একইরকম, শুধু একটু কম আগোছালো। দেয়ালে কয়েকটা স্টিকম্যান আঁকা। স্টিকম্যান নাচছে।

    আমাদের গল্পের সাদা দেয়ালের ঘরে হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে একটা লম্বা, হালকাপাতলা গড়নের যুবকবয়সি ছেলে ফোন চাপছে। ঘড়ির কাঁটা এগোলেও তার বিশেষ ভাবান্তর নাই। মুখের এক্সপ্রেশনে সময়ে সময়ে হালকা হাসি ফুটে উঠলেও মোটাদাগে খুবই ভাবলেশহীন, কিছুটা বিরক্তিই বরং উঁকি দেয় অনেকদিন না কাটা দাড়ির জংগল থেকে। ঘরের ভিতর থেকে হঠাৎ নারীকন্ঠের ডাক আসে,

    “একটু দেখে যা, করোনার রিপোর্ট শুরু হইছে!” ছেলেটির বয়স বিবেচনা করে আমরা ধারণা করতে পারি তার মা তাকে ডাকে। তার মধ্যবয়েসি মায়ের কন্ঠে করোনা বুলেটিন নিয়ে একটা অদ্ভুত শিশুতোষ আগ্রহ টের পাওয়া যায়। যেন এখন নব্বই-এর দশক আর বিটিভিতে সপ্তাহান্তে দেখানো সিনেমা শুরু হয়েছে।

    ছেলেটা সম্ভবত খেয়াল করে না, নিরুত্তর থাকে। তখন তার মা এসে দাঁড়ায় ঘরের দরজায়।

    “আজকে ৪৫৮১ জন নতুন আক্রান্ত, মারা গেছে ৫১ জন।” তার মা কিছুটা উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে। তার আপাত নিস্তরঙ্গ সংসারজীবনে যেন হঠাৎ খুব বড় এক্সাইটমেন্টের কিছু হয়েছে।

    “তুমি জানো এই হিসাব ঠিক নাই মা।” গমগমে স্বরে অলস উত্তর দেয় ছেলেটা।

    “হ্যাঁ, তা তো ভুয়াই। কালকে তোমার চাচা পিজি হাসপাতাল গেছিল। সে বলছে টেস্টিং-এর জন্য মানুষের বিশাল লাইন। পুলিশ দিয়ে লাঠিচার্জ করে সামলাইছে, ঠিকমত টেস্টই হচ্ছে না।”

    “যাইহোক একান্ন জন মারা গেছে এইটা ভালোই। কালকে আটান্ন জন ছিল। যদি সংখ্যা কমায়েও বলে তাও আগেরদিনের চেয়ে কম তো।”

    “হ, তবে নিউমোনিয়ায় অনেকে মারা যাইতেছে। সরকার সবচেয়ে বেশি মরার হিসাবে গরমিল দিছে। তোর মামার কলিগ তো স্বাস্থ্য সচিব...”

    এখানে এসে ছেলেটার কানে আর কথা ঢোকে না। সত্য কি? এই যে যারা সরকারি হিসাবের বাইরে মারা যাচ্ছে প্রতিদিন তাদের আসলেই করোনা ছিল? তাহলে তাদের মৃত্যুর কারণ কখনো স্বীকৃতি পাবে না। মৃত্যুর আবার স্বীকৃতি কেন লাগবে? ছেলেটা নিতান্ত আলসেমির সাথে বিছানায় মোচড়ায়, আর তার মগজে চিন্তা মোচড়ায়।

    উফফফ! গা ঝাড়া দিয়ে আকাশকুসুম চিন্তা ফেলে নিজের চোখে কী দেখা যায় দেখতে রুমের বারান্দায় আসে ছেলেটা। থিয়েটারের পর্দা উঠলে যেমন হয় তেমন হুট করে সে আসতেই বাইরের রাস্তায় বিশাল চিল্লাপাল্লা কোলাহল শুরু হয়। জনাদশেক লোক মিলে বাসার সামনের ল্যাম্পপোস্টে একজনকে বেঁধে ফেলেছে। শুরু হয়েছে বেমক্কা মার। ছেলেটা তার ফোন বের করে ভিডিও করে ছোট্ট একটা ক্লিপ। এই মারামারি থামাতে করোনার মধ্যে বাসার নিচে নামা উচিত কিনা ভাবতে ভাবতেই পুলিশের গাড়ি চলে আসে। নামা নিয়ে আর ভাবতে হবে না দেখে ছেলেটা অজান্তে স্বস্তির ছোট শ্বাস ফেলে। আরামসে ভিডিও ক্লিপটা ফেসবুকে আপলোড করে কত দ্রুত কত রিএক্ট আসে তা নিয়ে ভাবতে না ভাবতেই হঠাৎ তার কানে একটা শব্দ আসে। পাশের রুমে তার বাবা জোরে সাউন্ড দিয়ে ওয়াজ শুনছে, “এই যে করোনা ভাইরাস হইল খোদার সৈন্য! যেসব কাফের নাফরমান আছে তাদের বিনাশের জন্য আসছে এই করোনা…” ছেলেটা দ্রুত তার রুমের দরজায় দাঁড়ায় এবং চিৎকার করে বলে,

    “বাবা, তুমি যা-ই দেখো না কেন তুমি মসজিদে যাবা না এই করোনার মধ্যে।” রুমের দরজা জোরে শব্দ করে আটকে দেয় সে।

    ওদিকে সবুজ দেয়ালের রুমের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব বিছানায় বসে থাকা একটা কোমর পর্যন্ত লম্বা চুলের মোটামুটি দীর্ঘকায়া এক মেয়েকে। তার মুখভঙ্গিমা পাথরের মত শক্ত হয়ে আছে, সম্ভবত অন্য ঘর থেকে ধারাবাহিক আসতে থাকা জঘন্য গালিগালাজের শব্দে। এব্যাপারে আপনারাও একমত হবেন একটা পুরুষ এবং একটা নারীকন্ঠের ভয়ংকর সেই চিৎকার-চেঁচামেচি গল্পে লিপিবদ্ধ করা নিষ্প্রয়োজন। যাহোক, একপর্যায়ে মেয়েটি শেষমেশ হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় আর প্রচণ্ড শব্দে তার দরজা বন্ধ করে। দরজা বন্ধের শব্দে অন্য ঘরের ঝগড়ায় ছেদ পড়ে। অন্তত তা চলতে থাকলেও আর এই ঘরে শোনা যায় না।

    মেয়েটা মোবাইল খুলে ফেসবুক স্টোরি চেক করে। একটা ভিডিও আসে; কে জানি আপলোড দিয়েছে। এক লোককে মানুষজন ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে মারছে। মেয়েটা হালকা শিউরে উঠে কমেন্ট করে,

    “আয়হায়! এনাকে মারতেছে কেন?”

    “আসলে এই লোক কাল রাতে চুরি করতে গিয়ে ধরা খাইছিল। তখন রাস্তায় বেঁধে মারছে।” টুং করে মেসেঞ্জারে উত্তর আসে।

    “তারপর কী হইছে?”

    “পুলিশ নিয়ে গেছে। লোকটার বউ আর একটা ছোট বাচ্চা আসছিল। বউ কেঁদেকেটে বলল যে করোনায় কাজকাম নাই দেখে এই অবস্থা হইছে। আর বাচ্চাটা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়ে ছিল।”

    বস্তিতে প্রতিদিন এমন হয়। নিজের সাত আট বছরের জীবনে এমনটা বহুবার দেখেছে বাচ্চাটা। এই যেমন শেষবার রইসের বউর সাথে একই ঘরে পাওয়া যায় মুন্সিকে, তারপর সে কী মার। বাচ্চাটা অতশত জানে না। ঘরের সামনে একটা ড্রেনের উপর সে মুন্সিকে উবু হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছে। কিন্তু এ তো তার বাবা।

    তাই সে বেশ জোর দিয়ে বলে, ”আমার আব্বা চোর না।”

    উপস্থিত জমায়েতের বেশ কৌতুক হয়। বাচ্চার মা এসে বাচ্চার মুখ চেপে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু বাচ্চাটা হাত ছাড়িয়ে নেয়। জমায়েতের কেউ একজন বাঁধা লোকটাকে প্রশ্ন করে,

    “তয় এই শুওরের বাচ্চা কি?”

    বাচ্চাটা এক মুহূর্ত চুপ থাকে। এরপর সে যেন আনমনে কিছুটা অবাক স্বরে উত্তর দেয়, “আমার আব্বা।”

    আমাদের সবুজ ঘরে মেয়েটা স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়ের জন্য। দুই তিন মিনিট মেসেজ সিন হয়ে থাকার পর মেয়েটা উত্তর দেয়। “কী ভয়ংকর ব্যাপার!”

    তার করুণা হয়। বুকের মধ্যে হালকা একটা ধাক্কার মত। চেহারায় ছাপ পড়ে না, যেভাবে তার করুণার জন্য ঐ লোকটা বা এমন কারও জীবনেও কোনো ছাপ পড়ে না। দুইটা রুমের মতই সব আপাত অপরিবর্তনশীল। এদিকে তাদের কথা চলতে থাকে--

    “এমনে চললে কয়েকদিন পর ক্ষুধার জ্বালায় সব মানুষ একসাথে হয়ে সবকিছু লুটেপুটে আগুন জ্বালিয়ে দিবে। একদম পুরা এনার্কি।”

    “হ্যাঁ, আমার মনে হয় কি জানেন? মানুষের জীবনে ক্যাওসের চাইতে বড় কোনো নিয়তি নাই।”

    “আমারও তাই মনে হয়। মানুষ এক্কেবারে ফ্রি মার্কেটের মত।”

    “মানে?”

    “আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় নিজেকে টিকায়ে রাখতে পারবে, কিন্তু আসলে লং রানে একদম ভেংগেচুরে যায়।”

    এখানে এবার কিছু হাসির ইমোজি আসবে। ওই রাতে আরও কিছু কথা হবে। লকডাউনের কর্মহীনতার দরুন এই কথাবার্তার মেয়াদ এসে ঠেকবে একদম নিত্যদিন চব্বিশ ঘন্টায় এবং কিছুদিন পরে তারা দুজন প্রেমে পড়বে। প্রেমের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা অসম্ভব হবে এবং শেষমেশ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দেখা করার সিদ্ধান্ত হলেও দেখা হওয়ার কিছুক্ষণ পর তাদের ঠোঁট একত্র হবে। আমরা ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে তাদের ব্যক্তিগত চিরন্তন দৃশ্যগুলো পিছনে ফেলে চলে যাব তাদের প্রথম দেখা হওয়ার দুইদিন পর।

    সাদা কামরায় ছেলেটা পায়চারি করছে। বেশ অস্থির। আজকে সারাদিনে কথা হয়নি। তার হাতে ফোনে সে একটু পরপর চেক করছে মেয়েটা অনলাইন কিনা। নাহ! অনেকক্ষণ ধরেই অনলাইনে আছে। সে মেসেজ দেয়। কিন্তু কোনো রিপ্লাই আসে না। “এই পদ্মা, কী হইছে তোমার? কোনো সমস্যা?”

    সবুজ ঘরে মেয়েটা বিছানায় শুয়ে আছে। গলা পর্যন্ত টানা কাঁথা। তার হাতে ফোন খোলা আর মুখে অস্বস্তির অভিব্যক্তি। বারবার তার স্ক্রিনে আলো জ্বলে, নিভে, জোনাকির মত। শেষমেশ সে উত্তর দেয়।

    “না।”

    “রিপ্লাই দিচ্ছ না কেন?”

    “আচ্ছা তুমি কি কিছুক্ষণ আমাকে একা থাকতে দিতে পারবে না?”

    “মানে? হ্যাঁ। কিন্তু কী হইছে? তুমি ঠিক নাই।”

    “ঠিক নাই দেখে যদি প্যারাই খাও তাহলে ঠিক থাকার মত জিনিস করতা।”

    “হইছেটা কী তোমার!”

    “আমার আজকে সকাল থেকে হুট করে অনেক ঠান্ডা জ্বর। আমি ঘুম থেকে উঠে মাকে ব্রেকফাস্টে হেল্প করতে গেছি, তখন হুট করে হাঁচি শুরু হইছে। এরপর জ্বরও।”

    “কিহ্‌! এখন কী অবস্থা তোমার? জ্বর মাপছ?”

    “চুপ করো সুমন, প্লিজ।”

    কিছুক্ষণ সিন হয়ে থাকার পর মেসেজ রিপ্লাই দেয় সুমন।

    “কিন্তু করোনাই যে এটা তো--”

    “আমার এমনিতে জ্বরসর্দি হয় না তেমন। আর করোনা যদি হয় তাহলে আমার বাসায় বাবা মা সবার মধ্যে ছড়াইছে অলরেডি।”

    “কিন্তু টেস্ট না করায়ে তো বলা যাবে না। টেস্টিং করানোর ব্যবস্থা করতে হবে। দেখি আমি আমার বন্ধু সাজিদকে একটা ফোন দেই।”

    “এবং এই ঘটনা তোমার বিশাল একটা ইরেস্পন্সিবিলিটির জন্য হইছে। আমাদের ঘরে বয়স্ক বাবা মা আছে, তারপরেও দেখা করার মত জঘন্য স্বার্থপর একটা কাজ করছি আমরা থ্যাংস টু ইউ।”

    “ওয়েট! মানে? তুমি নিজেও দেখা করতে চাইছিলা। এবং আমরা সবকিছু নিয়ে কথা বলে ডিসিসন নিছি।”

    “সিরিয়াসলি? তুমি এখন আমার সাথে ঝগড়া করবা? বিন্দুমাত্র রেস্পন্সিবিলিটি দূরে থাক, তোমার কি বিন্দুমাত্র সিম্প্যাথিও নাই?”

    কিছুক্ষণের মধ্যে দুজনেই রেগে তাদের ফোন অফ করে দেয়। এবং এর কিছুক্ষণ পরে পদ্মা নামের মেয়েটা জ্বর আর শ্বাসকষ্টে রীতিমতো অজ্ঞান হয়ে যায়। তবে তার পরিবার কীভাবে জানি পরদিনই টেস্ট করতে দেয় আর হাসপাতালে এডমিট করার ব্যবস্থাও করে ফেলে। এক্ষেত্রে ধরে নেয়া যেতে পারে পদ্মার পরিবার অর্থবিত্ত অথবা রাজনৈতিক চিনাজানা বা উভয় দিকেই মোটামুটি অগ্রগণ্য। এদিকে ঝগড়ার দিন রাত থেকেই সুমনের মা আর ছোটভাইয়েরও ভয়ংকর জ্বর আর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এক বন্ধুকে ধরে পরদিন টেস্ট করালে দেখা যায় সুমন আর তার বাবা-মা ও ছোট ভাই সবারই করোনা। কোনো দৈব উপায়ে তারা এডমিটও হয়ে যায় হাসপাতালে। সেখানে বাবা-মার অবস্থা বেশ খারাপ। ছোটভাইও ভালোই ভুগছে তবে শ্বাসকষ্ট কম। কিন্তু সুমনের তেমন কিছু নাই হালকা হাঁচি-কাশি বাদ দিলে। তাই হাসপাতালে সিট পাওয়ার পরেও সিট ছেড়ে দিতে চেয়েছিল সে। কিন্তু কুর্মিটোলা হাসপাতালের মিলিটারি ট্রেন্ড ডাক্তার তাকে চরম ধমক দিয়ে ভর্তি করে রাখে। মন্দের ভালো এই যে অন্তত পরিবারের লোকজন কাছেই আছে।

    এদিকে জ্বরের তীব্র ঘোরের মধ্যে মানুষের শব্দ টের পায় পদ্মা। শুধু শব্দগুলো এখন জলের মত নিরাকার। কোনো মানে নাই, অর্থ নাই। পদ্মার শ্বাসকষ্ট হয়। মগজে অক্সিজেন কম গেলে তার নেশাগ্রস্ত লাগে। চারপাশে অনেক আলো। সে চোখ শক্ত করে বন্ধ করে রাখতে চায়। বন্ধ চোখের ভিতর সে ফিরে যায় যখন তার বয়স বোধহয় ছয়।

    “আম্মু আম্মু, দেখো দেখো আমি কী আঁকছি!” ছোট্ট একটা মেয়ে দুই বেণীর চুল দুলাতে দুলাতে ছুটে আসে একটা সবুজ দেয়ালের ঘরে। সেখানে একটা বিছানায় শুয়ে আছে মোটামুটি সদ্য কৈশোরে পড়া ছেলে। তার হাত-পা কয়েক জায়গায় কাটা। আর এই দুই বাচ্চার মা ছেলেটার হাতে ব্যান্ডেজ লাগাচ্ছে।

    “তুই ওদের সাথে মারামারি করতে গেলি কেন?”

    “হামিম আমাকে ব্যাটিং দিচ্ছিল না!”

    “আহারে! বাবু আমার।” ছেলের গালে চুমু খায়।

    “আম্মু আম্মু, দেখো আমি কী আঁকছি!” মেয়েটা মায়ের জামা ধরে আস্তে আস্তে টান দিতে দিতে বলে।

    “আম্মু দেখো, কীসব ছাইপাশ জানি আঁকছে। অইটা কী রে? কাকের ঠ্যাং?” জোরে হাসতে হাসতে বলে ছেলেটা। বাচ্চা মেয়েটার চোখ অদ্ভুতরকম হয়ে যায়। সম্ভবত হরিণের মত। তার মা সেদিকে তাকায়ও না। মুচকি হেসে ছেলের কৌতুকে সায় দেয় শুধু।

    আকাশে দশটা হাতি উড়তেছে। পদ্মা নিশ্চিত। হাতিগুলো উড়তে উড়তে মেঘ হয়ে যাচ্ছে আর মেঘ থেকে ঝরে পড়তেছে লেবু। পদ্মা একটা বাচ্চার মত দুই হাত তুলে ছুটে যাচ্ছে আকাশ থেকে পড়া লেবু ধরতে। ধরতে গেলে লেবু হয়ে যাচ্ছে বল আর পদ্মা ক্লাস সিক্সের মেয়ে। হাত থেকে বল ছুঁড়ে দিচ্ছে সুদুরে, ব্যাট ছিদ্র হয়ে স্ট্যাম্পে ঢুকে যাচ্ছে আগুনের গোলার মত…

    “তোমার জাস্ট কোনোকিছুতে মন নাই। পড়ালেখার ধারেকাছে দেখি না সারাদিন। ঘরের একটা কাজেও বিন্দুমাত্র আসো না। সারাটাদিন আমি বসে বসে গতর খাটি। আজকাল কাজের বুয়া পর্যন্ত পাওয়া যায় না। এদিকে তোমার একটা কোনো কাজের ঠিক নাই। এটা কি পরছ?”

    “আম্মু এইটায় আরাম লাগে, বিকালে খেলতে গেলে সুবিধা হয়।”

    “চুপ। আমি বলছি না খেলা বন্ধ এখন থেকে? তুমি এখন বাচ্চা নাই, বড় মেয়ে হইছ। আর এইসব ফকিন্নি মার্কা জামাকাপড় এরপর পইরা আসলে আমারে মা ডাকবা না। “

    পদ্মার হালকা ঘোর কাটে। হাসপাতালের কেবিনে চারদিকে সে তাকায়। চশমা ছাড়া আর জ্বরে দুই চোখ ভিজে থাকায় সে সব ঝাপসা দেখে। মানুষ হলো আসলে অবয়ব। আর অবয়বে সবাই এক। আবার ওই বেডের পাশের টেবিলটাও একটা অবয়ব। সেও কি মানুষ? পদ্মার চোখ আবার বুজে আসে।

    “এই পদ্মা! এতক্ষণ বইসা তুই কী করতেছিস?”

    “ছবিটা হচ্ছে না রে। অনেক চেষ্টা করতেছি কিছু একটা করার। কিচ্ছু হয় না, কিসব বালছাল আঁ--”

    “চুপ কর পদ্মা। একদম চুপ। তুই অসম্ভব ভালো আঁকিস। একটা আঁকা যতই ভালো হোক, এক্সিবিশনে যাক, তাও তোর মুখে কক্ষনো ভালো কিছু শুনলাম না। থাক তুই তোর ঢং নিয়ে।”

    পদ্মার বান্ধবী তানহা চোখের সামনে থেকে সরে যেতেই সেখানে সুমন আসে। সুমনের হাসিতে একটা খুব কৌতূহলোদ্দীপক কিছু একটা আছে। ছোটবেলায় গ্রামে ঘুরতে গেলে যেদিকে যাওয়া যেত না মেয়ে হওয়ার কারণে, সেই বাঁশঝাড়ের মত একটা কৌতূহল। সুমন তাকে বলে,

    “চলো সব ভাঙি। নিয়ম, নিষেধ…”

    পদ্মা ভেঙ্গে পড়ে সুমনের শরীরের উপর। তার ঠোঁট চুমু খায় সুমনের ঠোঁটে। পদ্মা আবিষ্কার করে জীবনে সে প্রথমবারের মত এত্ত আনন্দিত। না, খুশি জীবনে সে আরও হয়েছে। কিন্তু এখন সে প্রথমবারের মত সম্পূর্ণ অসচেতন। কারণ চুমুর কোনো নিয়ম নাই, চিন্তা নাই। আস্থা আছে, আদর আছে আর ভালোবাসা আছে। সব শুধু আছে। সব শুধু মিশে যাচ্ছে, গলে যাচ্ছে অবিরত।

    ওদিকে সুমন বিছানায় শুয়ে আস্তে আস্তে হালকা জ্বরবোধ করে। এইরকম জ্বর আরামই লাগে। সে চোখ বন্ধ করে পুরানো দিনের কথা ভাবে। বোধহয় ছোটবেলার কথা ভাবলে--একটু আগে মার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে--এই নিয়ে চিন্তাটা মাথা থেকে নামবে। পদ্মাকে নিয়ে প্রচণ্ড অপরাধবোধও হয়ত কমবে একটু।

    তখন তার মনে পড়ে সাদা দেয়ালের তাদের এপার্টমেন্ট বাসা। সে বাসার দরজা দিয়ে লুকিয়ে বের হতে যাবে এমন সময় মা এসে হাজির। আতংকে সিঁটিয়ে উঠল স্কুলপড়ুয়া সুমন। যদি মা আজকে হুট করে আটকে দেয় এই ভয়েই সে লুকিয়ে বের হচ্ছিল। অন্যদিন খেলতে না গেলে কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু আজকে পাশের স্কুলের গুন্ডামত কয়েকটা ছেলে আসবে সোহেল-রাব্বীদের সাথে দেখা করতে। সোহেল বলেছে সবাইকে থাকতে। ওই সব ছেলেপিলে বয়সেও ঢের বড়। মারামারি লাগলে অন্তত সংখ্যায় ওদের চেয়ে ভারী হওয়া দরকার। এজন্য তাকে যেতেই হবে।

    “কই যাও সুমন?”

    “আম্মু খেলতে যাই।”

    “এভাবে লুকাইয়া লুকাইয়া ক্যান?” আম্মু শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকে বিদ্ধ করে।

    “না মানে…”

    “কার কাছে যাও?”

    “সোহেল, রাব্বী, অনিক…”

    “তোমরা মারামারি করবা।”

    “আম্মু, আমি কক্ষনো অন্যায় কিছু করি না।”

    “ইশ বড় বড় কথা শিখছে! ন্যায়, অন্যায়ের বুঝিস কী তুই! এক্ষুনি রুমে যা।”

    পরদিন খেলতে গিয়ে সুমন আবিষ্কার করে সোহেল রাব্বী অনিক সবাই মোটামুটি ক্ষতবিক্ষত। তারা জামাকাপড় সরিয়ে নিজেদের হাত পায়ের ছোলা-কাটা জায়গা দেখায়। অনিকের তো হাত গলার সাথে ব্যান্ডেজে ঝুলানো। কেমনে তারা অল্পের জন্য মার খেয়ে গেছে আর মারের সময় কে কী করছিলো তা নিয়ে সে এক বিশাল হাসাহাসি চিল্লাপাল্লা। এদিকে ছেলেপেলেগুলো ব্যথায় ঠিকমত নড়তে পারছে না। ওদিকে সুমন কিন্তু একদম সুস্থ। তার মনে আনন্দ নাই কেন?

    তীব্র জ্বরে সুমনের মনে হয় তার শরীর গরম আগ্নেয়গিরির লাভার উপর বিছিয়ে রাখা। তার শ্বাসকষ্ট হয়। পানিতে ডুবে যাবার মত তড়পায়। তখন হঠাৎ সে দেখে তার বিছানার পাশে সেই বাচ্চাকালের সোহেল, রাব্বী, অনিক। অন্যপাশে পদ্মা দাঁড়িয়ে আছে। সুমনে আনন্দে হাসতে থাকে। শ্বাসকষ্টে তার হাসি বিকৃত হয়ে যায়। কথাবলার সর্বশেষ শক্তি দিয়ে সে বেশ জোরেই বলে উঠে, “এবার আমি তোমাদের কাছে যাব।” অন্য কেউ এই কথা শুনতে পায় কিনা জানা নেই আমার। তবে শুনলেও জ্বরের প্রলাপের বেশি কিছু ভাবার অবশ্যই কারণ নেই।

    এই যা! গল্পের শুরুতে একটা সবুজ আর একটা সাদা দেয়ালের ঘর নিয়েই গল্প করার যে ওয়াদা করেছিলাম, শেষে এসে তার বেশ কিছুটা বরখেলাপ হয়েছে। এমনিতেই ঘরদুটো বহুদিন তাদের বাসিন্দার অভাবে অনাদরে পড়ে আছে। তার উপর বেশিক্ষণ তাদের গল্পের বাইরে রাখার দরুন তাদের মনোপীড়ার দায় নিয়ে এখানেই শেষ করছি। আপনারাও মার্জনা করবেন।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments