• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮০ | অক্টোবর ২০২০ | গল্প
    Share
  • বিবিৎসা : স্বরূপ মণ্ডল


    কাল সাতটা। বৈঠকখানায় চায়ের কাপ হাতে সবে খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছেন সুজন মল্লিক। চোখ কচলাতে কচলাতে চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়াল নুলা, সুজনবাবুর মেয়ে। সবে চারে পা দিয়েছে। কিছু কঠিন শব্দ ছাড়া প্রায় সবই বলতে শিখেছে। ওর আধো আধো কথাগুলো কানের ভিতর দিয়ে গিয়ে মরমে পশে। বড় ভাল লাগে! “কী হয়েছে?” জিগ্যেস করতেই মুখ গুঁজে দিল কোলে। মায়ের উপর রাগ হলে এমনটাই করে ও। ঊষাদেবীকেও দোষ দেওয়া যায় না। কাজের সময় মেয়ের উদ্ভট সব প্রশ্ন মাথা গরম করে দেয়। মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, “চলো, আমরা বেড়াতে যাবো।” মুহূর্তে হাসি ফুটলো মেয়ের, বললো, “বাবা, পুকুরপাড়ে নিয়ে যাবে?” এই কর্মহীন জীবনে এটুকু করতে পারলেও সংসারের কাজে সুবিধা হয়, বললেন, “তাই চলো।”

    বাড়ির অনতিদূরেই ঘোষালদের পুকুর। ছোট্ট জলাশয়। পুকুরভর্তি শালঞ্চ। চারধারে জংলী ডুমুর আর ভ্যারেণ্ডার বাদাড়। মেয়েকে নিয়ে পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়ালেন সুজনবাবু। মেঘগুলো ভেসে ভেসে হিমালয়ের দিকে এগোচ্ছে। দু’ এক দিনের মধ্যেই বৃষ্টি হবে। মুশলধারে! লাল-খয়েরী ফড়িংগুলো ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশময়। মাকড়সাগুলো খেলা করছে জলের ওপর। একমনে দেখছিল নুলা। খলাৎ করে জল নড়ে উঠতেই বললো, “ওটা কি মাছ?”

    মাছটা ছোট বলেই মনে হলো সুজনবাবুর; বললেন, “পোনামাছ।”

    বাজার থেকে রুই, কাতলা, শাল, শোল, পুঁটি, কই, শিঙি এসবই আনতে দেখেছে বাবাকে। ভাবলো, এ নিশ্চয় অন্য মাছ হবে। “পোনামাছ কেমন দেখতে, বাবা?” মেয়ের কৌতূহলী চোখের দিকে চেয়ে একটু ইতস্তত করে বললেন, “সব বাচ্চা মাছেদের পোনামাছ বলে।” কিছুক্ষণ চুপ থেকে নুলা আবার জিগ্যেস করলো, “ওরা জলে থাকে কেন?”

    ঠিকই তো! এটা তো ভেবে দেখেন নি তিনি। মাছ বলেই জলে থাকতে হবে? মেয়ে এই বয়সেই ওর বাবাকে চিনেছে। সুজনবাবুকে ভাবতে দেখে, ডান হাতের তর্জনীটা টান মেরে বললো, “বাড়ি যাবো।”

    সুজনবাবু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “সেই ভালো!”

    বাড়ি ফিরতেই এক ছুট্টে মায়ের কোলে গিয়ে ঢুকলো নুলা। ঊষাদেবীও চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে লাগলেন ওর গাল। মনটা কেমন করে উঠলো সুজনবাবুর। বোধহয় কিছু একটা মনে পড়লো। খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে উপরের ঘরে এলেন। কাল কঠোপনিষদের দ্বিতীয় বল্লী শেষ করেছিলেন। আজ তৃতীয় বল্লীতে মনোনিবেশ করলেন। উপনিষদ পড়তে পড়তে সেই একটা শ্লোকই বারবার কানে বেজে ওঠে সুজনবাবুর--

    “ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
    তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ ধনম্।।”
    ।। দুই ।।

    উঠোনের একপাশে কতকগুলো ঘুটীং কুড়িয়ে খেলা খেলছিল নুলা। এখনো তার স্কুলিং শুরু হয় নি। বর্তমানের এই ইঁদুর-দৌড়ে মেয়েকে সামিল হতে দিতে চান না সুজনবাবু। ঊষাদেবী অবশ্য বারকয়েক বলেছেন সুজনবাবুকে। বাড়িতে থেকে বেয়াদপ হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। তার চেয়ে স্কুলে দিলে পড়াশোনা না হোক অন্তত তরিবৎটাও তো শিখবে! কিন্তু সুজনবাবু গোঁ ধরে বসে রয়েছেন। তাঁর মতে এখন মেয়ের বাড়িতে থাকারই সময়।

    সকালের বাসি কাজ সেরে জলখাবার বানিয়ে মেয়েকে ডাক দিলেন ঊষাদেবী। তৎক্ষণাৎ উত্তর এলো, “আমি খাবো না।” আজকাল ছেলেমেয়েদের এই এক কথা। ভাত, রুটি, সুজি, সাগো সবেতেই অরুচি। রুচি কেবল মশলাদার মোড়কবন্দী খাবারে। মেয়ের কাছে গিয়ে বললেন, “খেয়ে নাও, নইলে বড় হতে পারবে না যে!” আপন মনেই খেলছিল নুলা, খেলা থামিয়ে বললো, “মা, বড় না হলে কী হবে?” অপ্রত্যাশিত এই প্রশ্নের উত্তরে ঠিক কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না ঊষাদেবী, একটু ভেবে বললেন, “বড় না হলে ইস্কুলে যাবে কি করে?”

    “মা, ইস্কুলে না গেলে কী হয়?” কৌতূহল যেন বেড়ে গেল মেয়ের।

    মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে বললেন, “স্কুলে না গেলে তুমি যে কিছুই শিখতে পারবে না। সবাই তোমায় মুখ্যু বলবে!”

    “মা, তুমি মুখ্যু?” প্রশ্নটা শেলের মতো বিঁধলো বুকে। ঢোক গিলে উপরের ঘরের জানলার দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বললেন, “আমি তো মুখ্যুই মা, নইলে কি আর তোমার বাবার মতো নিষ্কম্মাটি জোটে আমার কপালে! এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও দেখি? আর জ্বালিয়ো না।” নুলা মায়ের কথার বিন্দু বিসর্গ বুঝতে পারলো না, শুধু মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।

    বাড়ির অমতেই বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পর ক্রমে বুঝতে পেরেছেন সুজনবাবুর মতো মানুষেরা আসলে মরীচিকা। ধরাও দেয় না, ছোঁয়াও যায় না, শুধু দেখা যায়। সেটাও আবার দৃষ্টিভ্রম!

    ।। তিন ।।

    কিছুক্ষণ আগেই সূর্য অস্ত গেল সেপাইদিঘির ওপারে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। আবছা আলোয় দু’ চারটে ফোঁটা ফোঁটা আলোকবিন্দু নজর হচ্ছে আকাশের গায়ে। কোনটা জ্বলজ্বল করছে আবার কোনটা মিটমিট করছে। রোজকার মতো আজও মেয়েকে নিয়ে সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছিলেন সুজনবাবু।

    “বাবা, ওগুলো তারা?” আকাশের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললো নুলা।

    সুজনবাবু একবার আকাশের দিকে চেয়ে অন্যমনস্কভাবেই বললেন, “হ্যাঁ।”

    “ওরা কী করছে?”

    “আলো দিচ্ছে।”

    “ওরা আলো দিচ্ছে কেন, বাবা?” সহজ একটা প্রশ্ন। অথচ উত্তর মিলছে না। কী বলবেন এখন? আলো থাকলেই কী দিতে হবে? টোকা মারতেই কিন্তু কিন্তু করে বললেন, “ওদের আলো আছে, তাই দিচ্ছে।”

    মেঠো পথ ছেড়ে পাকা রাস্তায় উঠলেন। বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো নুলা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সুজনবাবু।

    ।। চার ।।

    দোতলায় লাইব্রেরি কাম পড়াশোনার ঘর। দিনের বেশির ভাগ সময়টা ওখানেই কাটান সুজনবাবু। পৈতৃক বাড়ি, কিছু জমানো টাকার সুদ আর লেখালেখি করে যা দু-চার পয়সা রোজগার হয় তাতেই চলে যায় কোনোরকমে। ‘গল্পকথা’ কাব্যগ্রন্থের আঠারো নম্বর কবিতায় সবে হাত দিয়েছেন। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ার মতো ঘরে ঢুকলো নুলা। সুজনবাবুর মনের মধ্যে আসা শব্দগুলো এলোমেলো করে দিয়ে জিগ্যেস করলো, “সাত সাগর, তেরো নদী কোথায়, বাবা?” গতকাল রাতে ঠাকুমার কাছে গল্প শুনেছে। যে সব প্রশ্ন ওর মনে জেগেছিল, সেগুলো ভোলে নি এখনও। সুজনবাবু কলমটা খাতার উপর নামিয়ে রেখে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ও সব গল্পেই থাকে, নুলা।”

    “গল্প কী, বাবা?”

    মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, “গল্প হলো মনগড়া সত্যি কথা।”

    এমন সময় খঞ্জনি বাজিয়ে একজন ভিখারি এলো সদরে। কোল থেকে নেমে দৌড়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো নুলা। খঞ্জনির সাথে হরে-কৃষ্ণের সুর ওর খুব প্রিয়। মাকে একটা বাটিতে করে চাল আর আলু দিতে দেখে জিগ্যেস করলো, “বাবা, ও কে গো?”

    ভিখারি বলাটা উচিত হবে না ভেবে সুজনবাবু বললেন, “উনিও একজন দাদু হন তোমার।”

    ভিখারিটা ভিক্ষা নিয়ে গলি রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে গিয়েই মিলিয়ে গেল। নুলা চট করে নিচে নেমে গিয়ে মাকে বললো, “দাদু, কোথায় গেল?”

    ঊষাদেবী মেয়ের প্রশ্নে আমল না দিয়ে বললেন, “জানি না, খাবে এসো।”

    ।। পাঁচ ।।

    বেলা তিনটে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে ঝিমোচ্ছিলেন সুজনবাবু। নুলা এল। অন্যদিন এ সময় ঘুমায় ও। আজ ঘুম আসে নি। বাবাকে ঘুমোতে দেখে পায়ের কাছে বসে ঘুটীং খেলতে শুরু করলো। চোখ মেললেন সুজনবাবু। স্মিত হাসলেন। বাচ্চাদের আপন মনে খেলতে দেখলে ভারি ভাল লাগে তাঁর! কিছুক্ষণ একভাবে চেয়ে রইলেন তারপর জিগ্যেস করলেন, “তোমার মা কী করছে, নুলা?”

    খেলাতে মগ্ন ছিল। সুজনবাবুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, “মা টিভি দেখছে। বললো, বাবার কাছে যাও। আচ্ছা, তুমি আমার বাবা?”

    সুজনবাবু হেসে বললেন, “হ্যাঁ।”

    “তুমি আমার বাবা কেন?”

    এও কি এক প্রশ্ন হল! বললেন, “আমি তোমাকে জন্ম দিয়েছি তো, তাই।” পরক্ষণেই ভাবতে শুরু করলেন, সত্যিই কি তিনি জন্ম দিয়েছেন, নাকি সেই সর্বশক্তিমান যিনি সবার অলক্ষ্যে থেকে সমস্ত কিছু সৃষ্টি আর ধ্বংস করে চলেছেন?

    “মা যে বলে, মা আমাকে জন্ম দিয়েছে,” অভিযোগের সুরে বললো নুলা।

    মেয়ের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন সুজনবাবু। শেষে বললেন, “তোমার মা ঠিকই বলে নুলা, আসলে আমরা দুজনেই জন্ম দিয়েছি তোমায়।”

    কি একটা ভেবে আবার জিগ্যেস করলো, “জন্ম হয় কেন, বাবা?”

    মুহূর্তে সুজনবাবুর ভাবনার অন্ধকার আকাশ আলোকিত করে বিদ্যুৎ খেলে গেল। সত্যিই তো! কেন জন্ম? কেন মৃত্যু? কেন সৃষ্টি? কেন ধ্বংস? কেন শুরু? কেনই বা শেষ? এই ‘কেন’গুলোই ঘুরপাক খেতে লাগলো মাথার মধ্যে। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলেন, তারপর বললেন, “নুলা, আমি জানি না মা, তবে জানতে পারলে নিশ্চয় বলবো তোমায়, এখন যাও।” এই বয়সেই মেয়ের বিশ্বাস অর্জন করেছেন তিনি। নুলা জানে, বাবা জানতে পারলে নিশ্চয় বলবে ওকে। তাই শান্তভাবে চলে গেল। কিন্তু সুজনবাবুর ঘোর কাটলো না। এক বিরাট গহ্বর! বনবন করে ঘুরছে সবকিছু। আরও তলিয়ে যেতে লাগলেন ঘূর্ণিতে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments