• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | প্রবন্ধ
    Share
  • জয় তব বিচিত্র আনন্দ : রত্না চ্যাটার্জী


    বনীতা দেবসেন চলে যাবার পর থেকে আমরা ওনার সম্পর্কে নানা লেখা পড়ছি। জীবনীমূলক, স্মৃতিচারণ, কবিতা--বেশ কিছু রচনা মনকে ভীষণভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার মধ্যেও ওনাকে নিয়ে ভিড় করে আসা নানা কথার ঘনঘটা। কিন্তু এতদিন সেসবের কিছুই উচ্চারণ করতে পারিনি, একদম চুপ থেকেছি। মনে হয়েছে, প্রকাশিত স্মৃতিকথাদলের অনেকগুলোই এত উঁচুমানের যে আমার লেখা একেবারেই পানসে ঠেকতে পারে। তথ্য বা ভাষা কোনোটাই আমার দখলে তেমনভাবে নেই যা ওনার বিষয়ে অতিরিক্ত কোনো মাত্রা সংযোজন করার সম্ভাবনায় পূর্ণ। তাছাড়া মন এতটাই খারাপ হয়ে থেকেছে যে এ নিয়ে ভাব আর ভাষা সুবিন্যস্তভাবে সাজিয়েগুছিয়ে পরিবেশনযোগ্য করে কিছু বলতে খুব একটা ইচ্ছেও করেনি। ওনার সম্পর্কে নানা বিষয় মনে ছেয়ে থেকেছে। খানিকটা স্বাভাবিকভাবেই একটা বিষণ্ণ নীরবতা গ্রাস করেছিল আর সেটাকে প্রশ্রয়ও দিয়েছি। তবে সেই প্রাথমিক আঘাতের ব্যথা আবারও প্রাকৃতিক নিয়মেই এখন সামান্য ফিকে।

    এইবেলা একটা কথা বলার জন্য খুবই তাড়িত বোধ করছি। বিষয়টি মৌলিক কিছু নয়, সর্বজনবিদিত। ওনার সম্পর্কে নতুন কোনো দিগন্ত হয়ত উন্মোচিত করবে না। তবু নিজের ভেতর থেকে আরও জোরালোভাবে অনুভূত ভাবনাটি প্রকাশ করে তার মাধ্যমে ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার্ঘ্যটুকু নিবেদন করা একটা দায়িত্ব বলে মনে করছি। পূজনীয়র নামগান করা ভক্তের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

    আমরা অনেকেই অতি ছাপোষা, উল্লেখযোগ্য কোনো গুণ অর্জন করতে পারিনি। অভিনেতা, গায়ক, শিল্পী, খেলোয়াড়, কবি-লেখক কিছুই আমরা নই। এঁরা আমাদের কাছে দূর গগনের নীহারিকা। এঁদের জীবনের সত্য-অসত্য অনেক খবর আমরা খুব উৎসাহের সাথে সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করি। এঁদের ঘিরে আমাদের নানা আলো-আঁধারির কল্পনা আর মায়া-কাজল বুলানো মুগ্ধতা। নবনীতা দেবসেনও সেরকমই এক অতি উজ্জ্বল নক্ষত্র। আমরা তাঁর 'ভালো-বাসা'-র কথা পড়ে পড়ে হদ্দ হয়ে গেছি; ব্যক্তিগত মালিকানাধীন আর কোনো বসতবাড়ির নাম বোধহয় বাঙালির সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন আগেই এভাবে কিংবদন্তীর পর্যায়ে চলে যায়নি। ও বাড়ির বিভিন্ন সময়ের বাসিন্দা 'গুনিয়া ভাই’ বা 'কানাই' অথবা 'শিবু' আমাদের অপরিচিত নয়। আমরা শুধু অন্তরা, নন্দনাকেই চিনি না। পিকো, টুম্পাও আমাদের খুব চেনা, হয়তো একটু বেশিই।

    ওদের বাড়িতে ঘরগুলির বিন্যাস বা গ্যারেজটির ছাদে 'খুকু’-র ছেলেবেলার ভাঙা সাইকেলটিও আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই। তাঁর ছেলেবেলার দুধ খাবার যে রূপোর গেলাসটি মায়ের দেরাজে সযত্নে রক্ষিত, সেটিও আমাদের চোখ এড়াতে পারেনি। বাড়ির বাগানের দুটো নিষ্ফলা পেঁপে গাছ আর বজ্রাঘাতে উর্ধ্বাঙ্গ ঝলসে যাওয়া নারকোলগাছগুলোও ওই তো এখনো দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবেশী গৃহগুলি, যেমন কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর 'ইলাবাস' বা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের 'সুধর্মা' (যেখানে এখন 'ফ্যাব ইণ্ডিয়া’র অভিজাত শো-রুম) অথবা জ্যোতি বসুর আবাসস্থলটিও আমাদের চোখে স্পষ্ট। কিন্তু থিওরিতে যতই জোরালো হই না কেন, প্র‍্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতার তীব্র ইচ্ছে থাকলেও সে গৃহে প্রবেশের সাহসের ছাড়পত্র নিজেদের সাধারণত্বে নিশ্চিত আর সংকুচিত আমাদের নেই। আমরা 'সই’-এর কথা শুনেছি সইমেলা-বইমেলা অনুষ্ঠিত হবার তারিখ, নির্ঘন্ট ইত্যাদিও আমাদের জানার পরিধিতেই। কিন্তু সে সংস্থার হেডসই দিদির স্নেহধন্য সদস্য হবার যোগ্যতা আমাদের নেই।

    তিনি রবীন্দ্রনাথের থেকে নিজের নামকরণ লাভ করেন, হার্ভার্ড-কেমব্রিজ-অক্সফোর্ডে পড়াশোনা আর গবেষণা করেন,গাদাখানেক দেশী-বিদেশী ভাষা প্রায় মাতৃভাষার মতো জানেন, বিশ্বময় আমন্ত্রিত হয়ে কবি-সম্মেলনে স্বরচিত কবিতা পড়েন, পৃথিবীজোড়া তাঁর অগণিত বন্ধুর (যাঁদের মধ্যে প্রচুর বিদেশী) বাড়িতে আন্তরিক আতিথ্য পান, হরেক জাতীয় আর আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঝুলিতে ভরেন এবং পাশের পাড়ায় যাবার থেকেও বেশিবার বিশ্বভ্রমণ করেন। তাঁর অনেক বন্ধু বা পরিচিত মানুষ তো বটেই, পরিবারেরও প্রায় সবাই সেলেব্রিটি। এক উজ্জ্বল আলোকবলয়ের অভ্যন্তরের বাসিন্দা নবনীতার ক্যারিশমা বিপুল। আমাদের মতো একেবারেই নন-এনটিটি যাঁরা, তাঁদের কাছ থেকে স্বাভাবিকভাবেই তিনি বহু যোজন দূরে। তাঁর শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক অবস্থান আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও--তা সত্ত্বেও, আমরা আজ নিজের জন চলে যাবার অনুভূতিতে ভীষণভাবে কষ্ট পাচ্ছি। তিনি যে খুব অপরিণত বয়সে গেছেন তাও তো নয়। আর যথেষ্ট কাজ করে রেখেই গেছেন। তবু ওনার প্রয়াণে আমাদের বুকভরা কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসছে।

    তাঁর আত্মীয়, বন্ধু, পরিজনই শুধু নয়, অনেক দূরের অতি সাধারণ, অপরিচিত আমরাও যে স্বজনবিয়োগের ব্যথা অনুভব করছি এ তো নিখাদ সত্য। এ কি আমরা সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেনের লেখার একান্ত অনুরাগী পাঠক বলে? তাঁর রেখে যাওয়া সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা আর পরাণপ্রিয় কলমটি থেমে যাবার অভাব বোধে? অবশ্যই তাই। কিন্তু এটাই সব নয়। অন্য আরেকটি গভীর কারণও আছে। সেটিই আমার আজকের আলোচ্য পয়েন্ট।

    ব্যাপারটা হল অতি উৎকৃষ্ট গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ভ্রমণকাহিনী, রূপকথা, অনুবাদ সাহিত্য এবং রম্যরচনার লেখিকাকে তাঁর সাহিত্যকীর্তি ছাড়া মানুষ হিসেবেও আমরা খুব ভালোবেসে ফেলেছি। ওনার সাহিত্যিক সত্ত্বা শুধু নয়, ওনার নিজের জীবন ওনাকে আমাদের কাছে আরও প্রিয়, আরও শ্রদ্ধার মানুষ করে তুলেছে। অনেক কবি-লেখক-শিল্পীর চলে যাওয়াতেই আমাদের মন খারাপ হয়। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই সেটা শুধুমাত্র তাঁদের কাজের জন্য... এককথায়, জনতার আসরে প্রকাশিত তাঁদের প্রতিভার কারণেই তাঁদের জন্য আমাদের মনে শ্রদ্ধা-সম্মানের আসন। ব্যক্তিমানুষটি যে সবসময় আমাদের মন জয় করে নিয়ে থাকেন তা নয়। কিন্তু নবনীতা দেবসেনের ক্ষেত্রে তাঁর নিজের সৃষ্টিকর্ম ছাড়াও আমাদের ভালবাসা আদায় করে নিয়েছে তাঁর বাস্তব জীবন। ওনার পাণ্ডিত্য, শক্তি, সাহস, কর্তব্যবোধ, স্বাবলম্বন, রোমান্টিকতা, ভ্রমণ উন্মাদনা, রসবোধ, সংবেদনশীলতা, কর্মমুখীনতা, মানবতাবোধ এবং আন্তর্জাতিক অথচ আদ্যন্ত বাঙালি সত্ত্বা--ওনার ব্যক্তিত্বকে এত গ্রহণযোগ্য, এত আদরণীয় করেছে। 'নবনীতা দেবসেনের লেখা আমার খুব প্রিয় কিন্তু মানুষটা একদমই ভাল নয়', -- এমন কথা বলার বা শোনার অভিজ্ঞতা আমাদের একেবারেই নেই।

    শারীরিক আর মানসিক চরম বিপর্যয়কে জয় করে, উনি সারা জীবন ধরে যেভাবে সদর্থক আর আনন্দময় জার্নি করেছেন এবং সাফল্যের মুকুট মাথায় পরেছেন, তার দৃষ্টান্ত একেবারেই সুলভ নয়। তিনি এক চূড়ান্ত জীবনরসিক; তাঁর শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দুতে জীবনবোধ নিরন্তর প্রবহমান। তাঁরা জয়যাত্রা অনেক মানুষের পুনরুজ্জীবনের পাঠ হতে পারে। সন্দেহাতীতভাবে উনি একজন 'রোল মডেল'... প্রগাঢ় না-পাওয়া নিয়ে অনুযোগ-অভিযোগ না করে, অবিশ্বাস্যরকমের সাহসী লড়াই করে, আনন্দে ভরে থেকে এবং ভরিয়ে রেখে, জীবনকে উদযাপন করে সফল মানুষ হয়ে ওঠার মডেল। নিজের কীর্তি এবং জীবনচর্যা, দুটিকেই সম্মান-ভালোবাসার যোগ্য করে তুলতে অনেক প্রতিভাবান মানুষই পারেন না। নবনীতা সেটা পেরেছেন আর এখানেই তিনি বাজিমাত করেছেন। সক্কলের বুকের ভিতরটিতে একদম পাকাপাকি ঠাঁই করে নিয়েছেন। এ এক দুর্লভ অর্জন!

    আবার বলি, এ লেখায় নবনীতা দেবসেন সম্পর্কে নতুন কিছু একেবারেই বলা নেই। তাঁর রচনার প্রশস্তিমূলক কোনো তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ, ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকায় সেই সংক্রান্ত মূল্যবান অভিজ্ঞতা শেয়ার করা--স্মৃতিকথার স্বাভাবিক এবং আকর্ষণীয় উপাদানগুলির কিছুই এতে নেই। কিন্তু একটি সুদূরের তারকার আমাদের আত্মার আত্মীয় হয়ে যাবার কথা আবারও বলতে চেয়েছি। যে শিল্পী তাঁর কাজ এবং বাঁচা, সব দিক দিয়েই আমাদের আনন্দিত-সমৃ্দ্ধ করে গেছেন, তাঁকে আবারও কুর্নিশ জানাতে চেয়েছি। নবনীতা একেবারেই অনন্যা। আমরা সৌভাগ্যবান যে তাঁর মতো সাহিত্যিক এবং মানুষকে ছোটো থেকে বড় এবং আমাদের বার্ধক্যের সকাল পর্যন্ত পেয়েছি। অক্লান্ত, উৎসাহী আমরা আরও পেতে চেয়েছি। কিন্তু প্রকৃতির কাছে নতজানু হয়ে এ প্রস্থান মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের হাতে আর কিছু নেই। সৃষ্টির অনিবার্য নিয়মেই তিনি চলে গেছেন। তবে তাঁর মানবজন্ম যে সার্থক, চূড়ান্তভাবে সার্থক, তা বলাইবাহুল্য।

    "...ভরা অশেষের ধনে।”



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ রাজীব চক্রবর্তী
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments