নিপাতনে সিদ্ধঃ অর্ধশতকের অন্য ইতিহাস— অনিল আচার্য; প্রথম প্রকাশ: ২০১৬; অনুষ্টুপ, কলকাতা; ISBN: 978-93-82425-60-1
সম্প্রতি একটি ভিন্ন স্বাদের বই পড়ার সুযোগ হল। কেন জানি না বইটি পড়তে পড়তেই এই বইটির বিষয়ে কিছু লিখবার কথা মনে হয়েছিল। অনেকগুলো গদ্য রচনা নিয়ে এই বই। বইটির নাম ‘নিপাতনে সিদ্ধঃ অর্ধশতকের অন্য ইতিহাস’। প্রকাশিত হয়েছে ২০১৬ সালে। প্রকাশক -- ‘অনুষ্টুপ’। বইটি লিখেছেন অনিল আচার্য। লেখক সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। অনিল আচার্য বাংলা সাহিত্যের একটি অসাধারণ পত্রিকা ‘অনুষ্টুপ’-এর সম্পাদক। যে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে/হচ্ছে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অম্লান দত্ত, গোপাল হালদার, অশোক মিত্র, শঙ্খ ঘোষ, সমর সেন, অশ্রুকুমার সিকদার, দীপেন্দু চক্রবর্তী, প্রণব বর্ধন, আনিসুজ্জামান, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, অরিন্দম চক্রবর্তীসহ বাংলা সাহিত্যের আরও অনেক বড় মাপের লেখকদের বিশ্লেষণধর্মী মৌলিক প্রবন্ধ এবং অন্যান্য রচনা। এই পত্রিকায় গল্প, কবিতা, সাক্ষাৎকার ও অন্য ধাঁচের গদ্য রচনা প্রকাশিত হলেও এটি মূলত প্রবন্ধের পত্রিকা। যা অন্য আরও কিছু গুণগত মানসম্পন্ন সাহিত্যপত্রিকার মতো বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যকে বিশ্ব মানে পোঁছে দিতে সাহায্য করেছে বলে আমার ধারণা। দীর্ঘ ৩০ বছর এই পত্রিকার একজন মনোযোগী পাঠক হিসেবে আমার এমনটাই মনে হয়েছে। তিনি এই সাহিত্যপত্রিকাটি বিরতিহীন সম্পাদনা করে চলেছেন একটানা দীর্ঘ ৫৩ বছর। অর্থাৎ ‘অনুষ্টুপ’-এর জন্ম হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। বাংলা সাহিত্যে একজন সম্পাদক এতদিন ধরে কোন সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন বলে আমার জানা নেই। সেই হিসেবে তিনি একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। যা নিয়ে একদিন হয়ত অনেক লেখালেখি হবে, যথার্থ মূল্যায়ন হবে।
এবার বইয়ের বিষয়ে আসা যাক। এই বইতে ভূমিকাসহ (কোলাজ-১, ২) মোট ৩৫-টি নাতিদীর্ঘ গদ্য রচনা আছে। এছাড়া রয়েছে ৫-টি পরিশিষ্ট। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য লেখকের নেওয়া চলচ্চিত্রকার পল কক্সের সাক্ষাৎকার। এই বইয়ের লেখাগুলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে ‘এই সময়’ পত্রিকার ‘রবিবারোয়ারী’র নিপাতনে সিদ্ধ কলামে। এই রচনাগুলোই বই আকারে প্রকাশিত হল।
গোড়াতেই বলা দরকার যে এই গদ্য রচনাগুলো কোন গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ নয়। শুরুতেই লেখক সেটা স্পষ্ট করেছেন। এগুলো খুব হালকা মেজাজে অনেকটা গল্প বলার ঢং-এ ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকার জন্ম, বেঁচে থাকার লড়াই ও বিকাশের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন বিভিন্ন লেখায় এবং এছাড়া তুলে ধরেছেন সেই সময়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা প্রসঙ্গ। তবে তা খুব প্রচ্ছন্নভাবে ছোট ছোট করে উঠে এসেছে অনেক লেখায়। কিন্তু কোথাও কোন বাড়াবাড়ি নেই, খুব বড় করে তুলে ধরার চেষ্টা নেই, কোন অহংকারি আচরণ নেই। এমন কী এই পত্রিকা প্রকাশ করতে যেয়ে যেসব বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হয়েছেন এই দীর্ঘ ৫৩ বছর সেসব ঘটনা প্রকাশের মধ্যেও কোন ক্রোধ, আবেগ, অভিমান বা অভিযোগের ভাষা ধরা পড়েনি। আবেগ ধরে রাখা খুব সহজ নয়। আর এখানেই লেখকের কৃতিত্ব। আর তাই পাঠক হিসেবে পড়তে পড়তে কোথাও চোট পেতে হয়নি। বরং বিষয়গুলো নিয়ে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছে। যা এই লেখাগুলোর আরেকটি বিশেষত্ব। যা আলাদা মাত্রা দিয়েছে বইটিকে। লেখাগুলোর মধ্যে উঠে এসেছে ৬০ এবং ৭০ দশকের উত্তাল সময়ের ইতিহাস, খণ্ডচিত্র। জানা গেছে অনেক অজানা বা হারিয়ে যাওয়া কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষের আত্মাহুতি বা আত্মত্যাগের কথা। কিন্তু কোথাও কোন তত্ত্ব বা পাণ্ডিত্য দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা নেই। লেখক এক জায়গায় বলেছেন যে তিনি কখনই কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। কিন্তু যখন সারা পৃথিবী জুড়ে সমাজতান্ত্রিক বা বাম আন্দোলনের নানা বিচ্যুতি বা ব্যর্থতা নিয়ে বিরূপ আলোচনা হচ্ছে, সেখানে তিনি খুব সাহসের সঙ্গে নকশাল আন্দোলনের নানা দিক অনেকটা গল্পের মতো করে তুলে এনেছেন সেই সময়ের ইতিহাস হিসেবে। যা আমাদেরকে আবার এই বিষয়ের দিকে মন ফেরাতে বা নতুন করে ভাবতে সাহায্য করলেও করতে পারে।
এই বইয়ের আরেকটি বড় সম্পদ হল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেক বড় বড় মানুষের নানা ঘটনা। যা এতদিনের এই সব চেনা মানুষগুলোকে অন্যভাবে বুঝতে বা জানতে সাহায্য করবে। এছাড়া এর মধ্যে দিয়ে উঠে আসবে ‘অনুষ্টুপ’-এর কিছু ভুল ত্রুটির কথাও। এখানে তার কয়েকটা উদাহরণ দিলেই তা স্পষ্ট হবে।
কবি সমর সেনের উপর ‘অনুষ্টুপ’-এর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। এটি একটি অত্যন্ত জরুরী কাজ, বিরল কাজ। এটি প্রকাশ করতে গিয়ে নানা কিছুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এরকম একটি ঘটনা এই ভাবে উল্লেখিত হয়েছে---
বিষ্ণু দে-র বাড়িতে তাঁর স্ত্রী প্রণতি দে-র কাছে সমর সেনের লেখা অনেক চিঠি সযত্নে রাখা রয়েছে, এমন খবর পেলাম এক বন্ধুর কাছে। কিন্তু যাবার সাহস সঞ্চয় করতে পারছিলাম না। কেন পারছিলাম না? সেকথা বলতে গেলেও প্রসঙ্গ চলে আসে ‘অনুষ্টুপ’-এর । বিষ্ণু দে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছিলেন। তখন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার-এর অর্থমূল্য ছিল এক লক্ষ টাকা। আমরা ‘অনুষ্টুপ’-এর ‘সংস্কৃতি সমাচার’ শীর্ষক অংশে তখন নানা বিষয়ে তীব্র সমালোচনার ঝড় তুলছি। ছদ্মনামেই সেই সব লেখা হত। ‘লাখপতি লেনিনবাদী’ এই নামে তীব্র সমালোচনা প্রকাশিত হল কবি বিষ্ণু দে-র উদ্দেশ্যে। সেই সময় দীপেন্দু চক্রবর্তীর একটি তীক্ষ্ণ প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল, প্রবন্ধটির নাম ‘বিষ্ণু দে-র দুর্ভেদ্য কেল্লা’। …এতসব কাণ্ড ঘটিয়ে কী করে গিয়ে মুখ দেখাব প্রণতি দে-র কাছে? ...শুনে শঙ্খদা হাসলেন। ‘ঠিক আছে একটা ফোন করে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যান। আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি।’ … সেভাবেই গেলাম আমরা, মানে সোমেশদা আমি ও পুলক চন্দ। শঙ্খ ঘোষের চিঠিটি হাতে তুলে দিলাম। চিঠিটি পড়ে আমাদের ভেতরে নিয়ে বসালেন। একটু বাদে চা ও মিষ্টি এসে গেল। এরপর কী বলবেন, সেটা শোনার জন্য আমরা প্রবল উৎকণ্ঠায়! কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রণতি দে বললেন, ‘তুমি ‘অনুষ্টুপ’-এর সম্পাদক? তোমাদের কাগজে আমার স্বামীর নামে তোমরা যা-তা সব কি লিখেছিলে? সে-সব লেখা পড়ে উনি খুব দঃখ পেয়েছিলেন।’ আমরা ভাবলাম যাঃ, আর বোধহয় চিঠিগুলো পাওয়া গেল না। আমাদের বসতে বলে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন, হাতে একটি প্যাকেট। বললেন, ‘শঙ্খবাবু চিঠি লিখেছেন বলে চিঠিগুলো তোমাদের দিলাম। তোমরা খুব দুষ্টু। এমন দুষ্টুমি আর কখনো কোরো না।
এই বইতে কলকাতা বইমেলার জন্ম ইতিহাস এবং বইমেলা বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অজানা তথ্য আছে। আছে অনেক ছোট ছোট ঘটনা । যার মধ্যে দিয়ে উন্মোচিত হয়েছে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চরিত্রের নানা দিক। এরকম একটি ঘটনার কথা এইভাবে বলেছেন---
জ্যোতিবাবুর একটি বই এই বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল (১৯৯৬)। বইটির নাম -- ‘অথোরাইজড বায়োগ্রাফি’। বইটি সম্পাদনা ও অনুলিখন করেছিলেন তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকাশক চেয়েছিলেন বইটি যেন উদ্বোধনের মঞ্চে জাক দেরিদা উদ্বোধন করেন। বইমেলার উদ্বোধনে গিলড-এর নিজস্ব প্রকাশনা ছাড়া অন্য কারও বই প্রকাশ করার রীতি নেই। বিপদ হল যখন বুদ্ধবাবু বললেন, এটা জ্যোতিবাবুও চাইছেন। মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন যখন, সেটা তো অগ্রাহ্য করা যায় না। কিন্তু আমরা সেদিন বুদ্ধবাবুকে বলতে পেরেছিলাম, ‘এটা আমাদের রীতি বা কনভেনশন নয়, আমরা অন্য প্রকাশকের বই, উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রকাশ করতে পারব না।’ জ্যোতিবাবুর মতো মানুষকে এ কথা বলার জন্য বুকের পাটা থাকার দরকার। কী আশ্চর্য! আজকের দিনে যেটা অসম্ভব, সে দিন সেটা হতে পেরেছিল। জ্যোতিবাবু মেনে নিয়েছিলেন সে কথা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবার পর এক ঘণ্টা বাদে জ্যোতিবাবুর বই প্রকাশিত হয়। এখন দেখছি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রকাশক নির্লজ্জের মতো নিজের প্রকাশনার বই প্রকাশ করছেন এবং পর পর তিন বছর ধরেই তা চলছে। এটা যে রীতিবিরুদ্ধ সেটা বলবার মতো সাহস নেই কোনো বীরপুঙ্গবের।
দুটো উদ্ধৃতি একটু বড় হয়ে গেল। তবুও বিস্তারিত উল্লেখ করলাম ঘটনা দুটো পুরোপুরি ধরার জন্য। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল এগুলো প্রাগৈতিহাসিক যুগের ঘটনা। কত দ্রুত সব কিছু বদলে গেছে বা বদলে যাচ্ছে। সাধারণ সৌজন্যবোধের জায়গাটা ভয়ংকরভাবে নড়বড়ে হয়ে গেছে। তোষামোদি করতে করতে, নতজানু হতে হতে, মেরুদণ্ড সোজা করে কথা বলতে ভুলে গেছি বা যাচ্ছি। নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বুঝতে চাই না, ভাবতে চাই না। মাঝে মাঝে তাই বড় অসহায় লাগে। এক নিষ্ঠুর সময়ে বসবাস! ‘অনুষ্টুপ’-এ প্রকাশিত লেখার গুণগত মান পাঠকের জানা। তাই এর লেখা নির্বাচনের প্রক্রিয়া যে খুব সহজ নয় এবং নিরপেক্ষভাবে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে তা করা হয় সেটা বলাই বাহুল্য। আর সে কারণেই ৫৩ বছর ধরে এই পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলোর মান বজায় রাখতে পেরেছে এবং এর প্রাসঙ্গিকতা এখনও হারিয়ে যায় নি। এখানেই ‘অনুষ্টুপ’-কে আলাদা করে চেনা যায় এবং শুরু থেকেই একটা সন্মানের জায়গা ধারণ করেছিল এবং সেই জন্যই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিল। খুব কাছের লোকের লেখা ছাপতে অস্বীকার করতে কোন দ্বিধা করেননি সম্পাদক। আর লেখা নির্বাচনের বিষয়-টা স্পষ্ট হয় এই উদ্ধৃতির মধ্যে--
প্রেস-এ বসে রাত-জাগা, রিকশ করে ছাপা ফর্মা নিয়ে আসা, পত্রিকার গ্রাহক সংগ্রহ করা, বিজ্ঞাপন সংগ্রহে সাহায্য করা থেকে সবরকম কাজে ও যে-কোনো সংকটে আমাদের পাশে থেকেছে শংকর (শংকর সেনগুপ্ত, নকশালপন্থী রাজনীতির সমর্থক)। … বাংলা গদ্যর প্রকরণ ও শৈলী নিয়ে শংকরের সঙ্গে আমার মতপার্থক্য আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু সেই বিরোধ কখনো কোনো প্রকাশ্য বাদ-বিসংবাদে যায়নি। শংকরের গল্প হয়তো ‘অনুষ্টুপ’-এ অনেক সময় ছাপা হয়নি। অভিমান করেছে সে, কিন্তু সংঘর্ষে গড়ায়নি তা।
বাংলাদেশের লেখকদের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের কিছু লেখকের উন্নাসিকতা বা তাচ্ছিল্য বিষয়ে কমবেশি আমাদের অনেকেরই জানা। এই বইতে এরকম একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এইভাবে--
মনে আছে তাঁর (গল্পকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস) মৃত্যুর আগে একবার ঢাকায় গিয়েছিলাম, পশ্চিমবঙ্গের বন্ধু গল্পকারদের জন্য অনেকটা দোচোয়ানি দিয়ে দিয়েছিলেন। পরে সেই ইলিয়াসের স্মৃতিময় পানীয় অন্য বন্ধুদের দিয়েছিলাম। ইলিয়াসের কথাও বলেছিলাম, তারা হেসেছিল এবং ব্যঙ্গ করেছিল। আর সেটাই তো স্বাভাবিক, কেননা তারা তো কেউ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখার এক লাইনও পড়েনি, পড়েনি ‘চিলেকোঠায় সেপাই’ বা ‘খোয়াবনামা’ বা তাঁর ছোটোগল্প।
শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে এই বইয়ের অনেকগুলো গদ্যে নকশাল আন্দোলন প্রসঙ্গ এসেছে। যা এই বইয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। যখন এই বিষয়টা নিয়ে প্রায় কেউই কথা বলতে চায় না এবং তা বললেও শুধু ভুলগুলো নিয়ে কাটাছেঁড়া করতেই বেশি ভালবাসে, সেখানে লেখক সাহসের সাথে গভীর মমতায় তুলে ধরেছেন কিভাবে শিক্ষিত যুবসমাজের একটা অংশ শুধু আদর্শের জন্য কত সহজে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিল, কিভাবে জীবন দিয়েছিল অনেক সাধারণ মানুষ। তার সংগে উঠে এসেছে সেইসব পরিবারের স্বজন হারানোর অসহনীয় বেদনার কথা। জানতে পারি এমন কিছু মানুষের কথা যাদের কথা কোনদিন জানা হত না। আমরা ক’জন বিষয়টাকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবেছি? শুধু রাজনৈতিক বিশ্লেষণই কি সব কথা, শেষ কথা? তার চেয়েও বড় কথা সমাজে সাধারণ ছিন্নমূল মানুষের উপর শোষণ-নির্যাতন তখনও ছিল, এখনও আছে। এর সমাধানের পথ এবং মতবাদ নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। অন্ততঃ ওরা কিছু করার চেষ্টা করেছিল ওদের জীবন দিয়ে। এরমধ্যে স্বার্থসিদ্ধির কোন মতলব ছিল না। ওদের নিষ্ঠার কোন অভাব ছিল না। আমরা ক’জন পারি এরকম নিঃস্বার্থ কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে? তাই সেটাকে ছোট করে দেখার কোন কারণ নেই। তারও একটা মুল্য আছে সমাজে। সেরকম আত্মত্যাগের এবং সহযোগী অন্যরকম কিছু মানুষের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। লেখক এইসব মানুষদের একটু অন্যভাবে বোঝানোর বা বোঝার চেষ্টা করেছেন। যা সেই সময়ের বাস্তবতাকে ধরতে সাহায্য করবে বলে আমার মনে হয়:
অজয় বসুরায় এবং আমাদের প্রয়াত বন্ধু সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৭৭ সালের ১৭ আগস্ট ‘জেল থেকে মাকে’ এই শিরোনামে একটি সংকলন প্রকাশ করেছিল। এই সংকলনে পেয়ে যাই এমন একজন মা-কে যিনি তাঁর দু’টি সন্তানের দু’জনকেই হারিয়েছিলেন সত্তর দশকে। এই মায়ের নাম মায়া রায়চৌধুরী। দুই সন্তানের নাম যথাক্রমে প্রদীপ রায়চৌধুরী (শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারং কলেজের ছাত্র) ও প্রবীর রায়চৌধুরী (প্রেসিডেন্সির ফিজিক্সের ছাত্র)। ...২০১৪ সালে প্রদীপ-প্রবীরের মতো ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের মায়েরা এখনও হয়তো স্বপ্ন দেখেন। সে স্বপ্ন হাজার চুরাশির মায়ের স্বপ্ন নয়। সে স্বপ্ন হয়তো ইউরো এবং ডলারের। দিন বদলেছে। প্রতিদিনই তো একটা নতুন দিন।
বা,
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের (দাপুটে শিল্পী) কথা ভাবলে প্যান্ট, গেঞ্জি-পরা একজন মানুষের ছবি এখনো ভেসে ওঠে মনের আয়নায়। বেলেঘাটায় একটি ফ্ল্যাটে তিনি থাকতেন। নকশাল আন্দোলনের সময় মিঞাবাগান বস্তিরই একটি নকশাল ছেলে রাত্রিবেলা আশ্রয় চাইল দেবুদার কাছে। দেবুদা বামপন্থী হলেও নকশাল আন্দোলনকে সমর্থন করেন নি কখনো। তবু তিনি ছেলেটিকে আশ্রয় দিলেন। সেই রাতেই এল পুলিশ। দেবুদা দরোজা খুলে তাদের সামনে দাঁড়ালেন। ‘আমাদের কাছে খবর আছে, একটি নকশাল ছেলে আপনার ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। আপনার ফ্ল্যাটটা আমরা সার্চ করব।‘ --- পুলিশের কর্তার মুখে এই কথা শুনে দেবুদা বলেছিলেন, ‘শুনুন আমার নাম দেবব্রত মুখার্জী। আমি একজন শিল্পী। আমার ঘরে আমি আপনাদের ঢুকতে দেব না। পারলে এই অপরাধে আমায় অ্যারেস্ট করুন। পুলিশ ফিরে গিয়েছিল।
আরও--
দ্রোণাচার্য অনেক কষ্ট পেয়েছেন, শহীদ হয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবেও তাঁকে চিনতাম। আমরা কেউই তার মতো জীবনটা দিয়ে দিই নি। তাই ‘তাই আমরা বেশ ভালো আছি, দ্রোণটাই কেবল চলে গেল’ এমন একটা অবস্থা থেকে একবার ফিরে দেখতে চাইছি দ্রোণকে। ... ‘নতুন জীবনের মধ্যে আবার ঢুকলাম। এখন গাংনেগড়ে যাদু বলে এক আদিবাসির বাড়িতে রয়েছি...। বর্তমানে পেশা নিয়েছি দিনমজুরের। লজ্জা- ঘৃণা- ভয়- এ-তিনটের কোনটা রাখলে এই সমস্ত মানুষকে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে সামিল করতে পারবো না – তা স্পষ্ট বুঝেছি প্রতি পদক্ষেপে।
খুবই ভালো কথা। এটা তিনি লিখেছেন ২৩/১/৬৮ সালে। আর ঠিক পরদিনই লিখছেন--
ঘুম ভাঙ্গার পরেই যাদুদা পাশে এসে বসলো। তারপর ওকে শুরু করলাম ছোটোদের রাজনীতি পড়াতে ...এরই মধ্যে দু’জন এসেছিল তাদের রাজনীতি দিলাম কিছু।’ ... ‘এই কিছু রাজনীতি দেবার’ খেলাটাই ভুল, এবং দ্রোণাচার্যদের যদি ভালো করে ‘ইয়েনান ফোরামটাও পড়ানো হত, এসব রাজনীতি দেবার মধ্যবিত্ত ছেলেমানুষি থাকত না। আদিবাসী মানুষের সরল ও কষ্টের জীবনের সাথী হওয়া অবশ্যই একটি অভিজ্ঞতা, কিন্তু তাঁদের একজন হওয়া যায় না যে! সে এক অন্য আশ্চর্য! এর ফলেই আমরা হারালাম একজন সংবেদনশীল কবিকে যে প্রেম, কবিতা ও বিপ্লবকে সমানভাবে আত্মস্থ করতে চেয়েছিল। ...১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘অনুষ্টুপ’-এ দ্রোণের কবিতা ‘বস্তুত এখন প্রয়োজন’ –এর কয়েকটি পঙ্ক্তি মনে পড়ল ---‘আমাদের জন্মে শুধু অবিরাম শোষণের গ্লানি/এখন সময় নেই চপল ছায়ায় বসে গল্পের আসর/এখন সময় নেই পান করি অসহায় চরিত্রের মদ…।’
এরকম অনেক অজানা কথা এবং সেই সময়ের নানা ঘটনা নিয়েই এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো এই বইটি। যা সংবেদনশীল পাঠককে ষাট-সত্তর দশকের সেই উত্তাল সময়ের অন্য জগতে নিয়ে যাবে।
তবুও এই বইটির বিষয়ে কিছু অনুযোগ থেকেই গেল। লেখাগুলো খুব ছোট লেগেছে। অনেক সময় মনে হয়েছে তা যেন হঠাৎ করেই শেষ হয়েছে। কোন কোন ঘটনা আরেকটু বিস্তারিত হলে পাঠকদের ভাল লাগত, বুঝতে, ভাবতে সাহায্য করত। অনেক কবির কথা এসেছে এই বইতে। যেমন সমীর রায়, সৃজন সেন, মণিভূষণ মজুমদার বা সব্যসাচী দেবের কথা অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে এসেছে। কিন্তু ওঁদের কবিতা বিষয়ে এবং নকশাল আন্দোলনে ওঁদের সম্পৃক্ততা বিষয়ে আরেকটু বিস্তারিত লিখলে পাঠকদের আরও আগ্রহ হত এইসব গুণী কবিদের ব্যাপারে। কেন না সরাসরি কোন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া কবির সংখ্যা বাংলা সাহিত্যে প্রায় নেই বললেই চলে। তাই এইসব কবিদের ভাষা ও প্রেক্ষাপট আলাদা, উপস্থাপনা ভিন্ন, কিন্তু তবুও ওঁদের অনেক কবিতাই কবিতা হয়ে উঠেছে। মনযোগী পাঠকের মন ছুঁয়েছে। কিন্তু এই কবিতাগুলো অনেক পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারলো না! এছাড়া তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের ভুমিকার কথা থাকার কথা ছিল। কেননা সেটাও সেই সময়ের ইতিহাসেরই অংশ। এটা আমাদের জানা যে কিভাবে তিনি নকশাল আন্দোলনকে বিপথগামী করেছিলেন, এই আন্দোলন-এ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিলেন এবং ওনার পরিকল্পিত তথাকথিত ‘এনকাউনটার’-এর মাধ্যমে শত শত নকশালদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। এ বিষয়ে কোন চাঞ্চল্যকর তথ্য বা ঘটনার কথা কোন রচনায় থাকাটা খুব স্বাভাবিক ছিল এবং তা যুক্তিসঙ্গতও হত বলে আমার মনে হয়। কিন্তু এরকম কোন তথ্য এই বইতে না পেয়ে বেশ অবাক হয়েছি। জানি না লেখক ইচ্ছে করেই তা এড়িয়ে গেছেন কী না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আগামী সংস্করণে ভাবা যেতে পারে। পাঠকদের জন্যে তা বাড়তি পাওয়া হবে। অনেক পাঠকের হাতে বইটা পৌঁছলে খুব ভাল হবে, অনেকেই উপকৃত হবে। বইটির বহুল প্রচার হোক। সেই প্রত্যাশা রইল।