কিসের অন্বেষণে
সকালটা বেশ লাগছিল প্রফেসর সেনের। বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে বর্শার ফলার মতো নেমে আসছে শীতের মিঠে রোদ। নীচে ঝরা পাতার কার্পেটে তাই দিয়ে আঁকা হয়ে যাচ্ছে আশ্চর্য আলপনা। পাখপাখালির ডাকের সাথে মিশে যাচ্ছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণীদের ঝরাপাতার ওপর দিয়ে চলাফেরার শব্দ। চারদিকে এত জীবন ছড়িয়ে আছে অথচ এই বনবাংলোর বারান্দা থেকে জঙ্গল ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। এই জঙ্গলে সাপখোপ, হরিণ, শেয়াল থেকে শুরু করে তেন্দুয়া পর্যন্ত দেখার সম্ভাবনা আছে। গতকাল রাতে এখানে এসেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জীবাশ্মবিদ প্রফেসর অন্বেষ সেন। এখানকার শিলাস্তর ও জীবাশ্ম পরীক্ষা করবেন। জব্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিদ্যা বিভাগের প্রধান ডঃ আলোক শ্রীবাস্তব ওনার এখানকার সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ডঃ শ্রীবাস্তব আগেই ওনাকে বলেছিলেন যে ‘স্যার আপনি যেখানে থাকবেন সেই বাংলোটা জঙ্গলের বেশ গভীরে। এর কিছুটা দূরেই একটা গভীর খাদ আছে। সেই খাদের একেবারে নিচে বেশকিছু আদিবাসী থাকে, ওপরের মানুষের সাথে যাদের নিয়মিত কোন যোগাযোগ নেই। একেবারে বিচ্ছিন্ন তারা। এরা হিংস্র এবং কাঁচা মাংসভুক। নিজেদের প্রয়োজনে মাঝে মাঝে ওপরের গ্রামে উঠে এসে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস, বিশেষত নুন, তামাক, বিড়ি ইত্যাদি নিয়ে যায়। ওদের সমাজে মুদ্রার আদান প্রদান নেই। নানা পশুর ছাল, বাকল, নখ, দাঁত, গাছের শিকড়-বাকড় ইত্যাদির বিনিময়েই এরা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে। এরা ছাড়াও এখানে অন্যান্য হিংস্র জানোয়ারের বিপদ তো আছেই।’ তিনি আরও জানিয়েছিলেন যে ওই বনবাংলোর খুব নিয়মিত কোন রক্ষণাবেক্ষন নেই। একজন চৌকিদার মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে সাফাই ইত্যাদি করে আসে। আর সে থাকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের আর একটা বনবাংলোতে। ভাল হয় যদি সেনসাহেব ওই দূরের বাংলোতেই থাকেন। কিন্তু প্রফেসর সেন এই কথায় আমল না দিয়ে বলেছিলেন যে ‘আলোক, আমি ওখানেই থাকতে চাই। যাতায়াতে সময় অনেক বাঁচবে, ফিল্ড ওয়ার্কে অনেকটা সময় দেওয়া যাবে।’ ডঃ শ্রীবাস্তব নিজেই খড়গপুরে প্রফেসর সেনের ছাত্র ছিলেন। উনি জানতেন স্যারকে এসব বলে কোন লাভ হবে না। এই ষাটোর্ধ্ব, লম্বা, সুদর্শন, অকৃতদার, কাজপাগল মানুষটির কাছে কাজই সব। অন্যান্য বিপদ-আপদের কথা তিনি ভাবেনই না।
ড্রাইভার যখন তাকে এই গভীর অরণ্যের বাংলোর বারান্দায় মালপত্র সমেত নামিয়ে দিয়ে চলে গেল তখন চারদিক থেকে অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ছে। গাড়ীর ইঞ্জিনের আওয়াজটা মিলিয়ে যেতেই তিনি টের পেলেন যুগপৎ মশা ও শীতের কামড়। বিকেল বিকেল আসার পথে এই জঙ্গলকে খুব মায়াবী বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখানে এসে যখন দেখলেন যে চৌকিদার তখনও এসে পৌঁছয়নি, তখন বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। যদিও জানতেন যে দেরিতে হোলেও চৌকিদার এসে যাবেই। সকালেই জীপ নিয়ে আলোকের ঠিক করা ড্রাইভারও এসে যাবে তার ব্যবহারের জন্য। কালই ফিল্ডের কাজ শুরু করতে হবে। তার কাছে বন বিভাগের অফিস থেকে দেওয়া বাংলোর একটা চাবি ছিল। সেটা দিয়ে দরজা খুলে অন্ধকারের মধ্যে ঘরে ঢুকলেন তিনি। বাংলো বলতে মাঝখানে একটা বড় শোবার ঘর, তার একপাশে বাথরুম আর অন্যপাশে একটা ষ্টোররুম। এখানে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। নিজের সাথে আনা মোমবাতি জ্বালিয়ে, সারা গায়ে ওডিকলোন মেখে নিলেন। তারপর সঙ্গে করে আনা কিছু শুকনো বিস্কুট খেয়ে বাংলোর স্যাঁতসেঁতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। ভাগ্যিস এরা বাংলোটা আগেই পরিষ্কার করে রেখেছিল। খড়গপুর থেকে কলকাতা হয়ে জব্বলপুর এসে তারপর ৭০ কিমি. জীপ-এ করে এই জঙ্গলে একটানা জার্নি। বেশ কাহিল লাগছিল শরীরটা। নতুন জায়গা হোলেও এক ঘুমেই রাত কাবার হয়ে গেল। সকালে উঠে দেখলেন চৌকিদার বেড টী নিয়ে হাজির।
****
দিন চারেক রাস্তার ধারে, পাহাড়ের গায়ে, নদীর উপত্যকায় বা জঙ্গলের ভেতরে ম্যাপ ও নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে বিস্তর শিলাস্তর ও জীবাশ্ম পরীক্ষা করলেন প্রফেসর। কিন্তু ফিল্ডে পাথর ও ফসিলের কিছু আউটক্রপ বা সারফেস স্যাম্পেল হাতুড়ি ও ছেনি দিয়ে সংগ্রহ করলেও, এই প্রাথমিক নিরীক্ষণে নিজে যেই ধরণের শিলাস্তর বা জীবাশ্ম খুঁজছেন, তা পেলেন না। একদিন শেষদুপুরে সেই হিংস্র আদিবাসীদের রহস্যময় গভীর খাদও দেখলেন। দিনের বেশিরভাগ সময় সেখানে সূর্যালোক পৌঁছয়না বলে মনে হল। এই ওপরের জঙ্গলেও হিংস্র জীবজন্তু কম নেই। নানারকম বিপদের সম্ভাবনা মাথায় রেখে নিজের লাইসেন্সড রিভলভারটা সাথেই রাখেন তিনি। অন্ততঃ নিজেকে তো বাঁচান যাবে। কিন্তু ওপরে সেই শিলাস্তর বা জীবাশ্ম না পেলেও, তাঁর ধারণা, নিচের খাদে সবই পাওয়া যাবে। যদিও ওখানে যাওয়াটা জীবনের ঝুঁকি সাপেক্ষ।
‘ইউ-এস-জিওলজিকাল-সারভে’-র সাথে জুড়ে একটা বড় গবেষণার অঙ্গ তিনি। প্রোজেক্ট হেড হলেন আর একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জীবাশ্মবিদ, কলোরাডোর ডঃ নরমান স্মিথ। গবেষণার বিষয় ‘বিশ্বের উষ্ণায়ন’। এ প্রসঙ্গে তাদের কাজ হল, বিশ্বের উষ্ণায়ন জনিত কারণে ‘জীবসমূহের বিনাশ’ বা মাস এক্সটিঙ্কসন ইভেন্টগুলো পৃথিবীর পাথরের বা জীবাশ্মের ইতিহাসে কি কি চিহ্ন রেখে গেছে তা খোঁজা। জীবাশ্মের মধ্যে সেই সময়কার উষ্ণায়নজনিত কোনও অভিযোজনের চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা এবং এখনকার প্রাণীজগতে সেইসমস্ত চিহ্ন দেখা যাচ্ছে কিনা তা অন্বেষণ করা। মোদ্দা কথা আজকের পৃথিবী উষ্ণায়নজনিত বিনাশ থেকে কতটা দূরে আছে তা জানা। ইতিমধ্যেই অনেকটা কাজ করে ফেলেছেন তিনি। এবারে তিনি এসেছেন ২৫ কোটি বছর আগের পার্মিয়ান সময়ে সবচেয়ে বড় ‘জীবসমূহের বিনাশ’ বা বিলুপ্তির ঘটনা নিয়ে কাজ করার জন্য। বিশ্বের উষ্ণায়ন-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটাতে অনেক দেশের অর্থনীতি ও আনুষঙ্গিক শিল্পায়ন ইত্যাদি জড়িয়ে আছে। ইতিমধ্যে ড: নরমান দুবার অ্যান্টার্কটিকা গেছেন। অনেক পাথর ও জীবাশ্মের নমুনা সংগ্রহ করে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। আগামী বছর অর্থাৎ ১৯৮১-র ভারতের অ্যান্টার্কটিকা এক্সপিডিসনের টীমের সাথে প্রফেসর সেনেরও যাবার কথা।
জীবনে জীবন যোগ করা
আরো দিন-দুয়েক পরে এক দুপুরে একটা ঘটনাতে তিনি খানিকটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। সিগারেট ফুরিয়ে যাওয়াতে মাইল কয়েক দূরের একটা হাটে গিয়েছিলেন তিনি। শেষ-শীতের রোদে হাটটা ঘুরে দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল তার। রংবেরং-এর সামিয়ানা খাটিয়ে কোথাও বিক্রি হচ্ছে ক্ষেতে ফলান সবজি, কোথাও ফলমূল, নদীর মাছ, মাংস, শাড়ী, গয়না, কি নেই! সিগারেট ইত্যাদি কেনার পরে হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল একটা বড় শালগাছের নিচে একজন স্থানীয় লোক অদ্ভুত কিছু জিনিসপত্র নিয়ে বসে আছে। যেমন জীবজন্তুর হাড়, মাথার খুলি, বিভিন্ন ধরনের রঙ্গিন পাথর। গাছের ডাল বা পাথর দিয়ে তৈরি ফুলদানী, বাতিদান বা অন্যান্য ঘর সাজাবার জিনিসপত্র। এইসমস্ত জিনিসের মধ্যেই তাঁর চোখে পড়ল একটা ফুটখানেক লম্বা ও ইঞ্চি ছয়েক চওড়া একটা পাথর, আর তার মধ্যে প্রোথিত ইঞ্চি চারেকের একটা জীবাশ্ম। মনে হল এটা একটা বডি ফসিলের অংশ। জীবাশ্ম বলতে বেশিরভাগ-ই পাওয়া যায় ট্রেস ফসিল। যেগুলো কিনা তাদের জীবনের কোনও চিহ্ন, যেমন পায়ের ছাপ, বা জীবনযাত্রার ছাপ, তাদের শক্ত খোলার চিহ্ন। মাঝে মাঝে পাওয়া যায় বডি পার্টস। যে গুলো হল বডি ফসিল। এটাও সেরকমই। বাইরের খোলার মধ্যে হয়তো জীবের শরীরের কিছু অংশও সংরক্ষিত রয়েছে। উনি পাথরটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন এই জীবাশ্মটি অনেকটা ২৫ কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া অমেরুদণ্ডী, সন্ধিপদী, সামুদ্রিক প্রাণী ‘ট্রাইলোবাইটে’র মতো দেখতে।
‘কোথা থেকে পেলে ভাই এই জিনিসটা?’ হাটুরে লোকটি বলল যে নিচের খাদের আদিবাসীদের একটা দল তাদের গ্রামে এসেছিল। তারাই ওদের এইসব জিনিসপত্রের বিনিময়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে গেছে। তার মধ্যেই এটা ছিল। প্রফেসর সেন দেখলেন এইরকম প্রাণী ওই ‘সমূহ জীববিলুপ্তি’ বা ‘বিনাশে’র পরে আর পাওয়া যায় নি। কিন্তু পাথরটা মনে হোল অনেকটাই নবীন, প্রায় ২০ কোটি বছর আগেকার ‘ট্রায়াসিক’ সময়ের। তবে কি এই প্রাণীরা পার্মিয়ান সময়ে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয় নি? কিছু স্পিসিস সারভাইভ করেছে? ভালো করে পরীক্ষা করতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে আগে জানা দরকার এটা কি একটা ইন-সিটু বা এখানেই তৈরী হওয়া পাথর নাকি অন্য দূর কোন জায়গা থেকে নদী- বা সমুদ্র- বাহিত হয়ে এসেছে। ভারী খুশী হয়ে জিনিসটি কিনে নিলেন তিনি। লোকটির নাম আর সে কোন গ্রামে থাকে জেনে নিলেন। বলে এলেন যে ওই আদিবাসীরা যদি আবার আসে তবে তাকে যেন বনবাংলোতে খবর দেওয়া হয়। মনে মনে ভাবলেন তাকে হয়ত ভবিষ্যতে খাদে নামতে হবে।
সেদিনই রাতে হারিকেনের আলোতে পাথর আর ফসিলটিকে অনেকক্ষণ পরীক্ষা করলেন অধ্যাপক সেন। দেখতে খানিকটা একরকম হোলেও এটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ‘ট্রাইলোবাইট’ নয়। বরং আরও কিছুটা উন্নত কোন প্রাণীর জীবাশ্ম। এরা কি তবে কিছুটা অভিযোজন করেছিল? এই সন্ধিপদী প্রাণী থেকেই কি পরবর্তীকালে আরো উন্নত প্রাণীরা এসেছিল? এটা কি একটা মিসিং লিঙ্ক? ভাল করে পরিষ্কার করে তারপর এর ফিচারগুলো দেখতে হবে। কালই একবার প্রফেসর নরমান-এর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনাও করতে হবে কাছাকাছি কোন বড় পোস্ট অফিসের থেকে আই এস ডি কল করে।
নিজের প্রিয় ‘লাইকা’ ক্যামেরাতে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে কয়েকটা ছবি তুললেন তিনি ফসিলটির। ধুলোবালি মুছে ছুরি দিয়ে ফাটা জায়গাগুলো থেকে নোংরা খুঁচিয়ে বের করে একেবারে পরিষ্কার করলেন। উত্তেজনার বশে ধারাল ছুরির খোঁচায় নিজের আঙ্গুল একটু কেটেও গেল। কয়েক ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ল টেবিলে আর ফসিলের ওপর। সঙ্গে আনা ডেটল লাগালেন আঙ্গুলে, তুলো দিয়ে টেবিলে লেগে থাকা রক্ত পরিষ্কার করে ওয়াশরুমের লাগোয়া ড্রেসিং রুমে অন্যান্য জিনিসের সাথে পাথরটা রেখে দিলেন।
কোথা যে উধাও হল
‘খুট’ করে একটা আওয়াজ হোলো কোথাও। ঘুমটা তাতেই ভেঙ্গে গেল প্রফেসর সেনের। হারিকেনের নিবু নিবু আলোতে চট করে কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। বাইরে চৌকিদারের টিনের চালে টিপ টিপ বৃষ্টির আওয়াজ। কম্বলের আরাম থেকে টর্চ হাতে মশারির বাইরে এলেন। টর্চ জ্বালিয়ে চারদিক দেখলেন। ঘরের মধ্যে কোথাও কিছু নেই। ঘড়ি দেখলেন। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে সময়। ‘খুট’ করে আওয়াজ-এর উৎসটা যে কোথায় তা কিছুতেই বুঝতে পারলেন না। রাতচটিটা পরে বনবাংলোর পুরনো কার্পেট-এর ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেলেন তিনি। সেখান থেকে বেরিয়েই ভীষণ আশ্চর্য হয়ে দেখলেন ঘরটা একটা হাল্কা মায়াবী নীলচে আলোতে ভরে গেছে। তার অবাক অবস্থার মধ্যেই সেই আলোটা কমে গিয়ে আবার অন্ধকার হয়ে গেল। টর্চের আলোতে আবিষ্কার করলেন, একেবারে কোণের দিকের জানলার একটা পাল্লা খোলা। ঠান্ডা হাওয়া আসছে সেখান দিয়ে। কিভাবে খুলল জানলাটা! চৌকিদার বলেছে জানলাটাতে গ্রিল বা তারজালি লাগান নেই বলে ওটা সবসময় বন্ধ থাকে। বাইরের থেকে খোলা সম্ভব নয় আর ভেতর থেকেই বা এটা কে খুলবে? একটা অস্বস্তি হতে লাগল মনের মধ্যে। ওই জানলা দিয়ে বাইরে টর্চ ফেলে কিছুই দেখতে পেলেন না। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে। সেই আলোতে চৌকিদারের টিনের ঘরের ওপারের ঘন জঙ্গল আরও রহস্যময় দেখাচ্ছে। জানলাটা ছিটকিনি লাগিয়ে বন্ধ করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন। পুরোটাই কি তাহলে মনের ভুল? মোলায়েম আলোর উৎসই বা কি? বৃষ্টিটা বাড়ছে। ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলেন তিনি।
সকালে উঠেই যা দেখলেন তাতে মাথা ঘুরে গেল তাঁর। দেখলেন, পাথরটা ড্রেসিংরুমে টেবিলের নিচে মাটিতে পড়ে আছে কিন্তু ফসিলটা তার মধ্যে নেই। কেউ যেন খুলে নিয়ে গেছে সেটা। পাথরটা না ভেঙ্গে কি করে ফসিলটা আলাদা করে নিয়ে গেল চোর তা ভেবে কূল কিনারা পেলেন না। চোর ঢুকলই বা কি করে? প্রথমে ভেবেছিলেন, পাথরটা বদলে দিয়েছে কেউ। কিন্তু না তা নয়, পাথরে এখনো লেগে আছে তাঁর রক্তের আবছা দাগ। রাতের অস্বস্তি আবার ফিরে এল। এর মধ্যে চৌকিদার এসে খবর দিল, কাল রাতে বৃষ্টির সময়ে এখানকার কুকুরটাকে কোন জন্তু আক্রমণ করে ক্ষতবিক্ষত করে গেছে। কিন্তু কোনো জন্তু জানোয়ার উঁচু তারকাঁটার বেড়া ডিঙ্গিয়ে বাংলোর চৌহদ্দিতে আসবে কিভাবে এটাই সে ভেবে পাচ্ছে না।
পরের দিন মাইল পাঁচেক দূরের বড় পোষ্টঅফিস থেকে ডক্টর নরমান-কে ‘আই এস ডি’ কল করলেন প্রফেসর সেন। অনেকক্ষণ কথা হোল। যদিও কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল না, তবু তিনি যতটুকু উদ্ধার করলেন তাতে বুঝলেন যে তাঁদের দুজনেরই ভাবনা প্রায় একই রকম। প্রথমত হারানো ফসিলটার হদিস করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যদি এর মধ্যে অভিযোজনের চিহ্ন পাওয়া যায় এবং ‘সমূহ বিলুপ্তি’ এরা সারভাইভ করে, তবে সেটা হবে একেবারে নতুন ফাইন্ডিং। আর সেই অভিযোজনের চিহ্নগুলো পরীক্ষা করতে হবে। ডক্টর নরমান যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। এমনকি যদি সঠিক শিলাস্তর ও আরও জীবাশ্ম পাওয়া যায় তাহলে তিনিও এখানে ফিল্ডে এসে পরীক্ষা করবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।
পোষ্ট পফিস থেকে বেরিয়ে দেখলেন এই শীত যাই যাই সময়ে শিমুল পলাশের ফুলে জঙ্গলে যেন আগুন লেগে গেছে। প্রকৃতি-প্রেমিক হয়েও এসব দেখলেন না প্রফেসর সেন। বাংলোতে ফেরার পথে প্রফেসর সেন মনে মনে ছকে ফেললেন যে, খাদের নিচে নামতে গেলে প্রশাসনের সাহায্য দরকার। আলোককেও বলতে হবে ব্যাপারটা।
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
রাত ৯-৩০-এ এখানে গভীর রাত। সবে বিছানাতে গা এলিয়ে দিয়েছেন প্রফেসর। উত্তেজনা থাকাতে মনটা একটু বিক্ষিপ্ত লাগছিল। ভাবলেন কাল একবার গ্রামে সেই স্থানীয় হাটুরে লোকটির কাছে যেতে হবে। নিচের খাদের আদিবাসীদের সঙ্গে যদি কোনভাবে যোগাযোগ করা যায়।
এবারে জীবাশ্ম-হীন পাথরটা খুব যত্ন করে পাশের স্টোর রুমে একটা তাঁর আনা একটা কাঠের বাক্সে তালা দিয়ে রেখে দিয়েছেন। ফসিলটা গেল কোথায়? কে নিল? সাতপাঁচ ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ কোণের গ্রিলহীন বন্ধ জানলাটার নিচেই বাইরে থেকে একটা জোর ‘ফোঁস ফোঁস’ আওয়াজ পেলেন। এত জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে কে? কোন বন্য জন্তু? টর্চ ফেলে দেখলেন জানলাটা ভেতর থেকে বন্ধ। কিছুক্ষণ পরে মনে হোল বাইরে থেকে জানলাতে কেউ যেন নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে। কেউ কি জানলাটা খোলার চেষ্টা করছে? হারিকেনটা উস্কে দিয়ে ওই জানলার ঠিক পাশের জানলাটার ছিটকিনি নিঃশব্দে খুললেন। এই জানলাতে লোহার গ্রিল লাগান আছে কাজেই কেউ চট করে ঢুকতে পারবে না। একটা পাল্লা একটু ফাঁক করে বাইরে টর্চের আলো ফেললেন। পাশের জানলার নিচে যা দেখলেন সেরকম আগে কোনদিন দেখেন নি তিনি। টর্চের আলোর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে একটা ভয়ঙ্কর জীব বাংলোর পেছন দিকে বাগানে চলে গেল। জন্তুটি ধুসর রঙের একটা অতিকায় গিরগিটির মতো। প্রায় দেড় মিটার। ছুঁচল দাঁত আছে মনে হোল। পিঠে আছে শক্ত খোল বা বর্ম। মাথাটি গোলাকৃতি এবং বেশ বড়। চারটে পা দেখা গেল। সামনের পা-দুটো শরীরের তুলনায় ছোট। কিন্তু বেশ শক্তিশালী। কিন্তু পেছনের পা দেখে যুক্তপদ বলেই মনে হোল। একটু যেন খুঁড়িয়ে চলছে সে। ওর বড় নখের আঁচড়ের আওয়াজ জানলাতে নিজেই শুনেছেন তিনি। একটা হাল্কা আলোর বলয় কি ঘিরে রেখেছে ওকে? কি করে এটা ঢুকল এখানে? চৌকিদারের ঘরের দিকে টর্চ ফেলে কোনও বিশেষ কিছু দেখতে পেলেন না। দুই তিনবার জোরে জোরে ডেকে চৌকিদারকে সজাগ করার চেষ্টা করলেন। কোন সাড়া পাওয়া গেল না। জানলাটা বন্ধ করে, হারিকেন-এর আলোতে ফিল্ড নোটবুক বার করে প্রথমেই অভ্যস্ত হাতে জীবটির একটা স্কেচ করে ফেললেন। এখুনি মনে করতে পারলেন না এরকম কোন জীব দেখেছেন বলে। কিন্তু যেই হোক ঘরের ভেতরে ঢুকতে চাইবে কেন সে? ও কি আবার ফিরে আসবে? বিছানায় শুয়ে বুঝতে পারলেন আজ আর সহজে ঘুম আসবে না। কাল একবার আলোকের ওখানে যেতে হবে। ওর লাইব্রেরিতে কিছু কাজ করতে হবে। কিছুটা সময় পার হোল। ঘুমটা আসবো আসবো করছে এমন সময় একটা তীক্ষ্ণ চিৎকারে সচকিত হয়ে উঠলেন। সাথে সাথেই শুনলেন দরজায় কে যেন জোরে জোরে ধাক্কা মারছে। গলা শুনে বুঝলেন চৌকিদার। আবার কি বিপদ হোল। তড়িঘড়ি দরজা খুললেন। চৌকিদার ঘরে ঢুকেই জোর শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিল। তার চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ।
প্রচণ্ড উত্তেজিত অবস্থায় সে জানাল যে দরজায় আঁচড়ের শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। জানলা দিয়ে দেখেছিল একটা ভীষণদর্শন জন্তু তার ঘরের দরজা খোলার চেষ্টা করছে। ভয় পেয়ে পরে সে কোনরকমে পেছনের দরজায় তালাবন্ধ করে দৌড়ে এখানে চলে এসেছে। ডক্টর সেন ভীত চৌকিদারকে বললেন বাকি রাতটা তার স্টোর রুমেই চাদর মুড়ি দিয়ে কাটিয়ে দিতে। আশঙ্কার রাত গড়িয়ে গেল ভোরের দিকে।
কিছু পাই অনুমানে
পরের দিন ফসিল পাথরটা আবার পরীক্ষা করলেন। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন বডি ফসিলের একটা ছোট অংশ পাথরের মধ্যে তখনো লেগে আছে। এত ছোট অংশ যে আগে লক্ষ্য করেন নি। কিন্তু টুকরোটা বার করা যাচ্ছে না। ফসিলের সন্ধিপদ বা যুক্তপদ পায়ের অংশ বলে মনে হল। আবার পুরনো ভাবনা পেয়ে বসল তাকে। চোর তো পাথরশুদ্ধই ফসিলটা নিয়ে যেতে পারত? তবে কি চোর নয়---? কিছু একটা আন্দাজ করে শরীর শির শির করে উঠল তার।
চৌকিদারকে এখন মূল বাংলোতেই থাকতে বলেছেন প্রফেসর সেন। কারণ তার দরজার অবস্থা ভাল না। টিনের শেডটাও নিরাপদ নয়। সে বিছানাপত্র এখানেই নিয়ে এসেছে আর স্টোর রুমে ব্যবস্থা করে নিয়েছে। অদ্ভুত একটা রহস্য যেন ঘিরে ধরেছে এই বাংলো আর তার চারপাশের জঙ্গলকে।
এই রহস্যের কিনারা না করে তিনি ফিল্ডেও যেতে পারছেন না। মাঝে একদিন কেটেছে। গতকাল রাতে জানলায় আঁচড় পড়েছিল কিন্তু জীবটিকে দেখা যায় নি। তবে রোজ রাতেই আসছে সে। আজকাল বিশ্বস্ত রিভলভারটিকে সবসময় কাছাকাছি রাখছেন তিনি। আলোকের ইউনিভারসিটির থেকে জীবাশ্ম সম্পর্কিত কিছু বই ইস্যু করিয়ে এনেছেন গতকাল। সেখানে অজস্র প্রাণী আর ফসিলের ছবির সাথে তার রাতের বেলায় আঁকা সেই জীবটির স্কেচ-এর মিল খুঁজে দেখছেন তিনি সারা দিন ধরে। প্রাচীন সন্ধিপদী প্রাণীদের সাথে কিছু আকৃতিগত মিল থাকলেও বুঝলেন এই জীবটি ঠিক সন্ধিপদী নয়। এর যদিও সন্ধিপদ, শরীরে বর্মের মতো কিছু একটা আছে। অনেক পোকাদের যেমন থাকে। সামনের পা দুটি ছোট হোলেও বেশ শক্তিশালী। আবার ছুঁচলো দাঁতও আছে। লেজ এবং পেছনের দু পায়ে ভর দিয়ে হাঁটার ভঙ্গিতে মনে হোল জীবটি প্রাচীন সরীসৃপ শ্রেণীরও হতে পারে। এদের থেকেই কি পরবর্তীকালে ডাইনোসররা এসেছিল? বহুযুগের ওপার থেকে কিভাবে এল এই জীব? কালই কথা বলতে হবে নরমানের সাথে।
আজকে রাতে হবে একটা মজারু
আজ রাতে ঘুমোলে চলবে না। অপেক্ষা করে আছেন প্রফেসর সেন। বলা ভালো আজ ফাঁদ পেতেছেন তিনি। রাতে অতিথি আসলে তাকে ধরতে হবে। জীবটি তাঁর গবেষণার জন্য ভীষণ জরুরী। হারিকেন একেবারে নিবু নিবু করে রেখেছেন। চৌকিদার পাশের স্টোর রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে। টর্চ আর রিভলভার বালিশের পাশেই আছে। কোণের জানলার ছিটকিনিটা খুলে রেখেছেন। অল্প ধাক্কাতেই যাতে ওটার পাল্লা খুলে যায়। রাত বেশ গভীর। আশেপাশে শালের ঘন জঙ্গলেও প্রাণের কোন সাড়াশব্দ নেই। তার নিজের ধারণা, এখানকার জীবজন্তু বা প্রাণীজগৎ এখান থেকে বহু দূরে চলে গেছে। হয়ত এই অদ্ভুত প্রাণীটির ভয়ে। প্রফেসর নরমানের সাথে দুপুরে কথা হয়েছে। সব শুনে ওনার মনে হয়েছে প্রাণীটি হয়তো সন্ধিপদী আর সরীসৃপ-এর মাঝামাঝি কোন জীব। কিন্তু উভচর প্রাণী নয়। এমন জীব এখনকার সময়ে কি করে এলো তা নিয়ে বিস্তর ভাবনার অবকাশ আছে। জীবটিকে বন্দী করার চেষ্টা করতে বলেছেন তিনি। তাই বড় ঝুঁকির কাজ করা হবে আজ। চৌকিদার পুরোটা জানে না। সবাই জানলে ব্যাপারটা অনাবশ্যক জটিল হয়ে যাবে। যদি দরকার হয় ওকে জানাবেন ঘুম থেকে তুলে। অমাবস্যা বলে আজ আকাশে চাঁদ নেই। কোন সাড়াশব্দও নেই কোথাও। কিছু যেন ঘটার অপেক্ষায় মঞ্চ তৈরি। এমন সময় জানলায় নখের আঁচড় পড়ল। প্রথমে আস্তে, তারপর একটু জোরে। স্নায়ু টানটান প্রফেসরের। ‘ক্যাঁচ ক্যাঁচ’ আওয়াজ করে খুলে গেল পুরোনো জানলা। অন্ধকারে ‘ঝুপ’ করে একটা শব্দ হোল ঘরের ভেতরেই। খুব হাল্কা একটা নীল আলো ঘরের অন্ধকারকে একটু যেন তরল করে দিল। প্রথমে দেখা গেলনা কিছু। কিন্তু চোখ সয়ে আসার পর ফুটে উঠল প্রাণীটির অবয়ব। পেছনের দুপায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে সামনের দুটি শুঁড়ের মত অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে কি যেন আন্দাজ করার চেষ্টা করছে সে। একহাতে টর্চ আর এক হাতে রিভলভার নিয়ে খাট থেকে নামলেন তিনি। টর্চ জ্বালালেন না। তিনি চাইছেন, ও যেন পাশেই বাথরুমের দিকে যায়। সেখানে দরজা বন্ধ করে তাকে ধরে রাখার সব ব্যবস্থা সারা। ডক্টর নরমানের সাথে সে কথাই হয়েছে আজ দুপুরে। ড্রেসিং-সহ বাথরুমের দরজা খোলা আছে, সেখানে একটা বড় চৌবাচ্চা আছে তাতে নোনা জল ভরা আছে এবং আছে কিছু জলজ উদ্ভিদ আর প্রাণী। একটা নকল সামুদ্রিক পরিবেশও তৈরি করার প্রচেষ্টা। এই প্রাণীটি আদতে যদি সামুদ্রিক হয় তবেও ওর পছন্দ হবে। কিন্তু না, প্রাণীটি ওই দিকে গেলই না। সে চলল সম্পূর্ণ উল্টোদিকে স্টোর রুমের দরজা লক্ষ্য করে। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে শরীরটাকে নিয়ে বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ক্ষণিক দেখল বন্ধ দরজাটা। তারপর সজোরে সামনের পায়ের থাবা চালাল দরজার পাল্লায়। এই প্রচণ্ড ধাক্কা দরজাটি সইতে পারল না। ভেতরের ছিটকিনি ভেঙ্গে গেল। চৌকিদার আছে এই স্টোর রুমে ঘুমিয়ে। প্রবল আশঙ্কায় রিভলভার তাক করলেন তিনি, যাতে চৌকিদারকে আক্রমণ করতে উদ্যত হোলেই গুলি করা যায়। প্রাণীটি এত শক্তিধর ভাবেন নি। ঘরে ঢুকল সেই জীব। চৌকিদার এদিকে দরজা ভাঙ্গার শব্দে জেগে উঠেছে। সেই মুহূর্তে টর্চের আলো ফেললেন তিনি। চৌকিদার আলোআঁধারিতে সেই ভীষণ দর্শন জীবটিকে একেবারে তার ঘরের মধ্যে বিস্ফারিত চোখে দেখল তারপর ‘হেওবান’ বলে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার করে স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে হোল অজ্ঞান হয়ে গেল। প্রাণীটি সেসব কিছু গ্রাহ্য করল না। নির্ভুল লক্ষ্যে এগিয়ে গেল জানলার পাশে রাখা স্যাম্পেল বক্সের দিকে। বিরাট থাবার আঘাতে ভেঙ্গে ফেলল বাক্সটা। আর ভেতর থেকে বের করে আনল পাথরের টুকরোটা যাতে লেগে আছে ফসিলের বাকি অংশটা। নখ দিয়ে খুঁচিয়ে অনায়াসে তুলে নিল ফসিলের টুকরো। তারপর একটা পায়ে ফসিলের টুকরোটাকে ঘষতে লাগল। টুকরোটা যেন ওর পায়ের সাথে মিশে গেল। অবাক হয়ে টর্চ আর পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রফেসর সেন। চকিতে জীবটি ঘুরে গেল জানলার দিকে। তারপর এক লাফে জানলার একদম কাছে। কি করবেন বুঝতে পারছেন না তিনি। একবার ভাবলেন চৌকিদারের অজ্ঞান শরীরটাকে টেনে দরজার বাইরে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেবেন তিনি। কিন্তু সেটা কি সম্ভব হবে? ওর শরীর বেশ ভারি। বের করতে সময় লাগবে। এর মধ্যে প্রাণীটি আক্রমণও করতে পারে। কিন্তু ওনাকে আরও অবাক করে প্রাণীটি খোলা জানলার শিকগুলো থাবা মেরে ভেঙ্গে ফেলল। জানলার ওপর উঠে বাইরে ঝাঁপ দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। আরে জীবটি বেরিয়ে গেলে তো আর ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওকে আটকাতে হবে। এই ভেবে ওর দিকে রিভলভার তাক করলেন প্রফেসর। তারপর মনঃসংযোগ করে গুলি ছুঁড়লেন তিনি। গুলি প্রচণ্ড শব্দ করে প্রাণীটার পিঠে বর্ম ছুঁয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। বর্ম ঘেঁষে চলে গেল না তো গুলিটি? গুলিটি লেগেছে, কিন্তু কতটা ঘায়েল সে বোঝা গেল না। গুলির শব্দে ঘুরে দাঁড়াল প্রাণীটি। তার পুঞ্জাক্ষি ঘুরতে ঘুরতে স্থির হোল প্রফেসরের দিকে। তীরের ফলার মতো ধারাল ওর ছুঁচল দাঁত দেখতে পেলেন তিনি। জানলার থেকেই সে তার শরীর লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল। আবার গুলি করার জন্য ট্রিগারে আঙ্গুল দিয়ে বুঝতে পারলেন উত্তেজনায় সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে তাঁর। চাপ দেবার শক্তিটুকুও নেই। আঙ্গুল জমে গেছে ট্রিগারে। প্রচণ্ড লাফ দিয়ে জীবটি এসে পড়ল তার শরীরে। বিরাট থাবায় ছিটকে পড়ল তার হাতের পিস্তল। নখের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হতে লাগলেন তিনি। কোমরে ভীষণ যন্ত্রণা। পিস্তল ধরা হাতটাতে থাবার আঘাতে কোনও সাড় নেই। তিনি মাটিতে পড়ে আছেন চিৎপাত হয়ে আর প্রাণীটি তাঁর বুকের ওপর বসে থাবা তুলেছে। এই বোধ হয় সব শেষ। কিন্তু ওনাকে ভীষণ আশ্চর্য করে জীবটি হঠাৎ থাবা নামিয়ে নিল। নখরাঘাতে দর দর করে রক্ত ঝরছিল তার। তিনি দেখলেন জীবটি তার শরীর থেকে নেমে মাটিতে পড়ে থাকা সেই রক্ত মুছে নিচ্ছে নিজের পা দিয়ে মাথা দিয়ে শরীর দিয়ে। লক্ষ্য করলেন প্রাণীটির পিঠে গুলির গভীর ক্ষত। গুলিটা লেগেছে আর বিঁধে আছে তার পিঠে, শরীরের গভীরে। ধোঁয়া বের হচ্ছে সেখান থেকে। রক্তমাখা জীবটি নিমেষে জানলার ওপর উঠে দাঁড়াল আবার। প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যে হাতড়ে হাতড়েও রিভলভারটা পেলেন না তিনি। জ্বলন্ত টর্চটা একদিকে পড়ে আছে। জীবটি লাফিয়ে পড়ল জানলার বাইরে। প্রবল যন্ত্রণা নিয়েও নিজের শরীরটা তিনি টেনে নিয়ে গেলেন জানলার কাছে। দেখলেন জীবটি টলতে টলতে চলে যাচ্ছে চৌকিদারের ঘরের দিকে। পিঠ থেকে বেশ ধোঁয়া উঠছে, আগুনও দেখা যাচ্ছে যেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি আবছা হয়ে আসছে। জ্ঞান হারিয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে তিনি দেখলেন ভুশ করে আগুন জ্বলে উঠল ওর ক্ষতস্থানে আর তার শিখা গ্রাস করা নিল পুরো জীবটাকে। তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ বেরিয়ে এল তার নিঃশ্বাস থেকে। জীবটা কি এখনো চলছে না লাফ মারল, নাকি আগুনের গোলাটাই আকাশে উঠল তা আর মনে নেই তাঁর।
কোন পুরাতন প্রাণের টানে
‘ওই ভয়ঙ্কর জীবটা কোথা থেকে এসেছিল স্যার আর ফসিলটাই বা গেল কোথায়?’
জব্বলপুরের সিভিল হাসপাতালের একটা কেবিনে চোখ বুজে শুয়ে আছেন প্রফেসর সেন। হাতে পায়ে প্লাস্টার। ড: আলোকের প্রশ্নে চোখ খুললেন। কেবিনে বসে আছে তাঁর আরও দুজন রিসার্চ স্কলার যারা খড়গপুর থেকে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এসেছে। আজ উনি সবার প্রশ্নের উত্তরে নিজের ভাবনা মেলে ধরবেন বলেছেন।
‘আলোক, আমি বলেছিলাম যে ওটা ছিল একটা বডি ফসিল। কোনও কারণে, বোধ হয় প্রথমে লাভাস্রোতে এবং পরে হিমবাহের স্রোতে কোন নির্দিষ্ট চাপ ও তাপে বা এদের তারতম্যে জীবটা প্রায় নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। ঠিক মৃত্যু নয়। যেমন মানুষ কখনো কোমাতে চলে যায়, সেরকম। তারপর ওটা পাথরের মধ্যে চাপা পড়ে ফসিল হয়ে যায়। ওর শরীরের ওই বর্ম আর পাথরের আস্তরণ ওকে বাহ্যিক ধ্বংস থেকে রক্ষা করে। কোটি কোটি বছর ধরে প্রাণীটি মৃত্যুর খুব কাছাকাছি একটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে। ওই অবস্থায় ওকে আমি পেয়েছিলাম। প্রফেসর নরমান এবং ওনার ওখানকার অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মতে, আমি যখন ফসিল আর পাথরটা পরিষ্কার করছিলাম, তখন আমার হাতের আঙ্গুল ছুরির খোঁচায় কেটে গিয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়েছিল সেই ফসিলটার ওপরে। পাথরের ফাটলের মধ্য দিয়ে যেটা ওর শরীরে পৌঁছয়। ওর শরীরের কোনও পুরনো ক্ষতস্থান দিয়ে যেটা ওই সন্ধিপদীর ওপেন সিস্টেম রক্ত সঞ্চালনে মেশে। হয়ত আমার রক্তের হিমোগ্লোবিন থেকে ওর রক্তে অক্সিজেন যায়। আর সাথে সাথে ওর কোষের বহুযুগ ধরে থেমে থাকা প্রোটোপ্লাজম সচল হয়। ওর শরীরে প্রাণের সঞ্চার হয়। মানে ও কোমা থেকে জাগে আর ওর কোষ বিভাজন শুরু হয় আবার। অনেক দিনের থেমে থাকা প্রসেস তাই অত্যন্ত দ্রুত বিভাজন হতে থাকে। ও রাতারাতি বিরাট বড় হয়ে যায়।’
‘ওই বড় হবার সময়েই কি ও নিজেই পাথর থেকে বিযুক্ত হয় এবং জানলা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়? কিন্তু যে জীবটি ফিরে এলো সে ট্রাইলবাইটের মতো পুরোপুরি সন্ধিপদী নয়?’
‘এটা নিয়েও ডঃ নরমানের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে আমার। আমাদের মনে হয়েছে যে ওর জিনে কিছু অভিযোজনের বা পরিবর্তনের চিহ্ন ছিল, যার কারণে ওর সন্ধিপদী শরীরে আরো উন্নত মেরিদণ্ডী সরীসৃপ শ্রেণীর কিছু লক্ষণও ফুটে ওঠে। সন্ধিপদী ট্রাইলোবাইট হিসেবে চলে গিয়ে ও সরীসৃপ হয়ে ফিরে আসে।’
‘কখন বুঝলেন যে এই জীবটাই সেই ফসিল ছিল?’
‘যখন ও নিজেই ওর পায়ের অংশটা ফেরত নিতে এলো।’
‘স্যার, ওই আলোর বলয়ের ব্যাপারটা কিভাবে এলো?’ এবারে প্রশ্ন করল তার এক রিসার্চ স্কলার।
‘ওটার কারণ হোল এক ধরনের মাইক্রোব। সেই আদিম সময়ে মানে প্রায় ২৫ কোটি বছর আগে ওদের শরীরের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকত ওই মাইক্রোব। যারা ওই ফ্লুরেসেন্ট আলো বিচ্ছুরণ করত। যেই ফসিল জেগে উঠে প্রাণী হয়ে উঠল, তখনই ওর শরীরে ঘুমিয়ে থাকা মাইক্রোবগুলোও সক্রিয় হয়ে উঠল।’
‘আপনি কি জানতেন যে ওই বাংলোর ঘরে ও আবার ফিরে আসবে?’
‘ওই ফসিলের লেগে থাকা টুকরোটা পাথরের মধ্যে দেখামাত্রই আমি আন্দাজ করেছিলাম যে, ওটা নিতেই বারে বারে হানা দিচ্ছে ও। ডঃ নরমানও তাই বলেছিলেন। সেই ভাবেই ওর ফাঁদ সাজিয়েছিলাম যাতে ও ঘরে এসে ওই বাথরুমের লাগোয়া ড্রেসিংরুমে ঢুকে যায়। যেখানে ওর ফসিলটা প্রথমদিন ছিল।’
‘তবে ও ড্রেসিংরুমের দিকে যেতে গিয়েও স্টোর রুমের দিকে গেল কি করে?’ অন্য রিসার্চ স্কলারটিও বেশ উত্তেজিত।
‘আমার মনে হয় ওর যে দুটো শুঁড় ছিল তারাই ওদের শক্তিশালী সেন্সরি অর্গান। তাই দিয়ে ও সেন্স করতে পেরেছিল কোথায় আছে ওর শরীরের বাকি অংশটা।’
‘স্যার, জীবটা বাংলোর বেড়া টপকে ঢুকত কি করে?’ ছাত্রটির পরের প্রশ্ন।
‘ও বড় লাফ দিতে পারত। আমার ধারণা ওর দুটো ছোট ছোট পাখা ছিল। সেই সময় পাখা সাহায্য করত ভেসে থাকতে। সেই ভাবেই লাফ দিয়ে ও তারের বেড়া পেরিয়ে বাংলোর চৌহদ্দিতে ঢুকত।’ দুর্বল শরীরেও স্যারের গলার আওয়াজ বেশ চনমনে।
‘কিন্তু ওই গুলির জায়গা থেকে আগুন লাগল কি করে?’
‘আলোক, এখানেও মাইক্রোব। ‘মিথানোসরসিনা’ বা ওই ধরনের কোন মাইক্রোব। এরা বাতাসের সংস্পর্শে এসে মিথেন তৈরি করে। এই মাইক্রোবের তৈরি মিথেন কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীর কার্বন সাইকেল পরিবর্তন করেছিল অক্সিজেনের সাথে মিশে কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করে। তাতেই আগুন লেগে ওই সময় পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘সমূহ জীববিলুপ্তি’র এটা একটা বড় কারণ। এই ব্যাপারগুলো বিশদে জানার জন্যই ওকে ধরা আমাদের খুব দরকার ছিল।
হসপিটালের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরে রোদে পুড়ে যাচ্ছে পৃথিবী।
‘এবারে উঠবো স্যার। কাল তো আপনাকে ছেড়ে দেবে। এখানকার দিন কুড়ির চিকিৎসায় অনেকটা সাড়া পাওয়া গেছে। আপনার ছাত্ররাই আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার সব ব্যাবস্থা করেছে। আমি আসব আপনাকে বিদায় জানাতে। একেবারে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আরও মাস খানেক সময় লাগবে। তবে একটা বড় আফসোস রয়ে গেল স্যার। জীবটাকে ধরা গেলে অনেক দূর এগিয়ে যেত গবেষণা। অনেক নতুন তথ্য জানা যেত।’
এবারে মিটি মিটি হাসতে হাসতে বিছানার পাশের ছোট সাইড টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে ফেললেন ডক্টর সেন। বের করে আনলেন একটা প্লাস্টিকের মোড়ক। তার মধ্যে দেখা গেল একটা পাথরের টুকরো। ডক্টর শ্রীবাস্তবের হাতে সেটা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘কিছু দেখতে পাচ্ছ অলোক?’
অবাক হয়ে অলোক দেখলেন পাথরের মধ্যে প্রোথিত আছে ফসিলের একটা খুব ছোট টুকরো। ‘এটা কি করে পেলেন স্যার? আপনি তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন সেই সময়।’
‘চৌকিদারকে দিয়ে পরে আনিয়ে নিয়েছিলাম পাথরটার বাকি ভাঙ্গা টুকরোগুলো। এই একটাই কাজের মতো জিনিস ছিল সেখানে। জীবটিও পুরোটা নিতে পারেনি। হ্যাঁ আলোক এটাই আমার এই যাত্রার ফসল। এটাই আপাতত পরীক্ষা করতে হবে। এছাড়াও নিয়েছি ওর গুলির ক্ষত থেকে ঝরা রক্তের নমুনা। আর, ওই প্রাণীটিকে কিন্তু আমি আগুনে পুড়তে দেখিনি। পুরোটা পোড়ার আগেই আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। পরের দিন ওখানে কিন্তু কিছু ছাই ছাড়া ফসিল সম্পর্কিত আর কিছুই পাওয়া যায় নি। পুড়লে ওর দাঁত নখ এগুলো গেল কোথায়?’
‘তাহলে কি স্যার?’
‘হ্যাঁ, এখনো আমি নিশ্চিত নই যে সত্যই সে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে কিনা। আমার ধারণা, সে লাফ দিয়ে আগুন নিয়েই কোথাও চলে গেছে। যে কোটি কোটি বছর প্রকৃতির এত ঝড়ঝাপটা সহ্য করে বেঁচে থাকে, তার মৃত্যু সহজে হয় না। তাছাড়া আমারও তো শিগগিরই এখানে আসতে হবে। কাজ তো শেষ হয় নি। ওই গভীর খাদে নামতে হবে। খুঁজতে হবে ওর মতো অন্য জীবাশ্ম। তখন নিশ্চয়ই আমার কাছে আসবে ওই জীবটি ওর শরীরের এই অংশটি নিতে। ততদিন অপেক্ষা করব আমি।’
‘একটা খটকা এখনো রয়ে গেল স্যার। আপনার বুকের ওপরে উঠে থাবা তুলেও সে আপনাকে মারল না কেন?’
‘এ ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই আলোক। আমার শরীর থেকে তখন ভীষণ রক্তপাত হচ্ছিল। দেখেছিলাম সেই রক্তে ও শুঁড় ডুবিয়ে দিয়েছিল। একই রক্তের টান ও হয়ত টের পেয়েছিল নিজের শরীরেও। হা, হা, আলোক, বড় বিচিত্র এই প্রাণীজগৎ। এত সহজে কি বোঝা যায় সবকিছু?’
বলতে বলতে চোখ দুটো বুজে এল প্রফেসর সেনের। যেন কোন বিচিত্র অনুভবের সাগরে ডুব দিলেন তিনি।
(গল্পটি প্রখ্যাত বাংলা কল্পবিজ্ঞানমূলক কাহিনী লেখক সদ্য প্রয়াত শ্রী অদ্রীশ বর্ধনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত)