• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৫ | জুন ২০১৯ | প্রবন্ধ
    Share
  • সব কিছু সিনেমায় : জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
    | | ৩ | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩


    || ৩ ||

    ক্যামেরার ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স লাগালে দৃশ্যমান বস্তু চওড়া--বেশ গোটা গোটা আয়ত ফ্রেমবন্দী হয়। শরতের ভোর ছিল সে বেলা। নীল নীল আকাশে সাদা সাদা টুকরো মেঘের ছবি, আর তার চিলতে আলোয় রোদ্দুরের ঝকঝকে রূপরেখা। মানুষের ঘাড়টা যদি মুভি ক্যামেরার স্ট্যান্ডের মত হয়, তবে সেই আকাশ থেকে টিল্ট ডাউন করা মাত্র চোখের সামনে সাবেক কাঠামোয় তৈরী লাল রঙের দোতলা বসতবাড়ি। আর চোখের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সের দৃশ্যমানতায় দুপাশে হরিয়ালী। আর পাশ-ভেজানো দরজা। কেমন যেন মনে হল, এ ধরনের দরজা খুললে “ক্যাঁচ” শব্দের বাহারি তরঙ্গ কান থেকে হৃদয়ের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করবে। হলও তাই। মনে হল যেন, কতদিন বাদে এ বাড়ির দরজা খুললো। এ বাড়ি আলাউদ্দীন খান সাহেবের মাইহারের বসতবাটি। এ বড়িতেই বেড়ে ওঠা, তালিম নেওয়া, বাবা আলাউদ্দীনের ছত্রছায়ায়, সরোদের ওস্তাদ আলি আকবর খানের, সেতারের দুই মহাপণ্ডিত রবিশঙ্কর ও নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আর নীরব-ইতিহাস মাখা শ্রীমতী অন্নপূর্ণা দেবীর জীবনচরিত।

    এখন আর সুর ঝরে না এদিকটায়। ফাঁকা বাড়ি তো! যখন মানুষ ঢোকে বেরোয়, শুধু ঝরাপাতায় পদসঞ্চারণের মর্মরধ্বনি আর অভিমানী বকবকানীয়া পায়রার আলসে বড় গম্ভীর ধ্বনি।

    বেশ অনেকটা পথ পেরিয়ে আমাদের যেতে হয় মাইহারে। কলকাতা থেকে দু-একটা ট্রেন যায় বৈকি। কিন্তু, গাড়ি-পথের ল্যান্ডস্কেপ বোঝার জন্য আমরা ক্যামেরা, লাইটের লটবহর নিয়ে দিল্লীগামী রাজধানী এক্সপ্রেস করে মাঝরাত্তিরেই নেমে গেলাম এলাহাবাদে। দরাদরি করে গাড়ি নেওয়া হল। ঘণ্টা পাঁচেকের রাস্তা। এলাহাবাদের গঙ্গাব্রীজ-এর জ্যাম জট পেরিয়ে উন্মুক্ত বনানী, পাহাড়-টিলা, চড়াই-উৎরাই আর এক স্বপ্নের প্রান্তর।

    গড়গড়িয়ে গাড়ি চলতে চলতে বেলাবেলি মাইহার শহরে পৌঁছলাম। ভারত সরকারের ফিল্মস ডিভিশানের একটা ফেলোশিপ প্রোগ্রাম, প্রযোজনার দায়িত্বে দিল্লীর পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং ট্রাস্ট। তথ্যচিত্র তৈরী হবে আলি আকবর খান সাহেবের ওপর। তাই, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটা উত্তেজনা কাজ করছিল। মাইহার একটা ছোট্ট শহর। মধ্যপ্রদেশের। এলাহাবাদ থেকে গোয়ালিয়র অভিমুখী রাস্তার ওপর যে শহরটি আদতে তা সঙ্গীতময়, তা উপলব্ধি করলাম শহরে পা দিয়ে। এখানেই আছে বাবা আলাউদ্দীনের স্বপ্নের বাড়ি, স্বপ্নের সঙ্গীতাশ্রম। এ শহর বেশ প্রাচীন। পাহাড়ের ওপর দেবী সারদার মন্দির। অবিরল ঘণ্টাধ্বনি। সারা দেশ থেকেই সারা বছর ধরে চলে ভক্ত সমাগম। কথিত আছে, রোজ ভোরে, বাবা আলাউদ্দীন তাঁর প্রিয় সরোদ নিয়ে হাজির হতেন পাহাড়-চূড়ায় মন্দির প্রাঙ্গণে। ভোরে ভৈরবী বা ললিত রাগে মুখরিত হয়ে উঠতো মন্দির পার্শ্বস্থান। বাবা এমনই। ফকিরবৎ। সব ধর্মের সব দেবতার স্থান ছিল তাঁর হৃদয়-অন্তরে।

    বাড়ির নাম ‘মদিনা ভবন’। মদিনা অর্থাৎ বাবার স্ত্রী। আলি আকবর খান সাহেব ও অন্নপূর্ণা দেবীর মা। তাঁর নামাঙ্কিত ফলক বাইরে আছে। এখনও। অন্দর অঞ্চলে একটা উঠোন। মুখোমুখি সোজা ঘর বাবার। ঘরের মধ্যে ঘর। সবুজ দরজা পেরিয়ে আরেক সবুজ দরজা, ভেতর ঘরে বাবার শয়নকক্ষ ছিল। সাধনকক্ষও বটে। বাইরের ঘরে তাঁর গুরু ওয়াজির খানের তৈলচিত্র। সাথে বেশ পুরনো কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাকেন্দ্রিক স্থিরচিত্র। কিন্তু ভেতরের ঘরটি! বাঙালী বাবুটির মতো। ছোট্ট কক্ষ। কিন্তু হৃদয়বহুল। দেওয়ালে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের নানা ছবির সমাহার। যীশু থেকে দেবী দুর্গা ও কালীর ফটোফ্রেম।

    অবাক হয়ে ভাবছিলাম, অধুনা বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবেড়িয়া থেকে সুদূর মাইহারে বাবা আলাউদ্দীনের যাত্রা শুরুর দিনগুলো। এমনও বোধহয় হয়, রূকথার গল্পের মতো। মাইহারের মহারাজা ব্রীজ সিং ছিলেন বাবার একান্ত অনুগামী শিষ্যও বটে। একটা বট গাছের ঝুরিতে যেমন নতুন নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয়, বাবা ছিলেন তেমনি এক মহীরুহ। দিগন্ত প্রসারিত তাঁর বহুমুখী সঙ্গীত প্রতিভায় মুগ্ধ ব্রীজনাথ সিং তাঁকে গুরু বলেই মেনেছিলেন। বাজনে ভুল হলে সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহারাজাও যে তাঁর কঠোর অনুশাসন থেকে বাদ পড়তেন না — এ কথা আজ সর্বজনবিদিত।

    এ প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট গল্প বলি। এক বিকেলে প্যালেস সন্নিহিত সিঁড়ির নিচে বাবা আলাউদ্দীন ও মহারাজা চা খাচ্ছিলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে কোনও এক সৈন্যের হাত থেকে তার বন্দুকটি পড়ে যায়। সেটা সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নীচে পড়ে। সশব্দে। সৈন্যর হাত থেকে বন্দুক পড়ে যাওয়া একটা অবমাননার স্বাক্ষর। যথারীতি মহারাজার সমস্ত রাগ এসে পড়ে ঐ সৈন্যর ওপর। বাবার চিন্তা ছিল অন্যরকম। তিনি তো রাগ করলেনই না, উপরন্তু পড়ন্ত বন্দুকের আওয়াজ এমন শ্রুতিতে আনার জন্য সৈন্যটিকে ধন্যবাদ দিতে থাকলেন এবং মহারাজাকে অনুরোধ করলেন যাতে কিছু নলওয়ালা বন্দুক বাবাকে তিনি দেন। দিলেন। আর সেই বন্দুকগুলোর লোহার নল ছোট বড় মাঝারি মাপে কেটে সাজিয়ে বাবা তৈরী করলেন অত্যাশ্চর্য এক সুরেলা সঙ্গীত যন্ত্র। নাম দিলেন ‘নল-তরঙ্গ’।

    বাজাবার লোক কই? নল-তরঙ্গের সুরধ্বনির সূক্ষ্মতা এতটাই তীব্র যে বারবার সমান-অভ্যাসের সুরেলা ছন্দ পরিবেশন করা যে বড্ড কঠিন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরই মাইহার-এ প্লেগের মহামারীতে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। প্রচুর শিশু অনাথ হয়ে পড়ে। দরদী মহারাজা ব্রীজ সিংহর আশ্রয় পেলো শতাধিক অনাথ শিশু। আর তাদের মধ্যে থেকেই কিছু শিশু নিয়ে বাবা আলাউদ্দীন তৈরী করলেন দেশের প্রথম ও একমাত্র ক্ল্যাসিকাল সঙ্গীতের দল — মাইহার ব্যান্ড। একজন দুজনকে বেছে নলতরঙ্গের তালিম দিয়েছিলেন ওস্তাদ নিজেই। আর তারই পরম্পরা চলে আসছে শতাব্দী জুড়ে।

    এমন অনেক স্মৃতিতে থমকে আছে মাইহারের লাল-রঙা সেই বাড়িটি। মানুষের চোখ দুটো যদি ক্যামেরার লেন্স হয়, তাহলে বলাই যায় ক্যামেরাটি যখন ঢুকলো বাড়ীর দালানের ত্রিসীমানায়, উত্তর দিকে মুখ করে দাঁড়ালেই, বাঁ দিকে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলার অলিন্দে। ওই ওপরের বাঁদিকের ঘরটি আলি আকবর খান সাহেবের আর তার পাশের দুটো ঘরে থাকতেন সদ্য বিবাহিত রবিশঙ্কর তাঁর স্ত্রী অন্নপূর্ণাকে নিয়ে।

    দিনুচাচা বাড়িটিকে এখনও তরিবৎ করে রাখার চেষ্টা করেন। বয়সের ভারে কুঞ্চিত তাঁর চামড়া, তবু এখনও ঋজু আর সুঠাম দেহ। দেহাতি বয়স্ক এক বউ তাঁর, ঘোমটার আড়াল থেকে একটু দেখা তাঁর হাসি-ভরা সলজ্জ মুখটি। ঝাড়পোঁচ হয় তো বাড়িটিতে। মাঝে মাঝে। কিন্তু বকম-ডাকা গুচ্ছের পায়রাদের জন্য গমের দানার অভাব নেই। বৎসরান্তে একবার আলি আকবরের বড় ছেলে সরোদীয়া গুরু আশিষ খান আসেন। সুদূর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। বাবা-ঠাকুর্দার কাছে তালিম নেওয়া গুরুজীও এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। মাঝে মাঝে আলমও আসেন। আলি-পত্নী মেরি খানের ছেলে। শেষ জীবনে স্যান রাফায়েলেই কাটিয়েছিলেন আলি আকবর। ওখানে তৈরী করেছিলেন আলি আকবর কলেজ অব মিউজিক।

    সন্ধ্যার পর আঁধার নামে মাইহারের বাড়িটিতে। দিনুচাচা দীপ জ্বেলে যায়। এক চিরকালীন মৌলবী আসেন সন্ধ্যাবেলা নিয়মিত। দালানের এক খাটিয়াতে বসে নমাজ পড়ে যান। নিয়মিত। শান্ত এখন এ বাড়ি। ঝিঁ ঝিঁ ডাকে। জোনাক জ্বলে। কান পাতলেই নমাজের সুর। আর ঘ্রাণে দিনুচাচার বৌ-এর উনুন-স্যাঁকা তাওয়া রুটির বাস।

    অথচ এ বাড়ি তো ছিল সঙ্গীতময়। ছাদের ওপরে যে তে-তলার ছাদ আছে, দূরে পাহাড়-টিলার ওপর সারদা দেবীর মন্দির চূড়া দেখা যায়। এত দূর তো, তাই ঘন্টা-ধ্বনি শোনা যায় না। তবু নাকি শেষ বয়সের বাবা আলাউদ্দীন এখানে বসেই দূর-মন্দির দর্শনে তৃপ্ত হতেন। সরোদ কোলে ঐ দূর থেকেই সারদা দেবীকে শোনাতেন তাঁর সঙ্গীত বৈভব। বয়সকালে মন্দির প্রাঙ্গণের কাছে যেতে না পারার এক বেদনাতুর অনুভূতি। এ যেন, যমুনাতীরের তাজমহল দূর থেকে দেখা শেষ শয্যার শাহজাহান।

    আলি আকবরের ছোট থেকে বেড়ে ওঠা এ বাড়িতেই। তেমনি পণ্ডিত রবিশঙ্করের কিশোর থেকে যৌবন এ বাড়িতেই অতিবাহিত। অনেক প্রিয়-অপ্রিয় ইতিহাসের ভিড়ে আমি যেতে চাই না। আমার এ লেখা ইতিহাস-সন্ধানী নয়, চলচ্চিত্রকার হিসেবে একদা সঙ্গীতমুখর বাড়ির অলসভাবে পড়ে থাকা অন্দরমহলের অনুভূতি। বুঝতে পারি, এ বাড়ির আনাচ-কানাচ স্পর্শ করলেই সুর-ঝঙ্কার বেজে ওঠে। আপনা হতেই মনের মধ্যে সুরের জন্ম নেয়।

    আমার দীর্ঘিদিনের সহকর্মী অলোক ব্যানার্জী সুররসিক। আমরা দীর্ঘিদিন ধরে ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স-এ বিশিষ্ট শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশন শুনতে যেতাম। ITC-SRA-র বার্ষিক সঙ্গীত সম্মেলনেও নিয়মিত শ্রোতা ছিলাম। সেই উৎসাহ ও ইচ্ছেকে সঙ্গী করেই আলি আকবর খানের ওপর ছবিটি তৈরী করার স্বপ্ন। এ সময়েই গুরু আশিষ খানের সাথে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিল তাঁরই শিষ্য সন্তুর-বাদক দিশারী। দিশারী চক্রবর্তী। তখন তার কিশোর বয়স। অতি উৎসাহী আর নির্ভেজাল সঙ্গীত রসিক হিসেবেই তাকে আমরা পেয়েছিলাম। মাইহারের বাড়ির সাথে, মাইহার ঘরানার সাথে, মাইহার ব্যান্ডের সাথে সর্বোপরি গুরু আশিষ খানের সাথে যোগাযোগগুলোর সব রাস্তা খুলে গেল।

    মাইহারের বাড়ির দোতলার ঘরে বহু দিন বন্ধ জানলার পাল্লা খুলেছিলাম। ঘরের পরিত্যক্ত খাটের ওপর বাইরে থেকে আসা আলোর ঝলসানো রশ্মি এসে বর্ণময় করে তুলেছিল সে ঘরটিকে। চোখের পাতা নির্লিপ্ত থাকলে বায়বীয় ইথার তরঙ্গের বুদবুদ চোখে পড়েছিল। আর আলোর রশ্মিপথ ধরে উড়ে বেড়ানো ধূলিকণা। সকালের রাগ বেজে উঠেছিল মনের মাঝে। এমন অনুভূতিগুলো দৃশ্যায়িত করার প্রকাশ বড় কঠিন। এমন তো কিছু অনুভূতি অপ্রস্ফুটিত হয়ে চিরকাল থেকে যায় নিজের মনের মধ্যে। মনের কোরকে মুড়ে রয়েছে সে দিনের সে সকালটা।

    কিন্তু শিল্পীর অন্তর-মনে সঙ্গীতের প্রকাশ হয় কি ভাবে? সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়কে অনুরোধ করলাম। “একটা ছবি আঁকবেন! আমাদের তথ্যচিত্রের সর্বশেষ দৃশ্যে যেটা অমলিন হয়ে শোভা পাবে শেষ দৃশ্যের প্রকাশে?”

    রাগের নাম বৃন্দাবনী সারঙ্গ। আলি আকবর খান সাহেবের বাজানো সরোদের ঝঙ্কার শুনে সুব্রতবাবুর তুলির টান আছড়ে পড়েছিল সাদা ক্যানভাসে। বিমূর্ত থেকে মূর্ত হয়ে উঠলো ফ্রেমটি। এক ঘণ্টার মধ্যে ফুটে উঠলো এক সুন্দরী নারীর অবয়বের প্রতিচ্ছবি। সঙ্গীত প্রকাশিত হয়েছিল তুলির টানে।

    মাইহারের সেই নির্জন বাড়ি সচল হয়ে উঠেছিল ছবির পর্দায়। নিজেদের অনুভূতির জায়গা থেকে। নিজেদের ভাললাগার জায়গা থেকে। ছবির নাম দিয়েছিলাম — Strings of melody: Ustad Ali Akbar Khan.


    (ক্রমশ)



    অলংকরণ (Artwork) : ছবি : লেখক
  • | | ৩ | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments