নাম সরলা বাস্কে, গ্রাম কুসুমটিকরি। এইটুকুই বলতে পারল জুয়েল। বাকি যা বলার বলল সুনীল মাঝি। থানার মেজোবাবু মিসিং ডাইরি লিখতে লিখতে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “দেখ বাপ, শুধুমুধু মন খারাপ করিস না, ও গায়ের ঝাল মিটলে নিজেই ফিরে আসবে। গাঁ-গঞ্জের মেয়েছেলে মানুষ, কোথায় আর যাবে; পড়ন্ত বয়েসে কোন ছেলেছোকরার সাথে লটকে পড়বে সেই চান্সও কম, তো যাবে কোন চুলায়? এক যদি না কিছু একটা করে বসে, মানে গাছের ডালেফালে ঝুলে না পড়ে!“
জুয়েল কোন উত্তর করে না, চোখ তুলে তাকায় মেজোবাবুর দিকে, নিস্পৃহ দৃষ্টি থানার ঘরের সীমানা পেরিয়ে দূরে কোথাও চলে যায়। নিজের ওপর বিস্তর রাগ হয়, কেন কাল রাতে ওরকম করে বসল, গুমরে মরে নিজের ভিতরে। এতদিন ঘর করছে সরলার সঙ্গে, কোনদিন গায়ে হাত তোলেনি বউটার; নেশার ঘোরে কি করে বসল আর সরলাও এক কাপড়ে ঘর ছাড়ল। অভিমানে বুক ফেটে যায় জুয়েলের, “এত দিনের সম্পর্ক, টুক ভুলের জন্য এত বড় শাস্তি ট দিতে হবে? স্বামী স্ত্রীর বিবাদ কি হয় না? তাই বুলে ঘর সংসার ছেড়ে বেবাগি হতে হবে?” প্রথমটায় ভয় পেয়েছিল জুয়েল, সরলা কোথাও নেই মানে লোকে আবার না ওকেই ভুল বুঝে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। সকাল হতেই খবরটা চাউর হয়ে গেল, জুয়েল এদিক-সেদিক অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সরলার হদিস পেল না। শেষে সুনীল বলল ভোরের দিকে নাকি সরলাকে দেখেছে বড়রাস্তার দিকে যেতে। তা সে তো আর জানে না যে “বেটিছেলে রাগ কইরে ঘর ছেড়েছে!” এ-গাঁ সে-গাঁ খবর গেল, সারাদিন তক কেউ কোন খবর দিতে পারল না। কোন উপায় না দেখে থানায় গেল জুয়েল। পুলিশের উপর খুব যে ভরসা আছে তা নয়, পার্টি-পলিটিক্স করতে গিয়ে কম তো দেখল না পুলিশের কেরামতি। তবু এই ধরনের ঘটনায় পুলিশের কাছে একটা রিপোর্ট লেখানো দরকার বটেক। এইসব ঘরের কথা দাদার কানে তোলার ইচ্ছে নেই জুয়েলের, একবার মনেও হয়েছিল দাদাকে জানিয়ে রাখা দরকার তবুও শেষ পর্যন্ত দাদাকে আর ফোন করেনি জুয়েল। দাদা ব্যস্ত মানুষ, কত ঝক্কি, কত দায়িত্ব, তাকে ইসব বলে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। কাল সকাল থেকে তো দাদার সঙ্গেই ছিল জুয়েল, বিকেলের দিকে টুক খানাপিনা হোল, বিলাইতি মাল আর কি সব কাবাব না কি বলে। দাদা, মানে হারাধন মাল এবার বিধানসভায় লড়ছে। হারাধনের জিত নিয়ে কোন সংশয় নেই জুয়েলের। আর কেউ জানুক না জানুক, হারাধন নিজে জানে, জুয়েল কি না করেছে ওর জন্য। টানা দু মাস ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর লোক আজকাল পাওয়াও মুশকিল। তবে জুয়েল স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে আর হারাধন দেখাতে। “তুয়াদের কথা বলার জুন্যই তো আমার লড়াই। একবার এমএলএ হলে দেখবি এই কুসুমটিকরির চেহারা পাইলটে দিব।” জোর দিয়ে বলেছে হারাধন। জুয়েল জান লড়িয়ে খেটেছে কটা দিন। এখন তো আবার মিটিং-মিছিল করতে গেলেও কর্তাদের অনুমতি লাগে, প্রোগ্রাম ঠিক করা থেকে চিঠি লেখা, বিডিও অফিস থেকে থানা ঘুরে অনুমতির কাগজ বের করা, সব একার হাতেই সামলেছে জুয়েল। বুকে শুধু একটাই স্বপ্ন, আরও একটু বেশি ভালো থাকার ব্যবস্থা হবে দাদার হাত ধরে, বদল আসবে অনেক না-পাওয়ার জ্বালা নিয়ে বেঁচে-থাকা একঘেয়ে জীবনে। হ্যাঁ, জুয়েল জানে, স্বপ্নকে বুকের ভিতরেই টিঁকিয়ে রাখতে হয়, ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্ন তো ঘুম ভাঙলেই মিলিয়ে যায়।
জুয়েল বাস্কের জন্মকম্ম কুসুমটিকরিতেই। বছর দশেক আগেও গ্রামে জনা চল্লিশ ঘর লোক ছিল। ক্রমে পরিবার ভেঙে এখন ষাট-বাষট্টি। লোকের রুজিরোজগার বলতে অন্যের জমিতে মুনিষ খাটা। আশপাশের কোন গ্রামেই সেরকম চাষাবাদ হয় না। একটু দূরেই যেতে হয় কাজের জন্যে। ইদানিং মাটি কাটার সরকারি কাজের সুবাদে এলাকাতেই লোকে কিছু কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে বটে। পঞ্চায়েতের বাবুরা শুধু পুকুর কাটার কাজ ধরে। শুখা জায়গায় জল ধরে রাখার জন্য পুকুর কাটার দরকার আছে বৈকি। তবে পাথুরে জমিনে দশ হাত মাটি কেটেও জল ওঠে না। আবার বৃষ্টিতে জল জমলেও সে জল উধাও হয়ে যায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। রুখা-শুখা টাঁড় জমিতে আগাছা আর ইতস্তত তাল-খেজুরের উঁকিঝুঁকি। বিক্ষিপ্ত এলাকা জুড়ে ইউক্যালিপটাস আর শালের জঙ্গল। ফরেস্টের বাবুরা কিছু কিছু জায়গায় ইতিউতি আকাশমণি আর শিশুর চারা লাগিয়েছে। চাষ-বাস সেরকম নেই বললেই চলে। জুয়েলের বাপ টিঙ্কা বাস্কে কর্মঠ মানুষ ছিল তবে এদিক-সেদিক মুনিষ খেটে যা পয়সা পেত তার বেশিটাই যেত চোলাই-এর পিছনে। আজকাল আবগারি দফতরের হানাদারির কারণে চোলাই-এর রমরমা কমেছে। তার বদলে আট-দশ মাইলটাক যেতে পারলে সরকারের লাইসেন্স পাওয়া দোকানে লেবেল মারা দিশি-বিদিশি মাল বুক ফুলিয়ে কিনে নেওয়া যায়। কুসুমটিকরির আদিবাসী মানুষজন অবশ্য হাঁড়িয়াতেই খুশি। দামি মাল কিনে খাওয়ার সঙ্গতিই বা কোথায়! চোলাই টেনে টিঙ্কা অল্প বয়সেই লিভার পচিয়ে ফেলেছিল, একদিন সোমত্ত বউটাকে ফেলে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেল পরপারে। জুয়েল তখন বছর পাঁচেকের হবে, ফুলমনি গায়-গতরে খেটে ছেলেটাকে শুধু বাঁচিয়েই রাখল না, গ্রামের স্কুলে ভর্তিও করে দিল। বিশু মাহাতো কুসুমটিকরি গাঁয়ের মাতব্বর; তিন পুরুষের চালকল, তেলকল-এর ব্যবসা। ফুলমনির দুর্দিনে বিশু মাহাতো পাশে এসে দাঁড়াল, নিজের বাড়িতে কাজে লাগিয়ে নিল ওকে। বিশুর রুগ্ন বউয়ের ছেড়ে রাখা খানিকটা জায়গা বিনা সংশয়ে দখল করল ফুলমনি। এই নিয়ে কানাঘুষো করার লোকের অভাব না থাকলেও ফুলমনির তাতে কোন পরোয়া ছিল না, সেই ফিসফাসে পরোয়া ছিল না বিশুরও। তাছাড়া টিঙ্কা তো ফুলমনির অনেক চাহিদাই অপূর্ণ রেখে চলে গেছে যেটা পুষিয়ে দিতে কার্পণ্য করেনি বিশু মাহাতো।
মাধ্যমিক পাশ দেওয়ার পর জুয়েল আর পড়াশোনা করেনি। গাঁয়ের জলহাওয়ায় বেড়ে ওঠা মজবুত শরীরটা দেখে মনে হয় বুঝি পাথরে খোদাই করা একটা মানুষ। লেখাপড়া ছাড়ার পরেই ভিন গাঁয়ের ইটভাঁটায় কাজে লেগে পড়ল জুয়েল। বছর ঘুরতেই মজুরি বাড়ানোর দাবি নিয়ে বিবাদ লেগে গেল মালিকের সঙ্গে। ইটভাঁটার কাজ ছেড়ে তারপর এখানে-সেখানে নানা কাজে হাত পাকিয়ে শেষপর্যন্ত মাটি কাটার সরকারি কাজের সুপারভাইসারি। তখন থেকেই হারাধনের সঙ্গে জুয়েলের পরিচয় আর সময়ের সাথে সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি।
হারাধন টিকিট পাওয়ার আগে থেকেই জুয়েলকে যাবতীয় দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছিল। প্রথমটায় জুয়েলের রাজনীতি নিয়ে খুব একটা উৎসাহ ছিল না। মনে হত, “সব ফালতু বটেক। এই রুখাশুখা জমিনটাই তো কুসুমটিকরির ভূত-ভবিষ্যৎ। জলের অভাবে চাষ হয় না, শুখা মাটি হাঁ করে সব জল শুষে ল্যায়। ইখানে কি পরিবর্তন হবেক? এই অভাগা টাঁড় জমিনের লিগা এত মাতামাতি কেনে?” গাঁয়ের সভায় হারাধন স্বপ্ন বুনে বলত, “সেচের উন্নতি হবেক, উই কংসাবতি জলাধার থিকে সেচ নালা কাইট্যে জল আনিব, জমিনে ফসল ফইলবে, বিজলি বাতির আলো পাবে সবাই, আরও কত কি, তুমাদের কথা আমার থিকে ভালো কে বুইঝবে বল? শুধু একবার বিধানসভায় যেতে হবেক।” জুয়েলের মন ছুঁয়ে যায় দাদার কথা, সত্যি এই অভাগা কুসুমটিকরির জন্য কে আর এত ভাবে! নতুন দিনের আশায় বুক বাঁধতে খুব ইচ্ছে করে জুয়েলের। দাদাকে সবসময় পাওয়া যায় না, ব্যস্ত মানুষ, দাদাই ফোন কিনে দিয়েছে জুয়েলকে, বলেছে, “তুই আমার জুয়েল বটেক, ইদিকটা কিন্তু দেখে লিবি বাপ, একটা ভোটও যেন অন্য দিকে না যায়।” জুয়েল জান লড়িয়ে খেয়াল রাখে সব দিকে, বুক-ভরা স্বপ্নগুলো সত্যি না-হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই ওর। ভোট মিটেছে দিন কয়েক হোল, মেশিনগুলান সব তালা বন্দি হয়ে ঘুমিয়ে আছে সদর-এর কলেজে। মেশিন না কুসুমটিকরির ভাগ্য কে জানে!
“ইসব করে কি লাভ? মাটি কাটার কাজ বন্ধ থাকলে তো সেই হাত খালি। দাদারে একটা কাজের কথা বুল্লেই পার।” সরলার কথায় আমল না দিয়ে জুয়েল বলে, “যা বুঝ না, তাই বল কেনে? দাদা আমার তরে কত ভরসা করে জান? সবুর করলে মেওয়া ফলে। দাদা জিতলে দিন বদলে হবে। সেচের জল মিলবে, চাষ হবেক আমাদের কসুমটিকরিতে, বাপের সেই টাঁড় জমিনটা রুইব তখন। গাঁয়ের লোকে গাঁয়েই কাজ করবে, ভিন গাঁয়ে যাইতে হবেক লাই। শুধু একবার দাদারে জিতে এমএলএ হইতে দ্যাও।” সরলা হাঁ করে শোনে জুয়েলের কথা, আশার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ডাগর চোখ দুটো। আবেশে জড়িয়ে ধরে জুয়েলকে। সরলার স্পর্শে জুয়েলের শরীর মন উদ্বেলিত হয়, জাপটে ধরে আদর করে বুকের আড়ালটুকু সরিয়ে নেয় সরলার, নিমেষে মিশে যায় দুটি আদিম মানুষের শরীর।
গত পনেরো দিন যাবত জুয়েলের রাত দিনের ঠিক ছিল না। একটা ভোটের ঝক্কি তো আর কম নয়। ভোট মেটার দুদিন পরে হারাধন কয়েকজন একনিষ্ঠ কর্মীর সঙ্গে বসল, বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চলল খানাপিনা, মদের ফোয়ারা ছুটল আর তাতে ডুব দিল জুয়েল, রাতে ঘরে ফিরল প্রায় বেঁহুশ হয়ে। সরলা আবিষ্কার করল নতুন চেহারার জুয়েলকে। এতদিন যে লোকটা ন মাসে ছ মাসে মদ ছুঁত, তাকে একেবারে বেসামাল দেখে সরলার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। কদিন ধরে এমনিতেই জুয়েলের পাত্তা নেই, ঘরে বউটা কি খেল না খেল সেই খবরটুকু পর্যন্ত রাখে নি; এদিকে হাতের টাকাপয়সাও যা ছিল প্রায় শেষ। সরলার মেজাজ সপ্তমে চড়ল। কথাকাটাকাটি থেকে ঝগড়া আর মেজাজ হারিয়ে সরলার গায়ে হাত তুলে বসল জুয়েল। হতবাক সরলা প্রতিবাদ করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলল। শারীরিক আঘাতের থেকেও অনেক বেশি মানসিক আঘাত পেল সরলা। সেই রাতেই রাগ করে ঘর ছাড়ল জুয়েল। সারারাত হালদারদের মন্দিরের দাওয়ায় কাটিয়ে, সকালে নেশা ছুটতে ঘরে ফিরে দেখল সরলা নেই। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল জুয়েলের। সারাদিন অনেক খোঁজাখুঁজির পরে শেষ পর্যন্ত থানায় গেল জুয়েল। থানা থেকে ফিরে ফাঁকা ঘরে অসহ্য লাগল; কাছের মানুষ না থাকলে ঘর কি ঘর থাকে? আজ রাতেও মন্দিরের দাওয়ায় শুয়ে কাটাবে ভেবে অবসন্ন শরীরে ঘর ছাড়ল জুয়েল।
“তোর কি বুদ্ধি হবেক লাই? ঘরের বউয়ের গায়ে কেউ হাত তুলে?” হারাধনের ফোন পেয়ে অবাক হয়ে গেল জুয়েল। দাদা কি ভাবে জানল আকাশপাতাল ভেবেও মাথায় এল না। আমতা আমতা করে বলল, “সে দাদা, আমার বেবাক দোষ হইয়েছে, নেশার ঘোরে টুক ভুল কইরে ফেলেছি। কিন্তু বেটিছেলে কুথায় গেল কে জানে!” গলা ধরে এল জুয়েলের। হারাধন ধমক দিল ফোনের ওপাশ থেকে, “কুথায় আর যাবে, বেটিছেলের বুদ্ধি আছে বটেক। উয়ার ফোন পাইয়ে বলে দিলাম আমার কাছে চলে আসতে, তুয়ার সঙ্গে থাকবে না বুলল যে।” খ্যক খ্যক করে হাসল হারাধন মাল, তারপর বলল, “বেটিছেলে কোলকাতার বাস ধইরে, ঠিকানা খুঁজে ঠিক চলে আইলো আমার কোলকাতার বাসায়; বুদ্ধি ট দেখ। তা আইসে যখন পড়েছে, থাক কিছুদিন, কলকাতায় পরিবার ছাইড়ে একা থাকি, দেখভাল করার কেউ লাই। তুয়ার বউটা বড় ভালো, নিজে থেকে থাকতে চাইছে যখন থাক কটা দিন। গণনা মিটে গেলে না হয় এসে লিয়ে যাবি। তুয়ার হাত খরচার টাকা সরলার হাতে দিয়ে দিব, উসব লিয়ে ভাবতে হবেক লাই। আর হ্যাঁ, থানার ডাইরি ট তুলে নিস। বলবি বউ ট ভিন গাঁয়ে আত্মীয় ঘর গেছে।”
ফোন ছেড়ে হতবাক হয়ে বসে রইল জুয়েল, বুকের ভিতর উথালপাথাল চলছে দুদিন ধরে। হৃদপিণ্ডের সবটা জুড়ে থাকা যত্নে লালিত স্বপ্নগুলো দুমড়ে মুচড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে জল হয়ে। চারপাশটা ঝাপসা হয়ে এল নিমেষে, বৃষ্টি নামল ঝুপঝুপিয়ে, কসুমটিকরির শুখা মাটিতে জল থাকে না জেনেও।