দেয়াল ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। এ বছর বর্ষা বেশ দরাজ। আষাঢ় পড়তে না পড়তেই আমানির মতো ঘোলাটে মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। বৃষ্টিও হয়েছে ভালো। পুকুর, ডোবা, খানাখন্দ সব টাবটুব করছে। খেপে উঠেছে বাঁশঝাড়, আগাছার বাদাড়। হ্যারিকেনের আবছা আলোয় বারান্দায় বসে রয়েছে ভূষণ। এই তল্লাটে একবার বিদ্যুৎ গেলে চট করে আসে না। পুরনো একটা হাতল-অলা চেয়ারে বসে গালে হাত রেখে গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে। একতলা কড়ি-বরগা দেয়া পৈতৃক বাড়িটার হাল খারাপ। দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়ে বেরিয়ে এসেছে নোনা ধরা, ক্ষয়ে যাওয়া ইটগুলো। ছাদ চুঁইয়ে এখানে-ওখানে জল পড়ছে। আশু মেরামতি প্রয়োজন নইলে কোনদিন ছাদের তলায় চাপা পড়েই ভবলীলা সাঙ্গ হবে। কিন্তু ভূষণের সে সামর্থ্য নাই। বর্ষা ওর বড় প্রিয় অথচ আষাঢ় এলেই দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে মুখে-চোখে। চওড়া উঠোনের এক কোণে তুলসী মন্দির। বাড়ি ঢোকার মুখে জুঁইফুলের গাছটা সাদা হয়ে উঠেছে। গন্ধে ম-ম করছে বাড়ির আশপাশ।
রঞ্জনা রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে এসে ভূষণের হাতে দিয়ে বললো, “কী এত ভাবছো?” ভূষণ গরম চায়ে ফুঁ দিয়ে একটা চুমুক দিল, তারপর রঞ্জনার মুখের দিকে চেয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও পারলো না। একটু ইতস্তত করে আবার চোখ ফেরালো উঠোনের দিকে। বয়ে চলা জলের ধারায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে অসংখ্য বুদবুদ তৈরি হয়ে ফেটে যাচ্ছিল। ভাঙ্গাগড়ার খেলা চলছিল যেন। বারান্দার বাঁ-দিকের কোণে জল টিপচ্ছে দেখে রঞ্জনা একটা বালতি নিয়ে এসে জায়গামতো পেতে দিতেই টপটপ আওয়াজে ভেঙে যেতে লাগলো বারান্দার নিস্তব্ধতা। এতক্ষণ যদিও বা সহ্য হচ্ছিল, এবার একেবারেই অসহ্য হয়ে উঠল। ওই আওয়াজ কাঁটার মতো বিঁধতে লাগলো ভূষণের বুকে। বড্ড অসহায় লাগছিল ওর। রঞ্জনা ভূষণের কষ্টটা বুঝতে পেরে কাছে এসে বললো, “অত চিন্তা করো না তো, দেখবে এবারের শারদ সংখ্যায় তোমার লেখা উপন্যাসটাই সিলেক্ট হবে। বড় লেখক হবে তুমি। তখন আর অভাব থাকবে না আমাদের।” ভূষণ যেন শুনেও শুনতে পেল না কথাগুলো। রঞ্জনা জিজ্ঞেস করলো, “রাতে কী খাবে? ভাত না রুটি?”
লেখাকে জীবিকা করা ইস্তক ভূষণের সংসারে অনটন। তবু লেখা ছাড়তে পারে নি ও। রঞ্জনা ওকে অনেকরকম রুজি রোজগারের উপায় বাতলে দিয়েছিল, কিন্তু কোনোটাই মনে ধরে নি ওর। শেষ পর্যন্ত কম্পোজিটরের কাজ শিখে একটা ছাপাখানায় কাজ নিয়েছিল। রোজগারপাতিও মন্দ হতো না। বাপ-ঠাকুরদার রেখে যাওয়া বিঘে খানেক ধানি জমি ভাগে দিয়ে যা ধান, চাল পেত আর যা দু-চার পয়সা রোজগার করতো তাতেই কষ্টেসৃষ্টে কেটে যেত ওদের। কিন্তু যখন বুঝতে পারলো অবসর যাপন ছাড়া লেখালেখি অসম্ভব, তখন ছাপাখানার কাজটা ছাড়তে দ্বিতীয়বার ভাবে নি ও। ভূষণের ভাবনা আর আবেগকে সম্মান দিয়েছিল রঞ্জনা। যদিও এমনটা কমই দেখা যায়। আসলে রঞ্জনার মধ্যেও নিহিত রয়েছে এক শিল্পীসত্তা যা ভূষণের লেখকসত্তার প্রতি প্রেমকে দিনদিন বাড়িয়ে তুলেছে। ভূষণের সব পাগলামিকে অন্ধের মতো সমর্থন করে আরও পাগল করে তুলেছে ওকে।
ভূষণ সবসময় কিছু যেন ভাবে। উদ্ভট সব চিন্তা মাথায় আসে ওর। আর সেইসব চিন্তাভাবনা লিখে লিখে পাতা ভরায়। তারপর লেখাগুলো ফ্রেশ করে নামীদামি পত্রপত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়ে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে। কখনোসখনো ওর সব উদ্ভট চিন্তাকে স্বীকৃতি দিয়ে লেখা মনোনয়নের চিঠি পাঠান সম্পাদক মহাশয়েরা। সঙ্গে পাঁচশো, হাজার টাকার চেক। তাতেই মন ভরে যায় ওর। বাড়ির দরজায় ক্লিং ক্লিং শব্দ করে ডাকপিওন যখন চিৎকার করে বলে, চিঠি আছে, উচ্ছ্বসিত হয়ে এগিয়ে যায়। ওই চিঠি ওর জীবনে পরম প্রাপ্তি। আর যৎসামান্য মূল্যের চেক ওর লেখার রসদ। যেন হীরে জহরত পায় ও। সই করে দিয়ে চিঠি আর চেকটা নিয়ে এসে রঞ্জনার হাতে দিয়ে বলে, “দেখো রঞ্জনা, একদিন আমার লেখা সবাই পড়বে। পৃথিবীর কোনায় কোনায় পৌঁছে যাবো আমি।” চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে রঞ্জনার। ভাবে এই পাগল মানুষটাকে কে বোঝাবে, এইভাবে চললে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে শেষে পথে দাঁড়াতে হবে। তবু ভূষণকে নিরুৎসাহিত করে না, বলে, “ঠিকই তো! তোমার মতো ক’ জন লিখতে পারে? কত সহজভাবে কত কঠিন বিষয় লিখতে পারো তুমি। তোমাকে নিয়ে আমার গর্ব হয় গো!” ভূষণও নতুন উদ্যমে মনের মধ্যে জমে ওঠা কথাগুলো লিখতে বসে যায়।
ভূষণ রঞ্জনার দিকে চেয়ে বললো, “রুটি,” পরক্ষণেই জিজ্ঞেস করলো, “নুমি কোথায়? কী করছে ও?” নুমি ওদের একমাত্র মেয়ে। সবে চার পূর্ণ হয়ে পাঁচে পড়েছে। এখনো স্কুলিং শুরু হয় নি। মায়ের কাছেই অ-আ-ক-খ পড়ে। লেখালেখি করতে গিয়ে মেয়েকেও ঠিকমতো সময় দিতে পারে না। রঞ্জনা বললো, “শোবার ঘরে, বোধ হয় পুতুল নিয়ে খেলছে। ডেকে দেব?” একটা ইতিবাচক ভঙ্গিতে ভূষণের মুখটা প্রসন্ন হয়ে উঠল, বললো, “না থাক, খেলছে খেলুক।” রঞ্জনা যা বোঝার বুঝলো। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে হাঁক দিল, “নুমি, বাবা তোমায় ডাকছে।” নুমি যেন এই ডাকটার অপেক্ষায় ছিল। অমনি এক ছুট্টে ঘর থেকে বারান্দায় এসে বাবার কোলে উঠে আধো আধো গলায় বললো, “গল্প বলো বাবা, সেই চুরুলির গল্পটা!” ভূষণ মেয়েকে আদর করে বললো, “ওরে বাবা, সে যে ভয়ানক গল্প! তোমার ভয় করবে যে।” নুমিও নাছোড়। ও চুরুলির গল্পই শুনবে। আগেও দু-একবার গল্পটা বলেছে ভূষণ। ভূতের গল্প বললে কান খাড়া করে শোনে নুমি। চুপটি করে বসে থাকে বাবার কোলে। তারপর মা ডাকলেই দৌড়ে গিয়ে কোলে চড়ে। নুমি বললো, “না, না, ভয় করবে না; আমি তো বড় হয়ে গেছি।” নুমির কথা শুনে হাসি পেল ভূষণের, বললো, “তাই তো! আমার নুমি কত্তো বড় হয়ে গেছে। আমি বুঝতেই পারি নি। ঠিক আছে, শোনো তবে।” গল্প বলতে শুরু করলো ভূষণ—
আমার মামাবাড়ির পাশের গ্রাম হলো পলাশপুর। সেই গ্রামে ছিল এক বিশাল দিঘি। এখন আর নাই। গাঁয়ের সবাই মিলে বুজিয়ে দিয়েছে। সেই দিঘিতে চান করা তো দূরের কথা, পাড় দিয়েও যেতে পারতো না গাঁয়ের লোকেরা। দিঘির জল কেউ কোনোদিন শুকোতে দেখে নি। এমনকি যে বছর প্রচণ্ড খরা হতো, মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে যেত, পুকুর, ডোবা, নদী, নালা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত, সেবারেও টলমল করতো দিঘির জল। দিঘির মাঝখানেএকটা কুয়ো ছিল। সেই কুয়োতে থাকতো একটা চুরুলি। লাল চোখ, হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চুল, ইয়া লম্বা লম্বা নখ। মাঝেমধ্যেই ডাঙায় উঠে চুল এলিয়ে রোদ পোহাত। যদি কেউ একবার চুরুলির চোখে পড়ে যেত আর রক্ষে থাকতো না তার। একেবারে তাকে সঙ্গে নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়তো জলে। এক, দু-দিন পরে ফুলে ঢোল হয়ে ভেসে উঠতো। একদিন এক নাপিত-বউ দিঘির পাড় দিয়ে বিষ্ণুপুর যাচ্ছিল। পথেই এক সুন্দরী বউমানুষের সাথে দেখা। নূপুর পায়ে ঝুমঝুম করতে করতে ঘাটের দিকে যাচ্ছিল। নাপিত-বউ জিজ্ঞেস করলো, “হ্যাঁ গা, তুমি কাদের বাড়ির বউ গা? একলা এই ঘাটেই বা এয়িছো ক্যানে?" বউটি খিলখিলিয়ে হেসে বললো, “কেন গো? এ দিঘিতে ভূত আছে নাকি?” নাপিত-বউ গলা নামিয়ে বললো, “এ কথা কেউ তোমায় কয় নি বুঝি?” বউটি বড় বড় চোখ করে বললো, “কই না তো!” চোখে চোখ পড়তেই নাপিত-বউয়ের মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। কেমন যেন নেশা ধরানো চোখ। এমন চোখ ও কখনও দেখে নি। নাপিত-বউয়ের আর বুঝতে বাকি রইল না, এই সেই চুরুলি, বউমানুষের রূপ ধরেছে। নাপিত-বউ দেখলো মরণ তার নিশ্চিত, তবু মরার আগে একবার বুদ্ধি খাটিয়ে দেখতে দোষ কী? হাসি হাসি মুখ করে বললো, “মা, তুমি বউমানুষ, এট্টু আলতা পরিয়ে দি?” চুরুলি নাপিত-বউয়ের চালাকি ধরতে পারলো না। আহ্লাদে গদগদ হয়ে ঘাটের পাড়ে বসে পড়লো। নাপিত-বউ দেখলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই ওকে পালাতে হবে। চুরুলিটাকে খুশি করার জন্য বললো, “মা, তোমার অমন সুন্দর পা; যে-সে নক্সা ভাল লাগবে নেকো, বৈঁচির কাঁটা তুলে আনি, পিঁপড়ের সার দিয়ে দিব, ক্যামন?” চুরুলির তখন আনন্দ আর ধরে না! ঘাড় নেড়ে বললো, “যাও, তাড়াতাড়ি আনো গিয়ে।” নাপিত-বউ তখন বৈঁচির কাঁটা খোঁজার ছলে এক পা, দু-পা করে বেশ কিছুটা তফাত হতেই বাবাগো, মাগো, গেছিগো বলে মারলো ছুট্। তাই দেখে চুরুলিটা নিজের রূপ ধরে হিঁ হিঁ করে হাসতে শুরু করলো। তারপর “যাঁ যাঁ, বেঁচেঁ গেঁলিঁ,” এই বলে লোকজন জড়ো হওয়ার আগেই ঝুপ করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
নুমি জানে, গল্পটা এখানেই শেষ। আগেও শুনেছে ও। ওর একটা বড় গুণ হলো, গল্প বলার মাঝে আর সব বাচ্চাদের মতো হাজারটা প্রশ্ন করে না। মন দিয়ে শোনে আর ভাবতে থাকে। পরে সেইসব গল্পগুলোই পাড়ার বন্ধুদের বলে। গল্প বলার সময় এমন কিছু যোগ করে যা ভূষণ বা রঞ্জনার বলা গল্পে থাকে না। নুমির এই ক্ষমতা দেখে ওরা বলাবলি করে, ওদের মেয়ে একদিন মস্ত বড় সাহিত্যিক হবে। গল্প শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল নুমি। রান্নাঘর থেকে রঞ্জনা হাঁক পাড়ল, “হ্যাঁ গো, নুমি ঘুমিয়ে পড়লো নাকি?” মায়ের ডাক শুনে ভূষণের কোল থেকে নেমে এক ছুট্টে রান্নাঘরে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো রঞ্জনাকে। নুমিকে কোলে করে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে রঞ্জনা বললো, “যত সব আজগুবি গল্প বলে শুধু শুধু ভয় পাইয়ে দাও মেয়েটাকে। নাও, এবার সামলাও?” ভূষণ মৃদু হাসলো। মুখে কিছু বললো না।
মেয়েকে খাইয়েদাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রঞ্জনা যখন বারান্দায় এল, দেখলো ভূষণ আধ-শোয়া অবস্থায় ঝিমোচ্ছে। ভূষণের মায়া জড়ানো মুখটা ওর সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। মাথায় হাত দিতেই চোখ মেললো ভূষণ। রঞ্জনা বললো, “খাবে এসো।” ভূষণ জিজ্ঞেস করলো, “নুমি ঘুমিয়েছে?” ভূষণের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো, “এইমাত্র ঘুমলো।”
হাত ধুয়ে খেতে বসলো ভূষণ। একটা থালায় গোটা তিনেক রুটি, একটু আচার, এক কুচি পেঁয়াজ, একটা লঙ্কা আর বাটিতে করে খানিকটা ছোলার ডাল বেড়ে দিলো রঞ্জনা। নিজেও নিল। খেতে খেতে কথাটা পাড়লো ভূষণ, যেটা সে সারাদিনে বলবো বলবো করে বলে উঠতে পারে নি। বললো, “আজ বাজার যাওয়ার পথে শিবেনের সঙ্গে দেখা। ও আমাদের জমিটা কিনে নিতে চায়।” জমি বিক্রির কথা শুনে ছ্যাঁৎ করে উঠল রঞ্জনার বুকের ভেতরটা, বললো, “দেখো, পৈতৃক সম্পত্তি বলতে ওই জমিটুকু; বাড়ির যা অবস্থা, কোনদিন ভেঙে পড়ে ঠিক নাই; এটুকুও যদি বেচে দাও তাহলে যে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে যাবো!” ভূষণ বললো, “দেখো, চাষবাস আমার দ্বারা হবে না, সারাবছর জমি থেকে যা পাই তা দিয়ে ছ-মাসের খাবারও হয় না। তার চেয়ে জমিটুকু বেচে যা টাকা পাবো, তাতে বাড়িঘর মেরামতি করেও যা পড়ে থাকবে যদি পোষ্ট-অফিস বা ব্যাঙ্কে রাখি যা সুদ পাওয়া যাবে তাতে কোনোরকমে চলে যাবে। আমি অনেক ভেবেচিন্তেই জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” রঞ্জনা জানে, অভাবের সংসারের জ্বালা সুদের টাকায় মিটবে না। বিচলিত হয়ে বললো, “তোমার কোনো কাজেই কোনোদিন বাধা দিই নি, তুমি যেটা করো ভেবেচিন্তেই করো, তবু আমার মন সায় দিচ্ছে না। অন্তত, মেয়েটার কথা ভাবো।” ভূষণের খাওয়া শেষ হয়ে এসেছিলো, শেষ গ্রাসটা মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বললো, “তুমি কি মনে করো, আমি নুমির কথা ভাবি না। ওকে আমি এমন তৈরি করবো যে এসবের দরকারই পড়বে না। তাছাড়া ছাদটা না সারালে কোনদিন সকলে চাপা পড়বো যে!” কথাটা সত্যি। রঞ্জনা জানে ভূষণ যখন একবার মনস্থির করে ফেলেছে জমি সে বেচবেই, আর তাকে আটকানো যাবে না। বাধা দেওয়া বৃথা। খাওয়া শেষ করে বাসনগুলো গুটিয়ে এঁটো নিতে নিতে বললো, “যা ভালো বোঝো করো।”
আজ সারাদিন মনের সাথে দ্বন্দ্ব চলেছে। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতেও কম কষ্ট হয় নি। কিন্তু এছাড়া আর গত্যন্তর নাই। কেবল সঙ্কোচ হচ্ছিলো রঞ্জনার সামনে কথাটা কিভাবে বলবে। যদিও ও জানে রঞ্জনা শেষমেশ ওর সিদ্ধান্তই মেনে নেবে, তবু বিনা প্রতিবাদে মেনে নেওয়ার ব্যাপারটা আরও বেশি মুশকিলে ফেলে দেয়। যাই হোক, জমিটুকু বেচে দিলে যখন আশু সমস্যা মিটছে, তখন সেটা করাই শ্রেয়। কারণ ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে বর্তমানকে নষ্ট করতে চায় না ও। কাজকর্ম সেরে রঞ্জনা যখন শুতে এল, রাত এগারোটা। বৃষ্টির বেগ মাঝে কিছুটা কমেছিলো, আবার ঝেঁপে এল। কথাটা বলতে পেরে অনেকটাই স্বস্তি পেয়েছে ভূষণ। জমিটা বিক্রি হলে ওর সব দুশ্চিন্তার অবসান হবে। বিছানায় শুয়ে রঞ্জনার জন্য অপেক্ষা করছিলো। রঞ্জনা পাশে শুতেই পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো ওকে। রঞ্জনা ভূষণের এই স্বভাবের সাথে পূর্ব পরিচিত। যখনই ভালো কিছু ঘটে, আবেগ চেপে রাখতে পারে না। জড়িয়ে ধরে আদর করে ওকে। জমি আর ভিটেটুকুই ওর সম্বল অথচ ওর চিন্তা-ভাবনা, লেখালেখির প্রধান অন্তরায়। অন্তত একটা বাধা কমবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ভূষণের বুকে মিশে গেল। আরও বাড়লো বৃষ্টির বেগ।
দেয়ালঘড়িটা কাত হয়ে ঝুলছে। বেলা এগারোটা। বৃষ্টি থেমেছে। মেঘলা আকাশ। খাঁ খাঁ করছে বারান্দা। রঞ্জনা আর ভূষণ মিলে ভাঙাচোরা ইটগুলো সরিয়ে উঠোনের একপাশে জড়ো করছে। চাতালে বসে শুকনো মুড়ি চিবোচ্ছে নুমি। খুব কপাল জোর তাই প্রাণে বেঁচেছে ওরা। ভোর পাঁচটা নাগাদ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে বারান্দার বাঁ-দিকের দেয়াল-সহ ছাদের কিছুটা অংশ। বিকট আওয়াজ শুনে ছুটে আসে প্রতিবেশিরা। ততক্ষণে হতচকিত হয়ে বেরিয়ে এসেছে ওরা। ওদের জীবিত দেখে স্বস্তি পায় সকলেই। খানিকক্ষণ কলরব করে যে যার বাড়ি ফিরে যায়। কেউ কেউ পরিহাস করতেও ছাড়ে না। এটুকু ভূষণের প্রাপ্তি ছিলোই।
দরজায় ক্লিং ক্লিং শব্দ করে ডাকপিওন হাঁক দিলো চিঠি আছে। হাতের ইট ফেলে রঞ্জনার দিকে তাকালো, তারপর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলতেই একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে সই করিয়ে নিল পিওন। খামে প্রেরকের ঠিকানা দেখে আনন্দে বিহ্বল হয়ে গেল ভূষণ। খাম ছিঁড়ে চিঠিটা বের করে পড়তে শুরু করলো—
মাননীয়,ভাঁজ করা চেকটা খুলে অবাক হয়ে গেল। বেশ মোটা অঙ্কের। চিঠি আর চেকটা রঞ্জনার হাতে দিল। আনন্দের ধারা নেমে এল দুজনের চোখ বেয়ে।এবারের শারদ সংখ্যায় আপনার পাঠানো উপন্যাস মনোনীত করতে পেরে আমরা গর্বিত। সাম্মানিক স্বরূপ যৎসামান্য মূল্যের চেক পাঠালাম। ভবিষ্যতে আরো লেখা পাঠাবেন আশা রাখি। আপনার সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করি।
নমস্কারান্তে—
বসন্ত কুমার
সম্পাদক
আঁধারে আলো পত্রিকা