শোনা যায়, পুরনো বে স্টেশনে সাদা কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায় একটি মেয়ে। কবে, কোন্ অতীতে সে মরে গিয়েছিল কেউ জানে না; তবে অনেকেই দেখেছে মেয়েটিকে।
রাত একটার শেষ ট্রেনে বে স্টেশনের একমাত্র যাত্রী ছিল গ্রেগর। সে দেখতে পায়, প্ল্যাটফর্মের পশ্চিম অংশের অন্ধকার দিক থেকে এগিয়ে আসছে মেয়েটি। মার্বেল পাথরের মেঝেতে পিছলে আসছে মেয়েটি--তারই দিকে। অপেক্ষমান গ্রেগর ট্রেন আসতে দেখে প্ল্যাটফর্মের একদম কিনারায় বুটিদার হলুদ অংশে এসে দাঁড়ায়--ট্রেন আসা মাত্রই উঠে পড়ে হাঁপ ছাড়ে।
বার্গার কিংয়ে বসে গ্রেগর সাদা পোশাকের মেয়েটিকে দেখেছে বলে জানায়।
‘তোমার হ্যালোসিনেইশন হয়েছিল।’
‘না। হ্যালোসিনেইশন মনোরোগের একটা লক্ষণমাত্র। মনোবিকার বা মনোরোগ আমার নেই।’
গ্রেগরের কথা বিশ্বাস করল জাবের। রাস্তায় একটা কালো বেড়াল দেখলে যাত্রা মাটি হয়ে যায় বলে যাদের প্রতীতি হয়, তাদের ব্যাপারে সংস্কার-কুসংস্কার দু’টি বিষয়ই মেনে চলা নেহাৎ আবশ্যক।
উভয়ের জীবনে ঈশ্বর প্রদত্ত একটা ট্র্যাজিক সাদৃশ্য ব্যাপ্তমান। এরা দু’জন পত্নী-হারা। গ্রেগরের পত্নীবিয়োগ ঘটেছে কর্কট রোগে, আর জাবেরের অর্ধাঙ্গিনীর জীবনাবসান হয় সন্তান বিয়োবার প্রাক্কালে। স্ত্রী গত হবার পর অবসাদে ভুগে ভুগে গ্রেগর ভালো জবটা ছেড়ে দিল। কিছুদিন সে ঘর থেকে বেরোয়নি। ভোদকা বা হুইস্কি খেত, জিনিসপত্র ভাঙচুর করত। তারপর একদিন সে অর্থের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। সিকিউরিটি কোম্পানিতে আবেদন করে। রাতের কাজ গ্রেগরের পছন্দ রাতে ঘুম হয় না বলেই। সেই চাকরির ইন্টারভিউতে জাবেরও ছিল। দু’জনই চাকরি পেল; নিযুক্ত হলো একটা কনস্ট্রাক্শন সাইটে। সেখানেই বন্ধুত্ব, রাতভর গল্প করত দু’জন।
তারপর বিচ্ছেদ।
খেপে গেল গ্রেগর। সুপারভাইজারের এক প্রশ্নের উত্তরে সে সশব্দে বায়ু নির্গত করল। বিজ্ঞ পাকিস্তানি সুপারভাইজার গায়ে মাখল না--বায়বীয় বিষয় গায়ে মাখানো যায় না।
গ্রেগর বলল, ‘কন্ডোর ডিউটি? দরজা মনিটর করা, সুইচ টিপে গ্যারাজ খুলে দেয়া, অতিথিদের পার্কিং পাস দেয়া, এসব তো?’
‘এসবই। আমাদের সিস্টেম তা-ই বলে।’
গ্রেগর আবার বায়ুত্যাগ করে।
সুপারভাইজার আলতাফ খান অন্যদিকে মুখ ফেরাল।
‘দরজা দিয়ে রাত দুপুরে যে ঢুকবে, সে মাতাল ও কন্ডোর একটা অ্যাপার্টমেন্টের মালিক। তাকে আমি কীভাবে না ঢুকতে দিতে পারি?’
‘ঢুকতে দেবে, যাতে সে গণ্ডগোল না-করে ঢোকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’ সুপারভাইজার বলল, ‘প্রয়োজনে কপ ডাকবে।’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হয় গ্রেগর।
জাবেরকে দেয়া হলো এটোবিকো’র এক জংলি এলাকার কন্স্ট্রাকশন সাইটে।
রোমেনা ও কেটি আকাশের দেবীদের মতো ওদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল--দুই মেরুর দুই বাসিন্দাকে তারা নিয়মিত মনিটর করে চলল সিসি ক্যামেরার মতো।
কন্স্ট্রাকশন সাইটের সিসি ক্যামেরায় জাবের সাইট মনিটর করে। আর গ্রেগর কন্ডোতে বসে পুন:পুন: বায়ুত্যাগ করে কিনা জানার উপায় রইল না। গ্রেগর বদলিস্থল কন্ডো সম্পর্কে কিছুই বলেনি আর।
ড্যানফোর্থ এলাকায় দু’জনের বসবাস। শিফটিং ডিউটি হলেও দুইজনের হপ্তায় অন্তত একবার মিলিত হবার সুযোগ ঘটে যায়। আর এই দিনটাতে পানপর্ব চলে, লাঞ্চ-ডিনার হয়। তারা প্রথমে আসে বার্গার কিংয়ে। কফি ও অনিয়ন রিং খেয়ে শরীর ঝরঝরে করে, কথার সূত্রপাত ঘটায়। কেটি ক্যানেডিয় সিডায় কাজ করার সুবাদে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়েছিল। কেটি বাংলাদেশের গাঁও-গেরাম ও সেসবের মানুষগুলোকে ভালবাসত। বিয়ের পর সে গ্রেগরকে বাংলাদেশ ঘুরিয়ে দেখায়।
‘থোমার খবর কী?’ গ্রেগর মুচকি হেসে বাংলায় বলল।
‘খবর আর কী, জঙ্গলে পড়ে আছি।’
গ্রেগর হাসল।
গ্রেগর নীল রঙের বুইক নিয়ে আসে। সেই গাড়িতে চড়ে পান করতে আর নতুন খাবারের সন্ধানে কিংবা দূরের কোনো টিম হরটনে চলে যায় দু’জন। জাবেরের জানা নেই গ্রেগরের মতো চমৎকার বিপত্নীক পুরুষ পৃথিবীতে ক’টি আছে। সে আইফোন ব্যবহার করেনা, নেহাৎ প্রয়োজনে একটা সাধারণ ফোন ব্যবহার করে। অতিযান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সে। তার মতে, সাবওয়েতে বিলাসবহুল কার যোগ না করে সেই টাকায় বেশি সংখ্যক হাসপাতাল এবং ওল্ড হোম করা উচিত। সে কাচের ভেতর থেকে আঙুল উঁচিয়ে রাস্তার ওপারে টরোন্টো ডমিনিয়ন ব্যাংকের কুটির-মার্কা বিল্ডিং দেখিয়ে বলল, ‘শ্বশুরমশাই এই আদল পছন্দ করতেন। তিনি টিডি কর্তৃপক্ষকে বহুবার পত্র দিয়েছেন এরকম ভবনের আকার-আকৃতি পরিবর্তন না করতে।’
‘হুম।’
‘আমি লিঙ্গুইস্টিক্স-এর শিক্ষক। ভাষা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালোবাসি। পার্টটাইম ইনুকটিটুট পড়াতাম। আমার বাবাও ভালোবাসতেন পূর্বাঞ্চলীয় ক্যানেডর এই ভাষা। আর জানো, কেটি অনেককিছু জানত। ভাষাতেও ওর চমৎকার দখল ছিল।’
মাঝেমধ্যে জাবেরের মনে হয়, জীবনের অনেক পাপ সে করেছে; কিন্তু গ্রেগরকে কোনো পাপ কখনও স্পর্শ করেনি। গ্রেগরের কাছে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়।
তখন তার মানসপটে জেগে ওঠে রোমেনা। যে একদিন এসেছিল ওর জীবনটাকে রাঙিয়ে দিতে।
‘এই বলো না, আমি তোমার জীবনে কেমন রং হয়ে এসেছি?’
‘পলাশ-রাঙা হয়ে।’
জাবের ওকে নিয়ে গিয়েছিল গ্রামে। মুগ্ধ হয়ে রোমেনা দেখেছিল ফাল্গুনের শিমূল-পলাশের গাছ। প্রায় পাতাবিহীন গাছগুলোয় থোকা থোকা ফুলের মেলা রোমেনাকে পুলকিত করেছিল। পলাশ দেখে আসার পর থেকে রোমেনা বারবার পলাশের গল্প করত। যেন জাবের তাকে গুচ্ছ গুচ্ছ গহনা গড়িয়ে দিয়েছে।
এখন জাবের ভাবে--কোথায় সেই শিমূল-পলাশ, আর কোথায় ওল্ড বে স্টেশন! মাত্র একটি যুগ। এই এক যুগকে মনে হয় কতশত যুগ! আবার মনে হয়, এই তো সেদিন।
ওল্ড বে স্টেশনের মেয়েটি কোথায় থাকে? ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠে? কী খেয়ে বেঁচে আছে সে? নাকি কিছু খায় না? সে কি কায়া নাকি ছায়া? সে কেন আসে পৃথিবীতে, কী লাভ এসে? গ্রেগর বলেছিল--কেউ যদি মরে গিয়ে অতৃপ্ত হয়ে দুনিয়াতে ঘুরে বেড়ায়, তা যুক্তিগ্রাহ্য না হবার কোনো কারণ নেই। সে জানাল, তার নাকি মনে হয়, জাবেরও একদিন দেখবে ওকে।
সে কেটিকে অত্যন্ত ভালোবাসত। জাবের ওকে সান্ত্বনা দেয় না। মনে মনে ভাবে--দু:খ ওর জন্য বিলাসিতা নয়; ওর জীবনের সঙ্গী।
পরদিন ডিউটি না থাকায় এক শনিবার রাতে গ্রেগর গলা অবধি গিলল। জাবের মনে মনে প্রস্তুতি নিল ড্রাইভ করে ওকে পৌঁছে দেবার। সে ওর গাড়ির অটো কি নিয়ে নিল।
***
রোমেনার কয়েকবারই ব্যথা উঠেছিল। ফের ঠিক হয়ে গিয়েছিল। শেষবার ব্যথা উঠেছিল এক সন্ধেয়। জাবের অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে তন্দ্রায় লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল--রোমেনার কাতর ধ্বনি শুনতে শুনতে ঘুমে তলিয়ে গেল। সকালে উঠে দেখল রোমেনা ঠোঁট নাড়ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।
জাবের অ্যাম্বুলেন্স ডাকল। বাহনটার ভেতরে নাকে অক্সিজেন নিয়ে রোমেনা তাকিয়ে ছিল জাবেরের দিকে।
রোমেনার দুই চোখের কোণের অশ্রু মুছে দিল জাবের। বলল, ‘তোমার ছেলে হবে।’
রোমেনা জবাব দিল, ‘হুমম।’
‘এখন কেমন লাগছে?’
মুখে অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে রোবটের মতো যান্ত্রিক স্বরে রোমেনা বলল, ‘আমার ছেলেটাকে দেখে রেখো।’ আর কথা বলেনি রোমেনা। মাঝপথেই সে ইহলোক ত্যাগ করে।
***
গ্রেগরের বুইক অ্যালিউর চালিয়ে ওকে ওর থাইরা অ্যাভেনিউর হাউসে নামিয়ে দিলে জাবের। গ্রেগর টলতে টলতে ঘরে ঢুকে গেল।
জাবের হাঁটাপথে ফিরে এলো স্বদেশী ভদ্রলোকের বাড়ির বেইজমেন্টে।
এখানে সে আছে একা, রোমেনাবিহীন প্রায় একটি যুগ। এই এক যুগে সে একটা বাড়ি কিনতে পারত, কেনার স্পৃহা থাকলে। সিকিউরিটির কাজ করে অর্থ জমিয়ে একটা ডজ ক্যারাভ্যান কিনেছিল। সেটা প্রায়ই নানা যান্ত্রিক সমস্যায় ভুগত, সে গাড়িটা বিক্রি করে দেয়।
এই দেশে আসবার পরিকল্পনা ছিল রোমেনার। যে-সন্তান সে গর্ভে ধারণ করেছিল সেই সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়বে সে একটি সভ্য-উন্নত দেশে। যেদিন ওদের ইমিগ্রেশন ভিসা হয়ে গেল সেদিন জাবের রোমেনাকে নিয়ে ঘূর্ণির মতো ঘুরল।
‘এই থামো, বাবুর ক্ষতি হবে।’
জাবের থেমে গিয়েছিল।
ভিসাপ্রাপ্তির পর রোমেনা ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে লাগল। আসন্ন বাবুর কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে তার নিজের গরম কাপড়, প্রয়োজনীয় মেয়েলি জিনিসপত্তর, জাবেরের শার্ট-প্যান্ট-জিন্স কিনতে লাগল।
‘এই শোনো, বাবু হওয়া মাত্রই আমরা পাড়ি দেব।’
‘অবশ্যই।’
পাড়ি দেয়া হলো। কিন্তু একা...। রোমেনা পাড়ি দিল অজানা কল্পলোকে।
একদিন ভীষণ গর্বে পেটে হাত বুলাতে বুলাতে রোমেনা বলল, ‘টরোন্টো থেকে আমার বান্ধবী ফোন করেছিল। ফৌজিয়া ও তার বর সেখানে অনেকবছর ধরে সেটেল্ড। ওদের কাছাকাছি বাসা পাওয়া থেকে শুরু করে আমাদের সেটলমেন্টে সবরকমের সাহায্য ওরা করবে।’ প> কথাগুলো বলেছিল সে মৃত্যুর সাতদিন আগে। রোমেনার অনুরোধে জাবের ফোন করে ফৌজিয়ার হাজব্যান্ডের সাথে কথা বলেছিল। রাতভর ঘুমোয়নি রোমেনা, স্বপ্নাবিষ্ট ছিল সে একটা অজানা ও সমৃদ্ধ দেশে পাড়ি দেবার পুলকে। সেইরাতে সে জাবেরকে ঘুমাতে দেয়নি, কথার ফুলঝুরি ছুটিয়েছিল।
‘ওখানে বাবুর কোনো অসুবিধা হবে না তো?’
‘কোনো অসুবিধা হবেনা। তুমি বাবুকে আগলে রাখবে, আমি লেবার খেটে উপার্জন করব।’
‘তোমার শরীরটা তো ভালো যাচ্ছে না, কীভাবে খাটবে ওখানে?’ ‘শরীর ওখানে গেলে ভালো হয়ে যাবে, ক্লিন ওয়েদার, ভেজালমুক্ত ভাল খাবার। দেখবে সাতদিনেই তাগড়া হয়ে গেছি।’
‘হুমম।’
‘তাছাড়া, বাড়তি কিছু ডলার পাব। বাবুর চাইল্ড বেনেফিট। আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে পারব। তুমি ভেব না।’
***
গ্রেগর ক্রিসমাসের আগের রাতে ফোন করে ওর বাসায় আনল জাবেরকে। বাড়িতে সে আর তার বুড়ি মা। গ্রেগরের বাবা অলঝাইমারস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
গ্রেগর বেইজমেন্টের কক্ষের টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে নানাজাতের মদ। বেইজমেন্টের এই কক্ষে সে অনেকটা সময় একাকী কাটায়। সে বৈষয়িক বিষয়গুলোকে অবজ্ঞা করে। ভাড়া দিলে হয়তো মাসে ন’শ ডলার জুটত। এই নিয়ে মায়ের সাথে তার বাদানুবাদ হয়। তিনি চান বেইজমেন্টের ভাড়া দিতে, গ্রেগর তা চায় না। ফলে সম্প্রতি তার সাথে তার মায়ের দূরত্ব বেড়েছে।
কক্ষটায় স্বল্প আলোর বাতি জ্বলছে। বাইরের মাইনাস শীতল হাওয়ার আমেজ বদ্ধ ঘরটায়। গ্রেগর বলল, ‘ঠান্ডা আমারও লাগছে। বেইজমেন্টে হিট একটু কম আসে। ভাবছি হিটিং সিস্টেমটা রিপেয়ার করব। অবশ্য ম্যালা টাকা লাগবে।’
জাবের ঘাড় নাড়ল। সে মৃদু আলোয় গ্রেগরের মুখের দিকে তাকাল। গ্রেগর যেন স্বপ্নচারী। মিউজিক সিস্টেমে লো ভলুমে বাজছিল একটা গান;
Today has been a special day.
An anniversary, a request
That you play a piano
As the evening sun slowly sets….
জাবের অতি কল্পনায় আক্রান্ত হলো। সাদা গাউনে, চাপদাড়িতে একহারা গড়নের গ্রেগরকে যেন যিশুখ্রিস্টের মতো লাগছে। গানটার সুর স্বর্গীয়; বাইরে তুষারপাত। বেইজমেন্টের ছোট্ট স্লাইড জানালার ওপারে অন্ধকার গ্যারাজ। জানালায় আঁচড় কাটছে একটা র্যাকুন। গ্রেগর মুখোমুখি বসে একটুকরো পিজা মুখে পুরতে পুরতে বলল, ‘আজ আমাদের অ্যানিভার্সারি।’
গ্রেগর উঠল, আরেকটা কক্ষ থেকে সুদৃশ্য এক কৌটো নিয়ে এলো। টেবিলে সেটা রেখে খুলে বলল, ‘আমাদের দু’জনের এনগেজমেন্ট রিং।’
অ্যালকোহলের প্রভাবে, ঘরের পরিবেশে জাবের কম্পিত হাতে হীরের আংটি দু’টো তুলে নিল। সে বিহ্বল চোখে টাকায়। হঠাৎ হা-হা শব্দে হেসে উঠে গ্রেগর বলল, ‘তোমাকে এমন নার্ভাস লাগছে কেন?’
প্রত্যুত্তরে জাবের ভাঙাচুরা হাসি উপহার দিল।
জাবের বলল, ‘গানটা কে গাইছে?’
‘ইভা ক্যাসেডি। কেটির বয়সে মারা যায়। তেত্রিশ বছর বয়স ছিল। মরার পর স্বীকৃতি পেল। আমার মনে হয়, কেটি মারা যাবার পর যেভাবে এখন ওকে ভাবছি, বেঁচে থাকতে যদি ততটা ভাবতাম।’
‘ততটাই ভেবেছিলে। সেই ভাবনাগুলো আসলে একাকার হয়ে কেটির সাথে সাথে মিলিয়ে গেছে।’
‘কেটি ভালো মেয়ে ছিল। সে-ও আমার মতো যান্ত্রিকতা পছন্দ করত না। ওর দাদা ছিলেন মেটিস। মানে, কেটির দাদা ফার্স্ট নেসন। তিনি উনবিংশ শতকের প্রথমে এক ব্রিটিশ রমণীকে বিয়ে করেন। কেটি বড় হয় ফার্স্ট নেশন হিসেবেই। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, কেটি ছিল ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ও কবি। পোয়েটস ফোরাম থেকে পুরস্কার পেয়েছিল। ওর বাবা কেটির যথার্থ মূল্যায়ন করেছিলেন। ওকে পাঠিয়ে দেন টরোন্টোতে। এখানে এসে সে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়, থাকত ডর্মে। সেখানেই ওর সাথে পরিচয় হয়। আমি পাস করে ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে যোগ দিই।’
একটা গেলাসে স্কচ হুইস্কি ঢেলে চুমুক দিয়ে গ্রেগর বলল, ‘মা চেঁচাচ্ছে। আমার মনে হয় সে পাগল হয়ে গেছে।’
‘কী বলছেন তিনি?’
‘শোনো কী বলছে।’
জাবের কান পাতে: ‘হু ইজ দিস গাই? হ্যাজ হি কাম টু রেন্ট দ্য বেইজমেন্ট?’
জাবের নি:শব্দে হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘গ্রেগর, আজরাতে ব্লিজার্ডের ফোরকাস্ট আছে। যেতে হবে আমাকে।
‘হ্যাঁ, যাও।’
রোমেনা চলে যাবার পর একরাতে জাবের ঘুমের মধ্যে টের পেল সে তার মাথার কাছে বসে আনন্দোচ্ছ্বল স্বরে কথা বলছে। হাসছে। জাবেরও হাসছিল। সে বলেছিল, ‘হাসির জন্য ঘুমাতে পারছি না। একটু থামবে?’ রোমেনা থামেনি, জাবেরকে আরো হাসাতে লাগল। জাবের রেগে গিয়ে উঠে বসল, ‘একটু ঘুমাতে দাও না।’ সে দেখল রোমেনা শিথানের পাশে বসে মুখ টিপে হাসছে।
জাবের ওর হাত দু’টো ধরে ফের ঘুমিয়ে গেল।
রোমেনা বলল, ‘ছাড়ো এখন, বাবু কাঁদছে, ওকে দুধ খাওয়াতে হবে।’
‘কাঁদুক, তুমি বসে থাকো।’
‘ছি:, এভাবে বলতে পারলে তুমি! ছাড়ো।’
‘না।’
‘না!’ রোমেনা হাত ছাড়িয়ে নিল।
জাবের ঘোরের মধ্যে উঠে বসে।
জাবের শেষরাতে ঘুম ভেঙে দেখল বিছানার পাশে চেয়ারে বসে আছেন বাড়িওয়ালা খালাম্মা।
‘কী ব্যাপার খালাম্মা, আপনি!’
‘তুমি রোমেনাকে খুঁজতে খুঁজতে অনেকরাতে এসে আমার বাসায় নক করেছিলে।’
‘আপনার বাসায়!’
‘হ্যাঁ, তারপর আমি আর তোমার খালু তোমাকে ধরে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছি।’
‘ও’... চরম হতাশায় জাবের মাথা এলিয়ে দিল বিছানায়।
***
সব ছেড়েছুড়ে টরোন্টোতে এসে বেইজমেন্টের গুমোট আবহে আর সিকিউরিটি অপারেটিভের কাজ করে কাল যাপন করছিল জাবের। মাঝেমধ্যে শরীর কেমন বিবশ হয়ে যায়। সে জানে, তার শরীরে রোগ নেই, যা আছে সব মনে।
তার জগৎ এই বেইজমেন্ট, যেখানে রাত দিন সমান। সময় তালগোল পাকিয়ে যায়। তার চেনা জগৎ তো সে ফেলে এসেছে। তার অস্তিত্বের অনেকখানি জুড়ে আছে জন্মভূমি, স্বজন, রোমেনা, মৃত অপরিণত সন্তান।
বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস আট হলেও এক রাতে সে ঘামছিল। সেইসময় সেলফোনে গ্রেগরের নাম ভেসে উঠল।
গ্রেগর কনস্ট্রাকশন সাইট থেকে ফোন দিয়েছে। সে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, ‘কী ব্যাপার জাবের, তুমি এখনো এলে না যে! ডেসপ্যাচ থেকে কল করেছিল। আমি বলেছি, দু’জনেই আছি। সুপারভাইজার যাচাই করতে এলে বিপদে পড়ে যাব দু’জনই। শিগগির এসো।’
জাবের ডিউটির কথা বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। খুব দ্রুত সে সিকিউরিটির লেবাস পরে নিল। তারপর প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে এলো ভিক্টোরিয়া পার্ক সাবওয়েতে। ট্রেন থেকে নেমে সে বাসে চেপে সাইটে এলো।
জাবের কেবল ঢুকেছে, এইসময় ঢুকল গায়ানিজ সুপারভাইজার বিল। গ্রেগর জাবেরকে দেখে তার চিরাচরিত সেই মৃদু হাসি দেয়ার সময়টুকু পেল না। বিল দুইজনকে দেখে হাসল। জাবেরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার চোখে ঘুম লেগে আছে।’
‘রাতে ঘুম আসে, কিন্তু ঘুমাই না। তাই এখন ঘুম লেগে থাকে চোখে।’
‘ওয়েলসেইড।’ হা-হা করে হেসে উঠল বিল।
গ্রেগর, আরেক বাংলাদেশি সিকিউরিটি গার্ড স্বপন আর ড্যানফোর্থের বাঙালিসমাজ নিয়ে জাবেরের দিন কাটে।
তার মনে কোনো স্বপ্ন নেই। দিন কাটে দিনের মতো। রাত কাটে ডিউটি করে। বিলাস, সমৃদ্ধি তাকে স্পর্শ করেনা। কোনো পার্থক্য বহন করে না সহস্র যোজন দূরত্বের দুই ভূখণ্ড।
***
গরম। দরদর করে ঘামে জাবের। জৈষ্ঠ্য মাসের মতো গরম। আটমাসের ধবধবে সাদা বরফ উবে গিয়ে গ্রীষ্মের গরমটাই যেন ধ্রুব সত্য হয়ে দেখা দিল। উঁচু গল্ফ মাঠের পাশ ঘেঁষে সাইডওয়াক দিয়ে হাঁটছিল জাবের। তার আগে হেঁটে চলেছে একটি মেয়ে। না, মেয়ে নয়, চল্লিশোর্ধ এক নারী।
স্বল্প পোশাক মেয়েটির গায়ে। সাদা কুর্তা, আর পাতলা ট্রাউজার। ঘন কালো চুল মাথার ওপর ছোটোখাটো টিলার মতো দাঁড়িয়ে আছে। পায়ে চটি। এই দেশে এই বেশে বাঙালি রমণীদের মানিয়ে যায়। নির্জন নিরালা দুপুরে হেঁটে যায় মহিলা।
....এভাবেই তো চুল বাঁধত রোমেনা। গড়নটাও তো রোমেনার মতোই। দ্রুত হেঁটে সেই রমণীর সমান্তরালে এলো জাবের। সেই রমণী মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘টু হট, রাইট?’
থমকে দাঁড়ায় জাবের। রমণী কিছুদূর এগিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল জাবেরকে। তারপর আবার হাঁটতে লাগল।
...বহুদিন দেখা হয় না গ্রেগরের সাথে। সে ব্যস্ত নতুন স্ত্রীকে নিয়ে। সে ছো্ট্ট কন্যা সন্তানের মা এক রমণীকে বিয়ে করেছে। জাবের হাঁটতে হাঁটতে গ্রেগরের কথাই ভাবছিল।
বিপরীত দিক থেকে নাজমা এসে যোগ দিল। সে বলল, ‘কী কথা বললে মহিলার সাথে?’
‘আমি কিছু বলিনি। সে-ই বলল। ঢং! আমাকে দেখে কি বাঙালি মনে হয় না? সে ইংরেজিতে মন্তব্য করল। বলো তো দেখি।’
নাজমা হেসে বলল, ‘মহিলা বাঙালি না, জ্যামাইকান। আমি চিনি, সেভেন ক্রেসেন্টে থাকে।’
‘ও তাই বলো।’
‘চলো টিম হরটনে গিয়ে বসি, ভ্যাপসা গরম।’
‘না। ডাউনটাউনে যাই চলো। আজ তো ক্যানেডা ডে। ডানডাস স্কোয়্যারে নাচগান হবে।’
‘এই গরমে নাচগান ভালো লাগবে না। টিম হরটনে বসি।’
‘ঠিক আছে। তবে আজ রাতে তোমাকে নিয়ে বে স্টেশনে যাব।’
‘সেখানে কী!’
‘সেখানে রাতবিরেতে সাদা পোশাকে একটি মেয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাকে দেখব।’
‘বুঝেছি, তোমার মন খারাপ।’
‘তুমি যাবে না?’
‘যাব। পরশুদিন কিন্তু আমাদের ফ্লাইট।’
‘হুমম।’
‘তুমি কি খুশি নও?’
‘কী যে বলো। আমি খুশি, খুব খুশি। চলো টিম হরটনে যাই, নাকি কান্ট্রিস্টাইলে যাবে?’
ওরা বসল কান্ট্রিস্টাইলে। নাজমা ট্রেতে করে কফি ও টিমবিট নিয়ে এলো।
নাজমা আহ্লাদিত ভঙ্গিতে বলল, ‘বাংলাদেশে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা সেরে ফিরে এসে এখানে গুছিয়ে বসব। কী বলো?’
‘এত তাড়া কীসের?’
‘তাড়া নয়, প্ল্যান করছি।’
জাবের হাসল। বলল, ‘চলো, বে স্টেশনে।’
নাজমা অনুসরণ করল তাকে। কান্ট্রিস্টাইল থেকে বেরিয়ে দু’জন এলো ভিক্টোরিয়া পার্ক স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে এসে ট্রেনে উঠতে গিয়েও থেমে যায় জাবের। ট্রেনটা চলে গেল। ‘কী হলো!’ নাজমা বলল। প> ‘না থাক। যাব না।’
‘যাবে না কেন! না যাবার তো কারণ দেখছি না।’
‘আচ্ছা, চলো।’
তিনমিনিট পরের ট্রেনে উঠে ঝিম দিয়ে থাকে জাবের। ভাবে, সে শুধু কোনো অজুহাতে অস্তিত্বমান। বহুবছর আগের সেই দিনগুলোর যেমন সমাধি হয়ে গেছে, সেইসাথে তেমন ওর বর্তমান অস্তিত্ব কোনো প্রকার জটিল আবরণে ঘেরা।
হয়তো সে প্রবেশ করেছে পুনর্জন্মে। কিংবা সে মৃত হয়ে ফিরে গেছে আগের জগতে।
সে দেখতে পায় বে স্টেশনের মেয়েটিকে......।