• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭০ | মার্চ ২০১৮ | প্রবন্ধ
    Share
  • সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা : রবিন পাল


    দিও যোহান একারমান-এর সঙ্গে কথাবার্তায় মহাকবি গ্যেটে ভয় দেখিয়েছিলেন যে রাজনৈতিকতা কবিত্বের অপমৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে, রাজনৈতিক সত্তা কবিসত্তাকে গ্রাস করে, কবির গান থেমে যায়, তথাপি একথা সকলের ক্ষেত্রে সত্য নয়। জনজীবনের প্রসঙ্গ কবিতাতে চলে আসছে কয়েক শতাব্দী জুড়ে, দান্তের দিভাইন কমেডিতে কবি ধর্মপ্রিয় হলেও জনপ্রসঙ্গ ছিল কাব্যশরীরে। কাব্যস্বর যদি জেগে ওঠে জনপ্রসঙ্গের মধ্য থেকে তাহলেও সংবেদী পাঠককে, তার হৃদয়কে ঢেউ দিয়ে যায়। রাজনৈতিক কবিতার একটা বড়ো অংশে মেলে বিশাল বর্তমানকে আত্মস্থ করার, ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা। পাঠকের একাংশ রাজনৈতিক কবিতায় বিমুখ হলেও এমন কবিতার শিরদাঁড়ায় জেগে থাকে বহু মানুষের হৃদয় সংবেদনার পরিচয় যাতে করে কবিচেতনা ও জনচেতনার মিতালি ঘটে যায়।

    সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ সাড়া জাগিয়েছিল অখণ্ড বাংলায়। একালের পাঠক লক্ষ করলেন ‘পদাতিক’-এর প্রকাশক ‘কবিতা ভবন’ (১ম সং ১৯৪০) এবং বুদ্ধদেব বলেন--‘দশ বছর আগে বাংলার তরুণতম কবি ছিলাম আমি। ...সম্প্রতি এই ইর্ষিতব্য আসন সমর সেনেরও বেদখল হয়েছে, বাংলার তরুণতম কবি এই সুভাষ মুখোপাধ্যায়।’ অরুণ মিত্রের মতে এই প্রথম পর্যায়ের কবিতায় ছিল ছন্দনিয়ন্ত্রণ, শব্দ প্রয়োগের নতুনত্ব এবং জনমুখী দৃষ্টি। লক্ষ্য করার মতো তাঁর তির্যক কথনভঙ্গি। সূচিপত্রবিহীন ২৩-টি কবিতার সংকলন ‘পদাতিক’, যাতে আছে বুর্জোয়া ছাঁদের হাতছানি সত্ত্বেও নবযুগ আনার ইচ্ছা, মিলিত অগ্রগতির ইচ্ছা এবং শেষকার পথ অজানা থাকলেও অব্যাহত গতি। কবি জানান--‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা’। তরুণ কবি উপলব্ধি করতে শিখেছেন—‘ইতিহাস অর্থনীতির হাতে বাঁধা’। কবি পরিস্থিতি থেকে শিখেছেন--‘কৃষক, মজুর! তোমরা শরণ/ জানি, আজ নেই অন্য গতি।’ প্রচল রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে কবিমন--‘ছেঁড়া জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে/ বেঁধে নিই মন কাব্যের প্রতিপক্ষে’। অর্থাৎ ভাববাদী কবিতার বিরুদ্ধে কবি, কন্ঠে আছে শ্লেষ ও আত্মপরিবর্তনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা--ত্রিশঙ্কু মনে আছে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব। শ্লেষ মধ্যবিত্ত ভাববাদী মানসিকতার প্রতি--‘সম্মতি নেই মজুর ধর্মঘটেও/ ভাংচি ঘটায় শৃগাল বুদ্ধি ভাড়াটে’। এখানে বিষ্ণু দে এবং সমর সেনের শৈলী উঁকি দিয়ে যায়। ‘দলভুক্ত’ কবিতায় জানিয়ে দেন কবি--‘নিরপেক্ষ থেকে আর চিত্তে নেই সুখ’। ‘পদাতিক’ কবিতায় উপলব্ধি আছে--‘বুঝেছি ব্যর্থ পৃথিবীর পাড় বোনা/ স্বপ্নের ভাঁড় সামনেই ওল্টানো’। বলা বাহুল্য বুর্জোয়া ‘শ্রেষ্ঠী বিলাপ’ কবিতায় কবি শ্রেষ্ঠীদের পক্ষ থেকে সমর্পণের কথা বলেন--‘জনজাগরণে সদলবলেই মেনেছি হার--/ হে বলশেভিক, মারণমন্ত্র মুখে তোমার’। ‘অত:পর’ কবিতায় শ্লেষাক্ত কন্ঠস্বরে জমিদারশ্রেণীর পক্ষ নিয়ে কথা বলার ভান করেন। ‘চীন: ১৯৩৮’ কবিতার পরিসর ভারত ছাড়িয়ে যুদ্ধরত চীনে প্রসারিত। বামপন্থী কবিতায় পরিসরবৃদ্ধির চেহারাটি অন্য অনেক বামপন্থী কবির লেখাতেই মিলবে। ‘আর্ষ’ কবিতায় কবি তৎকালীন বাংলা প্রগতিশীল ট্রাডিশন মেনে উচ্চারণ করেন--‘আমাকে সৈনিক করো তোমাদের কুরুক্ষেত্রে ভাই’। ‘পদাতিক’ কবি সুভাষ কার্যত: পথে নামেন, জনতার সখ্যে মাতেন, ক্রমশ তাঁর কন্ঠে উচ্চারিত হয়--রাস্তাই একমাত্র রাস্তা।

    সুভাষের কবিতায় রাস্তা বা পথের মেটাফর চলে আসে নানা ভাবে--

    ক) কী এক গভীর চিন্তায়
    কপাল কুঁচকে আছে
    চড়িয়ালের রাস্তা।

                              (এক অসহ্য রাত্রি / ফুলফুটুক)

    খ) মাথায় লাঠির বাড়ি খেয়ে পড়ে-যাওয়া
    গাঁয়ের হাড়-জিরজিরে বুড়োর মতো
    রাস্তাটা
    একদৃষ্টে তার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে।

                              (রাস্তার লোক / যতদূরেই যাই)

    গ) আমাদের এদিককার রাস্তাঘাটে, মশাই
    আর বলবেন না
    বছরে বারোমাস ভোঁচকানি লাগা ক্ষিধে--
    বেরোলেই পা জড়িয়ে ধরে।

                              (একটু পা চালিয়ে, ভাই / একটু পা)

    রবীন্দ্রনাথ, সমর সেন, সুকান্ত পথের মেটাফর ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সুভাষের সঙ্গে এঁদের কারুর এক্ষেত্রে মিল নেই। অমলেন্দু বসু একদা বলেছিলেন--সুভাষের কবিতায় তিনি পান তিনটিই সুর--ব্যঙ্গতীক্ষ্ণ সুর, চড়া গলার সুর, স্বগতোক্তির সুর। তিনটিতেই লেগে আছে এক অটল অধ্যায়। চড়া গলার সুর একদা সময়ের দাবিতেই হয়ত সুভাষ, অরুণ মিত্র, বিষ্ণু দে এবং আরো অনেকের কবিতায় দেখা দিয়েছিল। সুভাষের কবিতায় পেয়েছিলাম--

    বজ্রকন্ঠে তোলো আওয়াজ
    রুখবো দস্যুদলকে আজ,
    দেবে না জাপানী উড়োজাহাজ
    ভারতে ছুঁড়ে স্বরাজ!

                              (জনযুদ্ধের গান)

    অথবা,

    স্ট্রাইক! স্ট্রাইক!
    যেখানেই হাকি, ময়দানে হবো সকলে সামিল আজকে।

    স্ট্রাইক! স্ট্রাইক!
    একবার লাখো হাত এক হোক, দেখে নেব পশুরাজকে।

                              (উনত্রিশে জুলাই)

    এই ধরনের কবিতা বুদ্ধিজীবী অমলেন্দু বসুর পছন্দ নয়। ‘চীন: ১৯৪১’ নামক কবিতায় অন্তিম স্তবক--

    সিঙ্গাপুর, রেঙ্গুনের পথে পথে রক্ত দেয় চীন--
    ভূগোলে অবাধ আজ পদক্ষেপ সশস্ত্র মুক্তির;
    মৈত্রীর সংকল্প নেয় সুতীক্ষ্ণ সঙিন

    এ ধরনের উচ্চারণকে অমলেন্দুবাবু ‘ক্যানেস্তারা-পেটানো পদ্য’ বলেছেন। এবং ‘গণ বক্তৃতার rhetorical declamatory style--অতি অলঙ্কৃত, স্ফীতকন্ঠ রচনাশৈলী--সেটাই যেন ‘পদাতিকে’র পরপর্যায়ী কাব্যের প্রধান শৈলীতে দাঁড়িয়েছে।’ হয়তো তা ঠিক, কিন্তু এ আর একধরনের কবিতা, তাকে ‘ক্যানেস্তারা-পেটানো পদ্য’ বলা অনুচিত। মাঝে মাঝে সব দেশের কবিরাই সময়ের তাগিদে এমন চড়াগলার কবি হয়ে ওঠেন। এটাই, চীৎকৃত ‘উচ্চারণই’, হয়ে ওঠে জরুরী।

    অশ্রুকুমার সিকদার বলেছেন নাজিম হিকমতের কবিতা অনুবাদের পর সুভাষের কবিতার শৈলীও বদলে যেতে থাকে। নাজিম হিকমতের কবিতা বেরিয়েছিল ১৯৫২-তে। তার পর ‘ফুল ফুটুক’ (১৯৫১-৫৭) নিশ্চয়ই তা মনে করাবে। কিন্তু ‘যত দূরেই যাই’ (১৯৬২) থেকে ‘ছেলে গেছে বনে’ (১৯৭২) বদলে গেছে অনেক। তারপরে বদল আসে আরো অনেক। আনুপূর্বিক কবিতা পড়তে গেলে তা পাঠকের টের না পাওয়ার কথা নয়। অশ্রুকুমার লক্ষ্য করেছেন সুভাষের কবিতা কখনও সম্পাদকীয় প্রবন্ধের মতো হয়ে ওঠে, কখনো তা ‘কবিতার ছদ্মবেশে গদ্য’। কিন্তু মাঝে মাঝে যেমন কবিতাও হয়ে ওঠে গদ্য, তেমনি গদ্যেও কবিতার রঙ লাগে। রেখাচিত্র আঁকার এক দক্ষতা ক্রমশ: স্ফুটতর হয়ে ওঠে তাঁর কবিতায়--

    মাথার ওপর একটানা দীর্ঘ তারে
    ছড় টেনে
    ঝড়ের সুর বাজাতে বাজাতে গেল
    একটা মন্থর ট্রাম।

    কখনও কখনও আগে অল্প কথায় গল্প বলার ঝোঁক--

    অনেক অলিগলি ঘুরে
    মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে
    বাবা এল।
    ছেলে এল না।

    কিংবা শাশুড়ির অপছন্দের কালো বৌ-এর গল্প ‘মেজাজ’ কবিতায়। ‘আমার কাজ’ কবিতায় সুভাষ বলেছিলেন--

    আমাকে কেউ কবি বলুক
    আমি চাই না
    কাঁধে কাঁধে লাগিয়ে
    জীবনের শেষদিন পর্যন্ত
    যেন আমি হেঁটে যাই।

    আমি যেন আমার কলমটা
    ট্র্যাক্টরের পাশে
    নামিয়ে রেখে বলতে পারি
    এই আমার ছুটি--

    সুকান্তও একদা বলেছিলেন--কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি। গদ্যময় পৃথিবীতে দুজনেই একদা হতে চেয়েছিলেন--পার্টিজান কবি। কিন্তু সুভাষ দুটো দিক থেকে সরে গেলেন। প্রথমত: পার্টিপ্রচারের মুখপাত্র হয়ে থাকতে চাইলেন না। দ্বিতীয়ত: প্রসারিত বাংলায়, দুয়ার খুলে পৌঁছতে চাইলেন মানবতার রাজ্যে, দেশের সাধারণ, মারখাওয়া, বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের মধ্যে। কবিতাকে জোর করে পিছনের সিটে বসিয়ে রেখে লড়াকু সাংবাদিক সুভাষ গ্রামে-গঞ্জে, শহর-নগরে কলকারখানায় খেতখামারে চষে বেড়িয়েছেন। লিখেছিলেন--‘আমার চোখ আমার পা দুটিতে বাঁধা। পা নড়িয়ে নড়িয়ে আমি দেখি। ...আমি দেখি বাংলাদেশের মুখ।’ রমাকৃষ্ণ মৈত্র ঠিকই বলেছেন--‘বজবজের দু-বছর নর নারীর জীবনযাপন সুভাষের ব্যক্তিগত ও কাব্যগত জীবনে ব্যঞ্জনাক্ষুব্ধ সমুদ্রে একটি লাইট হাউস-এর কাজ করেছে।’ একটা স্তরে ছিল শপথ, অঙ্গীকার, পরিস্থিতির কথা। তারপরে এল দুর্ভিক্ষ ও দাঙ্গাপীড়িত ‘জীবনের গোলকধাঁধার’ কথা, ‘চিরকুট’ পর্বে। ক্ষুদ্ধ কবিকন্ঠ ছিল স্ট্রাইকের উচ্চারণে। ‘ফুল ফুটুক’ থেকেই সম্ভবত, মিছিলকে ছুঁয়েই অবশ্য, ব্যঞ্জন হেড়িয়া (বজবজের কাছে একটি জায়গা) জীবন কবিকে শিখিয়েছে মানুষের কথাকেই বড়ো করে তুলতে। ‘যত দূরেই যাই’ (১৯৬২) থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠল অতি সাধারণ লোকজনের কথা। তখন-ও অবশ্য দুলে দুলে দুলে ওঠা নিশান বন্দনা। সংকট উত্তরণের শক্তি তিনি কুড়িয়ে নিতে চান প্রকৃতি ও জীবনের দিকে চোখ রেখে। তরুণদের ওপর পুলিশ নির্যাতনে ব্যঙ্গবিদ্রূপ--

    আর পাঁচ মিনিট। আর পাঁচ মিনিট
    মশাইরা, দাঁড়িয়ে যান--
    পড়ে যাবে আরও একটা লাশ
    খেলা হবে খেলা হবে খেলা হবে খেলা।

    আর খোলার বদলে সর্বত্র খোলা হাওয়া--

    খোলা হাওয়া কোথাও
    নেই, কোথাও
    নেই

    আমরা এ ওকে
    সে তাকে
    নখ দিয়ে খুঁড়ছি

    এবং

    এ এক ভারি অদ্ভুত সময়
    পুরনো ভিতগুলো যখন বালির মত ভাঙছে
    আমরা ভাই বন্ধুরা
    ঠিক তখনই
    ভেঙে টুকরো টুকরো হচ্ছি।

    তবু কবি বলেন--

    শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে
    একটু পা চালিয়ে ভাই, একটু পা চালিয়ে।

    প্রৌঢ় কবি বলেন--

    হৃদয়ের লাল ডাক বাক্‌সে
    ফেলা চিঠিতে
    নাম লিখেছি, ভুলে গিয়েছি
    ঠিকানা দিতে
    বসে রয়েছি কালবোশেখি
    ঝড়ের আশায়
    ভালবাসা বাড়াচ্ছে হাত
    নীলকন্ঠ পাখির বাসায়।

    (উড়ো চিঠি)

    ‘পদাতিক’-এর কবি, ‘চিরকুট’ ও ‘অগ্নিকোণ’-এর কবি একসময় লিখলেন--

    তোমাকে বলাই হয়নি
    এবার রথের মেলায়
    কী কী কিনব--
    মেয়ের জন্য তালপাতার ভেঁপু
    আর বাড়ির জন্যে
    সুন্দর পেতলের খাঁচায়
    দুটো বদরিকা পাখি

    অথবা

    আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে
    নিকোনো উঠোনে
    সারি সারি
              লক্ষ্মীর পা
    আমি যত দূরেই যাই

    অথবা, তাঁর চোখে পড়ে--

    যেখানে স্টিমারের খালাসির মত
    স্মৃতি
    শুধু
    রশি ফেলে ফেলে
    জীবনের জল মাপে

    এ কবিতাকে রাজনৈতিক কবিতা বলার মত নির্বোধ নই। এ জীবনরসের কবিতা। আর জীবনরসের ভিত শক্ত হলেই জেহাদের কবিতা আসে মাঝে মাঝে। পাবলো নেরুদার কথা মনে পড়ে, পার্থক্য সত্ত্বেও, এ প্রসঙ্গে।

    যতই দিন গিয়েছে সুভাষের কবিতা প্রবচন, বাগধারা, লোকগল্প, রূপকথা প্রভৃতির আশ্রয় নিয়ে বক্তব্যকে তুলে ধরেছে। কিছু উদাহরণ--

    ক) লক্ষ্মীর চেলাচামুণ্ডার উৎপাতে
    সরস্বতী দাঁড়ান এসে ফুটপাথে

    খ) গৌরী সেনের বাপের টাকায়
    বাছাধনেরা ফলার পাকায়

    গ) কান-কাটাদের রাজ্যে
    ঠোঁটকাটারা যাই বলুক না
                   আনে না কেউ গ্রাহ্যে।

    ঘ) আদার ব্যাপারী তাই বুঝি না জাহাজের হালচাল কিছুই

    ঙ) সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না
    আড় হয়ে লাগতে হবে

    চ) চোরের মায়ের খুব ফুর্তি রে দাদা

    ছ) শিকে ছিঁড়লে বেড়ালের ভাগ্যে
    করবে সবাই আপনি- আজ্ঞে

    জ) পিঁপড়ে খাবে লাভের গুড়
    পঙ্‌ক্তি ভোজের পাতায়

    ঝ) মনে হল, এ তো তোমারও হাতের পাঁচ
    তেরে কেটে বলে বাপ রে, কী তুড়ি লাফ

    কখনও আসে লোকগল্প--

    ক) সুয়োরাণী লো সুয়োরাণী তোর
                          রাজ্যে দিল হানা
    পাথর চাপা কপাল যার সেই
                          ঘুঁটে কুড়ুনির ছানা

    অথবা, রূপকথার আভা--

    ক) আমাদের প্রাণভোমরা গুলো বড় বড় খোলের মধ্যে ভ’রে
    সরু সুতোয় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে

    খ) চোখে যাদের দেখেছিলাম
    আলাদিনের আলো
    দীনদরিদ্র বন্ধুরা সব
    অখ্যাত নাম
    তারা কোথায় গেল?

    দৈনন্দিন জীবনের মেয়েলি কথা তাঁর কবিতার উচ্চারণকে করেছে সমৃদ্ধ--

    ক) মিনসের আক্কেলও বলিহারি
    কোত্থেকে এক কালো অলুক্ষণে
    পায়ে ক্ষুরঅলা ধিঙ্গি মেয়ে ধরে এনে
    ছেলেটার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে গেল

    খ) মুখপুড়িটা তাকাচ্ছে দ্যাখ
    বলছে আ সর মিনসে

    এই সব ব্যবহারে দুটো কাজ হয়। জনজীবনের নিবিড় সংযোগে মানুষের কাছের হয়ে ওঠে কবিতার স্বর। সমাজচেতনা, রাজনৈতিক চেতনা, জীবনচেতনা প্রকাশের স্বতন্ত্রতা ফুটে ওঠে। রাজনৈতিক কবির এই স্বতন্ত্রতা বাংলা কবিতায় অবশ্যই ব্যতিক্রম।

    সুরজিৎ দাশগুপ্ত ‘পদাতিক’ বইয়ের ‘অত:পর’ কবিতাটির সূত্রে একটি কথা বলেছেন যা আমারও মনে হয়। এ কবিতার ক্ষেত্রে কবিতা ও অকবিতার অদৃশ্য পাঁচিলের ওপর কবি যেন বসে আছেন। এই ব্যাপারটা সুভাষের অনেক কবিতাতেই আছে। যা তাঁকে বিশিষ্টতা দেয়। আর একটা উপলব্ধি--‘সুভাষদার পার্টির স্বরে সাধা কবিতার মধ্যেও পার্টির বাইরেকার কবিতা পেয়েছিলাম।’ পার্টিজান কবিতায় একটা যান্ত্রিকতা এসে যায়, মানবিক কবিতায় পার্টির বাইরেকার ছবি ফুটে ওঠে। চেষ্টা করলে ভেতরকার স্বর-ও মেলে। সুভাষকে সেই কারণে পার্টি নেতারা পছন্দ করেনি। পরে তাঁকে সংশোধনবাদী ইত্যাদি আখ্যা দেয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও এসব ঘটেছিল। তবে মানিকের মেজাজ আর সুভাষের মেজাজ আলাদা। সুভাষের ‘ভুতের বেগার’ নিয়ে পার্টি নেতাদের গালমন্দ তাদের মুখই পুড়িয়েছে। মানিকবাবুও তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন--সি.পি.আই. ভারতীয় জনগণের মনকে বুঝতে পারে না, বুঝতে চায় না। সু্ধীন্দ্রনাথ বলেছিলেন সুভাষ-প্রতিভাকে রাজনীতি উদরস্থ করে ফেলেছে। পারে নি। রাজনীতি সুভাষের কবিসত্তাকে গ্রাস করতে পারে নি। সুরজিতের আর একটি মন্তব্য সমর্থন করি। তা হল--‘অনেকদূর চলে এসেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। দলগত আদর্শ থেকে ব্যক্তিগত বৃত্তান্তে এবং তারপর ব্যক্তিগত সত্যের অন্বেষণ অভিযান।’ ঠিক আছে। আমি শুধু সংযোজন করি যে দলগত আদর্শ ছাপিয়ে ব্যক্তিগত আদর্শ ও সত্যের অন্বেষণে অভিযান তাঁর কবিসত্তাকে মানবিক রেখেছিল। এক্ষেত্রেও আমার পাবলো নেরুদার স্পেন পর্বের কবিতা এবং শেষ পর্বের কবিতার ফারাকের কথা মনে পড়ে। রাজনীতির সীমানা ডিঙিয়ে উর্দিপরা শিল্পিদের শৃঙ্খলা ভেঙে দুজনের কবিতা গেছে অস্তিত্বের গভীরতর মানবিক চেতনার অভিমুখে।

    জনজীবনের মধ্যে সর্বদা অবস্থান কবিকে বাঁচায়, পার্টিজান কবিকেও বাঁচায়। যান্ত্রিক পার্টিজান কবিতা মুমূর্ষু হয়ে ওঠে। জনজীবন সন্নত কবিতা কবিতাকে ছড়িয়ে দেয় মানুষের মধ্যে। তার মধ্যে মানুষ আবিষ্কার করতে পারে নিজেকে, ধারপাশের লোককে, মুঠো তোলা শ্লোগান তৎপর মানুষকেও। এই পথেই সুভাষের কবিতা হয়ে উঠেছে চিরভাস্বর। তাঁর শেষপর্যায়ের আচরণ ও কবি-উচ্চারণ নিয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু যথার্থ কবিতাপাঠক তাতে আবিষ্কার করতে পারেন অনেক কিছু--প্রত্যক্ষে না হোক, পরোক্ষে।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments