• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬১ | ডিসেম্বর ২০১৫ | নাটক
    Share
  • মামণির ছবি একাঙ্ক নাটিকা : কৌশিক সেন


    পাত্রপাত্রী

    মৃন্ময়ী
    চম্পা
    তনু

    (দক্ষিণ কলকাতার একটি ছিমছাম করে সাজানো ফ্ল্যাটবাড়ি। মৃন্ময়ী রায়চৌধুরি এই বাড়ির কর্ত্রী, একাই থাকেন, স্বামী মারা গেছেন প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল, একমাত্র ছেলে আমেরিকাবাসী। বাজার, রান্নাবান্না, বাড়ির কাজ সবকিছু দেখাশোনা করে চম্পা মণ্ডল, ওর দেশ ক্যানিং ছাড়িয়ে আরো অনেকটা দক্ষিণে। চম্পার স্বামী অনেকদিন হলো ওকে ছেড়ে গেছে, একমাত্র মেয়ে দেশের বাড়িতে বুড়ি মায়ের সঙ্গে থাকে। পর্দা উঠলে দেখা যাবে মৃন্ময়ীর বসার ঘর, সোফা, টিভি আর কফি-টেবিল, তার পিছনে একটি সুদৃশ্য চায়না ক্যাবিনেট, তার মধ্যে অনেকগুলি কাপ প্লেট আর বিভিন্ন আকারের কফি মগ সাজানো। চম্পা ঝাড়ন দিয়ে কাপগুলোকে পরিষ্কার করছে।)

    মৃন্ময়ী : (নেপথ্যে) - চম্পা, বিছানাটা নোংরা হয়ে আছে, একটু ঠিক করে দে।

    চম্পা : গেলো যা। বিছানা করতে গেলে বলবে আলমারিটায় ধুলো পড়ে আছে পরিষ্কার কর। বলি একসঙ্গে আর কটা কাজ করবো?

    মৃন্ময়ী : (নেপথ্যে) - তুই সব ছেড়ে ওইটা নিয়েই পড়লি কেন? তোকে কতবার বলেছি না যে আমি সামনে না থাকলে ওই চায়না ক্যাবিনেটে হাত দিবি না। এমনিতেই তোর হাতে পায়ে লক্ষ্মী, তার ওপর চোখদুটো সবসময় টিভি’র দিকে। তুই আগে বিছানাটা ঠিক করে, তারপর যা গিয়ে এক কাপ চা বসা দেখি। আমি পুজোটা সেরে আসছি।

    চম্পা : (দর্শকদের) - শুনছেন তো! সকাল থেকে খালি খিটখিট আর খিটখিট। যত দিন যাচ্ছে, এই আমাদের মাসিমার মাথাটাও আরো বেশি করে খারাপ হচ্ছে। যতো মায়া এইসব নাতনির ছবি লাগানো বিলেতি কাপের ওপর। আরে বাবা নাতনি তো আসে তিন বছরে একবার। এদিকে আদিখ্যেতা করে বছরে তিনবার কায়দা করে ছবি লাগানো সব জিনিসপত্তর পাঠানো চাই। বুড়ি সারাদিন ধরে সেগুলোর গায়ে হাত বোলাচ্ছে আর উলোট পালট বকছে। এ এক আজব কায়দা হয়েছে বটে। কাপে ছবি, গেলাসে ছবি, টুপিতে ছবি, জামার গায়ে ছবি।

    মৃন্ময়ী : (নেপথ্যে) - চম্পা, চা টা বসালি না কি?

    চম্পা : বসাচ্ছি গো বসাচ্ছি। একটু মন দিয়ে পুজো করলেও তো পারো। আচ্ছা বাপু এতোই যদি শখ তো ও-দেশে গিয়ে ছেলে, ছেলের বৌ আর নাতনির কাছেই থাকো না। বলি এই শহরে আছেটা কে তোমার? কি আত্মীয়স্বজন, কি দাদাবাবুর বন্ধুরা, সকলেই নাকি ভারি ব্যস্ত, তাই সারা বছর কারো টিকির দেখাও মেলে না। এদিকে বুড়ি মরে থাকলেও কেউ টেরটি পাবে না। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো এই আমি না থাকলে—

    (মৃন্ময়ী ঢোকেন)

    মৃন্ময়ী : – চম্পা, চা টা আনলি?

    চম্পা : (ঝাড়ন না ফেলে দিয়ে) - দাঁড়াও আনছি। (দুম দুম করে চলে যায়)

    মৃন্ময়ী : (ক্যাবিনেট থেকে একটা কফি মগ তুলে নেন। খুব সাবধানে ঝাড়নটা তুলে পরিষ্কার করেন।) ইস কি ধুলোই না পড়েছে। এই ছবিটা আমার মামাণির পাঁচ বছরের জন্মদিনে তোলা। ওরা বেড়াতে গেছিল ফ্লোরিডা ডিজনি ওয়ার্লডে। এই যে ওদের পিছনে জাদুর কেল্লা আর রাজকন্যের ছবি। (আদর করেন) মামণি, আমার রাজকন্যে। (আরেকটা কাপ তুলে নেন) তারপর এই যে, এইটা। টুবাই, মামণি আর ওর মা ওদের বাড়িতে ক্রিসমাস ট্রি’র সামনে বসে আছে। আমার মামণিকে লাল জামা আর টুপিতে কি সুন্দর লাগছে, ঠিক যেন সাহেবদের মেয়ে। হবে না কেন, ও তো ওখানেই জন্মেছে। টুবাইটাকে একটু রোগা দেখছি, আজকাল তো আবার রোগা হওয়াই ফ্যাশন। (চা নিয়ে চম্পা ঢুকছে) দে, চা টা এখানে দে। (আরেকটা মাগ তুলে নেন)

    চম্পা : এই নাও। দেখি দেখি এইটা নতুন এসেছে বুঝি?

    মৃন্ময়ী : (চমকে উঠে) - দেখিস দেখিস হাত থেকে ফেলে দিসনে যেন। এই দ্যাখ মামাণি স্কুলে বেহালা বাজাচ্ছে। দেখেছিস কি সুন্দর লম্বা চুল।

    চম্পা : (দেখতে দেখতে) - সত্যিই ভারি সুন্দর গো তোমার নাতনি। (শ্বাস ফেলে) আমার মেয়েটারও তো এই বয়েস। বছর ঘুরতে চললো মেয়েটাকে দেখিনি।

    মৃন্ময়ী : দেখিস এখুনি আবার ছুটি চাস না যেন। তাছাড়া আজকাল ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনিরা তো দূরে দূরেই মানুষ হয়। সেই আগের দিন কি আছে? আমাদের সেই বেহালার বাড়ি, একগাদা ভাইবোন, কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে সবসময় গমগম করতো। অবশ্য বাড়িটা পুরনো ছিল আর বেশ ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে হতো।

    চম্পা : মেয়েটা স্কুলে যাচ্ছে এই এক ভরসা। লেখাপড়া শিখে যদি একটা ভালো চাকরি পায়। আমার তো লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করেই জীবন গেল।

    মৃন্ময়ী : ও তুই বুঝি ভাবছিস লেখাপড়া শিখলে মেয়ে তোর আঁচল ধরে বসে থাকবে। আচ্ছা একটা কথা বল? এই বিলডিং-এ কটা বাড়িতে কাজ করেছিস তুই আজ অবধি?

    চম্পা : তা ঠিকে কাজ, সবসময়ের কাজ মিলিয়ে প্রায় সাত বাড়ি হবে। কেন গো?

    মৃন্ময়ী : কিরকম বয়েসের লোকজন থাকে এখানে বল দেখি?

    চম্পা : (একটু ভাবে) - ওই তো সবই তোমার বয়েসেই হবে। ওপরের ফেলাটের দাদাবাবুরা তো বেঙ্গালুরু চলে গেল। ঘোষবাবুদের ছেলেটাও দিল্লীতে চাকরি পেয়েছে। বাকি রইল কে? ও ওই তো তনুদি আছে, অঞ্জলি-কাকিমার মেয়ে। জানো ও নাকি টিভি সিরিয়াল করবে।

    মৃন্ময়ী : তনুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আমেরিকায়। ভারি ভালো মেয়ে, হাঁটতে যাবার সময় নিজে এসে রোজ কথা বলতো। আর কেউ তো বলে না। (হাসেন) সে’ও চলল। এইটা হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম, বুঝলি বৃদ্ধাশ্রম। (নি:শ্বাস ফেলে) গোটা শহরটাই তাই হয়ে যাবে কিছুদিন পর।

    চম্পা : (বুঝতে না পেরে) - কিসের আশ্রম বললে গো?

    মৃন্ময়ী : তুই বুঝবি না। ওই দ্যাখ, আবার গপ্পো করতে বসলি। এক্ষুনি বলবি – টিভিটা একটু খুলে দাও না গো মাসিমা, সিরিয়ালের টাইম হয়ে গেল যে। বলি রান্নাটা চাপাতে হবে না কি?

    চম্পা : এতো তোমার তাড়া কিসের হ্যাঁ? খাবে তো এইটুকুনি। দাও পয়সা দাও, চিনি আনতে হবে।

    মৃন্ময়ী : হয় টিভি দেখা নয় দোকানে যাওয়া। এই তো সেদিন চিনি আনলি, এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেল? চায়ে কতটা করে চিনি দিস? (কাপটা রেখে ব্যাগ খুলে পয়সা বার করতে যান, ইতিমধ্যে হাত ফস্কায়, চায়ের কাপটা হাত থেকে মাটিতে পড়ে। মৃন্ময়ী প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন) ও: আবার একটা কাপ ভাঙলো। কি যে হয়েছে আমার ছাই।

    চম্পা : (মৃন্ময়ীকে ধরে বসায়, কাপটা কুড়িয়ে নেয়) তোমার হাত আজকাল খুব কাঁপে গো মাসিমা। ডাক্তার দেখাও না কেন?

    মৃন্ময়ী : দেখিয়েছি। পারকিনসন না কি একটা নাম বললো, এর রোগ নাকি সারে না। যাকগে তুই যা।

    চম্পা : তোমায় আরেক কাপ চা এনে দি। দাও না ওখান থেকে আরেকটা কাপ বের করে দাও।

    মৃন্ময়ী : না, বলেছি না ওইগুলোতে কখনো হাত দিবি না। যা চিনির সাথে কয়েকটা প্লাস্টিকের চা খাবার কাপও কিনে আন। আমার বোধহয় ভালো কাপে চা খাবার দিন শেষ।

    চম্পা : তা যা বলো। আমি হলে বাপু ওইগুলোতে খেতাম। (বেরিয়ে যায়)

    মৃন্ময়ী : তাড়াতাড়ি ফিরিস, আমি হাঁটতে যাবো। (খুব সাবধানে ক্যাবিনেট থেকে আরেকটা কাপ বের করেন। হাত কাঁপছে) উনি থাকতে দুজনে একসাথে বসে চা-কফি খেতে খুব ভালোবাসতাম। কতো দামী দামী চায়না জমিয়েছিলাম তখন। টুবাই তো জানে, তাই তো এই কফি খাওয়ার কাপগুলো পাঠায়। কি সুন্দর এগুলো। তাই তো মামণির দেড় বছরের হামা দেবার ছবি। সবাই বলে ওর হাসিটা ঠিক আমার মতন। আর এইটা ওদের কুকুর জোজোর সাথে। আচ্ছা একটা কুকুর পুষলে কি রকম হয়? হাঁটতে যাবার সময় বেশ সঙ্গে সঙ্গে যাবে? না: আর মায়া বাড়িয়ে কাজ নেই। যেরকম টলমলে হয়ে যাচ্ছি আজকাল, কদিন আর হাঁটতে যেতে পারবো কে জানে? (আরেকটা কাপ তুলে নেয়) এই মামণি সাইকেল চালাচ্ছে। আমিও ছোটবেলার সেই রেল কলোনিতে না, সাইকেল চালিয়ে বাড়ি থেকে আঁকার ক্লাসে যেতাম। ওঁর সঙ্গেও তো ওইখানেই প্রথম দেখা। (আবার বসে পড়ে) আজকাল তো আঁকতে গেলেও আঙুল কেঁপে সব ধেবড়ে যায়।

    (চম্পা ঢোকে)

    চম্পা : এই নাও গো মাসিমা, নতুন করে চা বানিয়ে এনেছি। (সামনে বসে। ওর নিজের হাতে ভাঙা কাপটা) আমি এখন থেকে এই কাপটাতেই খাবো। এই দ্যাখো হ্যান্ডেলটা ফেভিকল দিয়ে জুড়ে দিয়েছি।

    মৃন্ময়ী : ভালো করেছিস। খুব দামী কাপ তো, ফেলে দিতে মায়া লাগে।

    (দুজনে খানিকক্ষণ নি:শব্দে চা খায়)

    চম্পা : জানো মাসিমা, আমিও না আমার মেয়েকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছি।

    মৃন্ময়ী : (একটু চমকে উঠে) - কি? কি করেছিস?

    চম্পা : সাইকেল কিনে দিয়েছি।

    মৃন্ময়ী : ও:। তা দেখিস, এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায় না যেন আবার। যা দিনকাল, কোথা থেকে কে যে কার নজরে পড়ে। মামণিটার জন্যও খুব চিন্তা হয়। অবশ্য ওদের পাড়াটা খুব ভালো এলাকায়। সবসময় রাস্তায় ছোটছোট বাচ্চারা সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। পাশ দিয়ে হুস হুস করে গাড়ি চলে যাচ্ছে, আমার বাপু বুক কাঁপে।

    চম্পা : আমার মেয়ে সাইকেল করেই স্কুলে যায় গো। অনেকটা দূর কিনা।

    মৃন্ময়ী : জানিস তো মামণি যে স্কুলে পড়ে আমার বৌমা সেখানেই পড়ায়। খুব নামকরা প্রাইভেট স্কুল, অনেক টাকা মাইনে দিয়ে ছাত্ররা পড়তে আসে। (আরেকটা কাপ তুলে নেন) এই দ্যাখ সেই স্কুলের সামনে মা আর মেয়ে।

    চম্পা : জানি। তবু যদি তোমাকে এক কাপ চা করে দিত। কুল্লে তো তিন সপ্তাহ ছিলে তার মধ্যেই কতো না নালিশ। মেসোমশাইয়ের কাছে সব শুনেছি।

    মৃন্ময়ী : যা বুঝিস না তাই নিয়ে কথা বলিস না তো। ওদের কতো কাজ জানিস? তোর মেসোমশাই যে কোন যুগে বাস করতো কে জানে বাবা। সারাজীবন আমাকে আগলে আগলে চলে এখন এই বুড়ো বয়েসে একলা রেখে নিজে দিব্যি কেটে পড়লো – (গলা একটু ধরে যায়, কাশেন) শোন তুই রান্না বসা, আমি হাঁটতে যাচ্ছি।

    চম্পা : ও মাসিমা। আজকে না বেরুলেই নয়। কাল বললে মাথা ঘুরছে, আজকে হাতের কাঁপাটাও বেশি বেশি দেখছি।

    মৃন্ময়ী : না রে বাবা, আমি ঠিক আছি। বসে গেলেই আরো বেশি বুড়ো হয়ে যাবো। (মৃন্ময়ী বেরিয়ে যান। চম্পা গিয়ে দরজা বন্ধ করে। তারপর টিভিটা চালিয়ে দেয়। ঘরের মধ্যে হালকা যন্ত্রসঙ্গীত শোনা যাবে। চম্পা গিয়ে ক্যাবিনেট থেকে একটা কাপ তুলে নেয়, তারপর নিজের চা সেটার মধ্যে ঢালে। চেয়ারে বসে আরাম করে চা খায়। একটা হিন্দী সিনেমার গান গাইছে।)

    চম্পা : (ভেঙিয়ে) - সাবধান ভেঙে ফেলবি। এসব কাপ বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। এগুলো সব আমার মামণির ছবি। বলি ভাঙলোটা কে শুনি? আমি বাপু রোজ মাসিমা হাঁটতে গেলে বেশ জুত করে আমেরিকার কাপে চা খাই। কি হয়েছে? তাতে কি কাপগুলো ক্ষয়ে গেছে? ভারি তো আমার সাধের কাপ। ছেলে তিন বছরে একবার আসে, বৌদি একদিন মুখ দেখিয়ে বেঙ্গালুরুতে বাপের বাড়ি যান, আর সাধের মামণিও তাঁর সঙ্গে যায়। আমি হলে কাপগুলো ছুঁড়ে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিতাম।

    (কাপটা ঘুরিয়ে দেখে) এই মেয়েটা কিন্তু সত্যি আমার তিন্নির মতই দেখতে। ঠিক ওইরকম টানা টানা চোখ, এক মাথা চুল আর ছটফটে মুখের ভাব। হ্যাঁ গায়ের রংটা অত পরিষ্কার নয়, তাছাড়া অত ভালো ভালো সব জামাকাপড় তিন্নি কোথায় পাবে। তাও বলবো আমাদের ঘরের মেয়েদের তুলনায় অনেক ফর্সা। (অন্য একটা কাপ তুলে নেয়। মামণির ঘোড়ায় চড়া ছবি।) এবার পুজোর সময় গড়ের মাঠে গিয়ে তিন্নিকেও ঘোড়ায় চড়াবো। কোথাও তো বেড়াতে নিয়ে যেতে পারিনি কোনোদিন।

    (সামনে এসে দর্শকের প্রতি) বাবুরা, মা ঠাকরুনেরা সবাই শোনেন। আমার তিন্নি কিন্তু আমাকে বড়ো ভালোবাসে গো। ছবি লাগানো কাপ পাঠাতে পারে না তো তাই চিঠিই পাঠায়। দেখবেন (হঠাৎ ঘরের মধ্যে ছুটে গিয়ে একটা চিঠির বান্ডিল নিয়ে আসে)। স্কুল থেকে ফিরে রোজ মা’কে চিঠি লেখে, হপ্তায় একবার করে সেগুলো ডাকে পায়। আপনারা আশীর্বাদ করুন, আমার মেয়েটাও একদিন আমেরিকায় যাবে। (হঠাৎ থমকে যায়) কিন্তু আমাকে তো নিয়ে যেতে পারবে না। অনেক কাজ থাকবে তো। তা থাক, তখন বলে দেবো, তিন্নি রে--আমার জন্য খুব সুন্দর সুন্দর ছবিওয়ালা মগ আর ওই যে কি বলে গ্লেটিং কাড, ওইসব পাঠিয়ে দিস। কিন্তু চিঠি লেখাটা বন্ধ করিস না যেন। তোরা বড়ো হচ্ছিস, চোখে দেখার ভাগ্য তো হলো না, ওই চিঠি পড়েই যতখানি পারি বুঝি।

    (বাইরে একটা গোলমালের শব্দ। তনু ধরাধরি করে মৃন্ময়ীকে নিয়ে ঢোকে, চেয়ারে বসিয়ে দেয়। মৃন্ময়ী হাঁপাচ্ছেন। চম্পা দৌড়ে আসে, চিঠিগুলো টেবিলের ওপর ছড়িয়ে পড়ে)

    চম্পা : কি হয়েছে মাসিমার?

    তনু : মাথা ঘুরে গেছিল। ভাগ্যিস আমি কাছেই ছিলাম। একটু জল দে চম্পা আর ডাক্তারবাবুকে একটা ফোন করে দে।

    মৃন্ময়ী : (সামলে নিয়ে) - না না এতো ব্যস্ত হবার কিছুই নেই, মাথাটা শুধু একটু ঘুরে গেছিল, কোথাও লাগেনি। তনু তুই কাজে বেরোচ্ছিলি, আমার জন্য দেরি হয়ে গেল তো। তুই বরং আয় এখন, আমি একেবারে ঠিক আছি, ভাবিস না।

    তনু : না মাসিমা আমি বসছি ডাক্তার আসা অবধি।

    মৃন্ময়ী : না রে তুই যা, তোর দেরি হয়ে যাবে। হ্যাঁরে আসছে মাসে তো তোর বিয়ে, কেমন লাগছে শুনি?

    তনু : (হেসে) - খুব খারাপ লাগছে। পাড়া ছেড়ে যেতে হবে বলে। (ফোনটা বার করে দেখে) ঠিক আছে মাসিমা, আমি আসছি। আসলে একটা ইমপরট্যান্ট মিটিং আছে। চম্পা মাসিমার কাছে থাক, আমি মাকেও বলে যাচ্ছি। দরকার হলেই ফোন কোরো কিন্তু।

    (তনু বেরিয়ে যায়। চম্পা জল নিয়ে ঢোকে)

    চম্পা : বললাম শরীরটা ঠিক নেই, আজকে আর বেরিও না। তা কাজের মেয়ের কথা আর কে কানে নেয়।

    (হঠাৎ থেমে যায়। মৃন্ময়ী টেবিলের ওপর থেকে কাপটা তুলে নিয়ে দেখছেন। চম্পার গলার আওয়াজ বদলে যায়)

    চম্পা : সর্বনাশ। ও মাসিমা গো, এই কান ধরছি আমাকে মাপ করে দাও। নাহয় আমাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিও কিন্তু আজকে এই অসুস্থ শরীরে আর রাগারাগি কোরো না গো। আমার বাবার মতন তোমারও না ইস্ট্রোক হয়ে যাবে। তুমি হাঁটতে বেরুলে আমি ওই আমেরিকার কাপে চা খাই। কেন খাই জানি না মাইরি বলছি। আমার দোষ হয়েছে, এই তোমার পায়ে পড়ি আর কখনো এমন করবো না।

    মৃন্ময়ী : (কাপটা রেখে ছড়ানো চিঠিগুলো নাড়াচাড়া করেন) চিঠিগুলো কার?

    চম্পা : আমার মেয়ের। বলেছি রোজ স্কুল থেকে ফিরে দু’লাইন চিঠি যেন লেখো। কতদিন দেখি না মেয়েটারে গো। (গলা ধরে আসে)

    মৃন্ময়ী : (আনমনে চিঠি আর কাপগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে নিজের মনেই কথাগুলো বলেন) টুবাই যখন প্রথম কলেজে গেছিল প্রায়ই আমাকে লিখতো। তখন ইমেইল হয়নি। এখন বলে কি – আচ্ছা মা, তুমি সোস্যাল মিডিয়ায় আসো না কেন, তাহলে তো মাঝে মাঝে আমরা চ্যাট করতে পারি। আমি কথা বলা বুঝি, চিঠি লেখা বুঝি কিন্তু চ্যাট করাটা ঠিক বুঝি না। আমারই দোষ।

    চম্পা : ও মাসিমা চলো একটু ঘরে গিয়ে শোবে। আমি ওগুলো খুব ভালো করে ধুয়ে রেখে দিচ্ছি, মা কালীর দিব্যি আর কোনোদিন ওতে হাত দেবো না।

    মৃন্ময়ী : (নিজের মনেই) - সব সম্পর্ক পুরনো হয়ে যায়। নতুন সম্পর্ক বানাতে না পারলে মানুষ স্মৃতির পিরামিডের মধ্যে মমি হয়ে বেঁচে থাকে। আজকে যদি পড়ে যেতাম কারা আমার সঙ্গে হাসপাতালে যেতো? এই তোরা। আর আমি কিনা এগুলো তোদের হাত থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম--লোক দেখানো ভালোবাসার মিথ্যে খেলনাগুলোকে।

    চম্পা : ও মাসিমা। ভগবানের দোহাই দিয়ে শুয়ে পড়ো, ডাক্তারবাবু এসে পড়লেন বলে।

    মৃন্ময়ী : অথচ নতুন ভালোবাসা আমাদের দরজায় টোকা দিয়ে বেড়ায় প্রতিদিন। প্রতিদিন সূর্যের দিকে নতুন কুঁড়ির দল মুখ তুলে তাকায়। আমারই মনের দরজা বন্ধ করে মৃত জীবনের প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে মাথা খুঁড়তে থাকি।

    চম্পা : এ যে দেখি ভুল বকছে। (প্রায় কেঁদে ওঠে) মাসিমা গো—

    মৃন্ময়ী : আসলে আমরা সবাই সমান আহাম্মক। বিছানা বদলে যায় কিন্তু আমরা পুরনো বালিশে মুখ গুঁজে থাকি। (সোজা হয়ে বসে, চশমাটা চোখে লাগান। হঠাৎ কি মনে করে হেসে ওঠেন) শোন, ওখান থেকে তোর পছন্দমতো দুটো কাপ নিয়ে কড়া করে কফি বানিয়ে আন দেখি। তারপর এখানে বোস, আমি বরং এই চিঠিগুলো পড়ি। তারপর তোর দেশের বাড়িতে একটা খবর পাঠা, এই রবিবার যেন মেয়েটাকে একবার এখানে নিয়ে আসে। কোন ক্লাসে পড়ে বললি যেন—

    চম্পা : মাসিমা!

    (মৃন্ময়ী খুব খোশমেজাজে বসে চিঠিগুলো পড়ছেন। চম্পা খুব বাধো বাধো হয়ে সাবধানে দুটো কাপ তুলে নিলো।)

    চম্পা : (বেরিয়ে যেতে যেতে দর্শকদের প্রতি) দেখছেন তো। বুড়ির মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments