• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬০ | আগস্ট ২০১৫ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • অনাদৃত প্রতিভার আগুন দর্পণ : শম্পা ভট্টাচার্য


    দ্য পার্সিকিউটেড; রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়; সম্পাদনাঃ সুরঞ্জন মিদ্দে; প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০১২; অঞ্জলি পাবলিশার্স - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ১৬০; ISBN: 978-93-81745-17-5

    সারা বছর ধরে বাংলা প্রকাশনার জগৎ নানা ছাঁচে আর ধাঁচে অসংখ্য বই প্রকাশ করে চলেছে। তার একটা অংশ পরীক্ষামুখী, পাঠ্যবই। বিদ্যার্থীদের জন্য রচিত। আর একটা অংশে থাকে সৃজনমূলক ভাবনাচিন্তার ভিত্তিতে মৌলিক লেখালেখির আগ্রহে রচিত অনবদ্য কিছু বইপত্র। দেশ ও জাতির ইতিহাস সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান এবং নির্মোহ ইতিহাসবোধ থেকে এ ধরনের গ্রন্থ রচিত হয়। অধ্যাপক সুরঞ্জন মিদ্দে সম্পাদিত রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'দ্য পার্সিকিউটেড' নাটকটি এমনই দীর্ঘ শ্রমজাত উপস্থাপনা।

    দীর্ঘদিন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বাঙালি জাতির কাছে অবজ্ঞাত ও অনাদৃত ছিলেন। এই অবজ্ঞাত লেখকটির অনেক আগেই সঠিক মর্যাদা পাওয়া উচিত ছিল। দেরিতে হলেও 'দ্য পার্সিকিউটেড' নাটকটি সাধারণ পাঠক-সমাজের কাছে উপস্থাপিত করে সম্পাদক পূর্বসুরীদের সেই অসম্পূর্ণ কর্মটি সমাধাপূর্বক সকলের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। উনিশ শতকের উত্তাল সময়ের জীবন্ত দলিল এই নাটক। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের এই পূর্ণাঙ্গ নাটকটির নাম 'The Persecuted or the dramatic scenes illustrative of the Present state of Hindu society in Calcutta;' প্রকাশকাল ১৮৩১ সালের ১২ই নভেম্বর। নাট্যকার হিন্দু যুবসম্প্রদায়কে এই নাটকটি উৎসর্গ করলেন এই আশায় যে হিন্দু-সমাজের গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিবাদ করতে পারবেন।

    যতদূর জানা যায় বাঙালির লেখা এই প্রথম মৌলিক নাটক কখনও অভিনীত হয়নি। ঐতিহাসিকরা এর দুটি কারণ নির্নয় করেছেন—এই নাটকটি মঞ্চস্থ করলে পরোক্ষে ইয়ংবেঙ্গলকে স্বীকার করে নিতে হয়। তাছাড়া এই নাটক মঞ্চস্থ হলে হয়তো রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের মতো হিন্দু সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা হিন্দু থিয়েটারে পদার্পণ করতেন না। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের এই নাটকটি সম্পর্কে 'সমাচারদর্পণ' লিখেছে—'গ্রন্থকর্তা বাবু কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমরা 'তাড়িত' নামক একটি গ্রন্থ প্রাপ্ত হইলাম—ঐ গ্রন্থ অতি নৈপুণ্যরূপে রচনা করিয়াছেন। ইঙ্গরেজী ভাষা ঐ বাবুর দেশিয় ভাষা নহে অতএব ইহা বিবেচনা করিএ তাঁহার ঐ ভাষাতে লিখন অত্যুত্তম জ্ঞান হয়—কিন্তু কলিকাতাস্থ লোকেরা ঐখানে যে প্রকার দলাদলে বিভক্ত আছেন—তাদৃষ্টে এই পুস্তকের মর্ম প্রকাশ করা আমাদের সুকঠিন।'

    বাঙালির জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য দলাদলির শিকার হয়েছিলেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন। ১৮৭৭ সালে কলকাতার টাউন হলে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ সভা হয়েছিল রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন তাতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনে শিশিরকুমার ঘোষ, রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগী কৃষ্ণমোহনের 'The Arian witness' এবং 'Dialogue on the Hindu Philosophy' আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছিল। বাংলাভাষার উন্নতিতে সর্বদা সচেষ্ট এই মানুষটি ১৩ খণ্ডে 'বিশ্বকল্পদ্রুম' নামে বিশ্বকোষ গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৬৪ সালে ৪ঠা জুলাই রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইংল্যাণ্ডের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন। কালিদাসের রঘুবংশম্‌ এবং কুমারসম্ভব ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন তিনি।

    রক্ষণশীল প্রসন্নকুমার ঠাকুরের বিরুদ্ধে কৃষ্ণমোহন প্রকাশ করেন 'এনকোয়্যারার' পত্রিকা। প্রায় পঞ্চাশটি পুস্তক ও পুস্তিকার লেখক রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ডি. লিট. উপাধি পান। ১৮৩১ সালে 'দ্য পার্সিকিউটেড' নাটকটি প্রথম প্রকাশের ১১০ বছর পর অমল হোমের সম্পাদনায় 'দ্য ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট'-এ তা আবার প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালে। ডিরোজিওর শিষ্য কৃষ্ণমোহনের উপর রক্ষণশীলদের অত্যাচারের বিষয় এ-নাটকে প্রতিফলিত। নাটকটির প্রতিটি সংলাপে ক্ষমাহীন ভাষায় উন্মোচিত হয়েছে রক্ষণশীলদের মুখ ও মুখোশ। সেক্সপীয়রের আদর্শে লেখা পাঁচ অঙ্কে পনেরোটি দৃশ্যে বিন্যস্ত 'দি পার্সিকিউটেড' নাটকে কুড়িটি চরিত্র আছে। মুখ্যচরিত্র ধর্মনৈতিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তরুণ বিদ্রোহী বাণীলাল কৃষ্ণমোহনের আদর্শে গড়া। এ নাটকে কোনো নারীচরিত্র নেই। কৃষ্ণমোহন খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করলে তাঁকে গৃহত্যাগ করতে হয়। আত্মীয়স্বজন পরিত্যক্ত এই মানুষটি গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য সমাজের দ্বারা নানাভাবে উৎপীড়িত হন। সে ঘটনা কিঞ্চিৎ প্রতিফলিত এখানে। লেখার মধ্যে যে দীপ্র অগ্নি থাকলে তা কালজয়ী হয় তার প্রমাণ এই নাটকটি।

    আলোচ্য গ্রন্থের সম্পাদক ১৯৪১ সালে এই নাটকটির সঙ্গে প্রকাশিত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটিও সংযোজিত করেছেন। এই বইটির আটটি প্রবন্ধে কৃষ্ণমোহনের প্রতিভার নানা দিক সম্বন্ধে মূল্যবান আলোচনা আছে। গবেষকদের আকরগ্রন্থ এই বইটির দুর্লভ চিত্রমালা পাঠকের নজর কাড়বে। দ্য পার্সিকিউটেড নাটকটি বহুদিন দুষ্প্রাপ্য ছিল। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, এই তরুণ অধ্যাপক নাটকটি সম্পাদনা করে একটি দুর্লভ গ্রন্থকে জিজ্ঞাসু পাঠকের সামনে উপস্থিত করেছেন। এ জন্য তিনি ধন্যবাদার্হ। হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'প্রাক কথন' গ্রন্থটির অন্যতম আকর্ষণ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments