• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৮ | নভেম্বর ২০১৪ | প্রবন্ধ
    Share
  • হিরো অফ আওয়ার টাইম : গৌতম সেনগুপ্ত


    কোনো কিছু খুব বেশি, খুব বেশিরকম বেশি জানলে ২০-মিনিটে বলা খুব কঠিন। একটা বিখ্যাত চিঠির কথা মনে পড়ছে। সাড়ে সাত পাতা লম্বা সেই চিঠির শেষ দুলাইন ছিল অনেকটা এরকম, তুমি বিষয়টা ছোটো করে জানতে চেয়েছো। হাতে সময় কম, তাই চিঠিটা লম্বা হয়ে গেল।

    আমাদের পারিবারিক দৈনন্দিনে নবারুণদা ছিলেন একটা বড়সড় মেঘের মতো। ঠিক যেমনটা এরোপ্লেন থেকে দেখা যায়। চারদিকে ভয়ংকর রোদ। তার মধ্যেই ছোটো ছোটো দ্বীপের মতো, টুকরো টুকরো ছায়া। আমাদের বাড়িতে নবারুণদা যতোটা লেখক, তার চেয়েও অনেক বেশি, দাদা। রাগি বড়দা। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ব্লু খদ্দরের শার্ট পরে, লম্বা সরু আঙুল তুলে নবারুণদা আমার স্ত্রীকে বলছেন, 'সে কি তোমাদের মেডিক্লেম নেই! তোমরা কি ইললিটারেট, গ্র্যাজুয়েট নও?' কথাটা শুনে নবারুণদার ছেলে তথাগত, মিষ্টি হেসে জানালো, 'বাবার ছিল না'।

    নবারুণদাকে প্রথম কোনো সভায় দেখেছি নাকি যারা আগুন লাগায় নাটকে মনে নেই। তবে প্রথম আলাপ নাইন্টি ফাইভে, প্রতিক্ষণ দপ্তরে। সেই প্রথম শারদীয়ায় লেখা বেরিয়েছে আমার। প্রতিক্ষণের শেষ শারদীয়া। ডেকে পাঠিয়েছেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শ্রী দেবেশ রায়। সেই বিকেলে দেবেশদার ঘরে চাঁদের হাট। একদম কোণে, একটু কাত হয়ে বসে আছেন নবারুণদা। খদ্দরের শার্ট। রংটা সম্ভবত পিংক। গোটানো জিনস্‌। পায়ের ওপর পা। এক পায়ে চটি। অন্য পায়ের চটিটা মেঝেতে।

    ঢোকামাত্র দেবেশবাবু বললেন, 'এই যে গৌতম, আপনার ফ্যান ক্লাবের প্রেসিডেন্ট'। একটা ত্যারচা লুক, 'সেনগুপ্ত?' মাথা নাড়ার আঙুল তুলে বললেন, 'ভালো হচ্ছে, মালটা ওঘরে।' মাল? 'ক্যাশ, ক্যাশ। ওটা আগে, কথা পরে।' ক্যাশ নিয়ে আসার পর শুরু হয়েছিল কথা। থামে নি। মৃত্যুর মাস ৫/৬ আগে অব্দি টানা।

    কিছু প্লেয়ার থাকে অলটাইম পড়পড়। কিন্তু পড়ে না, গোল করে বেরিয়ে যায়। যেমন, জর্জ বেস্ট। নবারুণদা ওরকম, ঠিক ওরকম, দ্য বেস্ট। এত এতবার মৃত্যুকে ডজ ড্রিব্‌ল করেছেন, ওঁর ভাষায়, 'চুক্কি মেরে', বেরিয়ে গেছেন যে এক-এক সময় মনে হতো, মাইকেলের সেই অমোঘ লাইনটা বোধহয় মিথ্যেই হয়ে যাবে। না, হল না। চলে গেলেন। এই চিরস্থায়ী অনুপস্থিতির সামনে আর কিই বা করা যায়, চুপ করে বসে থাকা ছাড়া?

    আমার সঙ্গে নবারুণদার দেখা হত কম, আড্ডাটা মূলত ফোনেই। যেটুকু দেখা, দুপুরে, বৌদি বেরিয়ে যাবার পর। তারপর যা ঘটতো, সহজেই অনুমেয়। তারও পর, বেরিয়ে পড়া, নবারুণদার ভাষায়, 'পাগলা চক্কর'। খিদে পেলে দুটো 'রেস্টুরেন্ট' বাঁধা। একটা ভেজ, বাসবদার, প্রয়াত বাসব দাশগুপ্তের ডালহৌসির অফিস। অন্যটা, নন-ভেজ, তারাতলায় রামকুমারদার, বিশিষ্ট লেখক রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের অফিস।

    নবারুণদা মুডে থাকলে, অনেক সময় না থাকলে তা আনতে, গল্প শোনাতেন। সবই বিদেশি (কালেভদ্রে দিশি) বিপ্লবী, তাত্ত্বিক-লেখকদের গল্প। ওঁর গলায় সে-গল্প যাঁরা শুনেছেন তাঁরা জানেন। খেয়াল রাখতে হবে, নবারুণদা শুধু লেখক নন, একজন প্রথম শ্রেণীর অভিনেতা/নির্দেশক। আর, 'ওয়ান অ্যাণ্ড ওনলি সন অফ দ্য গ্রেট বিজন ভট্‌চারিয়া।'

    প্রথম গল্পটা সন্ধের। প্যারিসের সেই শনিবারের সন্ধেতে শ্রমিক বস্তির গলিতে সবাই মাতাল। বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক বাবার প্রাসাদোপম বাড়ি ছেড়ে মিশেল ফুকো তখন চলে এসেছেন এই গলির শেষ মাথায় একটা ছাপোষা ফ্ল্যাটে। তাঁর বাড়ি খুঁজছে এক তরুণ। সেই মদির সন্ধেয় কেউ তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। শেষটায় দয়া হল এক বুড়োর। গেলাসের দিকে তাকিয়ে সে বললো, 'কি করে লোকটা?' তরুণ শুরু করে দিল ফুকোর বিভার কথা। কাজ হচ্ছে দেখে অন্যান্য বৈশিষ্টের কথা, পোলোনেবা, নেড়া মাথা, সমকাম। বুড়ো বললো, 'সে সব তো হল আমাদের জন্য কিছু করেছে? আদৌ কিছু করেছে কি?' 'আরে, উনি তো তোমাদের অধিকারের জন্যই লড়াই করেন'। এই প্রথম গ্লাস থেকে মুখ তোলে বুড়ো। ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে বলে, 'আমাদের জন্য যাঁরা লড়াই করেন, তাঁদের সবার নাম জাঁ পল সার্ত্র।'

    দ্বিতীয় গল্পটা রাতের। গভীর রাতের। লন্ডনে সেবার ঠাণ্ডা পড়েছিল খুব। টেবিলে কলম রেখে উঠে দাঁড়ালেন মহালেখক চালর্স ডিকেন্স। আপনমনে বললেন, 'লোকে বলে আমি ইংরিজি ভাষার গর্ব। আমি আছি বলেই ভাষাটা আছে। এই লন্ডন শহরের প্রতিটা ধুলো আমার চেনা। শুনেছি এখানকার সমস্ত ম্যাপ ধ্বংস হয়ে গেলেও শুধু আমার লেখা থেকেই তা ফের তৈরি করে নেওয়া যাবে। চলো হে ডিকেন্স, একবার পায়ে হেঁটে দেখে নেওয়া যাক শহরটা। সূঁচের মতো হাওয়া কোট ফুঁড়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে হাড়। দূরে ঠাণ্ডায় হল্লা করছে যে মাতালগুলো, এদের আমি চিনি না। দু-একটা দলছুট বারবণিতা এখনো খদ্দেরের আশায়! না, এদের আমি চিনি না। আর ওই যে বাচ্চা কোলে মেয়েটি, আগুনের ভেতর ঢুকে পড়তে চাইছে বারবার, ভাবছে, হয়তো বেঁচে যাবে। না, ওকেও আমি চিনি না। ছোঃ, দুপয়সার কলমপেষা মজুর। ছোঃ ছোঃ ছোঃ। যা, যা। শহর চিনতে এসেছিস। যা, লেখার টেবিলে ফিরে যা। আর নোংরা কর পরিষ্কার সাদা পাতাগুলোকে।'

    নবারুণদার লেখা নিয়ে কথা বলা আমাকে মানায় না আমি জানি। তবু কিছু কথা উঠে পড়লো 'কিউ' খ্যাত কৌশিকের তথ্যচিত্রের সুবাদে। আর কৌশিকের সাগরেদ সুরজিৎ জানতে চাইছিলেন সাবভার্সানের কথা। ওঁরা অন্তর্ঘাত দিয়েই পড়েছেন নবারুণকে। ঠিকই পড়েছেন। কিন্তু তারপরও একটা প্রশ্ন, ছোট একটা খটকা থেকেই যায়। ধরা যাক আদ্যন্ত রোমান্টিকের রোমান্সটাই যদি সরে যায়। মানে সেই তাঁকে, দেখা যাবে প্রতিদিন, পোস্টারে, দেওয়ালে দেওয়ালে কিন্তু অভিশাপ এমনই দেখা হবে না। কি করবে সেই প্রেমিকা? তার সরল ভাষা কি বদলে যাবে না তীক্ষ্ণ অপভাষায়? সে কি মুখে পেট্রোল নিয়ে ছুঁড়ে দেবে না আগুন?

    আমার পড়ায় নবারুণদা একজন আদ্যন্ত রোমান্টিক মানুষ, যাঁর স্বপ্ন জুড়ে থাকতো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। কিউদের ওই সাক্ষাৎকারে আমি একটা গল্প বলেছিলাম। অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাড়ি ফিরছি। দূরে একটা আলো। কাছে গিয়ে দেখি শীর্ণ একটা মোমবাতি। আর তার চেয়েও রোগা একটা ছেলে লাল রঙ লাগাচ্ছে কাস্তে হাতুড়ির ওপরের তারাটায়। ওই ছেলেটা, ওই ছেলেগুলো নবারুণদা।

    পরদিন রাতে ফোন, কি দিয়েছিস, পুরো বিশ্বনাথ, টোকায় তার।

    — হবে না। হিরো অফ আওয়ার টাইম।

    ব্যাস, কান্না চালু। বাসবদার স্মৃতিসভায় বক্তৃতাটা খুব বেশি হলে দু লাইন। বাকি পুরোটাই কান্না। নবারুণদা আমি শেষ দেখেছিলাম চলে যাবার দিন তিনেক আগে। হ্যাঁ, আমিও ওরকম। না, না, সেসব কথায় যাবো না আমি। বদলে দুটো লেখা পড়বো। প্রথম অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে। ওটা গল্প নয়, সম্পাদকীয়। দ্বিতীয়টা গল্প। অন্ধবেড়াল। তার শেষটা।

    স্টপওয়াচ পারি কমিউনের সময় কমিউনার্ভরা রাস্তায় বেরিয়ে শহরের বড় বড় ঘড়িগুলোকে গুলি করেছিল। বলেছিল ওই ঘড়িতে রয়েছে শাসকের সময়। আমরা নিজেদের সময় কায়েম করতে চাই। এটা জাল্টের বেঞ্জামিনের লেখায় আছে। হারবার্ট মার্কিউসের একটি প্রবন্ধেও ঘটনাটির উল্লেখ পেয়েছি। যাই হোক, ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে হল আমাদের লেখাগুলো এক একটা স্টপওয়াচ, পাঠক পড়তে শুরু করলে চলতে শুরু করে। এক একসময় চলেও না। অলৌকিক এই স্টপওয়াচ ধরতে পারে লেখকের, পাঠকের ও তাদের বাইরের সময়। বাতিল, অকেজো বা ফালতু ঘড়ি বানিয়ে কোনো লাভ নেই।

    অন্ধবেড়াল

    ... সেই ভয়াবহ ঝড়ের ওপরে শেষ অবধি অন্ধ বেড়ালের ভাগ্য নির্ভর করে রয়েছে। নদীতে তখন ফুঁসে ফুঁসে উঠবে দু-মানুষ ঢেউ। সেরকম খ্যাপা জলোচ্ছাস হলে বাঁধ ধ্বসে যাবে। আর এরকম ঘটনা ঘটার আগে থেকেই যে দুর্যোগ অবধারিত শুরু হয়ে যায় তার ফলে সেই মেয়েটার বাচ্চা দুটোকে নিয়ে এপারে আসাও অসম্ভব। জলের ধাক্কায় আর উন্মত্ত বাতাসের দাপটে হোটেলটা যখন কেঁপে কেঁপে উঠবে, নদীর দিকে খুঁটিগুলো যখন একটা একটা করে টলে যেতে থাকবে তখন হোটেল মালিক বাসনকোসন আর চেয়ার টেবিলগুলো সামনের গলির ওপারে যে রকের মতো জায়গাটা আছে সেখানে নিয়ে গিয়ে ডাঁই করে রাখতে পারে। এপাশ-ওপাশ দুলতে থাকা লণ্ঠনটাও সে নিতে ভুলবে না। কিন্তু জল বেড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলেও তা শুরু হবে টাল খাওয়া দিকটার থেকে। অন্ধ বেড়াল তখন বড়জোর অপেক্ষাকৃত উঁচু উলটো দিকটায় সরে যেতে পারে। কিন্তু ওঘর ছেড়ে বেরোবে না। এখানেও দুটো সম্ভাবনা রইল। ঘরটাতে আস্তে আস্তে জল বাড়তে পারে অথবা এক ঝটকায় দোতলা সমেত হোটেলটার গোটা কাঠামোটাই নদীতে ধ্বসে পড়তে পারে। এর কোনো একটা হলে অন্ধ বেড়ালের কিছু করার নেই। হয় জল তাকে ছাপিয়ে উঠবে নয়তো ঘরের সঙ্গেই সে নদীতে তলিয়ে যাবে। কিন্তু ঝড় যদি কোনো কারণে রাস্তা পালটায় বা অত ভয়াবহ না হয় তাহলে হোটেলটা যেমন আছে তেমনই থাকবে। এবং, টেবিলের তলায়, অন্ধকারে বসে থাকবে অন্ধ বেড়াল। সকালে এসে বাচ্চাদুটোও দেখতে পাবে যে, চেনা জায়গাতেই সে চুপ করে বসে রয়েছে।

    [এটা কোনো প্রবন্ধ নয়। ২০১৪-র ২২ সেপ্টেম্বর, বিশিষ্ট লেখক নবারুণ ভট্টাচার্যের স্মরণ অনুষ্ঠানে বলা। সাহিত্য অকাদেমির আমন্ত্রণপত্রে বলার সময়টা নির্দিষ্ট করা ছিল, ২০ মিনিট।]



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ নিউ এজ থেকে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments