'মাতা' শব্দের ভারতবর্ষীয় শাস্ত্রে ষোড়শ এবং মতান্তরে সপ্তপ্রকার ভেদ থাকলেও এখানে নারী বা মাতার কর্মব্রতী ভূমিকার মর্যাদা নেই। শাস্ত্রে একই সঙ্গে মা শক্তিস্বরূপা, পূজনীয়া, অন্যদিকে নারীর কোনো স্বাতন্ত্র্য অনুচিত, সে গোধনতুল্য, সে দাসী। এই দ্বিচারিতার আড়ালে পুরুষ আধিপত্য, নারীর দাসত্ব বাধ্যতা ছিল। নারীবিদ্রোহ গল্পকথা, দু-একটি উদাহরণ ব্যতিক্রম। এটাই ভারতে, বাইরে, রাশিয়াতেও। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ১৯১৭ তে না ঘটলে নারীর দাসত্ব, জেনানা ফাটক থাকতই।
গোর্কির 'মা' উপন্যাস অবশ্য ১৯০৭-এ প্রকাশিত, ঘটনাকাল ১৯০২, বাস্তব চরিত্র-ভিত্তিক। বিশ্বসাহিত্যের প্রাঙ্গণে এই প্রথম হাজির এক শ্রমজীবী মা, তার রাজনৈতিক সংগ্রাম। প্রথম দিকে পাভেলের মা ভীরু, মাতাল স্বামীর অত্যাচারে বিপন্ন এক নারী। কিন্তু পাভেল যেদিন বাবার অমানুষিকতার বিরুদ্ধে হাতুড়ি তুলে ধরে, তার মুখ পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় দিন দিন ধারালো হয়ে ওঠে, তখন মা পেলাগেয়া ভয়ও পায়, কৌতূহলীও হয়। ছেলে বদলায়, মা বদলায়। ধীরে ধীরে পেলাগেয়া হয়ে ওঠেন পাভেলের মা থেকে সকল বন্ধুর মা। এর পর পাভেলের গ্রেপ্তার ও মায়ের পরিবর্তন। কারখানায় মজুরদের মধ্যে রুটি বিক্রির সঙ্গে ইস্তেহার তুলে দেওয়া। আদালতে মায়ের কথা আরেক মাকে — 'দুনিয়ায় এগিয়ে চলেছে আমাদের সন্তানেরা, তাদের ছড়ানো আলোয় আলোকিত হবে বিশ্ব।' গোয়েন্দা পুলিশ তাকে ঘিরে ধরলে শুনি দৃপ্ত উচ্চারণ— 'আমার পুনরুজ্জীবিত আত্মাকে মারতে পারবে না ওরা।' সাহিত্যে—এক নূতন মা-চরিত্রের মডেল তৈরি হয়ে ছড়িয়ে গেল নানা দেশে, আমাদের দেশেও। জানা যাচ্ছে ১৯২৫ থেকে ১৯৩৮-র মধ্যে বাংলাতে 'মা' উপন্যাসের চারটি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ইংরেজি থেকে, যদিও সংক্ষেপে। বিপ্লবী প্রমথ ভৌমিক বলেছেন — 'বাঙালি বিপ্লবীদের রূপান্তরে গোর্কির অবদান কম নয়। শুষ্ক তত্ত্ব যা করতে পারত না, গোর্কির বিপ্লবী আবেগ তা-ই ঘটাল।' গোর্কি এক মর্মান্তিক গল্প লিখেছিলেন — 'দেশদ্রোহীর মা'। এই মা এক নাগরিক, আবার মা এমন এক ছেলের যে দেশ ধ্বংস করছে, হাসিখুশি, সুদর্শন, অথচ হৃদয়হীন ছেলে। এই ছেলে মায়ের কাছে দেশশত্রু, শ্রেণিশত্রু। মা বহুজনের আপত্তি তুচ্ছ ক'রে ছেলের শিবিরে যান, একটি ছুরি নিঃশব্দে ঢুকিয়ে দেন ছেলের বুকে। আর তারপর শোকার্ত মা — নাগরিক হিসেবে, দেশের জন্য সাধ্যমত করার পর ছেলের রক্তে উষ্ণ ছুরিটি বিঁধিয়ে দেন নিজের বুকে। বিপ্লবী রোমান্টিকতার উদ্বেলতা ফুটিয়ে তুলতে চান লেখক, মাতৃচরিত্র হয়ে ওঠে শ্রেণিঘৃণায় ভাস্বর।
গোর্কির পেলাগেয়া-র বাঙালি উত্তরসূরী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হারাণের নাত জামাই' গল্পের ময়নার মা। অবশ্য মানিক আগে 'জননী' লিখেছেন, যার সংগ্রাম রাজনৈতিক নয়। বরং 'শহরতলী'র যশোদার কথা আসতে পারে। তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে 'হারাণের নাতজামাই' গল্পে কৃষকনেতা ভুবন মণ্ডলকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিল ময়নার মা, হঠাৎ পুলিসের আগমনে কৃষকনেতাকে জামাই সাজিয়ে পুলিসকে ঠকিয়েছিল। গ্রামীণ সংস্কারকে চূর্ণ ক'রে মেয়েকে কৃষকনেতার সঙ্গে একঘরে পাঠিয়ে বৈপ্লবিক ভূমিকা নিয়েছিল তেভাগা প্রভাবিত অশিক্ষিত মা-টি। আসল জামাই জবাবদিহি চাইলে, ময়নার মা মেয়েকে সাহস দিয়ে বলে — 'বাপেরে নিয়া ঘরে গেছিলি, বেশ করছিলি, কাঁদনের কি?' আসল জামাইকে ধমকে সে শোনায় আর এক বৈপ্লবিক কথা — 'খালি জম্মো দিলেই বাপ হয় না, অন্ন দিলেও হয়। মণ্ডল আমাগো অন্ন দিছে। আমাগো বুঝাইছে, সাহস দিছে, একসাথ করছে, ধান কাটাইছে।' একজন অশিক্ষিত মায়ের এ কথা অবশ্য শাস্ত্র সম্মত, কিন্তু বুঝেছে অভিজ্ঞতা মারফৎ।
মহাশ্বেতার লেখায় নারীর স্থান, সমস্যা, সংকট যথেষ্ট। সেখানে হাজার চুরাশীর মা ব্রতীর মা যেমন আছেন, তেমনি আছেন সাঁঝ সকালের মা, স্তনদায়িণী, রুদালি, জাহ্নবী মা, কানাই বৈরাগীর মা, হুলমাহার মা, সমাজ-বিরোধীর মা, গিরিবালা, মাদার ইণ্ডিয়া, রামরহিমের মা প্রভৃতি। বলাবাহুল্য এই মাতৃমণ্ডলী সবাই শ্রমজীবী নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিকূল শোষণ শাসনের দিকটিই বড়ো হয়ে উঠেছে। পেলাগেয়া হল পিওতর জালোসভের মায়ের প্রতিচিত্র। তাঁর মা সংগঠনে কাজ করতেন, ছদ্মবেশে সাহিত্য পৌঁছে দিতেন — এসব কথা গোর্কি আমাদের জানিয়ে দেন। ময়নার মা প্রকৃতপক্ষে কোন্ বাস্তব চরিত্র নিয়ে জানি না, তবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ। পুলিস তাড়ানি মেয়েলি শাঁখ ঘন্টা বঁটি কাটারি নিয়ে রুখে দাঁড়ানোর কথা মণিকুন্তলা সেন জানান 'সেদিনের কথা'য়। মহাশ্বেতাও জানান — তাঁর দিদিমা খুবই রাজনীতি সচেতন ছিলেন, নারীমুক্তি বিষয়ে যথেষ্ট চিন্তা করতেন। মায়ের কাছে কাজের সূত্রে আসা যাওয়া বিচিত্র নারীসমাজ দেখেছেন, যারা 'বেজায় প্রাণবন্ত এবং অতীব দুর্দান্ত।' নিজের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও কম নয়। শবর খেড়িয়া লোধা সাঁওতালদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে আরো অনেক মেয়ে, মাকে দেখেছেন। 'হাজার চুরাশীর মা' লেখিকার ভাষায় — 'একজন অরাজনীতিক মা' যে তরুণ প্রজন্মকে বুঝতে, জানতে চেষ্টা করেছে। ব্রতীর জন্য সুজাতা স্বামী শাশুড়িকে অমান্য করেছেন, ভোগবাদী জীবন থেকে ছেলেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। ব্রতীর জন্মদিনে বাবা দিব্যনাথের পার্টি, মেয়ের বিয়ের পাকা কথা, কুখ্যাত পুলিস কর্তার সে পার্টিতে আসা — এ সব কিছুকে প্রত্যাখ্যান করে সুজাতা, অন্যদিকে কম্যুনিস্ট পার্টির অধিকাংশ লোকজনকে দেখে 'শবদেহ' ভেবে নেওয়া, এদের ভোগলিপ্সা, অতীত বিস্মরণ, বেদনাহত সুজাতার মৃত্যু — পারিবারিকতা রাজনৈতিকতায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়। তরুণ সমাজে বইটির জনপ্রিয়তা এই নিঃশব্দ প্রতিবাদিতাকে প্রকট করে তোলে। মহাশ্বেতার 'মায়ের মূর্তি' গল্পটিতে আমরা লক্ষ্য করি জমি দখলের লড়াইয়ে তেভাগা আন্দোলনের শহীদ কৌশল্যার কথা। লাল নিশানে আবৃত কৌশল্যা জয়চাঁদকে নিয়ে শোকক্ষুব্ধ মিছিল, শ্লোগান — মাতৃবন্দনা তথা তেভাগা বন্দনার নামান্তর। 'জাহ্নবী মা' গল্পে আছে ধনুকধারীর বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ। এই মা বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও সঞ্চার করে দিতে পারেন প্রজ্জ্বলন্ত ক্রোধ বাগদীদের মনে। 'কানাই বৈরাগীর মা' গল্পের পলাতক ছেলেটি আহত অবস্থায় পাঁচিল টপকে মায়ের কাছে আশ্রয় পায়, সে মা-ই যে কানাই এর মা, তা সে জানত না। মায়ের ধমকানিতে রাজনৈতিক ছেলেদের সঙ্গত সমালোচনা ('তুমি তুমি করছ কেন বাছা? ভদ্রভাবে কথা কইতে পার না? না কি ঘরে মা বোন নেই?' অথবা — 'টাকা দেব! টাকার যদি অত ক্ষমতা তাহলে তুমি এখন ফাঁদে বন্দি শেয়ালের মতো হাঁচড় পাঁচড় করছ কেন বাছা? তোমার টাকার মুখে নাথি। থাকতে হয় পড়ে থাক ঘরের এক কোনায়।') রাজনৈতিক উপলব্ধির স্তরান্তরকে প্রকাশ করে, যা ঐতিহাসিক। ১৯৪৯ সালের ২৭ শে এপ্রিল বৌ বাজার স্ট্রীট অঞ্চলে মিছিল গুলি চলে, কয়েকজন পুরুষ সহ লতিকা সেন, অমিয়া দত্ত, গীতা সরকার, প্রতিভা গাঙ্গুলি, যমুনা দাস মাহাতো, মৃণালিনী দেবী — যাদের প্রথম তিনজন পার্টি সদস্য — 'সৃষ্টি করল এক নতুন লিজেণ্ড। কী করে অবহেলায় প্রাণ দিতে হয় — এই পাঠ নতুন করে পেল কমিউনিস্টরা।' (উত্তাল চল্লিশ — অসমাপ্ত বিল্পব — অমলেন্দু সেনগুপ্ত, পৃ. ৩৫০)
সাবিত্রী রায়ের গল্পে উপন্যাসে আছে বামপন্থী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া মেয়েরা। 'পাকা ধানের গান'-এ তেভাগা আন্দোলনে প্রতিরোধী মেয়ে সরস্বতীর দেখা পাই, পোয়াতি এক বৌ মরে পুলিশের মারে, সারথির মা ঢলে পড়ে বন্দুকের গুলিতে। ভদ্রা বেআইনি পার্টির কাজ নিয়ে এসে পাহাড়পুরের মাটিতে দৃপ্ত কণ্ঠস্বরে বলে ওঠে — 'মায়েরা, বধূরা, বোনেরা, তোমাদের সন্তানদের শান্তির ঘুম কেড়ে নিয়েছে যারা, তাদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার শপথ নিয়ে তোমাদের সন্তানদের, স্বামীদের, ভাইয়েদের পাশে এসে দাঁড়াও। তোমাদের দোলনা দোলানো হাতে বর্শা তুলে নাও।' সাবিত্রী রায়ের মনোভাবটি কি আমাদের কাছে অস্পষ্ট থাকে? একেবারেই না। তাঁর মেয়ে গার্গী লিখেছেন — মধ্যবিত্ত ঘরের লেখিকা হিসাবে মাকে নানান দিক সামলে লিখতে লিখতে বসতে হয়েছে। ফলে — 'তাঁর লেখিকা-সত্তার সঙ্গে গৃহিণী-সত্তার বা মাতৃসত্তার দ্বন্দ্ব চলেছে।' দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক সত্তারও।
ননী ভৌমিক লিখেছিলেন — 'সলিমের মা'। একসময় মার খেত সলিমের মা স্বামী মঈনুদ্দিনের হাতে। তার পর তেভাগায় দেশ যখন ক্ষিপ্ত, আকাল যখন বাড়ছেই, তখন সিপাহী, চৌকিদার, বন্দুক লাঠি নিয়ে আস্ফালন করছিল, জোতদার গাড়িতে ধান চাপাতে চাইছিল, তখন 'ধানের পুঁজ ভেঙে ছত্রখান' করার মুহূর্তে উন্মাদিনীর মতো বেরিয়ে এসেছিল সলিমের মা — 'ধান নিবেন কেনে তোমরা—কেনে নিবেন—' 'ধানের পুঁজ দুই হাতে জাপটে ধরে মরিয়া হয়ে শুয়ে পড়েছিল সলিমের মা।'
সমরেশ বসুর 'প্রতিরোধ' গল্পের সন্তানসম্ভবা রাধাও গর্জে উঠেছিল— 'আমি শিবদাস মোড়লের মাইয়া না। ধান কাড়বনি আমার কাছ থেইক্যা? কত মায়ের দুধ খাইছে ঢ্যামনারা দেইখ্যা লমু। তুমি যাও গা— দেরি কইরো না।' পুলিসের গুলিতে রাধা মারা যায়।
স্বর্ণ মিত্রের 'ময়না তদন্ত' আরও পরের কালের গল্প। (১৯৬৮) কুব্জার ছেলে ভোলা মজুর বাপের ট্রেনে মৃত্যুর প্রতিশ্রুত ক্ষতিপুরণ চাইতে গিয়ে গাল খেয়েছিল। খিদের জ্বালায় ভোলা বিষকচু সেদ্ধ করে খায় ও মারা যায়। সরকারী নিয়মে ময়না তদন্ত হয়, ভোলার মা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে ওঠে — 'পলাব কেনে? কী দুষটা করিছি? ফূর্তি হইছে? ভোলার প্যাট চিরি কী পালি? ভাত পালি অ্যাতটুক্? জবাব দে বেধা মরার জাত, কোন্ সোনা দানাটা পালি ভোলার প্যাট চিরি, জবাব দে।' বলা বাহুল্য, প্রশাসন তরফে কোনো জবাব যায় না, তবে নামকরণে মাতৃত্বের দ্যোতনা আছে। কৃষিবিপ্লবের অংশীদার আন্না ক্যাম্প কমাণ্ডারের হাতে ধরা পড়ে এবং গর্ভবতীর অভিনয় ক'রে বেঁচে যায়। গল্পের ক্লাইম্যাক্স শেষ পংক্তিতে — 'হৃদয়পুর জেলার সান্ধ্য আইনের মধ্যে আন্না শবর প্রসব করল — চারটে রিভলবার, অনেকগুলো চিঠিপত্র — আপত্তিকর লালবই।' এই ভাবে মাতৃত্ব হয়ে ওঠে মেটাফরিক।
বাংলা গল্প উপন্যাস থেকে এইসব মায়েরা কোথায় গেল? বাস্তবে তো এইসব মায়েরা ছিল এবং আছে।