• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৭ | জুলাই ২০১৪ | গল্প
    Share
  • উড়ন্ত প্রেম : সন্দীপন সান্যাল


    ঞ্জিনিয়ারিং পড়বার সময় আমাদের ইউনিভার্সিটি বুয়েটে কিছু প্রতিষ্ঠিত প্রজেক্ট ম্যানেজার ছিল। ঘটকের বুয়েটীয় নাম। প্রাক ইমেইল-মোবাইল যুগে এরা কপোত-কপোতিদের জুটি বাঁধতে সাহায্য করত। এই গ্রুপেও এদের কয়েকজনের আনা গোনা টের পাই।

    কখনো দুজনকে এমনিই জুটি বাঁধিয়ে দেয়া হোত। একে বলা হোত ও তোমাকে মিস করছে – ওকে বলা হোত এ তোমাকে মিস করছে। এ ভাবে মিস মিস থেকেই ওদের মিশামিশি শুরু হোত। একদিন হাঁসা আর হাঁসি কে হাত ধরাধরি করে ক্যাম্পাসে হাসাহাসি করতে দেখা যেত।

    অনেকেই প্রেম করতে চাই বলে এপ্লিকেশন জমা দিত। এরকম দুই আঁতেল বান্দা বান্দিকে একেবারে ফোরথ ইয়ারের পি এল এ জুটি বাঁধিয়ে দেয়া হোল। ওরা প্রেম শুরুর প্রথম দিনেই সবাইকে ঘোষণা দিয়ে পার্টি দিয়ে দিল। লাইব্রেরীতে পাশাপাশি পড়ত। আমরা পেছন থেকে স্পাইগিরি করেও ঠিক মতো ঠাহর করতে পারিনি কখন প্রেম করছে। দুজনে পাশাপাশি ঘন্টার পর ঘন্টা যার যার বইয়ে ডুবে আছে। ওরা একই ডিপার্টমেন্টেরও ছিল না। কাজেই আলাদা সাবজেক্ট নিয়ে পড়ছে – সেখানেও কোন শেয়ারিং নেই। পরে শুনেছি কলমটা দাও, রাবার টা দাও – এগুলোই ছিল নাকি ওদের প্রেমের প্রকাশ। প্রেমের ভাষা বুঝতে পারিনি বলে বুয়েট লাইফে কোন প্রেম করা হোল না।

    আমেরিকার আশু বাবুর পাঠশালা মানে ASU তে পড়তে এসে এই প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ফেললাম। সেই গল্পই লিখতে এসেছি।

    আমার ডিপার্টমেন্টের চাইনিজ এক ছেলের আরেক চাইনিজ মেয়েকে বেশ কিছুদিন থেকেই মনে ধরেছে। বেচারা মুখ চোরা প্রেমিক। আধারে বসে মিষ্টি হাসি দেয়, মাইয়া সে হাসি দেখতেও পায় না। আমাদের কাছে এসে মাঝে মাঝে চিং পিং ভাষায় গুজুর গুজুর করে । খুব সহানুভূতি হয় ওর জন্য। মাথায় ঘুরতে থাকে কি ভাবে এই প্রজেক্টটা নামিয়ে দেয়া যায় সেই চিন্তা।

    ***

    সেবার সেমিস্টারের গ্যাপে ছেলেটা দেশে যাবার ফ্লাইটে উঠেছে। যাবার আগে আমাকে পই পই করে বলে গেছে “দোস্ত, ওকে একটু দেখে রাখিস। কেউ যেন আমার বাড়া ভাতে হাত না দেয়।” ভাত আবার কবে বাড়া হোল সেটাই বুঝলাম না। তবুও ওকে আশ্বস্ত করলাম। আমার এ হাত থাকতে অন্য কাউকে ওর দিকে হাত দিতে দেব না। সেদিন ল্যাবে মেয়েটার পাশে বসে কাজ করছি। ভদ্রলোক মানুষ – বন্ধুকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। কাজেই পাশে বসে যতটা সম্ভব দেখে রাখার চেষ্টা করছি। ঠিক ঐ মুহূর্তে ছেলেটা প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে। চট করে মাথায় একটা কূট বুদ্ধি চলে এল।

    সে-সময় ইমেইল ব্যাপারটা কেবল শুরু হয়েছে। হট মেইল তখনো হট হয় নি। স্কুলে ব্রাউসিং-এ নেটস্কেপ ব্যবহার করতাম। নেটস্কেপ থেকে এক চিকন পদ্ধতিতে যে কারো নামে ইমেইল করা যেত। চিনে ছেলেটার নামে মেয়েটাকে একটা ইমেইল লিখে ফেললাম। উল্লেখ্য সেসময় কেবল কথাবার্তা চলছে প্লেন থেকে পাবলিকলি ইমেইল পাঠানোর ব্যবস্থা নিয়ে। ইমেইলটার বিষয়বস্তু অনেকটা এমন ছিল।

    “প্রিয় চিং মিং গা, আমি ভূপৃষ্ঠের বারো হাজার ফুট উপর থেকে এই ইমেইল টা করছি। আমাদের প্লেনটা এই মুহূর্তে খুব জাম্পিং করছে। তাই টাইপগুলো এলোমেলো হলে কিছু মনে কর না। পাইলট কিছুক্ষণ আগে জানিয়েছে যান্ত্রিক ত্রুটি হয়েছে। চারপাশে সবাই ভয়ে নীল হয়ে আছে। কেন যেন এ সময় শুধু তোমার মুখটিই দেখতে পাচ্ছি। এই ফ্লাইটে পরীক্ষামূলক ভাবে লিমিটেড ইমেইল চালু করা হয়েছে। এয়ার হোস্টেসকে হাতে পায়ে ধরে এই ইমেইলটা করছি। সত্যি বলছি লক্ষ্মী ওদের আর কিছু ধরি নি। শুধু একশ ডলারের একটা নোট কোমরে খুব সাবধানে স্পর্শ না করে গুঁজে দিয়েছি। জানি না শেষ পর্যন্ত প্রিয় পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারব কি না। শুধু জানিয়ে রাখতে চাই তোমাকে খুব মিস করছি। ও আমার ভালবাসা, তুমি ভালো থেকো।”

    চিনে ছেলেকেও জানিয়ে দিলাম যে এই ইমেইলটা ওর একাউন্ট থেকে করেছি। এবার আড়চোখে আড়িপেতে চিং মিং গা কে দেখবার পালা।

    ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল। বাথরুম চেপে বসে আছি। প্রায় আধ ঘন্টা পরে মেয়েটার নজরে পড়ল ইমেইলটা। ডান হাত অল্প অল্প কাঁপছে। গাল সামান্য একটু লাল হয়ে গেছে। ছোট্ট চোখের অনুভূতির পরিবর্তন বোঝা আমার সাধ্যি নয়। কিছুক্ষণ কাজ করে, আবার ইমেইল খুলে পড়ে। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে – “শং ডিং পং, তুমি কি ব্যস্ত?”

    ভাব নিয়ে বলি – “হ্যাঁ একটু ব্যস্ত। কেন? কিছু বলবে?”

    “ও। তাহলে থাক।”

    যা--ব্বাবা। আরে আমি তো ব্যস্ত তোর জন্য। পুরো ইয়ে চেপে বসে আছি। “আরে না! তোমার জন্য আবার ব্যস্ততা কিসের? বল, কি বলবে বল।”

    আমি রিভলভিং চেয়ার ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাই। মেয়েটার কাঁপা কাঁপা গলা – “সাং তুনের ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়েছে।”

    পুরো অবাক হবার ভান করি। “ইন্টারনেটে দিয়েছে নাকি?”

    “না। ও আমাকে ইমেইল করেছে ফ্লাইট থেকে”।

    এবার যেন বিস্ময়ে ফেটে পড়ছি। “তুমি নিশ্চয়ই ফাজলামি করছ। তোমাদের চীনা জোক মাঝে মাঝে এত সিরিয়াস হয় না!”

    “আরে না। তুমি ইমেইলটা দেখ”।

    আমি এবার হুমড়ি খেয়ে ইমেইল পড়তে থাকি। বিস্ময় টিঁকিয়ে রেখে বলি – “তোমাদের মধ্যে ইটিস পিটিস আছে যে সেটা তো জানতাম না। তবে ব্যাপারটা বেশ চিন্তার অবশ্যই।”

    চিং মিং গা ফ্যাকাসে চোখে আমার দিকে তাকায় – “তুমি তো হাত দেখতে পার। একটু হাত দেখে বল না ওর ফ্লাইটের কিছু হবে কি না।”

    আশু বাবুর পাঠশালাতে একটা ছোট গণ্ডির মধ্যে জ্যোতিষী বাবা হিসেবে আমার ছোটখাট পরিচিতি হয়েছে। হাত দেখে দু একটা কমন জিনিষ মেরে দেই। যেমন, তুমি ছোটবেলায় একবার বিষণ্ণতায় ভুগেছিলে। এক নিকটজন তখন এগিয়ে এসে সাহায্য করেছে – ইত্যাদি ইত্যাদি। কি করব? ডাঙ্গর মেয়েরা যে আমাকে হাঙ্গর ভাবে। তাই এই রাস্তায় যা একটু হাত ধরা যায়।

    চিং মিং গা কে বলি - “প্লেনের তো হাত থাকে না। সান তুং এর হাত পেলে তাও হোত।” মেয়েটা হাল ছেড়ে দেয়। এবার ওর দিকে তাকিয়ে করুণা হয়। আস্তে আস্তে বলি – “তুমি কি ওকে ভালবাস?”

    এদিক ওদিক তাকায় – “আগে বাসতাম কিনা জানি না। তবে এখন বাসি।”

    গম্ভীর গলায় বলি – “তা হলেই হবে। তোমার ডান হাতটা আমার দিকে দাও।”

    হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। হালকা সেন্টের গন্ধে মনটা উদাস হতে চায়। ফিরিয়ে আনি। “চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বল, আমি সান তুং কে ভালবাসি।” ও অবাক হয়ে তাকায়। “এটা বললে তুমি কি ভাবে বুঝবে যে প্লেনটার কি হবে?”

    আমি যতটা সম্ভব গলাটাকে গায়েবী করে বলি – “আমি প্রথমে বুঝতে চাই তুমি আসলেই ওকে ভাল বাসছ কিনা। তারপর তোমার হাত দেখে বুঝতে চেষ্টা করব তোমার ভালবাসার কি পরিণতি। তোমাকে যা বলতে বলেছি বলবে, আর আমি তোমার হাতের স্পন্দন অনুভব করব।”

    পরবর্তী কয়েক মিনিট চিং মিং গা চোখের পাতা নামিয়ে পরম আবেগে বলতে থাকে, “সান তুং, আমি তোমাকে ভালবাসি---”

    হাতে ওর হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন যেন অনুভব করি। মাথা নেড়ে অভয় দেই। হাত ছেড়ে দিয়ে কাগজে হিজি বিজি আঁকি বুকি করি। তার পর মাথা তুলে বলি – “বৃহস্পতি তুঙ্গে। প্রেমের সফল পরিণতি।”

    উদ্বিগ্ন মুখে হাসি ফিরে এল। কল কল করে বলে চলল সান তুং কেমন ছেলে মানুষ – এই বিপদের সময় শুধু ওকেই মনে করছে। আমার হাত ধরে বলে, তোমার মতো বন্ধু হয় না। কি সুন্দর আমার মন ভাল করে দিলে।

    আমি হাসি মুখে বলি-- “তোমাদের যদি ছেলে হয় তাহলে নাম দিও – শং ডিং পং”।

    একটু লজ্জা হাসি নিয়ে বলে – “কি জান? আমাদের ছোট্ট শহরে যখন কোন বাচ্চা হয় একটা টিনের চালে থালা ছুঁড়ে মারা হয়। তখন যে শব্দ হয় সেটাই বাচ্চার নাম।”

    নিশ্চয়ই রসিকতা করছে। ও মাঝে মাঝে বেশ সিরিয়াস ভাবে রসিকতা করে।

    চিং অভয় দেয় –
    “আমি একজন অভিজ্ঞ ছোড়াওয়ালাকে ডেকে এমন ভাবে ছুড়তে বলব যেন শব্দ হয় শং ডিং পং।”

    আচমকা যেন মনে পড়ল, “এই দাঁড়াও। সান তুং কে একটা রিপ্লাই দিই।”

    কিছুক্ষণ পট পট করে কিছু একটা লিখল। আমার খুব ইচ্ছে হোল দেখতে কি লিখছে। কাজেই বলি – “দেখ, এই মুহূর্তে চিঠির উত্তরে কি কি শব্দ ব্যবহার করছ তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রেমের প্রথম প্রকাশ তো, পাপড়ি ঠিক মতো মেলছে কিনা তার সাথে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান মিলিয়ে দেখতে হবে সব কিছু ঠিক আছে কিনা।”

    “আমার লেখা হয়ে গেছে। তুমি একটু দেখবে কোথাও ভুল হোল কিনা।”

    নিতান্ত অনিচ্ছায় দেখতে হোল। “ও আমার উড়ন্ত প্রেম - - - ”

    প্রথম লাইন পড়েই থেমে যাই। যমরাজের কি সাধ্যি আছে এমন প্রেমকে কাঁচকলা দেখায়?



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments