অপারেশন স্বর্গদ্বার; আইভি চট্টোপাধ্যায়; প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০১২, প্রতিভাস - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ; ISBN :
পিকাসোর ছবি দেখে বিমূঢ় কোনও দর্শক যখন হতাশ, তখন নাকি শিল্পী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন "প্রথমবার আপনি যখন কফি খেয়েছিলেন, তখন কেমন লেগেছিলো? আর এখন যে ভালো লাগে তার কারণ কী?" বোঝাতে চেয়েছিলেন কফির taste জন্মাতে যেমন কিছু সময় লাগে, তেমনই কিছু কিছু ছবি বুঝতেও সময় লাগে, চেষ্টা লাগে।
আইভি চট্টোপাধ্যায়ের চতুর্থ প্রকাশিত গ্রন্থটি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এ কথাটাই সর্বাগ্রে মনে এলো। হঠাৎ হাতে নিয়ে ট্রেনে যেতে যেতে পড়ে ফেলার মতো বই এটি নয়। বরং বইটি পাঠকের কাছে কয়েকটি দাবি করে : যথা, সময়, কারখানা বা ইস্পাত তৈরি সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান, আঞ্চলিক বা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান, অভাবে আগ্রহ এবং কৃষি ও শিল্পের মধ্যে বিরোধের স্বরূপ সম্বন্ধে অবহিত থাকা। আকারে বিশেষ বড় না হয়েও (১৩৫ পৃষ্ঠা) এই বইটি চিন্তাশীল পাঠককে নাড়া দিয়ে যায়, যায়ই। আর সাধারণ পাঠকের মনেতেও রেখে যায় নিত্য সত্যের এক আভাস।
লেখিকা ইস্পাত-নগরীর বাসিন্দা হবার সুবাদে স্টিল কারখানার সুবিশাল কর্মযজ্ঞ এবং কারখানার খুঁটিনাটি সম্পর্কে সবিশেষ ওয়াকিফহাল। এই কাহিনীর পটভূমি, নায়ক-নায়িকা, পার্শ্বচরিত্র প্রায় সবই কারখানা-ক্যানভাসেরই নানান অঙ্গ। যদিও উপন্যাসের theme বা মূলসুরটি চিরন্তন এবং তার প্রাসঙ্গিকতা দেশ-কাল-পাত্র নির্ভর নয়। ভাঙা থেকে গড়বার কাজেই যে আনন্দ বেশি, গড়ার ব্রতই যে মানুষকে রূপান্তর বা উত্তরণের পথ দেখায়—এ বইটি সেই সত্যেরই ধ্বজা ওড়ায়।
"অপারেশন স্বর্গদ্বার"-এর পটভূমি বাংলা-বিহার-ঝাড়খণ্ডের খণ্ডাংশ নিয়ে। যে শহরের নাম না করেও লেখিকা এ'কাহিনী বুনেছেন, বুঝতে অসুবিধা হয়না সেটা জামশেদপুর। আমাদের চেনা কারখানার প্রতিষ্ঠাতার বা প্রাণপুরুষের নাম অনুল্লিখিত। পরিচালক, প্রধান প্রবন্ধক, অন্যান্য বরিষ্ঠ পদাধিকারীর নামও প্রায়শই সামান্য সাদৃশ্য রেখে পরিবর্তিত। কিন্তু কারখানার অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তি বা উৎপাদক-প্রক্রিয়ার যে প্রাসঙ্গিক বিবরণ, তা অত্যাশ্চর্যরকম সত্যনিষ্ঠ ও যথাযথ। এবং অনাবশ্যক জটিলতার সৃষ্টি না করেই। নগণ্য দু'একটি ত্রুটি-বিচ্যুতি বাদ দিলে এ সত্যটি লেখিকার নিরলস নিষ্ঠা ও প্রয়াসের প্রতি বিস্ময় জাগায়। উপন্যাসের ঘটনাস্রোত ইস্পাত-নগরীর দুই তীরের সত্য ঘটনাবলী ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে। টারেট-ভেসেলে ঘোষ সাহেবের মৃত্যু, শহরের হড়পা বান, কারখানার ৭৫ বছর, বিস্ফোরণে ট্রেন উড়ে যাওয়া, ৮% ছাই-ওয়ালা কয়লা, কারখানায় এথিক্সের ক্লাস—এ সবই সত্য ঘটনাকে মুখোশে ঢেকে সামনে আনা, অথবা সত্য তথ্যের ও তত্ত্বের বিবরণ। বোদ্ধা পাঠকের কাছে এ fact আর fantasy-র এক fusion! হয়তো যে পাঠক মূল উপাদানগুলোকে একেবারেই চেনে না, তার পক্ষে এর সম্পূর্ণ রসাস্বাদনে কিঞ্চিৎ ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
তা যদি ঘটেও বা, শুরুর থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত যে সমস্যাটি কাহিনীর ভিত্তিভূমির ভূমিকা পালন করেছে, সেটি আজকের ভারতবর্ষে, বা সারা পৃথিবীর উন্নয়নশীল সব দেশেই কম-বেশি প্রযোজ্য। মুনাফালোভী মালিক বা পরস্বাপহারী পুঁজিপতি, ধনতান্ত্রিক বা সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, অসাম্য ও বঞ্চনা এ সবই বহুমাত্রিক সমস্যার বিভিন্ন দিক। ভূমিহীন বা প্রান্তিক চাষীকে উৎখাত করে, আদিবাসী ভূমিপুত্রদের জমি থেকে, জঙ্গল থেকে বঞ্চিত করে উন্নয়নের বুলডোজার চালালে যে প্রগতি-রথের চক্র-ঘর্ঘর শোনা যায়, তার মধ্যে শতসহস্র স্বপ্ন এবং অমেয় অশ্রু অদৃশ্য ও অস্পৃষ্ট থেকে যায়। সভ্যতার ইতিহাসে এ কাহিনী নতুন নয়। এর থেকেই কখনও কখনও জন্ম নেয় বিদ্রোহ বা বিপ্লব। কখনও পুনর্বাসনের দাবি, কখনও ভূমি-দখলের লড়াই, কখনও পরিবেশ-রক্ষার বা প্রদূষণ প্রক্ষালনের - নানারূপে ভাষা নেয় সেই প্রতিবাদ। পরিণামে অনেকসময়ই যা হারিয়ে যায়, বা বয়ে যায় অন্য খাতে। কিছু কম দামি প্রাণহানির হিসেবও থাকে না সব সময়।
যে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের পরিকল্পনা অপারেশন স্বর্গদ্বারের পরতে পরতে, তার পটভূমিতেও তাই নিঃসন্দেহে রয়েছে দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ইতিহাস, যা কোম্পানির কিছু সামাজিক ক্রিয়াকর্মে মুছে যাবার নয়। অন্ততঃ বিদ্রোহী - বিপ্লবী আদিবাসী-ভূমিপুত্রদের সেটাই সযত্ন-লালিত ধারণা। আনন্দবাজার পত্রিকার ৫ই জুন ১৩ র একটি প্রবন্ধেও খানিকটা এর সমর্থন পাওয়া যায়: "মাওবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে দ্রুত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে আদিবাসী উন্নয়ন, অরণ্যের অধিকারের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো। প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছেন বটে, 'উন্নয়ন ছাড়া মাওবাদী সমস্যার পূর্ণ সমাধান সম্ভব নয়।' কিন্তু যে তীব্রতায় মাওবাদী সন্ত্রাসের মোকাবিলা করে কেন্দ্রীয় বাহিনী, উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার এক শতাংশ ক্ষিপ্রতা কেন্দ্রের নেই। ...... একথাও ভুললে চলবে না যে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অনুন্নয়নের ফলে আদিবাসীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক ধরণের নিরাপত্তা-হীনতা, প্রাণের চেয়েও তাঁদের কাছে অনেক মূল্যবান তাঁদের নিজেদের সংস্কৃতি, অরণ্যের মধ্যে যা বহু বছর ধরে সযত্নে লালিত। খনিজ পদার্থ আহরণ আর শিল্পস্থাপনের নামে জঙ্গল কেড়ে নিলে আঘাত হানা হয় তাঁদের বিশ্বাসে, সংস্কৃতিতে।"
বিশাল স্টীল-কারখানার সম্প্রসারণের অঙ্গ হিসেবে নতুন ব্লাস্ট-ফার্নেস বসবে, পুরনোগুলোরও সংস্কার হবে পুরোপুরি। আর যেহেতু ব্লাস্ট-ফার্নেস মানেই স্টীল-কারখানার হৃদ্পিণ্ড বিশেষ, এরা বা এদের একটা বন্ধ হলেই বিরাট বড় ধাক্কা খাবে কোম্পানি, মার খাবে উৎপাদন, মুনাফা নেমে আসবে অনেকখানি, জব্দ হবে 'মালিকপক্ষ'। কারখানার ও শহরের আশেপাশে/গ্রামে-গঞ্জে যে সব শ্রমিক/কৃষাণের বাস, তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে, তাদের বঞ্চনা-বোধের বেলুনকে ফুলিয়ে দিয়ে তাদের সংগঠিত করে চলে যে দলটি, তার 'নামে কী বা আসে যায়?' আমরা তাকে পুরো না চিনলেও জানি বৈ কি! এদেরই স্থানীয় নেতা চৌহানজি, যিনি এক ঠিকাদারের অধীনে কারখানার ভেতরে নাম-কা-ওয়াস্তে কিছু একটা কাজ করেন। আর অতীব সাবধানতায় তাঁর দলের 'সৈনিক' নির্বাচন করেন, তাদের নির্দেশ দেন, সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্যের প্রতি তন্নিষ্ঠ থাকতে উৎসাহিত করেন, এবং অবশ্যই কারখানা-ধ্বংসের নীল নক্শা তৈরি করেন। চৌহানজির ডান হাত হয়ে কারখানায় কাজ করে contract labour চিতা হেমব্রম বা চিতু : শিকারী চিতার মতোই শব্দহীন যার চলাফেরা, এবং চিতার মতোই ভয়ঙ্কর! গোপনে গোপনে সাঙ্কেতিক ভাষায় সব পরিকল্পনা চলে কীভাবে সমসাময়িক বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হবে চুল্লীগুলো। চোরাপথে বিস্ফোরণের মালমশলা ঢুকে যায় কারখানার ভেতরে, সিকিউরিটির শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে, টানা হয় বিস্ফোরণের জন্য বিজলির তার। সংগঠনের মূল কেন্দ্র থেকে কখনও কখনও প্রয়োজনীয় নির্দেশ আসে; দায়িত্বের ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়, কখনও খতম করে দেবার ফতোয়া আসে: অপারেশন স্বর্গদ্বার-কে সত্বর সফল করার জন্য! তাদের বিশ্বাস এই আন্দোলনের সাফল্যই খুলে দেবে কোনও অচেনা না-ছোঁওয়া স্বর্গের দরজা। বঞ্চিত আদিবাসীরা দু'বেলা পেট ভরে খেতে পাবে, মাঠভরা শস্য জন্মাবে, শেষ হবে অভাব-অনটনের দিন! কবি শরৎ মুখোপাধ্যায়ও তো তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'বঙ্গভূম'-এ এই স্বপ্নেরই ছবি এঁকেছিলেন
"লদীভরি জল টলটল করে, মাঠ ভরি ধান, কাল কাল মানুষগুলন খিলখিল খিলখিল করি হাসে! ... হায়, ত্যামুন দিন কবে আসবেক গ'? কবে আসবেক? দুধ পাবেক, পেট ভরে মুড়ি পাবেক পোড়া দেশের মানুষ!"
উপন্যাসের নায়ক অবশ্যই মাটকু। বছর কুড়ির সদ্য যুবক, যার চোখে বিশাল স্বপ্ন, আদিবাসীদের অধিকার ফিরিয়ে দেবার, দিগন্ত-বিস্তৃত শস্যক্ষেত্রের, সীমাহীন সাম্যের গহন বাধাহীন অরণ্যের যেখানে
"অত্যাচারীর খড়গকৃপাণ ভীম রণভূমে নামিবে না; উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না"।
গ্রামের পরিচিত পরিজনের হাত ধরে এসে মাটকুর কারখানায় যোগ দেওয়া। গোপন মিটিং-এ হাজিরা দেওয়া, উড়িয়ে দেওয়া-পুড়িয়ে দেবার নানান্ কাণ্ডে অংশ নিয়ে উত্তেজনার আগুন পোয়ানোর পাশেপাশে কারখানার কাজ শিখতে শিখতে সুবিশাল কর্মযজ্ঞে ভাগ নিতে গিয়ে মাটকু বাঁধা পড়ে যায় অনির্দেশ্য এক মায়ার বন্ধনে। যার পরিণামে অস্তিত্ব-সঙ্কটের এক বিপন্নতা তাকে গ্রাস করে। কেননা তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল "where order is injustice, disorder is the begining of justice" — যে কথা সত্তরের দশকে আমরা শুনেছি অনেক, দেখেছি দেয়ালে দেয়ালে তারই রক্তাক্ত অনুবাদ "বন্দুকের নলই শক্তির উৎস"!
অথচ আমাদের মাটকু অবাক হয়ে দেখছে কী অপরিসীম্ নিষ্ঠায়, কী অনিঃশেষ তৎপরতায় কী নিখুঁত শৃঙ্খলায় গড়ে উঠছে, বেড়ে উঠছে কারখানা। কী মায়াবী মমতায় পুরোনো শ্রমিক সারিয়ে তুলছে অসুস্থ মেশিনকে! কী অস্বস্তিকর অ-স্বাভাবিকতায় কোম্পানির মালিক শ্রমিকের কাঁধে-পিঠে হাত রাখছেন মমতার, বিশ্বাসের; কথা বলছেন সুখ-দুঃখের। ইউনিয়ন যদি এ কোম্পানির মালিকের ধামা-ধরাও হয়, এই সহজ আন্তরিক সম্পর্ক কী করে গড়ে ওঠে এমন যান্ত্রিক বা যন্ত্রময় পরিবেশে? এমনটা তো হবার কথাই নয়! পুলিশ বা স্কুলমাস্টার হত্যা করে, কিম্বা হেল্থ-সেন্টার, হাসপাতালে আগুন দিয়ে যে উল্লাস, উৎসাহ, কারখানা গড়ে তোলার ব্রতে তার চতুর্গুণ উদ্দীপনা বোধ করে মাটকু। E.O.T ক্রেনের রহস্য বুঝতে চায়, 'উর্জা'র জাদু তাকে মুগ্ধ করে fly ash-এ তৈরি ইটের তত্ত্ব তার মাথা ঘুরিয়ে দেয়। আর তাই, সামান্য অবসরে বা কাজের ফাঁকে, ভাঙার থেকে গড়ার কাজেই কি আনন্দ বেশি, এই সংশয়ে তার "মাথা গুলিয়ে যায়", তার দিশেহারা লাগে।
বেচারী মাটকুকে আমরা কী দোষ দেবো? কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুনই তাঁর mentor শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করছেন কোন্টা কর্ম আর কোন্টা অকর্ম? ধর্ম-অধর্মের মধ্যের সীমারেখা যে আদৌ স্পষ্ট নয়, সে তো গীতা-র প্রথম অধ্যায়েই স্পষ্ট হয়ে যায়। আর এই কাহিনীতে ধর্ম আর অধর্মের দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত মাটকু ভাবে : রাজার প্রতি অন্নদাতার প্রতি আনুগত্য দেখানো কি ধর্ম নয়? আসলে মাটকু এবং তার দলের নেতা-কর্মীদের কাছে মালিকের একটাই রূপ - মুনাফাখোর। তার নির্দিষ্ট পথে চলা, বা তাদের কর্মযজ্ঞে সাগ্রহে অংশগ্রহণ করা মানে তার ভাঁওতায় ভুলে তারই হাত শক্ত করা। মার্কসীয় দর্শনে শ্রমিকশ্রেণীর ইতরীকরণ (estrangement) বোঝাতে গিয়ে যে স্তরবিভাগ করা আছে: (১) শ্রমিক ও পণ্য (products) (২) শ্রমিক ও পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া (process) (৩) শ্রমিক ও অন্য শ্রমিক এবং শেষ পর্যন্ত (৪) শ্রমিকের নিজের সঙ্গে নিজের, এই কাহিনী সামগ্রিকভাবে সেই চতুস্তর তত্ত্বকে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। কারখানার গল্প হয়ে যায় রাজারাণীর রূপকথা। কমরেড চিতা-র সতর্কবাণী "লিশা (নেশা) হয়ে গেলে স্বপ্ন দেখতে পাবি না" হাওয়ায় মিলিয়ে যায়; চশমাচোখে তাত্ত্বিক দিদিমণির সাবধানবার্তা "এ তোদের বাঁচার লড়াই" জাতি-ধর্ম পালটে হয়ে যায় "জান লড়িয়ে গড়বার লড়াই"।
তারপরে, যেমনটি আশা করা গিয়েছিল, গড়ার লড়াইয়েরই জয় হয়। ভাঙার যুদ্ধের সব প্রস্তুতি, সব উত্তেজনা, সব প্রতীক্ষা প্রায় সহসাই নির্বাপিত হয় একটি আকস্মিক মৃত্যুর পরে। 'Life is Beautiful' চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যের মতো জীবনের জয়গান বেজে ওঠে এ বইয়ের সমাপ্তিতেও।
মাটকুকে বাদ দিলে একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র যমুনা : বলতে গেলে একমাত্র নারী চরিত্র, স্পষ্টবাদিতায় এবং খরভাষণে, ব্যক্তিত্বে ও স্বাতন্ত্র্য সমুজ্জ্বল। কোনো 'মরদ'ই তার কাছে ঘেঁষতে সাহস পায়না, অথচ তার জীবনেও 'প্রেম একদিন এসেছিল নীরবে'; এক বেদনাময় উপসংহারে যমুনার কাহিনী যেন জলরঙে মিশে যায় পুরো ক্যানভাসের কবিতায়।
বাইজুবাবা, মদনের বাবা ও পরশুরাম এই উপন্যাসের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। দ্বিধাগ্রস্ত মাটকু, বিপজ্জনক বিদ্রোহী চৌহানজি বা চিতু, কারখানার অফিসার চ্যাটার্জি সাহেব বা তিওয়ারি সাহেব — এদের নিয়ে যে গতিশীল গল্প, তার পেছনে অস্পষ্ট পাহাড়ের মতো বিশাল অস্তিত্ব নিয়ে জেগে থাকে এই ত্রয়ী। অভিজ্ঞতার বিপুল সম্ভার নিয়ে, কারখানা ও কাজের প্রতি গভীর প্রেম ও তার মালিকের প্রতি মরমী শ্রদ্ধা নিয়ে। আর এই contrast-ই ঘটনাকে climax এর দিকে নিয়ে যায়।
ভূমিপুত্রদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী উৎসব, তাদের দেবদেবী, পুজো-পার্বণ ঘুরে ফিরে এসেছে বইয়ের পাতায় পাতায় : এমন মেঠো ভাষায় এসেছে যে অধিকাংশ পাঠকের কাছেই তা সময় সময় দুর্বোধ্য ঠেকবে। যেমন : "আজকাল আর পরবে ঘুসুর (পাঁঠা) কেটে, খুখরা (মুরগী) কেটে, নাচ-গান ডিয়াং করে (একধরনের নৃত্য) মজা লাগেনা"। কিম্বা "উ ছোঁড়াটা কে বটে? উ কথা বলেনা? টুকুর টুকুর ভাইলছে (আড়চোখে চাইছে)"। মজা হচ্ছে এরকম কয়েকটা শব্দ বা বাক্যবন্ধ দুর্বোধ্য থেকে গেলেও কাহিনীর গতি শ্লথ হয়না। বরং মাঝেমাঝেই পাহাড়ি চটির মত আমরা যেন বিশ্রামের কিছু জায়গা পেয়ে যাই : "ধামসা মাদল নাই থাক, গান আছে আগ্নেয়গিরির পাহাড়েও"। আবার মহিষবলির বীভৎস দৃশ্যের অবতারণার আগে প্রকৃতির বর্ণনা পাঠককে নিয়ে যায় বুদ্ধদেব গুহের 'কোয়েলের কাছে' : "বিকেলে বিন্ধা। বিন্ধা পরবে বৃষ্টি হওয়া শুভ। আকাশ সেইরকম হয়ে আছে। গুড়গুড় শব্দে মেঘ রুয়াম পাহাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ছে"। কারখানার রাত্রিকালীন বর্ণনায় নিরুপম রূপময়তা : "রাতের বেলা সব শান্ত। বড়ো বড়ো চিমনিগুলো পজ্জন্ত হালকা হালকা শ্বাস ফেলে ঘুমায়ে পড়ে। শুধু ব্লাস্ট ফার্নেস জেগে বসে লাল চোখ মেলে পাহারা দেয়।" শেষ অধ্যায়ে আবার "কারখানা জুড়ে শুধুই বাঁশির সুর। ধ্বংসের তাণ্ডবের দামামা নয়, সৃষ্টির আনন্দের স্নিগ্ধ বাঁশি।"
শুধু বর্ণনা বা বাক্যবন্ধের বিশ্রামগৃহ নয়, মাঝেমধ্যে মহাভারত বা পুরাণের কাহিনীর উল্লেখ, চিরন্তন কিছু মূল্যবোধের প্রসঙ্গ, অনুচ্চারিত এক প্রেমের কাহিনীর মর্মান্তিক পরিণতি উপন্যাসটিকে বর্ণময় করেছে, যে বর্ণসমারোহ বৈচিত্র্য এনেছে, কিন্তু পাঠ বা অনুভবকে পীড়া দেয়নি। বিশেষ করে (৮০ পৃষ্ঠায়) আইভি যে নিত্যসত্যের আভাস দিয়েছেন প্রায় কবিতার ভাষায়, যার শেষ প্রার্থনা উপনিষদের সেই অমোঘ স্বস্তিবাচনকে মনে করায় : "সর্বে সুখিনঃ সন্তু / সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ ....", তা বারবার পড়তে ইচ্ছে করে।
ছাপা ও বাঁধাই সুন্দর। প্রচ্ছদটি (সুদীপ্ত দত্ত)-ও ভাবায়, কেননা 'যত আদিম মহাদ্রুম'-এর মাঝখানে পথহারা এক মানুষের প্রতিকৃতি স্বর্গদ্বারের আভাস না দিক, মাটকু তথা আমাদের সকলেরই প্রশ্নের প্রতীক। সামান্য কিছু ছাপার ভুল উপেক্ষা করাই যেত, যদি না 'কারখানা' বারবার বর্দ্ধিত আকারে 'কারাখানা' হয়ে যেত, কারখানার গন্ধ হয়ে যেত 'কারখানা বন্ধ'। Perfection এর ব্যাপারে এ্যালার্জি আমরা কবে কাটিয়ে উঠবো?
তবু লেখিকাকে কুর্নিশ, কারখানার কাণ্ডকে প্রায় নিখুঁতভাবে তুলে ধরেও ঠাসবুননের একটি কাহিনী উপহার দেবার জন্য।
প্রতিভাস (প্রকাশক)-কে সেলাম, সাহস করে বইটি পাঠকের হাতে তুলে দেবার জন্য। আর অবশ্যই অভিবাদন আমাদের নায়ক মাটকুকে, ধ্বংসের ধ্বজা ফেলে দিয়ে সৃষ্টির সাম্রাজ্যে সগৌরব পদার্পণের জন্য।
কৃষি-শিল্প বিরোধ নিয়ে যে ব্যথা আইভিকে দীর্ণ করে, ('আমার কথা' দ্রষ্টব্য) এই রচনা সেই ব্যথাকে উত্তীর্ণ করে দিয়ে যায় প্রায় অলৌকিক এক স্তরে। ক্ষীণতনু এই গ্রন্থটির সার্থকতা সেখানেই।