রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি ও ফরাসি গীতাঞ্জলি, কবীরের দোঁহার ইংরেজি অনুবাদ `ওয়ান হানড্রেড পোয়েমস অব কবীর' এব. `টকস ইন চায়না'র ভূমিকা লিখেছেন চারজন বিদেশি । এই চারজনকে নিয়ে এবং তাঁদের লেখা ভূমিকার বাংলায় পরিবেশন করা এই নিয়ে সমীর সেনগুপ্তের `প্রতিবিম্বিত রবীন্দ্রনাথ' ।
সময়ের বিচারে ইংরেজি `গীতাঞ্জলি'র কথা আগেই আসে । উইলিয়ম বাটলার ইয়েট্স ছিলেন ইংরেজি গীতাঞ্জলির সম্পাদক ও ভূমিকা লেখক । আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে একজন আইরিশ কবির ভারত, বিশেষত বাংলাদেশ সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান থাকার কথা নয় । তাই গীতাঞ্জলি সম্পাদনার ভার হাতে নিয়ে ইয়েট্স প্রথমেই কবির পারিবারিক পশ্চাত্পট, ধর্মবোধ, বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য জানবার চেষ্টা করেছেন । গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বর্ষাঋতুর ভূমিকাটি অজানা থাকলে `মেঘের পরে মেঘ জমেছে' অথবা `আজি শ্রাবণ ঘন গহনমোহে' প্রভৃতি রচনার অন্তরে প্রবেশ করা যায় না ।
একসময় ইয়েট্স ভারতে আসতে চেয়েছিলেন কেবল একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে, `যে পৃথিবীর শস্য হিসেবে এই কবিতাগুলির জন্ম হয়েছে সে পৃথিবীকে প্রত্যক্ষ করা । কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের ফলে ইয়েট্সের এই ভ্রমণ প্রস্তাব , বাস্তবায়িত হয়নি' ।
`প্রতিবিম্বিত রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে সমীরবাবু উল্লিখিত চারটি গ্রন্থের ভূমিকার অনুবাদ ছাড়াও তাদের লেখকদের সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের একটি রূপরেখা নির্মাণ করেছেন । এটি আমাদের বাড়তি পাওনা । এদের মধ্যে `রবীন্দ্রনাথ ও ইয়েট্স' রচনাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ন । তার কারণ এই প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে কী ভাবে ১৯১২ সালের রবীন্দ্ররচনার মুগ্ধতা কেটে গিয়ে একদিন ইয়েট্স-এর মনে জেগে ওঠে অসূয়ার এক মূর্তিমান সমালোচক । যিনি একদিন দাবী করেন গীতাঞ্জলির প্রায় সব কবিতা আগাগোড়া তারই সংশোধন করে দেওয়া । একথা পরবর্তীকালে বন্ধুদের কাছে যেমন লিখে জানাচ্ছেন, তেমনই প্রকাশক ম্যাকমিলান কোম্পানীকেও লিখে জানাচ্ছেন যে "তিনি ইংরেজি গীতাঞ্জলি এবং দ গার্ডেনার- এর পাণ্ডুলিপি আদ্যোপান্ত সংশোধন করে দিয়েছিলেঅ, বই দুটি যে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছে তার পিছনে সেটি একটি বড়ো কারণ - এমনকি, সেটাই সম্ভবত তার মূখ্য কারণ ।" এরপর সমীরবাবু অধ্যাপক সৌরীন্দ্র মিত্রের `খ্যাতি অখ্যাতির নেপথ্যে' গ্রন্থ থেকে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন - ইয়েট্স-এর দাবী একেবারেই অসংগত । মূল শব্দাবলীতে ইয়েট্স প্রায় হাত দেননি ।
১৯১২ সালের সাক্ষাতের পর ইয়েট্স-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আর একবার মাত্র দেখা হয়েছে লণ্ডনেই, সেটা ১৯২০ সালের কথা । যদিও চিঠিপত্রে ১৯৩৫ পর্যন্ত দুজনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল । ১৯৩১ সালে দ গোলডেন বুক অব টেগোর-এ ইয়েট্স-এর যে চিঠি ছাপা হয় তার এক জায়গায় তিনি বলেছেন, "আমি ... আপনাকে বলতে চাই, আমি এখনো আপনার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছাত্র ও গুণগ্রাহী । ... আপনি তো জানেন, আপনার কবিতা আমার কাছে এসেছিল এক বিরাট উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা হিসেবে, সম্প্রতিকালের বছরগুলিতে আমি আপনার গদ্যে প্রজ্ঞা ও সৌন্দর্যের পরিচয় পেয়েছি - ঘরে বাইরেতে, আপনার ছোটগল্পগুলিতে ও আপনার জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথের মনেও ইয়েট্স স্নেহ-প্রীতির ভাবটি যে চিরকাল বজায় ছিল তার প্রমাণ মেলে ইয়েট্স-এর মৃত্যুতে লেখা তাঁর মন্তব্যের মধ্যে । "... আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি মনে রাখব যে আধুনিক ইউরোপের একজন মহৎ কবির স্মৃতির সঙ্গে আমার জীবন যুক্ত হয়ে আছে ।" [দ্র. বিশ্বভারতী কোয়াটারলি, মে-জুলাই ১৯৫১]
গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদের ভূমিকা লিখেছেন আঁদ্রে, জীদ । তিনি কেবল ভূমিকা লেখকই নন, গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদক ও রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ১৩দিন বাদে জীদের ফরাসি অনুবাদ
সমীরবাবু জানিয়েছেন গীতাঞ্জলি ফরাসিতে অনুবাদ করার জন্য বেশ কয়েকজন আগ্রহী ছিলেন । ফলে জীদের অনুবাদ-স্বত্ব পাওয়ায় ব্যাপারটি জটিল হয়ে ওঠে । অবশেষে তাঁর বন্ধু সাঁ জঁ প্যার্স-এর চেষ্টায় অনুবাদ স্বত্বটি আঁদ্রে জীদই পান ।
ফরাসি গীতাঞ্জলির প্রথম সংস্করণ ছিল ভূমিকাহীন । ভূমিকাসহ দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলো ১৯১৪ সালের গোড়ায় । যা পড়ে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে প্রথম জানতে পারেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো । এবং কবিতার অনুবাদ পাঠ করে রোমা রোলাঁ রবীন্দ্রনাথের প্রতি আকৃষ্ট হন ।
জীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দুবার দেখা হয়েছে । প্রথম দেখা ১৯২১ সালে প্যারিসে । দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ১৯৩০ সালের ২৩ এপ্রিল । নিজের ছবির প্রদর্শনী উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ তখন প্যারিসে এসেছেন । ভূমিকার অনুবাদ কর্ম ছাড়াও এমন বহু তথ্যে সমৃদ্ধ সমীরবাবুর `প্রতিবিম্বিত রবীন্দ্রনাথ' ।
`ওয়ান হানড্রেড পোয়েমস অব কবীর'- এর ভূমিকার অনুবাদ এবং ইভলিন আণ্ডারহিল- এর প্রসঙ্গ এসেছে তৃতীয় প্রবন্ধে ।
কবীর দোঁহার প্রথম ইংরেজি অনুবাদক ছিলেন অজিতকুমার চক্রবর্তী । তিনি একসময় কবীরের বাণীর রসে আকৃষ্ট হয়ে ১১৬টি পদ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং সেগুলি রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছায় ১৯১৩ সালের মাঝামাঝি তাঁর কাছে ইংলণ্ডে পাঠিয়ে দেন । রবীন্দ্রনাথ তাঁকে গ্রন্থের ভূমিকাস্বরূপ কবীর সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখে পাঠাতে বলেন ।
প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথের মনে প্রত্যাশা ছিল যে এ বই অজিতকুমারের নামে প্রকাশিত হবে । কিন্তু তা হয়নি । এর কারণ বিদেশে বই ব্যবসায় নিয়মকানুন রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট জানা ছিল না ।
যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ অজিতকুমারের কবীর দোঁহার অনুবাদ থেকে বেছে পরিবর্তন পরিমার্জন করে একশোটি দোঁহা প্রকাশার্থে প্রস্তুত করেন । অনুবাদ ও সম্পাদনার কাজ ছাড়াও ইভলিন আণ্ডারহিলের উপর এর ভূমিকা লেখার ভার পড়েছিল । তাঁর ভূমিকার প্রথম খসড়াটি রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহন ও অজিতকুমারের অনুমোদনের জন্য শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছিলেন । ভূমিকায় আণ্ডারহিলের বক্তব্য ছিল, কবীর প্রমুখ ভারতীয় সন্তদের উপর খ্রিষ্টিয় প্রভাব । সেই ভূমিকা পাঠ করে ক্ষিতিমোহন ও অজিতকুমার উভয়েই ক্ষুব্ধ হলেন । ক্ষিতিমোহন লিখেছেন : "... আমার হইয়া তখন রবীন্দ্রনাথের চিরঅনুরাগী গুণজ্ঞ পরলোকগত অজিতকুমার চক্রবর্তী এক সুদীর্ঘ প্রতিবাদ লিখিলেন । ফলে ভূমিকায় একটু পরিবর্তন হইল ।"
তাহাতে সিদ্ধান্ত দাঁড়াইল এই যে "কেহ কেহ এইসব সন্তদের উপর খৃষ্টীয় প্রভাব মানিলেও এই বিষয়ে নানা প্রকার মত আছে, কাজেই এই বিষয়ে কিছু লেখা হইল না ।" [দ্র. ভারতীয় সাধনার ধারায় রবীন্দ্রনাথ, ক্ষিতিমোহন সেন ।]
ইভলিন আণ্ডারহিল ছিলেন লণ্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক । একাধারে ঔপন্যাসিক, কবি-প্রাবন্ধিক । ইভলিনের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা মিস্টিসিজম বইটি পড়েছিলেন । উভয়ের প্রথম সাক্ষাৎ ২ অক্টোবর ১৯১২ সালে, ঔপন্যাসিক, সাহিত্য-সমালোচক মিস সিনক্লেয়ারের এক নৈশ ভোজের নিমন্ত্রণে । পরের বছর বেশ কয়েকটি আসরে রবীন্দ্রনাথের মুখে `রাজা'-র অনুবাদের
`প্রতিবিম্বিত রবীন্দ্রনাথ'-এর শেষ অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা স্বল্পখ্যাত গ্রন্থ `টক্স ইন চায়না'-র ভূমিকার বাংলা অনুবাদ এবং তার লেখক চৈনিক পণ্ডিত, সাংবাদিক দার্শনিক লিয়াঙ ছি ছাও সম্পর্কে কিছু কথা আছে ।
১৯২০ সালে লিয়াঙ ছি ছাও প্রতিষ্ঠা করেন `বেজিং লেকচার অ্যাসোসিয়েশন' । এই প্রতিষ্ঠানের নিমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ সালে চীনে যান । তাঁর চীন ভ্রমণ সর্বাংশে সুখের হয়নি । `বিতর্কিত অতিথি' গ্রন্থে শিশিরকুমার দাসের সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে । সমীরবাবুও সংক্ষেপে তাঁর প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের তিক্ত স্মৃতির কথা উল্লেখ করেছেন ।
চীন থেকে ফিরে আসার আটমাস পরে `টক্স ইন চায়না' প্রকাশিত হয় । কিন্তু প্রকাশিত হবার কিছুদিন পরেই রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে বইটি বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়, পরে প্রকাশিত হয় পরিবর্তিত এক নতুন সংস্করণ । রবীন্দ্রনাথ চীনে উপস্থিত হলে তাঁকে স্বাগত জানাতে অ্যাসোসিয়েশনের সভায় সভাপতি হিসেবে লিয়াঙ ছি ছাও যে স্বাগতভাষণ দেন সেখানে তিনি চীন ও ভারতের সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের দীর্ঘ ইতিহাসের উল্লেখ করেছেন ।
লিয়াঙ জানিয়েছেন তাঁরা ভারতের কাছে শিখেছে স্বাধীনতার তত্ত্ব, পরম প্রেমের তত্ত্ব, সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রেও তারা ভারতের সাহায্য পেয়েছেন । সংগীত, স্থাপত্য, চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, নাটক প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁরা ভারতের ঋনী ।
তিনি স্বাগতভাষণের শেষে লিখছেন, "ভারতবর্ষের সঙ্গে আমাদের যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল সেই সম্পর্ককে যদি এই উপলক্ষে আমরা নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি ... তাহলেই রবীন্দ্রনাথ টেগোরকে সত্যিকারের অভ্যর্থনা জানানো হবে আমাদের ।"
অনুবাদ কর্মের সার্থকতা বিচার হয় প্রধানত দুটি ব্যাপারে । এক অনুবাদের মধ্যে মূলের স্বাদ পাওয়া গেল কি না ? দুই অনুবাদের ভাষা সাবলীল হলো কি না ? এই দুই ক্ষেত্রেই সমীরবাবু সসম্মানে উত্তীর্ণ ।
(পরবাস-৪৬, সেপ্টেম্বর, ২০১০)