![]() ভগবানই তোমাকে সাহায্য করতে পারেন' |
আমি সম্প্রতি কুমাসির হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবকের কাজে এক মাস কাটিয়েছিলাম । সেই সুযোগেই আশান্তিদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় । ঘানা দেশটি ছোট্ট । পশ্চিম আফ্রিকার সমুদ্রের উপকূলে । পুরনো নাম ছিল গোল্ড কোস্ট । সোনার দেশ । দেশের মাটিতে সোনার ছড়াছড়ি ছিল তখন । তার লোভেই গত পাঁচ-ছশো বছর ধরে পর্তুগীজ, ডাচ, ফরাসী ও ইংরেজ দস্যুদের হানা । পঞ্চাশ বছর আগে স্বাধীনতার সঙ্গে নাম পালটে ঘানা হল । পাশের দেশটি কিন্তু এখনও ফরাসী আইভরি কোস্ট নামেই আছে । সমুদ্রতীরের এইসব দেশ থেকেই ইওরোপীয় দস্যুরা কালো পুরুষ ও নারীদের ধরে আমেরিকায় ত্রক্রীতদাস চালান করত । সেই কুখ্যাত কীর্তির নিদর্শন হিসেবে সমুদ্রের তীরে এখনও অনেক ত্রক্রীতদাস দুর্গের চিহ্ন দেখা যায় । বর্তমান কৃষ্ণকায় আমেরিকানদের পূর্বপুরুষরা এই দেশেরই লোক ছিল ।
ঘানার বর্তমান রাজধানী আক্রা হলেও ঐতিহাসিক শহর কুমাসি আশান্তিদের রাজধানী । কুমাসি আক্রা থেকে উত্তরে, সোজা রাস্তায় পাঁচ ছ'ঘন্টার মত লাগে । শহরটি ১৬৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত, তাই প্রায় তিনশ বছরেরও বেশি পুরনো । তার আগে ঐ জায়গায় ছোটখাটো গ্রামই ছিল আশান্তিদের ঘাঁটি হিসাবে ।
![]() |
ছোটবেলা থেকেই বাচ্চা মেয়েদের প্র্যাকটিস শুরু হয় - ছোট ছোট বোঝা মাথায় ব্যালান্স করে রাখার কায়দা । শুধু মাথার বোঝাই নয় । পিঠেও বাচ্চাদের বেঁধে রাখে এরা । ছোট মেয়েরাও শিশু ভাইবোনদের পিঠে একফালি কাপড়ে বেঁধে বইবার প্র্যাকটিস করে । মাথায় বোঝা ব্যালান্স করে আর একই সঙ্গে পিঠে চঞ্চল শিশু বেঁধে সারাদিন এরা কী ভাবে সংসারের সব কাজ সামলে চলে ভেবে সত্যিই অবাক হতে হয় । অনেকে কাপড়ের বদলে দুহাত পেছনে করে অবলীলায় দু'বছরের বাচ্চাকে বইতে পারে । আমি একটা জলের বোতল নিয়ে ঐভাবে বইবার চেষ্টা করে দেখেছি । ব্যাপারটা মোটেই সহজ নয় ।
বাচ্চারাও মায়ের পিঠে বেশ আরামেই বসে থাকে বা ঘুমোয় । কোনোরকম কান্নাকাটি বা ছটফট করতে দেখিনি কাউকে । ডাক্তারদের মতে ঐভাবে শিশু বহন নাকি বাচ্চাদের কোমর ও পায়ের পক্ষেও উপকারী ।
![]() |
এই ফাঁকে ঘানার খাবার দাবার সম্পর্কে কিছু বলা দরকার । আমার আবার নানা দেশের খাবারে খুব কৌতূহল । আমার মতে খাবারের মধ্য দিয়ে জাতীয় চরিত্রটা অনেকটা চেনা যায় । বেশিরভাগ আফ্রিকান দেশের মতোই ঘানারও জাতীয় রান্না বা খাবার
(cuisine) বলতে কিছুই নেই বিশেষ । মোটা চালের ভাতই খাওয়া হয় সাধারণত । তাছাড়া আছে কন্দ জাতীয় কাসাভা, ইয়াম ইত্যাদি । ওগুলো এমনিতে স্বাদহীন । তাই ওপরে মশলা দেওয়া সস বা ঝোল মাখিয়ে খাওয়া হয় । কাসাভা পিষে আটার গোলার মত তৈরি করে । তবে কাঁচা আটার থেকে কাসাভা বেশি হড়হড়ে । একে বলে "ফুফু" । এর সঙ্গে ঝোল মেখে হাত দিয়ে খাওয়া হয় । এটাই এদের সবথেকে জনপ্রিয় দুপুরের খাবার । এটা না খেলে এরা নিজেদের উপবাসী মনে করে । আমার সহকর্মীরা প্রতিদিন এই ফুফু খেতেন । এদের মতে বিদেশে থাকার প্রধান সমস্যা এই ফুফুর অভাব । এদের পাল্লায় পড়ে আমি ফুফু খেয়েছি -- কাঁচা আটার গোলার মতই বিস্বাদ । কিন্তু আপ রুচি খানা !ফুফুর ঝোলে কখনো কখনো দু একটা মাছ বা মাংসের টুকরো পড়ে । সেগুলো সাবধানে খেতে হয় কারণ এরা পশুদেহের কোনো অংশই বাদ দেয় না । তাই পাতে চামড়া, হাড়, চোখ, ঘিলু সবকিছুই দেখা যায় । এসব নিয়ে আফ্রিকানদের কোনো শুচিবাই নেই । গরীবদেশে কিছুই ফেলা যায় না । ফুফুর মতই আরেকটা প্রিয় খাবার বাংকু । এটায় ফুফুর গোলাটা জমিয়ে আরও হড়হড়ে করে তোলা হয় । এর সঙ্গে রেড-রেড বলে টোমাটো আর লংকা দেওয়া ছোলার ডাল আর গ্রীন-গ্রীন বলে শাকের একটা পদ খাওয়া হয় । এর মধ্যে একমাত্র রেড রেডই আমার প্রিয় ছিল । রোজ মাছ ভাজা ও কাঁচকলা ভাজা দিয়ে ঐ রেড রেড খেতাম ।
আফ্রিকার দেশে মিষ্টি খাবারের খুব একটা চল নেই । তার জায়গায় আম, কলা, পেঁপে বা আনারসের মত মিষ্টি ফল দিয়েই এরা ভোজন সারে । দুধ তো পাওয়াই যায় না । এখানে কেউই মায়ের দুধ ছাড়ার পর আর দুধ খায় না । এমনকি ছানা, দই ইত্যাদিরও চল নেই । বাজারে বিদেশি আমদানী বলে দামও খুব চড়া । কেক পেস্ট্রি তো পাওয়াই যায় না । এমনকি পাঁউরুটি বলে যা বিক্রি হয় তা-ও শক্ত, জমাট, ইটের টুকরোর মত । আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশেই আমি এই রকম খাবার দেখেছি ! এই খেয়েই কিন্তু এরা অলিম্পিকে মেডেল জেতে !
একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় । গরীব হলেও যে সব আফ্রিকান দেশগুলি ফরাসী অধীনে ছিল, সে-সব দেশে খাবার রান্না ও পরিবেশন হয় খুব সুন্দর ভাবে । অল্প খাবারই নানারকম সস দিয়ে মুখরোচক করে তুলতে ফরাসীদের জুড়ি নেই । প্রাক্তন ফরাসী উপনিবেশ মালি ও ম্যাডাগাসকারে আমি অনেক ভালো রান্না খেয়েছি যা কেনিয়া, টানজানিয়া বা ঘানায় পাইনি । এটা ফরাসী রন্ধন ঐতিহ্যের নিদর্শন ।
![]() |
![]() |
ঘানা দেশটি ছোট হলেও অনেকগুলি ন্যাশনাল পার্ক ও প্রাণী সংরক্ষণের জায়গা
(wildlife preserve) আছে । তার মধ্যে দক্ষিণে সমুদ্রতীরে রেনফরেস্ট কাকুম ও উত্তরে বিরাট জঙ্গল মোলে সবথেকে বিখ্যাত । কাকুম আয়তনে ছোট হলেও রাজধানী আক্রার কাছাকাছি বলে পার্কটা জনপ্রিয়, তাই ভিড়ও বেশি । কাকুম পার্কের অন্যতম আকর্ষণ দড়ির সেতু যা মাটি থেকে প্রায় দেড়শ ফুট উঁচুতে গাছের মাথা সমান । সেখান থেকে উঁচু গাছের মগডালে পশুপাখির দেখা পাওয়া যায় যা নীচে ঘন জঙ্গলে দেখা মুশকিল ।
![]() |
![]() |
মোলের বাতাবরণ একেবারেই আলাদা । উত্তরে বলে আবহাওয়া বেশ শুকনো । আর কুমাসি থেকে আট-দশ ঘন্টার রাস্তা বলে ভিড়ও খুব কম । ফলে পশুপাখি দেখার সুযোগও বেশি । মোলে পার্কটি বিরাট কিন্তু ট্যুরিস্টদের দেখানো হয় দশ শতাংশ মাত্র । বাকি সারা পার্ক নির্জন শুধু বণ্য প্রাণীদের আসর । পার্কে থাকার জায়গা বলতে একটা হোটেল । তার পিছনের বারান্দায় বসেই অদূরে জলাশয়ে প্রচুর প্রাণীর দেখা পাওয়া যায় । বেড়াতে গেলে রাইফেলধারী গার্ড সঙ্গে যাবেই । আর জোর করে পরাবে হাঁটু উঁচু গামবুট । বুনো হাতি ও সাপের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য । হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা বেশ ভালো এবং ব্যয়বহুল নয় । তবে পার্কে পৌঁছবার রাস্তাটাই ভীষণ খারাপ, কাঁচা রাস্তা খানাখন্দে ভর্তি । তিরিশ মাইল যেতে দু'ঘন্টারও বেশি লাগে । হয়তো ইচ্ছা করেই রেখেছে এই অবস্থায় যাতে পার্কে মানুষের ভিড় বেশি না হয় । পশুপাখির পক্ষে ব্যবস্থাটা ভালই বলতে হবে ।
![]() |
ঘানায় ছ-সাতশ বছরের পুরনো এইরকম স্লেভ দুর্গ অনেক আছে । এখন সেখানে বিদেশী ট্যুরিস্টদের সঙ্গে দেশীয় স্কুলের ছেলেমেয়েরাও দেখতে আসে মানব সভ্যতার এক নির্লজ্জ অবমাননার উদাহরণ । দুর্গগুলি বেশ শক্তপোক্ত । বাইরে গভীর খাল কাটা, ছাতের চারদিকে কামান উঁচানো । ত্রক্রীতদাস ছাড়াও মহামূল্যবান সোনা ও হাতির দাঁত রপ্তানি হতো । সেসব রক্ষার জন্যই এত আয়োজন । দুর্গের ভেতরে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার কুঠুংইরর মধ্যে মেয়ে ও পুরুষদের আলাদা করে বন্দী রাখা হত । বাইরে সমুদ্রের দিকে একটি ছোট্ট দরজা - এক এক করে বন্দীদের বের করে জাহাজে তোলা হত । বন্দীরা এই দরজাটার নাম দিয়েছিল
Gate of no return. এই দোর দিয়ে একবার বেরুলে কেউ আর ফিরে আসেনা । সম্প্রতি অবশ্য এই ভয়ঙ্কর সত্যটা মিথ্যা প্রমাণ করতে কয়েকজন কালো আমেরিকান ট্যুরিস্ট সমুদ্রতীর থেকে এই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলেন । তাই নিয়ে বেশ লেখালেখিও হয়েছিল । দুর্গের ভেতর অনাহার ও গাদাগাদি গরম ও নোংরা অবস্থায় থাকার জন্য অনেক বন্দীই মারা যেত, কিন্তু তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের বিশেষ মাথাব্যাথা ছিল না । আশ্চর্যের বিষয়, এই দুর্গের মধ্যেই অধিপতিদের সপরিবারে রাজার হালে থাকার ব্যবস্থাও ছিল । এমনকি দলনেতাদের সুখভোগের জন্য একটা গোপন সিঁড়িও তৈরি ছিল - সোজা মহিলা বন্দীদের কুঠুরী পর্যন্ত । বন্দী অবস্থাতেই এদের যখন খুশি ব্যবহার করা হত । দুর্গের মধ্যে প্রার্থনার জন্য একটি চার্চ পর্যন্ত তৈরি করা ছিল । সেখানে প্রতি রবিবার ভক্তিগান ও প্রার্থনাও হত । পাশবিক অত্যাচারের পাশেই ভগবানের পূজার এরকম নির্লজ্জ উদাহরণ আমি আর কোথাও দেখিনি ।
![]() |
![]() |
দেশীয় লোকদের জলাজঙ্গল থেকে ধরে আনা সহজ কাজ নয় । বিদেশীদের আফ্রিকান লোকেরাই সাহায্য করত - গুলিগোলা, বন্দুক ইত্যাদির পরিবর্তে । এই ব্যাপারটা অনেকেই জানেন না । ঘানা ও আশেপাশে রাজ্যে শক্তিশালী আশান্তিরাই তাদের দুর্বল বা শত্রু প্রজাতিদের ধরিয়ে দিত বিদেশীদের হাতে । এদের সহযোগিতা ছাড়া এরকম ব্যাপক ত্রক্রীতদাস চালান করা সম্ভব ছিল না । পরে অবশ্য ব্রিটিশ শাসকরা বেশি সোনার লোভে আশান্তিদের উপরেই আক্রমণ করে ও তাদের রাজাকে এই স্লেভ দুর্গেই বন্দী করে রাখে । সেই জনপ্রিয় রাজার দর্শনে দেশ বিদেশ থেকে আশান্তিরা এসে দুর্গে হানা দিত । ব্যবস্থা এতই গুরুতর হয়েছিল যে ভিড় ভাঙার জন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ রাজাকে দূর সেশালিস দ্বীপে নির্বাসন দিতে বাধ্য হয়েছিল ।
কুমাসি আশান্তিদের ঐতিহাসিক রাজধানী । লোককথা অনুযায়ী এইখানেই তিনশ বছর আগে তাদের দেবতা কোমোফো আনোকি স্বর্গ থেকে তাদের জন্য প্রতীক হিসেবে একটি তলোয়ার ও একটি সোনার টুল দিয়েছিলেন । টুলটি এখন ওদের রাজার প্রাসাদে । এটির দখল নিয়েই ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই শুরু হয় । এই দুইটিই ওদের ধর্মে পরম পবিত্র জাতীয় প্রতীক । তলোয়ারটি মাটিতে গাঁথা অবস্থায় রাখা আছে আমাদের হাসপাতালের প্রাঙ্গনে । প্রতি মাসে আশান্তিদের প্রধান পুরোহিত সেখানে পুজো দেন । ছাগল বা ভেড়াও বলি দেওয়া হয়, সঙ্গে অনেকেই মদের বোতলও দেয় পুজোয় । তলোয়ারটার চারদিকে রক্তের দাগ ও বোতলের টুকরো । কথায় আছে কেউ ঐ তলোয়ারটা টেনে বার করতে পারে না । যদি কেউ বার করে তাহলে সমস্ত আশান্তি জাতির শেষ দিন নিশ্চিত ।
![]() |
![]() |
![]() |
আশান্তির রাজবংশ তাদের দেবতা থেকেই উদ্ভূত । তাই রাজাকে দেবতার প্রতিনিধি হিসাবে মান্য করা হয় । বর্তমান রাজার প্রাসাদ কুমাসি শহরেই । প্রাসাদটার খুব একটা চাকচিক্য নেই কিন্তু রাজার ছবিতে দেখা যায় সোনা গয়না মণি মুক্তার ছড়াছড়ি । ঘানায় সোনার খনি আছে অনেকগুলি । তাই রাজার সাজপোশাকে ভারী ভারী সোনার পাত গয়না ইত্যাদির ব্যবহার । গয়নাগুলি এতই ভারী যে বেচারা রাজা উঠে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারেন না, দুই রক্ষক দুপাশে ধরে থাকে । রাজার দর্শনের জন্য প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়, তাই আমি আর সে চেষ্টা করিনি । প্রাসাদের ছবি তোলাও বারণ ।
রাজা ওসি টুটুর চার স্ত্রী । সবাই কুমাসির প্রাসাদেই থাকেন । কিন্তু বিশেষ উত্সব ছাড়া তাদের দেখা পাওয়া দুর্লভ । আশান্তি লোককথায় স্ত্রীর প্রধান কর্তব্য হল তার স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখা । আর কে না জানে পুরুষের সন্তুষ্টির প্রধান উপাদান বিভিন্ন নারীসঙ্গ । কিন্তু নানা কারণে তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে স্ত্রীর উচিত অন্তত মাসে একবার তার চেহারা ও বেশভূষা পালটানো যাতে তাকে অন্য নারী বলে মনে হয় । সে জন্য উত্কৃষ্ট উপায় চুলের স্টাইল বদলানো । তাই হয়ত আফ্রিকান মেয়েরা যুগ যুগ ধরে তাদের চুলের কত রকম বিনুনি, খোঁপা, রং, কাট ইত্যাদি করে আর সেই জন্যই হয়তো সারা শহরে এত সেলুনের ছড়াছড়ি !
![]() |
কোনো এক দেশের লোকদের জানতে হলে এক মাস কেন এক বছরও যথেষ্ট নয় । তবু এই অল্প সময়েই এই অচেনা দেশটির সঙ্গে একটু পরিচয় হল । পেলাম কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও অতিথিবত্সল ঘানাবাসীদের বন্ধুত্ব । সেটাই তো ভ্রমণের পরম পুরস্কার ।
![]() |
(পরবাস ৪৫, এপ্রিল, ২০১০)