প্রাচীনকাল থেকেই যৌনকর্মীদের সম্বন্ধে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে লেখা হয়েছে । ভারতে বারাঙ্গনাদের ইতিহাসের একটি পূর্ণ বিধৃতি পাওয়া যায় যে গ্রন্থটিতে তার নাম - দেবদাসী থেকে যৌনকর্মী-- যুগ্ম লেখক মণি নাগ ও স্বাতী ভট্টাচার্য ।
ভারতীয় জনমানসে ও সামাজিক আঙ্গিকে বারাঙ্গনাকে হেয় দৃষ্টিতে পরিমাপ করা হলেও ধর্মীয় -অঙ্গনে কখনো বা এই বারাঙ্গনাই দেবতার পূজার অপরিহার্য অঙ্গ । ইতিহাস নির্ভর উপরোক্ত গ্রন্থটিতে গণিকা জীবনের ঐতিহাসিক উত্তরণের বিভিন্ন দিকটি বিধৃত হয়েছে । বহুগামিনী স্বেচ্ছাচারিনী অপ্সরার কল্পনাতেই বারাঙ্গনার ধারণা উপ্ত হয় । গ্রন্থটির শুরু বারাঙ্গনা, বেশ্যা, গণিকা - প্রমুখের পরিভাষাগত ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে । এরা সমাজের কোন শ্রেণী নন, ব্রাত্য একটি গোষ্ঠীমাত্র যারা দেহকে মূলধন করে জীবিকা নির্বাহ করেন । এই অর্থে বেশ্যা কেবল মেয়েরাই নয়, পুরুষ কিংবা নপুংসকরাও বেশ্যাবৃত্তি করতে পারেন । সমাজে বারাঙ্গনাদের ভূমিকা অনেকটা `সেফটি ভালব্'
(Safety Valve) এর মত । এঁরা আছেন তাই অতিকাম পুরুষের লালসা পূর্ণ করেন এঁরা । পুরুষতান্ত্রিক সমাজে স্ত্রী পুরুষের যৌন সম্পর্কে একপ্রকার ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করেন বেশ্যারা - এ কথা বললে কি অত্যুক্তি করা হয় ? গ্রন্থকার এ বিষয়ে নিরুত্তর থাকলেও তাঁদের স্পষ্ট উক্তি - "পুরুষ ও নারী, দুজনের মধ্যে যৌনতৃপ্তির ইচ্ছে সমানভাবে কাজ করে ... আসলে সমাজে পুরুষরাই প্রধান ... পুরুষের বাসনা পূর্ণ করার সুযোগ অনেক বেশি । আর তার সবচেয়ে সহজ উপায়, বিবাহিত সম্পর্কের বাইরে গিয়ে, অন্য একটি মেয়েতে তৃপ্তি খোঁজা । বারাঙ্গনারা সেই প্রয়োজন পূরণ করে ।" পুরুষশাসিত সমাজে এই উদাত্ত স্বীকারোক্তির জন্য লেখক-লেখিকাদ্বয়কে অভিনন্দন ।সাবলীল গতিতে ভারতে বারাঙ্গনার ইতিহাসটি বিধৃত হয়েছে । প্রাচীন ও মধ্যযুগের ঐতিহাসিক বিবর্তন ত্রক্রমাগত প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ শাসনকালে । বেদের যুগ থেকে মহাকাব্য কাল, বৌদ্ধযুগ, সংহিতা-পর্ব সর্বত্রই বারাঙ্গনা, বেশ্যা ও গণিকাদের অবাধ বিচরণ ছিল । বাত্স্যায়নের কামসূত্র ব্যাখ্যা পূর্বক গ্রন্থকারদ্বয় প্রাচীনকালে সমাজে গণিকাদের অবস্থা কি ছিল তা ব্যাখ্যা করেন ।
ধর্ম প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সর্বদাই নারীর যৌনজীবন নিয়ন্ত্রণ করে নানাভাবে । পুরুষ বহু সময়েই ধর্মকে হাতিয়ার করে নারীকে শোষণ করত । এই শোষণেরই প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেবদাসী প্রথা । মন্দির ও দেবপূজার প্রক্রিয়ার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই আধা-ধর্মীয় পুরুষ নিয়ন্ত্রিত শোষণপ্রথা ।
ব্রিটিশ শাসনকালে বারাঙ্গনাদের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে মূলত: বাংলা তথা কলকাতার প্রেক্ষাপটে । এই যুগে সামাজিক কারণের পাশাপাশি লেখকদ্বয় ব্যাখ্যা করেছেন ব্রিটিশ শাসনজনিত অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের । দূর্ভিক্ষ দারিদ্র্য ইত্যাদির সঙ্গে সমাজে অপরাধমূলক কার্যকলাপের ত্রক্রমিক বৃদ্ধি ঘটে এবং বেশ্যাপল্লী গুলিরও একপ্রকার রমরমা শুরু হয় ।
গ্রন্থটির একটি পর্বে বারাঙ্গনার শ্রেণীবিভাগ অংশটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় । কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে, থিয়েটারে, সঙ্গীতে তথা সংস্কৃতিতে বারাঙ্গনাদের বিবিধ ভাগ এবং বাঙালি বেশ্যার পাশাপাশি অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানের উপস্থিতির কাহিনি পাঠককে আকর্ষণ করে । এই পর্বে কলকাতার বাইরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের কিছু তথ্য পরিবেশিত হলে হয়ত আরও বেশি আকর্ষক হত ।
পরবর্তী অধ্যায়ে - কলকাতা, দিল্লী, মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, কানপুর প্রমুখ স্থানের নিষিদ্ধপল্লীর যৌনকর্মীদের জীবনধারার একটি চিত্র আমরা পাই । বেশ্যাদের নিয়ত দৈনন্দিন জীবন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও স্বাস্থ্য বিষয়ে একটি স্পষ্ট চিত্র আমরা লক্ষ্য করি । প্রাদেশিক ও ভাষাগত পার্থক্য বা সীমানার বিভেদ যৌনকর্মীদের পরিভাষার কোন পার্থক্য নির্দেশ করে না ।
দক্ষিণ ভারতের বেশ্যালয়ের বিষয়ে লিখিত অধ্যায়টিও অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক । কেরল, ব্যাঙ্গালোর ও তামিলনাড়ুর যৌনকর্মীদের জীবনযাত্রা ও মানসিকতার উপর অনবদ্য তথ্য পরিবেশিত হয়েছে এই অংশে । যৌনকর্মীদের মানসিকতার বিভিন্ন দিক যে দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবেশিত হয়েছে তা নি:সন্দেহে পাঠককে ধরে রাখে । যৌনকর্মীদের জীবন সত্যতার বিভিন্ন চিত্র পাঠককে সন্নিবিষ্ট করে তোলে । একনিষ্ঠ পাঠে ছেদ না ঘটিয়ে ত্রক্রমান্বয়ে পড়তে হয় গ্রন্থটি ।
যৌনকর্মীর এক অন্যতম শ্রেণীবিভাগ - পুরুষ যৌনকর্মী । সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্রাত্য হিজড়া, নপুংসক ও লিঙ্গান্তরকামী মানুষরাও এই পেশা গ্রহণ করেন । এই বিশেষ শ্রেণীর যৌনকর্মীদের বিষয়ে বিশেষ কিছু তথ্য পরিবেশিত হয় একটি প্রচ্ছদে । বাংলাভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে এই বিষয়টি কদাচ আলোচিত হয়েছে এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্তমান গ্রন্থটি যথেষ্ট তথ্যপূর্ণ ।
শিশু যৌনকর্মী যেকোন সমাজের একটি কঠিনতম সমস্যা । বর্তমান গ্রন্থে বিষয়টি পৃথকভাবে পরিবেশিত হয়েছে । শিশু পাচারের বিষয়টি পাঠককে আকৃষ্ট করলেও কিছু তথ্য পরিবেশনে ত্রুটি লক্ষ্যণীয় । শিশু যৌনকর্মী বিষয়ে পরিবারের ভূমিকা বা সীমান্ত অতিক্রম করে উভয় রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার চিত্র আরও একটু বিশদে আলোচনার দাবী রাখে ।
গ্রন্থটির শেষের কয়েকটি অধ্যায় কিছুটা ভিন্নধর্মী । আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বারাঙ্গনাদের কিরূপে বিচার করা হবে - বেশ্যাবৃত্তি আইনসিদ্ধ বা নিষিদ্ধ হবে - সেই প্রশ্নটি পাঠকের সামনে আনা হয়েছে অতি সুচারুরূপে । ভারতবর্ষের আইনের একটি পর্যালোচনাপূর্বক এদেশে যৌনকর্মীদের আইনি অবস্থানের দিকসমূহও আলোচিত হয়েছে । প্রসঙ্গত ভারতবর্ষের বিভিন্ন সংস্থাগুলির কথা এবং এই জটিল প্রশ্নটি বিষয়ে তাঁদের অবস্থান উপস্থাপিত হয়েছে ।
পরিশেষে গ্রন্থটির একটি বিশেষ আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ - "বারাঙ্গনাগণের নিবেদনমিদং" । বারাঙ্গনাদের নিজেদের কথা আলোচিত হয় এমন কিছু লেখা ও রিপোর্টের অনবদ্য সংগ্রহ এই অংশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
সামগ্রিক আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে আজকে বিশ্বায়নের যুগে নারীর শোষণ ও বারাঙ্গনার করুণ কাহিনি অতীতের ভোগবাদী অর্থনীতিতে নারীশোষণের একটি রূপান্তর মাত্র । মনে রাখতে হবে বিশ শতকের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সর্বদাই কিন্তু সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি অর্থনীতির পরিমাপে বা মানদণ্ডে বারাঙ্গনা সমস্যাকে বিচার করতে হয় । সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার অন্যতম এক মাত্রা হল - যৌন সমাজ যেখানে বারাঙ্গনা থেকে পাচার - এক একটি সূচকে দৈহিক শোষণকেই ব্যাখ্যা করে । সুতরাং এহেন অবস্থায় বর্তমান গ্রন্থটি নি:সন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ।
(পরবাস-৪৪, ডিসেম্বর, ২০০৯)