• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৩ | জুলাই ২০০৯ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • চম্পাবতীর দেশে : রাহুল মজুমদার

    চব্বিশে অক্টোবর দু হাজার সাত, বেলা চারটে

    বহুদিন পর লম্বাপাড়ির গাড়ি । আমরা পাঠানকোটের যাত্রী । ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিয়ে ছুটবে জম্মুর টানে । এই প্রথম `কলকাতা' থেকে পাড়ি । বাইরের ভেংচিকাটা গরম । ঠাণ্ডা কামরায় ঢুকতেই মেজাজ নরম । ঠিক `দুজনে কূজনে' না হলেও দিব্যি তেঁতুলপাতায় ন-জন হয়ে চলেছি । অবশ্য আগামী দু-দিনে সুজনদের মেজাজ কতটা মচকাবে জানিনা । বাইরে আড়িপাতা রোদ্দুর এখন শান্ত । এখন আর তার চোখ রাঙা নয় । বরং শেষবেলার আকাশকে রাঙাবার তাল খুঁজছে । সারাদিনের পরিশ্রমে সূয্যিমামা ক্লান্ত ।

    বেলা পাঁচটা

    ধানবাদকে ধন্যবাদ জানাবার জন্যই বুঝি গাড়ি অনেকক্ষণ তার গায়ে গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে । এমন আলসে গাড়ি `বাঘ' ছাড়া আর দেখিনি । এ বোধহয় `সিঙ্গি', বৈষ্ণোদেবীর পুণ্যার্থীর দলটা গোটা কামরাকে আমোদের সুরে ভরিয়ে দিয়েছে । একেবারে গোটা ক্রিকেট ম্যাচের (দু-দল মিলে, টুয়েলফ্থ ম্যান সহ) দল, চব্বিশজনের ।

    পঁচিশে অক্টোবর, ভোর (!) সোয়াপাঁচটা

    আজ কোজাগরী পূর্ণিমা - লক্ষ্মীপুজো । আকাশ এখনও দিব্যি লক্ষ্মীছেলের মত বুটিদার কালো কম্বলখানা মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে । রাতের আঁধারে পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে, ঝাড়খণ্ডের এক খণ্ডের ওপর দিয়ে বিহার পার করে গাড়ি ঢুকে পড়েছে উত্তরপ্রদেশে । গাড়ি সাহাপুরে পৌঁছে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই আমাকেই ঘুম থেকে উঠতে হল ।

    সাতটা কুড়ি

    আলসে গাড়ি আবার দাঁড়িয়ে পড়েছে । বেচারির বেশি পরিশ্রম সহ্য হয়না - খানিক পরেপরেই জিরিয়ে নেয় । তার কাণ্ড দেখে সূয্যিমামা হামা দিয়ে হাজির । তার লালচে কিরণ পুবের জানালার শার্সিতে টোকা মারছে ।

    সকাল আটটা

    রামরাজ্যে প্রবেশ । অযোধ্যায় এখন আর রাম না থাকলেও নরবানরের দিব্যি সহাবস্থান স্টেশনজুড়ে । এর পরেই ফৈজাবাদ - আবুল ফজলের জাগীর । প্রদেশ বদল, রাজ্যবদল, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে সেই খড়ের চালের মাটির কুঁড়ে, সেই লাউমাচা, সেই গাছের ছায়াঘেরা আঙিনা, সেই পাখির কূজন, গরুর জাবরকাটা ।

    বেলা পৌনে বারোটা

    লক্ষ্মণাবতী - লখনউ । লক্ষ্মণের রাজধানী লক্ষ্মণাবতী; নবাব ওয়াজিদ আলি শা-র লখনউ; নবাবী গন্ধমাখা লখনউ; বাদশাহী আংটির ফেলুদার প্রিয় শহর লখনউ । এবার শুধুই ছুঁয়ে চলা । বাইশ মিনিট পরেই `ছোড় চলে লখনউ নগরী' ।

    ছাব্বিশে অক্টোবর, সকাল পৌনে সাতটা

    অবশেষে পাঠানকোটে জোড়া পাঁঠার অবতরণ । ডালহাউসি যাবার জন্য ট্যাক্সিভাড়া যা চাইল, তাতে এই সুন্দর হিমেল সকালটা আগ্নেয়গিরি হয়ে গেল । অতএব সাইকেল রিক্সাবাহিত হয়ে বাস-টার্মিনাসে । স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে বামপন্থী হতে না হতেই ডান হাতে তার অবস্থান । বড্ডবেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, স্টেশনের মতই - এরা এখনও আমাদের মত `সভ্য' হতে শিখল না ।

    ডালহাউসির প্রথম বাস সাড়ে ছ-টায় টা-টা । অতএব চাম্বার বাসে এঁকেবেঁকে তিনঘন্টায় বনিখেত । তারপর `পবননন্দন' বাহিত হয়ে রবিঠাকুর, নেতাজির স্মৃতিমাখা ডালহাউসি (২১১৫ মি:) পাহাড়ে । বেশ নিরিবিলি শান্তশিষ্ট শহরটা - সিমলা, দার্জিলিং, গ্যাংটকের মতো লেজবিশিষ্ট নয় । সুভাষ চৌক আর গান্ধী চৌকের মাঝে শান্তির আবাস `সাংগ্রিলা' অনবদ্য । দিগন্তে তুষারমৌলিদের গ্যালারি মাঝে উপত্যকা হলুদ সবুজ মেখে মেলে ধরেছে নিজেকে । আশ্চর্যরকমের নৈ:শব্দমাখা শৈলশহর - দিল খুশ হো গয়া ।




    `রাত' সাতটা পঁচিশ

    নিস্তব্ধ ডালহাউসির নিচে অসংখ্য আলোর ফুল আর আকাশে `চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে' । হিমেল আবহাওয়ার রাজত্ব এখন । চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে মহাত্মাজি গান্ধী চৌককে নজরে রাখছেন । তাঁর পাশ দিয়ে তিব্বতী রিফিউজি মার্কেটকে পাশ কাটিয়ে এক পথ দৌড়েছেন খাজ্জিয়ার পানে, একজন নেমেছেন ডাকঘরের গা ঘেঁষে বনিখেতের দিকে । গান্ধীজির আর একপাশ দিয়ে পথ নেমেছে বাসস্ট্যাণ্ডে আর সুভাষ বাওলির খোঁজে । উল্টোদিকে ডালহাউসি হোটেলের পাশ ঘেঁষে ওঠা ঊর্ধ্বমুখী পথটার ডাইনে ঘেঁষে পথ চলেছে সুভাষ চৌকে । খয়েরিমাখা সবুজ পাহাড়ের ঢেউগুলো গিয়ে মিশেছে তুষাররেখায় । সবই এখন আঁধারমাখা, শুধু চাঁদমামা পাইনের মাথা ছাড়িয়ে আলো ছড়াবার তালে ।

    সাতাশে অক্টোবর, ভোর (!) ছ-টা দশ

    ডালহাউসির পশ্চিম আকাশে এখনও পূর্ণচন্দ্রের রাজত্ব । দক্ষিণ-পূর্বে শুকতারার সতর্ক নজর । আকাশ তার কালো কম্বলটা কাচতে বসেছে । তাই তার পুবদিকটা নীলচে তাতে হালকা কমলা ছোপ । তারারা হারাবার পথে । পাখিদের কূজন এখনও শুরু হয়নি, ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক এখনও ঝিঁঝিদের কনসার্ট ।

    সকাল পৌনে আটটা

    এখনও রবির বরাভয়স্পর্শ এসে পৌঁছয়নি ডালহাউসির বরতনুতে । শহর সবে আড়মোড়া ভাঙছে । আমাদের মতো `চাতালের' পক্ষে এত বেলা পর্যন্ত না-চা পর্ব বড়ই কষ্টদায়ক ।

    রাত্রি আটটা আটান্ন

    লেপমুড়ি দিয়ে গুড়িসুড়ি মেরে কলম চালাচ্ছি । আজকের `রোজনামচা' নামানোর চেষ্টা করি ।




    সকাল ন-টায় চা-পানান্তে `হনুমান'বাহিত হয়ে প্রথম দৌড় কালাটপ পানে । শহর ছাড়াতেই সকালের ঝলমলে পোশাকটা পরে প্রকৃতি তার রূপরাশি মেলে ধরল । পথের কালচে ফিতেটা এঁকেবেঁকে অল্প অল্প করে চড়াই ভাঙতে লাগল । `কালাটপ খাজ্জিয়ার অভয়ারণ্যের' দোরগোড়ায় অদ্ভুতরকম নির্জন এক সুন্দর জায়গায় উপবাসভঙ্গ করা গেল । একপাশে আকাশচুম্বী পাইনের ঘন অরণ্য, অন্যপাশে মাতার মন্দির লাল চুনরিতে ঢাকা । মাঝ দিয়ে পথটা দুটো মোচড় মেরে গা ঢাকা দিয়েছে । দূরে একদল তুষারের পাউডার মেখে নজর রাখছে । পেট ফুলিয়ে আবার মারুতির পেটে সেঁধুলাম । সে আমাদের নিয়ে এক ছুটে লক্কড়মণ্ডিতে পৌঁছে দম নিল । অভয়ারণ্যের প্রবেশ দক্ষিণা দিয়ে এরপর সে মাটি পাথরের লাফিয়ে লাফিয়ে চড়া পথে ঢুকতেই বড় গাছেরা ঘিরে ধরল । তাদের আদর মাখতে মাখতে আঁকতে বাঁকতে উঠে এলাম পাহাড়ের কাঁধে চুপটি করে বসে থাকা এক রূপসী বনবাংলোর ধারে । তাকে ঘিরে রয়েছে অতন্দ্রপ্রহরী ফারের দল, পায়ের কাছে কত শত ফুলের বাহার, লনের কার্পেট । ফারের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে তুষারমৌলি । ১৯২৫-এর এই চিরযৌবনার সঙ্গে অল্প আলাপের পরই বিদায় নিতে হল । এবার ডাইনকুণ্ড । লক্কড়মণ্ডি পর্যন্ত কেঁচেগণ্ডুষ, তারপর ডাইনে নয়, বাঁয়ে মোচড় মেরে চড়চড় করে পথ চড়েছে টঙয়ে । সেই টঙয়ে গাড়ির চলন থামল । এবার শ্রীচরণ ভরসা । পাথরভরা পাকদণ্ডী বেয়ে পাকে পাকে চড়তে চড়তে অনভ্যস্ত দম মাঝ পথেই ফুস্স্স্‌ । তাই দু পাঁচ পাক আগেই দম ফাঁক । সেখান থেকেই পীরপাঞ্জালের সঙ্গে চোখে চোখে কথা হল । তারপর ব্যাক টু মারুতি । পবননন্দন এবার গান্ধীচৌক হয়ে মোচড় মেরে নেমে এলো পঞ্জপুল্লায় । এখানে চিরনিদ্রায় শয়ান শহীদ বিপ্লবী ভগৎ সিং-এর স্বাধীনতা সংগ্রামী কাকা অজিত সিং । প্রবীণ এই দেশপ্রেমী এইখানে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট সকালে । তাঁর শোভন সমাধি মুখ দেখছে পাশের সুন্দর জলাশয়ে, যার জল আসছে উল্টোদিকের পাহাড়ের দশমিনিট উজানো পথে পঞ্জপুল্লা প্রপাত থেকে । সেই প্রপাতের ক্ষীণতনুর দর্শন সারতেই পঞ্জপুল্লা দর্শন সমাধা হল ।




    আবার পুনর্মুষিকোভব - আবার গান্ধীচৌক । এবার ডাইনে মোচড় সুভাষ বাওলির খোঁজে । পথের দু-পাশের সবুজ প্রহরীদের সতর্ক পাহারায় দেড় কিলোমিটার যেতে পথের ধারে সুরম্য সৌধ । এখানেই রয়েছে সেই জলধারা, ১৯৩৭ সালে প্লুরিসি আক্রান্ত সুভাষচন্দ্র বসু যার জল পান করে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন । শ্বেতশুভ্র হিমপ্রহরী সদাসতর্ক নজরে যেন আগলে রেখেছে এই ঐতিহাসিক পুণ্যস্নানকে ।

    মন খুশ হলেও পেটুকের পেট উসখুশ । গান্ধীচৌকে ফিরেই কাফে ডালহাউসির গা ঘেঁষে মোতি মার্কেটে ঢুঁ মারতে হল তাই । খাই-খাই পর্ব মিটিয়ে বিকেল ঘেঁষে ব্যাক টু দ্য হোটেল । কাল খাজ্জিনাগের বাসায় ঢুঁ ।

    আঠাশে অক্টোবর, সকাল সাতটা

    আজ খাজ্জিনাগের বাসায় বাসা বাঁধার কথা । তাই বাসে এসে বসা । বাস ছুটবে লক্কড়মণ্ডি পেরিয়ে পাহাড় বেয়ে, চারধারের সবুজের আদর আর দূর হিমালের আশীর্বাদ নিয়ে ।

    সন্ধ্যা ছ-টা

    খাজ্জিনাগের দেশে (নাগ মানে নাকি সরোবর, জলাশয়) দেওদার ঘেরা হোটেল দেওদারের আশ্রয়ে বিশ্রাম । জানালার ওপারে খাজ্জিয়ারে বিখ্যাত বুগিয়ালের মাঝে খাজ্জিয়ার সরোবর । জৌলুস হারিয়ে আজ সে প্রায় ডোবা । তবু তার রূপে চোখ ঝলসে গিয়েছিল এখানে পৌঁছে । একপাশে খাজ্জিনাগের ১২শ শতাব্দীর মন্দির পঞ্চপাণ্ডবের দারুভূত মূর্তির পাহারায় । তার পাশে শিব আর হিড়িম্বা দেবীর মন্দির আর গুটিকয় হোটেল রেস্তোরাঁ । সকলেই এখন বিশ্রাম নিচ্ছে শীতল আঁধার জড়িয়ে । সারাদিন কম ধকল তো যায়নি - হাজারো মানুষ গাড়ি থেকে নেমে ছুটে, লাফিয়ে, ডিগবাজি খেয়ে, ঘোড়ায় চড়ে, স্বচ্ছ গোলকে সেঁধিয়ে গড়িয়ে অস্থির করে তুলেছিল খাজ্জিয়ারকে । নেহাৎ উপায় নেই, নয়তো সরোবরের জল পালিয়ে বাঁচত । এমনিতেই সে দূষণের জ্বালায় সংকুচিত । দেবদারুর দল তাকে আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । সেই দেবদারু বন এখন নিশ্চিন্ত ঘুমে । সীমাহীন নিস্তব্ধতার মাঝে ঝিঁঝির অশরীরী কনসার্ট । চাঁদের নরম আলো খাজ্জিয়ারের দলিত মথিত শরীরে কোমল স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে ।




    বিকেলে, বউকে ফেলে একা খাজ্জিয়ার গ্রামের বনপথ ধরে এগিয়ে মোলাকাত করে এলাম তুষারকিরীটিদের সঙ্গে । বনের পাখিরা এ ওকে শুধোলো, `এই দুপেয়ে দুশমনটা এখানে কী মতলবে হানা দিয়েছে ? আমাদের কি দুদণ্ড শান্তিতে থাকতে দেবে না !' প্রস্তরীভূত বজরংবলী যুক্তকরে বোধহয় পরিবেশ রক্ষারই আবেদন জানাচ্ছেন । সারাদিন ধরে বুগিয়ালময় ঘোড়াওয়ালা, বলওয়ালা, চানাচুরওয়ালা, শিলাজিতওয়ালা, হোটেলওয়ালাদের খদ্দের ধরার সে কী চেষ্টা ! শব্দব্রহ্ম কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছিল । এখন সে সব অদৃশ্য । দৃশ্যমান শুধু অপার শান্তি ।

    ঊনত্রিশে অক্টোবর, ভোর ছ-টা

    আজ ভগিনী নিবেদিতার জন্মদিন । ভোরের আলোয় তাঁরই যেন আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে । কুয়াশার রূপ নিয়ে মেঘ খাজ্জিয়ার লেকের বুকে চুপটি করে বিছিয়ে দিয়েছে তার শরীর । চারপাশের অরণ্য ঘুমে মগ্ন । দাড়কাকেরা একে একে তাদের ঘুম ভাঙাবার উদ্যোগ নিচ্ছে ।

    সকাল সোয়া সাতটা

    পুবের আকাশে কমলার আভা । বনপথের অনন্ত নিস্তব্ধতা মেখে পথ চলার আনন্দই আলাদা । পাহাড়ি শ্যামারা (ইয়েলো বিল্ড্‌ ব্লু-ম্যাগপাই) `গান গায় রে, দেখা দেয় না' । নিচে খাজ্জিয়ার গ্রাম আড়মোড়া ভাঙছে । হনুমানজী এখনও জোড়হস্ত । ধীরে ধীরে এসে গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ- `ওঁ জবাকুসুম সংকাশং কাশ্যপেয়ম্‌ মহদ্যুতিম্‌ / ধনত্বারিং সর্বপাপঘ্ন প্রণতোহস্মি দিবাকরম্‌' । দিনমণির আবির্ভাব । বরাভয়-কিরণে ঝলমল করে উঠল ধরিত্রী । আনন্দগান ছড়িয়ে পড়ল আদিগন্ত ।

    সকাল সাড়ে দশটা

    খাজ্জিয়ারবাস চুকিয়ে বাসে উঠে বসলাম । আজ যাব চম্পাবতীর শহর চাম্বায় । ছাইরঙা পথটা আঁকড়ে বাস প্রথমে চড়ল, তারপর নামল । মাঝপথে অ্যাডভেঞ্চারের উদয় । পথে প্রলেপ পড়ছে, অতএব বাসে বসে প্রলাপ বকা ছাড়া উপায় কী ! পাক্কা তিরিশ মিনিট কাটিয়ে তবে মুক্তি । চাম্বা প্রবেশ শহরের ব্যস্ততম সময়ে । বাসস্ট্যাণ্ডে লক্ষ লক্ষ বাস (পরে হিসেব করে দেখেছি, সেখানে আটটার বেশি বাস দাঁড়াবার জায়গাই নেই), কোটি কোটি মানুষ (নিদেনপক্ষে দু-তিনশো তো হবেই), গাড়ির জট - বেচারি চাম্বা আমাদের ভালো করে অভ্যর্থনা জানাবার সুযোগই পেল না । গোদের ওপর বিষফোঁড়া গরম - আনন্দ কপ্পুর । ইরাবতীর তীরে চৌগানের ধারে হোটেল ইরাবতীর কোলে আশ্রয় পেয়ে ধীরেসুস্থে ফিরল আনন্দ ।




    শেষ বিকেল

    চম্পাবতীর চৌগানে চোখ মেলে দেওয়া । পায়ে পায়ে এগিয়ে দু-চোখ ভরে দেখা ইরাবতীর শরীরের বাঁক । তারপর দিল্লীগেট (ওরফে গান্ধী গেট), হরিরায় মন্দির আর চম্পাবতীর মন্দির, চৌগানের সহস্রাব্দ তোরণ, চাম্বা মন কেড়ে নিল । একাদশ শতাব্দীর রাজা সাহিল বর্মার প্রাণাধিকা কন্যা প্রেমে মজল এক সাধারণ যুবকের । রাজা স্বভাবতই এই সম্পর্কে নারাজ । বুঝিয়ে ধমকিয়েও মেয়ের মন টলাতে না পেরে রাজধানী ভারমোর থেকে বহু দূরে ইরাবতীর তীরে নতুন নগর গড়ে কন্যা চম্পাবতীকে পাঠিয়ে দিলেন সেখানে । সে নগরীর নামকরণও করলেন চম্পা । তাতেও আটকালো না প্রেম । তখন রাজা হত্যা করলেন কন্যার প্রেমাস্পদকে । সেই দু:খে আত্মাহূতি দিলেন চম্পাবতী । প্রাণাধিকা কন্যার প্রাণ বিসর্জনে মর্মাহত হয়ে রাজা সাহিল বর্মা রাজধানী তুলে আনেন চম্পায় (যা কালক্রমে হয়ে দাঁড়ায় চাম্বা) । এখানে তিনি গড়লেন কন্যার স্মৃতিতে মন্দির, তার আত্মার শান্তি কামনায় একাধিক দেবদেউল । হাজার বছরের প্রাচীন চাম্বার `চৌগান' (পোলো খেলার মাঠ) শোনাচ্ছিল তার ইতিহাস, কিংবদন্তী । শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে টেরই পাইনি সন্ধ্যার আগমন । পাহাড়ের গায়ে ফুটে উঠল আলোর ফুল; আরামের ঠাণ্ডা মাখতে মাখতে ফিরে এলাম হোটেলে । হোটেলের ম্যানেজার, অদ্ভুত রকমের ভালো মানুষ নীনা সহগল উদ্যোগ নিয়ে সলুনির একমাত্র আশ্রয়স্থল P.W.D -র বাংলোয় বুকিং করে দিলেন, সঙ্গে আন্তরিক শুভেচ্ছা । আগামীকালের সলুনী ভ্রমণের সুখস্বপ্নে রাত কাটল ইরাবতীর কোলে । চম্পাবতীর শহরে ফিরব আবার দু-দিন পর ।


    (ক্রমশ:)




    (পরবাস-৪৩, জুলাই, ২০০৯)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)