বেলা পাঁচটা
ধানবাদকে ধন্যবাদ জানাবার জন্যই বুঝি গাড়ি অনেকক্ষণ তার গায়ে গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে । এমন আলসে গাড়ি `বাঘ' ছাড়া আর দেখিনি । এ বোধহয় `সিঙ্গি', বৈষ্ণোদেবীর পুণ্যার্থীর দলটা গোটা কামরাকে আমোদের সুরে ভরিয়ে দিয়েছে । একেবারে গোটা ক্রিকেট ম্যাচের (দু-দল মিলে, টুয়েলফ্থ ম্যান সহ) দল, চব্বিশজনের ।
পঁচিশে অক্টোবর, ভোর (!) সোয়াপাঁচটা
আজ কোজাগরী পূর্ণিমা - লক্ষ্মীপুজো । আকাশ এখনও দিব্যি লক্ষ্মীছেলের মত বুটিদার কালো কম্বলখানা মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে । রাতের আঁধারে পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে, ঝাড়খণ্ডের এক খণ্ডের ওপর দিয়ে বিহার পার করে গাড়ি ঢুকে পড়েছে উত্তরপ্রদেশে । গাড়ি সাহাপুরে পৌঁছে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই আমাকেই ঘুম থেকে উঠতে হল ।
সাতটা কুড়ি
আলসে গাড়ি আবার দাঁড়িয়ে পড়েছে । বেচারির বেশি পরিশ্রম সহ্য হয়না - খানিক পরেপরেই জিরিয়ে নেয় । তার কাণ্ড দেখে সূয্যিমামা হামা দিয়ে হাজির । তার লালচে কিরণ পুবের জানালার শার্সিতে টোকা মারছে ।
সকাল আটটা
রামরাজ্যে প্রবেশ । অযোধ্যায় এখন আর রাম না থাকলেও নরবানরের দিব্যি সহাবস্থান স্টেশনজুড়ে । এর পরেই ফৈজাবাদ - আবুল ফজলের জাগীর । প্রদেশ বদল, রাজ্যবদল, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে সেই খড়ের চালের মাটির কুঁড়ে, সেই লাউমাচা, সেই গাছের ছায়াঘেরা আঙিনা, সেই পাখির কূজন, গরুর জাবরকাটা ।
বেলা পৌনে বারোটা
লক্ষ্মণাবতী - লখনউ । লক্ষ্মণের রাজধানী লক্ষ্মণাবতী; নবাব ওয়াজিদ আলি শা-র লখনউ; নবাবী গন্ধমাখা লখনউ; বাদশাহী আংটির ফেলুদার প্রিয় শহর লখনউ । এবার শুধুই ছুঁয়ে চলা । বাইশ মিনিট পরেই `ছোড় চলে লখনউ নগরী' ।
ছাব্বিশে অক্টোবর, সকাল পৌনে সাতটা
অবশেষে পাঠানকোটে জোড়া পাঁঠার অবতরণ । ডালহাউসি যাবার জন্য ট্যাক্সিভাড়া যা চাইল, তাতে এই সুন্দর হিমেল সকালটা আগ্নেয়গিরি হয়ে গেল । অতএব সাইকেল রিক্সাবাহিত হয়ে বাস-টার্মিনাসে । স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে বামপন্থী হতে না হতেই ডান হাতে তার অবস্থান । বড্ডবেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, স্টেশনের মতই - এরা এখনও আমাদের মত `সভ্য' হতে শিখল না ।
ডালহাউসির প্রথম বাস সাড়ে ছ-টায় টা-টা । অতএব চাম্বার বাসে এঁকেবেঁকে তিনঘন্টায় বনিখেত । তারপর `পবননন্দন' বাহিত হয়ে রবিঠাকুর, নেতাজির স্মৃতিমাখা ডালহাউসি (২১১৫ মি:) পাহাড়ে । বেশ নিরিবিলি শান্তশিষ্ট শহরটা - সিমলা, দার্জিলিং, গ্যাংটকের মতো লেজবিশিষ্ট নয় । সুভাষ চৌক আর গান্ধী চৌকের মাঝে শান্তির আবাস `সাংগ্রিলা' অনবদ্য । দিগন্তে তুষারমৌলিদের গ্যালারি মাঝে উপত্যকা হলুদ সবুজ মেখে মেলে ধরেছে নিজেকে । আশ্চর্যরকমের নৈ:শব্দমাখা শৈলশহর - দিল খুশ হো গয়া ।
সাতাশে অক্টোবর, ভোর (!) ছ-টা দশ
ডালহাউসির পশ্চিম আকাশে এখনও পূর্ণচন্দ্রের রাজত্ব । দক্ষিণ-পূর্বে শুকতারার সতর্ক নজর । আকাশ তার কালো কম্বলটা কাচতে বসেছে । তাই তার পুবদিকটা নীলচে তাতে হালকা কমলা ছোপ । তারারা হারাবার পথে । পাখিদের কূজন এখনও শুরু হয়নি, ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক এখনও ঝিঁঝিদের কনসার্ট ।
সকাল পৌনে আটটা
এখনও রবির বরাভয়স্পর্শ এসে পৌঁছয়নি ডালহাউসির বরতনুতে । শহর সবে আড়মোড়া ভাঙছে । আমাদের মতো `চাতালের' পক্ষে এত বেলা পর্যন্ত না-চা পর্ব বড়ই কষ্টদায়ক ।
রাত্রি আটটা আটান্ন
লেপমুড়ি দিয়ে গুড়িসুড়ি মেরে কলম চালাচ্ছি । আজকের `রোজনামচা' নামানোর চেষ্টা করি ।
মন খুশ হলেও পেটুকের পেট উসখুশ । গান্ধীচৌকে ফিরেই কাফে ডালহাউসির গা ঘেঁষে মোতি মার্কেটে ঢুঁ মারতে হল তাই । খাই-খাই পর্ব মিটিয়ে বিকেল ঘেঁষে ব্যাক টু দ্য হোটেল । কাল খাজ্জিনাগের বাসায় ঢুঁ ।
আঠাশে অক্টোবর, সকাল সাতটা
আজ খাজ্জিনাগের বাসায় বাসা বাঁধার কথা । তাই বাসে এসে বসা । বাস ছুটবে লক্কড়মণ্ডি পেরিয়ে পাহাড় বেয়ে, চারধারের সবুজের আদর আর দূর হিমালের আশীর্বাদ নিয়ে ।
সন্ধ্যা ছ-টা
খাজ্জিনাগের দেশে (নাগ মানে নাকি সরোবর, জলাশয়) দেওদার ঘেরা হোটেল দেওদারের আশ্রয়ে বিশ্রাম । জানালার ওপারে খাজ্জিয়ারে বিখ্যাত বুগিয়ালের মাঝে খাজ্জিয়ার সরোবর । জৌলুস হারিয়ে আজ সে প্রায় ডোবা । তবু তার রূপে চোখ ঝলসে গিয়েছিল এখানে পৌঁছে । একপাশে খাজ্জিনাগের ১২শ শতাব্দীর মন্দির পঞ্চপাণ্ডবের দারুভূত মূর্তির পাহারায় । তার পাশে শিব আর হিড়িম্বা দেবীর মন্দির আর গুটিকয় হোটেল রেস্তোরাঁ । সকলেই এখন বিশ্রাম নিচ্ছে শীতল আঁধার জড়িয়ে । সারাদিন কম ধকল তো যায়নি - হাজারো মানুষ গাড়ি থেকে নেমে ছুটে, লাফিয়ে, ডিগবাজি খেয়ে, ঘোড়ায় চড়ে, স্বচ্ছ গোলকে সেঁধিয়ে গড়িয়ে অস্থির করে তুলেছিল খাজ্জিয়ারকে । নেহাৎ উপায় নেই, নয়তো সরোবরের জল পালিয়ে বাঁচত । এমনিতেই সে দূষণের জ্বালায় সংকুচিত । দেবদারুর দল তাকে আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । সেই দেবদারু বন এখন নিশ্চিন্ত ঘুমে । সীমাহীন নিস্তব্ধতার মাঝে ঝিঁঝির অশরীরী কনসার্ট । চাঁদের নরম আলো খাজ্জিয়ারের দলিত মথিত শরীরে কোমল স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে ।
ঊনত্রিশে অক্টোবর, ভোর ছ-টা
আজ ভগিনী নিবেদিতার জন্মদিন । ভোরের আলোয় তাঁরই যেন আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে । কুয়াশার রূপ নিয়ে মেঘ খাজ্জিয়ার লেকের বুকে চুপটি করে বিছিয়ে দিয়েছে তার শরীর । চারপাশের অরণ্য ঘুমে মগ্ন । দাড়কাকেরা একে একে তাদের ঘুম ভাঙাবার উদ্যোগ নিচ্ছে ।
সকাল সোয়া সাতটা
পুবের আকাশে কমলার আভা । বনপথের অনন্ত নিস্তব্ধতা মেখে পথ চলার আনন্দই আলাদা । পাহাড়ি শ্যামারা (ইয়েলো বিল্ড্ ব্লু-ম্যাগপাই) `গান গায় রে, দেখা দেয় না' । নিচে খাজ্জিয়ার গ্রাম আড়মোড়া ভাঙছে । হনুমানজী এখনও জোড়হস্ত । ধীরে ধীরে এসে গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ- `ওঁ জবাকুসুম সংকাশং কাশ্যপেয়ম্ মহদ্যুতিম্ / ধনত্বারিং সর্বপাপঘ্ন প্রণতোহস্মি দিবাকরম্' । দিনমণির আবির্ভাব । বরাভয়-কিরণে ঝলমল করে উঠল ধরিত্রী । আনন্দগান ছড়িয়ে পড়ল আদিগন্ত ।
সকাল সাড়ে দশটা
খাজ্জিয়ারবাস চুকিয়ে বাসে উঠে বসলাম । আজ যাব চম্পাবতীর শহর চাম্বায় । ছাইরঙা পথটা আঁকড়ে বাস প্রথমে চড়ল, তারপর নামল । মাঝপথে অ্যাডভেঞ্চারের উদয় । পথে প্রলেপ পড়ছে, অতএব বাসে বসে প্রলাপ বকা ছাড়া উপায় কী ! পাক্কা তিরিশ মিনিট কাটিয়ে তবে মুক্তি । চাম্বা প্রবেশ শহরের ব্যস্ততম সময়ে । বাসস্ট্যাণ্ডে লক্ষ লক্ষ বাস (পরে হিসেব করে দেখেছি, সেখানে আটটার বেশি বাস দাঁড়াবার জায়গাই নেই), কোটি কোটি মানুষ (নিদেনপক্ষে দু-তিনশো তো হবেই), গাড়ির জট - বেচারি চাম্বা আমাদের ভালো করে অভ্যর্থনা জানাবার সুযোগই পেল না । গোদের ওপর বিষফোঁড়া গরম - আনন্দ কপ্পুর । ইরাবতীর তীরে চৌগানের ধারে হোটেল ইরাবতীর কোলে আশ্রয় পেয়ে ধীরেসুস্থে ফিরল আনন্দ ।
(পরবাস-৪৩, জুলাই, ২০০৯)