• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪০ | ফেব্রুয়ারি ২০০৮ | প্রবন্ধ
    Share
  • নন্দীগ্রামের বর্তমান, আমাদের ভবিষ্যৎ : চিরন্তন কুন্ডু



    পালাবদলের পালা

    তুই কী বলতে চাস ? জমি ছেড়ে দিতে !

    হ্যাঁ, সেটাই সব দিক থেকে ভালো । তাতে কেওয়ল সিংকে হাতে রাখা যাবে - আমাদের আপদে বিপদে ও দেখবে ।

    কিন্তু যাদের ঘর ভাঙবে, তাদের কী হবে ?

    তাদের একটু অসুবিধে সহ্য করতেই হবে । কয়েক জনের জন্য তো সবাই বিপদে পড়তে পারে না।

    তুই বলছিস এই কথা !

    নিজের নিজের সুবিধে হলে, সবাই বড় বড় কথা বলতে পারে । তোমার ছেলে দোকান খুলে বসেছে, তোমাদের আর খাওয়া-পরার ভাবনা নেই, তাই অন্যদের জন্য দরদ উথলে উঠেছে । কিন্তু যাদের ঘরে রোজগার করার কেউ নেই ? যে সব ছেলে চাকরি পায় না, তাদের কথা কে ভাবে ? কেওয়ল সিং কলোনির লোকদের চাকরি দেবে বলেছে –

    অর্জুন দু:খিত ভাবে মাথা নেড়ে বলল, দিব্য, এসব চাকরির কোনও মূল্য নেই রে ! কোনও মূল্য নেই । এগুলো টোপ ! এতদিন তো তোকে চাকরি দেয়নি ! আরও ছেলেদের চাকরি দেবে কথা দিয়েছে । ওর ফ্যাক্টরি বড় হলে ও আরও লোক নেবে, তাতে আমাদের সুবিধে । কয়েক জনের একটু অসুবিধে করে যদি কলোনির অনেক লোকের উপকার হয় –

    চাকরির লোভে তুই এদের দ্বিতীয় বার বাস্তুহারা হতে বলিস ?

    তুই সবই বুঝিস, আর কেউ কিছু বোঝে না, না ? আমরা সাহায্য না করলে, ওরা ওদের ফ্যাক্টরি বেঙ্গল থেকে তুলে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে । তাতে কার লাভ হবে ?

    -'অর্জুন' (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)


    'অর্জুন' উপন্যাসে আমরা দেখেছি কীভাবে কেওয়ল সিংয়ের কারখানার খাঁই মেটাতে উদ্বাস্তু কলোনির কিছু বাড়িতে আগুন লাগিয়ে সেই জমিতে কারখানার দেওয়াল গাঁথা হয়েছে । পুলিশ প্রশাসন পুনর্বাসন দপ্তর এই উদ্যোগে মদত দিয়েছে । কলোনির মানুষের মধ্যে সুকৌশলে বিভেদের বীজ ছড়ানো হয়েছে । কেওয়ল সিংয়ের বাহিনীর নেতা দিব্য কলোনিরই একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছে । উপন্যাসের শেষে অর্জুনের নেতৃত্বে কলোনির মানুষ কারখানার দেওয়াল ভাঙতে গিয়ে কেওয়ল সিং, দিব্য ও তাদের দলবলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে ।

    এই উপন্যাস বই হিসেবে প্রথম বেরোয় ১৯৭১ এ । আর ২০০৬-০৭ এ এসে আমরা দেখলাম সিঙ্গুর । টাটার কারখানার জন্য জমি দখল করল সরকার । তাপসী মালিক নামে এক যুবতীকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হল । কারখানার দেওয়ালের বাইরে বিক্ষোভ দেখিয়ে চললেন স্থানীয় কৃষকরা - যাঁদের জমি তাঁদের আপত্তি সত্ত্বেও কারখানার গর্ভে চলে গেছে । সেসব তিনফসলি জমির ঊর্বরতা নাকি গাড়ির কারখানার পক্ষে অপরিহার্য । আমরা দেখলাম নন্দীগ্রাম । যেখানকার ১৪ই মার্চএর গণহত্যা আর গণধর্ষণের পর এই উপন্যাসের লেখক লিখিতভাবে জানালেন জমি রক্ষার আন্দোলনে যে মহিলারা সামিল হয়েছিলেন, তাঁদের আবেগ সঠিক ছিল না । জানালেন তিনি মুখ্যমন্ত্রীর শিল্পনীতির একশো ভাগ সমর্থক । যে শিল্পনীতির লক্ষ্য, আমাদের অভিজ্ঞতায়, যে কোন মূল্যে কেওয়ল সিং-রতন টাটা-সালিমদের বেঙ্গলে নিয়ে আসা । যত খুশি প্রাণের বিনিময়ে ।

    চোপ উন্নয়ন চলছে

    তারা উন্নতি চায় না - তারা নিজের শর্করা নিজে খেতে এবং নিজের বিবরে নিজে বাস করতে চায়, তার কারণ তারা পিঁপড়ে, নিতান্তই পিঁপড়ে । কিন্তু আমরা যখন ডেঞে তখন আমরা তাদের উন্নতি দেবই, এবং তাদের শর্করা আমরা খাব ও তাদের বিবরে আমরা বাস করব - আমরা এবং আমাদের ভাইপো, ভাগ্নে, ভাইঝি ও শ্যালকবৃন্দ ।

    -'ডেঞে পিঁপড়ের মন্তব্য' (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


    পশ্চিমবঙ্গ এখন এক পিছিয়ে পড়া রাজ্য । জাতীয় নমুনা সমীক্ষণ সংস্থার ২০০৪-০৫ সালের সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, বছরের কয়েক মাস সব দিন যথেষ্ট খাবার পান না, এমন গ্রামীণ পরিবারের হার পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি - ১০.৬% । এবং বছরের প্রত্যেক মাসেই সব দিন যথেষ্ট খাবার পান না এমন পরিবারের তালিকায় শীর্ষে (আসাম - ৩.৬%) না হলেও ওড়িশার সঙ্গে যৌথভাবে পশ্চিমবঙ্গের (১.৩%) নাম জ্বলজ্বল করছে । কর্তারা অবশ্য বলে থাকেন এ রাজ্যে অনাহারে কেউ মারা যান না । আমলাশোলের পর মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন ওটা বাজে ব্যাপার । যদিও পরে অভ্যাসমাফিক সুর পাল্টে তিনি বলেছেন ওখানে 'অনাহারের পরিস্থিতি' রয়েছে । মনে রাখতে হবে তিরিশ বছরের সিপিয়েম শাসনে (যাঁরা ভুরু কুঁচকে "সিপিয়েম নয়, বামফ্রন্ট" বলছেন, তাঁদের উদ্দেশে ছোট্ট কুইজ - বামফ্রন্টের শরিক দল ক'টা ? সঠিক উত্তরদাতাদের জন্য পরের প্রশ্ন - সেগুলোর নাম কী ?) আমরা এইসব শীর্ষস্থানে পৌঁছেছি । এবং এই সরকার উন্নততর সরকার ।

    অনাহার-আক্রান্ত পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের প্রয়োজন - এ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই । তিরিশ বছর ধরে ধারাবাহিক জঙ্গি আন্দোলনে যাঁরা একের পর এক কারখানায় তালা ঝুলিয়ে এসেছেন, তাঁরাও এই কথাটা বুঝতে পেরেছেন বলে খবর । 'বিরোধী মানেই শিল্পবিরোধী' - গোয়েবেলসের কায়দায় বাজানো এই ঢাকের আওয়াজেও সারবত্তা পাওয়া যাচ্ছে না । শালবনীতে জিন্দালদের প্রকল্পে বিরোধীরা বাধা দেননি । সিঙ্গুরেও বিকল্প জমির প্রস্তাব দিয়েছিলেন । বিরোধ-বিতর্ক যা চলছে তা জমি অধি:গ্রহণ ও তার পদ্ধতি নিয়ে । বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন সিঙ্গুরে কারখানা গড়তে মোট ৯২৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে । হাইকোর্টে রাজ্য সরকারের তরফে ভূমি সংস্কার দফতরের যুগ্মসচিব সনত্কুমার মুখোপাধ্যায় হলফনামা দিয়ে জানান, মোট অধিগৃহীত জমির পরিমাণ ২৮৭ একর । আবার হাইকোর্টে সরকারের তরফে য়্য়াডভোকেট জেনারেল বলাই রায় জানালেন মালিকের সম্মতি নিয়ে জমি নেওয়া হয়েছে মোট ৩৮৭ একর । ফেলু মিত্তির রিটায়ার করার পর এই অদ্ভুত রহস্যের কিনারা করবার লোক নেই । টাটাদের সঙ্গে চুক্তিও এরকম নানা রহস্যের ঘোমটায় ঢাকা । মুখ্যমন্ত্রী এর বাংলা করেছেন ট্রেড সিক্রেট । ঘোমটার আড়ালে জনগণের টাকায় টাটাকে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে কিনা, সিঙ্গুরে এই নতুন ধাঁচের ভূমিসংস্কারের যৌক্তিকতা কী - এসব বেয়াড়া প্রশ্ন তোলা মানেই আপনি শিল্পবিরোধী । তথ্যের অধিকার ? ওসব গ্রাম্ভারি শব্দ বাড়ি গিয়ে বাঁধিয়ে রাখুন ।

    উন্নয়ন যুদ্ধ নয় । এখানে কোল্যাটারাল ড্যামেজের কোন জায়গা নেই । এই সরকার ও প্রধান শাসকদলের কাজকর্মে উন্নয়ন নয়, আগ্রাসনের লক্ষণই প্রকট । হঠাৎ আসা শিল্পায়নের বেগ যেন সামলানো যাচ্ছে না । কিছুদিন আগে জমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে কেন্দ্র যে নীতি তৈরী করেছে, তাতে অধিগ্রহণ করতে হবে মূলত: শিল্পসংস্থাকেই । সরকারের ভূমিকা সীমিত । অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিজে জমি অধিগ্রহণ করে সংস্থাকে দিতে বদ্ধপরিকর । এসবে কাদের লাভ, সেই লাভের গুড়ে আরো কারা ভাগীদার - এসব খোলসা হওয়া দরকার । মানুষের জীবন ও জীবিকা কেড়ে নিয়ে পুলিশ দিয়ে গুণ্ডা দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে উন্নয়নের বড়ি গেলানো বন্ধ না হলে বিরোধিতার সামনে পড়া অবশ্যম্ভাবী ।

    নন্দীগ্রাম

    কুটিলের মন্ত্রে শোষণের যন্ত্রে গেল প্রাণ শত প্রাণ গেল রে - -'

    গাঁয়ের বধূ' (সলিল চৌধুরী)


    মুখ্যমন্ত্রী ও সালিম ঠিক করেছিলেন নন্দীগ্রামের চাষের জমিতে কেমিক্যাল হাব খুব ভালো হবে । কিন্তু যাদের জমি, তাদের ভাবনাচিন্তা অন্যরকম । অতএব এমন সব মোড়লকে ভার দেওয়া হল যারা কোনরকম নোংরামিকেই ভয় করে না । হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটির দেওয়া জমি অধিগ্রহণের নোটিশ থেকে গোলমালের শুরু । যার পরিণতি ১৪ই মার্চের গণহত্যা । ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতারা সেদিন মহিলা ও শিশুদের সামনে রেখেছিলেন । তাঁদের আশা ছিল পুলিশ নারী ও শিশুদের দেখে অস্ত্র সংবরণ করবে । কিন্তু যে পুলিশমন্ত্রী পুলিশকে নির্যাতনে উত্সাহ দিয়ে ভরসা দেন মানবাধিকার-টিকার তিনি বুঝে নেবেন, তাঁর বাহিনী যে এসব মানবিকতার তোয়াক্কা করবে না বলাই বাহুল্য । করেওনি । হাইকোর্ট এক সাম্প্রতিক রায়ে সেদিন পুলিশের গুলিচালনাকে 'অন্যায্য ও অসাংবিধানিক' আখ্যা দিয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন । সরকার সিবিআই তদন্ত ঠেকাতে মরিয়া হয়ে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল । কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সে অপচেষ্টায় জল ঢেলে দিয়েছেন । এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়, আক্রান্ত হয়ে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে - এমন একটা তত্ত্ব খাড়া করা হয়েছিল । কিন্তু আহত বা নিহত পুলিশের নাম সরকার পেশ করতে পারেনি । কাজেই সে গল্প ধোপে টেকেনি ।

    ১৪ই মার্চের পর শোনা গেল সিপিয়েমের অনেক লোক ঘরছাড়া হয়ে খেজুরিতে আশ্রয় নিয়েছে । দল ও প্রশাসন এদের ফেরানোর ব্যবস্থা পাকা করল নভেম্বরের গোড়ায় । বৃন্দা কারাত জনসভায় নন্দীগ্রামে দমদম দাওয়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করলেন । পরিকল্পিতভাবে তেখালি ব্রিজের পাশ থেকে পুলিশ ক্যাম্প তুলে নেওয়া হল । নন্দীগ্রাম থানার পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হল তারা যেন থানার বাইরে না যায় । মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিলেন কোন বলপ্রয়োগ করা হবে না । অত:পর তাঁর দলের গুণ্ডারা রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ল দখল অভিযানে । ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নিরস্ত্র মিছিলের ওপর গুলি চালাল এই পোষা হার্মাদরা । আবার রক্তগঙ্গা । মেয়ের সামনে মাকে ও মায়ের সামনে মেয়েদের ধর্ষণ । চতুর্দিকে লাল পতাকার শোভা । সিপিয়েমের রাজ্য সম্পাদক সানন্দে নন্দীগ্রামে 'নতুন সুর্যোদয়' হয়েছে বলে বিবৃতি দিলেন । মুখ্যমন্ত্রী জানালেন - "দে হ্যাভ বিন পেড ব্যাক দেয়ার ওন কয়েন ।" (সম্প্রতি যথারীতি তিনি সুর পাল্টে জানিয়েছেন তাঁর ওটা বলা ঠিক হয়নি ।)

    ১৪ই মার্চ থেকে শিক্ষা নিয়ে সিপিয়েম এই পর্বে মিডিয়াকে ঢুকতেই দেয়নি । সিটু নেতা শ্যামল চক্রবর্তী বললেন মিডিয়ার সঙ্গে গুণ্ডারা ঢুকে পড়ছে, তাই এই ব্যবস্থা । কথাটা যে কতবড় সত্যি তা বোঝা গেল যখন ‘গণশক্তি’র এক সাংবাদিকের সঙ্গে ছোট আঙারিয়ায় কিছু মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারার মামলায় প্রধান দুই ফেরার আসামী তপন ঘোষ ও সুকুর আলি তৃণমূল কর্মীদের হাতে ধরা পড়ে । তারা প্রতিরোধ কমিটির কিছু আহত লোককে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল । উদ্দেশ্যটা বোঝা সহজ - বিশেষ করে এখন যখন নন্দীগ্রাম ও খেজুরির কবর থেকে পোড়া-আধপোড়া মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে । পুলিশের খাতায় ফেরার দুই আসামী অবশ্য এলাকায় দাপটে তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল । তাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানার কথা তারা নাকি জানতই না । সিপিয়েম জানাল তারা দীঘা বেড়াতে গিয়েছিল । সিপিয়েমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার বললেন তপন-সুকুর তাঁদের গর্ব । সিপিয়েমের মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ হুমকি দিলেন তপন-সুকুরকে ধরিয়ে দেওয়ার শাস্তি তৃণমূলকে পেতে হবে । সিপিয়েমের কবি জয়দেব হার্মাদ বসু টিভি চ্যানেলে জানালেন - উই আর প্রাউড অফ দেম । এবং এর সঙ্গে সুহৃদ দত্তের নামটাও জুড়ে দিলেন । যে সুহৃদ দত্ত সিঙ্গুরে তাপসী মালিককে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে সিবিআই হেফাজতে রয়েছে ।

    ১৪ই মার্চ পুলিশের পাশাপাশি মুখে কাপড় বাঁধা অস্ত্র হাতে বেশ কিছু লোক অভিযানে অংশ নিয়েছিল । ঘটনার পরপরই তদন্তে নেমে সিবিআই সেখানকার জননী ইঁটভাটা থেকে দশ জন দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করে রাজ্য পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল । রাজ্য পুলিশের ঐকান্তিক চেষ্টায় তারা বিনা চার্জশিটে ছাড়া পেয়ে যায় । তপন-সুকুরও কদিন আগে এই মামলায় জামিন পেয়েছে । পুলিশ জানিয়েছে তারা কিছু আহত মানুষের চিকিত্সা করাতে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল । জননী ইঁটভাটার সেই লোকেদের সিবিআই আবার খঁংউজছে এবং যথারীতি পাওয়া যাচ্ছে না । তবে তারা কাদের হয়ে কাজ করছিল এটা ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট । ধরে নিতে পারি তারা আবার ধরা পড়লে অনেকেই তাদের সম্পর্কে গর্ব প্রকাশ করবেন ।

    চক্রান্ত, চক্রান্ত

    The statements that make people mad are the ones they worry might be believed. I suspect the statements that make people maddest are those they worry might be true.

    ‘What You Can't Say’ (Paul Graham)


    ১৪ই মার্চের ঘটনার পর রাজ্যপাল হাড় হিম করা সন্ত্রাসের কথা বলেছিলেন । নভেম্বরের ঘটনার পর তিনি বললেন এই ঘটনা দীপাবলির আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে । সিপিয়েম নেতৃত্ব এতে বেজায় চটেছেন । বিনয় কোঙার তাঁকে তৃণমূলের ঝাণ্ডা নিয়ে রাজনীতি করতে উপদেশ দিয়েছেন । বিমান বসু জানাচ্ছেন রাজ্যপাল তাঁর সাংবিধানিক এক্তিয়ারের বাইরে কথা বলেছেন । তবে এ নিয়ে সংবিধানসম্মত উপায়ে মামলা দায়ের করার রাস্তায় তাঁরা হাঁটেননি । হাইকোর্টের রায় নিয়েও .তাঁরা ত্রক্রুদ্ধ । একজন বলছেন বিচারসভা বারবার সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করছে । আরেকজন প্রস্তাব দিচ্ছেন বিচারপতিদের মাইনে কিছু বাড়িয়ে দিলেই হয়, তাঁরাই দেশ চালাবেন । অবশ্য বিমানবাবু আগেও বিচারকদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন এবং আদালতে ক্ষমাও চেয়েছেন । এ ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে তেমনই কিছু হওয়ার সম্ভাবনা । মানবাধিকার কমিশন নন্দীগ্রামকে দেশের বুকে জঘন্যতম ক্ষত অভিধা দেওয়ায় কমিশনকেও কটূক্তি করা হয়েছে । মুখ্যমন্ত্রীর মতে নকশালরা এপিডিআরের আউটফিট । সিআরপিএফ জওয়ানেরা কিছু তাজা বোমা সমেত সিপিয়েমের শিক্ষক নেতা অভয় জানাকে বন্দী করেছেন । সিআরপিএফের মধ্যে তৃণমূলের লোক আছে বলে দাবি করেছেন শ্যামল চক্রবর্তী । আর মিডিয়াকে, বিশেষ ক'রে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে নিয়ে মুশকিলের শেষ নেই । কারণ এরা যা ঘটছে তার ব্যাখ্যাট্যাখ্যার তোয়াক্কা না ক'রে সরাসরি ক্যামেরায় দেখিয়ে দেয়, কোন মন্তব্য পরে অস্বীকার করার সুযোগটুকুও দেয় না । অতএব সুভাষ চক্রবর্তী বলছেন মিডিয়া চক্রান্ত করছে, তাদের জনরোষের শিকার হতে হবে । আর মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য তিনি যে 'বর্তমান' কাগজ বন্ধ করে দিচ্ছেন না, সে নেহাতই ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করবেন না ব'লে ।

    মোদ্দা কথাটা হচ্ছে চক্রান্ত । সিপিয়েমকে কেউ দেখতে পারে না, তাই রাজ্যপাল-আদালত-শরিক-তৃণমূল-মাওবাদী-মিডিয়া-মেধা পাটকর-মানবাধিকার কমিশন-সুমিত সরকার-অরুন্ধতী রায়-শঙ্খ ঘোষ-এপিডিআর এবং অবশ্যই আমেরিকা - সবাই এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত - যার একমেবাদ্বিতীয়ম লক্ষ্য নাকি সিপিয়েমকে সরানো । অর্থাৎ এতদিন কেন্দ্রের চক্রান্তের যে গল্পটা শোনানো হত, এ যুগে সেটা আর তেমন জমছে না । অগত্যা সাত জার্মানকে খাড়া করে জগাইয়ের এই মরিয়া লড়াই ।

    রাজনীতি

    রাজনীতির কি আদর্শ থাকে ? আমার ধারণা আদর্শ কথাটারই ব্যাখ্যা দরকার । রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের, ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা থাকে, আর একা তা পারা যায় না বলে দল করতে হয় । আর বলতে হয় দলের সকলের মঙ্গলের জন্যই চেষ্টা, ক্ষমতা দখলের চেষ্টা আদৌ নেই । আদর্শ শব্দটার সঙ্গে মিথ্যাচরণকে মেশাতে আমার আপত্তি আছে ।

    -'নিজের কথা' (অমিয়ভূষণ মজুমদার)

    সিপিয়েমের প্রবীণ নেতা বিনয় কোঙার দিনকয়েক আগে বলেছেন - টাটার কারখানা হোক না, বিপ্লব হলে সে কারখানা তো মানুষেরই হবে । অনেকদিন বাদে বিপ্লবের কথা শোনা গেল । এই বিনয় কোঙার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নন্দীগ্রামের মানুষের লাইফ হেল করে দেবেন । কেউ কথা রাখেনি - এ অপবাদ অন্তত: তাঁর সম্পর্কে দেওয়া যাবে না । এমন আত্মবিশ্বাসী নেতাও যখন বিপ্লব করার বদলে হওয়ার কথা বলেন, তখন বোঝা যায় বলতে হয় বলে বলা, গলায় জোর নেই । পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীর সঙ্গে বামপন্থা আর বিপ্লব জড়িয়ে কিছু গুজব বাজারে চালু আছে । সত্যি কথা বলতে সেটা গুজবই । ব্রিগেডে হাততালি দিতে যে সব নিরুপায় মানুষকে খেদিয়ে আনা হয়, তাদের খামোখা মার্কস-লেনিনবাদী ব'লে গালাগাল বা পিঠ চাপড়ানি দেওয়া অসমীচীন । আমরা বরাবরই রক্ষণশীল । স্বাধীনতার পর টানা কুড়ি বছর কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে এসেছি, আবার সাতাত্তর থেকে এতকাল সিপিয়েমকে গদিতে রেখেছি । বিপ্লব-টিপ্লব নিয়ে সিপিয়েমের মত আমাদেরও মাথাব্যথা ছিল না । আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে - এটুকুই আমাদের আকাঙক্ষা । পড়াশোনার দিকে আমাদের একটা টান ছিল । সেখানেও প্রত্যাশার পারদ নামতে নামতে এখন মিড-ডে মিলের খিচুড়িতে এসে ঠেকেছে । সত্তরের দশকে একটা অন্যরকম চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু তার খুব একটা জনভিত্তি ছিল না । কংগ্রেস সরকারের পতনের পর কংগ্রেসের যে সব কর্মী তড়িঘড়ি শিবির বদলেছিলেন, তাঁদের সিদ্ধান্তেও আদর্শানুরাগের চেয়ে বাস্তববুদ্ধির পরিচয়ই বেশি । সিপিয়েম এখন কেরিয়ার - প্রোমোটারি থেকে ইস্কুলমাস্টারি সবেতেই কাজে দেয় । না করলে বিপদও ঘটে থাকে । হ্যাঁ, বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ নিজেদের বামপন্থী বলে মনে করেন, তবে সেই চেতনার ভার আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাঁধে না চাপানোই ভালো । খোদ সিপিয়েমও সেটা বোঝে ব’লেই চেতনার ভরসায় ভোটপর্ব ছেড়ে রাখে না । তার চেয়ে সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের দখলে নিয়ে, কাউকে পাইয়ে দিয়ে, কাউকে হুমকি দিয়ে কব্জা করা অনেক নিরাপদ । সেটা করতে গেলে দলতন্ত্রে আনুগত্যকেই যোগ্যতা ধরতে হয় । আর এই যোগ্যতায় প্রোমোশন পেতে পেতে যাঁরা শীর্ষে উঠে আসেন, স্বাধীনভাবে কাজ করতে গিয়ে তাঁরা দিশাহারা হয়ে পড়বেন সেটাই স্বাভাবিক ।

    নন্দীগ্রামের ঘটনায় বামফ্রন্টের কিছু কিছু শরিক প্রকাশ্যেই সিপিয়েমের নিন্দা করেছে । তাদের মতে নন্দীগ্রামের ঘটনার সমস্ত দায় সিপিয়েমের । আরএসপির মন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামী পদত্যাগও করেছিলেন, যদিও দলের নির্দেশে আবার ফিরে এসেছেন । ফরওয়ার্ড ব্লক জানিয়েছে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তারা আলাদাভাবে লড়বে । সিপিআইও প্রথমে কিছুটা গর্জন করেছিল, তাদের বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াস ঘুষ নিয়ে বিধানসভায় প্রশ্ন তোলার অভিযোগে জড়িয়ে পড়ায় তারা এখন নরম । মজার ব্যাপার হল যতই নিন্দেমন্দ করুক, কেউই কিন্তু সরকার ছেড়ে সরে আসতে রাজি নয় । ক্ষমতায় থাকব অথচ ঘটনার দায় নেব না - এ হল ডুডুংউ ও টামাক একসঙ্গে খাওয়ার সুবিধাবাদ । এই সুবিধাবাদ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকগুলো বাঁধাধরা বদগুণের একটা ।

    জাতীয় রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্ব প্রায় নেই । যে জন্য কংগ্রেস বা বিজেপির মত জাতীয় দলগুলো এখানে গা লাগায় না । প্রদেশ কংগ্রেসের একজন সভাপতি জোগাড় হয় না । তার ওপর আছে তৃণমূলের মত দুর্বল বিরোধী দল ।

    সর্বশক্তিমান সিপিয়েম, উচ্ছিষ্টভোজী শরিক ও ছত্রভঙ্গ বিরোধী - এই ত্র্যহস্পর্শে পশ্চিমবঙ্গের নাভিশ্বাস ওঠার দশা । জাতীয় রাজনীতির সমীকরণও তাতে বাড়তি ফ্যাক্টর । সিপিয়েমের সমর্থনে কেন্দ্রে সরকার চলছে । বিরোধীরা একজোট হওয়ার চেষ্টা করলে কংগ্রেস হাইকমাণ্ড আপত্তি জানায় । আবার পরমাণু চুক্তি নিয়ে বিরোধিতায় মুখর সিপিয়েম নন্দীগ্রামের ঘটনার পর হঠাতি উদারচিত্তে সরকারকে আইএইএতে চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে বলে । এসব কি নেহাতই কাকতালীয় ? সিপিয়েমের নেতাদের বিবৃতিতে জঙ্গিপনার প্রতিদ্বন্দ্বিতার পেছনে রাজ্য কমিটি বা পলিটব্যুরোতে ঢোকার চেষ্টা কতটা ? এসব জটিল অঙ্কের খেলা । যেমন জটিল নির্বাচনের রাজনীতি । আমাদের দেশে নৈতিকতার সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই বললেই চলে । নন্দীগ্রামে সিপিয়েমের সন্ত্রাসবাদ মানুষের সামনে স্পষ্টভাবে উপস্থিত । কিন্তু তাতে কী ? নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনে হারেননি । হারেননি জর্জ বুশও । সিপিয়েমের নির্বাচনী ভবিষ্যৎ সময়ই বলতে পারবে । হয়তো এর পরেও উন্নততম সিপিয়েম গদিতে বসবে । তবে এই মুহূর্তে পরপর সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-রেশন-রিজওয়ানুর-তসলিমা কাণ্ডে তিরিশ বছরের জাড্যে একটা দোলা লাগার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে ।

    বুদ্ধিজীবী

    সে দেখল মোমের রাজা,   সে দেখল মোমের সভাঘর
    ত গ'লে যাব, গ'লে যাব - সারাক্ষণ এই মাত্র ভয়

    সারাক্ষণ বেঁচে থাকছে বাহবা-নির্ভর
    পায়ের তলায় ভূমিক্ষয় ।

    কবি তো নিচুর চেয়ে আরো নিচু - তাই বলে মোমবাতির মতো
    তার কিন্তু মেরুদণ্ড নরম সুতোয় তৈরি নয় ।


    -'ধানতলার পরে' (জয় গোস্বামী)


    কিছু কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধিজীবী=বামপন্থী=সরকারপন্থী গোছের একটা সমীকরণ চালু ছিল । ভিয়েতনাম-ইরাক-গুজরাট নিয়ে যাঁরা হামেশাই প্রতিবাদে গর্জে উঠতেন, ঘরের পাশের সমস্যা নিয়ে তাঁদের ঔদাসীন্য দেখার মত । ১৪ই মার্চের পর এই সমীকরণে একটা বড় আলোড়ন উঠেছিল । নাট্য য়্য়াকাডেমি থেকে, বাংলা য়্য়াকাডেমি থেকে অনেকেই পদত্যাগ করেছিলেন । কবীর সুমনের টিভি অনুষ্ঠানে ফোন করে লাইন জ্যাম করে দিয়েছিলেন এক দর্শক । তার পরে অনুষ্ঠানের দর্শকরা সুমনের ওজস্বী বাগ্মিতার সাক্ষী হয়েছিলেন যেখানে তিনি এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করতে বললেন আমরা এক জাগ্রত জাতি । আরেক অনুষ্ঠানে জয় গোস্বামী মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন 'গ্যালিলেও' নাটকের সেই মুহূর্তের কথা যেখানে গণিতবিদ কার্ডিনাল বারবেরিনি আস্তে আস্তে পোপের পোশাক পরতে পরতে রূপান্তরিত হচ্ছেন এবং শেষে অত্যাচারের যন্ত্রগুলো সেনর গ্যালিলেওকে দেখাবার নির্দেশ দিচ্ছেন । মেট্রো সিনেমার সামনে, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে পরপর অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন শিল্পীরা । নন্দীগ্রাম নিয়ে গান বাঁধলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায় ।

    পরের ধাক্কাটা এল নভেম্বরে । নন্দীগ্রামে সিপিয়েমের তাণ্ডবের পর স্মিতমুখে যে চলচ্চিত্র উত্সবের উদ্বোধন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, সেই উত্সব বয়কট করলেন অপর্ণা সেন-ঋতুপর্ণ ঘোষ-সন্দীপ রায় সহ বেশ কিছু মানুষ । ১১ই নভেম্বর কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মী জড়ো হয়ে রবীন্দ্রসদনের দিকে যাচ্ছিলেন । পুলিশ প্রথমে পার্কস্ট্রিটের মুখে তাঁদের আটকায় । তাঁরা কারণ জানতে চান । কারণ নেই । এখানে কি ১৪৪ ধারা ? তাও নয় । কিন্তু আদেশ আছে । যে আদেশের জোরে মার্চে গুলি চলেছিল, নভেম্বরে পুলিশ ক্যাম্প উঠে গিয়েছিল । তাঁরা অতএব আলাদা আলাদা ভাবে য়্য়াকাডেমির সামনে পৌঁছলেন । ছিলেন প্রবীণ শুভাপ্রসন্ন, যাঁকে পরে বুদ্ধদেব গুহ 'আজকাল' পত্রিকায় 'রাসপুতিনের মত দাড়িওলা কাক-আঁকা শিল্পী' বলে ব্যঙ্গ করেছেন । ছিলেন জয় গোস্বামী কৌশিক সেন পল্লব কীর্তনিয়া শাঁওলী মিত্র । বিভিন্ন নাট্যদলের কর্মীরা ছিলেন । তাঁদের হাতে অস্ত্র ছিল না কিন্তু গলায় গান ছিল । নন্দীগ্রামের পুলিশ গুলিগোলা দেখে যতই থানার ভেতরে ঢুকে থাকুক, নিরস্ত্র অহিংস মানুষের ওপর কলকাতা পুলিশের দাপট প্রশ্নাতীত । রবীন্দ্রসঙ্গীত আর পল রবসনই বা তাদের কতক্ষণ ভালো লাগে ? অতএব ডিসি সাউথ জাভেদ শামিম হুকুম দিলেন - সুবে সে বহোৎ হো গয়া, উঠা লো শালেলোগকো । শুভাপ্রসন্নকে ধাক্কা দিল পুলিশ, পরমব্রত বিদীপ্তা সহ অনেকে গ্রেফতার হয়ে লালবাজার লকআপ ঘুরে এলেন । মুখ্যমন্ত্রী স্মিতমুখে বললেন - যারা যত বেশি অন্ধ, তারা তত বেশি চোখে দেখে আজ ।

    ১৪ই নভেম্বর একটা মিছিল হল । মিছিল এ রাজ্যে মোটামুটি রোজই হয় । হাততালি দেওয়ার জন্য ট্রেনে বাসে লোকজন আনা হয় । কিন্তু এই মিছিলে তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না । দলীয় রাজনীতির বাইরের কিছু মানুষ এই মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন । তাঁদের আমরা ছবি লেখা গান বা নাটকের সূত্রে চিনি । রাজনীতির লোকেদের এই মিছিলে যোগ দিতে বারণ করেছিলেন উদ্যোক্তারা । সবাইকে কিছুটা অবাক ক'রেই অনেক অরাজনৈতিক একলা মানুষের যোগে এ মিছিল মহামিছিলে পরিণত হ'ল । মিছিলে নন্দীগ্রামে শান্তি প্রার্থনার পাশাপাশি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় গণহত্যার জন্য দায়ী লোকেদের শাস্তির দাবি তোলা হ'ল ।

    কিন্তু এটাই একমাত্র ছবি নয় । বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একদল লোক সরকার, বিশেষ ক'রে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি তাঁদের আনুগত্য গর্বিতভাবে ঘোষণা ক'রে থাকেন । বছরের গোড়ায় বইমেলা যখন মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জায়গা পাল্টাল, তখনও সেই আনুগত্য প্রমাণ করতে এঁরা মোমবাতিমুখর হয়েছিলেন । কোন কোন কবি মনে করেন যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী কবিতার লাইন মুখস্থ ব'লে দিতে পারেন, অতএব তিনি অনন্য । শুনেছি অটলবিহারী বাজপেয়ীও কাব্যচর্চা করেন, তাঁকে নিয়ে এঁরা কতটা উচ্ছ্বসিত আমরা জানি না । তবে এ যুক্তি প্রসঙ্গে বলার - মুখ্যমন্ত্রী কবিতা বলবেন, ত্রক্রীড়ামন্ত্রী জলসা করবেন, পুলিশ সিএবি চালাবেন, শিক্ষক বোমা বাঁধবেন - এসব বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় অবশ্যই অনন্যতার নমুনা । তবে যে সব কবি মনে করেন কেউ কবিতা মুখস্থ বলতে পারলে সেই অনন্যতাগুণে তাঁর যা খুশি করার অধিকার জন্মায়, তাঁর সাত, থুড়ি, চোদ্দ খুন মাফ; বাংলার এক প্রাচীন কবি সম্ভবত: তাঁদের জন্যই খাঁচায় রেখে নানান সুরে নামতা শোনানোর বিধান দিয়েছিলেন ।

    এঁদের আরেকটি যুক্তি হ'ল - মুখ্যমন্ত্রী তো দু:খপ্রকাশ করেছেন । বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী প্রায়ই দু:খপ্রকাশ ও ক্ষমাপ্রার্থনা করেন । এটা তাঁর নিজস্ব মুদ্রাদোষ । কিন্তু নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গে তিনি কোথায় দু:খপ্রকাশ করলেন ? দলের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের সভায় মাথায় আঙুল ঠেকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে দায় নিয়ে হাততালি কুড়োনোর মধ্যে প্রকাশ অবশ্যই আছে, কিন্তু দু:খের কোন লক্ষণ নেই । থাকলে গণহত্যায় নিহত-আহত-ধর্ষিতাদের ক্ষতিপুরণ দেবার আদালত-নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরিয়ে যেত না । দোষীদের শাস্তি হ'ত । সত্যিই নিজেকে দায়ী ব'লে মানলে তিনি অনেক আগেই গদি ছেড়ে আদালতে আত্মসমর্পণ ক'রে শাস্তিপ্রার্থনা করতে পারতেন । নন্দীগ্রামে যাওয়ার সাহস না থাকলেও সেই পুরুষোচিত সিদ্ধান্তের সুযোগ তাঁর ছিল । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নিভৃতে কষ্ট পাচ্ছেন । কথাটা শুনতে ভালো, তবে এই খবর আমাদের জানানোর পাশাপাশি সুনীল মুখ্যমন্ত্রীকেও জানালে ভালো করতেন ।

    তৃতীয় যুক্তি - মুখ্যমন্ত্রী তো আগেই বলেছেন ওখানে কেমিক্যাল হাব হবে না, তবে আর অশান্তি কেন ? ঠিক, গণহত্যার পরে মুখ্যমন্ত্রী এ কথা বলেছেন । তার আগে অবধি তিনি একটি 'মানুষ না চাইলে'-র 'ইতি গজ' ঝুলিয়ে রেখেছিলেন । চোদ্দই মার্চের পর তিনি শেষপর্যন্ত পিছু হটলেন । কিন্তু তার অনেক পরেও সালিম মহাকরণে দাঁড়িয়ে বলে গেছেন জায়গা বদলের কথা তাঁরা জানেন না । মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন জমি অধিগ্রহণের নোটিশ (যার অস্তিত্বই প্রথমে তিনি অস্বীকার করেছিলেন, ওটা নাকি বিরোধীদের ছড়ানো গুজব) ছিঁড়ে ফেলতে । অর্থাৎ আমাদের অপছন্দের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বাতিল করার রাস্তা এটাই - সংশ্লিষ্ট কাগজ ছিঁড়ে ফেলা । রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের এরকম বালখিল্য ধারণা সম্পর্কে কী বলব আমরা জানি না । ধারাবাহিক মিথ্যাচারের পরেও বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ মনে করেন মুখ্যমন্ত্রীর উপর বিশ্বাস হারানো পাপ । এবং এই পাপ যাঁরা করছেন, সেই অপর্ণা সেন ব্রাত্য বসু সুমন মুখোপাধ্যায় পরমব্রত বিদীপ্তাদের মূল উদ্দেশ্য যে ছোট পর্দায় মুখ দেখানো - সেটাও তাঁরা আপন প্রতিভাবলে আবিষ্কার করেছেন ।

    যাই হোক, ১৪ই নভেম্বরের মিছিলের দেখাদেখি এই বুদ্ধিজীবীরা ১৫ই নভেম্বর একটা পাল্টা মিছিল করলেন । সরকারপন্থী এই মিছিলে সরকারের তরফ থেকে সুভাষ চক্রবর্তী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রমুখ যোগ দিলেন । রীতিমাফিক বাসেটাসে লোক আনা হ'ল । মিঠুনকে দেখতেও অনেকে এসেছিলেন । একটা লক্ষণীয় বিষয় - এই মিছিলে অরুণ মুখোপাধ্যায় বিপ্লবকেতন চক্রবর্তীর মত যাঁরা হাঁটলেন, তাঁদের অনেকের সন্ততিই আগের দিনের মিছিলে যোগ দিয়েছেন । এটা হয়তো নতুন প্রজন্মের মনোভাবের একটা ইঙ্গিত ।

    মিছিলের বাইরেও অনেক বুদ্ধিজীবী নিজের নিজের মত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন । দিল্লির বামপন্থী ঐতিহাসিক সুমিত সরকার জানিয়েছেন নিজেকে বামপন্থী ব'লে পরিচয় দিতে তাঁর লজ্জা করছে । চলচ্চিত্র উত্সবে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট য়্য়াওয়ার্ড প্রত্যাখ্যান করেছেন মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় । উদ্বেগ জানিয়েছেন নোয়াম চমস্কি । ধর্মতলা মঞ্চে অনশনে বসেছেন অশীতিপর অম্লান দত্ত ।

    সমস্ত ক্ষেত্রের মত বুদ্ধিজীবী জগতেও সরকারি সিলমোহরের একটা মহিমা আছে । সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে সেই মহিমা থেকে বঞ্চিত হ'তে হয় । ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় আন্তর্জাতিক নারী চলচ্চিত্র উত্সব হ'ল । কথা ছিল অপর্ণা সেন তার উদ্বোধন করবেন । উত্সবের কয়েকদিন আগে আলিমুদ্দিনের তরফে সুভাষ চক্রবর্তী উদ্যোক্তাদের প্রস্তাব দিলেন অপর্ণা সেনের জায়গায় অনিন্দিতা সর্বাধিকারীকে দিয়ে উদ্বোধন করানোর । উদ্যোক্তারা হতবাক হয়ে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন । মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন । তবে সুভাষবাবু ত্রক্রীড়ামন্ত্রী । তিনি গ্যারি কার্স্টেনের জায়গায় অনিন্দিতার নাম প্রস্তাব করলে আমরা আরো আনন্দ পেতাম ।

    আমরা

    ওই ওরা কোল থেকে শিশু কেড়ে
    মাথা মুঠো করে
    দু'আড়াই প্যাঁচে ঘাড় ভেঙে
    নড়বড়ে পুতুলটিকে ছুঁড়ে দিল নদীর ভিতরে
    তুমিও দাঁড়িয়ে দেখলে
    আমিও দেখলাম
    এরপর কিবা লাভ কারো পদত্যাগ দাবি করে ?

    - জয় গোস্বামী

    আমার মেয়ের বয়স এখন দুই । এই বয়সের একটি মেয়ে পায়েল - সিঙ্গুরের পুলিশ তার নামে বেআইনি অস্ত্র রাখার অভিযোগ এনেছিল । আরেকটি মেয়ে, বয়সে অনেক বড়, তাপসী মালিক - তার হত্যাবার্ষিকী পেরোল এই সেদিন । বিনয় কোঙার স্বভাবোচিত বিদ্রূপে জানালেন তার বাবা এখন মেয়েকে ভাঙিয়ে খাচ্ছেন ।

    ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌলতে ১৪ই মার্চ আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে । নভেম্বরের তাণ্ডবের পরে কেউ কেউ সদর্পে জানিয়েছেন এটাই শান্তির পথ । হবেও বা । আমাদের তেমন দিব্যদৃষ্টি নেই । সাদা চোখে দেখছি স্বজনহারানো ভিটেহারানো মানুষের বিলাপে বাতাস ভারী হয়ে আছে । দেখছি শক্তির দম্ভ । অত্যাচারের বিভিন্ন মুখ । দেখতে দেখতে আমরা সন্তানকে একটু বেশী জোরে আঁকড়ে ধরেছি । যা দেখছি তা যে শুধু টিভির পর্দায় থেমে থাকবে, আমাদের ঘরে ঢুকে পড়বে না - এমন কোন ভরসার কারণ দেখছি না । আমার মেয়ের যদি ঐ গতি হয়, আমার কি সাহস হবে অভিযোগ করার ? কার কাছে কার বিরুদ্ধে অভিযোগ ? টেবিলে টেবিলে গমগম করছে ক্ষমতার স্বর - উই আর প্রাউড অফ দেম । ধর্ষণ ও হত্যায় পারঙ্গম কর্মীরা আমাদের ঘিরে জাল গুটিয়ে আনছে । আমাদের করের অর্থে প্রতিপালিত মন্ত্রীসান্ত্রীরা তাদের উত্সাহ দিতে তত্পর । আমাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আজ কাদের ? আমরা জানি না ।

    'গ্যালিলেও' নাটকে একটা দৃশ্য আছে । গ্যালিলেও যখন চার্চের কাছে নতিস্বীকার ক'রে তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত ভুল ঘোষণা করলেন, তাঁর প্রিয় শিষ্য আন্দ্রেয়া ধিক্কার দিয়ে বলেছিল - "দুর্ভাগা সেই দেশ যে বীরপ্রসবিনী নয় ।" তার উত্তরে মাথা নেড়ে গ্যালিলেও সেই অমোঘ উক্তি করেছিলেন - "না, দুর্ভাগা সেই দেশ যেখানে শুধু বীরেরই প্রয়োজন হয় ।" এখন সেই সংলাপ মনে পড়ে । মনে পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর ভুল-উদ্ধৃত জীবনানন্দের পরবর্তী পংক্তিগুলি । আমরা কী করব ? কুর্নিশ ক'রে নিরাপত্তা প্রার্থনা করব ? বালিতে মুখ গুঁজে নিরপেক্ষ (হত্যার সামনে নিরপেক্ষতা মানে হত্যার বিরোধিতা না করা । কিন্তু তা হত্যাকারীর পক্ষেই যায় ।) থাকব যতদিন না আমার পাশের লোকটির পর আমার ঘাড়ে থাবা এসে পডে ?

    নাকি আমরা চেষ্টা করব আমাদের বাড়িগুলোকে বধ্যভূমিতে পরিণত হ'তে না দিতে ? ক্ষমতামত্ততার চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট ক'রে বলব এই পথ আমরা মানছি না ? ঠিক, এই পরিস্থিতিতে সেটা কঠিন । কোন বিরোধী স্বর সহ্য করার অবস্থায় শাসক বা তাদের অনুগামীরা নেই । ফলে রাজরোষের কোপে পড়াই স্বাভাবিক । এবং এই হীরকরাজ্যে মগজধোলাই ছাড়া অনেক প্রত্যক্ষ শাস্তিও চালু আছে । কিন্তু সমাজের সর্বস্তর থেকে এই প্রতিবাদ তুলে ধরা ছাড়া আর কোন উপায়ও তো নেই । তাতে কিছু পাল্টাবে ? জানি না । কিন্তু সেটা না করলে যে এ জিনিস চলতে চলতে আমাদের ছোট ছোট ঘরের দরজায় কড়া নাড়বে তা নিয়ে সংশয়ের জায়গা নেই । রাজনৈতিক দল বা অন্য কারো ভরসায় ব'সে থাকার বিলাসিতা না দেখিয়ে আমাদের সামাজিক পরিসরেই যার যেমন সাধ্য উদ্যোগ নিয়ে দেখতে হবে তাদের যোগফলে এই অবস্থা পাল্টানো যায় কিনা ।

    কিন্তু এসব কাজের কথা । ভাবনাচিন্তার, পরিকল্পনার কথা । ভবিষ্যতের কথা । আমাদের পথে তারও আগে দাঁড়িয়ে আছে শোক । এমন সব ক্ষতস্থান যা মেরামত করা যায় না । ছাই উড়ছে । কবর থেকে উঠে আসছে মৃতদেহের মিছিল । পোড়া মাংসের গন্ধ । আমরা হেঁটে যাচ্ছি । পতাকা অর্ধনমিত ।



    অলংকরণ (Artwork) : রাজর্ষি দেবনাথ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments