ফুল-মালা আর সুগন্ধি ধূপে বছরের নির্দিষ্ট দিনে স্মরণ করবার প্রথার বাইরে যে রবীন্দ্রনাথ তিনি আমাদের অনন্ত আত্মবিশ্বাসের আকর। প্রতিটি মানুষের মধ্যে নিরন্তর চলছে অস্তিত্বের লড়াই। চোরাশিকারিরা মানবিকতা হরণ করে মানুষকে পশুর গোত্রে ফেলবার ষড়যন্ত্রে যখন অতি সক্রিয়, রবীন্দ্রনাথ তখন আমাদের মানুষ হয়ে লড়াই করবার প্রেরণা জোগান। ঈশ্বর মানে তো শুভচেতনা। রবীন্দ্রনাথ মানুষের ভেতরের সেই চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করেন। সমস্ত অশুভ টানকে জয় করবার শক্তি দেন। সমাজে মেয়েদের অবস্থান বর্তমানে কী? এখনও অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের লালসা আর বংশ-বহনের ধারক সে। কিন্তু সম্পর্কের প্রয়োজন মিটিয়ে দেবার পরও নারীর যে নারীত্বেই পূর্ণতা; সে দাসী নয়, দেবীও নয়; পুরুষ যদি তাকে সমান আসন দিয়ে পাশে রাখতে পারে তবেই নারীত্বের পূর্ণ মর্যাদা দিতে পারবে। এজন্য মেয়েদেরও সচেতন হতে হবে। পুরুষের সঙ্গে তার মিলন ধর্মের মিলন। ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ বলছেন — ‘স্বামী হবে এঞ্জিনিয়ার আর স্ত্রী হবে কোটনা-কুটনি, এটা মানবধর্মশাস্ত্রে নিষিদ্ধ। ঘরে ঘরে দেখতে পাই দুই আলাদা আলাদা জাতে গাঁটছড়া বাঁধা, আমি জাত মিলিয়ে নিচ্ছি। পতিব্রতা স্ত্রী চাও যদি, আগে ব্রতের মিল করাও।’ কুরূপা চিত্রাঙ্গদা যেদিন সুরূপা হয়ে উঠেছিলেন কামদেবের বরে; পঞ্চশরের জয় ঘোষণা হয়েছিল। কিন্তু রূপেরও ক্লান্তি আছে। সাময়িক রূপাবিষ্ট অর্জুন তাই শেষপর্যন্ত কুরূপা চিত্রাঙ্গদার গুণের রূপেই বশ / মুগ্ধ হয়েছিলেন। রূপের পসরা নয়, নারী প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী, সর্বোপরি সম্পূর্ণ মানুষ। লিঙ্গভেদে না গিয়ে প্রতিটি মানুষকে মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত করলে বোধহয় সমাজ নিরীক্ষণের মানসিক জট কিছুটা কাটে। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে তাহলে প্রেমের অবস্থান কী হবে? ওড়বার আকাশ আর জিরোবার বাসা দুই-ই আমাদের জীবনে অবশ্য প্রয়োজন। মনের ডানায় ভর করে প্রেমের রাজ্যে রাজা বা সম্রাজ্ঞী আমরা প্রত্যেকেই হতে চাই। কিন্তু সংসার সেই কষ্টিপাথর যেখানে যাচাই হবেই প্রেমের মূল্য বা জীবনের মূল্য। ‘তুমি’ ‘আমি’র মাঝখানে ‘সে’ ‘তারা’ ‘ওরা’ ভিড় জমাবেই। সংসারের চাপান-উতোরে প্রেম তখন জিরোবার নীড়। এই যে অসীম আকাশ আর সীমায়িত নীড় একই পাত্রে সন্ধান করলাম আমরা, সত্যিই কি তেমন মধুসূদনদাদার ভাণ্ড পাওয়া যায়? ছড়িয়ে পড়ে আমাদের আরও ভালোবেসে যাওয়ার তীব্র বাসনা। এ তো নিজেকেই উজাড় করতে চাওয়া। ভালোবেসেই ভালোবাসাকে উপলব্ধি। তবে কি সেই অনন্ত ভাণ্ডার আমাদের প্রত্যেকেরই মধ্যে? ‘আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কি’, ‘প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’, ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না’ — এই সমস্ত অজড় বিন্যাসে আমরা বুঝি নিজেকেই খুঁজে পাই। ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে’— এই ‘আমি’ কি নিজের অবস্থান খুঁজে নিচ্ছে না? আর প্রেম! সে-ও কখন তার পার্থিব সন্ধান পেরিয়ে পৌঁছে গেছে অপার্থিবলোকে। শ্রীচৈতন্যদেবের রাধা-রূপে কৃষ্ণময়তার কথা যেন মনে পড়ে। এই তো যথার্থ আত্ম-সন্ধান। কিন্তু জীবন তো আর সহজ সুরে বাজে না সারাবেলা। তার পাড় ভাঙা আছে, প্লাবন আছে, খরাও আছে, আছে প্রাত্যহিকের খুঁটিনাটি। কেমন করে সামলে নেব নিজেকে? সমস্যার ঢেউ-এর সঙ্গে খেলে যেতে হবে নিয়ত, কারণ ‘পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়/ আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী এই শুধু মোর দায়।’ দায় আরেকটু থেকে যায় মনের ঘরকে নিত্য ধোওয়া-মোছার, কারণ ‘কী জানি সে আসবে কবে’! সংস্কার মুক্ত মন আর শুভবোধকে আশ্রয় করলেই তা সম্ভব। মা আনন্দময়ী বিধর্মী শিশুকে মায়ের স্নেহে প্রতিপালন করেছেন ‘গোরা’ উপন্যাসে। গোরা বড়ো হয়ে গোঁড়াভাবে আঁকড়ে ধরেছে একটি ধর্মকে— রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন জীবনের মূল্যবান সময়, নিষ্ঠা, শক্তি কি তুচ্ছ বিষয়ে ব্যয় করি/ করছি নিয়ত আমরা। কারণ যে দেশকে নিয়ে গর্ব করি, সেই ভারতবর্ষেরই প্রতিরূপ আনন্দময়ী। তাঁর কাছে ধর্ম মানে মানবধর্ম। ভারত নানা জাতি নানা ধর্মের মিলনতীর্থ। নানা সংস্কৃতির কোলাজ ভারতীয় সংস্কৃতি। এখানে ক্ষুদ্র ধর্মবোধ-ই তাই বিধর্মী। ‘সবাই রাজা’র দেশে আরও রঙিন হোক মিলনক্ষেত্র। ‘রাজার রাজা’র দেখা তবেই তো পাওয়া যাবে।