• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Buddhadeva Bose | no category
    Share
  • বুদ্ধদেব বসুঃ স্বয়ং প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানের স্রষ্টা : সুমিতা চক্রবর্তী

    Bengali Article on Buddhadeva Bose by Sumita Chakraborty (Parabaas - Buddhadeva Bose Section)

    বুদ্ধদেব বসু : স্বয়ং প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানের স্রষ্টা

    সুমিতা চক্রবর্তী


    প্রতিষ্ঠান বলি কাকে ? দুটি ইংরেজি শব্দের বাংলা অনুবাদ রূপে `প্রতিষ্ঠান' শব্দটি প্রচলিত । একটি হল `এসট্যাবলিশমেন্ট' (establishment) , অপরটি হল `ইন্স্টিটিউশন' (institution) । `এসট্যাবলিশমেন্ট' শব্দটিতে দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত কোনো নির্মাণ বোঝায় । শব্দটি ব্যবহৃত হতে পারে কোনো ভবন, কোনো সংস্থা, অথবা কোনো ব্যক্তির কর্ম-জীবন সম্পর্কে । `এসট্যাবলিশমেন্ট' শব্দটির সঙ্গে যে-প্রাতিষ্ঠানিকতার সংযোগ সেখানে বিধি-নিষেধ-বিধানের কিছু নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা প্রত্যাশিত । সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীনতা কিছুটা খর্ব হতে পারে অনেক সময়ে । শব্দটির এই ব্যঞ্জনা থেকেই `প্রাতিষ্ঠানিকতার নিয়মে বাঁধা', `প্রাতিষ্ঠানিকতা ভাঙা' - ইত্যাদি অভিব্যক্তির জন্ম ।

    `প্রতিষ্ঠান' শব্দটি যেখানে `ইন্স্টিটিউশন্‌'-এর বাংলা প্রতিশব্দ সেখানেও অনেকক্ষেত্রেই আগের অর্থগুলিই বোঝায় । যে-কোনো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়; আবার পরিবার থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা; যে-কোনো কার্যালয় - সবই ইন্সটিটিউশন যেখানে নির্দিষ্ট বিধি-বিধান মান্য করাই সঙ্গত ।

    তবুও `ইন্সটিটিউশন' শব্দটির ব্যঞ্জনা এই বিধি-শাসিত প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরেও খানিকটা প্রসারিত হয় । আমরা যখন বলি - `মানুষটি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান' - তখন এই প্রসারিত অর্থের অনুভবই এসে যায় আমাদের মনের মধ্যে । `প্রতিষ্ঠান' এমন এক সমবায়িকতা যেখানে একাধিক সমমনস্ক মানুষ একত্র হয়ে এমন কোনো কর্ম-প্রবাহের সৃষ্টি করেন যা অনেককে আকর্ষণ করে, অনেকের সহায়তা করে, অনেকের মনের ভিতরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলে । সেই কর্মপ্রয়াস এমন একটি প্রতিষ্ঠা অর্জন করে - যিনি বা যাঁরা প্রথম স্থাপয়িতা - তাঁদের সময়ের পরেও তার সুফল-সমূহ সমৃদ্ধ করে অনেক মানুষকে । এই অর্থেই আমরা কোনো কোনো মানুষকে `স্বয়ং প্রতিষ্ঠান' বলে সম্মান জানাই । হয়তো সেই মানুষটি কোনো সঙ্ঘই গড়ে তোলেননি । নিজের মনেই চর্চা করে গেছেন কোনো বিষয়ের । কিন্তু তাঁর কাজের বিস্তার এতটাই যে, অনেকে তাঁর কাছে আসেন; তাঁর উপদেশ-নির্দেশ পেয়ে উপকৃত হন; তাঁর আদর্শ সামনেরেখে নিজেরা কাজ করবার প্রেরণা পান । শিক্ষকদের মধ্যে এমন মানুষ এখনও কিছু কিছু দেখা যায় । এই অর্থেই আমরা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, কিংবা সত্যজিৎ রায়, পি. টি. উষা-কে বলতে পারি স্বয়ং প্রতিষ্ঠান । সমবায়ী প্রয়াসে গড়ে ওঠা এই জাতীয় প্রতিষ্ঠান সবসময়েই খুব বড়ো মাপের না হতেও পারে । তা হতে পারে স্বল্পজীবী একটি পত্রিকা - যা পরবর্তী কালে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন দিক থেকে । অথবা তা হতে পারে নিতান্তই একটি আড্ডা - যেখান থেকে মনের রসদ সংগ্রহ করেছিলেন অনেক সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিক মানুষ । সেই আড্ডার প্রাতিষ্ঠানিক মূল্য সমকালে হয়তো বোঝা যায়নি ততটা । পরবর্তী সময়ে বহু মানুষের স্মৃতিকথায় যখন তাঁরা তাঁদের মন ওঅ মননের প্রাপ্তির কথা লিখেছেন তখন অনুভূত হয়েছে সেই আড্ডার গুরুত্ব । তেমন একটি আড্ডা ছিল `পরিচয়' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে হীরেন্দ্র নাথ দত্তের হাতিবাগানের মূর্তি-পুতুল বসানো, পাঁচিল ঘেরা বাড়িতে বিশ শতকের চতুর্থ দশকে । সেই আড্ডার কেন্দ্রে ছিলেন হীরেন্দ্রনাথের পুত্র ও `পরিচয়' সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত । পরে সেই আড্ডার বিবরণ দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে স্বতন্ত্র গ্রন্থ `পরিচয়ের কুড়ি বছর' - লিখেছেন হিরণকুমার সান্যাল । `শনিবারের চিঠি' পত্রিকাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল আর একটি আড্ডা । তার কিছু কিছু তির্যক-সরস বিবরণ পাওয়া যেত পত্রিকার পৃষ্ঠাতেই । সেই আড্ডায় বিভিন্ন ধরণের মত ও পথের মানুষেরা এসে মিলে ছিলেন । যেমন - মোহিতলাল মজুমদার, অচ্যুত গোস্বামী, গোপাল হালদার, নীরদচন্দ্র চৌধুরী । `কল্লোল' পত্রিকা আর `কবিতা' পত্রিকার আড্ডার বর্ণনাও বহু সূত্রে আজ আমরা জানি । তারও আগে ছিল `ভারতী' এবং `সবুজপত্র' পত্রিকার আড্ডা ।

    কোনো পত্রিকা নয়, একজন মানুষকে ঘিরেও গড়ে উঠতে পারে বহুজনের সমাগম যেখান থেকে জ্ঞান-মনন-সংস্কৃতি চর্চার আলো-হাওয়া ছড়িয়ে যায় অনেক মানুষের মনে । সেইসব মানুষ হয়ে ওঠেন প্রতিষ্ঠান ও তাঁদের ঘিরে সেই সমাবেশও প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পেয়ে যায় অনেক সুধীজনের বাড়িতেই এমন আড্ডা আছে এবং ছিল । বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ-পঞ্চম দশকে রমেশচন্দ্র সেনের কবিরাজি দপ্তরে এভাবেই গড়ে উঠেছিল `সাহিত্য সেবক সমিতি' । বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনের এক টুকরো ইতিহাস ধরা আছে সেখানেও ।

    যে-কোনো প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাকেই আমরা প্রতিষ্ঠান বলতে পারি । আবার একজন ব্যক্তিও আড্ডা ব্যতিরেকেও গণ্য হতে পারেন প্রতিষ্ঠান রূপে । উদাহরণ স্বরূপ নাম করা যায় অভিধাণ প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজ্ঞানী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর । তাঁরা যে-সব কাজ করেছেন সে-কাজ অনেকটা একাই করেছেন; প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে নয় । কিন্তু তাঁদের কাজের চরিত্র এমনভাবে সময়োপযোগী ও জনমুখী ছিল যার সুফল আমরা দীর্ঘকাল এবং আজও ভোগ করে চলেছি । এভাবেই ঐতিহ্যের অন্তর্গত হয়ে যাওয়া যে-কোনো প্রতিষ্ঠানের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ । রামমোহন, বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের কর্মপ্রয়াসের বিবরণ বাহুল্যবোধে পেশ করা থেকে বিরত রইলাম ।

    বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে তরুণ বয়স থেকেই প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার লক্ষণ বিদ্যমান ছিল । যদিও স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন মাতৃহীন, পিতৃসঙ্গ-বঞ্চিত, মাতামহের স্নেহানুশাসন-লালিত বুদ্ধদেব নিজের লেখাপড়ার জগতে কিছুটা একাই বাস করতেন; তবু তাঁর মধ্যে একাগ্র মেধা-উজ্জ্বলতা এবং শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কিত মাননিক নিষ্ঠা বিদ্যানুরাগী, বুদ্ধিমান ছাত্র ও কিশোর-তরুণদের আকর্ষণ করত । কোনো কাজ করবার কথা যখন ভেবেছেন, কাজে হাত দিয়েছেন তখন সংখ্যায় অল্প হলেও অনুরাগী অনুগামীরা তাঁর সঙ্গে থেকেছেন । বুদ্ধদেবের নিজের স্মৃতিকথাগুলি থেকে এবং তাঁর বন্ধু-বান্ধব, পত্নী, পুত্রকন্যা, ছাত্র-ছাত্রীদের স্মৃতিচারণ থেকেও অনুভব করা যায় যে, অনেককে মুগ্ধ করে রাখবার এবং আকৃষ্ট করবার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল তাঁর । চারিদিকে থাকা মানুষদের কেন্দ্রে বিরাজ করতেন তিনি । এ-কোনো সচেতন কৌশল নয়, এই আকর্ষন জন্ম নিত তাঁর ব্যক্তিত্বের দ্যুতি থেকে । যাঁরা ব্যক্তি হয়েও প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন তাঁদের চরিত্রে এই বৈশিষ্ট্য থাকেই । সে-জন্য ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ- এর বাড়িটি হয়ে উঠেছিল `কবিতা-ভবন' নামের প্রতিষ্ঠান । কিন্তু সে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনা । তারও অনেক আগে থেকে বুদ্ধদেব বসু যেখানে থাকেন সেখানেই তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠে সমাবেশ । মন-মনন-হৃদয় জুড়ে ঘনীভূত হয় সাহিত্যপ্রেমের বাতাবরণ ।

    বুদ্ধদেব বসু প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে । তাঁর প্রতিষ্ঠান-মনস্কতার অন্যতম নির্ণায়ক পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করবার ব্যগ্রতা । পত্রিকাই সেই মঞ্চ - যা একজন সম্পাদনা করলেও এবং লেখকেরা একা একা লিখলেও তা সকলের উদ্দেশ্যে নিবেদিত । পাঠক-কুলের হৃদয় জয়ের লক্ষ্যে সচেতন । বুদ্ধদেবের কাছে এই হৃদয় জয় কখনও সস্তা জনপ্রিয়তা ছিল না ।

    স্কুলের বালক যখন ছিলেন, তখন থেকেই বুদ্ধদেব বসু পত্রিকা-র প্রতি ভালোবাসায় জড়িয়েছিলেন । স্কুল-ছাত্রদের মধ্যে হাতে লেখা পত্রিকা করবার রেওয়াজ ছিল তখন । `পতাকা' (বুদ্ধদেব বসু `আমার ছেলেবেলা'-য় লিখেছেন - "বিকাশ অথবা পতাকা নামে একটি হাতে লেখা মাসিকপত্রের আমি সম্পাদক, প্রধান লেখক ও লিপিকার; ...") আর `ক্ষণিকা' নামের দুটি স্বল্পস্থায়ী পত্রিকা-প্রয়াসের পালা সাঙ্গ করে ১৯২৫-এ তিনি বার করলেন হাতে লেখা `প্রগতি' পত্রিকা । সঙ্গী ছিলেন বন্ধু টুনু অর্থাৎ পরবর্তীকালের কবি, অধ্যাপক, গবেষক অজিত দত্ত । কাছাকাছি ছিলেন আরও কেউ কেউ - অনিল ভট্টাচার্য, সুধীশ ঘটক, ক্ষিতীন্দ্র সাহা, প্রভুচরণ গুহঠাকুরতা, ভৃগু গুহঠাকুরতা, হিমাংশু সোম, প্রতাপ রায়, সোমেন ঘোষ, পরিমল রায়, অমলেন্দু বসু, মন্মথ ঘোষ ।

    এই বন্ধুরা সকলেই অবশ্য ঠিক একই সময়ে জমায়েত হননি । হাতে লেখা `প্রগতি' মুদ্রিত বর্ণমালায় পূর্ণতর রূপ গ্রহণ করেছিল ১৯২৭- এ । সে-বছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে কুড়ি টাকা বৃত্তি পেয়ে `প্রগতি'-কে পুরোদস্তুর মাসিক পত্রিকা রূপে প্রতিষ্ঠা করলেন বুদ্ধদেব । বুদ্ধদেব বসু স্থাপিত প্রথম প্রতিষ্ঠান এই `প্রগতি' পত্রিকা - প্রথম প্রকাশ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় অর্থাৎ জুন-জুলাই ১৯২৭ ।

    একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষন সম-মনোভাব-সম্পন্ন কয়েকজন - অন্তত দু-জন মানুষের সংযোগ; এবং লক্ষ্য কোনো এক পরিকল্পনার পথ ধরে অনেকের কাছে পৌঁছনো, আরও অনেককে কাছে টানা । `প্রগতি' প্রথম থেকেই এই লক্ষ্য পূরণ করেছিল । মাসে একশো টাকা হলে একটি কাগজ বার করা যায় । দশজন সহমর্মী পেতে অসুবিধা হল না যাঁরা মাসে দশ টাকা করে দেবেন । দ্রুত একত্র হলেন তরুণ লেখক-গোষ্ঠী । তার পর দু বছরের একটু বেশি সময় চলেছিল এই পত্রিকা । শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে (১৯২৯)।

    একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনিবার্যভাবে না হলেও একটি স্থানেরও আলগা একটা যোগ থাকে । একটি কোনো বাড়িতে ও ঘরে, চা-এর দোকানে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে, কোনো ক্লাব-এ সদস্যদের মিলিত হবার একটা জায়গা থাকলে প্রতিষ্ঠান বেশ জমাট হয় । `প্রগতি' পত্রিকার জন্ম ও জায়মানতায় তেমন এক স্থানেরও ভূমিকা ছিল । পুরানা পল্টন -এর টিনের ঘর এই সূত্রেই বিখ্যাত হয়ে আছে ।

    বুদ্ধদেবের মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯২৪- এ । মাতামহী স্বর্ণবালা কিছুকাল তাঁর ভাই-এর আশ্রয়ে থেকে ঢাকার `পুরাণা পল্টন' অঞ্চলে একটি বাড়ি তুললেন, ইটের পাঁচিল ঘেরা লম্বা একটি টিনের ঘর । মাটির মেঝে এবং লম্বা ঘরটি তিনটি পার্টিশনে তিনটি ঘরে রূপান্তরিত । বুদ্ধদেবের অংশে মাটির উপর সিমেন্ট এর প্রলেপ । প্রকৃতি-নিবিড় সেই বাসস্থান । তুলসীমঞ্চ, অপরাজিতা আর লজ্জাবতীর লতা, স্থলপদ্ম একটু দূরে বটগাছে পাখির ডাক । খোলা মাঠ, খোলা আকাশ, মেঘ-সূর্য-উধাও হাওয়া । টিনের ঘর দিনে উনুনের মতো গরম; রাতে বরফের বাক্স । এই টিনের ঘর ও `প্রগতি' পত্রিকা বুদ্ধদেব বসুর স্থাপিত প্রথম প্রতিষ্ঠান - ঠিকানা ৪৭ নং পুরানা পল্টন । অনেক বন্ধু, প্রচুর আড্ডা; বাংলা ও পাশ্চাত্য সাহিত্য নিয়ে ভাব-বিনিময়, মুগ্ধতা ভাগ করে নেওয়া, বিতর্ক । সেই সঙ্গে নিজেদের লেখার চর্চা । `প্রগতি' পত্রিকার কার্যালয় হয়ে উঠেছিল সেই টিনের ঘর ।

    `প্রগতি' পত্রিকাকে কেন বলছি একটি প্রতিষ্ঠান - তা একটু ভেবে দেখা যেতে পারে । `প্রগতি'-র ঠিক আগেই প্রকাশিত হয়েছে `কল্লোল' (১৯২৩-১৯২৯), `শনিবারের চিঠি' (প্রথম প্রকাশ ১৯২৪), `উত্তরা' (প্রথম প্রকাশ ১৯২৫) এবং `প্রগতি' সঙ্গেই প্রকাশ পেয়েছে `বিচিত্রা' । কিন্তু এই পত্রিকাগুলিতে নতুন লেখকের আবির্ভাব এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির স্বীকরণ ঘটলেও প্রথাসিদ্ধ পরম্পরাকে অস্বীকার করবার শৈল্পিক ঔদ্ধত্য ছিল না । সব ধরনের লেখাকেই স্থান দিতেন তাঁরা । রবীন্দ্রনাথের সম্মানিত উপস্থিতি ছিল অধিকাংশ পত্রিকায় । `শনিবারের চিঠি'-র ভিন্নতার মূলে ছিল রক্ষণশীলতার প্রতি আনুগত্য । আধুনিকেরা থাকতেন প্রথাসিদ্ধ সাহিত্যধারণার সঙ্গে সহাবস্থানে । কিন্তু `প্রগতি'-র সম্পাদকের নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর আধুনিকতার যে লক্ষণ-সমূহ পাশ্চত্য সাহিত্যে পরিস্ফুট তারই সমর্থনে দৃঢ় মত প্রকাশ করা । পত্রিকা চালাবার প্রয়োজনে মাঝে মাঝেই অবশ্য কিছুটা প্রথাসিদ্ধ ধরনের লেখাও নিতে হয়েছে তাঁকে । তবু তাঁর সচেতন প্রয়াস স্পষ্টতই নব্য আধুনিক ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করবার দিকে সক্রিয় ছিল সর্বদাই ।

    `প্রগতি'-তে `মাসিকী' নামে একটি বিভাগ থাকত । বুদ্ধদেব প্রায়শই নিজের মন্তব্য লিখতেন সেখানে । এরকম একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি -

    "অধুনা বাংলা সাহিত্যে একটি পরম বিস্ময়কর ও অভিনব
    movement শুরু হয়েছে, একথা আমরা বিশ্বাস করি, এবং সেই নব-রসের আস্বাদ বাংলার প্রত্যেক শিক্ষিত সন্তানকে গ্রহণ করাবার ভার প্রগতি নিয়েছে ।"

    (মাসিকী, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ) এই ভার কেবল নেওয়া নয়, সে দায়িত্ব পালনে সফলও হয়েছিল এই স্বল্পস্থায়ী পত্রিকাটি । এই পত্রিকার পৃষ্ঠাতেই জীবনানন্দের আধুনিকতার স্বরূপ চিনিয়ে দেবার চেষ্টায় পর পর তাঁর কবিতা ছেপেছিলেন বুদ্ধদেব । জীবনানন্দের কবিতা ব্যাখ্যা করে, তাঁর নবীনত্বকে সমর্থন করে লিখেছিলেন একাধিক প্রবন্ধ (`কালের পুতুল' গ্রন্থে সংকলিত)।

    `প্রগতি'-র পৃষ্ঠায় জোর দিয়ে রবীন্দ্র-অনুকরণের বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন বুদ্ধদেব । এ-বিষয়ে `প্রগতি' পত্রিকা সম্পর্কে তাঁর নিজের উক্তি -

    "রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুখোমুখি একটি অতি-আবশ্যক বোঝাপড়ার চেষ্টাও সেখানেই আমরা প্রথম করেছিলাম । বোঝাপড়া - মানে, এমন কোনো ব্যবস্থা, কিংবা বলা যাক আমাদের দিক থেকে প্রস্তুতি, যাতে রবীন্দ্রনাথের বিশাল জালে আমরা আটকে না থাকি চিরকাল, তাঁকে আমাদের পক্ষে সহনীয় ও ব্যবহার্য করে তুলতে পারি । লোকেরা এর নাম দিয়েছিল রবীন্দ্র-বিদ্রোহ, ...."

    (আমার যৌবন, ১৯৭৬, পৃ. ২৪)।

    সমকালীন অন্য পত্রিকাগুলিতেও নতুন স্বাদের রচনা প্রকাশিত হয়েছে । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অনুকরণই সাহিত্য রচনার একমাত্র পথ নয় - একথা বারবার প্রবন্ধে ঘোষণা করার কাজটা করেছিলেন বুদ্ধদেব । তার আগে স্মরণ করা যায় কেবল অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের `কল্লোল'-এ প্রকাশিত কবিতাটি -
    "সম্মুখে থাকুন বসি পথ রুধি রবীন্দ্র ঠাকুর
    আপন চক্ষের থেকে জ্বালিব যে তীব্র তীক্ষন আলো
    যুগ-সূর্য ম্লান তার কাছে । ......"
    অচিন্ত্যকুমারের কবিতার এই ঘোষণাটিকে যুক্তিতে, তর্কে, বিশ্লেষণে, পুনরুক্তিতে বিভিন্ন লেখায় প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু `প্রগতি'-র পৃষ্ঠায় ।

    কেবল কবিতাই নয় । নতুন স্বাদ ও শৈলীর গল্প লেখার ও লিখিয়ে নেওবারও চেষ্টা করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু এই পত্রিকার পাতায় । সমকালীন পাশ্চাত্য সাহিত্যে তখন ঘটনা-নির্ভর গল্প-প্লট এর জায়গায় একটু একটু দেখা যাচ্ছে আত্মকথন-মূলক এবং প্রতীকী গল্পের বয়ান । কোথাও ঘটনার পরিবর্তে আলাপ-আলোচনা-বিতর্কের মধ্যে একটি গল্প-আভাস শেষ হয়ে যাচ্ছে । কোথাও বিদ্রুপের আবরণে লেখক যেন সমাজ-সমালোচনার একটি ভাষা-অবয়ব গড়ে তুলছেন । কোথাও প্রথম মহাযুদ্ধ-উত্তর কালের মানুষের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, গন্তব্যহীন অনিশ্চয়তার চেহারা ফুটে উঠছে গল্পের পরিণতি-বিহীন পরিণামে । শ্যামল রায় ছদ্মনামে বিষ্ণু দে বেশ কয়েকটি ছোটোগল্প লিখেছিলেন `প্রগতি'-তে । `প্রগতি' দীর্ঘস্থায়ী হলে হয়তো নতুন রীতির ছোটোগল্পের দৃঢ় প্রতিষ্ঠা ঘটে যেত ওখানেই । বাংলা ছোটোগল্পে এই নতুন রীতির জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও প্রায় তিন দশক ১৯৫৪-১৯৫৫ পর্যন্ত ।

    প্রথম মহাযুদ্ধ উত্তর কালে ইংরেজি ব্যতীত ইউরোপীয় সাহিত্যের বৈচিত্র্যের দিকে দৃষ্টি পড়েছিল বাঙালি লেখকদের । এই আগ্রহের প্রথম জাগরণ ঘটিয়েছিলেন সম্ভবত প্রমথ চৌধুরী । তবে কলা-কুশলতায় কন্টিনেন্ট্যাল ছাপ থাকলেও সরাসরি বহুল অনুবাদ ও আলোচনার মধ্যে দিয়ে `কল্লোল'-ই ইউরোপীয় কথাসাহিত্যের ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্যকে এনে দিয়েছিল পাঠকের কাছাকাছি । সেই ধারাসূত্র হাতে তুলে নিয়েছিল `প্রগতি' । বুদ্ধদেব বসু আ-কৈশোর কন্টিনেন্ট-অনুরাগী - অন্তত সাহিত্য ও শিল্পকলার দিক থেকে । `প্রগতি'-তে কবিতা ও গল্পের অনুবাদ ছাড়া বিদেশি সাহিত্য নিয়ে লেখা হয়েছে প্রবন্ধ । রাশিয়া ও জাপানের সাহিত্য সম্পর্কেও লেখা হয়েছে অনেক । অনুবাদ করা হয়েছে রুশ কথাসাহিত্য ও জাপানের কবিতা ।

    সব মিলিয়ে দু-বছর তিন মাস জীবিত থাকা একটি পত্রিকা - যার গোষ্ঠী সদস্যবর্গের বয়স উনিশ থেকে পঁচিশের মধ্যে - বাংলা সাহিত্যে এতটাই উল্লেখযোগ্য এক প্রতিষ্ঠান যে `প্রগতি'-কে বাদ দিয়ে বিশ শতকের বাংলা কবিতার আলোচনা সম্পূর্ণতা পায় না ।

    `প্রগতি'-র সমকালেই প্রতিষ্ঠান-স্থপতি বুদ্ধদেব বসুর মানস-চরিত্রের ও কর্মী-চরিত্রের আরও কিছু পরিচয় পাই । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিকতার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হত । অনেকগুলি ছাত্রাবাস ছিল এবং বাড়িতে থেকে পড়তে আসা ছাত্রদেরও যুক্ত থাকতে হত কোনো না কোনো ছাত্রাবাসের পরিবৃত্তে । বুদ্ধদেব বসু যুক্ত ছিলেন `জগন্নাথ হল' নামক ছাত্রাবাসের সঙ্গে । তখন তিনি স্নাতক স্তরের ছাত্র । ছাত্র-সংসদের নির্বাচনে সাহিত্য-সম্পাদকের পদপ্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে হল তাঁকে বন্ধুদের আগ্রহে । নির্বাচনে জয়ী হলেন এবং সেই কাজটিও চালিয়ে দিলেন তিনি । তাঁর নিজেরই ভাষায় "কমিটি, সাব-কমিটি, কনস্টিট্যুশন, আইনের তর্ক ইত্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি মান্য করেই ।" সেই সঙ্গে `জগন্নাথ হল'-এর বার্ষিক পত্রিকা `বাসন্তিকা' তিনি এক বছর সম্পাদনা করেছিলেন । পত্রিকা-জাতীয় প্রতিষ্ঠানে বুদ্ধদেব প্রাণের আরাম আর মনের মুক্তি খুঁজে পেতেন । এই কলেজ-ছাত্রাবাসের `বাসন্তিকা' তাঁর হাতে হয়ে উঠেছিল প্রথম শ্রেণির পত্রিকা । তাঁর রোমান্টিক মনের স্মরণীয় অভিব্যক্তি `কঙ্কাবতী' কবিতা বাংলা সাহিত্যের এক স্থায়ী চিহ্ন - প্রকাশিত হয়েছিল `বাসন্তিকা'-তেই ।

    সাহিত্য সৃষ্টি আর সাহিত্যের পঠন-পাঠনে অনবিচ্ছিন্ন নিমগ্নতার কারণে বুদ্ধদেব বসু তাঁর নাট্য-প্রতিভার যথোপযুক্ত অনুশীলন করে যেতে পারেননি এবং গড়ে তুলতে পারেননি নাটকচর্চা সংক্রান্ত কোনো প্রতিষ্ঠান । কিন্তু তারও বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল তাঁর বাল্য বয়সেই । শোনা যাক তাঁর নিজের ভাষাতেই । তখন থাকেন নোয়াখালিতে, বয়স তেরো-চোদ্দ-র বেশি নয় - "আমি হঠাৎ একজন অভিনেতা হয়ে উঠেছি, এমনকি গড়ে তুলেছি আমার সমবয়সী বা আমার চাইতে অল্প বড়ো কয়েকটি ছেলেকে জুটিয়ে একটি নিজস্ব নাটুকে দল; কোনো রাজপুরুষের বিদায় বা অভ্যর্থনাসভায় এবং অন্যান্য উপলক্ষেও অভিনয় বা আবৃত্তির জন্য ডাক পড়ে আমাদের - জোড়াতালি দেয়া তক্তাপোশ-পাতা স্টেজ থেকে সাক্ষাৎ টাউনহল-মঞ্চে প্রোমশন পেয়েছি আমরা ।" (আমার ছেলেবেলা, এম. সি. সরকার অ্যাণ্ড সন্স্‌, ১৯৭৩, পৃ. ৫২) পরবর্তীকালেও নাট্যদল গড়ে তোলার কিছু প্রয়াস ছিল । যখন কলকাতায় বাস করছেন নব-বিবাহিতা পত্নী সহ - তখনও নাটক লিখেছেন । বন্ধুরা মিলে মাঝে মাঝে অভিনয় করেছেন সেই নাটক । নাট্যদলের নাম দিয়েছেন লিট্ল থিয়েটার । এই নাট্যপ্রীতির ফলে পরেও তিনি নাটক লিখেছেন; অনেক উপন্যাসের দৃশ্যবিন্যাস ঘটিয়েছেন নাটকের মতো করে; আর সাহিত্যসৃষ্টির পরিণত পর্বে একগুচ্ছ অপূর্ব কাব্যনাট্য লিখে বাংলা সাহিত্যের এই ধারায় হয়ে আছেন বিশেষ উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে অন্যতম ।

    বুদ্ধদেব বসু কলকাতা মহানগরীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার আকাঙ্খা নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করলেন ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে । নিয়মিত কোনো চাকরি নেই । এম. এ. পাস করেছেন বলে কলেজের অধ্যাপক পদ পাবার প্রত্যাশা করেন । লিখে এবং প্রাইভেট ট্যুশনি করে চালিয়ে নেবার চেষ্টা করেন দিন । তখন `পরিচয়' পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে (১৯৩১), পরের বছর প্রকাশিত হল `পূর্ব্বাশা' (১৯৩২)। প্রথম প্রকাশ কুমিল্লায় হলেও কয়েকমাস পরেই `পূর্ব্বাশা'-র দপ্তর উঠে এল কলকাতায় । বুদ্ধদেব বসুর কবিতা প্রাকাশিত হত দুটি পত্রিকাতেই । কিন্তু উক্ত প্রতিষ্ঠান দুটি যথাক্রমে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের এবং যুগ্মভাবে সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও সত্যপ্রসন্ন দত্তের নিজস্ব । বুদ্ধদেব বসুর নিজের জায়গা নয় ।

    ইতোমধ্যে বুদ্ধদেব বসু লিখে চলেছেন এবং অনুভব করেছেন যে, উপন্যাস, ছোটোগল্প, ছোটোদের গল্পের বই-এর প্রকাশক কিছু কিছু পাওয়া গেলেও - কবিতার বই-এর প্রকাশক নেই । অধিকাংশ প্রকাশক ফরমায়েশি লেখা লিখিয়ে নিতে চান; লেখকের ভালোবাসার লেখাটি প্রকাশ করতে চান না । তাঁরা ব্যবসায়ী, অধিকাংশই সাহিত্য-প্রেমিক নন । তাই বুদ্ধদেব বসু প্রথমে লেখক হিসেবেই নিজে প্রকাশ করলেন নিজের ও বন্ধু অচিন্ত্য কুমারের দুটি কবিতার বই - যথাক্রমে `একটি কথা' ও `আমরা' । তার পর তিনি ভাবলেন নিজের একটি প্রকাশনা-সংস্থার কথা । নিজের একটি প্রকাশনা-সংস্থা তৈরিও করে ফেললেন - নাম দিলেন `গ্রন্থকার-মণ্ডলী' । বুদ্ধদেব বসুর স্থাপিত আর একটি প্রতিষ্ঠান । এই প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অভিলাষ ও জেদ তিনি অনেকদিন বজায় রেখেছিলেন । `গ্রন্থকার-মণ্ডলী'-র প্রথম অনভিজ্ঞ প্রয়াস বিকশিত হয়েছিল `কবিতা-ভবন' প্রকাশনা-সংস্থায় । যদিও উল্লেখ্য যে বিষ্ণু দে-র প্রথম সংকলন `উর্বশী ও আর্টেমিস' প্রকাশ পায় । `গ্রন্থকার-মণ্ডলী' থেকেই । বাংলা সাহিত্যের টুকরো টুকরো ইতিহাস সুরভিত ফুলের মতো ফুটে উঠেছিল ঐ `কবিতা-ভবন' থেকে । বুদ্ধদেব বসু ছিলেন বিরল সেই প্রকাশকদের একজন - যিনি কোনো অর্থেই ব্যবসায়ের জন্য নয়, সাহিত্যকে ভালোবেসে স্থাপন করেছিলেন প্রকাশনা সংস্থা ।

    কলকাতায় একটু স্থিত হয়েই বুদ্ধদেব বসু আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন পত্রিকা সম্পাদনায় । সুযোগ্য সঙ্গিনী প্রতিভা সোমের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হল ১৯৩৪-এ, গোলাম মহম্মদ ম্যানশন নামক একটি বাড়িতে সংসার পাতলেন তাঁরা । ততদিনে লেখক হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়ে গেছেন বুদ্ধদেব । নতুন সংসার, কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সাহিত্যপ্রাণ, বন্ধুপ্রীতি সম্পন্ন এবং অতিথি-বত্সল । বন্ধু-বান্ধবের যাওয়া আসা ছিল যথেষ্ট । সেই বাড়িতেই ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে প্রথম প্রকাশিত হল `কবিতা' পত্রিকা (আশ্বিন ১৩৪২ বঙ্গাব্দ)। প্রথম দু-বছর সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র, সহ-সম্পাদক ছিলেন সমর সেন ।

    `কবিতা' পত্রিকা পরবর্তী পঁচিশ বছর ধরে (শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল চৈত্র ১৩৬৭ বঙ্গাব্দে; ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ) বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত বাংলা কবিতার আসরে কোন্‌ ভূমিকা পালন করেছিল তার বহু আলোচনা করেছেন গবেষকেরা এবং সাহিত্য-পাঠকেরা । আমরা তার বিস্তৃত আলোচনায় যাব না । বুদ্ধদেব বসুর লেখা `আমাদের কবিতাভবন' (প্রথম প্রকাশ- শারদীয় দেশ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ) গ্রন্থে পাওয়া যাবে এই পত্রিকার অন্তরঙ্গ ইতিহাস । প্রভাতকুমার দাসের `কবিতা পত্রিকা সূচিগত ইতিহাস'-এ পাওয়া যাবে আনুপূর্বিক বিবরণ ।

    পাঁচমিশেলি পত্রিকায় যেখানে সেখানে কবিতা বসিয়ে জায়গা ভরাট করবার যে প্রথা তখনও অনেকটাই প্রচল ছিল সেই অমর্যাদার জায়গা থেকে তুলে এনে কবিতাকে পূর্ণ সম্মানে প্রতিষ্ঠিত করবার ইচ্ছে ছিল তাঁর । চিরকালই আধুনিক কবিতাকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার সংকল্প অম্লান রেখেছেন মনের মধ্যে । `পরিচয়'-এর বৈঠকে অন্নদাশঙ্কর রায়ের হাতে হ্যারিয়েট মনরো সম্পাদিত, শিকাগো থেকে প্রকাশিত `পোইট্রি' পত্রিকা দেখে বুদ্ধদেব বসুর ইচ্ছে হল কেবলই কবিতা আর কবিতা-বিষয়ক গদ্য নিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশ করবেন । সেই পত্রিকাই `কবিতা' ।

    প্রথম সংখ্যাটিকেই, কিছু সমালোচনা করলেও, স্বাগত জানালেন রবীন্দ্রনাথ । সেই প্রথম সংখ্যা দেখেই এডওয়ার্ড টমসন `টাইম্স্‌ লিটেরারি সাপ্লিমেন্ট'-এ ১৯৩৬-এর ১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে আলোচনা করলেন । `কবিতা' সদ্যোজাত হয়েই পেল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ।

    নতুন আধুনিক কবিদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল `কবিতা' পত্রিকা; প্রতিষ্ঠিত করেছিল অনেক তরুণ কবিকে । এই পত্রিকাতেই পাঠক চিনেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী, সমর সেন, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অজিত দত্ত, অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহ-কে । পরবর্তীকালের `কৃত্তিবাস'-গোষ্ঠীর কবিরা অনেকেই `কবিতা'-য় আত্মপ্রকাশ করেছিলেন `কৃত্তিবাস'-এর আগেই । যেমন শঙ্খ ঘোষ, আনন্দ বাগচী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত । কবিতা-বিষয়ক অত্যুকৃষ্ট বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে `কবিতা'য় । কখনও কখনও উদ্বেজিত হয়েছে বিতর্ক । মাঝে মাঝেই প্রকাশিত হয়েছে বিশেষ সংখ্যা । রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যাগুলি আজও আমাদের কাজে লাগে । একটু অন্য ধরনের এক একটি বিশেষ সংখ্যা ছিল রীতিমতো অভিনব পরিকল্পনার ফসল । যেমন ১৯৫০-এ প্রকাশিত `মার্কিন সংখ্যা' । উনিশ জন আমেরিকীয় কবির কবিতা; কিছু কবিতার মূল এবং অনুবাদ পাশাপাশি; সেই সঙ্গে পাউণ্ড ও এলিয়ট-এর চিঠি । পরিমাণ স্বল্পই কিন্তু এই ধরনের গণ্ডি-ভাঙা আকাঙ্খা বাংলা কবিতার পত্রিকায় আগে কখনও দেখা যায়নি । `সবুজপত্র', `কল্লোল', `পরিচয়'-কে মনে রেখেও একথা বলা যায় । চিনদেশীয় কবিতার অনুবাদও বোধহয় গুরুত্ব সহকারে এই পত্রিকাতেই প্রথম স্থান পায় । `বিদেশী সাহিত্য' নামের একটি নিয়মিত বিভাগই ছিল `কবিতা'-য় । অবশ্য এক বছর পরে সেটি উঠে যায় কিন্তু সর্বদেশীয় কবিতার প্রতি উন্মুখ প্রীতি ছিল এই পত্রিকার বৈশিষ্ট্য । গ্রিক কবি দেমেত্রিয়স কাপেতানাকিস থেকে শুরু করে ফরাসি কবি ভালেরি, লাতিন আমেরিকার গেব্রিয়েলা মিস্ত্রাল সহ ইয়েট্স্‌, পাউণ্ড, এলিঅট, রিল্কে, হ্যোল্ডার্লিন, বোদল্যের-এর উপস্থিতি ছিল অবিরল - অনুবাদে, আলোচনায়, গ্রন্থ-সমীক্ষায়, সংবাদে । `কবিতা' পত্রিকার একটি দ্বিভাষিক সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৩-তে । কিছু বাংলা কবিতা, কিছু ইংরেজি; কিছু বাংলা কবিতার অনুবাদ; মুণ্ডা ও সাঁওতালি কবিতার অনুবাদ - এই নিয়ে দ্বিভাষিক সংখ্যা প্রকাশিত হওয়া মাত্র নি:শেষিত হয়, বিদেশ থেকে অর্ডার আসে, পুনর্মুদ্রণের দাবি ওঠে । বুদ্ধদেব বসু কবিতার জন্য পাঠকদের মনে এমনই একটি চাহিদা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।

    `কবিতা' পত্রিকার শততম সংখ্যাটি প্রকাশ পেল আন্তর্জাতিক সংখ্যা - `ইন্টারন্যাশনাল নাম্বার' (১৯৬০) নামে । বাঙালি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষার কয়েকজন কবির রচনার ইংরেজি অনুবাদ; সেই সঙ্গে ইংরেজি ভাষী কবিদের কবিতার বাংলা অনুবাদ - মোট ঊনসত্তরটি কবিতার সংকলন । এই সম্বল নিয়ে সম্পাদকীয় লিখন বা এডিটরস্‌ নোট-এ বুদ্ধদেব ঘোষণা করেছিলেন যে, এই সংখ্যাটিকে তাঁরা `মিটিং গ্রাউণ্ড অব্‌ নেশন্স্‌'

    (Meeting ground of Nations) করে তুলতে চান । এই প্রত্যাশার সাহস তাঁর ছিল; এই স্বপ্নকে সত্য বলে বিশ্বাস করবার ক্ষমতা তাঁর ছিল । এ-জন্যই তাঁকে বলি প্রতিষ্ঠানের স্রষ্টা । তিনি জানতেন - এক বিন্দু শিশিরে সূর্য ধরা দেয়; তিনি জানতেন `সব ঠাঁই মোর ঘর আছে, আমি সেই ঘর লব খুঁজিয়া'। এমন মানুষই অনন্ত সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেন ।

    পত্রিকা প্রতিষ্ঠানের স্রষ্টা হয়ে ওঠার এই নেশা বুদ্ধদেব বসুর ছিল শেষ জীবন পর্যন্ত । নিজের প্রকাশনা সংস্থা `কবিতাভবন'-এর জন্য একটি বার্ষিক সংকলন প্রকাশ করতেন তিনি । নাম ছিল `বৈশাখী' । তাতেও সংকলৈত হত অনেক লেখা । হুমায়ূন কবিরের সঙ্গে পরিচয় হওয়াতে পরস্পরের গুণগ্রাহী হয়েছিলেন তাঁরা । `চতুরঙ্গ' পত্রিকা ছিল হুমায়ূন কবিরের পরিকল্পনা । প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৮- এ (আশ্বিন ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ) । সেখানেও প্রথম বছরে যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু । পরে সেই পদটি ছেড়ে দিলেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি । একটি পত্রিকার গুরুত্ব এই যে, তা প্রবাহিত বর্তমানের সাংস্কৃতিক স্পন্দন ও তার অভিব্যক্তিকে লিপিবদ্ধ স্থায়িত্ব দেয় । বুদ্ধদেব বসু পত্রিকা ব্যাপারটির এই তাত্পর্য উপলব্ধি করেছিলেন বলেই পত্রিকার মধ্যে দিয়ে সংস্কৃতির অনুশীলনকে অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত না রেখে স্বস্তি পেতেন না । সংস্কৃতির সেই প্রাণবান ও বহতা ধারায় নিজের জাগ্রত মনের প্রতিটি পর্যায়কে তিনি মিলিয়ে দিতে উত্সুক ছিলেন । তাই পত্রিকা তাঁর কাছে ছিল বিকল্পহীন এক প্রতিষ্ঠান ।

    পত্রিকারই ঘনীভূত রূপ প্রকাশনা-সংস্থা - বুদ্ধদেবের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক কাজ `গ্রন্থকার-মণ্ডলী' নামের অস্ফুট প্রয়াস ধীরে ধীরে পূর্ণতা পেতে লাগল । ততদিনে বসু-দম্পতি উঠে এসেছেন ২০২, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এর বাড়িতে । সেই বাড়ি থেকেই `কবিতা' পত্রিকা এরপর প্রকাশিত হবে । যদিও `কবিতা' পত্রিকা-র নতুন ঠিকানায় `কবিতাভবন' শব্দটি ছিল না কিন্তু আষাঢ় ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের (জুন ১৯৩৭) `কবিতা'-য় সমর সেনের `কয়েকটি কবিতা' সংকলনের বিজ্ঞাপনে `কবিতাভবন' শব্দটি আছে । `কবিতাভবন' নামটি যেন আপনা থেকেই ফুটে উঠল । `কবিতা' পত্রিকার কার্যালয় এবং কবিতানুরাগী পরিবারের উদার আবাস রূপে যুগপৎ । প্রকাশনা-সংস্থার নামও সেভাবেই হয়ে গেল `কবিতাভবন' । প্রকাশিত হতে লাগল নতুন কবিদের কবিতার বই - বুদ্ধদেব বসুর `কঙ্কাবতী', সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতা-সংকলন `পদাতিক', সমর সেনের `কয়েকটি কবিতা', অমিয় চক্রবর্তীর `অভিজ্ঞান বসন্ত' । নির্ভুল মুদ্রণ, সুদৃশ্য টাইপ, দৃষ্টি-নন্দন প্রচ্ছদ অথচ দাম বেশি নয় - `কবিতাভবন' প্রকাশনা-সংস্থা একটা আদর্শই হয়ে উঠল সাহিত্য-জগতে । লেখকেরা নিজেদের বই-এর আর্থিক দায় বহন করবেন এটাই শর্ত ছিল । কিন্তু অনেক সময়ে লেখকেরা সব খরচ দিয়ে উঠতে পারতেন না । সেক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুকেই এগিয়ে আসতে হত । বিজ্ঞাপনও তিনিই দিতেন ।

    `কবিতাভবন'-এর প্রকাশনা `আধুনিক বাংলা কবিতা' আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক । রবীন্দ্র-উত্তর পর্বের কবিরা কবিতা লিখেছেন, নিজেদের ব্যয়ে সংকলনও প্রকাশ করেছেন যথাসম্ভব । কিন্তু কোনো সংকলন-গ্রন্থে বিন্যস্ত হয়ে মূল্য পাচ্ছে না তাঁদের লেখা । তেরো বছর আগে নরেন্দ্র দেব সম্পাদনা করেছিলেন `কাব্য-দীপালি' (১৯২৭)। প্রকাশক সুধীরচন্দ্র সরকারের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও নরেন্দ্র দেবের আগ্রহে সেই সংকলনে স্থান পেয়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু এবং শিবরাম চক্রবর্তী । তারপর ১৯৩৮-এ রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল `বাংলা কাব্য পরিচয়' । তাতে কবিতা ছিল জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অন্নদাশংকর রায়, বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, মনীশ ঘটক, দিনেশ দাসের । তবু সেই সংকলন বিশেষ করে অখুশি করেছিল আধুনিক কবিদের । সংকলনে ছিলেন না সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সমর সেন এবং তাঁদের অগ্রজ বিষ্ণু দে । কবিতার নির্বাচনেও সন্তুষ্ট হননি কবিরা । তাই কেবলই আধুনিক কবিদের নিয়ে একটি সংকলন করবার কথা ভাবা হল । সম্পাদনার দায়িত্ব পেলেন হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আর আবু সয়ীদ আইয়ুব । কিন্তু কর্ম-সম্পাদনার সিংহভাগই সম্পন্ন করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু । দুই সম্পাদকের মতের মিল হয়নি অনেক ক্ষেত্রেই । দুজনে লিখেছিলেন দুটি আলাদা সম্পাদকীয় । বুদ্ধদেবের সঙ্গেও কিছু কিছু মতানৈক্য ছিল দুই সম্পাদকেরই । বুদ্ধদেব নিজের কথা লেখবার সুযোগও পাননি । তা সত্ত্বেও তাঁরই নিরন্তর প্রয়াসে `কবিতাভবন' থেকে প্রকাশিত হল আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম সংকলন - যা শুরুই রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে । `কবিতাভবন'- এর অভিজ্ঞান বা `এমব্লেম' ছিল - ঢেউ এর উপর একটি নৌকো । সেটি প্রথম দেখা দেয় ১৯৪২-এ । `কবিতাভবন' থেকে প্রকাশিত হয়েছিল আরও অনেক বই কিন্তু বিশেষ উল্লেখযোগ্য `এক পয়সায় একটি' গ্রন্থমালা । এই পরিকল্পনার মধ্যেও নিহিত ছিল ভবিষ্যৎ বিকাশের সম্ভাবনা । তা অনেকটাই সফলও হয়েছে ।

    এই পরিকল্পনার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল একটি অভিনবত্বের স্বাদ দেওয়া, যাতে কবিতার দিকে আকৃষ্ট হয় পাঠকের মন । দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল সত্যিই কম দামে শোভন-দর্শন ভালো কবিতার একটি করে গুচ্ছ তুলে দেওয়া কবিতা-পাঠকের হাতে । ডিমাই সাইজের ষোলো পৃষ্ঠার বই । প্রতি পৃষ্ঠার দাম এক পয়সা হিসেবে ষোলো পয়সা - সেই সময়ের `চার আনা' দাম । কবিতার সংখ্যা নিয়ে কোনো নির্দিষ্টতা ছিল না । ষোলোটি পৃষ্ঠায় অর্থাৎ এক ফর্মায় যতগুলি কবিতা যেভাবে সাজানো যেতে পারে - ততগুলিই থাকত । অনেকে বলেন এই সিরিজ-এর একটি বিদেশি আদর্শ ছিল । আয়ারল্যাণ্ড-বাসী এবং ইংরেজি ভাষার বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক জেম্স্‌ জয়েস কবিতাও লিখতেন । তাঁর কয়েকটি কবিতার একটি সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯২৭-এ । তেরোটি কবিতার এই সংকলনটির নাম জয়েস দিয়েছিলেন

    'POMES PENY each' । পোয়েম্স্‌ (Poems) নয়, পোম্স্‌ (Pomes) - হয়তো তুচ্ছতাবাচক এই উচ্চারণ একটু অবজ্ঞার্থেই । বারো পেনিতে এক শিলিং হয় । বইটির দাম ছিল এক শিলিং । একটি কবিতা এক শিলিং-এ । একটি কবিতার নাম ছিল `টিলি' (Tilly), আয়ারল্যাণ্ড-এর চলতি ভাষায় `ফাউ' অর্থাৎ অতিরিক্ত । তাই কবিতার সংখ্যা তেরো । বুদ্ধদেব বসু অবশ্যই জানতেন জয়েস্‌-এর কবিতা-পুস্তিকাটির কথা । তাঁর বন্ধুরাও জানতেন । বর্তমান লেখককে এ-কথা বলেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায় ও বিমলপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় । দুজনেরই কবিতা-গ্রন্থ প্রকাশিত হয় `এক পয়সায় একটি' গ্রন্থমালায় ।

    কিন্তু সিরিজ-এর নামের ইঙ্গিত বুদ্ধদেব জয়েসের কাছ থেকে নিলেও এই গ্রন্থমালার পরিকল্পনা ছিল তাঁর নিজস্ব । অতি সুদৃশ্য ও বাছাই করা ছোটো ছোটো কবিতার বই স্বল্প মূল্যে কবিতার পাঠককে দেওয়া - এই ছিল তাঁর সংকল্প । আশাতীত সাফল্য পেয়ে ছিলেন তিনি । প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত - সবসুদ্ধ সংখ্যায় আঠারোটি । প্রত্যেকটিই জনপ্রিয় হয়েছিল । দ্বিতীয় সংস্করণ হয়েছিল চারটি বই-এর । এই সিরিজ-এ প্রকাশিত `বনলতা সেন'-এর প্রথম সংস্করণ কবি জীবনানন্দকে বিপুল পরিচিতি দিয়েছিল এবং আধুনিক রোমান্টিক কবিতার এক দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছিল বাংলার কবিতা-পাঠকদের সামনে । অমিয় চক্রবর্তীর `মাটির দেয়াল' ছিল এই সিরিজ-এর বিশিষ্ট সংকলন । তখনও অমিয় চক্রবর্তীর রচনা-শৈলীতে পাঠক অভ্যস্ত হতে পারেননি । এই নতুনকে চেনাবার দায়িত্ব যেন গ্রহণ করেছিলেন প্রকাশক বুদ্ধদেব বসু । মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় কবিতা-সংকলন `মন-পবন' প্রকাশিত হয় এই সিরিজ-এ, তখনও মঙ্গলাচরণ নবীন কবি । সেই সময়ে অত্যন্ত তরুণ দুই কবি সমর সেনের `খোলা চিঠি' আর হরপ্রসাদ মিত্রের `ভ্রমণ' প্রকাশ পায় এই সিরিজ-এ ।

    সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়া, তখনও ছড়া-লিখিয়ে বলে তাঁর কোনো পরিচিতি ছিল না । বুদ্ধদেব বসু কয়েকটি কবিতা চাইলে অন্নদাশঙ্করের কলমে হঠাৎ নতুন ধরনের ছড়া এসে যায় । সেই সময়ের মাপকাঠিতে অনভ্যস্ত ধরনের কবিতা । বুদ্ধদেব বসু সাদরে সেগুলি মুদ্রিত করেন । অন্নদাশঙ্করের বিখ্যাত ছড়া - এভাবেই প্রথম পৌঁছে গেল পাঠকের হাতে ।

    এই কবিতা-গ্রন্তহগুলিতে `কবিতাভবন' প্রকাশনীর তরঙ্গ-আন্দোলিত তরনী - মুদ্রিত হত । ঠিকানা সেই বিখ্যাত `২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, কলকাতা' । একথাও উল্লেখ্য যে, বইগুলির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন যামিনী রায়, শম্ভু সাহা, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ শিল্পী । বুদ্ধদেব বসুর ঐকান্তিক আগ্রহ ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানেই সম্ভব হয়েছিল এই সমাবেশ । `এক পয়সায় একটি' সিরিজ-এর আঠারোটি কবিতার এই গুচ্ছ বাংলা সহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা । এই সিরিজটি এক ফর্মা মাপের কবিতার বই ও পত্রিকাকে এমনই আভিজাত্য দিয়েছিল যে, এখনও পর্যন্ত সুদৃশ্য, এক-ফর্মার কবিতার কাগজ ও বই স্থূল কলেবরের বই ও পত্রিকার মধ্যে হারিয়ে যায়নি । এই মাপটিরও আছে এক নিজস্ব ঐতিহ্য ।

    কবিতা-সিরিজটির সাফল্যে উত্সাহিত বুদ্ধদেব বসু ১৯৪৩ থেকে একটি `ছোটোগল্প-গ্রন্থমালা' সিরিজ-এর পরিকল্পনা করেন । এই গ্রন্থমালার সম্পাদক ছিলেন প্রতিভা বসু । এটিও ছিল চমত্কার । থাকত একটি বা দুটি করে গল্প । স্বেচ্ছায় প্রথম গল্প দিয়েছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় - `যে বাঁচায়' । লিখেছিলেন প্রমথ চৌধুরী, অন্নদাশঙ্কর রায়, লীলা মজুমদার, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, রাজশেখর বসু, পূর্ণশশী দেবী, জ্যোতির্মালা দেবী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, পরিমল রায় ।

    কিছুটা অর্থাভাবে, মূলত বুদ্ধদেব বসু ত্রক্রমে নিজের লেখা, গবেষণা, অধ্যাপনায় বেশি জড়িয়ে পড়ায় দুটি সিরিজই এক সময়ে বন্ধ হয়ে গেল । কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন চলছে - সেই রাজনৈতিক আন্দোলন, মন্বন্তর, বেকার সমস্যা, মূল্যবৃদ্ধি, বোমাতঙ্কের যুগে - সাহিত্যের মুক্ত বাতায়ন খুলে রাখার এই একাগ্রতা আমাদের কাছে আজ এক প্রতিবাদী শক্তি বলেই প্রতিভাত হয় ।

    প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নির্দিষ্ট একটি স্থানের আলগা একটা যোগ আছে এ-কথা আগে বলেছি । `কবিতাভবন' প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবং ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এর বাড়িটি সেভাবেই অঙ্গাঙ্গী হয়ে আছে । এই বাড়ির প্রতিটি সন্ধ্যা সাদরে উন্মুক্ত থাকত শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্য । মধ্যে একবার নিয়মিত সাহিত্যসভারও প্রচলন করেছিলেন বুদ্ধদেব - মাসে দু বার - শনিবার সন্ধ্যায় বা রবিবার সকালে । বুদ্ধদেব স্বয়ং, গৃহর্কত্রী প্রতিভা বসু, বালক ও কিশোরবয়স্ক পুত্রকন্যারা - সকলেই একান্ত ভালোবাসায় আপ্যায়ন করতেন অতিথিদের । থাকত, বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় `সারবান কিছু খাদ্য'। মাঝে মাঝে অন্য সদস্যদের বাড়িতেও সভা বসত । কিন্তু সাহিত্যসভাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না `কবিতাভবন' প্রতিষ্ঠানটি । সেখানে প্রতিদিনই সমাবেশ, প্রতিদিনই আপ্যায়ন এবং নান্দনিকতার আনন্দময় বাতাবরণ । তরুণ কবি এবং কবিতাপ্রেমিকদের কথা বলা বাহুল্য; সেখানে মাঝে মাঝে আসতেন যামিনী রায়, অতুলচন্দ্র গুপ্ত । একবার এসেছিলেন প্রমথ চৌধুরী - যেন `সবুজপত্র'-এর ঐতিহ্য এসে মিলল `কবিতা'-র সঙ্গে । আসতেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জীবনানন্দ দাশের মতো মানুষ যাঁরা সর্বত্র স্বচ্ছন্দ হতে পারতেন না । `কবিতাভবন'-এর এই আবহাওয়াটি বুদ্ধদেব বসু এবং প্রতিভা বসু - দু জনেরই কোনো কোনো গল্প-উপন্যাসে মাঝে মাঝে ফুটে উঠেছে ।

    বুদ্ধদেব বসু স্থাপিত শেষ প্রতিষ্ঠান, বলা যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলকসাহিত্য বিভাগ । নতুন ধরনের বিষয় । আদর্শ এসেছিল পাশ্চাত্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে । অধ্যাপকেরা ছিলেন কেউ কেউ বিদেশি - ফাদার ফাঁলো, ফাদার আঁতোয়ান, ড: রোডেরিক মার্শাল । বাঙালি অধ্যাপকদের মধ্যে ছিলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, বুদ্ধদেব বসু স্বয়ং এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত । সুধীন্দ্রনাথ এম. এ. পাস ছিলেন না বলে আপত্তিও উঠেছিল । কিন্তু বুদ্ধদেব তাঁর প্রতিষ্ঠানে সম্ভব করেছিলেন সেই আপাত-অনিয়ম । এ ধরনের কাজ সমর্থনযোগ্য কিনা সে বিতর্কে আমরা যাব না । কিন্তু এ-টুকু বলব - সুধীন্দ্রনাথকে অধ্যাপক হিসেবে আহ্বান করার মূলে সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বন্ধন ছিল না । সুধীন্দ্রনাথ দত্ত নামের মানুষটির সাহিত্যজ্ঞান ও বোধের ব্যাপ্তি ছিল তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক হবার পক্ষে আদর্শ । না হলে, এমন সম্পর্ক বুদ্ধদেব বসুর বহুজনের সঙ্গেই ছিল । এবং তাঁদের ডিগ্রি নিয়েও কোনো প্রশ্ন উঠত না । কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছাড়া আর কাউকে তিনি ডাকেননি ।

    এই তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে প্রথম কয়েক বছর যাঁরা ছাত্রছাত্রী ছিলেন, যাঁদের নিজে শিক্ষিত করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু এবং পূর্বোক্ত অধ্যাপকেরা - তাঁরা প্রায় সকলেই পরবর্তী কালে বাংলায় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো-না-কোনো দিকে নিজেদের নামকে কম-বেশি প্রতিষ্ঠিত করেছেন । তাঁদের কেউ কেউ সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক - যেমন নরেশ গুহ (নরেশ গুহ অবশ্য প্রত্যক্ষ ছাত্র ছিলেন না, ছিলেন দীর্ঘ দিনের সহকর্মী), নবনীতা দেবসেন, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, দিব্যেন্দু পালিত । কেউ কেউ পঠন-পাঠনের জগতে গবেষণামূলক কাজ করবার জন্য এবং অনুবাদমূলক রচনার জন্য বিশিষ্ট হয়ে আছেন । যেমন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, অমিয় দেব, কমলেশ চট্টোপাধ্যায়, সমীর সেনগুপ্ত (সমীর সেনগুপ্তের লেখা বুদ্ধদেবের জীবনী এখন বুদ্ধদেব সম্পর্কিত যে কোনো কাজের জন্য অবশ্যপাঠ্য), দময়ন্তী বসু সিং (নিজের লেখা ছাড়াও পিতার বিভিন্ন রচনাকে যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষিত রাখার কাজে যাঁর নিষ্ঠা ও দক্ষতা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত)।

    যাঁরা প্রত্যক্ষ ছাত্র ছিলেন না কিন্তু তরুণ অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরাও এক-একজন খ্যাতনামা গবেষক - স্বপন মজুমদার, প্রয়াত সুবীর রায়চৌধুরীর গবেষণামূলক কাজ অ-বিস্মরণ যোগ্য । একটি প্রতিষ্ঠান এভাবেই তার সাফল্য প্রমাণ করতে পারে । সে প্রতিষ্ঠান কেবল প্রতিষ্ঠাতার নয় । সে প্রতিষ্ঠানের শক্তি ও সাধনায় সঞ্জীবিত হয়ে ওঠেন আরও অনেক মানুষ । বাংলার সংস্কৃতিতে একাধিক সদর্থক প্রতিষ্ঠানের স্রষ্টা বুদ্ধদেব বসুকে আমাদের নমস্কার ।




    পরবাস ৪০; জানুয়ারি, ২০০৮

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)