• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • বিষয়আশয় : বিশ্বদীপ সেনশর্মা





    পড়ন্ত বিকেলে মেঠো পথ ধরে বাড়ি ফিরছিল গঙ্গাচরণ। মাথায় একরাশ চিন্তা।

    সে গেছিল চৌধুরী মশায়ের কাছে তাঁদের আমবাগানের ইজারা নেবার ব্যাপারে কথা বলতে। প্রতিবছরই নেয়। তার একটা ছোট মনোহারি দোকান আছে বটে, কিন্তু তাতে সংসার চলে না। চৌধুরীদের বাগানের আম বিক্রি করেই বছর ঘুরলে সে দুটো পয়সার মুখ দেখে। খরচ-খরচা বাদ দিয়ে হাতে যা থাকে তাতে সারা বছর ভালভাবেই চলে যায়। ছেলে-মেয়ের পড়াশুনো, বউয়ের শখ-আহ্লাদ, সংসারের হাজার খরচা সব ওই আমবাগানের ভরসায়।

    তো এবছর চৌধুরীমশায় ইজারার জন্য যা দর হাঁকলেন শুনে তার চক্ষু চড়কগাছ। সে শুনেছিল বটে শহর থেকে বিদেশি কোম্পানিরা এসে এ তল্লাটের সব আমবাগান ইজারা নিতে চাইছে৷ তারা নাকি জ্যাম, জেলি, ফলের রস এসবের কারখানা বানাবে৷ তাদের ফড়েরা বাগান মালিকদের কাছে ঘুরঘুর করছে। কিছু টাকা বেশি দিতে হবে সে ধরেই নিয়েছিল। কিন্তু এ যে তার সাধ্যের বাইরে। যদিও আমের ফলন ভাল হলে টাকাটা হয়ত সে তুলে নিতে পারত, কিন্তু এত টাকা তাকে দেবে কে?

    চৌধুরীদের বাড়ি থেকে বেরিয়েই সে ছুটেছিল গাঁয়ের মহাজন বিষ্টু সাহার কাছে। বিষ্টু রাজি হয়নি। সে বিষ্টুর হাতে পায়ে ধরতে বাকি রেখেছে কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। বিষ্টুর বন্ধক চাই। আর বন্ধক দেবার মত তার কাছে আর কিছু নেই। বসতবাড়ি, বউয়ের গয়নাগাঁটি সবই বন্ধকে দেওয়া আছে। হ্যাঁ, প্রতি বছর সে অল্প অল্প করে শোধ করছে বটে, কিন্তু দেনা এখনও প্রচুর বাকি। বিষ্টু তার উপরে নতুন করে আগাম দিতে রাজি নয়।

    অনেক ভেবেও সে দিশা পাচ্ছিল না। গাঁয়ের পঞ্চায়েতের মেম্বার খগেন ঢালি তার বন্ধুস্থানীয়। তাকে একবার বলে দেখা যেতে পারে। কিন্তু লাভ হবে না। ফড়েরা টাকার থলি নিয়ে ঘুরছে, চৌধুরীমশায় মওকা ছাড়বেন কেন?

    ভাবতে ভাবতে সে বাড়ির রাস্তা ছাড়িয়ে এসেছিল। যখন খেয়াল হল অনেকটা চলে এসেছে। উল্টোপথে ফিরে না গিয়ে সে বাঁ-দিকে শীলদের ভিটের পাশ দিয়ে কোনাকুনি ছোট রাস্তা ধরল। ভিটে নামেই, জঙ্গলের মধ্যে কয়েকটা পোড়ো দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। সাপখোপের বাসা। ভিটেটার বদনাম আছে, রাতবিরেতে নাকি শীলদের বুড়োকর্তাকে এখানে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। শীলদের মহাজনী কারবার ছিল, অনেকবছর আগে নাকি গাঁয়ের অনেক গেরস্থের টিকি বুড়োকর্তার কাছে বাঁধা থাকত। তারপর ছেলেরা বড় হয়ে পড়াশুনো করে শহরে চলে গেছে, কর্তা একা যতদিন পারেন কারবার সামলেছেন। তারপর একদিন কালের নিয়মেই স্বর্গে গেছেন। তবে গাঁয়ের লোকে বলে এখনও নাকি ভিটের মাটিতে বন্ধকী কারবারের সোনাদানা সব পোঁতা আছে, বুড়োকর্তা যখ হয়ে সেসব পাহারা দেন।

    এইসব ভেবে এই সন্ধ্যাবেলা ভিটে পেরনোর সময় তার গা ছমছম করছিল বটে। নিজের অজান্তেই সে গতি বাড়িয়ে দিল। কিন্তু ওকি ওকি! সামনে ভাঙা দেয়ালের উপর বসে খেটো ধুতি আর ফতুয়া পরে বুড়োমতন ওটা কে পা দোলাচ্ছে? ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ। আমবাগানের জন্য তদ্বির করতে এসে কি বেঘোরে ভূতের হাতে প্রাণ যাবে!

    বুড়োটা হাত তুলে তাকেই ডাকছে। পালাবার পথ নেই। কাঁপতে কাঁপতে সে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বুড়োকর্তাই বটে। ছোটবেলায় দেখেছে এখনও মনে আছে। আপনা থেকেই তার দুই হাত জড়ো হয়ে কপালে উঠে এল।

    বুড়োকর্তা খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, তুই গণশার ছেলে না। গণশা আমার কাছে খুব আসত।

    সে কোনরকমে কাঁপা গলায় বলল, আজ্ঞে।

    বুড়োকর্তার মুখে এবার একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। বললেন, ভয় পাস না, তোর ক্ষতি করব না। তা চৌধুরী কি বলল, আমবাগান দেবে না?

    সে ঘাড় নাড়ল। ধীরে ধীরে ভয়টা কেটে গিয়ে মনের মধ্যে একটা অবাক ভাব জেগে উঠছে।

    বুড়োকর্তা বললেন, দেবে নাই তো। শহর থেকে বড় কোম্পানি এসেছে, তারা জ্যাম, জেলি আর জুস না কি বলে ওই সবের কারখানা বানাবে। এ তল্লাটের সব আমবাগান মোটা টাকা দিয়ে ইজারা নিচ্ছে।

    বুড়োকর্তা চুপ করে গেলেন। তার মাথায় বিদ্যুতের মত একটা চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল, যদি কিছু করা যায় এই যখবাবাজিই করতে পারবে। সে হাতজোড় করে বলল, উপায় কিছু একটা করে দ্যান কর্তা।

    বুড়োকর্তা আবার হাসলেন। বললেন, উপায় করার জন্যই তো বসে আছি। ইজারা পাবি। আগামের টাকা আমি দেব। তবে খরচ-খরচা বাদ দিয়ে টাকায় পঁচিশ পয়সা আমাকে দিতে হবে।

    সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। বুড়োকর্তা টাকা দেবেন? কীভাবে?

    বুড়োকর্তা তার মনের কথা বুঝে বললেন, কাল সূর্য ওঠার আগে একটা শাবল নিয়ে আসবি। এই পাশের গাছটা দেখছিস, এর সামনে মাটি খুঁড়বি। দেখবি একটা মাটির হাঁড়িতে পুরনো আমলের কিছু মোহর আছে। গুনে গুনে দশটা মোহর বার করে হাঁড়ি আবার যেমন ছিল পুঁতে রাখবি। মোহরগুলো নিয়ে যাবি পাশের গাঁয়ে দীনুস্যাকরার কাছে। তাকে আমার নাম বলবি। সে যা টাকা দেবে তাতে তোর ইজারার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

    রইল আমাকে ফেরত দেবার কথা। তোর হাতে যখন পয়সা আসবে আসল আর তার সঙ্গে সুদের টাকা যোগ করে দীনু স্যাকরাকে দিবি। সে তোকে মোহর বানিয়ে দেবে। সেগুলো এনে আবার হাঁড়িতে ঢুকিয়ে রেখে দিবি।

    সে আবার দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল, যে-আজ্ঞে কর্তা।

    বুড়োকর্তা বাতাসে মিলিয়ে গেলেন। সে দুর্গা দুর্গা করতে করতে বাড়ি ফিরল।


    তা সবকিছু ঠিকমতই হয়েছিল। গাছতলায় সে মোহরও পেয়েছিল আর দীনুস্যাকরার কাছ থেকে টাকাও। চৌধুরীমশাইও থোক এতগুলি টাকা হাতে পেয়ে খুশি হয়ে ইজারা তাকেই দিলেন। আর আমের ফলন যা হয়েছিল তাতে বুড়োকর্তার দেনা মিটিয়েও তার কাছে বেশ কিছু টাকা থেকে গেল। সে ভেবে রেখেছে অন্যান্য খরচা মিটিয়ে সে এর থেকে বিষ্টুর পুরনো ধারও কিছুটা শোধ করে দেবে।

    দীনুস্যাকরার কাছে মোহর পেয়ে একদিন ভোরবেলা সে সেগুলি মাটিতে পুঁতে দিতে গেল। কাজ শেষ করে ঘাম মুছছে, মনে হল পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। সে চমকে তাকিয়ে দেখল, বুড়োকর্তা। সে শশব্যস্তে হাত থেকে শাবল নামিয়ে রেখে হাতজোড় করে বলল, পেন্নাম হই কত্তা।

    কর্তা হেসে বললেন, তোর কাজ হয়ে গেছে তো? এখন যা, সামনের বছর আবার আসিস। আর শোন, গাঁয়ের চেনা-জানা আত্মীয়বন্ধুদের মধ্যে কারও বিপদেআপদে দরকার পড়লে আমার কাছে পাঠিয়ে দিস, টাকায় ওই পঁচিশ পয়সার বেশি নেব না। আমি মানুষটা খুব খারাপ নই৷

    সে হাসি চেপে বলল, যে-আজ্ঞে কর্তা।


    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments