–সিলভিনা ওকাম্পো (১৯০৩–১৯৯৩)
|| ১ ||
আর্হেন্তিনার রাজধানী বুয়েনাস আইরেস-এর শহরতলীতে সান ইসিডো এক বর্ধিষ্ণু মহল্লা—পাহাড়, নদী আর গাছপালা মিলে মনোরম পরিবেশ; ধনী আর অভিজাত মানুষদের বাগানঘেরা বাড়ি; রাগবি খেলা নিয়ে পাগল শহরটি; বয়েসে কলকাতার চেয়ে সামান্য কনিষ্ঠ—১৭০৭ সালে শহরটির প্রতিষ্ঠা; নদীর ধারের কাফেতে বসে ইস্পাতের পাত্রে রুপোর স্ট্র দিয়ে ‘মাতে’ নামক কড়া কফি পান করতে করতে শিল্প, সাহিত্য, ফুটবল, রাগবির আলোচনা। এই শহরের বাসিন্দা ওকাম্পো পরিবার—ধনী ব্যবসায়ী, অভিজাত আর্হেন্তিনার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত—সেইসঙ্গে শিল্প ও সাহিত্যের কেন্দ্রস্থল, স্পেন, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন, তিনটি দেশের সঙ্গেই সেই পরিবারের ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ। মানুয়েল ওকাম্পো এবং রামোনা আগুইরে ওকাম্পোর সব মিলিয়ে ছ’টি সন্তান। বড়ো মেয়ে রামোনা “বিক্তোরিয়া” এপিফানিয়া রুফিনা ওকাম্পো (১৮৯০–১৯৭৯)-কে আমরা চিনি রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা ছায়াসঙ্গিনী হিসেবে।
১৯২৪ সালে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণের সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথ এবং প্রায় দুমাসের জন্যে বিক্তোরিয়ার আতিথ্য গ্রহণ করেন। নিজের বসতবাটী ভিয়া ওকাম্পো থেকে কয়েক ব্লক দূরে মিরালরিও নামে একটি সদ্যনির্মিত বাগানবাড়ি ভাড়া করেন তিনি রবীন্দ্রনাথ এবং এল্মহার্স্টের বসবাসের জন্যে। তাঁকে একটি হিরের দামি গয়না বিক্রি করতে হয়েছিল কবি ও তাঁর সেক্রেটারির রাহাখরচ এবং তাঁদের জাহাজে ইয়োরোপ প্রত্যাবর্তনের টিকিটের জন্যে। কবির বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল; তিনি নদী ভালোবাসতেন, সেখানে বারান্দা থেকে দেখা যেত প্লাতা নদী। কবি তাঁর নাম দেন “বিজয়া” এবং ১৯২৫ সালে প্রকাশিত “পূরবী” কাব্যগ্রন্থটি তাঁকে উৎসর্গ করেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে তিনি “প্লাতা নদীর তীরে রবীন্দ্রনাথ” নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন—সেটি সাহিত্য একাদেমি প্রকাশিত ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ সম্পাদিত “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—শতবার্ষিকী সংকলন” গ্রন্থে (এটি ইংরেজি লেখার সংকলন—full name) সংকলিত হয়। ওই একই সময়ে প্রকাশিত হয় বুয়েনাস আইরেস শহরে তাঁর রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ক গ্রন্থ “তাগোর এন লাস বারানকাস দে সান ইসিদ্রো”—শঙ্খ ঘোষের “ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ” গ্রন্থে যার অনুবাদ “সান ইসিদ্রোর শিখরে রবীন্দ্রনাথ”।
বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় এসপানিওল ভাষার লেখক, সম্পাদক এবং নতুন প্রতিভা খুঁজে নেবার জহুরি হিসেবে। ১৯৩১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “সুর” (“দক্ষিণ”) নামে একটি যুগান্তকারী সাহিত্যপত্র, যেটি পরবর্তী চার দশকে লাতিন আমেরিকার নিরীক্ষামূলক সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। বিংশ শতাব্দীর সূচনায় বাংলা ভাষা ব্যবহারে নতুন পথ দেখিয়েছিল “সবুজপত্র”, কথাসাহিত্যে আলোড়ন তুলেছিল “কল্লোল”; আধুনিক কাব্যভাবনার খোলনলচে বদলে দিয়েছিল “কবিতা”। এই তিনটি সাহিত্যপত্রের অভিঘাতকে যোগ করলে বোঝা যাবে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে “সুর” পত্রিকার প্রভাব। সেখানে যোগ দিয়েছিলেন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অনুবাদক। অর্থসাহায্য দিয়েছেন আর সম্পাদনা করেছেন বিক্তোরিয়া নিজে; তাঁর সহকারী সাংবাদিক, অনুবাদক, ফ্যাশন বিশেষজ্ঞ পেলেগ্রিনা পাস্তোরিনা (১৯০২–১৯৮৮)। প্রথম সংখ্যা থেকে লিখেছেন স্পেনের দার্শনিক-প্রাবন্ধিক হোসে ওর্তেগা ই গসেত (১৮৮৩–১৯৫৫)। নিয়মিত প্রতিবেদক এবং কিছুদিনের জন্যে সম্পাদক হর্হে লুইস বর্হেস (১৮৯৯–১৯৮৬)। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন বিক্তোরিয়া নিজে। ১৯৩১ থেকে ১৯৭০, নিয়মিত প্রকাশিত হয় কাগজটি। এই “সুর” পত্রিকার একেবারে প্রথম পর্বের লেখকদের একজন হলেন বিক্তোরিয়ার সহোদরা সিলভিনা ওকাম্পো (১৯০৩–১৯৯৩)—কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক এবং লাতিন আমেরিকার স্বপ্নসম্ভব সাহিত্যের এক প্রধান ব্যক্তিত্ব।
|| ২ ||
ধনী ও অভিজাত পরিবারের সন্তান মানুয়েল ওকাম্পো পেশায় সিভিল এনজিনিয়ার—বিশাল বিশাল সেতু বানাতেন তিনি—বেশিরভাগ আর্হেন্তিনার রেলপথের জন্যে; তার মালিক এক ব্রিটিশ কোম্পানি, সেই সূত্রে ব্রিটেন এবং ইয়োরোপের সঙ্গে পরিবারটির নিয়মিত যোগাযোগ। ছ’টি সন্তান তাঁর, সবগুলি কন্যা। বিক্তোরিয়া সবচেয়ে বড়ো—তাঁর জন্ম ১৮৯০ সাল; সিলভিনা সবচেয়ে ছোট—তাঁর জন্ম জুলাই ২৮, ১৯০৩। সব বোনেদের জন্যেই বাড়িতে থাকত নানা বিষয়ের গৃহশিক্ষক/ শিক্ষিকা, প্রয়োজন ছিল না স্কুলে যাবার। সিলভিনার শিক্ষা শুরু ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায়, মাতৃভাষা এসপানিওলে হাতেখড়ি হবার আগেই। আজীবন তাঁর মাথায় আইডিয়া, চিত্রকল্প, শব্দবন্ধ এসে উপস্থিত হবে অন্তত তিনটি ভাষায় এবং তারা গা–ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে থাকবে তাঁর সাহিত্যে। জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষার মধ্যে বাস করবেন তিনি।
শৈশবে তিনি অল্পস্বল্প লিখতেন—বাবা–মা আর গৃহশিক্ষিকার মনোরঞ্জনের জন্যে, কিন্তু ভালোবাসতেন গান গাইতে আর পিয়ানো বাজাতে। কমবয়েসে মা–বাবার সঙ্গে নিয়মিত ফ্রানস ভ্রমণে গিয়ে ছবি আঁকায় আগ্রহ বাড়ে। সেই সময়কার লাতিন আমেরিকার অন্য অনেক শিল্পী–সাহিত্যিক–বুদ্ধিজীবিদের মতনই তিনি প্যারিসে গেলেন শিক্ষার জন্যে; ১৯৩১ সালে পিতার মৃত্যু—এর পরে তিনি আর দেশে ফিরলেন না দুবছর। ছবি আঁকার শিক্ষা নিলেন ইতালিয় পরাবাস্তববাদী চিত্রশিল্পী জর্জিও দে চিরিকো (১৮৯৮–১৯৭৮) এবং দুই ফরাসি কিউবিস্ট চিত্রশিল্পী ফার্নান্দ লেজের (১৮৮১–১৯৫৫) এবং আন্দ্রে লোহতে (১৮৮৫–১৯৬২)-এর কাছে। ১৯৩০-এর দশাব্দে তিনি ছিলেন ছবি আঁকায় মগ্ন কিন্তু তার পর ক্রমশ এই শিল্পে বীতশ্রদ্ধ হতে হতে চর্চা ছেড়ে দেন। কিন্তু পরাবাস্তববাদী এবং কিউবিস্ট চিন্তাভাবনা তাঁর সঙ্গে থেকে যাবে সারাজীবন।
সিলভিনা যখন চিত্রশিল্পের পাঠ নিচ্ছেন প্যারিসে, দিদি বিক্তোরিয়া ছিলেন বুয়েনোস আইরেস শহরে; পিতার মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকারের অর্থে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন “সুর” পত্রিকা এবং একই নামের প্রকাশনা সংস্থা। তাঁর বাড়িতে নিয়মিত আসতেন হর্হে লুইস বর্হেস—আড্ডা দিতে এবং পত্রিকার কাজে। ফ্রানসে সিলভিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হ’ল তাঁর দু বছরের ছোটো বোন নোরা বর্হেস (১৯০১–১৯৯৮)-এর—তিনি পরে সিলভিনার বেশ কয়েকটি বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণের কাজ করবেন। ১৯৩৩ সালে আর্হেন্তিনায় ফিরে তিনি “সুর” পত্রিকার কাজে নামলেন—সম্পাদনায় দিদিকে মদত দিতে এবং নিজের সাহিত্যচর্চায়। পরিচয় হ’ল দাদা বর্হেস-এর সঙ্গে—দুজনে বন্ধু থাকবেন সারা জীবন।
ঠিক যেমন বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে একদিন বিনা নোটিসে হাজির হয়েছিলেন কিশোর কবি সমর সেন, ১৯৩২ সালে বিক্তোরিয়ার বাড়িতে এলেন কিশোর গল্পকার আদোলফা বিয়য় কাসারেস (১৯১৪–১৯৯৯)। এর পর থেকে “সুর” লাগজে তিনি নিয়মিত লেখক, বিক্তোরিয়া ও হর্হের সঙ্গে তাঁর গাঢ় বন্ধুত্ব। বছর খানেক পরে সিলভিনা প্যারিস থেকে ফিরলেন—দুজনে দেখা হ’ল, প্রথমে সখ্য, তার পরে প্রেম—৩০ বছর বয়েসি সিলভিনা আর ১৯ বছর বয়েসি আদোলফো। সাত বছর সহবাসের পরে ১৯৪০ সালে তাঁদের বিবাহ—বর্হেস হলেন বিয়ের বেস্ট ম্যান এবং পরবর্তী পাঁচ দশকে দম্পতীর গৃহে নিয়মিত ডিনারের অতিথি।
দেশে ফিরে আসার পরে সিলভিনা মূলত গল্প লিখেছিলেন, আদোলফোর উৎসাহে তিনি কবিতাও লেখা শুরু করলেন। “সুর”-এ প্রকাশিত হ’ল তাঁর কবিতা ও গল্প। ১৯৩৭ সালে সুর প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হ’ল প্রথম গল্প সংকলন “ভিয়াহে ওলবিদাদো” (“বিস্তৃত যাত্রা”); পাঁচ বছর পরে প্রথম কাব্যগ্রন্থ “এনিউমেরাসিওন দেলা পাত্রিয়া” (“আমার দেশের আদমসুমারি”), প্রকাশ ১৯৪২ সাল। প্রথম দিকের কবিতায় তাঁর অনুসন্ধান আর্হেন্তিনার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী এবং ইতিহাস বিষয়ে, সমসাময়িক অন্য কবিদের মতই। এছাড়া রয়েছে তীব্র, ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ—পারিবারিক স্মৃতি, ঘনিষ্ঠতা, পায়ের তলায় মাটি সরে যাবার স্মৃতি। এই সংকলনের একটি বিখ্যাত কবিতা “সান ইসিদ্রো” আমি বাংলায় অনুবাদ করেছি। প্রেম ও যৌনতায় নারী ও পুরুষের চিরকালীন অসামঞ্জস্য অফুরন্ত নির্ঝর এখানে এবং পরবর্তী গ্রন্থগুলির কবিতায়। ছন্দে লিখতে পছন্দ করতেন তিনি, প্রথম দিকে তাঁর অনেক কবিতাই সনেট শৈলিতে রচিত। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “এসপাসিওস মেত্রিকোস” (“ছন্দোবদ্ধ পরিসর”) এবং ১৯৪৯ সালে আরও একটি “পোয়েমাস দে আমোর দেসেসপেরাদো” (“মরিয়া প্রেমের কবিতা”)।
কোনও সন্তান হয়নি এই দম্পতীর। সুদর্শন আদোলফো ঘনিষ্ঠতা চালিয়ে যান অন্য অনেক রমণীর সঙ্গে। ১৯৫৪ সালে তাঁর এক প্রেমিকা ‘মার্তা’ নামে এক কন্যার জন্ম দেন; সিলভিনা সেই কন্যাসন্তানটিকে দত্তক নেন ও প্রতিপালন করেন নিজের পরিবারে। মার্তা বিয়য় ওকাম্পো (১৯৫৪–১৯৯৪)-র মৃত্যু হয় ৩৯ বছর বয়েসে এক শোচনীয় গাড়ী দর্ঘটনায়। ডিসেম্বর ১৫, ১৯৯৩, দশ বছরের দীর্ঘ অসুস্থতার পরে সিলভিনা ওকাম্পোর মৃত্যু, পালিতা কন্যা মার্তার মৃত্যু তার তিন সপ্তাহ পরে। ৭৯ বছর বয়েসি আদোলফো তিন সপ্তাহের মধ্যে পত্নী এবং একমাত্র কন্যাকে হারান।
আদোলফোর ঔরসে এবং দেমারিয়া মাদেরোর গর্ভে ১৯৬৩ সালে জন্ম তাঁর একমাত্র পুত্র ফেবিয়ান বিয়য় কাসারেস-এর। তাঁরও অকালমৃত্যু প্যারিসে ২০০৬ সালে।
|| ৩ ||
১৯৪৬ সালে স্বামী–স্ত্রীর যৌথ প্রচেষ্টায় রচিত হয় এক নভেলা “যেখানে প্রেম থাকে, সেখানেই ঘৃণা” (“লস কে আমান, ওদিয়ান”); আগাথা ক্রিস্টির জনপ্রিয় “রইলো না আর কেউ” থ্রিলারের ধারা অনুসরণ করে তাঁরা লেখেন ব্যাঙ্গাত্মক ডিটেকটিভ গল্প অথবা রোমান্টিক স্যাটায়ার। ১৯৯০-এর দশাব্দে ১১২ পৃষ্ঠার এই নভেলাটির ইংরেজি অনুবাদ করেন সুজান জিল লেভিন (১৯৪৬- ) এবং জেসিকা আর্নেস্ট পাওয়েল। দুই অনুবাদকে মিলে বুয়েনোসে আইরেস গিয়েছিলেন লেখকদম্পতীর সঙ্গে দেখা করতে। সুজানের বর্ণনায়, “In her slacks and silk blouse, Silvina was a striking apparition, a short, sharp-featured woman with a notably nasal intonation.” তাঁর গল্পের চরিত্রগুলির মতন মানুষটিও রহস্যময়।
১৯৫০-এর দশাব্দে তাঁর কবিতায় পরিবর্তন আসে, ভাষা হয় সংযত এবং সংহত, তিনি মুক্ত ছন্দে অথবা গদ্য কবিতায় মন দেন বেশি। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “লস নোমব্রেস” (“নামগুলি”)—সেখানে উঠে আসে শৈশবের স্মৃতি এবং অধ্যাত্মচেতনার নানান সূত্র; গ্রন্থটি আর্হেন্তিনার “প্রেমিও মুনিসিপাল” পুরস্কার পায়।
এর পরে তিনি আরও প্রায় কুড়িটি গ্রন্থ রচনা করেন, তার বেশিরভাগই গদ্য--গল্প, নভেলা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, চিত্রনাট্য এবং আরও অনেক রচনা যাদের কোনও একটি ঘরানাতে খাপ খাওয়ানো অসম্ভব। তাঁর কথাসাহিত্য ও গদ্যভাবনা নিয়ে বিশদ আলোচনা জরুরি, কিন্তু এখানে তার অবকাশ নেই। রূপকথার আদলে বাস্তবসম্মত কাহিনি লেখেন তিনি, তাতে মানবের পাশাপাশি অবলীলাক্রমে দৈত্য-দানবরাও থাকে—একটি চরিত্র ভেঙ্গে-গড়ে একাধিক চরিত্র হয়ে দাঁড়ায়, আর তৈলচিত্রের মানুষ ফুরসত পেলেই গল্পগুজব করে যায় নিয়মিত। অথচ এসপানিওলভাষী জগতের বাইরে তাঁর নাম কেউ জানেন না বললেই চলে। ১৯৫৮ সালে তাঁর একটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন মার্কিন কবি উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস (১৮৮৩–১৯৬৩); “অসীমের ঘোড়াগুলি” নামের কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল “ন্যু ওয়ার্লড রাইটিং” পত্রিকায়। এর পরে ইংরেজিতে আর কেউ তাঁর কবিতা অনুবাদের চেষ্টা করেন নি। যদিও ইতালিয় ও ফরাসি ভাষায় তাঁর কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। ডিসেম্বর ১৪, ১৯৯৩—তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁকে নিয়ে এতটুকু হইচই হয়নি; ২০০৩ সালে তাঁর জন্মশতবর্ষেও না।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ “লো আমারগো পর দুলসে” (“মিষ্টির জন্যে তেতো”)—বাস্তবের সঙ্গে পরাবাস্তব এবং অধিবাস্তবের মেলামেশা সেখানে। দশ বছরের বিরতির পর প্রকাশিত হয় “আমারিও সেলেস্তে” (“স্বর্গীয় হলুদ”), প্রকাশ ১৯৭২—প্রাণীজগত আর উদ্ভিদজগতের সঙ্গে তাঁর আবেগময় ঘনিষ্ঠতা। সেই ধারাটি চলতে থাকে জীবৎকালে প্রকাশিত অন্তিম কাব্যগ্রন্থে “আরবোলেস দে বুয়েনোস আইরেস” (“বুয়েনোস আইরেস-এর বৃক্ষগুলি”)—প্রকাশ ১৯৭৯। শেষজীবনে রচিত কবিতাগুলি প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে, তাঁর মৃত্যুর আট বছর পরে, “পোয়েসিয়া ইনএদিতা ই দিসপার্সিয়া” (“অপ্রকাশিত ও ছড়ানো–ছিটানো কবিতা”)।
সিলভিনা নিয়মিত অনুবাদ করেছেন ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা থেকে কবিতা ও গদ্য এসপানিওল ভাষায়—জন ডান, বোদলেয়ার ও ভেরলেন-এর নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁর জীবনের শেষ কাব্যগ্রন্থ একটি অনুবাদ—মার্কিন কবি এমিলি ডিকিনসন (১৮৩০–১৮৮৬)-এর ৬০০টির বেশি কবিতার অনুবাদ সংকলিত হয় ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত “পোয়েমাস” গ্রন্থে।
তাঁর রচনাকে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই, তাকে অনুভব আর উপভোগ করলেই খুশি হবেন কবি। দীর্ঘদিন ইংরেজি ভাষার পাঠকের কাছে অজ্ঞাত থাকার পর ২০১৫ সালে জেসন ওয়েইসের অনুবাদ ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হিয়েছে তাঁর “নির্বাচিত কবিতা”। আমি এখানে তার থেকে কয়েকটি বেছে নিয়ে বাংলা অনুবাদ করেছি। আর অপেক্ষায় রয়েছি তাঁর কবিতা সমগ্রের।
সান ইসিদ্রো / সিলভিনা ওকাম্পো
দিদিভাই বিক্তোরিয়ার জন্যে
দিদিভাই, তোর সান ইসিদ্রোর ভিলা, আমি
ভালবাসবো চিরকাল; তোর সহিষ্ণু গিরিসংকট,
ঢেউ খেলানো জমি, সাবুগাছের সারি, ত্রিশূলের মতন
দেখতে বন্য উদ্ভিদগুলো—বেগুনি ও লাল ফুলওয়ালা,
সিন্দুকে ভরা রঙিন ছাতা, শরীর জুড়ানো হাতপাখা,
চেকার্স খেলার বোর্ড, গ্রামের গরীব ছেলেমেয়েগুলো
আর ঘন সবুজ পাতা।
চিরকাল আমি ভালবাসবো সিডার কাঠের আসবাব,
কারুকার্যময় যত অলংকার; ত্রিভূজ, বর্তুলাকার, বহুভূজ,
আর কুঞ্জবিতানে শান্ত, মধুর সঙ্গীতের পরিবেশ।
দোতলায় উঠে, ইলেকট্রিক আলোর মুকুটপরা
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক স্বর্গীয় গর্ভবতী,
অন্ধকার ঢাকা বারান্দায় চাঁপাফুলের সুবাস
অন্য বাগানের মধ্যে দিয়ে ভরিয়ে দেয় গৃহের বাকি অংশ:
সেলাইঘর, জামাকাপড় ইস্তিরির কক্ষ,
আলমারির ভাঁজ করা টেবিলক্লথগুলোতে
শাদা রঙের লিলি, কমলা রঙের শর্করামিষ্ট
মাকড়সার জালের এমব্রয়ডারি।
ঘরে পা দিয়েই শুনি পিয়ানো; গ্রীষ্মকালে
শোপ্যাঁ, রেভেল অথবা শ্যুমান,
দোয়েল গান গায় নুয়ে পড়া গাছের ডালে,
দেয়ালে আটকানো মরচে-ধরা চাকা,
সম্প্রতি কেনা কয়েকটি গাছ আর প্রস্তরমূর্তি, আর
আশা করি দেখতে পাবো দূরের জলাভূমিতে আলেয়া।
সবকিছুতেই গাছ গজায় এই ভিলাতে
গাছেরা কেড়ে নেবে তোমার স্নেহ–-তাতে
ভাগ বসাবে মালি, ফুলের টব, বেঞ্চি
আমি নিজে, ওপরে ওঠার সিঁড়ি, শাদা দস্তানা,
শুকনো পাতা আর খড়কুটোর স্বচ্ছ আগুন,
কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া, রেশম গাছের ফাঁকে ফাঁকে
বয়ে যাওয়া বাতাস, অনেক দিনের চেনা টালির ছাদ,
ঝিঁঝি আর উচ্চিংড়ের অবিচল, একটানা ধ্বনি।
কোদালের শব্দ থেমে গেলে
দ্রুত বেড়ে ওঠে বৃক্ষগুলো
তাদের গা বেয়ে জড়ায় মাধবীলতা;
যখন তুমি সবকিছু মুছে যাবার অপেক্ষায়:
ঝুড়ির মধ্যে পিচফলের লাজুক হাসি,
সবুজ তৃণভূমিতে সূর্যের অপার কিরণ,
তোমার অতিথিদের দিবানিদ্রা—ফিনফিনে
রেশমি কাপড়ের মশারির জেলখানায়,
গানের আসরের শ্রোতাদের মতন নির্বাক।
একবার ঘুম ভাঙলে পালাবার উপায় নেই:
এক রাত্তিরে রাস্তার কুকুরকে ছুরি মারলো
দুর্বৃত্তেরা, নতুন আলকাতরা বিছানো পথে
হেঁটে যাওয়াটাও অ্যাডভেঞ্চার।
গিরিখাত ধরে পালানোর পথ নেই, কারণ
প্রতিটি চাঁদের কিরণে শাদা রঙের ছায়া পড়বে
সুবিধাভোগী কয়েকজন চোর, তাদের ডানা রয়েছে
দেবদূতের মতন—জানালার কাচ বা বারান্দার
গ্রিলের পাশ দিয়ে তারা লাফিয়ে সরে গেলে
বিব্রত নও তুমি—তারা সিঁড়ির দিকে যাবেও না,
ঘন্টাও বাজবে না সদর দরজায়।
যে রাতে বন্দুকের আওয়াজ, সান্ত্রীর চিৎকার—
সারারাত জেগে রয় দোয়েল পাখি।
সান ইসিদ্রোর ভিলাগুলো, হতভম্ব
আকাশে চেয়ে থাকে পরদেশির মতন,
জানি তোমায়, তোমায় ট্রাইসাইকেল, তোমার অশ্রু,
তোমার হুপিং কাশি, তোমার হাতে-বোনা শাল,
নদীর ওপরে ফোটা লাইলাক আর চ্যাপ্টা কেঁচোর দল,
সারান দি মহল্লা আর তার অস্পষ্ট গলিপথগুলো,
একখানা চাঁদ আর শনিগ্রহের বলয়সমূহ,
শীতল এবং যুদ্ধে ব্যবহৃত দূরবীক্ষণ দিয়ে দেখলে
গোমড়া আকাশে দেখতে আকারে বড়ো লাগে,
স্টিরিওস্কোপের রহস্যময় আলোতে;
পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আর র্যাকে ঝোলানো
প্রাচীন টুপিগুলো—অনেক আয়নার ফাঁক দিয়ে,
শাদা রঙের বার্চগাছ, বিরল পাইন বৃক্ষ,
মটরশুঁটির ফুলে ভরা লতা এবং সন্ধেটার দৈর্ঘ্য
বেড়ে যায় অনির্দিষ্ট কালের জন্যে ধীর ও মধুর
তালপাতার হাওয়ায়—তার সঙ্গে সঙ্গে চলে
মেঘেদের নিখুঁত অভিনিবেশ এবং
গোলাপের নিজস্ব আমোদ।
San Isidro
টীকা:
শোপ্যাঁ—ফ্রেডেরিক শোপ্যাঁ (১৮১০–১৮৪৯), পোল্যান্ডের সঙ্গীতকার।
রেভেল—জোসেফ মরিস রেভেল (১৮৭৫–১৯৩৭), ফরাসি সঙ্গীতকার।
শ্যুমান—রবার্ট শ্যুমান (১৮১০–১৮৫৬)—জর্মন সঙ্গীতকার।
আলেয়া—আর্হেন্তিনার লোককথায় “লুস মালা” (“শয়তানের আলো”)—সেখানকার গ্রামের লোকে এখনও ভয় পায়; এমন আলো চোখে দেখলেই সাক্ষাৎ মৃত্যু।
বিরল পাইন বৃক্ষ—বৈজ্ঞানিক নাম “আরাউকারিয়া আরাউকানা”, চিলে আর আর্হেন্তিতাতে দেখতে পাওয়া যায়।
বারান্দা
পারী শহরের এক গ্রীষ্মের বিকেলে বারান্দায়,
একা উদাসীন বসে সিডার বৃক্ষের দিকে চেয়ে
দূরে এক হ্রদ তার জলরাশি অপূর্ব সুনীল
সেইবো বৃক্ষের আর পাখির গানের থেকে দূরে।
আমাদের ভালো লাগে আরও এক শূন্যতর ভূমি:
একটাও তালগাছ দিগন্তে দর্শনে নেই বলে
দুঃখ হয়, পাখিরাও ডাকে না প্রত্যূষে নিদ্রাশেষে—
নেই ঘোলা কাদা জল, ডিঙিনৌকোর আনাগোনা।
আমি তীব্রভাবে চাই আমার নিজস্ব প্লাতা নদী!
বিশ্বস্ত অবর্তমানে তার, তবু ভাবি অকৃতজ্ঞ আমি,
এখানে নিজেকে মনে হয়: বিদেশি, অচেনা এক নারী:
বারান্দা হারিয়ে গেছে, তালগাছ রয়ে গেছে স্থিত,
সিডার দিগন্তে নেই, ঘোলা স্রোত রয়ে গেছে মনে;
আহা কী সুনীল ছিল হ্রদ, তার পাশে গোলাপের বীথি!
টীকা:
সেইবো (Ceibo)— আর্হেন্তিনার জাতীয় বৃক্ষ, তার লালচে গোলাপি ফুল আর্হেন্তিনা এবং উরুগুয়াই-এর জাতীয় ফুল। বৈজ্ঞানিক নাম: “ইরাইথ্রিনা ক্রিস্তা-গাইই”। সিলভিনার মধ্য ও শেষ পর্বের কবিতা উদ্ভিদময়—বৃক্ষ, লতা, ফুল, পাতা, ওষধির উল্লেখ সেখানে।
অদ্বিতীয় প্রজ্ঞা
একমাত্র যে জিনিসটা আমরা জানি
যা আমাদের মনে বিস্ময় জাগায়:
পৃথিবীতে সব কিছু এমনভাবে ঘটে,
যেন আগে কখনও সেটা ঘটেনি।
[Singular Wisdom]
প্রমাণহীন ছবি
দেবী পরিণত হল গণিকায়;
সিংহ, বানর, দেবদূত ও মাছ মিলে
তৈরি হয় উদ্যান;
লুকোচুরি ক্রীড়ারত চারটি শিশু
পরিণত সৈকতে।
সময় অথবা সুযোগের আনুকূল্যে
এক ছবির ক্যানভ্যাসে উঠে আসে
অন্য এক ছবি—যেটা আসল,
যেমন আমাদের স্মৃতি।
[Apocryphal Picture]
নিশীথে
গৃহগুলি স্বপ্ন দ্যাখে রাতে
আঁধারে, বৃষ্টিতে আর ঝড়ে
তারা পরিণত তরণীতে।
[Nocturne]
বিহ্বলতা
যখন আমি প্রার্থনায় নতজানু
কেন সর্বিদাই মনে হয়,
“পা দুটো আমার কী করছে এখন?
[Perplexity]
মূল এসপানিওল এবং জেসন ওয়েইস-এর ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে।
তথ্যসূত্র:
Victoria Ocampo—Against the Wind and the Tide; Doris Meyer, George Brazillier, New York; 1979
Thus Were Their Faces—stories; Silvina Ocampo; Translated by David Balderston; New York Review of Books; 2015
Silvina Ocampo—Selected and Translated by Jason Weiss; NYRE Poets; 2015
The Topless Tower—Silvina Ocampo—Translated By James Wonack; Hesperus, Worldwide; 2010