• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | উপন্যাস
    Share
  • হারাধন টোটোওয়ালা (১৫, শেষ) : সাবর্ণি চক্রবর্তী



    ।।১৭।।

    বেবির বিছানায় খাটের মাথার ধারের উঁচু জায়গাটায় হেলান দিয়ে আয়েস করে চা খাচ্ছিল হারা। এক হাতে চায়ের পেয়ালা অন্য হাতে পেয়ালাটার নিচে হারা ধরে রেখেছে একটা ছোটো প্লেট। চায়ের ফোঁটা বিছানায় না পড়ে যায়। সেরকম হলে আর দেখতে হবে না। গালাগাল খিস্তিখাস্তার ঝড় বইয়ে দেবে বেবি। হারার সেরকম অভিজ্ঞতা আছে।


    চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে পেয়ালা আর প্লেট খাটের পাশে রাখা নিচু টেবিলটার ওপর নামিয়ে রাখল হারা। খাটের পায়ের দিকে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো আলমারিটার সামনে দাঁড়িয়ে বেবি হারার দিকে পেছন ফিরে সামনে ঝুঁকে ওর জামাকাপড় গোছাচ্ছিল। হারা বেবিকে পেছন থেকে দেখতে দেখতে দুম করে কথাটা বলে ফেলল, জানিস বেবি, বাতাসির বাচ্চা হবে।

    বেবি জামা গোছানো রেখে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। আলমারি বন্ধ করে তাতে চাবি লাগাল। তারপর ঘুরে হারার মুখোমুখি হল। চোখ আর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কি বললি?

    বেবিটা ঘোর খচ্চর, হারা ভাবল। ও কথাটা শুনতে পেয়েছে ঠিকই, ফালতু ঢং করছে। বাতাসির বাচ্চা হবে, আবার বলল হারা। আমি বাপ হব।

    বেবি হাসতে শুরু করল। কোমরে দু হাত দিয়ে, সোজা দাঁড়িয়ে, সামনে ঝুঁকে, মাথা পেছনে হেলিয়ে, মুখে আওয়াজ করে পুরো মিনিটখানেক ধরে হাসল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, ওহো, তাই আজকাল আমার কাছে আসা কমিয়ে দিয়েছিস। বৌএর সঙ্গে খুব কষে পীরিত করছিস বুঝি?

    হারা কোনো জবাব দিল না। এসব প্রশ্নের কোনো জবাব হয় না। হলেও সে জবাব না দেয়াই ভাল। তাছাড়া বেবির কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। গত মাসখানেক হারা বেবির কাছে একটু কম আসছে। অবশ্যি তাতে বেবির কোনো আর্থিক ক্ষতি নেই। ওর ব্যবসা খুবই বড়, হারার আসা বা না আসা ওর কাছে সাগরে না হলেও একটা বিরাট পুকুরে একঘটি জল কমবেশি হওয়ার মতো একটা ব্যাপার। কিন্তু ওর ইজ্জতে লাগে। হারাকে ও নিজস্ব একটা সম্পত্তির মতো মনে করে। ওর কাছে আসা কমিয়ে দিয়ে হারা বাতাসির কাছে পড়ে থাকবে ওর সেটা বরদাস্ত হবে না। হারা সেটা জানে, কাজেই ও চুপ করে রইল।

    বেবি-ই আবার কথা বলল। একটা শয়তানির হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁরে বিয়ের এত বছর পরে তুই বাপ হচ্ছিস, ঠিক জানিস তো যে তুই-ই বাচ্চাটার বাপ? অন্য কোনো পুরুষমানুষ বাতাসির সঙ্গে সুখ করে নেয় নি তো?

    এবারে হারা আর চুপ করে থাকতে পারল না। একটু রেগে গিয়েই বলল, যা:, কি যে আজে বাজে কথা বলিস। বাতাসি ওরকম মেয়ে নয়। তুই তো ওকে ছোটবেলা থেকে চিনিস, তুই কি করে ওর নামে ওসব বাজে কথা বলছিস? ওর বাচ্চা হওয়ার ব্যাপারে একটু শরীরের অসুবিধে ছিল। গত একবছর ধরে লক্ষ্মীমাসি ওর চিকিৎসা করিয়েছে। পাশ করা মেয়ে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা। প্রচুর ওষুধ ফষুধ খেয়েছে। তারপর ওর পেটে বাচ্চা এসেছে।

    বেবি ভালোমানুষের মতো একটা মুখ করে ইচ্ছে করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর সাধু মহাপুরুষের মতো একটা বাণী দিল, তোর কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবই বদলায়। কার যে কবে কি মতি হয় তা কি আগে থেকে কখনো বলা যায়? এই যে তুই, কখনো কি তুই ভেবেছিলি যে বৌকে ছেড়ে অন্য একটা মেয়েমানুষের কাছে আসা যাওয়া করবি? বাতাসিরও কার সঙ্গে কখন আশনাই হয়েছে তা কি বলা যায়?

    বেবির সন্ধেবেলার সাজগোজ করার সময় হয়ে গিয়েছিল। সেজন্যে হারা আর কথা বাড়ায় নি, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চলে এসেছিল। কিন্তু ও বেবির কথাটা মেনে নিতে পারে নি। বেবিটা ধুরন্ধর শয়তান। হারা আর বাতাসির বাচ্চা হবে সে ব্যাপারটা ওর ভালো লাগে নি। সেজন্যে ও এসব উল্টোপাল্টা কথা বলছে, হারার মাথায় বাতাসির ওপর একটা কুৎসিৎ সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।

    কিন্তু হারা বেবির কথাটা মাথার থেকে একেবারে ঝেড়েও ফেলতে পারল না। মাঝে মাঝেই ওর মনে হতে লাগল, আচ্ছা, বেবির কথাটা কি ঠিক? যদি ঠিক হয়? বাতাসি তো অনেকদিন ধরে জানে হারা অন্য মেয়েমানুষের কাছে যায়। বাতাসি যদি ওর ওপর শোধ নেবার জন্যে ইচ্ছে করে অন্য কোনো পুরুষকে সুযোগ দিয়ে থাকে? বাতাসি দেখতে ভালো নয়, সে কথা ঠিক, কিন্তু মুফতে এরকম একটা সুযোগ যদি পায় কোনো ব্যাটাছেলে কি আর সেটা ছেড়ে দেবে? সেই সময়তে কি আর সে ভাবতে বসবে মেয়েছেলেটা দেখতে ভালো কি ভালো নয়? সুযোগটা নিয়েই নেবে। কিন্তু, কিন্তু বাতাসি কি সেরকম করতে পারে? ও কি সেরকম শয়তান মেয়ে? না না, বাতাসি কক্ষনো সেরকম করে নি। হারা বাতাসিকে ছোটবেলা থেকে দেখছে, একসঙ্গে খেলা করে বড় হয়ে উঠেছে, ওর পক্ষে এরকম করা একেবারেই সম্ভব নয়। বাতাসির পেটের বাচ্চা ওর-ই। হারার মনটা আবার ভালো হয়ে ওঠে। বৌটাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।

    কিন্তু বৌকে নতুন করে মনে ধরলেও হারা বেবিকে ছাড়তে পারল না। বেবির একটা প্রচণ্ড পুরুষ টানবার শক্তি আছে, ও হারাকে একটা চুম্বকের মতো টানে। দু-তিনদিন বেবির কাছে না গেলেই ওর মনটা ছটফট করে ওঠে, ও সটান বেবির কাছে চলে যায়। যখনই যায় বেবি ওকে অজানা পুরুষের সঙ্গে বাতাসির আশনাই নিয়ে খোঁচা দেয়। ও উত্তর দেয় না, খালি একটু একটু হাসে। কিন্তু আবার ও বেবির কাছে যায়। না গিয়ে ওর উপায় নেই। একটা তীব্র টান তো আছেই, সে ছাড়াও ও বেবিকে একটা কারণে একটু ভয় পায়। বেবির কাছে যাওয়া একেবারে বন্ধ করলে ও যদি সোজা লক্ষ্মীমাসির বাড়ি গিয়ে একটা হাঙ্গামা বাধিয়ে দেয়? একটা বিশ্রী কেলেঙ্কারি হবে তাহলে।

    কয়েক মাস দেখতে দেখতে কেটে গেল। সেই যে বেবি ওকে প্রথমদিনে বলে দিয়েছিল তারপর থেকে হারা নিয়ম করে আগে ওর গাড়ি বেঁধে নেয়, তারপর গিয়ে বেবির দরজার ঘন্টি বাজায়। সেদিন গাড়ি বেঁধে রেখে হারা বেবির দরজার দিকে এগোচ্ছিল, এমন সময় পেছন থেকে ও একটা পুরুষের গলার ডাক শুনতে পেল, ও সাহেব, একটু শুনুন।

    হারা ডাকটা শুনে একটু বিরক্তি বোধ করল। এখন শীত গিয়ে গরম পড়তে শুরু করেছে, আজকের দিনটাতে রোদের ঝাঁঝ তো আছেই, একটু হাওয়াও দিচ্ছে না কোথাও। হারা অনেকগুলো খেপ খেটেছে আজকে, ঘেমে নেয়ে ক্লান্ত হয়ে আছে। এমন সময় কোথায় বেবির বিছানায় পাখার তলায় শুয়ে আয়েস করবে, না পেছন থেকে কেউ একটা ওকে ডাকল। বিরক্তভাবেই ও পেছন ফিরে তাকাল।

    ওকে ডাকছে এখানকার একজন দালাল। হারা এখন এ জায়গার সব কটা দালালকে চেনে, দাললারাও ওকে চেনে, খাতির করে। বেবিদিদির বাঁধা খদ্দের, পীরিতের লোক, তার তো খাতির হবেই। দালালটা ওকে বলল, বেবিদিদির ঘরে লোক আছে। আপনি এসেছেন, আমি খবর দিচ্ছি।

    হারা একটু অবাক হয়ে গেল। বেবি তো এসময় ঘরে হারাকে ছাড়া আর কোনো লোক নেয় না। আজ হঠাৎ কি হল। ও একটু বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

    দালাল লোকটা ততক্ষণে ওর মোবাইলে নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করেছে। নিশ্চয়ই বেবিই ওকে বলে রেখেছে হারা এলে ওকে খবর দিতে। লোকটা কথা বলে ওর মোবাইল ওর পকেটে রাখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেবির ঘরের দরজা অল্প ফাঁক হয়ে খুলে গেল, আর সেই ফাঁক দিয়ে বেবির মুণ্ডু বেরিয়ে এল। মুণ্ডুর মুখটা খব সাজগোজ করা, আর এটাও বোঝা যাচ্ছে যে মাথাটার নিচে যে ধড়টা রয়েছে সেটায় কোনো কাপড় চোপড় নেই। বেবি হারাকে বলল, তুই একটু মিনতির ঘরে বোস, আমি খালি হয়েই তোকে ডেকে নেব। এই ছোটু, তুই ওকে মিনতির ঘরে নিয়ে গিয়ে বসা।

    বেবির মুণ্ডু ভেতরে ঢুকে গেল, ঘরের দরজাও বন্ধ হয়ে গেল।

    মিনতির ঘরটা লম্বা বারান্দাটার একেবারে শেষে। ছোটু খুব খাতির করে হারাকে সেখানে নিয়ে গেল। আর যেতে যেতেই হারাকে বেবিদিদির ঘরের লোকটার অনেক খবর জানিয়ে দিল। শেঠ খুব মালদার, সিনেমা লাইনের লোক, আরও অনেক ব্যবসা আছে। শেঠ অনেক অনেক টাকার মালিক, কলকাতার পয়সাওয়ালা বড়লোকেরা তার তুলনায় কিছুই নয়। সমানে মুম্বাই কলকাতা যাওয়া আসা করে, কলকাতায় এলেই বেবিদিদির কাছে আসে। হারা গম্ভীর হয়ে ওর কথা শুনল। বেবির কাছে ওর আসার সময়ে অন্য লোক আসে এটা ভাবতে ওর ভালো লাগে না। অথচ ও খুব ভালোই জানে বেবির ব্যবসাটা কি, ওর কাছে বহু লোক আসে, ও তাদের থেকে কেন টাকা পায়। তবে ও এটাও বোঝে যে ওর মনোভাবটা একটু অদ্ভুত, ও চেষ্টা করে বেবির কাছে অন্য অনেক লোকের আসাটা স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে, কিন্তু মনের মধ্যে একটা কাঁটা ঠিকই থেকে যায়।

    মিনতি খুব যত্ন করে হারাকে ঘরে বসাল। হারা ওকে আগে কখনো দেখে নি। ওর বয়েস বোধ হয় বেবির থেকে কম, এ লাইনে হয়তো খুব বেশিদিন আসে নি। কিন্তু ওকে দেখতে ভালো নয়। গায়ের রঙ ময়লা, চেহারাটা রোগা, ক্ষয়াটে। ওর ঘর বেবির ঘরের থেকে ছোটো, আর আসবাবও বিশেষ কিছু নেই। এক পাশে একটা তক্তপোষ, তার ওপরে ময়লা বিছানা। পরিষ্কার বোঝা যায় যে ওর ব্যবসা খুব একটা ভালো চলে না। হারা ঐ ময়লা বিছানাতেই বসল, আর তো কোথাও বসার জায়গা নেই। ঘরের এককোণে একটা কেরোসিন স্টোভ রয়েছে, সেটাতে বোধ হয় মিনতি রান্নাবান্না করে। ওটা জ্বেলে মেয়েটা চা তৈরী করে হারাকে খেতে দিল। পেয়ালাটা ময়লা, দু-এক জায়গায় চলটা উঠে গেছে। ঐ পেয়ালাতে চা খেতে হারার মন লাগছিল না। কিন্তু এই রোগা কালো মেয়েটা এত যত্ন করে হারাকে চা বানিয়ে দিয়েছে। একটুও না খেলে ও দুঃখ পাবে। হারা চা-য়ে ছোটো ছোটো কয়েকটা চুমুক দিল, তারপর পেয়ালাটা হাতে ধরে রইল। মিনতি ওর পাশে গা ঘেঁষে বসেছিল, নানা কথা বলছিল। হারা ওর কোনো কথাই কানে নিচ্ছিল না, খালি ওর দিকে তাকিয়ে ওর কথা শোনার ভান করছিল। বেবির ঘরে লোক থাকায় ওর একটু রাগ হয়েছে, ও সেই রাগটাকে চাপার চেষ্টা করছিল।

    এই সময়তেই খবরটা এল। হারা ওর প্যান্টের পকেটে ওর মোবাইল ফোনটা রাখে, তাতে খবর আসার শব্দ পেয়েছিল। ও চায়ের পেয়ালাটা মেঝেয় নামিয়ে রাখল, পকেট থেকে মোবাইল বার করে খবরটা দেখল। ওটা পাঠিয়েছে গৌরা। খবরটা ভালো নয়। হারা একবার পড়ল, আবার পড়ল। বাতাসি পড়ে গিয়েছিল, রক্তপাত হচ্ছে। অজ্ঞান হয়ে আছে। বাড়ির কাছের সরকারি হাসপাতালটায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাড়াতাড়ি চলে আয়।

    হারা মিনতির বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠল। মিনতি কথা বলা থামিয়ে ওকে দেখছিল। এবার ওকে জিজ্ঞেস করল, কি খবর এসেছে? দরকারি কিছু?

    মিনতিকে সব কথা ভেঙে বলার প্রশ্ন ওঠে না। হারা শুধু বলল, আমাকে এখন যেতে হবে। খুব দরকার। তারপর ওর মানিব্যাগ হাতড়ে একটা একশো টাকার নোট মিনতির হাতে দিয়ে বলল, এটা তুমি রাখো।

    মিনতি টাকাটা নিল। কেউ বিনা কারণে টাকা দিলেও তা ফিরিয়ে দেবার মতো অবস্থা ওর নয়। ও হারাকে একগাল হাসি দিয়ে বলল, তুমি খুব ভাল লোক। তুমি বেবিদিদির ঘরে যাও তা আমি জানি। কিন্তু আমার কাছেও এসো মাঝে মাঝে।

    হারা ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তারপর ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

    বেবির ঘরে লোক এখনও বেরোয় নি। এ অবস্থায় ওর সঙ্গে এখন কথা বলা যাবে না। হারা বেবির মোবাইলে খবরটা পাঠিয়ে দিল। তারপর ওর তিনচাকার বাঁধন খুলে তাতে স্টার্ট দিল।

    হারাকে গাড়ি বাড়িতে রেখে যেতে হল। হাসপাতাল যে জায়গায় সেখানে এ জাতীয় তিন চাকার গাড়ি নিয়ে যাবার নিয়ম নেই। হাসপাতালের বিল্ডিং এর বাইরে গৌরা আর ওর কয়েকজন বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে। ওরা বিড়ি খাচ্ছে, নিজেদের মধ্যে নিচুগলায় কথা বলছে। ওখানে রোগীদের বাড়ির লোকজনদের বসার জায়গাও রয়েছে। কিন্তু সব জায়গা ভরতি, একটা বেঞ্চের এককোণে লক্ষ্মীমাসি কোনোরকমে বসে আছে। হারাকে দেখেই মাসি হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকল। বেঞ্চটার পাশে একটু খালি জায়গা, হারাকে সেখানে দাঁড় করিয়ে ওর একটা হাত চেপে ধরে রইল। মাসি তার আর এক হাতে একটা কালো রঙের বড়ো হাতব্যাগ নিজের পেটের সঙ্গে চেপে ধরে আছে। ওতে বোধ হয় টাকা আছে, হারা ভাবল। বাতাসিকে এখানে নিয়ে আসতে নিশ্চয়ই অ্যাম্বুলেন্স দরকার হয়েছে, তাতে অনেক খরচা হয়েছে। তাছাড়া হাসপাতালে বাতাসিকে ভর্তি করতেও কিছু টাকা লেগেছে। তার সঙ্গে এদিক ওদিক টাকা দেওয়া তো আছেই। লক্ষ্মীমাসির মুখটা শুকনো। বাতাসির অবস্থা খুব একটা সুবিধের নয়। জ্ঞান নেই, ডাক্তারবাবুরা বিশেষ ভরসা দেন নি। খালি বলেছেন, দেখা যাক।

    বাতাসির জ্ঞান আর ফিরে এল না। ঐ অবস্থাতেই কয়েক ঘণ্টা রইল, তারপর খবর এল, রোগী মারা গিয়েছে।

    এই অবস্থায় যা কিছু করার তা গৌরাই করল। হাসপাতাল থেকে ডেথ সার্তিফিকেট নেওয়া, বডি ছাড়ানো থেকে শুরু করে বাতাসিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা, সব ও-ই করল। ওর এক বন্ধু একটা ছোটো হাতি চালায়, কপাল ভালো সেটার তখন, কোনো ভাড়া খাটার ব্যাপার ছিল না। গৌরা ফোন করতেই ওর সেই বন্ধু গাড়ি নিয়ে চলে এল। হারা কেমন ভ্যাবলা মেরে গিয়েছিল, ও কোনো কাজই নিজের থেকে করতে পারছিল না। ও খালি কয়েকটা জায়গায় সই করল, সে-ও গৌরা ওকে বলে বলে করাল।

    বাতাসিকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হল ওদের বাড়িতে। সেখানে পড়শি মেয়েদের একচোট কান্না, সেই সঙ্গে বাতাসিকে ভালো একটা শাড়ি পরানো, ফুল চন্দন দিয়ে সাজানো। মালতিও খানিকটা কাঁদল, যদিও বাতাসি মারা যাওয়াতে ও খুব একটা দুঃখ পায় নি। লক্ষ্মীমাসি আওয়াজ করে কাঁদে নি। খালি মাসির চোখের জল গড়িয়ে গড়িয়ে দু গালের ওপর পড়ছিল, মাঝে মাঝে মাসি নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়ে তা মুছে নিচ্ছিল।

    সাজানোর পর ঐ ছোটো হাতিতেই বাতাসিকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানেও এটা ওটা সেটা খরচা। লক্ষ্মীমাসি সঙ্গে দিল, সব টাকাই এল মাসির ঐ ব্যাগের থেকে। গৌরার বন্ধুও ছোটো হাতির আদ্ধেক খরচা আগেই নিয়ে নিয়েছে। শ্মশানে গিয়ে গৌরা একবার হারাকে ফিসফিস করে বলে দিল, মা-র অনেক খরচা হয়ে যাচ্ছে, টাকাটা তুই পরে দিয়ে দিস।

    মৃতের মুখাগ্নি করতে হবে হারাকে। হাতে জ্বলন্ত পাটকাঠি নিল হারা। পুরুৎ কি সব মন্ত্র বলে যাচ্ছে, সে সব ওর কানে যাচ্ছিল না। ও নিচু হয়ে বাতাসির চন্দনে সাজানো মুখটা দেখছিল। শান্ত একটা মুখ, চোখের পাতা দুটো বোজানো, আরামে ঘুমোচ্ছে বাতাসি। ওর মুখটা দেখতে দেখতে হারার মাথায় একটা চিন্তা ভেসে এল, বৌটা দেখতে নেহাৎ খারাপ ছিল না। তারপর ও মরা বৌ-এর মুখে জ্বলন্ত পাটকাঠি ছোঁয়াল।

    সেদিন সকাল থেকেই অল্প অল্প মেঘ করেছিল। ফেরার পথে ইলশেগুঁড়ি বিষ্টি নামল। অসময়ের মেঘ, অসময়ের বিষ্টি। সমুদ্রে কোথায় নিম্নচাপ না কি একটা হয়েছে, তার জেরে এই বিষ্টি। দেহ পোড়ানোর কাজ শেষ করে ছোটো হাতির মাল রাখার খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে ওরা ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরল। রাতেও চলল এই বিষ্টি। দুজনের বিছানায় শুয়ে জেগে থেকে হারা সারা রাত ধরে ঐ বিষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে লাগল।

    ।।১৮।।

    বাতাসি মারা যাবার পর একটা মাস দেখতে দেখতে কেটে গেল।

    সকালের ইশকুলের খেপটা শেষ করে হারা এসে ওদের পছন্দের চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল। এখন ও আর খুচরো ভাড়ায় যাবে না। সেই ইশকুলের ছুটি হবার সময় সেখানে যাবে, বাচ্চাগুলোকে ফেরত নিয়ে আসার জন্যে। আজকাল ওকে একটা অদ্ভুত আলসেমি পেয়ে বসেছে, ও নিজেও সেটা বুঝতে পারে। বেশি করে কাজ করবার, আর সেই কাজ করে বেশি করে টাকা রোজগার করবার তাগিদ ও আর অনুভব করে না। খালি মনে হয় কি হবে ওসব করে? বৌটা মারা যাবার পর থেকেই ওর ভেতর এই ভাবটা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এমন নয় যে হারা বৌকে খুব বেশি ভালোবাসত। তবে একটা টান তো বরাবরই ছিল। বাতাসি মা হবে, এই খবরটা শোনার পর এই টানটা যে আরও বেড়ে গিয়েছিল হারা সেটা অস্বীকার করতে পারে না। লক্ষ্মীমাসির বাড়িটাও ঠিক আর আগের মতো নেই। মাসি হারাকে আগের মতোই স্নেহ করে, সেটা হারা বুঝতে পারে। কিন্তু মাসি অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। যন্ত্রের মতো কাজে যায়, কাজ থেকে ফিরে এসে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। বাড়িতে রান্নাও আজকাল আর বিশেষ করে না, মালতিকেই রান্নাবান্না করতে হয়। হারার জন্যেও ওকে রান্না করতে হয়, সেজন্যে ও হারার দিকে প্রায়ই রাগের চোখে তাকায়। মাসি না থাকলে বোধ হয় ও আর গৌরা মিলে হারাকে এতদিনে বাড়ির থেকে বার করে দিত, নয়তো থাকা খাওয়ার জন্যে ওর কাছ থেকে একটা মোটা টাকা আদায় করত। ওর ব্যবহারের জন্যে এখনও বাতাসির ঘরটা রয়েছে, ও রাতে যখন শুতে আসে বাতাসির ওষুধের শিশিগুলোর ওপর ওর চোখ পড়ে। সেগুলো একইভাবে একই জায়গায় রয়েছে, কেউ সেগুলোতে হাত দেয় নি, সূক্ষ্ম একটা ধুলোর আস্তরণ পড়েছে সেগুলোর ওপর। তিনটে শিশি, একটায় ক্যাপসুল, একটায় ট্যাবলেট, আর একটায় সিরাপ, ক্যাপসুল আর ট্যাবলেটের শিশিদুটো অর্ধেক খালি, সিরাপেরটা প্রায় পুরোটাই এখনও ভরতি। রাতে ঘুমের ঘোরে পাশের জায়গাটায় হারার হাত পড়ে, পুরোনো চেনা সেই নরম স্পর্শটা পায় না। পাশের জায়গাটা খালি, আধ ঘুমের ভেতর হঠাৎ অবাক লাগে, বাতাসি কি এই রাতে একা একা কলঘরে গেল? তারপর ঘুমের রেশটা কেটে গিয়ে ও পুরো সজাগ হয়ে ওঠে, সব কিছু মনে পড়ে যায়। আবার ও ঘুমোবার চেষ্টা করে। ঘুম আসতে চায় না, ও জেগে থেকে এটা ওটা সেটা ভাবে, বাতসির সঙ্গে সেই ছোটোবেলার থেকে অনেক দিনের অনেক কথাবার্তা ওর মনে পড়ে যায়। তারপর শেষরাতের দিকে ও কখন ঘুমিয়ে পড়ে সেটা ও জানতেও পারে না।

    বৌ মারা যাবার পর হারা এ পর্যন্ত আর বেবির কাছে যায় নি। বাতাসির মারা যাওয়ার খবরটা ওকে সেই হাসপাতাল থেকেই মোবাইল মারফৎ জানিয়ে দিয়েছিল। দুঃখ জানিয়ে বেবি একটা পাল্টা খবর পাঠিয়েছিল হারার ফোনে। ও ভারি বুদ্ধিমতী মেয়ে। হারা চুপচাপ রয়েছে দেখে ও-ও কোনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করে নি। হারা একটা শোক পেয়েছে, সেটা সামলে উঠতে ওর সময়ের দরকার। সেই সময়টা ওকে একা থাকতে দেওয়া দরকার। ওকে এখন ডাকাডাকি করা ঠিক নয়।

    তবে এই এক মাস কেটে যাওয়ার পর হারার মোবাইলে বেবির থেকে ডাক এল অনেক দিন একা রয়েছিস, এবার আমার কাছে আয়। বেবির ডাক পেয়ে হারা কয়েকদিন খুব ভাবনাচিন্তা করল। সত্যিই অনেকদিন হয়ে গেছে। আর এটাও ঠিক যে আর কিছুদিন ধরে মাঝেমাঝেই বেবির কথা ওর মনে আসছিল। ও বেবির কাছে গেল।

    বেবির ব্যবহারে হারা কিন্তু বেশ আশ্চর্য হয়ে গেল। ওর ব্যবহারের যে স্বাভাবিক একটা উগ্রতা, সেটা নেই, চিমটি কেটে বা হারাকে বিদ্রুপ তাচ্ছিল্য করে কথা বলা একেবারেই নেই। এ যেন একজন আদর দেয়া মায়ের ব্যবহার, আরেক লক্ষ্মীমাসির করা আদর। ও এখন হারার থেকে টাকা পয়সাও নেয়া বন্ধ করেছে। হারা নিজে থেকে একবার টাকা দিতে চেয়েছিল, বেবি নেয় নি। ওসব পরে হবে, একথা বলে হারাকে থামিয়ে দিয়েছে। এখন কোনোদিন যদি বেবির ঘর থেকে বেরোতে হারার দেরি হয়ে যায় বেবি খালি একটু ছটফট করে, বার বার ঘড়ির দিকে তাকায়। কিন্তু কখনো মুখ ফুটে হারাকে চলে যেতে বলে না। হারা ওর ওই ছটফটানি দেখেই টের পায় যে দেরি হয়ে গেছে, নিজে থেকেই তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে যায়।

    তবে হারা খুব ভালোই জানে এটা বেবির আসল স্বভাব নয়। ও হারার মনের এই অবস্থাটায় প্রলেপ দেয়ার জন্যে এরকম ব্যবহারের অভিনয় করছে। কিন্তু অভিনয় হলেও হারা মুগ্ধ হয়ে গেল বেবির এই ব্যবহারে। ও আবার বেবির কাছে রোজ যাওয়া শুরু করে দিল।

    আরও মাসখানেক গেল। হারা বেবির বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়েছিল। ওর মাথা বেবির কোলে, বেবি ওর চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দিচ্ছিল। বেবি ওদের ছোটোবেলার ছোটোখাটো ঘটনার কথা বলছিল, হারার সে সব পুরোনো কথা মনে আসছিল। ওসবে হারাও মাঝে মাঝে ফোড়ন কাটছিল, ও নিজেও ওর যা ছোটোবেলার কথা মনে আসছিল সে সব বলছিল। ওদের সবচেয়ে মজার কথা ছিল ছোটোবয়েসে একসঙ্গে খেলা, ঝগড়া, এমনকি কখনো কখনো মারামারি। এসব কথা বলতে গেলে অনিবার্যভাবে বাতাসির কথাও এসে যাচ্ছিল। হারার ছোটোবেলার বাতাসিকে মনে পড়ছিল, সেই কালো, রোগা, বেঁটে মেয়েটা।

    সে সব কথা থামিয়ে বেবি হঠাৎ হারাকে বলল, শোন হারা, তোকে একটা কথা বলব।

    হারা একটু ঠাট্টা করেই বলল, অনেক কথাই তো বলছিস, আর একটা কথা বলতে চাস তো বলে ফ্যাল।

    বেবি গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। বলল, না রে, যা বলব তা একটা ভাববার কথা। ও নিয়ে ইয়ারকি মারলে চলবে না।

    বেশ, ইয়ারকি মারব না, হারা বলল। তুই বল কি বলবি।

    বেবি একটু সময় চুপ করে রইল। হারার মুখের ঠিক ওপরে ওর মুখ, হারা সোজা ওর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। বেবিও একনজরে ওকে দেখছে, বোঝা যাচ্ছে ও যা বলবে তা নিয়ে ও এখন একটু ভাবছে।


    বেবি দু হাত দিয়ে হারার মুখটা জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, কেমন হয় রে যদি তুই আর আমি একসঙ্গে এখান থেকে চলে যাই? আমি আমার এই পচা ব্যবসা ছেড়ে দেব, আমরা দুজন অন্য কোথাও গিয়ে থাকব। কলকাতা থেকে দূরে অন্য কোনো জায়গায় যাব। কেমন হয় রে তাহলে?

    হারা ভাবতেই পারে নি বেবি ওকে এরকম একটা প্রস্তাব দেবে। বেবির কথাটার ধাক্কা বেশ জোরালো, ও ঝট করে কোনো উত্তর দিতে পারল না, বেবির দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিল সেভাবেই তাকিয়ে রইল।

    বেবি আবার বলল, তোকে সত্যি বলছি রে, এই যে রোজ এত লোকের সঙ্গে শুই, এতে আমার আজকাল প্রায়ই ক্লান্তি আসে। হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে কোথাও চলে যাই। খালি তোর কথা আলাদা। তুই যতক্ষণ আমার কাছে থাকিস আমি খুব আনন্দে থাকি।

    হারা কথা বলছিল না। ওর মাথায় এখন একসঙ্গে অনেক চিন্তা ধাক্কা মেরেছে, ওর পক্ষে এক্ষুনি কিছু বলা সম্ভব নয়।

    বেবি নিজের মুখটা নামিয়ে এনে হারার নাকের ডগায় চুক করে একটা ছোট্ট চুমু খেল। তারপর বলল, আমি তোর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি। এখন আমার কথার কোনো উত্তর দিস না। বাড়ি যা, গিয়ে ভাবনাচিন্তা কর। তারপর আমরা দুজনে মিলে এই নিয়ে অনেক কথাবার্তা বলব।

    হারা বেবির কথাটা ভাবল। একদিন, দুদিন, তিনদিন। অন্য সব চিন্তা ওর মাথার থেকে চলে গেল, খালি বেবির সঙ্গে দূরে কোথাও গিয়ে একসঙ্গে থাকাটা কিরকম হবে সেই ভাবনাই ওর মাথায় ঘুরতে লাগল। বেবি একটা বিরাট লোভনীয় টোপ ফেলেছে ওর সামনে। বেবির গত ক মাসের ব্যবহার ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে চাইলে বেবি যেকোনো পুরুষকে অত্যন্ত সুখী করতে পারে। হারা কেন বেবির সঙ্গে এখান থেকে দূরে গিয়ে ঘর করবে না? হ্যাঁ, একথা সত্যি যে বেবি এখন একটা বাজারের মেয়ে। কিন্তু ও তো আর তা থাকবে না। আর ও যে বারোয়ারি মেয়ে ছিল সেটা তো ওর গায়েও লেখা থাকবে না।

    অবশ্যি একথা ঠিক যে এ পর্যন্ত হারা লক্ষ্মীমাসির বাড়িতে যথেষ্ট সুখে আছে। কিন্তু সে তো লক্ষ্মীমাসি ওকে এত ভালোবাসে বলেই। এখন বাতাসি নেই, মাসি এ সংসারটা সম্পর্কে অনেকটা উদাসীন হয়ে গেছে। কিছুদিন পরে কি হবে তা বলা যায় কি? এই পুরোনো জীবন ভুলে গিয়ে বেবির হাত ধরে নতুন জায়গায় চলে যাওয়াই কি হারার পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না?

    তবে পুরোনো জীবন ভুলে যাওয়া অত সহজ নয়। হারা এখন সেটা ভালোই বুঝতে পারল। ওর মনে পড়তে লাগল সেই রাতের কথা। মা আত্মহত্যা করেছে, ও একা বসে আছে ঘরের বাইরে, ওর পেটে ভয়ঙ্কর খিদে আর চোখে ঘুম, সেই সময় লক্ষ্মীমাসি এসে ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল, আশ্রয় দিয়েছিল, ওকে নিজের ছেলের আদরে কাছে রেখেছিল। আর বাতাসি! হারা এখন বুঝল ও বাতাসিকে শুঁটকি, কেলটি যাই ভেবে থাকুক না কেন ঐ মেয়েটা ওর মনের ভেতর বেশ খ্যানিকটা জায়গা দখল করে আছে, সেখান থেকে ওকে তাড়ানো খুব একটা সহজ কাজ নয়। তাছাড়া বাতাসি ওর বাচ্চার মা হতে যাচ্ছিল, সেটা কি ওর পক্ষে একেবারে ভুলে যাওয়া সম্ভব?

    কিন্তু দিন কয়েক পরে হারা মন ঠিক করে ফেলল। ও বেবির সঙ্গে চলে যাবে। তার জন্যে পুরোনো কথা একেবারে ভুলে যাওয়ার দরকার নেই, সেটা সম্ভবও নয়। কেউ-ই পুরোনো কথা একদিনে ভুলে যায় না, তার জন্যে সময় লাগে। একটা সময় ঠিকই আসবে যখন ওর আগেকার জীবনের ছবি ফিকে হয়ে আসবে, ওসব আর ওর মাথায় বোঝা হয়ে চেপে বসবে না। এই ক’দিন হারা বেবির সঙ্গে ওদের এখান থেকে চলে যাওয়া নিয়ে কোনো কথা বলে নি, আজ নিজেই ও বেবির কাছে কথাটা পাড়ল। বেবিও এ পর্যন্ত হারাকে এই নিয়ে কোনো কথা জিজ্ঞেস করে নি। ও জানত হারা নিজেই ওর কাছে কথাটা তুলবে।

    দুজনে অনেক কথা হল। বেবি ওদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেক ভাবনাচিন্তা করে রেখেছে, বেশিরভাগ কথা ও-ই বলল। ও এ ব্যাপারে অনেক কাজও এগিয়ে রেখেছে। ও হারাকে বলল, আমাদের এখানে শোভা বলে একটা মেয়ে ছিল, আমার সঙ্গে ওর বেশ দোস্তি ছিল। বছর কয়েক আগে ও ওর ভাবের লোকের সঙ্গে এখান থেকে চলে গিয়েছে। সেই হিমালয় পাহাড়ের কাছে একটা জায়গায়, লাটাগুড়ি না ধূপগুড়ি কি যেন একটা নাম। ওর সঙ্গে আমার ফোনে কথাবার্তা হয়। ও এখন ঐ লোকের সঙ্গে দিব্যি ঘর করছে। একটা মুদি দোকান দিয়েছে, ওরা দুজনে মিলে চালায়। মুদি দোকানের-ই এক পাশে একটা চায়ের দোকানও দিয়েছে, বেশ চলে দোকানটা। আজকাল আবার লটারির টিকিট বিক্রীও ধরেছে। ওদের দোকানেই টিকিট কিনতে পাওয়া যায়। টিকিট বিক্রীর জন্যে কয়েকটা ছেলেকে এজেন্ট রেখেছে, ওরা জায়গায় জায়গায় ঘুরে টিকিট বিক্রী করে। ভালো লাভের ব্যবসা একটা। ওর সঙ্গে আমার কথা হয়ে গিয়েছে। আমরা ওখানে গিয়ে প্রথমে ওদের বাড়িতে উঠব, ওদের বাড়িতে বাড়তি ঘর রয়েছে। তারপর সব দেখেশুনে নিয়ে আমরা বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে যাব। আর আমরাও কিছু একটা ব্যবসা করব। আর কিছু না হয় তোকে একটা তিন চাকা কিনে দেব, টোটো আজকাল সব জায়গায় চলে। আমিও কোনো না কোনো কাজ করব। দুজনে মিলে রোজগার করব, দিব্যি থাকব আমরা। শোভা এখন ও জায়গাটার সবকিছু চেনেজানে, ও-ই আমাদের কোনো একটা লাইন ধরিয়ে দিতে পারবে।

    একটু থামল বেবি। হারা চুপ করে ওর কথা শুনছিল। বেবি ওর সামনে ওদের ভবিষ্যতের একটা রঙীন ছবি আঁকছে, সেই ছবিটা হারা মন দিয়ে দেখছিল।

    এবার বেবি একটু হাসল। ভারি মিষ্টি একটা হাসি, ইচ্ছে করলে বেবি এই হাসি হাসতে পারে। সেই হাসি হেসে বলল, জানিস, ওদের এর মধ্যে দুটো বাচ্চাও হয়ে গিয়েছে, তারপর আমার বন্ধু অপারেশন করিয়ে নিয়েছে।

    তারপর ঐ হাসিটা মুখে রেখেই বলল, আমাদেরও হবে। আর তুই যদি চাস তাহলে আমাদের দুটোর বেশিও হতে পারে।

    হারা হেসে ফেলল। বলল, দেখা যাক্‌। আগে ওখানে তো যাই।

    ট্রেনের টিকিট কাটতে দিতে হবে, বেবি বলল। তার জন্যে তোর বয়েসটা লিখে দিতে হবে। তোর আধার কার্ড অনুসারে তোর এখন বয়েস কত? পঁচিশ?

    সাতাশ, হারা বলল।

    ঠিক আছে, বেবি বলল, ঐ বয়েসটা লিখে দেব। ট্রেনে যাওয়ার সময় কার্ডটা দেখতে চাইতে পারে। ওটা সবসময় সঙ্গে রাখবি। পুরো রাস্তা অবশ্যি ট্রেনে যাওয়া যাবে না, কিছুটা রাস্তা বাসে যেতে হবে।

    একটু থেমে বেবি আবার বলল, দিন পনেরো পরের টিকিট কাটতে দেব। তার ভেতর আমাদের এখানকার সব কাজ হয়ে যাবে। তারপর হারার একটা গাল টিপে দিয়ে বলল, কি রে সব কাজগুলো হয়ে যাবে তো?

    হারা হাসল। বলল, হয়ে যাবে। গাড়িটা বিক্রী করতে হবে। যদি আমাদের যাওয়ার আগে বিক্রী না হয় তাহলে ওটা কাউকে এমনিই দিয়ে দেব।

    বেবি ধমকের সুরে বলল, যাঃ, বোকা ছেলে। এমনি এমনি দিয়ে দিবি কেন? সেরকম দরকার হলে ওটার চাকা, সীট, ব্যাটারি, সব আলাদা আলাদা বিক্রী করবি। যে কটা টাকা পাবি তা-ই বা ছাড়বি কেন?

    হারার মাথায় একটা সন্দেহ উঁকি দিচ্ছিল। ও বেবিকে বলল, আচ্ছা তুই যে এখান থেকে চলে যেতে চাইছিস, এখানকার লোকজন, যারা তোদের এই ঠেকটা চালায় তারা কি তোকে চলে যেতে দেবে? তোর রোজগারের ভাগ থেকে ওদের এত কামাই, ওরা তোকে ছাড়বে কেন?

    বেবি হেসে হারার গাল আবার টিপে দিল। বলল, ছাড়বে রে ছাড়বে। ওদের একগাদা টাকা দিতে হবে, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার এখন অনেক টাকা হয়েছে রে, ও টাকাটা দিতে গায়ে লাগবে না। ওখানে গিয়ে একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে নেব, তারপর আমার এখানকার ব্যাঙ্কের টাকা ওখানে সরিয়ে নেব। আমার যা টাকা আছে তাতে আমাদের দুজনের, আমাদের ছেলেমেয়েদের সারা জীবন হেসে খেলে চলে যাবে। কিন্তু কোনো কাজ না করে বসে থাকলে চারপাশের লোকদের নজরে পড়বে আমাদের ওপর। কাজেই আমাদের কিছু না কিছু রোজগার করতে হবে। বুঝলি রে আমার হারাধন?

    তারপর-ই বেবি গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, আমি যা যা ভেবেছি আর যা যা করেছি সবই তো তোকে বললাম। এবার তুই বল তুই কি ভেবেছিস, কি ঠিক করেছিস?

    তখন দেখা গেল হারা যদিও ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করেছে, সে সবই এলোমেলো। ঠিক কিভাবে কি কাজ করবে সেরকম কোনো নির্দিষ্ট চিন্তা এখনও ওর মাথায় নেই। বেবি ওকে বুদ্ধি দিল। প্রথমে ইশকুলের বাচ্চাদের খেপের জন্যে ওর নিজের জায়গায় আর একটা লোক ঠিক করতে হবে। তারপরে আসবে গাড়িটা বিক্রী করাটা। দুম করে খুব সস্তায় গাড়িটা ছেড়ে দিস না, বেবি ওকে বলল। বেশ কয়েক জায়গায় যাচিয়ে দেখে যেখানে বেশি দাম পাবি সেখানেই বেচবি। বিক্রী করে টাকাটা আমাকে দিয়ে যাস, আমি ও টাকা আমার ব্যাঙ্কে জমা করে দেব। আর হ্যাঁ, এক্ষুনি লক্ষ্মীমাসিকে বা আর কাউকে কিছু বলতে যাস না। বলবি তখন যখন নিজের জামাকাপড় নিয়ে একেবারে ওখান থেকে বেরিয়ে আসবি। খুব বেশি জামাকাপড়ও সঙ্গে নিবি না। একটা হাতে টানা ছোটো সুটকেসে যা ধরে তা নিবি। সেরকম সুটকেস যদি না থাকে তাহলে একটা কিনে নিস।

    হারা কাজে লেগে গেল। ইশকুলের বাচ্চাদের ফেরি করার জন্যে নিতাই-এর সঙ্গে কথা বলল। নিতাই এক কথায় রাজি। রাজি হবেই সেটা হারা জানত। মাসে মাসে বাঁধা একটা মোটা রোজগার। কে আর এরকম একটা দাঁও ছেড়ে দেবে? অবশ্যি নিতাই একবার জিজ্ঞেস করেছিল হারা নিজে কাজটা ছেড়ে দিচ্ছে কেন। হারা একটা উত্তর তৈরী করেই রেখেছিল। হারা নতুন ব্যবসায় নামছে। জামাকাপড় সাপ্লাই করার ব্যবসা। খুব লাভের। কিন্তু তার জন্যে কলকাতার বাইরে নানা জায়গায় ঘুরতে হবে। এখানে বসে থেকে টোটো চালানো যাবে না।

    নিতাই আর কিছু বলে নি। হারা যা ইচ্ছে করুক, ওর তাতে কি? ওর হারার এই ইশকুলের খেপের কাজটা পেলেই হল।

    হারার জন্যে তার পরের কাজটা হল নিতাইকে সব ইশকুলের বাচ্চাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে মা-বাবাদের ওকে চিনিয়ে দেয়া। বিশেষ করে মা-দের। এ কাজটায় লেগে গেল বেশ কয়েকটা দিন। এ কাজটার জন্যে নিতাইকে খালি পাওয়া চাই তো। ওর তো খালি বাচ্চাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরলেই চলবে না, নিজস্ব খেপ মেরে টাকাও তো কামাতে হবে। হারা তো জানে ওকে এখনও ওর গাড়িটার ধার শোধ করতে হচ্ছে, সে টাকাটা তো ওর রোজগার করার দরকার। এখন ইশকুলের গরমের ছুটি চলছে, সেটা একটা সুবিধে। তা না হ’লে এই কাজটা শেষ করতে আরও কয়েক দিন লেগে যেত। কয়েকজন মা অবশ্যি একটু গাঁইগুঁই করছিল। কেন হারাধন, তুমি হঠাৎ এই কাজ ছেড়ে দিচ্ছ কেন? তোমার হাতে আমার বাচ্চাকে ছেড়ে দিয়ে তো বেশ নিশ্চিন্ত ছিলাম বাবা। এখন আবার নতুন লোক — অবশ্যি তোমার বন্ধু — নিশ্চয়ই এর ওপরেও ভরসা করা যাবে -। হারার উত্তর তৈরী। কাপড়চোপড় সাপ্লাই এর কথাটা তো আছেই। আর নিতাই-এর ওপর ভরসার কথা? আরে ও তো আমাদের স্ট্যান্ডের-ই টোটোওয়ালা। ওর বাড়িও কাছে। এই দেখুন ওর আধার কার্ড। আর এই কার্ডের একটা জেরক্স কপিও দিলাম, এটা মাসীমা আপনার কাছেই রেখে দেবেন। নিতাই, তোর মোবাইল নম্বরটা মাসীমাকে দিয়ে দে। মাসীমা, ওর এই নম্বরটা আপনার ফোনে তুলে রেখে দিন।

    গাড়িটা বিক্রী করার জন্যে কিন্তু হারাকে বেশ একটু ঝামেলা পোয়াতে হল। ও প্রথমে চেষ্টা করেছিল যাদের এরকম গাড়ি নেই, পায়ে প্যাডেল করা রিকশা চালায় তাদের কাছে বিক্রী করতে। তা ওরা তো হারার গাড়ির জন্যে প্রায় কোনো দামই দিতে চায় না। এই তিন, চার হাজার, বড়জোর পাঁচ। আর তার সঙ্গে ঘ্যানঘ্যান, গাড়ির খুঁত ধরা। তোর গাড়িটা তো পুরোনো হয়ে গেছে রে হারা, এটা চালাতে গেলে এটার পেছনে অনেক খরচা করতে হবে। আজ টায়ার পাল্টাও, কাল ব্রেক সারাও, পরশু গাড়ির ছাদের ফুটো মেরামত করো। তোর গাড়ির ব্যাটারিও পুরোনো হয়ে গেছে। ওটা শীগগীরই পাল্টাতে হবে, সে আবার একটা বড় খরচা।

    রেগেমেগে হারা শেষ পর্যন্ত গেল সাধন মিস্তিরির কাছে। সাধন কম কথার লোক। যা বলার পরিষ্কার বলে দিল। ও গাড়িটাকে টুকরো টুকরো করে খুলে ফেলবে — ব্রেক, গাড়ির ইঞ্জিন, চাকা, সীট, পাটাতন। প্রত্যেকটার জন্যে পুরোনো জিনিষ হিসেবে দাম দেবে। ব্যাটারিটা পুরোনো, ওটার জন্যে কোনো দাম পাওয়া যাবে না। সব মিলিয়ে খুচরোখাচরা বাদ দিয়ে দশ হাজার। হারা চেষ্টা করেছিল পুরো দামটা অন্তত বারোতে তুলতে। সাধনের এক কথা। দশের এক পয়সা বেশি নয়। তাতে গাড়ি বেচতে হলে ওটা কারখানায় রেখে যাও, তার চাইতে বেশি চাইলে রাস্তা দেখ।

    হারার একটু খারাপ লাগছিল। ওর এতদিনের সঙ্গী এই গাড়িটা এভাবে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে? আর এই জলের দামে? কিন্তু এছাড়া উপায় কি? হারা রাজি হয়ে গেল।

    কাল সকালে গাড়ি নিয়ে আসবি, সাধন বলল। আমি টাকা জোগাড় করে রাখব। তোর গাড়ি আমার কারখানায় ঢুকবে, আর টাকাটা তোর পকেটে ঢুকে যাবে। ব্যস্, সব চুকে গেল।

    পরের দিন সকালে সাধনের কারখানার থেকে বেরিয়ে হারা বেবির ঘরে দিকে রওনা দিল। হেঁটেই চলল। পকেটে দশ হাজার টাকা নগদ, বাস বা অটোরিক্সায় উঠতে ওর সাহস হয় নি। যদি হারিয়ে যায় বা পকেটমার হয়ে যায়? বহুদিন তো ওসব যানবাহনে বিশেষ ওঠে নি, ওসবে ওঠার অভ্যেসটা চলে গিয়েছে। টাকাটা ওর মানিব্যাগে রেখেছে, মাঝেমাঝেই পকেটে হাত দিয়ে ও মানিব্যাগটা অনুভব করে নিচ্ছিল। ঐ টাকার থেকে হাজার দুই ও নিজের কাছে রাখবে, বাকিটা বেবিকে দেবে ব্যাঙ্কে জমা দেবার জন্যে। নতুন জায়গায় গিয়ে বেবির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে ও নিজের নামটাও জুড়ে নেবে, সেটা হারা ঠিক করে রেখেছে।

    বেবির ঘরের ওখানে হেঁটে যেতে অনেকক্ষণ লাগল, এক ঘন্টারও বেশি। হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে ওর এতদিনের বাহন তিনচাকার গাড়িটার কথা মনে পড়ছিল। আর মনটা একটু খারাপ লাগছিল। কিন্তু তা হলেও ভেতরে ভেতরেও একটা খুশির ভাব অনুভব করছিল। ওর যা যা কাজ করার ছিল সবই হয়ে গেছে। হারা হিসেব করে দেখল ওর পুরো আটদিন লেগে গেছে কাজগুলো সব সুষ্ঠুমতো সারতে। এই আটদিন ও বেবির কাছে যায় নি, ওদের কেউ কাউকে ফোনও করে নি। বেবি নিশ্চয়ই এর ভেতর ওদের যাওয়ার ট্রেনের টিকিট কাটিয়ে ফেলেছে। কতদিন পরের টিকিট পেয়েছে কে জানে। হয়তো বেশ একটু দেরির একটা তারিখের টিকিট কিনিয়েছে। এখন ইশকুল কলেজের গরমের ছুটির সময় চলছে, এ সময়টায় ভীড়টা তো একটু বেশি হয়। তা দশ-বারো দিন বেশি লাগলেও কোনো ক্ষতি নেই। যাওয়ার আগের সব কাজ তো মোটামুটি হয়েই গিয়েছে, এবার ট্রেনে চেপে বসতে পারলেই — ব্যস। তারপর নতুন জায়গা, নতুন জীবন। এই ক-টা দিন মালতি কিম্বা গৌরা ওকে প্রশ্ন করতে পারে — ওর গাড়ি কোথায় গেল? সে তখন কিছু না কিছু বলে দেওয়া যাবে। মেরামতিতে গেছে বললে হয়। হ্যাঁ, সেটা বললেই ঠিক হবে। ওরা কেউ আর কোনো সন্দেহ করবে না।

    বেবির ঘর অবধি গিয়ে হারা বেশ একটু ক্লান্ত বোধ করছিল। একটা পথ হাঁটার অভ্যেস তো আর নেই। ও ভাবছিল বেবির ঘরে ঢুকে হাত-পা-মুখ ধুয়ে একটু গড়িয়ে নেবে। বেবি নিশ্চয়ই এখনও খাট বিছানা ঘর থেকে খালি করে দেয় নি। ওদের এ জায়গা ছাড়তে এখনও বেশ কয়েকটা দিন তো রয়েছে এখনও। বেবি এখানকার আসবাব কিছু জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে কিনা কে জানে। তবে হারা ওকে বলবে এসব পুরোনো জিনিষ ওরা যেখানে যাবে সেখানে না পাঠাতে। এসব এখানে বেচেবুচে দিয়ে নতুন জায়গায় নতুন জিনিষ কিনে নেয়াই ভালো নয় কি?

    আজ আর সঙ্গে গাড়িটা নেই, চেন দিয়ে বাঁধবারও কিছুই নেই। হারা সোজা বেবির ঘরের দরজার সামনে চলে এল। এসেই কিন্তু ওকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। দরজা হুড়কো টেনে বন্ধ, তাতে তালা লাগানো। বেবি গেল কোথায়? আর দরজার তালাটা! বেবি যে তালাটা দরজায় লাগিয়ে বেরোয় সেটাকে হারা অনেকবার বেবির ঘরে দেখেছে। এ তালাটা তো সেটা নয়। এটা একেবারে আনকোরা নতুন, আরও বড়োসড়ো, আরও মজবুত। বেবি হঠাৎ তালা বদলে ফেলল কেন?

    কিন্তু সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে বেবি ফিরবে কখন? ও না ফিরলে বিছানায় গড়ানো তো দূরের কথা হারা বসে অপেক্ষাই বা করবে কোথায়? ও পকেট থেকে মোবাইল বার করে বেবিকে ফোন করল। ফোনে একটা যান্ত্রিক মেয়ের গলা ভেসে এল, আপনার ডায়াল করা নম্বরটি বৈধ নয়। এই কথাটা ইংরেজী আর হিন্দিতেও শোনা গেল। তারপর একটা লম্বা টানা আওয়াজ করে লাইনটা কেটে গেল।

    হারা ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। বেবি কখন ফিরবে সেটা কাউকে জিজ্ঞেস করা দরকার। দরজায় তালাটা দেখা ইস্তক হারা ক্লান্তিটা বেশি করে অনুভব করছিল। ওর বিরক্তও লাগছিল, এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে। গাড়িটাও তো আর নেই, ওটা সঙ্গে থাকলে ওটার সীটে বসে থাকা যেত। হঠাৎ ও ছোটু দালালটাকে দেখতে পেল। ছোটুও হারাকে দেখতে পেয়েছে, লম্বা লম্বা পা ফেলে এদিকেই আসছে।

    বেবিদিদি এখানে নেই, ছোটু হারাকে বলল। মুম্বাই গেছে। সিনেমা করতে।

    খবরটা হজম করতে হারার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। তারপর ও বলল, মুম্বাই গেছে? কবে ফিরবে?

    কবে ফিরবে তার তো কিছু ঠিক নেই। এ ঘরটাও তো ছেড়ে দিয়ে গেছে। এই ঘরে নতুন মেয়েছেলে আসবে — আর দশ-পনেরো দিনের ভেতরই আসবে।

    কেউ একজন হারার হাত ধরল। মিনতি। ও কখন নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে হারার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে হারা টের পায় নি।

    আমার ঘরে এসে বসো, মিনতি হারাকে বলল। এই রোদে তেতে পুড়ে এসেছ, আমার ঘরে বসে একটু জিরিয়ে নাও।

    হারা ওর সঙ্গে ওর ঘরে গেল। ও ক্লান্ত হয়েই ছিল, তার ওপর আচমকা এই খবরটার ধাক্কা। ওর সত্যিই এখন কোথাও বসে একটু বিশ্রাম করার দরকার।

    মিনতির ঘরটার একেবারে ভোল পাল্টে গেছে। বেবির আলমারি, চেয়ার, টেবিল, এসব এ ঘরে চলে এসেছে। সুন্দর করে নিজের ঘর সাজিয়েছে মিনতি। খালি ওর বিছানাটা পুরোনো, পুরোনো তক্তপোশটার ওপরেই পাতা রয়েছে। ওর বিছানায় বসে ঘরটার চারধারে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল হারা। মিনতি এসে ওর সামনে দাঁড়াল, ওর হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের পেয়ালা। পেয়ালাটা চকচকে ঝকঝকে, এটাও বেবির। ও চা বানাবার সময় হারার চারপাশে তাকিয়ে দেখাটা নজর করেছিল। চায়ের পেয়ালাটা হারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ও বলল, হ্যাঁ গো, যা ভাবছ তা-ই। এইসব আসবাবপত্তর সবই বেবিদিদির। যাওয়ার আগে আমাকে দিয়ে গেছে। শাড়ি জামা এসবও দিয়েছে অনেক। খালি খাটটা নিতে পারলাম না। ওই পেল্লায় খাট আমার ঘরে রাখব কোথায়? ঐ হারামজাদা ছোটু খাটটা নিয়ে নিল। তার সঙ্গে গদী, তোষক যা ছিল সব। আর নিয়েই ওটা বেচে দিয়েছে ব্যাটা। ভাল দাম পেয়েছে। কত ঠিক জানি না। হাজার পাঁচেক তো হবেই।

    একটু থেমে মিনতি আবার বলল, জানো, আমার একটা বাক্স খাট করাবার খুব ইচ্ছে ছিল। ওপরে শোয়া, আর তার নিচে জিনিষপত্তর, কাপড় চোপড় সব রাখা। কত সুবিধে। কিন্তু তার কি দাম, বাপরে বাপ! আমার ঘরের মাপমতো একটা ওরকম খাট করাতে কম করে দশ হাজার লাগবে। একবার ছুতোর ডাকিয়ে যাচাই করিয়েছিলাম। দশ লেগে যাবেই। আমার ওসব হবে না। আমি কোথায় পাব অত টাকা? তুমিই বল।

    হারার এসব কথা শুনতে ভালো লাগছিল না। বেবি হঠাৎ চলে গেল? সব পিছুটান কাটিয়ে? মনে তো হচ্ছে আর ফিরবে না। ফিরলেও কত দিনে কত বছরে তার কিছু ঠিক নেই। সে কথাই ও মিনতিকে জিজ্ঞেস করল, বেবি এরকম হঠাৎ চলে গেল? কি ব্যাপার তুমি কিছু জানো?

    সিনেমার ছবি করতে গেছে গো, হাত মুখ নেড়ে মিনতি বলল। ওই যে সেই সিনেমা লাইনের বিরাট টাকাওয়ালা লোকটা আসত বেবিদিদির কাছে, সে-ই সব ব্যবস্থা করে বেবিদিদিকে নিয়ে গেছে। সিনেমা মানে আসলে কি জানো? ঐ যে মেয়ে পুরুষের খেলার ছোটো ছোটো সব অসভ্য ছবি হয় সেই সব ছবিতে অ্যাক্টো করবে। ওর জন্যে শক্ত কাজ তো কিছু নয়। টাকা রোজগারের জন্যে যা এখন করে তাই-ই করবে, খালি সামনে ছবি তোলার যন্তর চালু থাকবে। লাখ লাখ টাকা আসবে ঐ সব ছবির জন্যে। আর সে হবেই, সারা দুনিয়ায় সে সব ছবি বিককিরি হবে তো। এ সব কথা বেবিদিদি নিজেই আমাকে বলেছে। বেবিদিদি যে কত টাকা রোজগার করবে তা ভাবা যায় না। আর দ্যাখো — করবে না-ই বা কেন? বেবিদিদির চেহারা আছে মুখটাও সুন্দরপানা — সে রোজগার করবে না তো কে করবে? আমাকে কেউ সুযোগ দিলে আমিও ওরকম অ্যাক্টো করতুম। তা আমাকে তো কেউ এসবের জন্যে ডাকবে না, আমি তো রোগা, কালো কুচ্ছিৎ। আরে এই দ্যাখো, তুমি তো আমার কথা শুনছোই না — আমি বক বক করেই যাচ্ছি। কি এত ভাবছ গো?

    হারা মিনতির কথা শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে পড়েছিল। বাতাসি গেল, বেবি গেল। ছোটোবেলার দুই খেলার সাথী — ওরা অদ্ভুতভাবে ওর জীবনে এসেছিল। আবার কি অদ্ভুতভাবেই ওরা চলে গেল। কিন্তু মিনতির প্রশ্নটা ওর কানে গিয়েছিল। ও চায়ের পেয়ালা থেকে মুখ তুলে মিনতির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।

    মিনতি ওর পাশে বসে পড়ল। দু’হাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, বেবিদিদির কথা ভাবছিলে? সে চলে গেছে তো কি হয়েছে? আমি তো আছি তোমার জন্যে। তুমি এখন থেকে আমার কাছে এসো।

    হারা উত্তর দিল না, পেয়ালার বাকি চা টুকু শেষ না করেই ওটা পাশের টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল। রাখতে গিয়ে ওর মনে এল, পেয়ালাটা, টেবিলটা দুটোই বেবির।

    ও দাঁড়িয়ে উঠল, নিজের মানিব্যাগ বার করে তার থেকে এক তাড়া টাকা বার করল। টাকাটা মিনতির দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, তুমি এই টাকাটা রাখো। দশ হাজার আছে। এই টাকায় তোমার পছন্দের বাক্স খাট বানিয়ে নিও।

    মিনতি টাকাটা ওর থেকে নিয়ে নিল। ওর চোখ খুশিতে জ্বল জ্বল করছিল। ও বলল, তুমি এত ভালো! এতসব টাকা তুমি আমাকে দিলে! আর কেউ দেয় না, তুমি দিলে!

    মিনতি একটু ঘাড় বাঁকিয়ে আদুরে গলায় বলল, কাল আবার এসো কিন্তু, অ্যাঁ?

    হারা আবারও একটু হাসল। হেসে মিনতির মাথায় কয়েকটা ছোটো আদরের চাপড় দিল। তারপর আর ওর দিকে না তাকিয়ে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

    বাড়ির দিকে হাঁটছিল হারা। তবে তাড়াহুড়ো করে নয় — ধীরে, ধীরে, ছোটো ছোটো পা ফেলে। হাঁটতে হাঁটতে ও কিছুই ভাবছিল না, ওর মাথা এখন একেবারে খালি। ও কি করবে কাল থেকে তাই নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করার আছে, আজ হারা ওসব কিছুই ভাববে না।

    রাস্তার একপাশে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। দশ বারো বছরের কতগুলো ছেলে সেখানে দুমদাম ফুটবল পিটছিল। এখন ইশকুলগুলোতে গরমের ছুটি চলছে, ওদের ইশকুলও নিশ্চয়ই এখন বন্ধ, তাই এই ভর দুপুরে খেলে বেড়াচ্ছে। ওদের একজন বলটাকে জোরে একটা লাথি মারল, বলটা সোজা এসে হারার পায়ে লাগল। দাঁড়িয়ে পড়ল হারা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঐ দলটার থেকে একটা চটপটে গোছের ছেলে দৌড়ে এসে হারার পায়ের কাছ থেকে বলটা কুড়িয়ে নিয়ে আবার দৌড়ে ওর সঙ্গীদের কাছে ফিরে গেল। হারার দিকে একবার তাকিয়েও দেখল না।

    বেশ ছেলেটা, হারা ভাবল। এই ঠা ঠা রোদে ফুটবল খেলছে, সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, মুখ একেবারে রাঙা, তবুও খেলার উৎসাহের কমতি নেই। এরকম একটা ছেলে হারারও হতে পারত। হল না। আর হবেও না।

    আবার রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল হারা। হারাধন টোটোওয়ালা।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • প্রচ্ছদ | পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ (শেষ)
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments