পুজোর মরশুম। তাই খাওয়াদাওয়া দিয়েই শুরু করি। সূত্রপাতের কথায় পরে আসা যাবে।
স্যার, অর্থাৎ কবি ও সাহিত্যিক তারাপদ রায় খেতে খুব ভালোবাসতেন, খাওয়াতেও। আমিও যেহেতু খেতে ভালোবাসি তাই যেদিন আমি সাতসকালে অনুলিখনের জন্য স্যারের বাড়ি গিয়ে হাজির হতাম সেদিন দুজনে একসঙ্গে বসে আগে খাওয়া সেরে তার পর কাজ শুরু করতাম।
একদিন সকালে গিয়ে পৌঁছোনোর পর দুজনে খাওয়ার টেবিলে বসেছি, জেঠিমা দুটো বড়ো বাটিতে বেশ খানিকটা মুড়ি দিয়ে গেলেন। আমি খেতে শুরু করব কি না ভাবছি এমন সময় আবার জেঠিমা দুটো প্লেটে চামচ সহ বেশ বড়ো সাইজের দুটো অমলেট দিয়ে গেলেন। অমলেট দেখে প্রাথমিকভাবে খুবই উৎফুল্ল হলাম। পরমুহূর্তেই ভাবছি, অমলেটের সঙ্গে মুড়ির সম্পর্কটা কী। এমন সময় স্যার বললেন, ‘খাও’। আমি চামচ দিয়ে এক টুকরো অমলেট কেটে এক মন দোলাচল নিয়ে অমলেটের টুকরোর গায়ে মুড়ির গয়না পরিয়ে মুখে পুরলাম।
ক্লাস টু-তে বাংলা বইয়ে পড়েছিলাম কীভাবে অসুরদের যুদ্ধে হারিয়ে দেবতারা অমৃত পেয়েছিলেন। সেই সুদূর পুরাণের যুগ পেরিয়ে সেদিন আমি অমৃতর স্বাদ পেলাম।
সেদিন গেছি, যেমন যেতাম সাতসকালে। স্যার যথারীতি খাওয়ার টেবিলে। আমাকে দেখে বললেন, ‘বোসো’। ফল খেতে স্যার খুব ভালোবাসতেন। তাই প্রায় রোজ সকালেই খাওয়ার টেবিলে নানারকম ফলের সম্ভার।
আমি বসার পর জেঠিমা আমার সামনেও এক থালা ফল দিলেন। আমি খেতে শুরু করলাম। খেয়াল করে দেখলাম, থালায় যা যা ফল আছে সবকটাই আমার চেনা, কেবল একটা বাদে।
আমার স্বভাব হল, আমি বার বার দেখা পুরোনো বাংলা সিনেমা বা কখনো কখনো ইংরেজিও, আবার দেখি। নতুন সিনেমাও দেখি। তবে দুটোর মধ্যে ‘অপশন’ থাকলে আমি প্রথমটাই বেছে নিই। এটা হয়তো আমার এক ধরনের রক্ষণশীলতা হবে। ঠিক জানি না।
যাই হোক, এই অভ্যেস বা ফরমুলা কাজে লাগিয়ে আমি সেদিন প্রথমে আমার চেনা ফলগুলোই এক এক করে খেয়ে নিলাম। খেতে খেতে দু-একবার আড়চোখে দেখলাম স্যারও বেশ নিবিষ্ট হয়ে ফল খাচ্ছেন। চেনা জানা ফলের অধ্যায় শেষ হয়ে গেলে আমি সেই অজ্ঞাতপরিচয় ফলের ছোটো ছোটো দু-তিনটে টুকরো নিয়ে মুখে দিলাম।
আমার সামনে কোনো আয়না ছিল না। কিন্তু তবু আমি বেশ বুঝতে পারলাম আমার মুখের মানচিত্রটা পালটে গেছে। স্যারের দিকে তাকাতেই দেখি, স্যার একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে, মুখে খুব হালকা একটা হাসির আভাস।
চোখাচোখি হতে শুধু একটাই শব্দ বললেন, ‘কামরাঙা’।
এর আগে আমি কোনো দিন কামরাঙা খাইনি। কিন্তু কিন্ডারগার্টেনে বইতে পড়েছি, কামরাঙা ‘টক’ গোষ্ঠীর একটি ফল।
থিয়োরি অনেকটা বয়স্ক হওয়ার পর প্র্যাকটিকাল এসে তার হাত ধরল।
কতগুলো বছর কেটে গেল। সব কথাই এখনও মনে জ্বলজ্বল। কেবল তাদের ‘রোল নম্বরগুলো’ এলোমেলো হয়ে গেছে।
প্রথম যেদিন যাব, সেদিন প্রায় শেষরাতেই ঘুম ভেঙে গেল। এক অসম্ভব উত্তেজনা, টান। যেন শুধু চৌকাঠটুকু পেরোনো। এক দোরগোড়া থেকে অবশেষে আর এক দোরগোড়ায় গিয়ে হাজির হলাম। যাওয়ার পথে বাসে জানলার ধারে সাতসকালের কাঙ্ক্ষিত সিটটা পাওয়ার পর জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতে সব কিছুই যেন অন্যরকম লাগতে শুরু করল।
পৌঁছে বেল বাজাতেই এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন। আন্দাজে বুঝলাম উনিই জেঠিমা, মিনতি রায়।
--- আমি অনমিত্র রায়। হাওড়া থেকে আসছি।
--- ও, তুমিই সে, প্রমোদের কাছ থেকে . . .? এসো এসো, তোমার জন্যেই বসে আছি।
দরজা দিয়ে ঢুকেই বেশ বড়ো একটা ঘর। চেয়ার, টেবিল, দেওয়াল ঘড়ি, বইয়ের আলমারি, ফুলদানি, দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। এবং চেয়ারে তিনি। কবি ও সাহিত্যিক তারাপদ রায়।
প্রথমেই যে কাজটা করা উচিত এক্ষেত্রে, সেটাই করলাম। এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলাম। বললেন, ‘বোসো, বোসো। (ফোনের ‘আপনি’, ‘তুমি’ হওয়ায় স্বস্তি পেলাম) প্রমোদ পাঠিয়েছে?’
--- হ্যাঁ।
--- নাম কী?
--- অনমিত্র রায়।
--- কীরকম রায়?
জীবনে এখনও পর্যন্ত সেদিনের সেই মুহূর্তের মতো বিচলিত হইনি।
‘রায়’-এর যে রকমফের থাকতে পারে জানা ছিল না। ‘মৌচাক’ সিনেমাটাও তখন সেভাবে দেখা ছিল না। তাই ‘কীরকম রায়?’ শুনে যাকে বলে বেশ ‘ভড়কে’ গেলাম এবং কয়েক সেকেন্ড চুপ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পরের প্রশ্ন, যেন আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরে আমাকে একটা সূত্র ধরিয়ে দিতে চাইছেন, ‘ব্রাহ্মণ?’
আবার আমি বিচলিত। ক্লাস ফোরের ইতিহাস বইয়ে প্রথম পড়ি বর্ণাশ্রম বা চতুরাশ্রমের কথা। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। নিজের জীবনে আজ পর্যন্ত কে ব্রাহ্মণ, কে শূদ্র তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কেবল বড়ো হওয়ার পথে আর সবাই যেমন একটু একটু করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, সেভাবেই এটুকু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি যে, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় হল ব্রাহ্মণ। এটুকুই। কিন্তু ‘রায়’? সে-ও ব্রাহ্মণ? জানি না তো! আবারও চুপ করে থাকতে দেখে তিনি পরের প্রশ্নে গেলেন।
--- এদিক না ওদিক?
এটা আমি বুঝতে পারলাম।
--- এদিক।
এর পরে আরও খানিকটা প্রশ্নোত্তর-পর্ব চলেছিল। প্রশ্নগুলো আজ আর মনে নেই। উত্তরগুলোও হারিয়ে ফেলেছি।
কিন্তু এর পরের প্রশ্নটা আমি করলাম। ভাববাচ্যে।
--- আপনাকে আমার কী সম্বোধন করা উচিত হবে? (কারণ আমার পক্ষে ওঁকে ‘তারাপদদা’ সম্বোধন স্পর্ধা ছাড়া আর কিছুই নয়।)
--- তুমি আমাকে ‘সার’ বোলো।
কিন্তু আমি একটা ‘য ফলা’ যোগ না করে থাকতে পারিনি।
এর পরে বললেন, ‘তুমি আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে?’ শুনে আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, কী কাজ?’
স্যার বললেন, ‘আমার তো বয়েস হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আমি আর একটানা লিখতে পারি না। তুমি একটু আমার হয়ে লিখে দেবে? মানে, আমি বলব, তুমি লিখবে আর বাকিরা পড়বে।’
প্রায় লাফিয়ে উঠে বলি, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই।’
--- তাহলে আজ থেকেই শুরু করা যাক। দাঁড়াও, খাতা, পেন নিয়ে আসি। খাতা, পেন এল। শুরু হল আমার ‘অনুলেখক’-এর জীবন।
শুরুটা হয়েছিল রম্যরচনা দিয়ে। সেদিনের মতো লেখা হয়ে গেলে, চা জলখাবার খেয়ে উঠতে যাব এমন সময় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার বাড়ি থেকে এখানে কীভাবে এলে?’
বললাম, ‘প্রথমে রিকশা, তারপরে বাস।’
--- কীভাবে যাবে?
--- প্রথমে বাস, তারপরে রিকশা অথবা বাস।
এবার তিনি তাঁর পাশে রাখা মানিব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে আমাকে দিলেন। বললেন, ‘এটা রাখো।’
আমি সঙ্গেসঙ্গে প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, ‘এ কী! আমি তো টাকার জন্য আপনার লেখা লিখতে আসিনি! আমি তো . . .’
মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে স্যার বললেন, ‘তাতে কী? আসতে যেতে তোমার একটা পরিশ্রম তো হল? আমার জন্য তোমার তো খানিকটা সময় খরচ হল? এটা রাখো।’
একথার পর আর না করতে পারিনি। তার পর থেকে যেদিনই স্যারের বাড়িতে গেছি অনুলিখন করতে, কোনোদিন পঞ্চাশ, কোনোদিন একশো, কোনোদিন পাঁচশো টাকা দিয়েছেন। কোনোদিন আবার কিছুই দেননি। পুজোর আগে একবার হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
প্রথমদিন পঞ্চাশ টাকাটা নেওয়ার সময় অবশ্য আমি একটা কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, ‘টাকা আমি নিতে পারি, তবে একটা শর্তে। আমি যেদিন যেদিন আসব, আমাকে আপনার লেখা একটা বই সই সমেত দিতে হবে।’ স্যার রাজি হয়েছিলেন এবং সেই শর্ত কোনোদিন ভাঙেননি।
আগেই বলেছি, মুহূর্তগুলো সবাই আজও হাজির, শুধু তাদের রোল নম্বরগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। স্যারের সম্পর্কে আমার একাধিক আফশোস রয়েছে। সেসব কথা, কথার ফাঁকে একে একে হবে না হয়। প্রথম আফশোস হল, আমি মাত্র দেড় বছরের বেশি স্যারের সান্নিধ্য পেলাম না। তবে এই দেড় বছরে যেটুকু পেয়েছি তা কিছু কম নয়।
অনেকদিন ধরে আমার মনের ভেতরে একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিল যে বড়ো বড়ো লেখক, কবি, সাহিত্যিকরা কীভাবে লেখেন সেটা জানার। কোনোদিন যদি কারুর সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করব, ‘আপনি কীভাবে লেখেন?’
স্যারের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পেরে অন্তত একজন লেখকের লেখার পদ্ধতি দেখার সুযোগ পেলাম।
বড়ো অদ্ভুত, বড়ো মজার সে-অভিজ্ঞতা। একটা লাইন বললেন, লিখলাম। এরপর হঠাৎ কোথায় যেন চলে গেলেন। বুঝলাম, দোতলায় গেছেন। বেশ কিছুক্ষণ পর এলেন। দেখি, চান সেরে এসেছেন।
‘কী যেন বলছিলাম?’ আগের লাইনটা পড়ে শোনালাম। স্যার আবার বলতে শুরু করলেন। এই বলার মধ্যে কোনো ধন্দ নেই, দ্বন্দ্বও নয়। মাঝের এই আধ ঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিটের আচমকা বিরতি তাঁর চিন্তাসূত্রে কোনো বাধাই হয়নি।
একদিন সকালে গিয়ে পৌঁছোনোর পর কাগজ, পেন নিয়ে বসে স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, আজ কী লিখবেন?’
--- আজ যাচ্ছেতাই লিখব।
এমনধারা কথা শুনে কীরকম প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত?
আমি রীতিমতো থতোমতো। তারপর যে ঘটনাটা ঘটল সেটা আমার কাছে অবশ্যই একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা।
বললেন, ‘একটি পত্রিকা খুব করে ধরেছে। ওতে শেক্সপিয়রের ‘As You Like It’ নাটকটা বাংলায় অনুবাদ করব ভেবেছি। নাম দেব “যাচ্ছেতাই”।’
বললাম, ‘বাহ! খুব ভালো।’
স্যার বললেন, ‘অনুবাদ করব।’ এদিকে আমি দেখি, উপকরণ বলতে একটা নাটকের মূল টেক্সট, একটা ঝরঝরে মার্কা English to Bengali Dictionary আর একটা চওড়া প্যাড। উঁকি দিয়ে দেখি তাতে কয়েকটা বাঙালি নাম লেখা।
এরপর স্যার সামনে ওই প্যাডটা খুলে রেখে, এক হাতে নাটকের মূল টেক্সট আর অন্য হাতে ডিকশনারিটা খুলে রেখে ‘যাচ্ছেতাই’ বলে যেতে থাকলেন।
দুঃখের বিষয়, বেশ কয়েকটা পর্ব চলার পর পত্রিকাটা বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটার নামটাও আজ আর কিছুতেই মনে পড়ছে না।
সেদিন লেখার কাজ ছিল না। সেদিন ছিল বইপত্রগুলো একটু গুছিয়ে দেওয়ার কাজ। দোতলার ঘরের মেঝেতে সমস্ত বইপত্র ছড়িয়ে, থেবড়ে বসে কাজ চলছে। হঠাৎ আমার হাতে একটা বই দিয়ে বললেন, ‘আজ এই বইটা নাও।’ হাতে নিয়ে দেখি, ‘তারাপদ রায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা।’ সঙ্গেসঙ্গে বললাম, ‘এটা আমার আছে।’ বলে, ওঁকে বইটা দিয়ে দিলাম। স্যার বইটা নিয়ে বললেন, ‘আছে? ও।’ বলে পাশে রেখে দিলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, যা:! আজ মিস হয়ে গেল। আজ আর বই পাওয়া হল না। কিন্তু পরমুহূর্তেই অন্য একটা বই টেনে বের করে আমার হাতে দিলেন। আমিও বইটা সঙ্গেসঙ্গে ব্যাগে পুরে নিলাম।
এরপর আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন লেখে?’ আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জানতে চাইলাম, ‘কে?’ বললেন, ‘তারাপদ?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘দারুণ। খুব ভালো।’ জিজ্ঞেস করলেন, ‘একেবারে একটু অন্যরকম, না?’ বলি, ‘হ্যাঁ।’
এইসব প্রশ্নোত্তরের ফাঁকে অনুভব করি ‘অসামান্য তারাপদ রায়’ আর ‘সামান্য অনমিত্র রায়’-এর মধ্যে কোথায় যেন একটা সেতু তৈরি হয়ে গেছে।
ক্লাস টু-থ্রি-তে আমার হাতের লেখা মুক্তোর মতো ছিল। তার প্রমাণ আছে। হাতের লেখা পরীক্ষার একটা পাতার ফোটোকপি এখনও সযত্নে রাখা আছে।
কবে, কীভাবে যেন আমার হাতের লেখা খারাপ হতে শুরু করে। একসময় প্রায় গোপাল ভাঁড়ের অবস্থায় পৌঁছে যায়। কী লিখেছি তা পড়ে দেওয়ার জন্য নিজেকে তো উপস্থিত থাকতেই হয়, বরং আর এক ধাপ এগিয়ে কী লিখেছি সেটা বলে দেওয়ার জন্য অন্যের দ্বারস্থ হতে হয়।
পাঠক-পাঠিকার দল হয়তো ভাবতে বসেছেন, আমার হাতের লেখার সঙ্গে তারাপদ রায়ের কী সম্পর্ক। সেই কথাতেই এবার আসব।
সে ছিল এক শীতের সকাল। মিঠে রোদ, হালকা ঠান্ডা হাওয়া, ফুরফুরে মন। স্যারের বাড়িতে পৌঁছে প্রাথমিক দম নেওয়া হয়ে গেলে সেই ‘পরশপাথর’ সিনেমায় শ্রদ্ধেয় অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর স্টাইলে স্যার বললেন, ‘আজ সকালটা খুব ভালো। চলো, আজ পার্কে বসে রোদ মাখতে মাখতে লিখি।’
পার্ক মানে স্যারের বাড়ির দেওয়াল-ঘেঁষা সেই পার্কটা, যার কথা প্রথমেই বলেছি। স্যার আগে আগে চললেন, পেছনে পেছনে খাতা বগলে আমি।
পার্কটার গেট দিয়ে ঢুকে চার-পাঁচ পা পরেই একটা সিমেন্টের বেঞ্চ। স্যার গিয়ে তার ওপর বসলেন। আমিও গিয়ে পাশে বসলাম। একটু দম নিয়ে স্যার বলতে শুরু করলেন। আমিও ঘাড় নীচু করে, কোলের ওপর খাতাটা রেখে লিখতে শুরু করলাম।
এভাবে লিখতে আমার খুব অসুবিধে হয়। কষ্ট হয়। স্পন্ডিলোসিসের আভাস তো তখন পেতে শুরু করেছি। কিন্তু সেদিনের সেই রোদটা সব কিছু কেমন গোলমাল করে দিল। সব ভুলে লিখে যেতে লাগলাম। বড়ো একটা গল্প শুরু করেছিলেন।
একটু পরে দেখলাম, স্যার হঠাৎ বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে যাচ্ছেন, আমি বসে বসে লিখে যাচ্ছি। আচমকা স্যার সামনের দিকে দু-চার পা এগিয়ে গেলেন। আমি কিন্তু বসে বসেই লিখে যাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যার আরও কয়েক পা এগিয়ে গেলেন। এবার আমি খেয়াল করলাম, স্যারের কণ্ঠস্বর একটু যেন ক্ষীণ। স্যার আরও এগিয়ে যেতে কোনো শব্দই আর আমার কানে এল না। বাধ্য হয়ে আমিও বাঁ-হাতে খাতা আর ডান হাতে পেন ধরে এগিয়ে গেলাম।
এবার যেটা হল, স্যার দু-পা এগিয়ে এক লাইন বলেন, অমনি আমিও দু-পা এগিয়ে এক লাইন লিখি। পাঠক-পাঠিকাকে আশা করি বুঝিয়ে বলতে হবে না, যা লিখছি তার রূপ কীরকম খুলছে খাতার পাতায়।
এদিকে নিজেকে তখন রীতিমতো একজন রিপোর্টার বলে মনে হচ্ছে।
কোনোকালেই রাজনীতি বিষয়টা আমি পছন্দ করি না। কিন্তু সন্ধে সাড়ে সাতটার বাংলা খবর শোনার জন্য জেঠু বা বাবা বা অন্য কেউ টিভি খুললে কোনো কোনোদিন সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোককে দেখতাম রাইটার্স বিল্ডিং-এর বারান্দা পেরিয়ে দ্রুতগতিতে একটা ঘরে ঢুকছেন আর ঢোকার মুখে দু-সেকেন্ড দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে কিছু বললেন। অমনি পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একদল লোক আমার মতোই ঘাড় নীচু করে বাঁ-হাতের ওপর কোনোমতে কাগজ রেখে ডান হাতে কলম ধরে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে লিখে নিলেন।
সেদিন সেই মিঠে রোদের মধ্যে নিজেকে একজন করুণ রিপোর্টার বলে মনে হচ্ছিল। হঠাৎ স্যার আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘চলো, এবার ঘরে যাই।’
এবার আমরা ঘরে ফিরলাম। শীতের রোদ থেকে শীতের ছায়ায়।
একসময় লেখা শেষ হল।
খানিক দম নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
ভালোবাসা সহজে ধরা পড়ে না। যখন পড়ে তখন হয়তো দেখা যায়, ছায়া অনেকটা বুড়ো হয়েছে।
স্যার আমাকে ভালোবাসছেন এটা বুঝতে পারতাম, কিন্তু কতটা, সেটা সেই শীত-সকালটা না এলে হয়তো বোঝাই হত না কোনোদিন। সেদিন সাতসকালের টিকিয়াপাড়া-সল্টলেক মিনি উল্টোডাঙা মোড় পরিয়ে সল্টলেকের ঘেরাটোপে মাথা গলাতেই বুঝলাম, বেশ ঠান্ডা আছে। শ্রাবণী পেরোতে রীতিমতো কাঁপুনি শুরু হল।
এদিকে হাওড়ার বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছি তখন ঠান্ডার দাপট তেমন কিছুই বুঝিনি। ফলে গায়ে শুধু একটা ফুলহাতা শার্ট। একটু মোটা। স্যার আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, ‘গরম জামা কই?’ আমি বললাম, ‘গরম জামা আর গায়ে দিইনি। তেমন ঠান্ডা তো আর নেই।’
শুনে তিনি খাতা পেন ফেলে রেখে সটান চলে গেলেন দোতলায়।
ফিরে এলেন একটা ‘চোখ ধাঁধানো নীল’ রঙের বেশ বড়ো মাপের উলের চাদর নিয়ে। বললেন, ‘এক্ষুনি এটা গায়ে দাও। এটা গায়ে দিয়েই বাড়ি যাবে। ওদেশ থেকে এনেছি।’
গায়ে দেওয়ার পর অনুভব করলাম, অত নরম, অত তুলতুলে আর আরামদায়ক চাদর আমি তার আগে আর কোনোদিন গায়ে দিইনি। ভাবলাম, আজ তবে মনে হচ্ছে বইয়ের বদলে চাদর দিলেন। কিন্তু ঠিক পরের মুহূর্তেই বললেন, ‘কেচে, ইস্ত্রি করে ফেরত দিয়ো।’ বললাম, ‘আচ্ছা।’
ওরকম একটা চাদর হাতছাড়া হওয়াতে আমি বিন্দুমাত্র হতাশ হইনি। একটুও ভেঙে পড়িনি। কারণ তখন আমার মনে একটা ঘোরতর দুশ্চিন্তা জন্ম নিয়েছে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এত বড়ো একটা চাদর গায়ে দিয়ে বাসে চেপে, কিছুটা হেঁটে আমি সল্টলেক সেক্টর ৩ থেকে হাওড়া ফিরব কী করে!
জীবনে যে দুটো জিনিসকে খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে চলি, তারা হল শীতের চাদর আর গ্রীষ্ম, বর্ষার ছাতা। চাদর গায়ে যে পথে নামি না, সেকথা তো বললাম। এমনকী এ ঘর থেকে ও ঘরে যেতে হলেও চাদর গা থেকে খুলে হাতে নিয়ে ও ঘরে গিয়ে আবার গায়ে দিই। চাদর বা ছাতা সঙ্গে থাকলে আমার পদক্ষেপ তার ছন্দ হারায়। কাঠফাটা রোদে বাইরে বেরোতে হলে ব্যাগে ছাতা ভরি ঘরোয়া অশান্তির ভয়ে, মনে মনে ভাবি চারদিকে এত গিজগিজে বাড়ি, একফালি ছায়া থাকবেই। সেই ছায়াপথেই হেঁটে যাব। তাই ছাতা খোলার দরকার হবে না। বেরোনোর আগে বৃষ্টি শুরু হলে দু-মিনিট দাঁড়িয়ে যাই। ভাবি, থামলে বেরোব। বৃষ্টি হয়তো তখনও শুরু হয়নি, আকাশে মেঘের ঘনঘটা, ভাবি, বাসে তো উঠেই পড়ব, ছাতা বের করতে হবে না। তাই ব্যাগের ছাতা ব্যাগেই ঘুমোয়।
সেই শীত-সকালটা পেরিয়ে এসে আজ মনে হয়---
ছায়ায় ছাতা লাগে না। ছাতা থাকলে ছায়া পড়ে।