• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | গল্প
    Share
  • পিলুদের পাশের বাড়ি : চন্দ্রাবলী ধর



    ।।১।।

    পিলুদের পাশের বাড়িটার নাম ছিল মণিমঞ্জিল, তবে পিলুরা বলত অমু-সামুদের বাড়ি। ও বাড়ির দুই ছেলে অমু আর সামু পিলুদের সঙ্গেই খেলত। দক্ষিণ কলকাতার এই পাড়াটা পুরোনো বাঙালি পাড়া হলেও এখানে পাঁচমিশেলি নানা জাতের লোকের বাসও ছিল। পিলুর দিদা বলতেন ‘এক্কেরে ছত্রিশ জাইতের মেলা’। পিলুদের খেলার দলটি ছিল যেন ভারতবর্ষের ছোটখাট প্রতিরূপ। বাচ্চারা কোন ভাষার বাধা মানে না। হিন্দি, ইংরাজি,বাংলা,পাঞ্জাবী, গুজরাটী সব মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি ভাষায় কথাবার্তা চালাত ওরা, কোন অসুবিধা হত না।

    তখন সময়টা ছিল বেশ গোলমেলে। পৃথিবীজোড়া যুদ্ধ সবে থেমেছে বটে, কিন্তু দেশের অবস্থা থমথমে, এখানে সেখানে গণ্ডগোলও বাঁধছে থেকে থেকেই। পিলু আর ওর ভাই নীলু, দুজনেই তখন বেশ ছোট, বড়দের কথা বুঝতও না, মাথাও ঘামাত না। তবে দিদার কাছে শুনে শুনে জাতপাত বলে যে একটা মস্ত ব্যাপার আছে তা ওরা জেনে গিয়েছিল। পারেখদের বাড়ির কিষণরাম হল গুজরাটী, গ্যারেজবাড়ির গুরবচন আর প্রীতম সিং হল পাঞ্জাবী, মোড়ের বাড়ির কেদিয়ারা হল মাড়োয়ারী (দিদার ভাষায় মাউড়া), আর মুদীর দোকানের বিরজু চাচা হল বিহারী (দিদা বলতেন খোট্টা)। এছাড়া পিলুরা হচ্ছে বাঙাল, আর ওপাশের বাড়ির বুলুদিদিরা হল গিয়ে ঘটি (যাদের সঙ্গে খুব ভাব থাকা সত্বেও দিদা আড়ালে বলতেন ঘইট্যা)।

    এদের কারুকে নিয়ে পিলুর দিদার কোন সমস্যা ছিল না। ওঁর যত রাগ ছিল মণিমঞ্জিলের লোকেদের ওপর। অমু-সামুরা নাকি মুসলমান, তাই ওরা ভাল না। কয়েক মাস আগে পিলুর বাবা দিদাকে দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছেন। দিদা বলতেন, মুসলমানদের জন্যই ওঁকে চলে আসতে হয়েছে। কিন্তু তার জন্য অমু আর সামুর কী দোষ, তা পিলুর ছোট্ট মাথায় ঢুকত না। ওরা তো পিলুদের সঙ্গে মিত্র স্কুলে পড়ে, ওদের সঙ্গেই খেলে, পিলুদের দেশের বাড়ি তো ওরা চেনেই না। তাহলে দিদার ওদের ওপর এত রাগ কেন? এমনিতে পিলু আর নীলু দিদার চোখের মনি, কিন্তু এই একটি বিষয়ে দিদা কিছু বুঝতে চান না। অমু, সামুদের সঙ্গে খেলা নিয়ে খুব গণ্ডগোল করেন, এমনকি বাবাও বোঝাতে গিয়ে হার মেনেছেন। অমুর বাবা আলী চাচা তো পিলুর বাবার খুবই বন্ধু। বাবার বৈঠকখানা ঘরের আড্ডাতেও নিয়মিত আসতেন, কিন্তু আজকাল আর আসেন না। পিলু, নীলু ছোট হলেও বুঝতে পারত, সব কিছু ঠিক নেই।

    কিন্তু ছোটরা তো ছোটই, তাই চারপাশে অনেক ওলটপালট হলেও, ওরা ওদের নিজেদের জগতে--স্কুল, গল্পের বই, খেলার সাথী--এই সব নিয়ে বেশ আনন্দেই ছিল। পিলুর মনে আছে, ও যখন আরো ছোট ছিল তখন সন্ধ্যে বেলা ঘুরঘুট্টি অন্ধকার হয়ে যেত, তার নাম ছিল ব্ল্যাক আউট। মাঝে মাঝেই জোরে সাইরেন বাজত, পিলুরা সবাই ছুটে গিয়ে একতলার সিঁড়ির নীচে লুকিয়ে পড়ত, ভারি মজা লাগত পিলু, নীলুর। অবশ্য হাসাহাসি করলে মার কাছে বকুনি খেতে হত। জাপানিরা ‘এরোপ্পেলেন’ নিয়ে আসছে, বোমা ফেললে সবাই মরে যাবে, এসব শুনলে ভয়ে ভয়ে চুপ করে থাকত দুই ভাই। অবশ্য জাপানিরা শেষ অবধি কলকাতায় আসেনি, যুদ্ধও হয়নি। তবে পিলুর মনে আছে এর পরেও অনেক দিন পর্যন্ত বাবাকে বলতে শুনেছে সুভাষ বোস যদি জাপানিদের সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন তাহলে ব্রিটিশরা পালাতে পথ পাবে না, স্বাধীনতা পেতেও আর কোন অসুবিধে হবে না। স্বাধীনতা, সুভাষ বোস, গান্ধীজী, এই সব শব্দ আর নাম তো সবসময়ই শুনতে পেত পিলু, কিন্তু দুর্ভিক্ষ শব্দটা তখনও শোনেনি।

    ।।২।।<

    তারপর কবে থেকে যেন রাস্তায় রাস্তায় অনেক লোক ভিক্ষে করতে শুরু করল। বড়দের কথা শুনে পিলু, নীলুও জেনে গিয়েছিল যুদ্ধের জন্য চাল পাওয়া যাচ্ছে না, তাই গ্রামের লোক শহরে চলে এসেছে ভিক্ষে করতে। ভিখিরি তো সবসময়েই থাকে, মা তাদের সিধেও দেন, কিন্তু তখন সব রাস্তা ভরে যেত ভিখিরিতে। তারা ‘মাগো, একটু ফ্যান দাও’ বলে কাঁদত। দুর্ভিক্ষ কথাটা তখনই শুনেছিল পিলু। সেই সময় পাড়ার বড় খেলার মাঠে ক্লাবের দাদারা খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াত। বাবা, আলী চাচা আরও পাড়ার সব বড়রা মিলে ব্যবস্থা করেছিলেন। একদিন মানদা মাসি সকালের দুধ নিয়ে ফিরে এসে হাঁউমাউ করে চেঁচাতে লাগল--পাড়ার মোড়ে একটা লোক মরে পড়ে আছে। মা মানদা মাসিকে বকে থামিয়ে দিলেন। কিন্তু পরে স্কুল যাওয়ার পথে এরকম মড়া ছোটরাও অনেকবার দেখেছে। ব্যাপারটা ক্রমশ যেন গা সওয়া হয়ে গেল।

    তবে সেসব দিনও একসময় কেটে গেল। এখন অত ভিখিরি আর নেই। দুর্ভিক্ষের কথাও সকলে প্রায় ভুলেই গেছে তবু পিলুর মনে হত ভেতর ভেতর কী যেন একটা বদলে গেছে। বাবার বৈঠকখানা ঘরের আড্ডায় তেমন তর্কাতর্কি, চেঁচামেচি হয় না, সকলেই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে আস্তে আস্তে কথা বলেন। এরই মধ্যে বাবা দেশের বাড়ি থেকে দিদাকে নিয়ে এসেছেন। মুসলমানদের জন্যই নাকি দিদাকে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। রায়ট কথাটাও নতুন শুনল পিলু। পুব বাংলায় নাকি অনেক জায়গায় রায়ট হচ্ছে, ওখানে থাকা আর নিরাপদ নয়। বাবা জোর করেই দিদাকে নিয়ে এসেছেন। তাই মুসলমানদের ওপর দিদার খুব রাগ--অমু, সামু, আলী চাচা, সক্কলের ওপর দিদার রাগ।

    পাড়ার বড় মাঠে বড় ছেলেরা খেলত। তাই ছোটদের দলটা খেলার জন্য এর ওর বাড়ির উঠোনে এসে জুটত। একদিন পিলুদের উঠোনে খেলার সময় ওদের বারান্দায় বল পড়েছিল। অমু সামনে ছিল, সকলে ওকে বলটা আনতে বলল। ও গেল না, নীলুকে বলল, তুই যা। নীলু বল নিয়ে এল। কেউ কিছু বলল না, ছোটরাও বুঝে গেছিল, সব কিছু আর আগের মত নেই। পিলু একদিন মাকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করল--মা, অমুরা তো খুব ভাল, দিদা কেন ওদের ওপর রাগ করেন। মা বললেন, ওরা ভাল, তবে আরো অনেকে আছে, যারা খারাপ।

    কারা যে খারাপ তা অবশ্য পিলুর জানা হয়নি। একদিন সকালে দেখল সারা পাড়ায় খুব উত্তেজনা, শুনল কলকাতাতেও রায়ট লেগে গেছে। বাবা রোজকার মত কোর্টে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু একটু পরেই ফিরে এলেন। বললেন পার্ক সার্কাসে, খিদিরপুরে অনেক বাড়ি লুট হয়ে গেছে, মুসলমানরা হিন্দুদের খুব মারছে। শহরের পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। সেদিন বিকেলেই পিলুদের বৈঠকখানা ঘরে পাড়ার বড়দের মিটিং বসল। মিটিংএর পরে ঠিক হল পাড়ার ছেলেরা রাত জেগে পাড়া পাহারা দেবে। পিলু শুনল, বাবা খেতে বসে মাকে বলছেন,--শুনতাছি, এইবার হিন্দুরাও পাল্টা এ্যাটাক শুরু করছে। এই পাড়ায় যে একঘর মুসলমান আছে সে তো অনেকেই জানে। মা ভয় পেয়ে বললেন--এই পাড়ায়ও কি এ্যাটাক হইব নাকি! বাবা বললেন, --কওন যায় না। যা পরিস্থিতি, সাবধান তো থাকতেই হইব। আলীভাইরে কইলাম, খিদিরপুরে আত্মীয়বাড়ি চইলা যাইতে। রাজি হইল না। বলে, এ পাড়ায় আমার কিছু হবে না--তোমরা তো আছ। মা বললেন, --ঠিকই তো। এ পাড়ায় কে ওনার ক্ষতি করব। বাবা চিন্তিত মুখে বললেন, -তাছাড়া, এখন পাড়ার বাইরে যাওয়াটাও ঝুঁকি হইতে পারে।

    এসব শুনে খুব ভয় করছিল পিলুর, নীলুর দিকে তাকিয়ে দেখল, ওর মুখটাও ভয়ে শুকিয়ে গেছে। দিদা এতক্ষণ বসে সব শুনেছিলেন, এবার নিঃশব্দে উঠে চলে গেলেন।

    ।।৩।।

    রাত বেশি বাড়ার আগেই গোলমাল বাড়ল। পারেখ কাকা আর নবনী জ্যেঠু এসে পিলুর বাবাকে ডাকলেন। জানা গেল দেবেন ঘোষ রোডে দাঙ্গা হচ্ছে। কথাবার্তা শুনে দিদা নেমে এসেছিলেন। কোন ভূমিকা না করেই পিলুর মাকে বললেন,--বৌমা পিছনের পাঁচিলের দরজাটা খুইলা দাও। বাবাকে বললেন,--আলীসাহেবরে কও, ওগো দিকের তালা খুইলা এদিকে চইলা আসতে। এক্ষনি, শুধু হাতে। পিলুদের আর অমুদের বাড়ির মাঝখানের পাঁচিলে একটা ছোট খিড়কি দরজা ছিল। আগে সেটা প্রায় সময় খোলাই থাকত। দু বাড়িতে যাতায়াত ওই পথেই হত, কিন্তু ইদানীং বন্ধই ছিল।

    আলীচাচা, আমিনা চাচী আর অমু, সামুরা আসতেই দিদা মাকে বললেন, --সক্কলরে উপরে আমার শোওয়ার ঘরে লইয়া যাও। আলীচাচা ইতস্তত করছিলেন। দিদা ঘোমটার আড়াল থেকেই বললেন, --দেরি করবেন না, উপরে চইলা যান। আলীসাহেব মৃদু স্বরে বললেন,--মা বাড়িটা খালি রেখে এলাম। দিদা কথা শেষ করতে দিলেন না, বললেন,--আপনে যান। এরা সব আছে, ব্যবস্থা একটা হইব। পিলুর মনে হল, দিদা যেন দক্ষ সেনাপতির মত পুরো ব্যাপারটা পরিচালনা করছেন। বাবা, নবনী জ্যেঠু আর পারেখ কাকাও তখন হাঁ করে দিদার দিকে তাকিয়ে আছেন। পিলুর মা সকলকে নিয়ে ওপরে চলে গেলেন। দিদা তখনও নীচেই রইলেন। তারপর কী কথা হয়েছে পিলুর আর শোনা হয়নি, মার সঙ্গেই ও দোতলায় চলে এসেছিল।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা আর দিদা ওপরে উঠে এলেন। তার আগেই বাইরের গেটে তালা পড়ে গেছে, বাড়ির সব দরজা জানালাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দিদার ঘরে আলীচাচারা আছেন, দিদা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। বাবাও ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে দিলেন। সকলেই শুয়ে পড়ল। সেই রাতটা ওরা কেউ সারা জীবনেও ভোলেনি। নীলু আর পিলু কাঠ হয়ে শুয়েছিল, ঘুম আসেনি। পাশের খাটে বাবা মাকে খুব নীচু স্বরে কি বলছিলেন তা ওরা শুনতে পায়নি।

    ঘন্টা খানেকও বোধ হয় কাটেনি, হালকা ঘুমের চটকা ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসল পিলু। প্রচণ্ড চিৎকার আর দড়াম দড়াম শব্দ। পিলুর মনে হল বাইরের গেটের ওপর ঝড় আছড়ে পড়ছে। পিলুদের ঘরে থাকতে বলে বাবা বারান্দায় বের হলেন। ঘর থেকেই ওরা দেখল ওদিকের দরজা খুলে দিদাও বেরিয়ে এসে বাবার পাশে দাঁড়িয়েছেন, বারান্দার আলোটাও জ্বালিয়ে দিয়েছেন। বাবা কিছু বলার আগেই দিদা জোর গলায় বললেন,--আপনারা কারা, কী চান এখানে? দিদাকে দেখে ভিড়ের লোকগুলো একটু থতমত খেয়ে গেল, তারপর ওদের মধ্যে থেকে একটা ষণ্ডামত লোক বলল,--মা-জী, মুসলমান লোগোঁকো নিকাল দিজিয়ে, বাস হমলোগ চলা যায়েঙ্গে। দিদা কড়া গলায় বললেন,--দেখো, আমি জপ ছাইড়া উইঠা আসছি। আমরা সদব্রাহ্মণ, আমাগো গৃহদেবতা আছেন। আমরা মুসলমানরে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দিমু না। দিদা রাতে শোয়ার আগে অনেকক্ষণ জপ করেন, জপের মালা হাতে নিয়েই বেরিয়ে এসেছিলেন।

    দিদার কথায় লোকটা যেন থমকে গেল, তবু বলল,--হাঁ মা-জী, ও তো ঠিক বাত, কিন্তু ওই বাড়ির মুসলমানগুলো কোথায় গেল। সব বাড়িটা আমরা একবার দেখব। দিদা ধীর স্বরে বললেন,--কোথায় গেছে তা তো জানি না। বাড়ি দেখতে চাও তো দেখ, তবে একজনের বেশি ঢুকবা না। লোকটা ইতস্তত করছে দেখে দিদা আবার বললেন,-- আমার ছেলে নীচে যাইতাছে, সে জামিন রইল, তোমরা একজন ভিতরে আস। বাবা নীচে গেলেন, দারোয়ানজী গেট খুলে ওই ষণ্ডামার্কা লোকটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে আবার গেটে তালা দিয়ে দিল। পিলুর বুকের ভেতর তখন হাতুড়ি পিটছিল। পিলু নীলু দুজনেই নিজেদের অজান্তেই মাকে জড়িয়ে ধরেছিল। পিলুর আজও মনে আছে, মার হাতটা ওর বরফের মত ঠাণ্ডা মনে হয়েছিল।

    লোকটা বাবার সঙ্গে নীচের তলাটা ঘুরে দেখল। বাবা নীচে গেটের কাছেই রইলেন। পিলুদের বাড়ির সব সময়ের কাজের লোক কানাইদাদা ওকে নিয়ে দোতলায় এল। দিদা এবার পিলুকে ডেকে নিলেন, --ভাই, আমার সঙ্গে আস তো। বাইরের পুরুষমানুষের সামনে একা মহিলা বার হওয়ার চল ছিল না সেকালে। তাই পিলুকেই সঙ্গে নিলেন দিদা। দিদার পরনে জপের মটকার শাড়ি, গলায় তুলসীর মালা, হাতে তো জপের মালা আছেই। লোকটা আপনি থেকেই মাথা নীচু করে বলল, --পরণাম মাতাজী।

    পিলু আর কানাইদাদাকে নিয়ে দিদা এগিয়ে গেলেন, লোকটাকেও সঙ্গে যেতে বললেন। বারান্দার লাগোয়া চারখানা ঘর। লোকটা একে একে ঘরে ঢুকে দেখছে। পিলুদের শোওয়ার ঘরেও ঢুকল। মা নীলুকে নিয়ে জড়সড় হয়ে বসেছিলেন। বারান্দার শেষে দিদার ঘর, তার দরজাটা ভেজানো। ভয়ে বুক ধুকপুক করছিল পিলুর, কানাইদাদারও মুখ কালো হয়ে গেছে। দিদা নিজেই দরজার পাল্লাটা ঠেলে খুলে দিলেন, তারপর সহজ ভাবেই বললেন,-- এই ঘরে আমি থাকি, আর ওই আমার ঠাকুরঘর। লোকটা ঘরের ভেতর উঁকি মেরে দেখল। লোকটার সঙ্গে পিলুরাও দেখল ঘরে কেউ নেই। ঠাকুরঘরেরও দরজা খোলা, বাইরে থেকে দিদার ইষ্টদেবতা রাধামাধবজীর মূর্তি দেখা যাচ্ছে, ধূপ জ্বলছে, সামনে জপের আসন রয়েছে আধভাঁজ করা। দেখে বোঝাই যাচ্ছে, দিদা জপ করতে করতে উঠে গেছেন। লোকটা ঘরের মাঝামাঝি গিয়েছিল, কিন্তু এবার বেরিয়ে এসে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইল,-- মাফ কীজিয়ে মাতাজী, কোই শালা বলল এ বাড়িতে আছে।

    যে তিন দিন রায়ট চলেছিল আলীচাচারা পিলুদের বাড়িতেই ছিলেন। দিদার ঠাকুরঘরে বাসনের আলমারির পিছনে অল্প একটু জায়গা ছিল, বাইরে থেকে সেটা বোঝা যেত না। ওখানেই দিদা লুকিয়ে রেখেছিলেন আলীচাচাদের। মণিমঞ্জিল লুট হওয়া থেকেও বাঁচানো গিয়েছিল। দিদার কথামতই নবনী জ্যেঠু পাড়ার ছেলেদের নিয়ে বাড়ি দখল করে বসেছিলেন। পাড়ার লোকেরা বলেছিল,--আমাদের পাড়ার বাড়ি, আমরাই লুট করছি, তোমাদের কিছু দেব না। এই কথায় দাঙ্গাবাজরা ফিরে গিয়েছিল।

    বেশ কয়েকদিন পরের কথা। শহর তখন শান্ত, রায়ট থেমে গেছে। পিলুর বাবা একদিন দিদাকে বললেন,--ঠাকুরঘরে ওঁরা সব ছিলেন, শোধন করা তো লাগব। দিদা কথাটা শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন,--লোকজন থাকলে কিছু অপরিষ্কার তো হয়ই। সে আমি আর বৌমা মিলা ভাল কইরা গঙ্গাজলে ধুইয়া মুইছা লইছি, আর কিছুর প্রয়োজন নাই। পিলু জিজ্ঞেস করল,--লোকগুলো যদি ঠাকুরঘরে ঢুকে পড়ত দিদা? --ঢুকত না ভাই, স্বয়ং রাধামাধব পাহারায় ছিলেন যে। এবার বাবার দিকে তাকিয়ে দিদা খুব মৃদু স্বরে বললেন,--আজন্মের সংস্কার তো ছাড়তে পারি না। তাই আচারবিচার এসব তো থাকবই। কিন্তু বিপন্নকে রক্ষা করা হইল ধর্ম। আমার মন কয়, যা করছি, রাধামাধবের নির্দেশেই করছি। তাই কোন শোধন আর লাগব না। তাছাড়া, রাধামাধবরে অপবিত্র করে এমন ক্ষমতা কার আছে! পিলু দেখল, বাবা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে দিদার দিকে তাকিয়ে বললেন,--মা এখনও তোমার কাছে আমার অনেক শিখনের বাকি। পিলুর মারও চোখ তখন জলে ভরে গেছে। দিদা কিছু না বলে পিলু আর নীলু, দুজনকে দুহাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলেন। পিলু দেখল দিদার মুখটা কেমন আলো আলো হয়ে গেছে।

    মা আর বাবা দুজনেই মাথা নীচু করে দিদাকে প্রণাম করলেন। পিলু কিছু বুঝে কিছু না বুঝে দিদাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, দেখাদেখি নীলুও।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments