• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থ-সমালোচনা : ভবভূতি ভট্টাচার্য

    || ফেলে দে রেশমী চুড়ি বঙ্গনারী ||



    ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই; শিশির কর; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর ১৯৮৮; ISBN 81-7066-137-4


    কিছু কিছু বইয়ের কোনো ‘কাল ’ হয় না।

    পঁয়ত্রিশ বছর আগে প্রথম প্রকাশিত কোনো এক নন-ফিকশন, যার বাণিজ্যিক মূল্যও বড় একটা উচ্চ হবার কথা নয়, এবং যে বই নির্মাণের পিছনে তার আগের দশক দেড় নিয়োজিত ছিল এক অনামী গবেষক দ্বারা—তার সামনে মাথা নত হয়ে আসবে না তো কী?! বহু পরিশ্রমে, বহু সময়-ও-অর্থ ব্যয় করে, কখনো জলপানি জোগাড় করে বছর দশ-বারো ধরে দিল্লি-কলকাতা-লন্ডন ঘুরে ঘুরে উনি নির্মাণ করেছিলেন এই বই। শিশির কর মশাই কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসবেত্তা নন। হাওড়ানিবাসী মধ্যবিত্ত ঘরের এই সাংবাদিক মানুষটি যে নিবেদিতপ্রাণতা নিয়ে এই বইটি লিখেছেন তার তুল্য বই বাংলাভাষায় অধিক সংখ্যায় লেখা হয়েছে বলে জানি না।
    আসুন, আজকের এই গ্রন্থ-পরিচয় কলমটির মাধ্যমে এই মহাগ্রন্থটির পঞ্চত্রিংশতম বার্ষিকী পালন করি আমরা!

    ***

    যুগে যুগে দেশে দেশে শাসকের রোষে পড়ে লেখকদের নির্যাতিত হবার নজির তো আর কম নেই! প্রাচীন গ্রীসও এরিস্টোফেনিসের ব্যঙ্গনাটিকার ঝাঁঝ সইতে না পেরে নিপীড়ন করেছিল তাঁকে। যুগান্তকারী ‘ডন কিহোতে’ উপন্যাসের স্রষ্টা মিগেল সার্ভান্তেকেও কম নির্যাতন সইতে হয়নি। পঁচিশ বছর বয়সি কাজী নজরুলের ‘বিষের বাঁশি’ কাব্যগ্রন্থ নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার; শুধু তা-ই নয়, তার আগে-পরে তাঁর আরও চার-পাঁচটি গ্রন্থ! ব্রিটিশ বাংলায় নজরুলেরই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বই বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, তাতেও দমানো যায়নি ‘বিদ্রোহী কবি’-কে (এই গ্রন্থে তাই তাঁর উপরেই নিবেদিত রয়েছে একটি অধ্যায়)।
    স্বাধীন ভারতেও কি তার ব্যত্যয় ঘটেছে? ভোটবাক্সের দিকে তাকিয়ে রাজীব গান্ধী ‘সাটানিক ভার্সেস’ ব্যান করেননি কি?

    ***

    এক গবেষকের নৈর্ব্যক্তিকতায় ষোলটি অধ্যায়ে গ্রন্থটিকে বিভক্ত করেছেন লেখক, অতঃপর তিনখানি ‘পরিশিষ্ট’-ও কম উপযোগী নয়। এখানে যেমন বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলাদা আলাদা অধ্যায় রয়েছে, তেমনি নিষিদ্ধ প্রবন্ধ-উপন্যাস-নাটক-গান নিয়েও রয়েছে নিবেদিত অধ্যায়। শুধু বই-ই নয়, ক্ষুদিরামের ফাঁসির পরে এক রকম ধুতির পাড় জনপ্রিয় হয়েছিল যেখানে লেখা থাকত, ‘বিদায় দে মা, ঘুরে আসি’ । ১৯১০-এর ১২ই মার্চ এক আদেশবলে ব্রিটিশ সরকার এই ধুতিও নিষিদ্ধ করে—শিশিরবাবুর এ’বই না পড়লে জানতে পারতুম কি? আবার, চারণকবি মুকুন্দদাসের যাত্রাপালা শুনে চলে যাবার সময়ে দেখা যেত মহিলাদের চিকের আড়ালে অনেক ভেঙে ফেলা রেশমী চুড়ি পড়ে আছে [‘ফেলে দে রেশমী চুড়ি বঙ্গনারী’] --এ-ও’ তো জানতুম না! ‘ছিল ধান গোলা ভরা, শ্বেত ইঁদুরে করল সারা’ গানটি বাঁধার জন্যে মুকুন্দদাসের তিন বছর কারাদণ্ড হয়!
    এ’সব পড়লে মনে হয়, কত পুণ্যবলে স্বাধীন ভারতে জন্মেছি—এঁদের কর্মফলে!

    ***

    শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাস নিষিদ্ধ করা নিয়ে পরাধীন ভারতবর্ষে যতটা বাদ-প্রতিবাদ-বিসম্বাদ হয়েছিল তার তুলনা আর বড় একটা পাওয়া যায় না। এই বইতে তার দীর্ঘ আখ্যায়িকা বিধৃত রয়েছে, বিশেষত এ’বিষয়ে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া-সহ, যেটা শরৎচন্দ্রকে বিশেষ ব্যথিত করে। শরৎকে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যুত্তর লিখেছিলেন,
    ….লেখক যদি গর্হণীয় মনে করেন তাহলে চুপ করে থাকতে পারেন না। কিন্তু চুপ করে না থাকার যে বিপদ আছে সেটুকু স্বীকার করাই চাই। …ইংরাজ সরকার যদি পথের দাবী-র প্রচার বন্ধ করে না দিত, তাহলে তোমার প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে তার নিরতিশয় অবজ্ঞা প্রকাশ পেত। শক্তিকে আঘাত করলে তার প্রতিঘাত নেবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।

    উপরন্তু, ইংরেজ সরকারকে ‘যথেষ্ট সহনশীল’ বলেও বর্ণনা করেছিলেন কবি।
    কে ঠিক কে ভুল সে বিতর্কে না গিয়ে এক গবেষক-ছাত্রের নৈর্ব্যক্তিকতা নিয়ে বিষয়টি পাঠ করতে চাইলে এই বইয়ের এই অধ্যায়টি অপরিহার্য। এক জায়গায় এ’সংক্রান্ত তাবৎ তথ্য পেয়ে যাওয়া কম কথা নয়।

    ***

    একটা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টিকোণ এসেছে।
    ‘লোলিতা’ বা ‘লেডি চ্যাটার্লি’জ লাভার’-এর মতো গ্রন্থ অশ্লীলতার দায়ে অনেক দেশে নিষিদ্ধ হলেও ব্রিটিশভারতে ‘পাঁক’ [উপন্যাস। প্রেমেন্দ্র মিত্র], ‘মাধবী প্রলাপ’ [কবিতা। নজরুল] বা, ‘রজনী হল উতলা’ [গল্প। বুদ্ধদেব বসু]-র মতো সাহিত্যকর্ম অশ্লীলতার দায়ে আলোচিত/নিন্দিত হলেও, বা লেখককে লালবাজারে ডেকে ধমকে দেওয়া হলেও কিন্তু নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়নি কখনও। অর্থাৎ, শ্লীল-অশ্লীল বিতর্কের থেকেও রাজদ্রোহিতা (sedition)-এ ব্রিটিশসিংহ বেশি ডরে ছিল, এটা তার প্রমাণ। লক্ষণীয়, এই তালিকায় ‘পোনাঘাট পেরিয়ে’ [গল্প। প্রেমেন্দ্র মিত্র], ‘বন্দীর বন্দনা’ [কবিতা। বুদ্ধদেব বসু] বা, ‘বেদে’ [উপন্যাস। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ]-ও স্থান পেয়েছে, সাহিত্যগুণে যেগুলি কালোত্তীর্ণ, এবং অশ্লীলতার সামান্য ছিটেও যাদের গায়ে লাগার কথা নয়।
    নিষিদ্ধ গ্রন্থরাজি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা তো পনেরোটি অধ্যায় জুড়ে রয়েইছে, অতঃপর ষোড়শ অধ্যায় এবং ‘পরিশিষ্ট’ জুড়ে নানান ইস্তাহার, পুস্তিকা ও পত্র-পত্রিকা নিষিদ্ধিকরণের কারণ ও সালতামামি-সহ সুদীর্ঘ তালিকাখানি দেখলে লেখকের পরিশ্রমের ব্যাপ্তির সামনে মাথা ঝোঁকাতে হবেই। বাংলাভাষায় এমন গবেষণাসমৃদ্ধ কাজ আর কয়টা হয়েছে, দুই-এক আঙুলের কড় গুণলেই শেষ হয়ে যাবে।

    বাংলাসাহিত্য তথা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের কোনো ছাত্রের ব্যক্তিগত সংগ্রহে এ’ বই না থাকলে তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

    ||| বিশ্ব তখন তারার আলোয় দাঁড়ায়ে নির্বাক্‌ ||


    শতবর্ষের সেরা সওগাত-- সম্পাদনাঃ সফিউন্নিসা; মিত্র ও ঘোষ,, কলকাতা-৭৩; প্রথম প্রকাশঃ মাঘ ১৪২৪; ISBN 978-93-5020-287-6




    ‘অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক
    তখন আমি ছিলেম শয়ন পাতি।
    বিশ্ব তখন তারার আলোয় দাঁড়ায়ে নির্বাক্‌
    ধরায় তখন তিমির গহন রাতি।’
    এ’ পঙ্‌ক্তি কয়টি ‘পূজা’ পর্যায়ের একটি গান হিসেবেই বেশি পরিচিত, যদিও এই কবিতাখানির আরেকটি গূঢ় পরিচিতি আছে।

    ***

    মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে তাঁর জন্মসনটি মিলে যায়—১৮৮৮ খ্রি:—যদিও মৌলানা জন্মেছিলেন মক্কায় আর ইনি পুববাংলার চাঁদপুরে। প্রাথমিক কর্মজীবন ও স্বীকৃতি দুজনেরই শহর কলিকাতায়, যেখানে টাকার থলি হাতে নিয়ে এক গ্রাম্যযুবক নাসিরউদ্দীন এসে পড়েছিলেন … কী করতে? ... ভাবা যায়, একটা বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করতে! ভেবে দেখুন, সুধী পাঠক, প্রত্যন্ত পূর্ব
    বঙ্গের এক দরিদ্রঘরের সন্তান সেকালে বীমা ব্যবসায় করে বেশ দু’ পয়সা উপার্জন করেছেন, এবং সে টাকা ইলিশের ব্যবসায় পুনরায় না ঢেলে তিনি সটান কলকাতায় চলে এলেন মুসলমান বাঙালির অশিক্ষা-কুসংস্কার দূরীকরণ হেতু এক বাংলা সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ করতে!

    সেই ‘বঙ্গদর্শন’-এর কাল থেকে কলকাতাকেন্দ্রিক নামী বাংলা পত্রিকার অভাব তো নেই কোনো, তখনও ‘ভারতবর্ষ’, ‘প্রবাসী’-র মতো পত্রিকাগুলি রমরম করে চলছে। না, ঠিক করেছেন, ‘মুসলমানদের বৌদ্ধিক উন্নতির জন্যে ’ পত্রিকা বের করবেন নাসিরউদ্দীন!

    বেশ তো, সেও তো ‘মিহির ও সুধাকর’, ‘কোহিনুর’, ‘নবনূর’-এর মতো পত্রিকার মাধ্যমে ইতোমধ্যেই প্রয়াস করে গেছেন রেয়াজুদ্দীন আহমেদ--রওশন আলি--এমদাদ আলীর মতো নামীদামী সাহিত্যিক-সাংবাদিকগণ।

    কিন্তু, ‘মিহির’, ‘কোহিনূর’ বা ‘নবনূরে’র মতো নামী ‘ইসলামী’ পত্রিকায় কি ছবি ছাপা হতো? জীবন্ত প্রাণীর ছবি ছাপা যে হারাম! আমাদের নাসিরউদ্দীন সাহেবের যুগান্তকারী এই ‘সওগাত’ [অর্থ হয়ঃ ‘উপহার’; প্রথম প্রকাশ--১৯১৮] পত্রিকা কিন্তু শুরু থেকেই ছবি (পরে রঙিন ছবিও), বিশেষত বেপর্দা নারীর ছবি ছেপে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। পত্রিকা হাতে পেয়েই ‘যুগনারী’ মা রোকেয়া টেলিফোনে ভূয়সী অভিনন্দন জানালেন সম্পাদক মোহম্মদ নাসিরউদ্দীন সাহেবকে, যিনি ততক্ষণে জোড়াসাঁকোর উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছেন—কবিগুরুর হাতে ‘সচিত্র সওগাত’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি তুলে দিতে হবে না? পত্রিকা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে, তার ছবিছাবা দেখে ও বেগম রোকেয়া-মানকুমারীর কবিতা পড়ে অভিভূত হন গুরুদেবও; স্বেচ্ছায় উপরের ঐ কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন ‘সওগাত’-এর দ্বিতীয় সংখ্যার জন্যে, এবং বিশেষভাবে জানিয়ে দিলেন এর জন্য কোনো অর্থমূল্য যেন না দেওয়া হয় তাঁকে।

    ‘সওগাত’-এর কবিতা-গল্প-নিবন্ধ পড়ে মোহিত পাঠককুল, কিন্তু গোঁড়া এক মৌলবী লিখে পাঠালেন, ‘সবই তো ভালো, কিন্তু ঘরে মানুষের ছবি ছাপা কাগজ থাকলে যে আমার নমায কবুল হবে না।’

    ‘পকেটে রাণীর ছবি আঁকা কারেন্সি নোট রেখে নমায পড়লে যদি নমায হাসিল হয় তো ‘সওগাত’ কী দোষ করল?’—রসিক সম্পাদক নাসিরউদ্দীনের হাজির-জবাব!
    ভাবা যায়?!

    ***

    প্রায় ছয় শত পৃষ্ঠার বর্তমান পৃথুলা সংকলনটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার নামী প্রকাশনালয় থেকে, সম্পাদনায় রয়েছেন ততোধিক নামী এক সাংবাদিক। প্রতি পাতায় পাতায় যত্নের ছোঁয়া। ছাপাই-বাঁধাই চমৎকার। কোনো মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়ল না। আর, আচার্য শহীদুল্লাহ্‌ থেকে এস্‌ ওয়াজেদ আলী [‘ভারতবর্ষ’-খ্যাত ] থেকে প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, রাধারাণী দেবী থেকে সুনির্মল বসু [কবিতাঃ ‘বিশ্ব-নবী’] প্রমুখ নামীদের লেখা পড়তে পড়তে আফশোষ—কেন এতদিন খোঁজ পাইনি এ’ মণিমুক্তোর, যদিও ‘সওগাত’ পত্রিকার নামটির সঙ্গে পরিচিত তো ছিলাম। প্রকাশক ও সম্পাদিকা, তাই, মস্ত বড় একটা কাজ করলেন, বিশেষত এপার বাংলার পাঠকদের জন্যে। নৈলে, প্রেমেন্দ্র মিত্র যে ‘সিনেমায় আলোর ব্যবহার’ নিয়ে বা দীনেশচন্দ্র সেন ‘বঙ্গভাষায় মুসলিম প্রভাব’ নিয়ে, বা ভাষাচার্য মহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাট্যকাব্য নিয়ে অসাধারণ সব নিবন্ধ লিখে গিয়েছিলেন—সে সব জানতুম কী করে?

    আর, সর্বোপরি কাজী-দা তো ছিলেনই! তাঁর ‘খালেদ’-এর মতো দীর্ঘ কবিতা ও ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ গল্প এই পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছিল, শেষেরটি তিনি করাচি থেকে পাঠিয়েছিলেন, যখন সেখানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার ছিলেন।

    ***

    ‘সওগাত’ নিয়ে কত যে উদ্ভাবন, কত যে নিরীক্ষা করেছিলেন নাসিরউদ্দীন সাহেব তার তুলনা নেই। এর মধ্যে আছে ‘মহিলা সওগাত’ (পরে ‘বেগম’ পত্রিকা ) ও ‘শিশু সওগাত’-এর প্রকাশনা, যুব-সম্মেলন, চলচ্চিত্র-সমালোচনা বিভাগ থেকে নিবেদিতপ্রায় রবীন্দ্রবিভাগ পর্যন্ত, যেখানে কবির নানান অভিভাষণ, সম্মাননা, নিবন্ধপাঠ ইত্যাদি ছাপা হয়েছে।

    তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল তাঁর মোহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবলারদের ছবি ছাপা! ১৯৩৪-৪১ সাত বছর কলকাতা ফুটবল লীগ জিতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল এই ক্লাব, তার উপর শীল্ড-রোভার্স-ডুরান্ড তো আছেই। কিন্তু এই প্লেয়ারদের চিনত-ই না সাধারণ মানুষ। নাসির সাহেব তাই প্রতিদিন খেলার শেষে তিন-চারজন করে খেলোয়াড়দের এক স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে গিয়ে ফটো তোলালেন, এবং পরে ছেপে বেরোলে তুমুল বিক্রি হয়েছিল সংখ্যাটির!

    ***

    ১৯১৮এ কলকাতায় প্রথম প্রকাশ হয়ে থেকে মাঝে মাঝে বাধা পড়লেও দীর্ঘকাল ধরে প্রকাশিত হয়েছিল ‘সওগাত’; ১৯৫০এর পর ঢাকা থেকে। সম্পাদকের ১০৬ বৎসরব্যাপী জীবনও আরেকটা রেকর্ড, তাঁর ৯১ বছর বয়সে জাতীয় সম্বর্ধনা দেওয়া হয় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সাহেবকে।

    বঙ্গীয় মুসলমানের জাগরণের এক অগ্রপুরুষ ছিলেন তিনি, এবং তাঁর এই ‘সওগাত’ পত্রিকা।
    অচিরাৎ মাথা নত হয়ে আসে এই যুগপুরুষের উদ্যোগের সামনে।
    জয় ‘সওগাত’!

    || নির্জনে সজনে অন্তরে বাহিরে… নিত্যপ্রিয় ||


    ঠিকানাঃ খাট--নিত্যপ্রিয় ঘোষ; একুশ শতক, কলকাতা; প্রথম প্রকাশঃ এপ্রিল ২০২২; ISBN 978-93-91252-33-5



    রসসাহিত্য হলো যেকোন ভাষা ও সাহিত্যের একটা বিশেষ উল্লেখ্য শাখা; অর্থাৎ যে ভাষা যত পুষ্ট তার রসসাহিত্য তত উন্নত। নৈলে কৃষ্ণনগরের রাজসভায় ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাবগ্রন্থটি কি আর সাধে কাত না করে ধরতে বলেছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র—যাতে রস গড়িয়ে পড়ে না যায়! ওদিকে ইউরোপে লন্ডনে যুগে যুগে ইংরিজে শিল্পসাহিত্যের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে এসেছে মেহিউ সাহেবের ‘পাঞ্চ’ পত্রিকা—রসিক শিল্পসাহিত্যের শীর্ষ পরাকাষ্ঠা!

    না, আজ অবিশ্যি রসসাহিত্য নিয়ে লিখতে বসিনি, বসেছি এক জীবনীসাহিত্য নিয়ে, যার মধ্যে দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে যাওয়া অনাবিল এক রসবোধ ‘বিদ্যাসুন্দর’ বা ‘পাঞ্চ’ ম্যাগাজিনের কথা মনে পড়ালো। রঙ্গরসিকতা করা, বিশেষত নিজেকে নিয়ে, এক অত্যুচ্চ সূক্ষ্ম সাহিত্যরসের পরিচায়ক, যেখানে তাঁর গুরু সমর সেন মশায়ের ‘বাবুবৃত্তান্ত’ মনে পড়বেই (শুরু পৃষ্ঠাতেই সেই ‘পুরুষাঙ্গ বাঁধা দিয়ে বিলেত যাব না’ মনে নেই?)!

    কার গুরুর কথা হচ্ছে?

    ছেলেটি হিন্দু স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় সিক্সথ স্ট্যান্ড করে প্রেসিডেন্সিতে আই.এ. পড়তে ঢুকল, এবং তাতেও সিক্সথ স্ট্যান্ড করে। কিন্তু বি.এ. পরীক্ষার ফল মনমতো না হওয়ায় আর এম.এ.-তে অত মন না দিয়ে আই.এ.এস. পরীক্ষার মাধ্যমে এলায়েড ক্যাডারে ঢুকলেন; পোস্টিং দার্জিলিঙে। কিন্তু শীঘ্রই তাতে মোহভঙ্গ হয়ে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে নিত্যপ্রিয় শুরু করলেন সমর সেনের বামপন্থী ‘Now’ পত্রিকায় সাকরেদি! সেকালে কেউ ভাবতে পারত না যে ঐ উচ্চ রাজপদ ছেড়ে অনিশ্চয়তার সাংবাদিকগিরিতেও আসা যায়। কিন্তু নামটি তাঁহার যে নিত্যপ্রিয় ঘোষ, ১৯৬৯-এ প্রকাশিত তাঁর প্রথম বই ‘বিপ্লবের কথা’-র পুনর্মুদ্রণ হয়েছে এই বইমেলায় (২০২৩)!
    ব্যাঙ্কের পি.আর.ও.-র চাকরির পাশাপাশি স্টেটসম্যান পত্রিকায় দীর্ঘকাল পুস্তক ও শিল্পসমালোচনা করে গেছেন নিত্যপ্রিয় ঘোষ (১৯৩৪-২০২২)—যাঁর কলমকে সমঝে চলতেন মৃণাল সেন থেকে সুচিত্রা মিত্রের মতো ব্যক্তিত্ব। সত্যজিতের ‘জন অরণ্য’ বা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘নিয়মিত শংকর-সুনীল গাঙ্গুলী পড়লে বুদ্ধি্র ধার ভোঁতা হয়ে যেতে বাধ্য’! আবার রবীন্দ্র-রসাস্বাদনে (appreciation) ওঁর ভুরি ভুরি লেখা পড়লে মনে হয় কেবল এ’বিষয়ে লিখলেই নিত্যপ্রিয় অমর হয়ে থাকতেন বাংলাসাহিত্যে। কলকাতার ‘গাংচিল’ প্রকাশনা সম্প্রতি ওঁর এই রচনাগুলি তিন খণ্ডে প্রকাশ করেছে।

    ***

    গোড়াতেই ব্যক্তি নিত্যপ্রিয়ের শিল্পসৃষ্টিতে এতটা নালেঝোলে হয়ে পড়লে আর ওঁর এই আত্মজীবনীগ্রন্থটি নিয়ে লিখব কখন?
    প্রথম হোঁচট যদিও, ঐ দেখুন না, শিরোনামে।

    ‘ঠিকানাঃ খাট’ আবার কারোর আত্মজীবনীর নাম হয় নাকি? খাটে চড়া বলতেই তো গঙ্গাযাত্রার কথা মনে আসে। যদিও লেখক যেন প্রকারান্তরে ও সরল বিনয়ে সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন, যদিও উল্লেখ করেছেন ধনকুবের মার্কিন নট ক্যারি গ্রান্ট সাহেবের কথা—সেই যে তিনি লিখেছিলেন না যে বুড়ো বয়সে এমন একটা খাট বানিয়ে অবসর নেবেন যার থেকে সারাদিনে আর নামবারই প্রেয়জন হবে না কো! নিত্যপ্রিয়ও লিখেছেন, তাঁর চুরাশি বছর বয়সে খাট-ই হয়ে দাঁড়িয়েছে শেষ আশ্রয়স্থল যেখানে উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়েই এই চারশ’ পৃষ্ঠার মহাগ্রন্থখানি নামিয়ে দিয়েছেন তিনি--বেশিটাই স্মৃতি থেকে! ভাবা যায়? সাধে কি তাঁর ছোড়দা ভাইয়ের এই বই প্রকাশকালে তূরীয় তারিফ করেছিলেন? ছোড়দা-বৌদি শঙ্খ-ও-প্রতিমাকেই উৎসর্গ করা হয়েছে এ’ বই।

    ***

    কী বিরাট প্রেক্ষাপট জুড়ে লেখা এ’গ্রন্থ—১৯৪০এর দশক থেকে ২০২০!
    বরিশাল বি.এম. কলেজে কবি জীবনানন্দের সহপাঠী ছিলেন নিত্যপ্রিয়ের পিতৃদেব মণীন্দ্রকুমার—সর্বজনশ্রদ্ধেয় হেডমাস্টারমশাই—-১৯৩০এর দশকে অবজেক্টিভ টাইপ প্রশ্নপত্র নিয়ে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের সঙ্গে পত্রাচার হয়েছিল তাঁর! আর স্কুল-কলেজে কী বিশাল বন্ধুদল ছিল নিত্যপ্রিয়ের—যাঁদের নিয়ে কত না এনিকডোট, কত না কথকতা! স্যার বীরেন ও লেডি রাণুর কন্যা নীতা মুখার্জী প্রেসিডেন্সি কলেজের ‘ইংলিশে’ ছিলেন নিত্যপ্রিয়ের ক্লাসমেট। বন্ধুরা বাজি ধরল, ‘নীতার কাছ থেকে চার আনা পয়সা চেয়ে আনতে পারবি?’ [সেকালে ক্লাসমেটিনীদের সাথে বাক্যালাপের চল বড় একটা ছিল না যে!]
    ‘কিন্তু আমার কাছে তো চার আনা পয়সা নেই!’—নীতার সমর্পণ (নিত্যপ্রিয়ের সাহস দেখানোটাই সার হলো)। ভাবা যায়, স্যার বীরেনের মেয়ের কাছে চার আনা পয়সা নেই!
    পরের দিন অবিশ্যি নীতা বাড়ি থেকে ঐ চার আনা পয়সা চেয়ে এনে বন্ধুদের দিলে তা দিয়ে ভোজ হয়েছিল।
    ১৯৫৩-র কথা এ’।
    কী কী সব ব্যাচমেট ছিল নিত্যপ্রিয়ের! কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বাংলা অনার্সে; ‘ফিরে এসো চাকা’-র কবি বিনয় মজুমদার আই.এস.সি. ক্লাসে। ১৯৫১-র ‘লাস্ট ম্যাট্রিকুলেট ব্যাচ’ বলে এক চাপা গর্ববোধ ছিল ওঁদের!
    মজার গপ্পো আছেঃ
    রবিবার সকালে একতাড়া প্রুফ নিয়ে কফি হাউজের নির্দিষ্ট জানলাটির ধারে ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য এসে বসেছেন দেখে আধা-চেনা কেউ যদি খেজুরে করতে এগিয়ে আসত তো উনি শুধাতেন, ‘আপনি ভাই কোন্‌ ব্যাচের ম্যাট্রিক?’ সে ম্যাট্রিক নয়, স্কুল ফাইনাল বা হায়ার সেকেন্ডারি জানলে বলতেন, ‘তাহলে আপনি ভাই একটু ঐ টেবিলটায় গিয়ে বসুন। এটা অনলি ম্যাট্রিকুলেটদের টেবিল।’ পাশে বসে মুচকি হাসতো ‘অপু’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও তার কেশনগরী বন্ধু সুধীর চক্রবর্তী [‘গভীর নির্জন পথে’]—আর দুই নামী ‘লাস্ট ম্যাট্রিক’!

    ***

    না, ‘খাটের গল্প’ বলতে শুরু করলে সহজে শেষ হবার নয়। তার চেয়ে, বাপু, পড়ে নিলেই তো পারেন।
    বাংলা জীবনীসাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন নিত্যপ্রিয় ঘোষের এই গ্রন্থ—তিলমাত্র সন্দেহ নেই তাতে।
    দশে সাড়ে দশ পায় এ’ বই!

    || ‘সক্রেটিসে’র লেখা একমাত্র বই! ||



    Political Parties in India--Gyantapas Abdur Razzaq (Edited by: Ahrar Ahmad, Foreword: Rounaq Jahan); University Press Ltd, Dhaka 1215; ISBN 978 984 506 381 4



    কিংবা ডায়োজেনিসের!

    কারণ, কাঁথায় মোড়া সহজসরল জীবনযাপন ও অমলিন হাসি দেখে তাঁর শিষ্যগণ সেই গ্রীকপণ্ডিতকেই খুঁজে পেতেন ‘স্যর’-এর মধ্যে।

    সক্রেটিসের মতোই এই জ্ঞানতাপসও আজীবন একটিও গ্রন্থ রচনা করে যাননি, তাঁর শিক্ষাপ্রদানের পদ্ধতিটিই ছিল সাধারণ (informal) কথোপকথন ও আলাপচারিতার মাধ্যমে, যদিও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ঢা.বি.-র এই লেকচারারকে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ পদে বৃত করে ধন্য হয়েছিল (১৯৭৫), তার আগে হয়েছিল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ওঁকে ডি.লিট. দিয়ে (১৯৭৩)। এবং এই ‘জাতীয় অধ্যাপক’ তৈরি করে গেছেন আরও আরও জাতীয় অধ্যাপকগণকে, অধ্যা. আনিসুজ্জমান সাহেব যাঁর মধ্যে প্রধান; আরও আছেন আহমদ শরাফী, সাহিত্যিক আহমদ ছফা, বদরুদ্দীন উমর প্রমুখের মতো জাতীয়জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মনুষ্যজন।
    এই উপমহাদেশের পরিসরে ‘জ্ঞানতাপস’ আবদুর রজ্জাক (১৯১৪-১৯৯৯) সাহেবকে তাই তুলনা করা চলে এম. এন. শ্রীনিবাস (১৯১৬-৯৯) বা রজনী কোঠারী (১৯২৮-২০১৫ ) বা আয়েষা জলালের (জ. ১৯৫৬) সঙ্গে, অর্থনীতি- ইতিহাস- সমাজতত্ত্ব-রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যাঁদের অবদান ভগীরথসম!
    আমি তো বলব, উনি ছিলেন বাংলাদেশের ‘ধূর্জটিপ্রসাদ’, কারণ রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজবিজ্ঞান-ইতিহাস-শিল্পসাহিত্যসংস্কৃতি ইত্যাদি ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্যরের যে ‘বিশ্বকোষী’ জ্ঞান তার তুলনা ঐ লক্ষ্মৌভী বঙ্গালী অধ্যাপক, যাঁর সাঙ্গিতীক প্রতিভাকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সমঝে চলতেন [দ্র. পরবাস ৪৬তম সংখ্যা. https://www.parabaas.com/article.php?id=4936]

    উনি কোনো বই লেখেননি তো এই বইটা এল কোথা থেকে?

    অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকে সন ১৯৪৫-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊনত্রিশ বছর বয়সি এক মুসলিম লেকচারার ‘লন্ডন স্কুল অব্‌ ইকনোমিক্সে’ ডক্টরেট করতে গেল কিংবদন্তী অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কির অধীনে। ১৯৫০-এ ল্যাস্কির অকস্মাৎ প্রয়াণের পরে কোন্‌-সে-অজ্ঞাত কারণে ও নানাবিধ ঘটনাপ্রবাহে থিসিসটি শেষাবধি সাবমিট না করেই ঢাকা ফিরে এসে সেই লেকচারার পদেই যোগ দিলেন রাজ্জাক, আজীবন আর পদোন্নতির প্রয়াস করেননি। সন ২০২২-এ ওঁর প্রিয় ছাত্রী রৌনক জাহানের আগ্রহাতিশয্যে সেই থিসিসটিই বই হয়ে বেরোল যেটা আজকের আলোচ্য; আবদুর রজ্জাকের যে থিসিস সম্বন্ধে প্রবাদ আছে ল্যাস্কি নাকি বলেছিলেন ‘তোমার ইন্ট্রোডাকশনই ডক্টরেট পাবার যোগ্য; বাকি ডিসার্টেশন আর লিখতে হবে না তোমাকে।’ [ল্যাস্কি তাঁকে নেহরুর সঙ্গে তুলনা করায় মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন রাজ্জাক]। ল্যাস্কি-পরবর্তী গাইড মরিস-জোন্স নাকি নিজেকে রাজ্জাকের এই গবেষণা পরীক্ষার যোগ্য বলেই মনে করেননি ইত্যাদি ইত্যাদি।

    এই এই সকল প্রবাদপ্রতিম কাহিনীর সন্দেহ অপনোদনেই বহু কষ্টে এই কেতাব জোগাড় করে পড়া এবং… এর সামনে নতজানু! [স্মর্তব্য, অধম সমালোচকটি কিন্তু ‘হিন্দু কালেজে’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইয়ের পাতাই উল্টে এসেছে।]

    ***

    Political Party কাকে বলে?
    ৪৭-এর দেশবিভাগের সমসাময়িক এক পাকিস্তানী নওজওয়ান স্কলার কেন লন্ডনে গিয়ে Indian Political Parties এর উপরে গবেষণায় আদৌ আগ্রহী হলো? এই গ্রন্থে তো কৈ তিনি ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ ও ‘মুসলিম লীগ’-এর মতো সে সময়ের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের উপরে কোনো আলোচনাই করেননি? তিনি আলোচনা করেছেন ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা’ (power) ও ‘রাজনৈতিক শ্রেণী’ নিয়ে, ‘শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের’ নিয়ে এবং মুদ্রাযন্ত্রের ভূমিকা ও রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে।

    তাহলে কি বইটির শীর্ষনাম যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর নয়?

    হেঁ হেঁ হেঁ এই এনিগ্‌মাটুকু না থাকলে আর আবদুর রজ্জাক পড়ছি কেন? দুই আর দুইয়ে যোগ করে চার করলে তো আর ‘ভিন্নভাবনা’ হয় না, যার জন্যে বিখ্যাত ছিলেন ‘স্যর’ [সারা দেশ তাঁকে শুধু এই নামেই ডাকত]। তাঁর মতে, অবিভক্ত ভারতবর্ষের ‘পলিটিক্যাল পার্টি’গুলি আদতে কাজ করেছে ‘রাজনৈতিক আন্দোলন’ [‘political movement’] হিসেবেই কারণ যে দেশের তখনো সার্বভৌমত্বই আসেনি সেখানে রাজনৈতিকদল তো অনর্থক। রাজনৈতিক দলের ইতিহাস (বা, political analysis) তাই মাটির কাছাকাছি খেটেখাওয়া মানুষজনের সমাজ-অর্থনীতির ইতিহাস (বা, সমাজ-বিশ্লেষণ)!

    না, এই দু’-কথায় ‘স্যর’ আবদুর রাজ্জাকের অনুধ্যান বুঝিয়ে দিতে পারি এমন বিদ্যে তো পেটে নাই এই সমালোচকের তাই অনুরোধ, এই মহাগ্রন্থ কিনে ঘরে রেখে দিন না; বারংবার পঠনে ক্রমে ক্রমে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে এর সুবাস, যা থেকে অনুধাবন, কেন সত্তর বছর পরেও এ’ মহাগ্রন্থের পুনঃমুদ্রণ ও পুনঃপাঠ জরুরি।

    ***

    GARF (Gyantapas Abur Razzak Foundation)-এর তত্ত্বাবধানে ও কপিরাইটে সুমুদ্রিত এই গ্রন্থের তাজ হলো স্যরের এক ছাত্র আহরার আহমদ সাহেবের অসাধারণ Editor’s Prefaceখানি, যেটি স্বনামধন্যা মার্কিনী অধ্যাপিকা (ও স্যারের ছাত্রী ) রৌনক জাহানের Forewordটিকেও ছাপিয়ে গেছে, কারণ আহরার আহমদ এখানে কেবল গুরুবন্দনা না করে এই প্রশ্নও তুলেছেন যে একই মানুষ কী করে দুই বিপরীতধর্মী ‘পাকিস্তান আন্দোলন’ [১৯৪৭] ও ‘বাংলাদেশ আন্দোলন’ [১৯৭১] কে কায়মনোবাক্যে সমর্থন করতে পারেন? প্রশ্ন তুলেছেন, ক্লিমেন্ট এটলি এসে ব্রিটিশ লেবার পার্টিতে যে ল্যাস্কি-কে নস্যাৎ করে দিলেন, তার অপ্রত্যক্ষ প্রভাব কি আর আবদুর রাজ্জাকের থিসিসে পড়েনি?
    কঠিন প্রশ্ন।
    আমাদের ভাবতে শেখায়।
    ‘ভাবো। ভাবো। ভাবা প্রাকটিস করো!’
    এই অধম সমালোচক অনেক বলে ফেলল।

    ***

    আপনারা এই বই পড়বার আগে আহমদ ছফা সাহেবের ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটি পড়ে নিন না!
    কী ভালো একটা লেখা!!
    বুড়া হৈছি ত, মহৎ শিল্পকর্মের সামনে নতজানু হই এখন তাই।
    অশ্রুপ্লাবিত হই।
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments