• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | প্রবন্ধ
    Share
  • নন্দলাল বসুর চিত্র ও ভাবনায় পটচিত্র : তানিয়া মণ্ডল



    প্রবন্ধটিতে ‘পট’শৈলী এবং এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে নন্দলাল বসুর (১৮৮২-১৯৬৬) অবদান কী সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। নন্দলাল বসুর পটচিত্র বিষয়ে পূর্বে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে পর্যায়ক্রমিক আলোচনার প্রয়োজনীয়তা থেকে এই প্রবন্ধটি লেখা। নন্দলাল বসুর কালীঘাট পটশৈলীর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পিছনে প্রাথমিক অনুপ্রেরণা কী ছিল, কালীঘাট পট তাঁর চিত্রচর্চায় কতটা প্রভাব ফেলেছিল, তাঁর আঁকা পটধর্মী চিত্রগুলি কোথায় স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।


    ভূমিকা

    বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ই. বি. হ্যাভেল (১৮৬১-১৯৩৪) ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৭১-১৯৫১) হাতে চিরায়ত ভারতীয় চিত্রকলাচর্চার পুনরুজ্জীবন ঘটে। এর আগে, বিশেষ করে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুল-এর শিক্ষার্থীদের মধ্যে, ঝোঁক ছিল পাশ্চাত্য শিল্পরীতির অনুকরণের দিকে। অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যদের মাধ্যমে প্রথমে বাংলা ও পরে সমগ্র ভারতে একটি নবচিত্র আন্দোলনের পরিমণ্ডল রচিত হয়। এই নবজাগৃতির অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন নন্দলাল বসু (১৮৮২-১৯৬৬)। শান্তিনিকেতনে আসার আগে পর্যন্ত তাঁর ছবিগুলিতে পরম্পরাগত শিল্পাদর্শ সঞ্জাত অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর সমগ্র শিল্পকর্মের দিকে তাকালে বোঝা যায় সমস্ত রকম আর্টেরই তত্ত্বসন্ধান, প্রয়োজনমত অনুশীলন, সম্ভবমত আত্মীকরণ চলেছে আশ্চর্য দ্রুত গতিতে। ভারতবর্ষের লোকশিল্পের প্রতিও ছিল তাঁর শ্রদ্ধাশীল মনোভাব। তাই যখনই সুযোগ পেয়েছেন পট নামক ঐতিহ্যবিরোধী অনভিজাত, লৌকিক শিল্প আঙ্গিকটিকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ ভাবে পটের প্রভাব তাঁর ছবিতে বার বার ফিরে এসেছে।



    একসময় ভদ্র কুলীন সমাজের শিল্পচর্চায় অনাদৃত ‘পট’ উনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি শিক্ষিত সমাজে অন্দরমহলের বস্তু হয়ে এসেছিল। তবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে লোকসাহিত্য নিয়ে গবেষণা শুরু হওয়ার এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। অবনীন্দ্র গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে নন্দলাল বসু লোকশিল্প ও পটচিত্র নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে শুরু করেন। প্রথমদিকে তিনি ও তাঁর সতীর্থরা বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে পট ও পাটা সংগ্রহ করা শুরু করেন। এই সময় কালীঘাটের বেশ কিছু পট, মেদিনীপুরে কিছু পট-পাটা আর দক্ষিণী কিছু কাটিং সংগ্রহ করেন। ভবিষ্যতেও পট-পাটা সংগ্রহের নেশা তিনি একেবারে কাটিয়ে উঠতে পারেননি। যখনই তাঁর নজরে ভালো কোন পট বা পাটা এসেছে তিনি তা নিজের ও কলাভবনের জন্য সংগ্রহ করে এনেছেন।

    বাণীপুরে কালীঘাট পট-এর পুনরুজ্জীবন

    আর্ট স্কুলের শিক্ষা শেষ করার পর ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘বিচিত্রা সভা’ প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নন্দলাল বসু কালীঘাটের পটের কথা মাথায় রেখে পুরোনো রীতিতে নতুন ধারা প্রবর্তন করার প্রচেষ্টা করেন। এর টেকনিক হবে পুরোনো বা ঐতিহ্য অনুসারী, কিন্তু আঁকার বিষয় হবে নতুন। অবনীন্দ্রনাথ একবার নন্দলালকে বলেন- “আমাদের আর্ট বিশেষ গোষ্ঠীর জিনিষ, গণ্ডীর জিনিস – পট আঁকো যাতে শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেরই হবে আনন্দ।” গুরুর নির্দেশমতো নন্দলাল নীতিকথা, বিভিন্ন প্রবাদ-প্রবচন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পটুয়া রীতিতে ছবি আঁকেন। এ ছাড়াও পুরোনো বই থেকে তিনি নানা জন্তুজানোয়ারের ছবির স্কেচ করেন পট-এর ফর্মটিকে মাথায় রেখে। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তাঁর বাণীপুরের বাড়িতে এই ধরনের ছবি আঁকতে শুরু করেন। ৩০-৬-১৯৪৪ তারিখে কানাই সামন্তকে (১৯০৪-১৯৯৫) লেখা একটি চিঠিতে নন্দলাল বসু বলেন – “একটা মুদির দোকানে রাস্তার ধারে প্রত্যহ একটা দড়ির পাকে ১০/১২ খানি ছবি ঝুলাইয়া দিতাম, উহা হাওয়ায় উড়তে থাকত, এবং jute mill এর ফিরতা কুলিরা দাঁড়িয়ে দেখত এবং রোজ প্রায় ৬/৭ খানা বিক্রয় হত গড়ে ৷৷৹ ৷৷৵৹ (আট আনা – দশ আনা) রোজগার হত। (ইহাতে বড় গৌরব বোধ করতাম এবং বড় সান্ত্বনা পেতাম -)।” দেশে বসে আঁকবার ও দেশেই বিক্রি করবার বাসনায় লোকচিত্র নিয়ে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তিনি মেতে ওঠেন। এসময় একটি ঘটনা থেকে শিক্ষা পেয়ে তিনি পট আঁকা থেকে নিবৃত্ত হন।

     
    সামাজিক পট: কালীঘাট
     
    পৌরাণিক পট: কালীঘাট


    নতুন কোন চিন্তাভাবনা বা নতুন কোন কাজ নন্দলাল তাঁর গুরু অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা করে করতেন। পট নিয়ে তাঁর এই নতুন ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষার খবর অবনীন্দ্রনাথকে জানাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। গরমের ছুটি কাটিয়ে অনেকদিন পর বাণীপুর থেকে জোড়াসাঁকোয় তাঁর শিক্ষাগুরুর সঙ্গে দেখা করতে যান। সঙ্গে নিয়ে যান তাঁর নিজের আঁকা কুড়ি–তিরিশটি কালীঘাটের পট। সেখানে কালীঘাটের পট সম্পর্কে কথা উঠতেই দুরুদুরু বুকে নিজের আঁকা ছবি তাঁর সামনে মেলে ধরেন। খানিকটা থমকে যান অবনীন্দ্রনাথ। তিনি ছবিগুলির দাম জানতে চান। নন্দলাল জানান তাঁর ছবিগুলি চার পয়সা করে বিক্রি করছেন। একথা শুনে অবনীন্দ্রনাথ এক টাকা করে সমস্ত ছবি কিনে নেন। এই ঘটনায় – “ব্যস, নন্দলালের মন কুঁচকে গেল- লজ্জাবতী লতার মতন। আর্টে ঘা পড়ল। অ্যাটিটুড বদলালো। সেই ধারা সেই থেকে বন্ধ হয়ে গেল। ও-খেলা ছেড়ে দিলেন। কেন যে অ্যাটিটুড বদলালো, সে রহস্য বরাবর নন্দলালের অজানা।” পঞ্চানন মণ্ডলের (১৯১৬-১৯৯৮) এই মন্তব্যের সমর্থন পেতে পারি ৩০-৬-১৯৪৪ তারিখে কানাই সামন্তকে লেখা নন্দলাল বসুর চিঠিটির উপর ভিত্তি করে। চিঠিটিতে এই ঘটনা সম্পর্কে নন্দলাল বসু লিখেছেন – “জানিনা কেন পট-ছবি আঁকার ইচ্ছা চলে গেল। (হয়ত গ্রীষ্মের পর [ছুটি] ফুরিয়েছিল – কলকাতায় এসেছিলাম বা ওঁর কাছে এসে দেখলাম, যে পথে চলেছি উহা গ্রাম্য এবং সাময়িক ইচ্ছামাত্র, কেবল একটু recreation মাত্র – তাই আবার উঁচু দরের শিল্পসাধনার কথা মনে জেগে উঠল। অবশ্য উনি ঐরূপ [গ্রাম্য] হয়ত ভাবেন নাই। আমার অর্বাচীন মন ঐ ধারণা করেছিল।”

    ছাত্রাবস্থায় গ্রীষ্মের ছুটিতে পট আঁকা ছিল নন্দলালের একটি খেয়াল। তার মধ্যে ছিল কম সময়ে পটের মতো ছবি এঁকে কম দামে বিক্রি করে জনসাধারণকে আনন্দদানের তৃপ্তি। শুধু দেব-দেবতার ছবি না এঁকে চারপাশের দৃশ্যমান জগতের বিষয় নিয়ে পট আঁকবার হালকা চালের খেলা। নন্দলাল বসুর চিঠি এবং পঞ্চানন মণ্ডলের মন্তব্যের উপর ভিত্তি করে বলা যেতেই পারে অবনীন্দ্রনাথের আচরণে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন লোকচিত্রের যে পথে চলেছেন তা গ্রামীণ সংস্কৃতির অঙ্গ। শিল্পশিক্ষায় শিক্ষিত মার্জিত রুচির ব্যক্তির পক্ষে এ পথ অবলম্বন করা সঠিক নয়। তাঁর গন্তব্য ভিন্ন। পটশিল্পচর্চাকে সাময়িক বিনোদনের পর্যায়ে রাখা উচিত। তাই দেখা যায় সেবারের মতো রণে ভঙ্গ দিয়ে আবার ধ্রুপদীশিল্প সাধনার দিকে মনোনিবেশ করতে।

    আমরা জানি নন্দলাল বাণীপুরে পট আঁকা শুরু করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথের নির্দেশ মাফিক। তাহলে সেই অবনীন্দ্রনাথ কেন তাঁর আচরণের মাধ্যমে শিষ্যকে এ পথ পরিত্যাগের ইঙ্গিত দিলেন সে প্রশ্ন মাথায় আসে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশটি ভালোভাবে বিচার করলেই হয়তো বিষয়টি খানিকটা স্পষ্ট হয়। বোঝা যায় অবনীন্দ্রনাথের এরূপ আচরণের অন্তরালে লুকিয়ে আছে অন্য বক্তব্য। পট অঙ্কনের নির্দেশ দেওয়ার আগে অবনীন্দ্রনাথ নন্দলালকে বলেছিলেন এমনভাবে ছবি আঁকবে যাতে লোকে ছবি নেয়। এই লোক বলতে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত দুই শ্রেণির লোককেই তিনি নির্দেশ করেছিলেন। কিন্তু নন্দলাল ঐ সময় পট বিক্রির নেশায় অতিদ্রুত হাতে ছবি আঁকা শুরু করেন। একটি ছবি শিল্প হয়ে উঠতে যে শ্রম, যে সাধনা, যে মননের দাবি করে নন্দলালের এই ছবিগুলি স্বাভাবিকভাবে সেই দাবি পূরণ করতে পারছিল না। স্বল্প মূল্যের হওয়া সত্ত্বেও jute mill-এর শ্রমিক বা ঐ শ্রেণির মানুষদেরকে তাই দরদাম করে বা প্রায় বিনামূল্যে সে সব ছবি নিতে দেখা যায়। দেখা যায় সস্তা দামে ছবি বিক্রি করতে গিয়ে নন্দলাল নিজের মূল্য দিতে ভুলে গেছেন। দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের গোচরে নন্দলালের আঁকা সে সময়ের পটগুলি আসার মুহূর্তেই তিনি উপলব্ধি করেন, এ ধরনের ছবি শিক্ষিত মানুষের রুচিগ্রাহ্য হতে পারে না। নন্দলালের মধ্যে তিনি যে প্রতিভা দেখেছিলেন ছবিগুলি সেইরূপ ছিল না। তাই তিনি বেশি দামে সমস্ত ছবি কিনে নেন। এমন আচরণের পিছনে অবনীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য ছিল নন্দলালকে মেধাহীন পট আঁকার খেলা থেকে বিরত করা। সস্তায় ছবি বিক্রির নেশা থেকে দূরে রাখা। তিনি চেয়েছিলেন জনসাধারণকে সস্তার বিনোদন দিতে গিয়ে সম্ভাবনাময় তরুণ শিল্পীটি যেন হারিয়ে না যায়।

    অবনীন্দ্রনাথ যে সময় বাংলার প্রবাদ প্রবচন অনুযায়ী কালীঘাটের পটশৈলীতে নন্দলালকে ছবি আঁকতে বলেছিলেন সে সময় তিনি নিজে ঐ ধরনের কোন ছবি এঁকেছেন বলে জানা যায় না। নতুন বিষয় নিয়ে পটশৈলীতে ছবি আঁকার যে রূপকল্পনা তিনি করেছিলেন তা তাঁর মনের মধ্যেই থেকে গিয়েছিল। পটধর্মী এক সিরিজ ছবি তিনি এর অনেক পরে আঁকেন, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। এসময় তিনি চণ্ডীমঙ্গলের নানা আখ্যান এবং শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা নিয়ে এক গুচ্ছ ছবি আঁকেন। অভিনব আঙ্গিকের এই ছবিগুলিকে সমালোচকরা পটধর্মী ছবি বলে উল্লেখ করেছেন। রাজপুত, মুঘল শৈলীতে বা ওয়াশ পদ্ধতিতে অবনীন্দ্রনাথের যে ছবি দেখে দর্শক অভ্যস্ত এই ছবিগুলি ছিল তার থেকে ভিন্ন; স্পষ্ট, বলিষ্ট ও সহজবোধ্য। কোন পূর্বসূরীর অনুকৃতি তাতে ছিল না। ফর্মের সারল্য, মোটা তুলির বলিষ্ঠ রঙের পোঁচ, গোলাকার রেখা দেখে এগুলিকে পট বলা হলেও এগুলি ছিল গ্রামাঞ্চলের পট বা কালীঘাটের পটের থেকে অন্য গোত্রের। ভাবলেশহীন পটের থেকে আলাদা। চরিত্র রূপায়ণ, রেখাঙ্কন, বর্ণনির্বাচন, বর্ণলেপন সবেতেই ছবিগুলি ছিল অভিনব। আরব্যরজনীর সিরিজের ছবিগুলিও আঁকার পর বহুকাল তিনি ছবি আঁকা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। সে সময় স্বাদের লেখনরীতি অবলম্বন করে সাহিত্যিক কৌলিন্য আর পরিশীলিত সংস্কৃতির জগৎ ছেড়ে গ্রামীণ যাত্রাপালার ঢঙে বাকবিস্তার করেন। দীর্ঘ বিরতির পর তিনি যখন আবার ছবি আঁকার দিকে আত্মনিয়োগ করলেন তখন তার মধ্যেও ছক ভাঙ্গার খেলা দেখা গেল। পরিশীলিত জগতের বিপরীতে চলাই তাঁর লক্ষ্য হয়ে দঁড়াল। অবনীন্দ্রনাথের নতুন মনের অভিব্যক্তিতে ছবির ভুবন ও সাহিত্যের ভুবন একাকার হয়ে গেল।

    হরিপুরা কংগ্রেসের সূত্রে পট-চর্চা

    সাময়িকভাবে নন্দলাল পট আঁকা থেকে বিরত হলেও পটের প্রতি ছিল তাঁর অন্তরের টান। বিশেষত কালীঘাটের পটের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ আকর্ষণ। তিনি বলেন – “কালীঘাটের পটের প্রতি আমার যে প্রীতি ছিল, সেটা রূপ নিলে হরিপুরায় যাবার পর।” ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনের মণ্ডপ-সজ্জা, শিল্প-প্রদর্শনী এবং ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ফৈজপুরের কংগ্রেস অধিবেশনে ‘তিলক নগর’ পরিকল্পনার ভার পান নন্দলাল বসু। দুটি ক্ষেত্রেই তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য অনুসরণ ও স্থানীয় খাঁটি ভারতীয় উপকরণ ব্যবহার করেন। নন্দলালের এই ভাবনায় গান্ধীজি (১৮৬৯-১৯৪৮) মুগ্ধ হন। স্থানীয় শিল্পীদের আপত্তি সত্ত্বেও তাই গান্ধীজি ১৯৩৮ সালে গুজরাটের বারদৌলির কাছে হরিপুরা গ্রামের কংগ্রেস অধিবেশনে মণ্ডপ সাজানোর দায়িত্ব দেন তাঁকে। গান্ধীজি নন্দলালকে বলেন – “…এমন Exhibition করো যাতে গ্রামের লোক রাস্তা চলতে চলতে কলাশিল্প দেখতে পায়। সমস্ত নগরটা শিল্প দিয়ে মুড়ে দাও।” গান্ধীজির নির্দেশমতো খুব অল্প সময়ে পুরো কংগ্রেস নগরটাকেই শিল্প-প্রদর্শনীতে পরিণত করার মূল দায়িত্ব তিনি পালন করেন। এসময় তিনি বহু পটজাতীয় ছবি এঁকে চতুর্দিকে, তোরণের দ্বারে, সেবকদের থাকবার ঘরে, গান্ধীজি ও সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুর (১৮৯৭-?) ঘরে লাগিয়ে দেন। হরিপুরায় পটের ধরনে আঁকা যে রঙিন ছবিগুলি দিয়ে তোরণ সাজানো হয় সেগুলির আবেদন পণ্ডিত-অপণ্ডিত নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ দর্শকের মর্মে গিয়ে পৌঁছায়। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে সংযোগ রেখে স্বদেশী চিন্তাচেতনা ও স্বদেশী উপকরণ দিয়ে ছবিগুলি আঁকেন তিনি। লোকশিল্পের সাবলীল স্ফূর্তিতে এই ছবিগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু এগুলিকে ঠিক লোকশিল্প বলা যায় না। মেজাজের দিক থেকে লোকশিল্প হলেও এতে ধ্রুপদীশিল্পসুলভ কারিগরি কুশলতা দেখা যায়। শিল্পীর মার্জিত রুচি ও সৌন্দর্য তার পরতে পরতে ফুটে ওঠে।

    এই সময়ে নন্দলাল বসুর আঁকা সঙ্গীত পর্যায়ের ষোলটি, খেলাধুলা পর্যায়ের আটটি, গৃহস্থ জীবনের ষোলটি, গ্রামীণ কারিগরি বা কুটিরশিল্প পর্যায়ের বাইশটি, চিরাচরিত কাল্পনিক বিষয় যেমন পরী, উড়ন্ত মানুষ ইত্যাদি বিষয়ের ছয়টি এবং জীবজন্তু ও অলংকরণ মিলিয়ে পনেরোটি। সব মিলিয়ে মোট তিরাশিটি ছবির হিসাব পাওয়া যায়। যদিও নন্দলাল বসু নিজে প্রায় চারশোটি পটের কথা বলেন। অনুমান করা হয় তিনি হয়তো মূল ছবি ও তার একাধিক কপি মিলিয়ে এই সংখ্যাটির কথা বলেন। এই বিপুল সংখ্যক ছবি তিনি তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্য নিয়ে মাত্র উনিশ দিনে সম্পন্ন করেন। কাগজ মাউন্ট করা, পটভূমিতে রং করার কাজগুলি ছাত্র-ছাত্রীরা করলেও মূলড্রয়িং-এর বনেদ তৈরি ও শেষ রেখা টেনে ছবি সমাপ্তির কাজ তিনিই করেন। হরিপুরা কংগ্রেসের ছবি আঁকা সম্বন্ধে নন্দলাল বলেন – “হরিপুরা কংগ্রেসের জন্য প্রায় দেড়শত ছবি কলাভবনে বসেই প্রধানত আঁকি। গোড়ায় ছোট ছোট স্কেচ্‌ করে নিয়েছিলাম – কীভাবে এগোব তার এ খসড়া। দিনে প্রায় কুড়িটি করে ছবি এঁকেছি। সে অপারেশন থিয়েটারের মতো ব্যাপার। ছাত্ররা কাগজ মাউন্ট্‌ করে দিত পরপর মাটিতে, আমি ড্রইং করে যেতাম আর সঙ্গে সঙ্গে ‘নোট’ করে দিতাম কোথায় কোন রঙ বসাতে হবে। ওরা রঙ দিয়ে দেবার পর কালো সাদায় আমি লাইন টেনে ফিনিশ্‌ করে দিতাম। ছবিগুলো এঁকে আমি হরিপুরায় চলে গেলাম। এখানে ছাত্ররা তিন দফায় সেইগুলোর কপি করে গেল সেখানে। গান্ধীজি ছবি প্রদর্শনী করতে চাইলেন না। বললেন রাস্তায়, দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে দিতে হবে। তাই করলাম।” গ্রামবাসীদের জন্য আকর্ষণীয়ভাবে গ্রাম্য জীবন চিত্রিত করতে তিনি গ্রাম জীবনের নিজস্ব সম্পদ পটচিত্রকে বেছে নিয়েছিলেন। যদিও সেগুলি গ্রামবাংলার লৌকিক পট বা শহুরে কালীঘাটের পটের থেকে ভিন্ন।

    নন্দলাল হরিপুরার ছবিগুলি খুব সহজ-সরলভাবে আঁকেন। আর এই সরলতা লোকচিত্র তথা পটচিত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পটশিল্পীদের আঁকা পটে ঘোরপ্যাঁচ থাকে না, সূক্ষ্ম কারিগরি থাকে না। যদিও পটচিত্রের এই সারল্য আর হরিপুরা পটের সারল্যের প্রেক্ষিত ভিন্ন। নন্দলাল বসুর আঁকা হরিপুরার চিত্রগুলির আঙ্গিকগত সারল্য এবং নৈপুণ্য তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার ফসল।

     
    উট: হরিপুরা পট
     
    ছাগল: হরিপুরা পট


    কালীঘাট পট মন্দির সংলগ্ন বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। শোনা যায় তৎকালীন সময়ে কালীঘাট মন্দিরের মাইল খানেক এলাকায় কেউ মূর্তি গড়িয়ে বা মূর্তি গড়ে পূজা করতেন না, পূজা হতো পটচিত্র দিয়ে। এইভাবেই একটা আঞ্চলিক চাহিদা মেটাতে ও মন্দির চত্তরে ভক্তসমাগম বাড়তে থাকায় তাদের চাহিদা মেটাতে শিল্পীরা কাগজে দ্রুত গতিতে চৌকো পট আঁকতে শুরু করেন। দ্রুততার কারণে রেখাঙ্কন, বর্ণলেপনের বিশেষ রীতি ও সরলীকরণ কালীঘাটের পটকে বিশিষ্ট করে তোলে। কালীঘাটের পটুয়াদের মতো তড়িৎ গতিতে অতি দ্রুততার সঙ্গে হরিপুরার পটগুলিও আঁকা। দ্রুততার সঙ্গে আঁকার জন্য হরিপুরা পটগুলিতে একটা স্বচ্ছন্দ সাবলীল ভাব দেখতে পাওয়া যায় ।

     
    বীণাবাদিনী: কালীঘাট পট
     
    বীণাবাদিনী: হরিপুরা পট


    বর্তুলাকার দ্বিমাত্রিক রেখার টান কালীঘাটের পটে লক্ষ করা যায়। আলো-ছায়ার খেলা বোঝাতে রেখাগুলি কোথাও মোটা আবার কোথাও সরু হয়েছে। এর ফলে দ্বিমাত্রিকতার মধ্যেই ত্রিমাত্রিকতার আভাস ফুটে ওঠে। কালীঘাটের পটের এই রেখাঙ্কন রীতির থেকে হরিপুরা পটের রেখাঙ্কনের রীতি অনেকটাই আলাদা। হরিপুরা পটের ছবিগুলির রেখা সাবলীল, কিছুটা আলংকারিক ধরনের। ছবির জমিকে দ্বিমাত্রিক থেকে ত্রিমাত্রিক করার কোন প্রয়াস সেখানে নেই। একটানে তুলি চালানোর প্রয়াস হরিপুরার পটগুলিতে নেই। একটানা বর্তুলাকার রেখার পরিবর্তে এখানে-ওখানে ক্যালিগ্রাফিক রেখাঙ্কন কৌশল সেখানে দেখা যায়। নন্দলালের ভাষায় শরপাতি (শরপাতার মতো) রেখা। কালীঘাট নয়, এই রেখাগুলির সঙ্গে বরং জাপানি লিপিকলার মিল পাওয়া যায়। হরিপুরার পটগুলিতে চাষী, তাঁতি, কুমোর, ছুতোর, নর্তকী, খেলোয়াড় প্রভৃতি প্রতিটি চরিত্রের নিজস্ব কাজের ছন্দটি গতিশীল রেখার দ্বারা রূপায়িত হয়েছে। ক্যালিগ্রাফিক রেখার টানে চরিত্রগুলি মাংস-পেশিময় হয়ে উঠেছে। সেগুলি কালীঘাটের পটের পুতুল-প্রতিমার থেকে অনেক বেশি প্রাণবন্ত। পুতুল বানানো পটুয়াদের থেকে সে রেখার ধার অনেক বেশি।

    কালীঘাটের পটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল গোল বা পানপাতা গড়নের ভারি মুখ ও টানা টানা বড় চোখ। চোখ বড় করে আঁকা হলেও তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুখমণ্ডলের রেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। হরিপুরা পটগুলিতে আঁকা লোক-জনের চোখ মুখের পাশ দিয়ে সামান্য বার করা। মুখগুলি পানপাতার গড়নে নয়, খানিকটা জৈন পুঁথিতে চিত্রিত নরনারীর মুখের ধাঁচে আঁকা। কালীঘাট পটের চরিত্রগুলির ভাবালুতাময় চোখ হরিপুরা পটে অমিল। কালীঘাটের পটে নারী-পুরুষ-জীবজন্তু সবার চোখের ধরন সমান। চরিত্র ও বিষয়বস্তুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মুখ বা চোখের অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন সেখানে হয় না। সামাজিক কদর্যতার ছবির ক্ষেত্রেও কালীঘাটের পটুয়ারা চিত্রের চোখগুলির মধ্যে চটুল বা নাগরিক ভাব আনতে পারেননি। কিন্তু হরিপুরা পটে চরিত্র অনুযায়ী চোখের ধরন বদলেছে।

     
    যোদ্ধা: হরিপুরা পট
     
    ডুগডুগিওয়ালি: হরিপুরা পট


    কালীঘাটের পটে রঙের ব্যবহারের বিশেষত্ব তাকে অন্যান্য গ্রামীণ পটগুলি থেকে পৃথক করেছে। ব্যবসায়িক কারণে খুব সামান্য সংখ্যক রং অপেক্ষাকৃত পাতলাভাবে পটে ব্যবহার করেছেন কালীঘাটের পটুয়ারা। এই ধরনের পটে ডৌল বা ‘রিলিফ’ দেখানোর জন্য বিভিন্ন রং বা একই রং গাঢ় থেকে হাল্কাভাবে লেপন করা হয়েছে। হরিপুরার পটেও খুব সীমিত সংখ্যক রং ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাইমারি রংগুলি ভারতীয় কায়দায় ছবিগুলিতে চাপানো হয়েছে। একটি অবয়ব বা আকৃতি মোটা তুলিতে উজ্জ্বল রঙের চওড়া ছোপে আভাসিত করে কালো বা অন্য কোন গাঢ় রঙে টানা রেখার সাহায্যে সেগুলি স্পষ্ট করা হয়েছে। ভারতীয় মানুষের গাত্রবর্ণের বৈচিত্র্য বোঝাতে বাদামি রং নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

    নন্দলাল বসু হরিপুরার ছবিগুলি কালীঘাটের পটুয়াদের মতো পেনসিল ব্যবহার না করে তুলি দিয়ে সমাপ্ত করেননি। তিনি কাগজের উপর পেনসিল দিয়ে প্রথমে ছবির মূল রূপটিকে ধরেছেন। তারপর জমিতে রং ভরাট করেছেন। সবশেষে কালো রঙের আউটলাইন টেনে ছবি সমাপ্ত করেছেন। ছবিগুলির ক্ষেত্রে রং ও রেখা সমান গুরুত্ব পেয়েছে।

     
    ডোম যোদ্ধা : খসড়া চিত্র
     
    ডোম যোদ্ধা : হরিপুরা পট


    কালীঘাটের পটের মধ্যে ভিত্তিচিত্রের গুণাবলী লক্ষ করা যায় না। অন্যদিকে হরিপুরার ছবিগুলি মিউরাল ধর্মী। লক্ষ করার বিষয়, প্রতিটি ছবিতেই আছে একটি নির্দিষ্ট আকারের বাঁধুনি। একটি বাঁকা খিলানের মতো ঘেরের মধ্যে মূল বিষয়বস্তুটি উপস্থাপন করা হয়েছে। দেওয়ালে ভিত্তিচিত্রের মতো পর পর রাখা হবে জেনেই পরিসীমার মিল রাখতে, শিল্পীর এই পরিকল্পনা বলে মনে হয়।

    ছবির মূল বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে পশ্চাদ্‌পটে হালকা রঙের ব্যবহার কালীঘাটের পটে লক্ষ করা যায়। নন্দলাল বসু ছবির পশ্চাদ্‌পটে বর্ণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই বাধ্যবাধকতাকে মানেননি। ছবির নিজস্ব প্রয়োজনে পশ্চাদ্‌পটে কোথাও হালকা কোথাও গাঢ় রং ব্যবহার করেছেন। কালীঘাট পটের মতো পশ্চাদ্‌পটকে একেবারে ফাঁকা না রেখে মূল বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছোট-বড় মোটিফ এঁকে পশ্চাদ্‌পটের শূন্যতাকে পূরণ করেছেন। পটের স্পেস-বিভাজন রীতিকে এখানে ভাঙা হয়েছে।

    কালীঘাটের পটে নারীচরিত্র ও পুরুষচরিত্রগুলির পোশাক-পরিচ্ছদ ও অঙ্গ-সজ্জা একটি নির্দিষ্ট গতে বাঁধা। হরিপুরা পটে চরিত্র অনুযায়ী ও পেশা অনুযায়ী পোশাক এবং সাজসজ্জা পরিবর্তিত হয়েছে। চরিত্ররা যেন নাটকের নট-নটী হয়ে নাট্যদৃশ্যের দাবি অনুযায়ী সাজঘর থেকে পোশাক-পরিচ্ছদ বদল করে এসেছে। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদের ধরনই যেন ছবির চরিত্রগুলিকে বাস্তব করে তুলেছে।

     
    মালি: হরিপুরা পট
     
    কানফোটানো: হরিপুরা পট


    কালীঘাটের পট তৎকালীন সময়ের সামাজিক ঘটনাবলীকে উপস্থাপন করেছিল বলেই পটগুলিকে সামাজিক দলিল হিসাবে গণ্য করা যেতেই পারে। সামাজিক ছবি আঁকার উদ্দেশ্য ছিল সমাজের ব্যভিচারকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করা। তাই ছবিগুলির মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক প্রতিবাদ। অন্যদিকে হরিপুরা পটগুলি আঁকার সময়ে সেগুলিকে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য ও আকর্ষণীয় করে তুলতে চেয়েছিলেন নন্দলাল। তাই সামাজিক মেজাজ অনুযায়ী গ্রামের নরনারী, দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম, খেলাধুলা, উৎসব অনুষ্ঠানের ছবি তিনি এঁকেছেন। হরিপুরার পটগুলি আঁকার আর একটি উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণকে শিক্ষাদান করা ও স্বদেশ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। কালীঘাট পট ও হরিপুরা চিত্ররাজি এ ভাবেই নিজ নিজ ধারায় সমকালকে বর্ণনা করেছেন।

    নন্দলাল বসু হরিপুরা পট আঁকার ক্ষেত্রে কালীঘাটের প্রভাবের কথা স্বীকার করেছেন। একথা সত্য যে হরিপুরার ছবিগুলি কালীঘাটের পটের দ্বারা প্রভাবিত। কালীঘাট পটের আদর্শের কথা মাথায় রেখে হরিপুরার পটগুলি নির্মিত। তবে হরিপুরা পট কখনই কালীঘাট পটের অন্ধ অনুকরণ নয়। দক্ষ চিত্রশিল্পীর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পরম্পরার মেলবন্ধনে ছবিগুলি রচিত হয়েছে। অশিক্ষিত পটুয়াদের গ্রাম্য রুচির পটের থেকে এই পটগুলি ভিন্ন হয়ে গেছে। ছবিগুলিতে শিল্পীর প্রশিক্ষিত মার্জিত রুচির স্পষ্ট ছোঁয়া রয়েছে। নন্দলালের আঁকা হরিপুরা পটে ভারতীয় প্রাচীন বা নবীন শিল্প আঙ্গিক অথবা কোন বিদেশী শিল্পাদর্শের থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সাময়িক মেজাজ।

    বাণীপুরের বাড়িতে বসে আঁকা পট এবং হরিপুরার পটধর্মী চিত্রগুলি ছাড়াও নন্দলালের আঁকা বেশ কিছু ছবিকে পট হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে আঁকা রাম-সীতা উপাখ্যানের রূপরাজিকে পট হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। “এগুলি পট এজন্যই যে, এই-সব আলেখ্যে প্রতি পদে নানা দেশ কাল ঘটনার নানা ভঙ্গী যথোচিত প্রতীক-যোগের চিহ্ন হলেও, সে রচনায় নেই বিশেষের বাস্তবতা বা রিয়েলিজ্‌ম্‌। সীমাবদ্ধ পটভূমির মণ্ডন বা অলংকরণই যা-কিছু আকার এবং আয়োজনের মুখ্য উদ্দেশ্য।”

     
    রামায়ণী পট : দশরথের কোলে রামচন্দ্র
     
    রামায়ণী পট : বিশ্বামিত্রের সঙ্গে রামলক্ষ্মণের তাড়কাবধে যাত্রা


    পট ও নন্দলালের দৃষ্টিভঙ্গী

    ধ্রুপদী শিল্পের পাশাপাশি অনভিজাত লোকশিল্প তথা ‘পট’ সম্পর্কে নন্দলাল বসুর ছিল গভীর জ্ঞান। তিনি অজন্তা, বাগ, কাংড়া, রাজস্থানী ছবির সঙ্গে দেশী পটের মিল খুঁজে পান। উইলিয়াম জর্জ আর্চারের (১৯০৭-১৯৭৯) Bazar Painting of Calcutta (১৯৫৩) বই সম্পর্কে তিনি বলেন - “...একসঙ্গে কালীঘাটের পটগুলি ছাপায় দেখে মনে হয় যেন খোটান বা অজন্তার বা নারার ছবির বংশধরদের দেখছি। কালীঘাটের পট পদ্ধতি অতি পুরাতন হঠাৎ হয় নাই, মোগল বা পারস্যর ছাপ অতি কম আছে। সময় ও উপকরণের (পরিমিতির) জন্য এই চেহারা হয়েছিল। বিলাতি আধুনিক শিল্পীদেরও influence করেছে। ইহা চিনা কাচের ছবির অনুকরণ নয় বরং খোটানের অনুকরণে চিনা কাচের ছবি হয়েছে।”

     


    নন্দলাল বসু কেবল বাংলার পট নয়, জগন্নাথের পট সম্পর্কে তিনি তাঁর সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘শিল্পচর্চা’ নামক গ্রন্থটির ‘জগন্নাথের পট’ নামক অধ্যায়ে। গ্রন্থটি তিনি লিখেছিলেন শিল্পশিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে। তিনি চেয়েছিলেন ছবি আঁকতে যা যা করণ-উপকরণ লাগে, সেগুলি তাঁর ছাত্রছাত্রীরা নিজে হাতে তৈরি করে সৃষ্টির আনন্দ লাভ করুক। অধ্যায়ের প্রথমেই এ ধরনের পট তৈরির উপকরণগুলি ক্রমানুসারে বর্ণনা করেছেন। মোট ষোলটি উপকরণের কথা তিনি বলেছেন। উপকরণগুলি কতটা পরিমাণে নিতে হবে, কেমন মানের নিতে হবে, কেমনভাবে সেগুলিকে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু কিছু উপকরণের ছবি এঁকে দেখিয়েছেন। এরপর এসেছে যথাক্রমে পটের জমি, খসড়ার প্রস্তুতি, তুলি তৈরি, রং তৈরি ও তার প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা। জগন্নাথের পট অঙ্কনের ক্রমটির বিভিন্ন ধাপগুলির স্থানীয় নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁর আলোচনায় উঠে এসেছে বাংলার পটের সঙ্গে শ্রীক্ষেত্রের পটের তফাত। রচনাটি পড়লে বোঝা যায় ভবিষ্যতের শিল্পীদের প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ।

     
    ‘জগন্নাথের পট’ আঁকার উপকরণ


    উপসংহার

    নন্দলাল বসুর ছবিকে কোন একটি অঞ্চলের আঞ্চলিক শৈলীর ছবি হিসাবে অভিহিত করা যায় না। সমগ্র ভারতবর্ষকে তিনি তাঁর আপন করে নিয়েছেন। ভারতবর্ষের মানুষজন, জল হাওয়া, প্রকৃতি, সূর্যালোক তাঁর প্রতিটি ছবিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাঁর চিত্রশৈলী একান্তই তাঁর নিজের। তা অজন্তা নয়, বাগ নয়, রাজস্থানী নয়, এমনকি পটশিল্পকলাও নয়। তিনি পটশিল্পের সহজ সরলতায় আকৃষ্ট হয়ে বহু ছবি এঁকেছেন, কিন্তু সেগুলিকে আক্ষরিক অর্থে কোন ভাবেই পটের ছবি বলা যাবে না, তা একান্ত ভাবে নন্দলালের নিজস্ব সৃষ্টি। লোকশিল্পের এই ধারাটি তাঁর অনুপ্রেরণার স্তরেই রয়েগেছে। পটশৈলীকে তিনি কখনই অনুকরণ করেননি। বিষয়গত ও শৈলীগত দু’দিক থেকেই তা সত্য। সাবেক পটের থেকে তাঁর আঁকা পট ভিন্ন গোত্রের। পটশৈলী সম্পর্কে নন্দলাল বসুর গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর বিভিন্ন লেখাতে। তিনি পটকে দেখেছেন গবেষকের মতো, আর ব্যাখ্যা করেছেন শিক্ষকের মতো। আলোচনাটিতে নন্দলাল বসুর পটচিত্রচর্চা ও তাঁর নিজস্ব মতাদর্শের একটি সঙ্ঘবদ্ধ ও সুসংহত ধারণাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।

    তথ্যসূত্র

    ১। সামন্ত, কানাই (১৯৬২)। নন্দলাল বসু। কলকাতা : কথাশিল্প প্রকাশন। পৃ- ৩৪

    ২। বসু, নন্দলাল (১৩৯২)। দত্ত, অম্লান ও সুব্রহ্মণ্যন্‌, গণপতি শ্রীকল্পাতি (সম্পাদিত)। দৃষ্টি ও সৃষ্টি । কলকাতা: বিশ্বভারতী। পৃ- ২৮২

    ৩। অধিকারী, সুশোভন (সম্পাদিত, ২০১৬)। মণ্ডল, পঞ্চানন।‘গুরুশিষ্য সংবাদ’। মাস্টারমশাই নন্দলাল। কলকাতা: লালমাটি। পৃ – ১৫১

    ৪। বসু, নন্দলাল (১৩৯২)। দত্ত, অম্লান ও সুব্রহ্মণ্যন্‌, গণপতি শ্রীকল্পাতি (সম্পাদিত)।দৃষ্টি ও সৃষ্টি । কলকাতা: বিশ্বভারতী। পৃ- ২৮৩

    ৫। মণ্ডল, পঞ্চানন (১৯৮২)। ভারতশিল্পী নন্দলাল (১মখন্ড)। বীরভূম: রাঢ়-গবেষণা-পর্ষদ। পৃ- ৩৯৬

    ৬। বসু, নন্দলাল (১৩৯২)। দত্ত, অম্লান ও সুব্রহ্মণ্যন্‌, গণপতি কল্পাতি (সম্পাদিত)।দৃষ্টি ও সৃষ্টি । কলকাতা: বিশ্বভারতী। পৃ- ২৪৮

    ৭। অধিকারী, সুশোভন (সম্পাদিত, ২০১৬)। দুগার, ইন্দ্র। ‘রূপপতি নন্দলাল’। মাস্টারমশাই নন্দলাল। কলকাতা: লালমাটি। পৃ - ৫৯

    ৮। সামন্ত, কানাই (১৯৬২)। নন্দলাল বসু। কলিকাতা: কথাশিল্প। পৃ- ৪৮-৪৯

    ৯। অধিকারী, সুশোভন (সম্পাদিত, ২০১৬)। সামন্ত, কানাই। ‘শিল্পীগুরু নন্দলাল’। মাস্টারমশাই নন্দলাল। কলকাতা: লালমাটি। পৃ- ৮০-৮১



    চিত্রগুলি বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ওয়েবসাইট এবং শ্রী পঞ্চানন মণ্ডলের ‘ভারতশিল্পী নন্দলাল’ (খণ্ড ১) এবং নন্দলাল বসুর ‘শিল্পচর্চা’ গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত।

     
     


  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments