‘পরশু থেকে ফের লকডাউন শুরু হবে, শুনেছ তো বৌমা?’
সবজি-ভরা থলিটা উঠোনের কোণে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন হৃষীকেশ।
রান্নাঘরের মধ্যে থেকে কী উত্তর এল, বোঝা গেল না।
উনি ততক্ষণে কনুই দিয়ে ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্ করে উঠোনের টিউবওয়েলটির হ্যান্ডেল টিপে টিপে জল বের করতে লেগেছেন---সাবান দিয়ে হাতটা ধুয়ে নিতে হবে। তারপরে মাস্কটা খুলবেন মুখ থেকে।
ঘরের মধ্যে থেকে নান্টু বলে উঠল, ‘আই পি এল ম্যাচ দেখবে তো আজ, দাদু? কে কে আর-এর সঙ্গে আজ…’
‘তুমি পড়াশুনোয় মন দাও দাদুভাই। কালকের অঙ্কগুলো ধরো আজ। ইস্কুল-পাঠশাল তো লাটে উঠেছে তোদের! ক্লাস ফোরে উঠলে আমাদের কালে…’
গজগজ করতে করতে পাশের ঘরে ঢুকে পরনের ফতুয়াটা খুলে হাওয়ায় মেলে দিলেন হ্যাঙারে টাঙিয়ে।
হাসি এবার ঘরে ঢুকে টেবিলের উপরে চায়ের কাপখানি রাখতে রাখতে বলল, ‘হ্যাঁ বাবা, মেসেজ এসে গেছে সকালেই আমাদের গ্রুপে। দেখেছি। তবে আমার আর কী? লকডাউনে তো আর আপনার ছেলের কোনো ছুটি নেই। সেই ছ’টা না বাজতে বাজতেই তো সে…’
শ্রীপদ-কে ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে পড়তে হয়। ঔষধের ফ্যাক্টরিতে কাজ তার। নো লকডাউন। সাইকেলে যায়। সাড়ে ছ’ মাইল রাস্তা।
‘তোমার মা খেয়েছেন?’
তক্তপোশে শোওয়া স্ত্রীর দিকে তাকালেন হৃষীকেশ।
না, সারদা খেতে পারে না নিজে নিজে। খাইয়ে দিতে হয়। সাত বছর আগে স্ট্রোকের পর থেকেই এই অবস্থা। হাসিই রোজ পরম যত্নে খাইয়ে দেয় শাশুড়িকে।
বৌমাটি বড় ভালো পেয়ে গেছেন!
কিন্তু এই মেয়েকেই ঘরে আনা-না-আনা নিয়ে কী তুমুল কাণ্ডটাই না হয়েছিল--মনে পড়ে যায় হৃষীকেশের।
***
শহরের প্রান্তে এই বাড়িটা করেছিলেন হৃষীকেশ চক্কোত্তি রিটায়ারমেন্টের পরে। তার দশ বছর আগে জমিটা যখন কিনে রেখেছিলেন অনেকেই মানা করেছিল ঐ ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে জমি কিনতে। কে যাবে ঐ প্রান্তে থাকতে? হৃষীকেশের অবিশ্যি এর চেয়ে বেশি সামর্থ্যও ছিল না। পৌরসভায় সামান্য চাকুরি করে গেছেন জীবনভর।
***
‘লকডাউন পড়ে গেলে কিন্তু আর তোমার বাড়িতে এসে এই চা-টুকু খাওয়া যাবে না,’ বৃদ্ধ আশু মাইতি শূন্য চায়ের কাপখানি প্লেটে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন।
লাঠি ঠুক ঠুক করতে করতে প্রায় প্রায়ই এসে পড়েন উনি হৃষীর খবরাখবর নিতে। আপিসে পাঁচ-সাত বছরের সিনিয়র ছিলেন আশুতোষ। চিরকালই একটু পাগলাটে আর মুডি লোক বলে কোলিগদের মাঝে হাস্যাস্পদ হতেন। পেছনে লাগত ওঁর সবাই। তবে বেহালা-বাদনের বেশ নামডাক ছিল তাঁর এ’তল্লাটে-- অনেক ফাংশনে ডাক পড়ত! এখন অবশ্য আশি ছুঁতে চলেছে আশুতোষের। ছানি অপারেশনটা সফল হয়নি। পুরু কাঁচের চশমা পরে লাঠি নিয়ে হাঁটতে হয়। থাকেন যদিও এই চৌহুদ্দিতেই, তবে খুব একটা কাছেও নয়। তবু তো আর তাঁর মুখের ওপর বলা যায় না, ‘কেন আসেন?’
মাঝে মাঝেই সকালের দিকে কী মুডে বেহালাখানি নিয়েই চলে আসেন আশুতোষ--কেউ কিছু না-বলতেই, না-ডাকতেই। সুর ধরেন--সারঙ্গ!
সে-দিনগুলো অন্যরকম লাগে হৃষীকেশের, যদিও রাগরাগিণীর কিছুই বোঝেন না তিনি। বৌমা কেবল রান্নাঘর থেকে বলে ওঠেন, ‘থামলেন কেন, কাকাবাবু। বেশ তো লাগছিল।’
হালকা হাসিতে ভরে যায় বৃদ্ধের মুখ।
নাতি নান্টুও ভিডিও গেমস ফেলে কান খাড়া করে শুনতে থাকে বুড়োদাদুর বাদন।
***
করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত সারা দেশের জনজীবন! প্রাণ আগে না জীবিকা আগে? একটা বাঁচলে যে অন্যটা বাঁচে না।
সেদিন সকালে বেড়াতে এসে আটকে গেলেন আশু মাইতি।
বেলা এগারোটা থেকে আকাশ কালো করে শুরু হয়ে গেল প্রবল ঝড়জল। সঙ্গে মুহুর্মুহু বজ্রপাত। দুপুর একটা বেজে যেতে বৌমা বললেন, 'কাকাবাবু আজ এখানেই চালে-ডালে দুটি খেয়ে নেবেন। আমি চড়িয়ে দিয়েছি।'
আর সারদার শ্বাসটা উঠতে শুরু করল তার আধ ঘন্টার মধ্যেই।
ছেলেকে আর শ্বশুরদের খাইয়ে খিচুড়ির থালাটা নিয়ে ওঁর ঘরে ঢুকতেই হাপরের মতো শাশুড়ির গলা থেকে শব্দটা কানে এল হাসির। টেবিলে থালাটা রেখে 'কী হয়েছে মা' বলতে বলতে ওঁর বিছানার পাশে এসে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সারদার মুখের দিকে তাকিয়ে স্থানুবৎ হয়ে গেল হাসি। লাল টকটক করছে মুখ। চোখ দুটি যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে!
‘বাবাআআ…..’ বলে একটা প্রচণ্ড চিৎকার করে মাথা ঘুরে পড়ে গেল প্রায়। ভাগ্যিস চেয়ারটা ধরে ফেলেছিল।
ভাদ্রমাসে ভাগীরথীর তীরে দাচা-বাবার মেলা বসে আসছে সুদীর্ঘকাল ধরে। নানান ধর্মের লোক আসে বাবার মাজারে মাথা ঠেকাতে, মানত করতে, মানত খুলতে।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এই সুফীসন্ত্ দাচা-বাবা, ওরফে দানেশ শেখ, পাঞ্জাবে গিয়ে বুল্লেহ্ শাহের মুরিদ হয়ে ফিরে আসেন, এবং রাম-রহিমের একাত্মতার বাণী প্রচার করতে থাকেন। অদ্ভুত কিছু ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল তাঁর--যে-সব গল্প আজও লোকমুখে ফেরে। বংশপরম্পরায় নাকি সে-সব অলৌকিক ক্ষমতা বাহিত হয়ে চলেছে। গপ্পকথা, অবিশ্যি, সে-সব। দরকার নেই বাপু আমাদের অত শত কথায়, না আজকের কাহিনির সঙ্গে তার কোন যোগ আছে সরাসরি।
তবে ওঁর বংশধারার এই প্রজন্মের প্রধান পুরুষ শেখ বাহারউদ্দিন হলেন একজন অতীব আধুনিক মানুষ। বছর আশির যুবক তিনি এখন! এই কোভিডের কালে মুখে মাস্ক পরায় জোর দেন, এবং ভ্যাক্সিন নেওয়ায়। তাঁর অগুন্তি শিষ্যশিষ্যাদের সোশাল ডিসটান্সিং মানতে বলেন, এমনকি ঈদের সমাগমেও।
আজ সকাল থেকে, অবশ্য, বাহার-সাহেবের মনটা কেন জানি না বড্ড উচাটন হয়ে আছে।
দুপুর গড়াতে-না-গড়াতেই আজ শুরু হয়ে গেল ঝড়ের প্রচণ্ড তাণ্ডব! ভাগীরথীর পাড় ভাঙাটা এ'অঞ্চলে খুবই স্বাভাবিক। আজ এত এত প্রবল ঢেউ এসে ভাঙতে লাগল পাড় যে ভয় লাগে কোনদিন না.....
“আল্লাহুম্মা ছাল্লি ওয়া সাল্লিম আ’লা সাইয়্যিদিনা …”
বিশেষ মনোযোগে উচ্চৈঃস্বরে দরুদ আবৃত্তি করতে থাকেন বাহারউদ্দিন সাহেব!
***
এ’দিকে, ঠিক সেই সময়ে শহরতলীতে হৃষীকেশ চক্রবর্তীর ঘরেও তখন হাহাকার! দিশেহারা সবাই।
নান্টু বলল, 'মা, ঠাম্মির বুকে ঐ মলমটা মালিশ করে দেব?'
কিন্তু সারদার ব্যায়রামটা যে এত সহজ নয় সেটা বুঝতে কারোর অসুবিধা হবার কথা নয়। দ্বিতীয় স্ট্রোক! প্রথমটা ওঁকে চলচ্ছক্তিহীন করে দিয়েছিল সাত বছর আগে।
হৃষীকেশ এসে বসে পড়েছেন পাশের চেয়ারটিতে। ঠক ঠক করে কাঁপছেন।
প্রবল শব্দে একটা বাজ পড়ল কাছেই কোথাও। অবিরাম বৃষ্টির কোনো কমতি নেই।
ঠিক এই সময়ে ঘরের ঠিক বাইরে বারান্দায় লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে বৃদ্ধ আশুতোষ বললেন, 'বৌমা। তোমার বাবাকে ডাকো। তিনি অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন পুরুষ। এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।'
'ডাকব? কী করে ডাকব? বিয়ের পর থেকে আজ দশ বচ্ছর কোন যোগাযোগ নেই তাঁর সাথে।'
উদ্ভ্রান্তের মত একটা আঙুল তুলে দেখালেন আশুতোষ।
ঐ!
দেওয়ালের বুক-সেলফে বই এর সামনে এক ফ্রেমে বাঁধানো ছোট্ট ছবি। ছবি না, লেখা একটা। বিজাতীয় ভাষায়। ডান থেকে বামে।
আকুল হয়ে ডাকতে লাগল মেয়েটি তার বাবাকে---উদ্ধার করো, উদ্ধার করো বাবা এই বিপদ থেকে।
হঠাৎ কানে এল বারান্দার চেয়ারটিতে বসে বৃদ্ধ আশুতোষ বেহালার ছড় টানছেন…ভেসে উঠছে সুরঃ
প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠল বেজে যেই
নীড়বিরাগী হৃদয় আমার উধাও হল সেই....
কিছুক্ষণের মধ্যেই অপূর্ব এক সৌরভে ভরে উঠল ঘরটি! সকলেই পেয়েছেন সেই সুগন্ধ। ধূপধুনোর।
সেই লেখাটির ফ্রেম থেকে যেন জ্যোতি বেরোচ্ছে একটা!
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেন সকলে, বিছানায় উঠে বসেছেন সারদা।
বিস্ময়ে চোখ ঠিকরে বেরোচ্ছে সকলের। নান্টু তার আট বছরের জীবনে ঠাকুমাকে উঠে বসতে দেখেছে বলে মনে করতে পারে না।
'কৈ দেখি, আয় তো মা হাসি, .... হাসিনা। আয় আমার কাছে।' হ্যাঁ, স্বরটা ভেসে আসছে মূক সারদার গলা থেকেই।
অবাক বিস্ময়ে ধপ্ করে বিছানার কোণে বসে পড়ে হাসিনা। আদরের বৌমা।
আলতো করে তার গালটা টিপে আদর করে বলেন সারদা, 'চলে তো সবাইকেই যেতে হবে মা। কান্না কেন তবে?'
তারপরে ফের বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বলেন, 'আব্বুরে আমার সালাম দিবা। উনি এসেছিলেন!'
গভীর প্রশান্তিতে চোখ মোদেন বৃদ্ধা।
***
'চলে গেলেন উনি।' আশুতোষের গলা। কখন থেমে গেছে ওঁর গান।
বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখেন সকলে কখন যেন বৃষ্টি থেমে আকাশ ঝলমলে রোদ্দুরে ভরে উঠেছে!
সেখানে আজ আর কোনো লকডাউন নেই!