• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | গল্প
    Share
  • কোল্যাটারাল ড্যামেজ : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়






    “আপনাকে আমি আগেই সাবধান করেছিলাম,” মোবাইল ফোনের উলটো দিক থেকে লোকটা বলল, “তখন গরিবের কথা কানে তুললেন না। এবার ঠ্যালা বুঝুন।”

    অ্যাড এজেন্সিতে কাজ করার অনেক ঝক্কি। তার ওপর অতিমারীর সময় বিস্তর লোকজন ছাঁটাই হয়েছে। প্রতিদিন অফিসে এসে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করেও বসের গালাগালি শুনতে হয়। ক্লায়েন্টগুলোও হয়েছে তেমন... কঞ্জুস মাক্ষীচুষ! বাংলায় যাকে বলে – ওয়ান পাইস ফাদার মাদার। সস্তার অ্যাডের জন্য নতুন মডেল খুঁজছিল দিব্য। সেই সূত্রেই মেয়েটার সঙ্গে পরিচয়। কাস্টিং এজেন্ট জয়প্রকাশ নিয়ে এসেছিল সঙ্গে করে... একটু ঢলানি টাইপের। কী যেন নাম বলেছিল... রিচা শর্মা, না কী! পরে জানল বাঙালি। মুর্শিদাবাদ থেকে চালান হয়ে মুম্বাইয়ের কোন চ্বলে এসে উঠেছে। আসল নাম চারু। গাওটি নাম শুনেই যাতে কেউ বাতিল করে না দেয়, সেই জন্য উল্টেপাল্টে ভেঙেচুরে রিচা। মেয়েটার হিন্দি উচ্চারণে সমস্যা ছিল। দিব্যর জন্ম-কর্ম মুম্বাইতে, অডিশনের সময় কানে লেগেছিল। ভাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু চারু হাল ছাড়েনি। বারবার ফোন করে কাকুতি-মিনতি করত। কোত্থেকে জানতে পেরেছিল দিব্যও বাঙালি। জয়প্রকাশই টুইয়ে দিয়েছিল বোধ হয়।

    বাঙালিয়ানা নিয়ে দিব্যর অবশ্য বিশেষ আদিখ্যেতা নেই। বাবা-মা জবরদস্তি বাংলা শিখিয়েছিল ছোটবেলায়, বাড়িতে বাংলাতেই কথা বলে, যদিও দু’-একটা মুম্বাইয়া হিন্দি ঢুকে যায় মাঝেমধ্যে, তবে ওই পর্যন্তই। চারুকে পাত্তা দেয়নি। সে অবশ্য ছিনে জোঁকের মত লেগে ছিল। দিব্যর মনে আছে, তখনই প্রথমবার লোকটা তাকে ফোন করে। দিব্যর সঙ্গেই কথা বলছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে বলেছিল, “স্যর, একটা কথা বলার ছিল আপনাকে। চারু মেয়েটা কিন্তু ভয়ানক গায়ে পড়া। একটু সামলে থাকবেন।”

    দিব্য আশ্চর্য হয়েছিল, খানিকটা বিরক্তও, জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি কে বলছেন? চারুকে চিনলেন কী করে?”

    লোকটা সে কথার জবাব দেয়নি। বলেছিল, “আপনাকে সতর্ক করা আমার কর্তব্য, তাই…”

    দিব্য অর্ধেক শুনেই ফোন কেটে দিয়েছিল। এরকম অনেক ফালতু ফোন আসে। ভেবেছিল জয়প্রকাশের কোনও শত্রু-টত্রু হবে। ভাঙানি দিচ্ছে। জানে না মেয়েটা অডিশনে উৎরোয়নি।

    বলা-কওয়া নেই চারু একদিন অফিসে চলে এল। সন্ধে গড়িয়ে তখন রাত উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। একটা অ্যানিমেশন তৈরি করে ক্লায়েন্ট রিভিউয়ের জন্য পাঠানোর ছিল, আরজেন্টলি... দিব্যর দেরি হচ্ছিল। অফিস প্রায় ফাঁকা, সিকিউরিটি সঙ্গে করে নিয়ে এসে চারুকে দিব্যর কেবিনে ছেড়ে দিয়ে গেল। এ অফিসে এমন কিছু চোখে লাগার মত ব্যাপার নয়। ডেডলাইনের মাথামুন্ডু থাকে না, অনেকেই রাত করে বসে। মেয়েদের আনাগোনাতেও তেমন বিধিনিষেধ নেই। সাধুসন্তদের দিয়ে আর তাই হোক, অ্যাড এজেন্সি চলে না। চারু এসে আক্ষরিক অর্থেই কেঁদে পড়ল, “স্যর, কাজটা খুব দরকার। যা করতে বলবেন করব।”

    মেয়েটাকে কাটিয়ে দেওয়ার জন্যই কতকটা, বলেছিল, “সামনের সপ্তাহে লোনাবেলায় একটা আউটডোর শ্যুট আছে। চলে এসো, আর একটা অডিশন নিয়ে দেখব।”

    ওদের টিম লোনাবেলার যে রিসর্টে গিয়ে ক্যাম্প করবে তার নাম-ঠিকানা নিয়ে মেয়েটা চলে গিয়েছিল। নির্দিষ্ট দিনে সকাল-সকাল হাজিরও হয়ে গিয়েছিল। লোকেশনের একপাশে দাঁড়িয়ে শ্যুটিং দেখছিল, দিব্য বলেছিল হাতের কাজ শেষ হলে কথা বলবে। ঘাট এরিয়ায় মেঘ বড় অসমীচীন। আগাম নোটিশ দিয়ে আসে না। শ্যুটিং চলার সময় ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নামল। ক্যামেরা-ট্যামেরা গুটিয়ে তুলে আনতে আনতে সবাই হাপুশুটি ভিজে গেল। রিসর্টে ফিরে গা-মাথা মুছে পোষাক বদলানোর পরও শীত-শীত করছিল। ভাবল কফি খায়। সরঞ্জাম ঘরেই মজুত, উঠে গিয়ে বানালেই হয়। আলস্য লাগছিল। তখনই ঘরের দরজায় বেল বেজেছিল। দিব্য ভেবেছিল ইউনিটের কেউ। খুলে দেখল চারু। সস্তার কামিজ ন্যাতার মত গায়ে লেপটে আছে, খোলা চুল থেকে জল ঝরছে। চোখে ছলোছলো হতাশা, বুঝেছে বোধহয়, আজ আর অডিশনের কোনও সম্ভাবনা নেই। বলল, “আসতে বলেছিলেন, স্যর…”

    মেয়েটাকে দেখে মায়া হয়েছিল। ভিতরে ডেকেছিল। সেটাই কাল হল। স্তিমিত আলোয় জানলার পাশে ভিজে শরীর নিয়ে কোনও উদ্ভিন্নযৌবনা নারী এসে দাঁড়ালে মুনিদেরও মতিভ্রম হয়… শাস্ত্রে আছে, দিব্য তো কোন ছার। দোষের মধ্যে খেয়াল করেনি কোন ফাঁকে চারু মোবাইল ক্যামেরাটা অন করে জায়গা মত রেখে দিয়েছিল। দু’-দিন পরে হতচ্ছাড়া ভিডিও ক্লিপটা একটা অচেনা নম্বর থেকে যখন টুং করে দিব্যর মোবাইলে এসে জমা পড়ল, টনক নড়ল। এক ঝলক দেখেই বুঝল কী কেলো হয়েছে। মাথা কাজ করছিল না। মেয়েটা যে এতখানি শয়তানি বুদ্ধি ধরে আগে আঁচ করতে পারেনি। চারুর নম্বরে ফোন করে দেখল ‘স্যুইচড অফ’। নিজের বোকামির জন্য হাত কামড়েছিল। মনে আছে, সেদিন ওই ঘটনার পর চারু অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে বিছানার ওপর বসে ছিল, কথা বলছিল না, ডাকলে সাড়া দিচ্ছিল না। দিব্য ওয়াশরুমে ঢুকেছিল, বেরিয়ে এসে দেখেছিল ঘর ফাঁকা, চারু নেই।

    ক্লিপটা ফোনে ঢোকার পুরো একদিন পর লোকটার ফোন এসেছিল, “কেমন আছেন স্যর?” আগের দিন রাত্তিরে দুশ্চিন্তায় ভাল করে ঘুম হয়নি। অফিসে এসেও কাজে মন দিতে পারছিল না। থেকে থেকেই মাথার মধ্যে যন্ত্রণা চিড়িক দিয়ে উঠছিল। ‘ধুত্তেরি’ বলে বিকেল-বিকেল বেরিয়ে ‘মুনলাইট বার আনি রেস্তোরাঁতে’ ঢুকেছিল। নতুন খুলেছে, চেম্বুর নাকা থেকে যে রাস্তাটা ক্রেমেটোরিয়ামের দিকে যাচ্ছে তার মুখেই। সবে একটা ভডকা নিয়ে বসেছে, ফোনটা এল। গলা শুনে চিনতে পারেনি। লোকটাই ধরিয়ে দিয়েছিল, “আগে একদিন ফোন করেছিলাম আপনাকে। চারুর ব্যাপারে...”

    মুম্বাইতে রিয়েল এস্টেট মহার্ঘ বস্তু। মানুষের চেয়েও জমির দাম বেশি। মুনলাইটের টেবিলগুলো বড্ড কাছাকাছি পাতা। দিব্য বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। হাতের পাতা দিয়ে সামনের রাস্তায় চলমান গাড়িঘোড়ার শব্দ আড়াল করে সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি কে বলছেন বলুন তো? চারুর কোনও রিলেটিভ?”

    লোকটা শুকনো গলায় বলেছিল, “চারুর তিনকুলে কেউ নেই, স্যর। একটা শুধু বাচ্চা মেয়ে আছে...বছর চারেকের... ওর কাছেই থাকে। প্রথম হাজব্যান্ডটা একটা কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে কাজ করত, মাথার দোষ ছিল, পাগলা-গারদে পাঠাতে হয়েছিল। তাকে ছেড়ে চারু একজন টোটো-ড্রাইভারকে বিয়ে করে, মেয়েটা তখন পেটে। আগে থেকেই আশনাই ছিল আর কী! মেয়েটা জন্মানোর পর মাথায় ভূত চাপে মডেল হবে। পত্রপাঠ দু’নম্বর হাজব্যান্ডকে ছেড়ে বাচ্চা কোলে করে মুম্বাই চলে আসে,” চারুর ব্যবহারে লোকটা যেন ভয়ানক অসন্তুষ্ট, একটু থেমে বলেছিল, “এখানে তো দেখার কেউ নেই, খুল্লাম-খুল্লা নষ্টামি করে বেড়াচ্ছে...”

    দিব্য সন্দিগ্ধ হয়ে বলল, “আপনি এত কথা জানলেন কী করে? নাম কী আপনার? আপনিই কি সেই মিস্টার টোটো?”

    লোকটা হেসেছিল, “ভাল নাম দিয়েছেন – মিস্টার টোটো। লোকটাকে চিনি, দেখা হলে জানিয়ে দেব। খুশি হবে। সে যাক, পারলে মেয়েটাকে এড়িয়ে চলবেন স্যর। আগেও অনেককে ফাঁসিয়েছে। এটুকু বলার জন্যেই ফোন করা।”

    “ফাঁসিয়েছে মানে?” দিব্য উদ্‌বেগ চাপা দিতে পারল না।

    “লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই, চারুর মুখের মধ্যে একটা ন্যাকা-ন্যাকা ভাব আছে, লোকে ভাবে সরল সাধাসিধে… ও সেটা কাজে লাগায়। এমন ছেনালিপনা করে, মানুষ নিজের অজান্তেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে। তারপর আর কী! লুকনো মোবাইল ক্যামেরায় সেইসব ইল্লুতির ছবিছাবা তুলে ভিকটিমদের কাছে পাঠায়, হুমকি দেয় সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দেবে, চাপ দিয়ে সুযোগ-সুবিধে, টাকা-পয়সা আদায় করে,” লোকটা থেমে থেমে বলল, “এটাই ওর... কী যেন বলেন আপনারা – মোডাস অপারেন্ডি।”

    দিব্যর মনে হল ‘অপা’ আর ‘রেণ্ডি’ শব্দ দুটোর মধ্যে লোকটা ইচ্ছে করেই একটু বেশি ফাঁক দিল। দিব্য মুখ ফস্কে বলে ফেলল, “আগে জানলে কে আর…”

    সামলে নিল বটে, ততক্ষণে লোকটা আন্দাজ করে ফেলেছে, বলল, “এ হে! আপনিও ফেঁসেছেন নাকি স্যর? আপনাকে আমি আগেই…” লোকটা বকে যাচ্ছিল। চারুর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে কুটছিল, মেয়েটাকে দুষছিল। দিব্যর মনে হল লোকটা চারুকে চিনলেও খুব একটা পছন্দ করে না, জিজ্ঞেস করল, “কী চায় ও? আমার ফোন নিচ্ছে না কেন? ওকে বলুন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।”

    “ওই যে বললাম, মডেল হতে চায়, তার জন্য ও সব কিছু করতে পারে, এমনকি...” বাক্যটা অসমাপ্ত রেখেই লোকটা থেমে গেল। কথা পালটে বলল, “আমি বললেই কি আর চারু শুনবে, স্যর? আমার কোন কথাটাই বা সে শোনে?”

    “তাহলে উপায়?” দিব্য হতাশ হল। শব্দ দুটো নিজের কানেই স্বগতোক্তির মত শোনাল।

    “উপায় একটা আছে,” লোকটা বলল, “আপনাদের একজন এজেন্ট আছে না, প্রকাশ না কী নাম, ওকে দিয়ে খবর পাঠান,” দিব্য দেখল লোকটা সব খবরই রাখে। লোকটা এবার বেশ কতৃত্বের সুরেই বলল, “চারুকে আর একবার ডাকুন। যেখানে ডাকবেন সে জায়গাটা আপনার চেনাজানা হলে ভাল হয়। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে মোবাইলটা জোর করে ছিনিয়ে নিন। ব্যস, ঝঞ্ঝাট খতম, পয়সা হজম।”

    অত সহজে কি নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে? দিব্যর বিশ্বাস হল না।




    দিব্য একবার ভাবল, মুম্বাই পুলিশের সাইবার সেল-এ যোগাযোগ করে। তারপর থমকাল। লোক জানাজানি হলে বাবা-মা ভয়ানক কষ্ট পাবে। মা গুম মেরে যাবে, বাবা নির্ঘাত চেঁচামেচি করবে। বাবার হাই ব্লাড প্রেসার। উত্তেজনার বশে কখন কী অঘটন ঘটে যায়, কে বলতে পারে? চারুর সঙ্গে কথাবার্তা বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়াই ভাল। লোকটা অবশ্য অন্য উপদেশ দিয়েছিল। জয়প্রকাশকে দিয়ে চারুকে ডেকে পাঠিয়ে সুযোগ বুঝে ফোনটা কেড়ে নিতে বলেছিল। কিন্তু একটা অচেনা লোকের কথার ওপর ভরসা করে কাজ করা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে বুঝতে পারছিল না দিব্য। আহাম্মকের মত নতুন কোনও ফাঁদে পা দেবে না তো? এমন তো নয়, জয়প্রকাশও এদের দলের? কতটুকুই বা চেনে তাকে? অবশ্য লোকটার কথা শুনে মনে হয় চারুর ওপর বেশ চটে আছে। মিস্টার টোটোর কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা আত্মীয় হবে হয়তো। বকলমে শোধ তুলতে চাইছে।

    চারুর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারলে সব থেকে ভাল হত। রাত্তিরে শুতে যাওয়ার আগে দিব্য একবার শেষ চেষ্টা করল। চারুর নম্বরটা সেভ করাই ছিল, খুঁজে বার করে ডায়াল করল। মোবাইলটা কানে লাগাতেই দিব্যকে অবাক করে দিয়ে চারু ফোন ধরল। দিব্য সোজাসুজি কাজের কথায় এল, জিজ্ঞেস করল, “ভিডিওটা ডিলিট করার জন্য কত টাকা নেবে?”

    চারু যেন আকাশ থেকে পড়ল, “কীসের ভিডিও? কী বলছেন স্যর?”

    দিব্য বলল, “সতীপনা কোরো না। যে ভিডিওটা তুমি পাঠিয়েছ তাতে কিন্তু তোমাকেও স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। ওটা পাবলিক হলে তুমি আর মডেলিং-এর কাজ পাবে ভেবেছ?”

    চারু কেমন স্যাঁতসেঁতে গলায় বলল, “মা কালীর দিব্যি বলছি স্যর, আমি আপনাকে কোনও ভিডিও-টিডিও পাঠাইনি। আমার ফোনটা সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে চালের কৌটোয় ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। কালকেই বার করে চালু করেছি।”

    মেয়েটা মিথ্যে কথা বলতে ওস্তাদ। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। দিব্য প্রসঙ্গ বদলাল, “আচ্ছা বেশ, তুমি পাঠাওনি। একটা কথা বলো তো, সেদিন লোনাবেলায় একা এসেছিলে, না সঙ্গে কেউ ছিল?”

    “কে আর আসবে স্যর? একাই গিয়েছিলাম, স্টেট ট্রান্সপোর্টের বাস ধরে,” চারুর গলাটা যেন বিমর্ষ শোনাল।

    দিব্য ফিরে আবার একই প্রশ্ন করল, “একা? একদম একা?”

    চারু বলল, “এত অবাক হচ্ছেন কেন, স্যর? আমাদের মত মেয়েরা একা একা চলাফেরা করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।”

    দিব্য ছাড়ল না, বলল, “সে না-হয় বুঝলাম। কিন্তু কাউকে কিছু না বলে রিসর্ট থেকে হঠাৎ রফু চক্কর হয়ে গেলে কেন?”

    চারু বলল, “অডিশন হবে না, বসে থেকে কী করব? তাই... দিন না স্যর একটা কাজ। দেখবেন একদম ঠিকঠাক উত্‌রে দেব।”

    দিব্য বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা, দেখছি...”

    এভাবে হবে না, দিব্য ভাবল, মুখোমুখি কথা বলতে হবে, বলল, “আর একদিন দেখা করা যায়? যদি তোমার অসুবিধে না থাকে।”

    চারু যেন লজ্জা পেল। স্খলিত গলায় বলল, “আপনি বললে... কোথায় আসতে হবে স্যর?”

    দিব্য বলল, “জানাচ্ছি পরে।”

    চারু কি ভিডিওটার ব্যাপারে সত্যিই কিছু জানে না? না কি পাতি ভাঁওতা দিল? ফোনটা রেখে দেওয়ার পর দিব্যর মনে হল চারুকে একবার জিজ্ঞেস করলে হত, যে ফোন নম্বর থেকে ভিডিওটা এসেছে সেটা ও চেনে কি না। সে যে সত্যি বলত তার কোনও গ্যারান্টি নেই, তবু... দিব্য একটু দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেল, বুনো হাঁসের পিছনে দৌড়োচ্ছে না তো? হয়তো অফিসের কেউ... ঈর্ষাকাতর কোনও সহকর্মী রিসর্টের ঘরে ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কে জানত চারু ওইদিন ঘরে আসবে, দিব্য বেসামাল হয়ে পড়বে... সমাপতনের একটা সীমা আছে। দেখা না হলে বোঝা মুশকিল মেয়েটা সত্যি বলছে না মিথ্যে।

    চারুর সঙ্গে সময় নিয়ে বসা দরকার। মুম্বাইয়ের চহল-বহলে সমস্যাটার সমাধান হবে না। ভাণ্ডারদারায় দিব্যর কলেজের বন্ধু রোহনের একটা বাংলো আছে। ওর বাবা বানিয়েছিল, এখন কেয়ার টেকারই সামলায়। মুম্বাই থেকে খুব দূরে নয়, জায়গাটা সুন্দর, আর্থার লেকের ধার ঘেঁষে ছোট্ট জনবসতি। যাওয়ার পথে বারি বলে একটা গ্রাম পড়ে, সেখানে ক্যাম্প করে মহারাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কলসুবাই ট্রেক করা যায়। কলেজে পড়ার সময় ওরা অনেকবার দলবেঁধে রোহনদের বাংলোয় গেছে। ট্রেক করে ফিরে এসে রাত জেগে হইচই, মৌজ-মস্তি করেছে। দিব্য ভাবল, চারুকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেলে কেমন হয়? বাংলোটা খালিই পড়ে থাকে, রোহন একদিন বলছিল কথায় কথায়। চারু তো এক পা বাড়িয়েই বসে আছে। গাড়িতে তিন-সাড়ে-তিন ঘন্টা, ব্রেকফাস্ট করে বেরোলেও বেলাবেলি পৌঁছে যাবে। চারুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওর ফোন থেকে ভিডিওটা মুছে ফেলা জরুরি, অবশ্য যদি ভিডিওটা চারুই পাঠিয়ে থাকে। তেমন দরকার পড়লে রাতটাও কাটিয়ে আসা যাবে। চারু মনে হয় না আপত্তি করবে। বদলে দু’-একটা কমার্শিয়াল। চারু চালাক-চতুর মেয়ে, একটু শিখিয়ে-পড়িয়ে নিলে ম্যানেজ করে দেবে।

    পরের দিন অফিস থেকেই রোহনকে ফোন করল দিব্য। রোহন বলল, কেয়ার টেকার ভালেরাও ছেলে-বৌ নিয়ে গ্যারেজে থাকে, বাংলোটা খালি-ফুকট তালাবন্ধ পড়ে থাকে। সপ্তাহে একদিন কেয়ার টেকারের বৌ ঘরগুলো খুলে ঝাড়পোঁছ করে। দিব্য গেলে রান্নাবান্না করে দেবে, অসুবিধে হবে না। একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, একাই যাচ্ছিস না সঙ্গে কোনও চিকনি চামেলিকে নিয়ে যাচ্ছিস? দিব্য একটু হেসে বলল, নেক্সট উইকেন্ডে যাব। দেখি তার মধ্যে কাউকে যোগাড় করতে পারি কি না। রোহন বলল, ভাই, বিন্দাস চলে যা। আমি ভালেরাওকে বলে রাখব।

    শুভস্য শীঘ্রম! ব্যাপারটার যত তাড়াতাড়ি ফয়সালা করা যায় ততই ভাল। পরের শনিবারই চারুকে ডাকবে বলে ফোন করতে যাচ্ছিল, লোকটার ফোন এল। বলল, “স্যর, আপনাকে একটা কথা সেদিন বলব বলব করেও বলা হয়নি। চারুর প্রথম স্বামী শুনলাম, মাস খানেক আগে পাগলাগারদ থেকে ছাড়া পেয়েছে। অবশ্য তারপর সে কোথায় উধাও হয়ে গেছে সে খবর কেউ রাখে না।”

    দিব্যর একটু রাগই হল, সে মরছে নিজের জ্বালায়! আর লোকটা চারুর সাতগুষ্টির গল্প শোনাচ্ছে, বলল, “চারুর প্রথম স্বামীর পাগলামির খবর নিয়ে আমি কী করব?”

    “না, মানে লোকটা একটু রগচটা, পাষণ্ড গোছের,” লোকটা একটু বিব্রত হয়েই বলল, “চারুর সঙ্গে আপনাকে দেখলে চড়াও হতে পারে। খেয়াল রাখবেন,” একটু থেমে যোগ করল, “চারুর ঠোঁটের ওপর একটা কাটা দাগ আছে দেখবেন। একবার ঘুঁষি মেরে মুখ ফাটিয়ে দিয়েছিল। সে এক ভয়ঙ্কর রক্তারক্তি কাণ্ড!”

    শুরুর থেকে লোকটা আনসান কথা বলে ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে। দিব্য ভাবল লোকটাকে আর প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। কাটিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, “ঠিক আছে, আপনাকে আর ভাবতে হবে না। চারুর সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। ও দেখা করতে রাজি হয়েছে।”

    লোকটা খুশি হয়ে বলল, “বাঃ! সে তো ভাল কথা। তবে একটা কথা স্যর। চারুর সঙ্গে কখন কোথায় দেখা করবেন, আগে থেকে কাউকে জানাবেন না। এমনকি চারুকেও নয়। জিজ্ঞেস করলেও মুখ খুলবেন না। আগে শুনতাম দেওয়ালের কান আছে, এখন চোখও ফুটেছে। কোথা থেকে কোথায় খবর পাচার হয়ে যাবে আপনি টেরও পাবেন না। পরে দেখবেন বিলকুল সব কথাবার্তা, কাজকর্ম রেকর্ড হয়ে গেছে।”

    দিব্য চুপ করে রইল। লোকটাকে ক্ষতিকর মনে হয় না। বরং সদুপদেশই দেয়। কিন্তু নাম-ধাম-পরিচয় জানাতে তার কীসের এত আপত্তি কে জানে! লোকটা বিনীত গলায় বলল, “আচ্ছা স্যর, রাখি এখন। দুশ্চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”




    শনিবার ন’টা নাগাদ আরসিএফ-এর এক নম্বর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল চারুর। দিব্য পৌঁছে দেখল, কেউ নেই। বন্ধ গেটের ভিতরে বসে দুটো সিকিউরিটি হাই তুলছে। গাড়ি থামিয়ে মোবাইল চেক করল দিব্য, চারু কোনও মেসেজ দিয়েছে কি না। নাহ! অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। চারু এল হুড়তে-পুড়তে মিনিট দশেক পরে। গাড়িতে উঠে বলল, “সরি স্যর, একটু দেরি হয়ে গেল। সকালে উঠে দেখলাম মেয়েটার গা গসগস করছে... আজ একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন স্যর।”

    আগে দেখেনি, দিব্য নজর করে দেখল চারুর ঠোঁটের ওপর সত্যিই একটা কাটা দাগ আছে, বলল, “পৌঁছোই তো আগে, তারপর ফেরার কথা।”

    ইউ টার্ন নিয়ে ফ্রি-ওয়ের নিচে দিয়ে এসে ইস্টার্ন এক্সপ্রেস হাইওয়ে ধরল দিব্য। চারু বলল, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন স্যর?”

    দিব্য হাসল, “গেলেই দেখতে পাবে। এত সুন্দর জায়গা, তখন আর ফিরতে ইচ্ছা করবে না।”

    চারু গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অনুনয়ের সুরে বলল, “মেয়েটার শরীর খারাপ, একা আছে... তাই বলছিলাম।”

    দিব্য জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাড়িতে আর কেউ নেই?”

    চারু ঘাড় নাড়ল, “নাহ...”

    “তোমার হাজব্যান্ড?” দিব্য ইচ্ছা করেই টোকা দিল। চারু বলল, “সে কলকাতায় থাকে, আমরা সেপারেটেড...”

    চা খাওয়ার জন্য সাহাপুরে একটা ধাবায় গাড়ি থমিয়েছিল দিব্য, মিনিট দশেকের জন্য। তারপর একটানা ড্রাইভ করে ইগতপুরি পেরিয়ে, হাইওয়ে ছেড়ে, আম্বেওয়াড়ি ফাটা থেকে যখন ডানদিকে বাঁক নিল, ঘড়ির কাঁটা সাড়ে-বারো ছুঁই-ছুঁই। ভান্ডারদারা আর বড়জোর আধঘন্টা। কাসারা থেকে বৃষ্টি পিছু নিয়েছে। মাঝেমাঝেই এক পশলা এসে গাছ, পাথর, দূরের পাহাড়গুলোকে ঝাপ্‌সা করে দিচ্ছে। এখন অবশ্য রোদ উঠেছে, চারু মুগ্ধ হয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে। এই রাস্তায় কিছু না-হোক বার দশেক গাড়ি নিয়ে এসেছে দিব্য। আপাতত প্রকৃতির শোভা দর্শন করার মত মানসিক অবস্থা নেই। মাথায় ভিডিওর কথাটাই ঘুরছে। মিনিট দশেক লাগবে বাংলোয় পৌঁছোতে। রোহনদের বাংলোটা একদম লেকের ওপর, নার্সিসাসের মত সারাদিন ঝুঁকে পড়ে জলে নিজের মুখ দেখে। দিব্য ভাবল, ভালেরাওয়ের যত্নআত্তির ঠেলায় আসল কাজটা সারতে না দেরি হয়ে যায়। তার চেয়ে বরং রাস্তায় কোথাও গাড়ি দাঁড় করিয়ে চারুর সঙ্গে কথা সেরে নেওয়া ভাল।

    লোকটাও বলেছিল উদ্ঘট কোথাও যেতে, পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই। এই অঞ্চলে আগে এতবার এসেছে, জায়গাটা হাতের পাতার মত চেনা। গতিবেগ কমিয়ে গাড়িটা একটা এবড়োখেবড়ো ইট বার করা সরু রাস্তায় ঢুকিয়ে দিল দিব্য। গাছপালার পাশ কাটিয়ে রাস্তাটা লেকের দিকে যায়, যদিও লেকটা অনেকটা নিচে। একটা খোলা জায়গা আছে ঘাস আর আগাছায় ঢাকা। কিনারে গিয়ে ঝুঁকে দেখলে কুড়ি-পঁচিশ ফুট নিচে জল দেখা যায়। কিন্তু পৌঁছে হতাশ হল। মনে হল কোনও কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে। ট্যুরিস্ট টানার জন্য তালুকা থেকে পার্ক-টার্ক বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে। গোটা পাঁচ-ছয় গাছ মুড়িয়ে কাটা। এক পাশে মাটি, পাথর খুঁড়ে তাগাড় করে রাখা। তার ওপর জিপের টায়ারের আলপনা। একটা জেসিবি হলুদ হাত বাড়িয়ে ভিখিরির মত কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য লোকজন নেই। হয়তো সবাই লাঞ্চে গেছে, একটু পরেই ফিরে আসবে। কতক্ষণ আর লাগবে? দিব্য গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করল। চারু অবাক হয়ে বলল, “এখানে কী?”

    দিব্য বলল, “চারু, শোনো, আমরা ঠিক করেছি, একটা কস্মেটিক কোম্পানির বিজ্ঞাপনে তোমাকে কাস্ট করব। দু’-এক দিনের মধ্যেই শ্যুটিং শুরু হবে। পয়সা-কড়ি খুব আহামরি কিছু না হলেও, কম নয়...”

    শুনতে শুনতে চারু উৎফুল্ল হয়ে উঠছিল। উজ্জ্বল চোখে দিব্যর দিকে তাকিয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যর, আমি ভাবতেই পারছি না... কী করে যে আপনার ঋণ শোধ করব?” বলতে বলতে দিব্যর কাছে সরে এসে ওর উরুর ওপর হাত রাখল।

    দিব্য ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার ফোনে যে ভিডিওটা আছে ওটা কিন্তু ডিলিট করে দিতে হবে। অন্য কোথাও কপি-টপি রাখোনি তো?”

    চারুর মুখ ম্লান হল, বলল, “আমি তো আগেই আপনাকে বলেছিলাম, স্যর। ভিডিওটা আমি বানাইনি, পাঠাইওনি। আপনি বিশ্বাস করুন স্যর, আমিও আপনার মতই অন্য কারো কাছ থেকে পেয়েছি। এই দেখুন...”

    দিব্যর মনে হল দোষ ঢাকতে চারু আষাঢ়ে গল্প বানাচ্ছে। অন্য কারো কাছ থেকে পেয়েছে না কাঁচকলা। হয়তো নিজেই আর একটা সিম থেকে নিজেকে পোস্ট করেছে। এখন মডেলিং করার আশ্বাস পেয়ে সাধু সাজছে। চারু লক খুলে নিজের মোবাইলটা দিব্যর দিকে এগিয়ে দিল। সস্তার মোবাইল, দিব্য ভিডিওটা খুঁজছিল, ঠিক সেই সময় মাটি কেঁপে উঠল। শব্দ পেল, কেউ জেসিবিটা চালু করল। লেবাররা কি ফিরে এল? এত তাড়াতাড়ি? দিব্য চারুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় সেভ করে রেখেছ? কোন ফোল্ডারে? জলদি বলো।”

    শব্দটা বাড়ছে, মাটির কাঁপনও। চারু হাত বাড়াল, “আমায় দিন, বার করে দিচ্ছি...”

    ফোনটা চারুর হাতে দিয়ে দিব্য রিয়ার ভিউ মিরর দেখল। হলুদ দানবের মত জেসিবিটা ওদের সেডানটার দিকে এগিয়ে আসছে। ব্যাপারটা কী? চারুও শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়ির পিছনের জানলার কাচের মধ্যে দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল। জেসিবিটা প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে বলা চলে। চারু হঠাৎ তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল। মনে হল জেসিবির মাথায় চড়া লোকটাকে চিনতে পারল। দিব্য দেখল আতঙ্কে চারুর মুখ রক্তহীন হয়ে গেছে। কে লোকটা? ত্রিসীমানায় আর আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তার মানে লেবারদের কেউ নয়। লোকটা সম্ভবত মুম্বাই থেকেই ওদের ফলো করে এসেছে, দিব্য একটা গাড়োল, বুঝতে পারেনি। এই নির্জন জায়গাটাতেও চুপিসারে ওদের পিছনে পিছনে এসে উপস্থিত হয়েছে। লোকটার মতলব ভাল ঠেকছে না। লোকটা কি জেসিবি দিয়ে ওদের পিষে দিতে চায় নাকি? ওদের মারতে চায়? কিন্তু কেন? বিদ্যুৎ চমকের মত দিব্যর মনে হল যে লোকটা দিব্যকে বারবার ফোন করত এ লোক সেই লোক। চারুর ওপর রাগ ছিলই। দিব্য চারুর সঙ্গে রয়েছে বলে দিব্যকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চায়... দিব্যর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নামল।

    জেসিবিটা এসে গাড়ির পিছনে ধাক্কা দিল। ধাতুর সঙ্গে ধাতুর সংঘাতে বিকট একটা শব্দ হল। ভয়ে হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছিল, কী করবে বুঝতে পারছিল না দিব্য। গাড়ি ঘুরিয়ে জেসিবিটাকে এড়িয়ে যাওয়ার মত জায়গা নেই সামনে। তবু চেষ্টা করাই যেতে পারে। হাত কাঁপছিল, চাবি ঘুরিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিতে গেল। মুহূর্ত সময়ে ইঞ্জিনটা বিশ্বাসঘাতকতা করল। একবার কেশে উঠে চুপ করে গেল। দ্বিতীয়বার চাবি ঘোরানোর সময় নেই, ততক্ষণে জেসিবি উল্টো হাতে গাড়িটাকে ঠেলতে শুরু করেছে। দিব্য প্রাণপণে হ্যান্ডব্রেকে টান দিল। গাড়িটা হেঁচকি তুলে দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেসিবির ঠেলা সামলাতে পারল না। ঘসটাতে ঘসটাতে খাদের দিকে এগিয়ে চলল। দরজা খুলে লাফিয়ে পড়ে যদি রেহাই পাওয়া যায়! দিব্য নিজের দিকের দরজাটা খুলতে চেষ্টা করল। ভাগ্য বিরূপ হলে যা হয়, একটা অর্ধেক কাটা গাছের গুঁড়িতে দরজাটা আটকে গেল। ঠিক তখনই মোক্ষম মারটা এসে পড়ল। গাড়িটা ওদের দুজনকে পেটে নিয়ে গোঁত্তা মেরে লেকের জলে গিয়ে পড়ল। তখনই বৃষ্টি নামল।


    *

    লোকটা জেসিবি থেকে নেমে এল। বৃষ্টির একটা চাদর লেকের ওপর দিয়ে উড়ে এসে লোকটার শরীর জড়িয়ে ধরল। আঃ, কী আরাম! কোমরে হাত দিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখল গাড়িটা আস্তে আস্তে জলের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। হৃষ্ট হয়ে হাতে হাত ঘষল। যাক একটা বড় কাজ শেষ হল। দৈবাদিষ্ট না হলে এসব কাজ সম্পূর্ণ করা যায় না। আগের বার যেমন লোনাবেলা গিয়েছিল, এবারও তেমনই মোটরবাইকে দিব্যদের গাড়িটার পিছু ধাওয়া করে এখানে পৌঁছে গিয়েছিল। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু আসার সময় ভাবেনি এত সহজে কার্যোদ্ধার হবে। লোনাবেলায় রিসর্টের লোকগুলোকে পটাতে তবু কিছু খর্চাপাতি হয়েছিল। এবার আর সেসবের দরকার পড়েনি। এসে দেখেছিল, চারিদিক শুনশান, চারুদের গাড়িটা খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে আর জেসিবির চাবিটা জায়গা মত ঝুলছে। সব কিছুই যেন পূর্বনির্দিষ্ট। লেবারগুলো হয়তো কাছাকাছিই কোথাও গেছে। এখুনি ফিরে আসবে। ওদের ফিরে আসার আগেই চুপচাপ কেটে পড়তে হবে। জলের গভীর থেকে উঠে আসা বুদবুদগুলোর দিকে আর একবার তাকাল। ছেলেটার জন্য একটু কষ্ট হল। এনিওয়েজ, কোল্যাটারাল ড্যামেজ। কিছু করার নেই।

    এবার মিস্টার টোটোর পালা। ঠোঁটের কোণে একটা হাসি এসে মিলিয়ে গেল, নামটা মন্দ দেয়নি ছোকরা, মিস্টার টোটো! হঠাৎ যেন কিছু মনে পড়ল। উদ্বিগ্ন হয়ে কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকাল। বৃষ্টি-বাদল বুক দিয়ে ঠেলে সন্ধের মধ্যে ফিরতে হবে। গোভান্ডির চ্বলে জ্বরো মেয়েটা একলা রয়েছে, কী খেল-দেল কে জানে? মেয়েটার মুখটা যেন মায়ায় জড়ানো। চ্বলের মানুষ হামেশা সদর দরজা খুলেই রাখে। এক ঘরের মধ্যে নইলে দম বন্ধ হয়ে আসে। লোকগুলোও মিশুকে। অচেনা লোকের সঙ্গেও বন্ধুত্ব পাতাতে সময় নেয় না। এ-ঘর ও-ঘর আনাগোনাতেও তেমন বিধিনিষেধ নেই। চারু যখন বাড়িতে থাকত না মাঝেমাঝে গিয়ে মেয়েটাকে দেখে আসত। যত বড় হচ্ছে ততই তার মুখের আদল স্পষ্ট হচ্ছে। কথায় বলে পিতৃমুখী মেয়েরা সুখি হয়। ওর মেয়েও জীবনে খুব সুখি হবে। ও জানে। পাগলরা প্রায়শই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হয়।



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments