‘দেশে বিদেশে’-র পটভূমি প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্থান। ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালার সূত্রে আফগানিস্থানের নান্দীমুখ হয়ে গেছে বাংলা সাহিত্যে। মিনির পিতার সঙ্গে রহমতের প্রথম আলাপের বর্ণনায় তিনি লিখছেন “…তাহার পর পাঁচটা কথা আসিয়া পড়িল। আবদর রহমান, রুস ইংরেজ প্রভৃতিকে লইয়া সীমান্তরক্ষানীতি সম্বন্ধে গল্প চলিতে লাগিল।” কলকাতার পথঘাটে বিশালাকৃতি জোব্বা পরিহিত এই আফগানি মানুষগুলিকে কাবুলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে দেওয়াটাই সেসময়ে বাঙালির পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। বস্তুত, বাঙালি মাত্রই ভারতীয়, কিন্তু ভারতীয় মানেই বাঙালি নয় – এই সারসত্যটি আফগানিস্থান আর কাবুলিওয়ালার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য, তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল আলীসাহেবের কলমের কালির। আর গড়পড়তার বাইরে কিছু বাঙালির কাছে আফগানিস্থানকে কেন্দ্র করে রাশিয়া আর ইংরেজদের ক্ষমতার দাবাখেলা, ইতিহাসে যা ‘The Great Game’ নামে প্রসিদ্ধ, তার ছায়া ছায়া অবয়ব হয়ত চেনার বৃত্তে প্রবেশ করেছিল। তবে কায়াটুকু সহজলভ্য ছিল না। শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের মত বিশ্বনাগরিকের পক্ষেই সেদিন সম্ভব ছিল সে দাবাখেলার চালের বিশ্লেষণ ও আলোচনা করা। এরই প্রতিফলন কাবুলিওয়ালা গল্পের উপরোক্ত বাক্য। অবশ্য এখানে মনে রাখা দরকার যে সময়টা ১৮৯২ সাল, যখন বিদেশের খবর নামের বস্তুটি মহার্ঘ এবং বাস্তবিকই অমিল।
দেশে বিদেশের প্রকাশকাল ১৯৪৮ হলেও বিষয়বস্তু তেইশ বছরের যুবক মুজতবা আলীর দৃষ্টিতে দেখা ১৯২৭ থেকে ১৯২৯এর আফগানিস্থান। শান্তিনিকেতনের পাঠ শেষ করতেই তিনি সরকারি ডাক পেয়েছেন আফগানিস্থানের ‘কাবুল কৃষি কলেজ’-এ ফার্সি আর ইংরেজি ভাষাশিক্ষাদানের। অল্পদিনের অবস্থানেই তাঁর জার্মান ভাষায় ব্যুৎপত্তির খবর রাষ্ট্র হয়, তাতে সে ভাষা পড়ানোর দায়ভারও চাপে তাঁর কাঁধে। আফগানিস্থানের সেটা অনেকটা ভালো আর কিছু মন্দয় মেশানো সময় – আমানুল্লা খানের প্রগতির রথ কিছু আপরিণত আতিশয্য সত্ত্বেও অপ্রতিহত চলছে কাবুলের রাজপথে। তবে ওই স্বল্প সময়ের পরিসরেই সে রথের চাকার ভূমিশয্যা নেওয়ার ট্র্যাজেডিরও সাক্ষী থেকেছেন ওই যুবক।
কালক্রমে এর প্রায় কুড়ি বছর পরে যে মুজতবা আলী তার বর্ণনা লিখতে বসছেন, তিনি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট, মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নেওয়া সুপণ্ডিত, যাঁর জিভ ও কলমের দখলে অন্তত ১৮টি ভাষা, গীতা থেকে গীতবিতান যাঁর কণ্ঠস্থ। এই জ্ঞানার্জনের পরিণত প্রজ্ঞায় উদ্ভাসিত দেশে বিদেশের আফগানি ইতিবৃত্ত। ওই দেড় বছরের অবস্থানের বাইরে পরবর্তী বিশ বছরে অবলোকন করা সে দেশের ইতিহাস, তার জাতিসত্তার সংঘর্ষ ও নির্মাণ, তার রাজনৈতিক একাকীত্ব ও নির্বাসন, এসবই আবছায়া চালচিত্রের ভূমিকা পালন করে গেছে দেশে বিদেশে নামের প্রতিমাটি নির্মাণে। তাই ওই দেড় বছরে দেখা আফগানিস্থান সময়ের সীমা অতিক্রম করে আজও প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। আজকে দেশে বিদেশে নিয়ে আলোচনার এটাই যৌক্তিকতা।
কলকাতা থেকে কাবুলমুখী যাত্রা দিয়ে এ বইয়ের চলা শুরু। আর শুরু থেকেই মনুষ্যচরিত্র বিশ্লেষণ তার অঙ্গ। ট্রেনের কামরায় ফিরিঙ্গি সহযাত্রী তাকে প্রশ্ন করে - ‘গোয়িং ফার?’ উত্তরে ইচ্ছে করলে গন্তব্যের গোপনীয়তা বজায় রেখেও না বা হ্যাঁ বলে তার আভাস দেওয়া যায়। ইউরোপীয় এটিকেট সদ্য পরিচিতকে আজকের ভাষায় ‘স্পেস দেয়’। বলতে চাইলে ঠিক আছে, না বললেও আপত্তি নেই। পক্ষান্তরে ট্রেন যখন পশ্চিম ভারতের রুখু প্রান্তরে, যখন
“… দাড়ি লম্বা হয়েছে, টিকি খাটো হয়েছে, নাদুসনুদুস লালাজিদের মিষ্টি মিষ্টি ‘আইয়ে, বৈঠিয়ে’ আর শোনা যায় না। এখন ছ-ফুট লম্বা পাঠানদের ‘দাগা দাগা, দিলতা রাওড়া’, পাঞ্জাবিদের ‘তুসি, অসি’ আর শিখ সর্দারজিদের জালবদ্ধ দাড়ির হরেক রকম বাহার।” - তখন বিনিময়ের মাত্রা অন্য স্বরলিপিতে বাঁধা পড়ে।এরা মনের ছবি ছাতিতে লটকে রাখে, সদ্যপরিচিতের সঙ্গে বুকে বুক ঠেকানো বন্ধুত্ব পাতায় এক লহমায়। সুতরাং তার হাল হক্কিকতের খবর তার দায়িত্ব আর অধিকারের আওতাতেই তো পড়ে। শিখ সর্দারজি তাই গোয়িং ফার নয়, সিধে প্রশ্ন ছোঁড়েন ‘কাঁহা জাইয়েগা?’ ছ-ফুটি পাঠান সঙ্গীদের উচ্চগ্রাম আলাপে পশ্চিমের খর-বৈশাখ সজল হয়ে ওঠে। তাতে সারজলের জোগান দেয় অপর্যাপ্ত খাবারের সরবরাহ।
প্রতি স্টেশনে আড্ডার কেউ না কেউ কিছু না কিছু কিনবেই। চা, শরবৎ, বরফজল, কাবাব, রুটি, কোন জিনিসই বাদ পড়ল না। কে দাম দেয়, কে খায় কিচ্ছু বোঝবার উপায় নেই। আমি দু-একবার আমার হিস্যা দেবার চেষ্টা করে হার মানলুম। বারোজন তাগড়া পাঠানের তির্যকবূহ্য ভেদ করে দরজায় পৌঁছবার বহু পূর্বেই কেউ না কেউ পয়সা দিয়ে ফেলেছে।
কালক্রমে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন পাঠান মেহমানদারি করতে পারলে আর কিছু চায় না, বিশেষত অতিথি যদি হয় তাঁর মত সাড়ে পাঁচ ফুটি বিদেশী।
এ হেন পাঠানদের যখন আধা-ইনসান তকমা দিলেন সর্দারজি, বিশেষত সঙ্গী আফগান বেতারকর্তার সাক্ষাতে তখন আলীসাহেব শঙ্কিত হয়েছিলেন এইবার একটা রক্তাক্ত হেস্তনেস্তর সূচনা হল বলে। কে না জানে আফগানিস্থানের পুরুষদের কাছে রাইফেল স্ত্রীর চেয়েও প্রিয়। এই বুঝি তার ইস্তেমাল হবে, দু-দশটা গুলি ছুটে একটা দুটো লাশ পড়বে। কিন্তু তেমন কিছু না ঘটাতে সর্দারজিকে জিজ্ঞেস করে জানলেন ইনি পাঠান নন, কাবুলি। বিস্ফারিত দৃষ্টি, আফগানিস্থানের সদর দরজায় সদ্য পা রাখা আলীসাহেবের পাঠান কাবুলির অভিন্নতার ধারণা নস্যাৎ করে সর্দারজি তখন খোলসা করেন রহস্য। পাঠান আফগানিস্থানের অধিবাসী, তাদের মাতৃভাষা পশতু। আর খাস কাবুলের অধিবাসি কাবুলিদের উৎস ইরান দেশ, মাতৃভাষা ফারসি। এরা সচরাচর কাবুলের সীমানা পেরোন না। বিহ্বল আলীসাহেব প্রশ্ন করেন
আমি বললুম, ‘তা না হয় বুঝলুম, কিন্তু কলকাতার কাবুলিওয়ালারা তো ফারসি বোঝে না।’
‘তার কারণ কলকাতার কাবুলিরা কাবুলের লোক নয়। তারা সীমান্ত, খাইবার বড়োজোর চমন কান্দাহারের বাসিন্দা। খাস কাবুলি পারতপক্ষে কাবুল শহরের সীমানার বাইরে যায় না। যে দু-দশজন যায়, তারা সদাগর। তাদেরও পাল্লা ওই পেশোয়ার অবধি।
আফগানিস্তানে পাঁচটি বড় শহর – কাবুল, হিরাত, গজনি, জলালাবাদ আর কান্দাহার। এদের কেন্দ্র করে এক এক জনজাতির বাস, তাদের ভাষা সংস্কৃতি জীবন যাপনের দিনলিপি আলাদা আলাদা অক্ষরে লেখা। এর বাইরে আফ্রিদি, শিনওয়ারি, খুগিয়ানি, এরকম অসংখ্য নানা ছোটবড় উপজাতির বাস। সেই বৈচিত্রের কি বাহারি বর্ণনা আলীসাহেবের কলমে –
মাস খানেক ঘোরাঘুরি করুন যে-কোনো সরাইয়ে – ডজনখানেক ভাষা বিনা কসরতে বিনা মেহনতে শেখা হয়ে যাবে। পশতু দিয়ে আরম্ভ করুন, চট করে চলে যাবেন ফারসিতে, তারপর জগতাইতুর্কি, মঙ্গোল, উসমানলি, রাশান, কুর্দি – বাকিগুলো আপনা থেকে হয়ে যাবে।
স্থান বদলের সঙ্গে তার অধিবাসী বদলায়, বদলায় ভাষা খাদ্য বস্ত্রের চরিত্র। তার রসাল বর্ণনার দীপ্তির একটি নমুনা;
জিজ্ঞেস করলুম, ‘সর্দারজি, শিলওয়ার বানাতে ক-গজ কাপড় লাগে?’বললেন, ‘দিল্লিতে সাড়ে তিন, জলন্ধরে সাড়ে চার, লাহোরে সাড়ে পাঁচ, লালামুসায় সাড়ে ছয়, রাওয়ালপিন্ডিতে সাড়ে সাত, তারপর পেশোয়ারে এক লম্ফে সাড়ে দশ, খাস পাঠানমুল্লুক কোহাট খাইবারে পুরো থান।
সর্দারজির ধারাবিবরণীর বিনোদন মূল্য অসীম। তবে ইতিহাসের এক গূঢ় বিবৃতি লুকিয়ে রয়েছে এই আপাতসরল স্টেটমেন্টে। তা এই, যে দিল্লি জলন্ধর হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে পেশোয়ার বা খাইবার পাশে শিলওয়ারের মতই মসৃণ যাত্রা করেছে হিন্দুস্তানের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্ম, উৎসবের জীবনযাপন। আর উল্টোপথে আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত বখরা করা চার দেশের দৌলতের স্রোত মোহনায় মেশা নদীর মত চারিয়ে গিয়েছে সেদেশ হয়ে ভারতে।
আফগানিস্থানের উত্তর ভাগ অর্থাৎ বল্খ – বদখশানের ইতিহাস তার সীমান্ত নদী আমুদরিয়ার (গ্রিক অক্ষুস, সংস্কৃত বক্ষু) ওপারের তুর্কিস্থানের সঙ্গে, পশ্চিমভাগ অর্থাৎ হিরাত অঞ্চল ইরানের সঙ্গে, পূর্বভাগ অর্থাৎ কাবুল জালালাবাদ খাস ভারতবর্ষ ও কাশ্মীরের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে নানা যুগে নানা রঙ ধরেছে।আফগানিস্থানের অর্বাচীন ইতিহাস নানা ফারসি পাণ্ডুলিপিতে এদেশে ওদেশে, অন্তত চারখানা দেশে ছড়িয়ে পরে আছে। …বাবুরের আত্মজীবনী সঙ্গে নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো ভারতীয় পণ্ডিত…কাবুল, হিন্দুকুশ, বদখশান বল্খ, মৈমানা হিরাতে ঘোরাঘুরি করেননি। কোন আফগান ইতিহাস লেখার শিরঃপীড়া নিয়ে ভারতীয় পণ্ডিত এখনও উদ্ব্যস্ত হননি। অথচ এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, আফগানিস্থানের ইতিহাস না লিখে ভারত-ইতিহাস লেখবার জো নেই, আফগান রাজনীতি না জেনে ভারতের সীমান্ত প্রদেশ ঠান্ডা রাখবার কোনো মধ্যমনারায়ণ নেই।
কবিগুরুর শান্তিনিকেতনের বিশ্ববীক্ষার মন্ত্রে দীক্ষিত সৈয়দ সাহেব সেই দায়ভার স্বীকার করেছেন স্বেচ্ছায়। ইতিহাসের সচেতন সন্ধান করে গেছেন আফগানিস্থানের সাধারণ মানুষ থেকে বিশিষ্টদের মজলিশে। পেশোয়ারে যাঁর বাসায় তাঁর প্রথম আশ্রয়, সেই আহমেদ আলীর আতিথ্যে আফগানিস্থানের ‘মেহেমানদারি’-র পরম্পরার ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে। কাবুলে তাঁর সঙ্গী হন অধ্যাপক বগদানফ - জাতে রুশ, যাঁর বিপুল পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ ডেকে নিয়ে গিয়ে শিক্ষকের সম্মান দেন বিশ্বভারতীতে। রাশিয়ান এম্ব্যাসির সাহিত্যপ্রেমী কর্মী তারিশ দেমিদফ, আত্মভোলা লেখক দোস্ত মুহম্মদ খান এমনতর নানা মানুষের সঙ্গ ও সেরিব্রাল আড্ডার সুবাদে আফগানিস্থানের সমসাময়িক পরিস্থতি-পরিবেশকে অদ্ভুত মুন্সীয়ানায় পেশ করেন লেখক। কিন্তু সে দেশের সদ্য ও দূর অতীতের নিরীক্ষণে আলীসাহেবের পাণ্ডিত্য ও পর্যবেক্ষণের সজল সাক্ষ্য হীরাকুঁচির মত ছড়িয়ে থাকে – যেন কাবুল নদীর সবুজ পাড়ে ঘাসের আগায় সূর্যালোকে বিস্ফারিত জ্বলন্ত শিশিরবিন্দু।
আজকের আফগানিস্থান বাকি পৃথিবীর কাছে এক ভীতিপ্রদ ভূখণ্ড, যেখানে গুলি বন্দুক আর বর্বরতা শাসন করে ভয়াবহ প্রবলতায়। তালিবানি নৈরাজ্য মহিলাদের মানুষ হিসেবে ন্যূনতম মূল্যকে বামিয়ানের বুদ্ধের মতই কামানের গোলায় উড়িয়ে দিয়েছে। পুরুষ সঙ্গী ছাড়া প্রকাশ্য রাস্তায় বেরোনর অপরাধে মহিলার খুলিতে ভরে দেওয়া হচ্ছে পিস্তলের গুলি। শিক্ষাঙ্গন থেকে অফিস কাছারির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে মেয়েদের সামনে। আর এই কবন্ধ মুষলপর্বে সময় এসেছে তার অতীতের আলোকিত ইতিহাসকে স্মরণ করার। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ঋষি হয়ত সে প্রয়োজন মেটাতেই এ বইয়ে রেখেছেন তার বিস্তারিত আখ্যান। আমরা জেনেছি যে আর্যজাতি আফগানিস্থান, খাইবার পাস হয়েই ভারতবর্ষে পৌঁছেছিল – পামির, দারদিস্থান বা পৈশাচভূমি কাশ্মীর হয়ে নয়। বোগাজ কো-ইর আফগানিদের ইহুদি উৎস মিথ হলেও কয়েক ছটাক সত্যির আধার। সিকান্দার শাহের সিন্ধুদেশ জয়ের আগে পর্যন্ত আফগানিস্থান ছিল ইরানি রাজা সায়েরাসের দখলে। গ্রিক অধিকারের পর থেকেই ইতিহাস পরণকথার খোলস ছিঁড়ে তথ্য পরিসংখ্যানের প্রামাণ্য দুনিয়ায় পা রাখে। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানায় বাঁধা পড়ে আরিয়া, আরখোসিয়া, গেদ্রোসিয়া, পারোপানিসোদাই ও দ্রাঙ্গিয়ানা। আজকের নিরিখে তারা যথাক্রমে হিরাত, বল্খ, কাবুল, গজনি ও কান্দাহার প্রদেশ নামে পরিচিত হয়, তাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক রাষ্ট্রপরিচয়ের মালিক হয় সে দেশ।
সিকান্দার শাহের মৃত্যুর পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য উত্তর ভারতের সমস্তটাই দখল করেন। এ প্রক্রিয়ায় হিন্দুকুশের উত্তরের বাল্হিক প্রদেশ ছাড়া সমস্ত আফগানিস্থান ভিন্ন ভৌগোলিক অস্তিত্ব ছাড়াই ভারতবর্ষের সীমানার মধ্যে চলে আসে। এই পর্বে বৌদ্ধ ধর্মের বিপুল প্রচার হয়। পাশাপাশি ভারতীয় কলা ও ভাস্কর্যে লাগে ইরানি ও গ্রিক শৈলীর ছোঁয়া। এরপর গুপ্ত বংশ, শকদের দিন পেরিয়ে কুষাণ যুগের প্রবর্তন। সে যুগের দ্বিতীয় রাজা বিম শক আর ইরানি পারথিয়ানদের হারিয়ে আফগানিস্থান জয় করেন। কনিষ্কের বিস্তৃত সাম্রাজ্যের সীমানা যখন ইরান, কাশগড়, খোটান, ইয়ারকন্দ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, আফগানিস্থান তখন তার অংশমাত্র। পেশোয়ারের বাইরে বুদ্ধের দেহাস্থি রক্ষা করতে স্তূপ নির্মাণ করেন তিনি। বস্তুত কনিষ্ক বৌদ্ধ হবার বহু পূর্বেই আফগানিস্থান তথাগতের শরণাগত হয়েছিল। আর ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডে কুষাণ যুগের অবসান হওয়ার পরেও দুশো বছর আফগানিস্থানে রাজত্ব করেছিল কিদার কুষাণেরা। এই কুষাণযুগের গান্ধার শিল্পের যৌবন ষষ্ঠ শতকের আফগানিস্থান আর তুর্কিস্থানে ছড়িয়ে আছে। তার অনুসন্ধানের কাজ উনিশ বা বিশ শতকের গরিব আফগানিস্থান করতে পারেনি।
প্রাচীন ইতিহাস পোঁতা আছে সে দেশের মাটির তলায়…আফগানিস্থান গরিব দেশ, ইতিহাস গড়বার জন্য মাটি ভাঙবার ফুর্সৎ আফগানের নেই, মাটি যদি সে নিতান্তই খোঁড়ে তবে সে কাবুলি মোন-জো-দড়ো বের করার জন্য নয় – কয়লার খনি পাবার আশায়।
তাই বলে আমরা কেন ভুলে যাব যে হিউয়েন সাঙের দেখা সপ্তম শতাব্দীর কাবুলে বৌদ্ধ আর হিন্দুর আধাআধি হিস্যার গল্প? ভারতের হিন্দুয়ানির নবজীবনের ঢেউ তখন তো কাবুলেও এসে লেগেছিল। এরপর আরব শাসকদের কাল। ৮৭১ সালে ইয়াকুব-বিন-লায়েস কাবুল দখল করেন। ১০২১এ গজনির সুলতান মাহমুদের হাতে শেষ হিন্দু রাজার পরাজয় ও নির্বাসন ঘটে। তবে সেদিন থেকে উনবিংশ শতাব্দি অব্দি দুই দেশ একই ঐতিহ্যের পরম্পরা স্বীকার করে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রেখে দুই দেশের যোগসূত্র অবিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করে গিয়েছিল।
যদি বলা হয় আফগানরা মুসলমান হয়ে গেল বলে তাদের অন্য ইতিহাস তাহলে বলি, তারা একদিন অগ্নি উপাসনা করেছিল, গ্রিক দেবদেবীর পুজা করেছিল, বেদবিরোধী বৌদ্ধধর্মও গ্রহণ করেছিল। তবুও যখন দুই দেশের ইতিহাস পৃথক করা যায় না, তখন তাদের মুসলমান হওয়াতেই হঠাৎ কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল? বুদ্ধের শরণ নিয়ে কাবুলি যখন মগধবাসী হয়নি তখন ইসলাম গ্রহণ করে সে আরবও হয়ে যায়নি।
এই সুলতান মাহমুদের সভাপণ্ডিত, পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ছয়জন পণ্ডিতের একজন আল-বিরুনী সংস্কৃত শিখে হিন্দু ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞান কাব্য কলা আত্মস্থ করে বিরাট গ্রন্থ তহকীক-ই-হিন্দ লিখেছিলেন। প্রত্যুত্তরে কোন ভারতীয় তার আফগান সংস্করণ লিখে যাননি।
তৈমুরের রাজত্বের কালো দিকে আলো ফেলেছে ইউরোপের ইতিহাসকারেরা। কেউ বলেনি তাঁর পুত্র শাহ-রুখ চিন থেকে শিল্পী আনিয়ে ইরানিদের সঙ্গে মিলিয়ে চারুকলার নব্য ধারা প্রবর্তন করেন। তাঁর পুত্রবধু গৌহর শাদ শিক্ষাদীক্ষায় রানী এলিজাবেথ বা ক্যাথারিনের চেয়ে কোন অংশে কম ছিলেন না। তাঁর নিজের অর্থে গড়া মসজিদ মাদ্রাসা দেখে চোখ ফেরাতে পারেন নি তৈমুরের প্রপৌত্র বাবর। ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের পত্তনকারির সম্পর্কে আলীসাহেবের মূল্যায়ন:
শ্বেতাঙ্গ পণ্ডিতের নির্লজ্জ জাত্যাভিমানের চূড়ান্ত প্রকাশ হয় যখন সে বাবুরের আত্মজীবনী অপেক্ষা জুলিয়াস সীজারের আত্মজীবনীর বেশি প্রশংসা করে।…আফগানিস্থান ভ্রমণে যাওয়ার সময় একখানা বই সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই যথেষ্ট – সে বই বাবুরের আত্মজীবনী। বাবুর কান্দাহার গজনি কাবুল হিরাতের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে আজকের আফগানিস্থানের বিশেষ তফাৎ নেই।
অতীতের সে সোনালি দিনকে লিপিনগরের কুঠুরিতে গুছিয়ে তুলতে যে বিদ্যাভ্যাসের অনুশীলনের প্রয়োজন, তার আয়োজন ক্রমেই ক্ষীণ হয়েছে যুদ্ধবিগ্রহের ক্রমবর্ধমান প্রকোপে। প্রতিকূল প্রকৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপজাতিদের মধ্যে যোগাযোগের রাস্তা তৈরিতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আপন বিশ্বাস ও সংস্কারে আবদ্ধ থেকে নিজের নিজের গণ্ডিতে আলাদা আলাদা আফগানিস্থান বানিয়ে ফেলেছে এক একটি উপজাতি। বন্দুকের নলেই তাদের বিনিময় সীমাবদ্ধ থেকে গেছে বেশিরভাগ সময়।
আফগানিস্থানের গরিবীয়ানা তার জাগতিক উন্নতিরই অন্তরায় হয়নি শুধু, তার সুপ্ত মেধাসম্পদের উদ্বোধন ঘটাতে যে বৌদ্ধিক পরিকাঠামো প্রয়োজন, তাকেও গড়ে তুলতে পারেনি। দেশের কোণে কোণে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি, তাই আসেনি চেতনা। আগাছায় ভরা বাগানে ইতিউতি কটি গোলাপ কি নারগিস ফুটেছে, কিন্তু সাধারণ জনগণ, বিশেষত উপজাতি সম্প্রদায় যারা আফগান জনসমষ্টির মেরুদণ্ডস্বরূপ, তারা রয়ে গেছে মোল্লাতন্ত্রের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যে সম্পৃক্ত। নারীকে অর্ধেক আকাশের মর্যাদা দেবার বোধ থেকে তারা রয়ে গেছে শতহস্ত দূরে। তাই আমানুল্লা খানের সংস্কারের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে মোল্লাতন্ত্রের উস্কানি এতটাই সফল হয়েছিল, যে সেই প্রতিক্রিয়া শেষ হয় তাঁর উৎখাতে। অথচ ততদিনে ১৯১৭র রুশ বিপ্লব সমাপ্ত হয়েছে, এ দেশে ১৯২৫এ নজরুল লিখে ফেলেছেন ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ তফাত রয়ে গেছে শিক্ষায়, চেতনায়, দর্শনে। মার্ক্সের সাম্যের শিক্ষা ভিত রচনা করেছে রুশ বিপ্লব ও বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার। তাই রাশিয়ায় সাধারণের জীবনযাপনের পাঠে সমতার রাজনীতির অধ্যায়টি অন্তর্গত হয়ে গেছে সহজেই, যার প্রতিফলন দেখা গেছে কাবুলের রুশ এম্ব্যাসির কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্কের চর্চায়।
আমি কম্যুনিজমের কিছুই জানিনে, এঁদের কথা বলার ধরন, অবিশ্বাসী এবং অজ্ঞের প্রতি সহিষ্ণুতা, আপন আদর্শে দৃঢ়বিশ্বাস আমাকে সত্যই মুগ্ধ করল।কিন্তু সবচেয়ে মুগ্ধ করল রাজদূতাবাসের ভিতর এঁদের সামাজিক জীবন। অন্যান্য রাজদূতাবাসে বড়োকর্তা, মেজোকর্তা ও ভদ্রেতরজনে তফাৎ যেন গৌরী শঙ্কর, দুমকা পাহাড় আর উইয়ের ঢিপিতে। এখানে যে কোনো তফাৎ নেই, সে কথা বলার উদ্দেশ্য আমার নয়, কিন্তু সে পার্থক্য কখনো রূঢ় কর্কশরূপে আমার চোখে ধরা দেয়নি।
তাই রুশ বিপ্লবের অভিমুখ প্রগতির সুরে বাঁধা।
পক্ষান্তরে আমানুল্লার সংস্কার যেন শেকড়ে টান না দিয়ে বৃক্ষের শাখাপ্রশাখায় টুনি বাল্বের আরোপিত সজ্জার আয়োজন। সবার জন্য শিক্ষা, রাস্তা তৈরি, নিজস্ব পরিবহণ ব্যবস্থার পত্তন, বিজ্ঞানচর্চাকে সমসাময়িক করে তোলা ইত্যাদির আন্তরিক ইচ্ছের জন্য ইতিহাস তাঁকে স্মরণে রাখবে। এও ঠিক যে ইউরোপের সঙ্গে পরিচয় তাঁকে জীবনের অন্য মাত্রাটি বুঝতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু নতুন ফসলের জন্য মাটিকে তার উপযোগী করে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় তিনি আস্থা রাখেন নি। তাই ফাঁকি রয়ে গেল রূপায়নের পরিকল্পনায়। পরিবর্তনকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করতে বাইরের সংস্কারে জোর পড়ল বেশি। ইউরোপের যা কিছু বাহ্যিক, তার হাস্যকর অনুকরণ আপামর জনগণের কাছে তাঁর সংস্কারের প্রয়োজনকে যুক্তিসিদ্ধ বিশ্বাসযোগ্যতায় পৌঁছে দিতে পারল না। আফগান পুরুষকে তার আজন্মলালিত শিলওয়ার ছাড়িয়ে কোট পাতলুন হ্যাট টাই-এর বিচিত্র পোষাকে সাজতে বাধ্য করা, মেয়েদের স্বাধীনতার নামে তাদের বোরখা ছাড়িয়ে টেনিস কোর্টে নামিয়ে দেওয়া বা বাজারে কার্পেটের ওপরে বসে দোকান করাকে নিষিদ্ধ করে চেয়ার টেবিলের ব্যবহারের বিধি আরোপ করা, সাপ্তাহিক ছুটির দিনকে শুক্রবারের পরিবর্তে বৃহস্পতিবার করে ফেলা এক মাত্রাছাড়া বিরোধিতার জন্ম দিল, যার বিস্ফোরণ হল যখন কুড়িজন তরুণীকে সেমিজ স্কার্ট পরিয়ে পাঠানো হল উচ্চশিক্ষার্থে। মোল্লারা যখন প্রচার করল যে ডাক্তারি পড়তে নয়, কুড়িজন মেয়েকে ভেট পাঠানো হয়েছে তুর্কিতে কামাল পাশার কাছে, তাতে অবিশ্বাসের কোন কারণ দেখল না আপামর উপজাতি আর বড় শহরের গরিষ্ঠ অংশের মানুষ।
এর পরের ইতিহাস ডাকাত বাচ্চায়ে সাকোর উত্থান, আমানুল্লার পরাজয়, পলায়ন আর সেই থেকে দ্বিগুণ গতিতে পিছনবাগে এগিয়ে যাওয়ার সূত্রে আজকের তালিবানি আফগানিস্থানের জন্ম।
মাত্র দেড় বছরের বসবাস – তাতেই এক ঋষিকল্প নিরীক্ষণের স্বপ্নিল বন্দীশ রচনা করে গেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। কবির মুগ্ধতায় বারবার বলে গেছেন সে দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মৌতাত:
…দিনের বেলার শুকনো নালা জলে ভরে গিয়ে দুই কুল ছাপিয়ে, নারগিসের পা ধুয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে। …এর গান ওর সৌরভে মিশে গিয়েছে…আর যে চিনারের পদপ্রান্তে উভয়ের সঙ্গীত সৌরভ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে সে তার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রভাতসূর্যের প্রথম রশ্মির প্রথম অভিষেকের জন্য।
লিখেছেন তাদের বন্ধুতার কথা যার মূলমন্ত্র “দোস্ত…তুমহারি রোটি, হমারা গোস্ত”, তাদের লা-পরোয়াই সাহসিকতার কথা যারা বলে ‘ভাই পাঠানসব, এসো আমরা সব উড়িয়ে দি, ডিমোক্রেসি, অটোক্রেসি, ব্যুরোক্রেসি, কম্যুনিজম, ডিকটেটরশিপ _ সব সব।‘ পণ্ডিত প্রশ্ন করেন, ‘তুই বুঝি অ্যানার্কিস্ট?’ পাঠান বলে ‘না, আমরা অ্যানার্কিও উড়িয়ে দেব।’
আর লিখেছেন এক মানুষের কথা যার নাম আবদুর রহমান। কাবুলের খাজামোল্লা গ্রামের বাসায় তাঁর খাস ভৃত্য হয়ে যার মঞ্চে প্রবেশ, আর প্রস্থানের করুণ পর্বে যার সঙ্গে বিচ্ছেদে তাঁর সর্বাধিক রক্তপাত।
হালকা, মাঝারি আর ভারি বৃষ্টির মত তিন কিসিমের বিষয়কেই আলোচনার পরিধির মধ্যে এনেছেন আলীসাহেব। একটা দেশের পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় সেটাই স্বাভাবিক। তবে গম্ভীর পাহাড়ের গায়ে যেমন জড়িয়ে থাকে হালকা কুয়াশার আস্তরণ, মাঝে মাঝেই যা সরে গিয়ে পথ করে দেয় সূর্যের কিরণের, তাতে ঝিকমিকিয়ে ওঠে তার গা, ঠিক তেমনি এক অনবদ্য বৈঠকী আড্ডার মোড়কে লেখক পেশ করেন সবরকম ওজনের প্রসঙ্গ। তাতে রসের যোগানে ঘাটতি হয় না, কিন্তু ভারটুকু সরে গিয়ে উপভোগ্য হয়ে ওঠে সে সব কাহিনি।
কাবুলের পথে একটিমাত্র হেডলাইটসর্বস্ব লজঝড় বাসটি যখন খাইবার পাসে এসে সেটিকেও হারিয়ে ফেলে, তখন এক যাত্রীর থেকে লণ্ঠন যোগাড় করে হ্যান্ডিম্যান বসল মাডগার্ডের ওপর।
আমি সভয়ে সর্দারজিকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘হ্যারিকেনের সামান্য আলোতে আপনার মোটর চালাতে অসুবিধে হচ্ছে না তো?সর্দারজি বললেন, ‘হচ্ছে বইকি, আলোটা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ওইটা না থাকলে গাড়ি জোর চালাতে পারতুম।
বন্ধু দোস্ত মহম্মদের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে এল সুন্দ – উপসুন্দের লড়াই।
দোস্ত মহম্মদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাইফেলের জন্য তারা লড়েছিল?’আমি বললুম, ‘না সুন্দরীর জন্য।’
দোস্ত মহম্মদ বললেন ‘তওবা! তওবা! স্ত্রীলোকের জন্য কখনো জব্বর লড়াই হয়? মোক্ষম লড়াই হয় রাইফেলের জন্য। রাইফেল থাকলে সুন্দরীর স্বামীকে খুন করে তার বিধবাকে বিয়ে করা যায়। উত্তম বন্দোবস্ত! সে বেহেস্তে গিয়ে হুরী পরী পেল, তুমিও সুন্দরী পেলে।”
সেকালের আফগানিস্থানে মহিলাদের নগণ্যতার এক করুণ মূল্যায়ন, পাশাপাশি সে সমাজে আইনের শাসনের ঊর্ধে গুলি বন্দুকের প্রতিপত্তির প্রতিবেদন – এই গুরুতর প্রসঙ্গ এক অনবদ্য আলীসুলভ ভঙ্গিতে পরিবেশিত হয়েছে। এমন মণিমুক্তো এ বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে।
পরিশেষে প্রচ্ছদ সম্পর্কে দু’কথা বলতে হয়। বই আকারে প্রকাশিত নিউ এজ পাবলিকেশনের ১৯৪৯-এর প্রথম সংস্করণে প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের বিখ্যাত শিল্পী বিনায়করাও মাসোজী। প্রচ্ছদের ওপরের তিন চতুর্থাংশ জুড়ে আফগানিস্থানের রুক্ষ পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলে গেছে পথ, তাতে মোটরগাড়ির সঙ্গে চলেছে উটের কাফেলা। প্রায় মনোক্রম খয়েরির গায়ে অল্প কটি কালো আর লাল কালির আঁচড় যেন আফগানিস্থানের বর্ণহীন প্রকৃতির এক কথার প্রকাশ। নিচের হাতে লেখার আদলে করা ক্যালিগ্রাফিতে বই ও লেখকের নামে এক অযান্ত্রিক, মাটির মানুষের অনাবিল অন্তরাত্মার স্বাক্ষর। একটি বইয়ের পাঠ যে প্রচ্ছদ থেকেই শুরু হয়, এ যেন তার মূর্ত উদাহরণ। প্রসঙ্গত এই অক্ষরশিল্পী ছিলেন লেখক নিজে। নিউ এজ কে ধন্যবাদ, তাঁরা নবতম সংস্করণে পুরনো প্রচ্ছদের প্রতিকৃতিটি ধরে রেখেছেন। পেছনে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির ছবি ব্যবহারে বর্তমান প্রচ্ছদশিল্পী সৌমেন পাল যে পরিকল্পনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, বই ও লেখকের নাম লেখার হরফে তার অভাব রইল।
আলীসাহেবের এ বই নিয়ে আলোচনা বোধ হয় অবান্তর। আফগানিস্থানের মর্মকথার যে লিপিচিত্র তিনি রেখে গেছেন তাঁর লেখায়, তার ওপরে একটি শব্দ যোগ করার চেষ্টাও ‘ক্যারিং কোল টু নিউক্যাসেল’-এর মত হাস্যকর অপপ্রয়াস। আর কে না জানে আলীসাহেবের এক চোখ টেপা ‘নটি হিউমার’-এর কথা, যার কাছে এ প্রবাদের প্রিয়তর সংস্করণ ‘প্যারিসে আপন স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া।’