অরিন্দমকাকুও আর বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না। যাবার আগে তিলোত্তমাকে আলাদাভাবে ডেকে কিছুক্ষণ কথা বললেন। শরণ্যা মুখে কিছু বলল না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে অবাক থেকে অবাকতর হচ্ছিল। এই ক'টা দিনের মধ্যে আর কত ধরণের সমাপতন দেখতে হবে চোখের উপর, কে জানে! সে ঘরের ভিতর একবার বুলিয়ে দেখল, এখন আনন্দকাকু-ইরাকাকিমা বাদ দিয়ে শুধু মৃণালিনীর বাবা আর শিল্দা রয়েছে, আর রয়েছে ওরা সাতজন। ধৃতিমান আর ঋদ্ধিমান লাঞ্চের ব্যবস্থা দেখতে গেল। শিলাদিত্য এতক্ষণ কাকুর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই বারবার তাদের সীটের দিকে তাকাচ্ছিল। মৃণালিনী অবশ্য দৃঢ়ভাবে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে ছিল। শেষ অবধি সে নিজেই এগিয়ে এল তাদের দিকে। বেশ খানিকক্ষণ ইতস্ততঃ করবার পরে বলল, “পরীক্ষা দিয়ে এলে?”
উপলা, শরণ্যা, তিলোত্তমা বেশ উদ্বেগের সঙ্গে তাকিয়েছিল মৃণালিনীর দিকে। হস্পিটালে বসে একটা কুরুক্ষেত্র ঘটালে তো মুশকিল। ছেলেটারও কি কোনো জ্ঞান নেই? এরকম একটা কাজ করবার পর কোন মুখে কথা বলতে এসেছে! কিন্তু প্রত্যেককে অবাক করে দিয়ে মৃণালিনী স্বাভাবিক গলায় বলল, “না। খবর পেয়ে আমরা সবাই হল্ থেকে উঠে এসেছি।”
“সেকি!” শিলাদিত্য চমকে উঠে বলল, “তোমাদের তো প্রি-বোর্ড ছিল। তা না নিয়েই —”
“সে কথা তোমার বোঝবার ক্ষমতা নেই।”
শিলাদিত্য মাথা নীচু করে রইল। মৃণালিনীর স্বরে এবার তীক্ষ্ণতার আভাস পাওয়া গেল, “আর কিছু বলার আছে?”
শিলাদিত্য আস্তে আস্তে বলল, “ফুল্কি, আমাকে ভুল বুঝো না প্লিজ।”
“ভুল বুঝিনি তো। বরং এতদিনে ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছি। সবটাই আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। এ সময় অবান্তর বিষয় নিয়ে আলোচনা করার প্রশ্নই ওঠেনা।”
শিলাদিত্য একটা নিঃশ্বাস ফেলে চলে যাচ্ছিল; মৃণালিনী পিছন থেকে বলল, “ভাল কথা। আমার নাম মৃণালিনী ।”
সে চলে যেতে অত্রি আশ্চর্যভাবে বলল, “তুই শিল্দার সঙ্গে ওভাবে কথা বললি কেন?”
মৃণালিনী মাথা নাড়ল, “নাও ইজ নট্ দ্য টাইম্।”
এর মাঝেই ঋদ্ধিমান কখন যেন স্যাণ্ডউইচ নিয়ে ফিরে এসেছিল। ঘটনাটা দেখে কিছুই বোধগম্য না হওয়ায় শরণ্যাকে জিজ্ঞেস করল, “কেস্টা কী?”
শরণ্যা চাপা গলায় বলল, “সে অনেক গল্প। ওই ছেলেটার নাম শিলাদিত্য। ও তোমার এক্স গার্লফ্রেণ্ডকে বিয়ে করছে।”
“হো-য়া-ট্!!” ঋদ্ধিমানের হাত থেকে খাবার পড়ে যাচ্ছিল আর কি, “কি হচ্ছেটা কী এসব?!”
“আঃ! আস্তে, প্লিজ। এত ঝামেলার মধ্যে আবার আরেকটা নাই যোগ করলে।”
ঋদ্ধিমান শিলাদিত্যর লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা মন দিয়ে দেখে নিয়ে বলল, “ঈশা একে বিয়ে করছে? পুরো টার্মিনাল রুগীর মতো চেহারা!”
“তুমি থামবে? এটা ফাজলামির সময় নয়।”
“আরে না না, আমি সেভাবে — কিন্তু তুই এই ব্যাপারটা কি করে জানলি? আর ওই মেয়েটার সঙ্গে কী নিয়ে প্রব্লেম?”
“ঈশা তোমার সঙ্গে যা করেছিল, শিল্দা তিল্লীর সঙ্গে ঠিক তাই করেছে।”
ঋদ্ধিমানের অভিব্যক্তি পালটে গেল। সে অস্ফুটে বলে উঠল, “ওঃ মাই গড্!”
হঠাৎ ধৃতিমান এসে ঋদ্ধিমানের কাঁধে চাপড় মেরে বলল, “কি ব্যাপার কী, খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সবাইকে দে!”
ঋদ্ধিমান চট্কা ভেঙে বলল, “ওঃ, হ্যাঁ হ্যাঁ, সরি।”
বিকেল প্রায় পাঁচটা নাগাদ নার্স এসে ডাকলেন, “তিলোত্তমা কে আছেন?”
তিলোত্তমা তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। ডাক এসেছে তাহলে। নিজের তো বটেই, ঘরের মধ্যে সবার হৃৎস্পন্দন টের পাচ্ছিল সে। আনন্দকাকু আর ইরাকাকিমা উদ্বিগ্নভাবে উঠে এলেন।
“আমাদের তো কিছু বলল না, দেখ্ যদি তোকে ... ”
গলার স্বর তেমন দৃঢ় না শোনালেও, তিলোত্তমা আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করল, “চিন্তা কোরোনা কাকিমা।”
আর আগে কখনও হসপিটালের কেবিনে ঢোকেনি সে। কেমন একটা ঠাণ্ডা, গা-ছম্ছমে ভাব। চড়া আলো জ্বালা থাকলেও, অন্ধকার যেন কাটতে চায় না। সর্বত্র ছড়ানো একটা মৃদু অথচ খুব স্পষ্ট ওষুধের গন্ধ। মৃত্যুর খুব কাছে এগিয়ে আসলে কি এরকম গন্ধ পাওয়া যায়? নীরা আজ মৃত্যুর কত কাছে চলে গিয়েছিল! ভয়ে তিলোত্তমার হৃৎপিণ্ডটা মুচড়ে উঠল যেন।
কাচ ঘেরা একটা কেবিনে শুয়ে ছিল নীরা। চোখ বন্ধ করা, নাকের নীচে তখনও অক্সিজেনের সরু নল। বিছানার অনুপাতে নীরার দেহটা অনেক ছোট। দূর থেকে একটা পুরোনো হয়ে যাওয়া পুতুলের মতো মনে হচ্ছিল ওকে। তিলোত্তমার গলার কাছটা ব্যথা করছিল। সে নিঃশব্দে নার্সের পিছন-পিছন কেবিনে ঢুকল। নার্স বললেন, “দেখো, বন্ধু এসেছে।”
নীরা চোখ খুলে প্রথমেই তিলোত্তমার দিকে চাইল। তারপর নার্সকে বলল, “থ্যাঙ্ক য়ু।”
“দশ মিনিট কিন্তু,” এই বলে নার্স বেরিয়ে গেলেন।
তিলোত্তমা বিছানার পাশে রাখা টুলটার উপর বসে পড়ল।
“পরীক্ষা কেমন হল?” নীরা অল্প হাসল।
তিলোত্তমাও ফ্যাকাশেভাবে হাসবার চেষ্টা করে বলল, “পরীক্ষা দিতে দিলি কোথায়, শালা?”
“ওঃ গড্,” নীরা এবারে গভীর আক্ষেপে মাথা নাড়ল, “আই অ্যাম অ্যান্ ইডিয়ট।”
“অফ্ কোর্স য়ু আর,” তিলোত্তমা মাথা নাড়ল, “তুই কি হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়েছিলি?”
নীরা বেশ কিছুক্ষণ কোনো উত্তর দিল না, যেন কোনো কিছুর জন্য নিজেকে তৈরি করে নিল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আই স্লেপ্ট্ উইথ্ রুদ্র।”
তিলোত্তমার মনে হল কোথাও একটা শুনতে ভুল করেছে নিশ্চয়ই।
“কি? কি বললি আরেকবার বল্?”
নীরা এবার তিলোত্তমার দিকে তাকিয়ে স্পষ্টভাবে আবার একই কথা বলল। তিলোত্তমার মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। এতক্ষণ ধরে বাইরে বসে থাকা অত্রির মুখটা দেখেছিল সে। আশঙ্কায়, উদ্বেগে কুঁকড়ে থাকা একটা মুখ। সে তো মৃণালিনীকে বারবার বলছিল, কিছুই জানেনা! ... আর ... ও কার নাম করল নীরা ... ?
তিলোত্তমা অনেক কষ্টে উচ্চারণ করে, “রুদ্র ... কে?”
একটা বুকভাঙা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে নীরা বলল, “তুই চিনিস। রুদ্ররূপ ভট্টাচার্য। রাহুলের বন্ধু।”
এই গত ক’দিনে বারবার অঘটনের মধ্যে পড়ে, একটার পর একটা বিপদের সম্মুখীন হয়ে, তিলোত্তমা ভেবেছিল আর কোনো কিছুই তাকে কাবু করতে পারবে না। কিন্তু এই খবরটা যেন তাকে একটা ঘূর্ণিঝড়ে পড়া গাছের মতো শিকড়সুদ্ধ উপ্ড়ে নিয়ে গেল। কতক্ষণ যে হতবুদ্ধির মতো নীরার দিকে চেয়ে রইল, খেয়াল নেই। এক এক সময়ে মনে হচ্ছিল, এই পুরো ঘটনাটাই মিথ্যে। আজ সকাল থেকেই যেন সে একটা অলীক দুঃস্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে; কেবলমাত্র দুঃস্বপ্নেই বাস্তবের চরিত্ররা এরকম আজগুবি সর্বনাশের জালে একসঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে!
অনেকক্ষণ পরে বজ্রাহতের মতোই বলে উঠল, “য়ু আর জোকিং।”
নীরা চুপ করে তিলোত্তমার প্রতিক্রিয়া দেখছিল এতক্ষণ ধরে। এবারে আস্তে আস্তে বলল, “তিল্লী, আজ সকালবেলায় বিষ খেয়ে মরার চেষ্টা করে আমি এখন হস্পিটাল বেডে শুয়ে আছি। এই সময় আমি মজা করব, এতটা মারাত্মক সেন্স অফ্ হিউমার আমার নেই।”
“কিন্তু ... কিন্তু ...” তিলোত্তমা এবারে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, “তুই ওকে চিনলি কি করে! আর যদি চিনেও থাকিস, ওরকম একটা ছেলেকে তুই কাছে ঘেঁষতে দিলি কি করে, লেট অ্যালোন —” উত্তেজনার চোটে টুল থেকে ছিট্কে নেমে পড়েছিল তিলোত্তমা।
নীরার চোখ ছল্ছল্ করছিল; সে যেন খানিকক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে চোখের জলটাকেই আটকে রাখল। তারপর শান্তভাবে বলল, “সেই জন্যই তোকে ডাকলাম। যে কথাগুলো আমার অনেকদিন আগে বলা উচিৎ ছিল, যেগুলো তোকে অন্ততঃ বললে আজকে এতসব কিছুই ঘটত না, সেগুলো সবই আমাকে বলতে হবে। আই ও য়ু অ্যান্ আপলজি।”
তিলোত্তমা যন্ত্রের মতো বসে পড়ল আবার। নীরা বলতে লাগল; প্রথম থেকে রুদ্র আর শুচিস্মিতার সঙ্গে অত্রির বন্ধুত্বের কথা, নীরার সঙ্গে রুদ্রর আলাপ, তিলোত্তমা আর রাহুলের সম্পর্ক নিয়ে রুদ্র যা যা বলেছিল, তার সঙ্গে নীরার বিভিন্ন সাক্ষাৎ, অত্রির সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি, তারপর সন্ধ্যেবেলা নীরার বাড়ি রুদ্রর আবির্ভাব ...
“এ কাজের কোনো এক্সকিউজ নেই, জানি,” নীরা ভারি গলায় বলে, “কিন্তু তখন আমি খুব একটা স্টেবল্ অবস্থায় ছিলাম না। জ্বরের ঘোরে মাথা ঝিম্ঝিম্ করছিল, আর মনের ভিতরে কি চলছিল সে তো আমিই জানি। আমার অতদিনের বন্ধু, যার সঙ্গে আমি লিটারালী বড় হয়ে উঠলাম, সে আমাকে বিনা কারণে এরকমভাবে ঠকাবে ... এটা আমি জাস্ট নিতে পারছিলাম না। এখন নিজেকে জগতের সবচেয়ে বড় মূর্খ মনে হচ্ছে, কিন্তু অ্যাট দ্যাট পয়েন্ট ... তা ছাড়া, অব্ভিয়াসলি, এর আগে আমার এই ধরণের কোনো এক্সপিরিয়েন্স হয়নি। আই ট্রাস্টেড্ রুদ্র ফুল্লি। ওই মুহূর্তে হী লুক্ড লাইক দ্য বিগেস্ট কম্ফর্ট, আর প্রথমটায় অত ... বাই দ্য টাইম আমি বুঝতে পারলাম যে এটা ভুল হচ্ছে, ততক্ষণে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে গেছে। আই ওয়াজ ওয়ে টূ ফার গন্।”
তিলোত্তমা দু-হাতের মধ্যে মাথা রেখে বসেছিল। ক্ষীণভাবে বলল, “তারপর?”
নীরার যখন ভাল করে হুঁশ ফিরল, তখন টের পেল যে জ্বর আরও বেড়ে গিয়েছে। পুরো ব্যাপারটা কেমন যেন ধোঁয়া-ধোঁয়া মনে হচ্ছিল তার কাছে। কে যেন এসেছিল ... অত্রি ... না, অত্রি তো ... তার চোখের সামনে একটা ছেলে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে জ্যাকেট পরছিল। লম্বায় অত্রিরই সমান কিন্তু ... রুদ্র!
এক ধাক্কায় সম্বিৎ ফিরল নীরার; এবং ভয়ে, অনুশোচনায় প্রায় অর্ধমৃতের মতো অবস্থা হল। এটা কী করল সে! আর রুদ্রই বা কিভাবে এটা হতে দিল! নীরার সঙ্গে যাই ঘটুক না কেন, রুদ্র তো অত্রির বন্ধু! এখন সে কী করবে! এত বড় সর্বনাশ থেকে বেরিয়ে আসবে কি করে!
রুদ্র পিছন ফিরে তার তাকিয়ে বলে উঠল, “আঃ! য়ু আর আওয়েক। আমি তো ভাবলাম অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে গেলে বোধহয়।”
রুদ্রর গলার স্বর শুনে নীরার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। এতটা স্বাভাবিক, কিছুটা যেন ঠাট্টার ভঙ্গিতে কি করে কথা বলছে রুদ্র!
নীরা আর্তস্বরে বলে উঠল, “রুদ্র, দিস ইজ আ ডিজাস্টার!”
রুদ্রর মুখে এবারে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠল। কিছু একটা ভাববার ভঙ্গি করে বলল, “ইজ ইট? ওয়েল, ইয়েস। তোমার পক্ষে এটা ডিজাস্টার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে অত্রি যখন শুনবে তখন কি করবে কে জানে! তোমাদের তো আবার নানারকম সেকেলে আদিখ্যেতা আছে। তবে য়ু টু ক্যান স্পিক ফর্ ইয়োরসেল্ভস্। আই হ্যাড আ ফ্যাবুলাস টাইম।”
বিশাল একটা আড়মোড়া ভাঙল সে। নীরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। এ কাকে দেখছে? নাটকের কোনো দর্শক যদি ভুল করে পর্দার পিছনে উঁকি দিয়ে চরিত্রের অভিনেতাকে আবিষ্কার করে ফেলে, ঠিক তেমনই একটা অনুভূতি হচ্ছিল তার।
নীরার এই অভিব্যক্তি দেখে রুদ্র আপনমনে হেসে গেল কিছুক্ষণ; যেন কোনো কারণে ভীষণ মজা পেয়েছে। তারপর খানিকটা করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমার আর রিয়ার — মানে শুচিস্মিতার প্রব্লেমটা কি জানো? উই গেট্ বোর্ড টূ ইজিলি। সিরিয়াসলি, জীবনে সব সময় কিছু এক্সাইট্মেন্ট না থাকলে পারা যায়? তাই আমাদের মাঝে-মধ্যেই একটা প্রজেক্ট্ দরকার হয়। রিয়া ভেবেছিল, অত্রি একটা ভাল প্রজেক্ট হতে পারবে, কিন্তু গুড্ লর্ড! ছেলেটা জাস্ট মরুভূমির মতো শুক্নো খট্খটে। এমন কোনো অ্যাঙ্গেলই নেই যেটা কাজে লাগানো যায়! এতরকম চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যাপারটা সিনেমা দেখা আর কফি খাওয়ার বেশি এগোলোই না! শেষমেশ যখন বিরক্ত হয়ে গেছে তখন আমিই বললাম রাহুলকে ধরতে। প্রজেক্ট হিসেবে রাহুল বেশ ইন্টারেস্টিং। ওরকম মুখের জিওগ্রাফি নিয়ে মারাত্মক সুন্দরী এক গার্লফ্রেণ্ড কোথা থেকে জোটাল! আমরা ভেবেছিলাম ঢপ দিচ্ছে বোধহয়, তারপর দেখলাম, না, সত্যি, নিলামে কেনা অ্যান্টিকের মতো সব জায়গায় দেখিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে মেয়েটাকে। বুঝলাম, এদের মধ্যে একজনের অন্ততঃ কোনো কেস্ নিশ্চয়ই আছে। ওদের পিছনে কাঠি দিয়ে বেশ মজায় ছিলাম ক’দিন — অ্যাট লীস্ট রিয়া তো ছিল বস্। মেয়েটার ক্ষেত্রে তেমন সুবিধে হল না অবশ্য — তোমার বান্ধবী, বুঝলে, পুরো সাইবেরিয়া — মানে আদৌ ছেলে না মেয়ে না অন্য কিছু, বোঝা যায় না বাবা! কি হবে ওরকম চেহারা দিয়ে? যাইহোক, তবু ভাল ওদের ব্রেক আপ্টা হল ... রাহুল যা ড্রামা করেছিল সেটা হাইলি এন্টারটেইনিং। কিন্তু এই প্রজেক্টটা ...” রুদ্র গা-ঘিন্ঘিনে হাসি হাসল একটা, “বিশ্বাস করো, এর থেকে এক্সাইটিং কিছু এর আগে কোনোদিন পাইনি আমরা। রাহুল এমনিতে গবেট হলে কি হবে, মাঝে মাঝে ওর মাথা থেকে যা সব অসাধারণ আইডিয়া বেরোয় না! যেই শুনল আমি তিলোত্তমার এক বন্ধুকে চিনি, অমনি তোমার উপর দিয়ে রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্য সেকি ঝুলোঝুলি! প্রথমটা ভেবেছিলাম অত ধকল পোষাবে না। কিন্তু ভাগ্যিস আগে থাকতে কিছুটা গ্রাউণ্ড্-ওয়ার্ক আমি কিছুটা নিজের ইন্টারেস্ট-এই করে রেখেছিলাম! না হলে গুগ্ল সার্চ মেরে যত রাজ্যের আর্টিস্টদের নাম মুখস্থ করা আর অত্রির কাছে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা তোমার গুণকীর্তন শোনা ... জাস্ট অসহ্য। বাট্ ইট্ অল পেয়েড অফ্ সো বিউটিফুলি! তুমি, অত্রি আর তোমার বন্ধুগুলো এতটাই বোকা, আমি আর রিয়া তো পপ্কর্ন নিয়ে দেখতে বসে গিয়েছিলাম পুরো ব্যাপারটা। আমার আর রিয়ার তোলা ছবিগুলো ফটোশপ করে অত্রির দার্জিলিং-এর ফটো দেখার সময় ওর ল্যাপটপে ঢুকিয়ে দেওয়ার বুদ্ধিটা অবশ্য রিয়ার। এরকম একটা হাস্যকর চেষ্টা যে সত্যি সত্যি কাজে দেবে আমি তো স্বপ্নেও ভাবিনি, কিন্তু এখন দেখছি আইডিয়াটা পুরো জিনিয়াস ছিল! অবশ্য আমার ফটোশপ স্কিল্স খুব হাই; চট্ করে ধরা যায় না। আমি তো তাও ভেবেছিলাম ওগুলো তোমার হাতে আসবার আগেই অত্রি দেখে ফেলবে। কিন্তু রিয়ার টাইমিং ক্যালকুলেশান-এর প্রশংসা করতে হয়।”
কথাগুলো বলতে বোধহয় খুবই উপভোগ করছিল রুদ্র, তাই এক নিঃশ্বাসে অনেকটা বলে গিয়ে অবশেষে থামল। তারপর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আবার বলল, “ডোন্ট টেক্ ইট্ পার্সোনালি। আমরা জাস্ট চারপাশে বোকা-বোকা লোকেদের ন্যাকা নাটক দেখতে দেখতে বোর হয়ে যাই। তখন তাদেরকে একটু শিক্ষা দিতে ইচ্ছে করে, এই যা। তোমারও ভালই হল। অত্রি যা হোপ্লেস মাল, ওর সঙ্গে যদি ব্রেক্-আপ হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে তুমিই আমাকে ধন্যবাদ দেবে। অবশ্য তুমি ওকে বলতে পারলে হয়। না পারলেও ক্ষতি নেই। আমি তো আছিই। এনিওয়ে, বাই!”
নীরা একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলল, “হি ওয়াজ রাইট্। কত বড় বোকা আমি! তোর আর ধৃতিমানের ব্যাপারে যখন ও এতগুলো কথা বলল, তখন আমি তোকে একবার বিষয়টা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না! ওই ছবিগুলো দেখবার পরে অত্রিকে একটা কথা অবধি বললাম না! ইডিয়ট না হলে কেউ এরকম করে? রুদ্র ছেলেটা ক’দিন আমাকে চিনেছিল, যে আমার সাইকোলজিটা একেবারে হাতে পাতার মতো পড়ে ফেলল?”
তিলোত্তমা কপালের রগদুটো টিপে বসে ছিল। চেনা-জগতের চেহারাটাই তার কাছে ওলটপালট হয়ে গেছে কয়েক মিনিটের মধ্যে। সত্যি, এই ক’দিনের গোলমালে সে রাহুল আর তার অসুস্থচিত্ত বন্ধুদের কথা ভুলেই গিয়েছিল। সেই দিনের ফোনের পর ভেবেছিল, এই অধ্যায়টা বুঝি চিরদিনের মতো চুকল। কি করে যে ভেবেছিল কে জানে! হায়নারা অত সহজে তার পিছু ছাড়বে কেন? কিন্তু এভাবে ...!
“রুদ্ররূপ ভট্টাচার্যকে জেলে পাঠিয়ে ছাড়ব আমি,” হিংস্রভাবে বলে ওঠে সে।
“কি করে?” নীরা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, “ইট্ ওয়াজ নট্ রেপ। ইট্ ওয়াজ কন্সেঞ্চুয়াল। জ্বরের ঘোরে আধা বেহুঁশ ছিলাম বটে, কিন্তু তাও। তাছাড়া ক’দিন আগেই আমি অ্যাডাল্ট হয়ে গিয়েছি। সেইদিক দিয়েও ও ধরাছোঁয়ার বাইরে।”
“প্রভোক্ড টু সুইসাইড তো হতে পারে! ওই ছবিগুলো —”
“ছবিগুলো তো দেখবামাত্র ফাইলসুদ্ধ ডিলীট করে দিয়েছি। তা ছাড়া ওগুলো যে ওরাই কম্পিউটারে ঢুকিয়েছে তারই বা কি প্রমাণ আছে? সবচেয়ে বড় কথা, মা-বাবাকে এর মধ্যে একদম জড়াতে চাই না আমি। আমার বোকামির জন্য ওদের সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে, এটা হতে দেওয়া যায় না। অলরেডি কম্ গেল না ওদের উপর দিয়ে,” এই বলে নীরা বিষন্ন, তিক্ত হাসল, “আর সত্যি বলতে, আমার তো মনে হয় কোর্ট কেস করলে রুদ্র বেশ খুশিই হবে। অনন্ত বোরডাম থেকে কিছুদিনের ছাড় হবে আর কি!”
খানিকক্ষণ কেউই কোনো কথা বলে না। কিছুই বলার নেই আর। হঠাৎ করে তিলোত্তমার মনে পড়ে মৃণালিনীর বাবার বলা কথাগুলো। চিন্তিত মুখে জানতে চায়, “পুলিশকে কী স্টেট্মেন্ট দিবি?”
“দেব কিছু একটা। পরীক্ষার চাপ, পড়া হয়নি — এইসব।”
“পুলিশকে মিথ্যে বলবি!”
“সত্যি-মিথ্যের কি আছে? এটা তো খুনের মামলা নয়।”
“তোর পকেটের ওই নোটটার কি এক্সপ্ল্যানেশান —”
“ওসব আমি ম্যানেজ করে নেব। বাদ দে তো।”
একটু থেমে নীরা অত্মগতভাবে বলে উঠল, “মরে যাওয়াটা খুব ভয়ের। কিরকম সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার মতো।”
তিলোত্তমা সামান্য শিউরে উঠল, কিছু বলতে পারল না। আজকের ঘটনাটা যদি অন্যদিকে ঘুরে যেত! “বিষটা খাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কিন্তু অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে ... কি আশ্চর্য দেখ্, অন্য কারুর কথা মাথায় এল না, মা-বাবা না, অত্রি না। শুধু ঠিক ব্ল্যাক আউট হয়ে যাওয়ার আগে তোদের চারজনের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল; স্কুল য়ুনিফর্ম পরা সবার। আর তক্ষুণি মনের সব জোর দিয়ে ভাবলাম, ‘ভগবান, এ যাত্রা বাঁচিয়ে দাও, আর কোনোদিন এমন বোকামি করব না!’”
তিলোত্তমা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ভগবানের কানে গিয়েছিল কথাটা। অ্যান্ড থ্যাঙ্ক গড্ ফর দ্যাট।” বাইরে থেকে নার্সকে আসতে দেখা গেল।
তিলোত্তমা একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “অত্রি সকাল থেকে বাইরে বসে আছে। ওকে কী বলব?”
“হুঁ। ওর অবস্থা কি হয়েছে জানি। আমি কাওয়ার্ডের মতো এস্কেপ করতে যাচ্ছিলাম ... কিন্তু আপাতত তুইই বল্। আমাকে তো এখন বেরোতে দেবে না। পুরোটা বলবি। কিছু বাদ দিবি না।”
“বেশ।”
নার্সের সঙ্গে ফিরে যেতে যেতে তিলোত্তমা জিজ্ঞেস করল, “ওকে কতদিনে ছাড়া হবে?”
“ভালই রিকভার করেছে। আজকের দিনটা অবজার্ভ করে কাল জেনারেল ওয়ার্ডে শিফ্ট করে দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে বড় জোর দু-তিন দিন।”
বাইরে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সবাইকে সবটা বলার নয়। নীরার মা-বাবাকে একটা অস্পষ্ট উত্তর দিল সে; অসুস্থতা, পরীক্ষার চাপ, হতাশাবোধ, ইত্যাদি মিশিয়ে বেশ নড়বড়ে কাঠামোর একটা গল্প বলতে হল। কাকু-কাকিমা অবশ্য বিশেষ কিছু জানতেও চাইলেন না। মেয়ে যে বেঁচে আছে এতেই তাঁরা আপ্লুত। ওঁরা ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেলে বন্ধুদের দিকে এগিয়ে গেল সে। অত্রিকে বলাটাই বোধহয় সবচেয়ে কঠিন ছিল। একেই তো ছেলেটাকে ভাল করে চেনে না, তার উপর কেঁদে কেঁদে যে নিজের কি অবস্থা করেছে সে! তবু, না বলে উপায় কী? আর কেউ জানুক না জানুক, তার জানা দরকার। অবশ্যই বলা সহজ হল না। এবং শোনাও সহজ হল না কারুর পক্ষে। অত্রির মুখ এতটাই ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, এক সময়ে মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে পড়েই যাবে বুঝি। বাকিদের অবস্থাও শোচনীয়। তবু, এতকিছুর মধ্যে একটাই শান্তির কথা — নীরা বেঁচে আছে।
অশেষ বিষন্নতা নিয়ে হস্পিটাল থেকে বেরিয়ে এল শরণ্যা। ভিতরে আর ভাল লাগছিল না। উপলা আর ঋদ্ধিমানদার জন্য অপেক্ষা করছিল বাইরে। একসঙ্গে বাড়ি ফিরবে। এতক্ষণে বাকিদের সঙ্গে কথা বলবার মতো অবস্থায় ফিরেছেন কাকু-কাকিমা। শরণ্যা দেখল ওঁরা ধৃতিমানের হাত ধরে বলছেন, “তোমাদেরকে তো আমরা চিনিই না। অথচ আজ তোমরা কত হেল্প করলে আমাদের ...”
সত্যি, কখন, কোথায়, কার সঙ্গে কীভাবে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে বোঝা দায়। এর আগে রঙ্গীতদাকে ছাড়া সমস্ত সমস্যাকেই দুর্লঙ্ঘ পাহাড়ের মতো ঠেকত। অথচ আজ কোথায় রঙ্গীতদা? তার বদলে এমন দুজন মানুষ তাদের সব কাজ ফেলে রেখে ছুটে এসেছে যাদের সঙ্গে সেরকম বন্ধুত্বই ছিল না এই কটাদিন আগেও।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। নামটা না পড়েই অন্যমনষ্কভাবে ফোন ধরল শরণ্যা, “হ্যালো।”
“রাকা? হাউ আর য়ু?”
“সানা?” শরণ্যা চমকে ওঠে, “ওঃ মাই গড্! এতদিন ফোন করিসনি কেন? এভ্রিথিং ওকে?”
“ইয়েস্ ইয়েস্, অল্ গুড্। আই ওয়াজ বিজি ফর আ হোয়াইল্, সরি। আই হ্যাভ গট আ জব্।”
“সত্যি! কোথায়?”
“সারে-তে। চার্টার-হাউজ স্কুলে। সেপ্টেম্বার থেকে ওখানেই শিফ্ট করে যাব।”
শরণ্যা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “দ্যাট্স গ্রেট, সানা। আই অ্যাম রিয়লি হ্যাপি ফর্ য়ু।”
খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতার পর অবশেষে ওপার থেকে আওয়াজ এল, “লিস্ন রাকা। টেল্ মম্ অ্যান্ড ড্যাড, আমি জুন মাসে ইণ্ডিয়া যাচ্ছি, তোদের কাছে। আই হ্যাভ বুক্ড আ ফ্লাইট।”
তাদের বাড়ির গলিটায় ঢোকবার মুখে হঠাৎ করে থেমে গেল অত্রি। মৃণালিনী পাশাপাশি হাঁটছিল এতক্ষণ। বলল, “কি হল, দাঁড়িয়ে পড়লি?”
অত্রি একেবারে হাঁউমাউ করে কেঁদে ফেলল। এবং কাঁদতেই লাগল। মৃণালিনী স্তম্ভিত হয়ে বলল, “কি ব্যাপারটা কী? পাগল হয়ে গেলি?”
“এটা আমাদের সঙ্গে কী হল, ফুল্কি? নীরা আমাকে এইটুকু বিশ্বাস করতে পারল না! আর রুদ্র! আমি আজ অবধি ওর কত উপকার করেছি তার হিসেব নেই, আর সেই রুদ্র —”
মৃণালিনী হঠাৎ ঠাস করে ওর গালে সপাটে এক থাপ্পড় মারল। অত্রি টাল সামলাতে না পেরে উলটে পড়েই যাচ্ছিল প্রায়; মৃণালিনী তার কলার ধরে হেঁচড়ে তেনে তুলল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “এই শোন্, নাকি কান্না বন্ধ কর্! কাঁদলে সব ঠিক হয়ে যাবে, ফাকিং ইডিয়ট? চোখ খুলে চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখ্, পৃথিবীটা এরকমই! আমাদের কাঁদতে দেখে সবাই হাসে! তুই যখন চোখের জলে মাটি ভেজাচ্ছিস, তখন তোর রুদ্ররূপ ভট্টাচার্য এন্টারটেইন্ড হচ্ছে! য়ু ওয়ান্ট জাস্টিস? য়ু ওয়ান্ট ফেয়ারনেস? তাহলে ফাইট্!”
এবং সত্যিই লড়তে লাগল দুজনে। অন্ধকারে, স্ট্রিট্ল্যাম্পের তলায় পরস্পরের সঙ্গে নিঃশব্দ মল্লযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ঠিক যেমন ছোটবেলায় লড়ত তারা। তখন তাদের মনে রাগ থাকত না, দুঃখ থাকতনা, জিতবার আগ্রহ, হারবার ভয়, কিছুই থাকত না। মনটা একেবারে ফাঁকা করে দিয়ে অনন্তকাল ধরে শুম্ভ-নিশুম্ভের মতো যুদ্ধ করে যেত শুধু, যেন কোনো অদৃশ্য দেওয়াল হাজার হাজার বছর ধরে ভেঙে দিতে চাইছে দুজনে মিলে।
কতক্ষণ এইভাবে কাটল, কে জানে! রাস্তার উপর ধপ্ করে বসে পড়ল ওরা। মৃণালিনীর ঠোঁট কেটে গেছে, কাঁধে ব্যথা ঝন্ঝন্ করছে, অত্রির কপাল ফুলে আলু হয়ে গেছে, বাঁ চোখ ঘিরে আবছা একটা কালো রেখা ফুটে উঠছে। কিছুক্ষণ হাপরের মতো দম নিয়ে মৃণালিনী বলল, “বেটার?”
খানিকক্ষণ খক্খক্ করে কেশে অবশেষে অত্রিও মাথা নাড়ল, “বেটার।”
“তুই কি নীরাকে ছেড়ে দিবি?”
অত্রি এমনভাবে তাকাল যেন মৃণালিনী কোনো আজগুবি গল্প বলেছে।
“আমি এই পুরো ব্যাপারটা নিয়ে সত্যিই হার্ট হয়েছি। কিন্তু ‘ছেড়ে দেওয়া’ বলতে কি বোঝায়? একজন বন্ধুকে কোথায় ছেড়ে দিতে পারে মানুষে?”
একটু থেমে সে আবার বলল, “তাছাড়া, দোষ আমারও ছিল। নীরার কানের কাছে দিনরাত ‘রুদ্র-রুদ্র’ করে মাথা খারাপ করে দিয়েছিল কে? আলাপই বা করাল কে? নীরা যে রুদ্রকে অকাতরে বিশ্বাস করেছিল তার দায় শুধুই আমার। নীরা তো জাস্ট কটাদিন মাত্র চিনত ওকে; আমি গোটা একটা বছর ওর সঙ্গে মিশে কিছুই বুঝিনি! আমার ল্যাপ্টপে ছবি দেখার নাম করে আস্ত একটা ফাইল ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল, আর আমি টেরও পেলাম না! সুইসাইড্ তো আমার করা উচিৎ।”
“তাতে কোনো লাভ হবে না,” মৃণালিনী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “আজকে আমরা যেটা করলাম, তার চতুর্গুণ মার মেরে আয় স্কাউন্ড্রেলটাকে। তাতে ড্যামেজ কন্ট্রোল কিছুই হবেনা, যা হয়ে গেছে সেটাকে বদলানোও যাবে না। তবু, গায়ের ঝাল তো মিটবে! এক্সাইট্মেন্ট খোঁজে বলছিল না? গিভ হিম সাম রিয়ল এক্সাইট্মেন্ট।”
অত্রি ঠাণ্ডা গলায় বলল, “ঠিক বলেছিস।”
আরও অনেকক্ষণ একইভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দুই বাল্যবন্ধু। তাদের মাথার উপর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে স্ট্রিট্ল্যাম্পের হলদে আলো।
“উফ্, ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’ কি সাধে বলে! পুড়িয়ে দিচ্ছে একেবারে,” ছোটমাসি সবাইকে সরবৎ এগিয়ে দিতে দিতে বলল।
শরণ্যা অবাক হয়ে চেয়ে ছিল। দিন যায়, বছর যায়, ছোটমাসি একই থাকে। গত শীতকালের কথা মনে করতে গিয়েও তো বুকের ভিতরটা ওলটপালট করতে থাকে তার। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো এই হাসিমুখের মেয়েটা — আজ থেকে সাত বছর আগে লণ্ডন থেকে বিদায় নেবার সময় যেমন চেহারা ছিল, আজও তার কিছুই বদলায়নি। বাকিরাও বেশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিল। আসলে ওকে এত কমবয়সী বলে কেউই কল্পনা করতে পারেনি বোধহয়। কলেজের প্রফেসার শুনেই তো চশমা-পরা গম্ভীর একটা ছবি ভেসে ওঠে!
“এতটা রাস্তা আসতে বেশ কষ্ট হল, বলো?” ছোটমাসি বলে, “এখানকার ধারাই এই। শীতে হাড়কাঁপানি, গরমে হাড়জ্বালানি। রাকাও বোধহয় গরমের সময় প্রথমবার এল। কি রে, তাই না?”
“ছোটমাসি, তোমার বাড়িটা কি সুন্দর!” মৃণালিনী আর উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারে না।
“সত্যি কথা,” তিলোত্তমা যোগ করে, “যদি জানতে পারতাম যে রনের এরকম একটা ফার্স্ট-ক্লাস বেড়াতে যাওয়ার জায়গা আছে, তাহলে আরও কত আগে চলে আসতাম!”
“এখনই আর কি দেখছ। শীতকালে বাগানটার চেহারা বদলে যায় একেবারে। কতরকমের রঙ — রাকাকে তো লিখেছিলাম পুজোর সময় আসবার জন্য। তা, আই.এস.সী — আই.এস.সী করেই তার ঘুম চলে গিয়েছিল তখন ... ভাল কথা! পরীক্ষা কেমন হল তোমাদের?”
সবাই পরস্পরের সঙ্গে মুখ-চাওয়াচাওয়ি করল। সত্যি, ওই কটা মাস কিভাবে যেন কাটল ওদের! প্রি-বোর্ডের সময় সবার জীবনে যে সাংঘাতিক দুর্যোগ নেমে এসেছিল, তার জের সহজে কাটবার ছিল না। নীরা ভাঙা শরীরেই কী মনের জোর নিয়ে বাকি পরীক্ষাগুলো দিল কে জানে! ততদিনে দুর্ঘটনার খবরটা সারা ক্লাসে চাউর হয়ে গিয়েছিল, সেই সাথে আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে নানা গুজবের গুঞ্জন। কিন্তু সেসব কিছুই গ্রাহ্য করল না নীরা। বাকিরাও না। তারপর এক মাস ধরে আসল পরীক্ষার প্রস্তুতিপর্ব চলল। প্রত্যেকেই আশা করেছিল যে পড়াশোনার চাপে হয়তো আর সবকিছু ভুলে যাওয়া যাবে। তা হয়নি — বরং গত কয়েক মাসের সমস্ত দুঃখ, দ্বন্দ্ব, বিশ্বাসভঙ্গ আর বিচ্ছেদ একসঙ্গে তাড়া করে বেড়াতে লাগল তাদের।
সানা ফিরে আসবে। ফেরাটা সাময়িক হলেও, দু-বছর পর যাবতীয় ভুল-বোঝাবুঝি আর রাগ-অভিমান দূরে সরিয়ে রেখে সে আসবে। কতদিন পর মম্-ড্যাডের মুখে বিরল হাসি ফুটে উঠতে দেখল শরণ্যা! তবু নিজে প্রাণ খুলে হাসতে পারল না। এখনও মাঝে মাঝে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে, কাচের বোতল আর আধপোড়া সিগারেটের কবর থেকে বেরিয়ে এসে এক উন্মাদ চিৎকার করে করে অন্ধকারকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
উপলার সাথে কণিষ্ক আর যোগাযোগ করেনি। শাক্যদার সাথেও ওইদিনের পর আর বিশেষ কোনো কথা হয়ে ওঠেনি। আসলে কিছুতেই তাকে ফোন করতে হাত সরতো না। কে জানে, শেষ পর্যন্ত অবন্তীকা আন্টির কি হবে! ঋদ্ধিমানদা মাঝে মাঝে ফোন করত, সোশিওলজি বুঝিয়ে দিত। সবচেয়ে বড় কথা, আজকাল মাঝে মাঝেই মনের খবর নেয় সে। কে জানে, কণিষ্কর মনের খবর কে রাখে এখন! তার কথা ভেবে এখনও উপলার বুকের ভিতর চিন্চিন্ করে। এই অসহায়তাটাই সবচেয়ে কষ্টদায়ক।
মৃণালিনী যার ভাবনা চিরকালের জন্য মুছে দিতে চাইছিল, বাড়ির বাইরে পা দেওয়ামাত্র বারবার তারই সামনে পড়ে যাচ্ছিল। প্রি-বোর্ডের মাঝেই তো শিলাদিত্যর বিয়ে হয়ে গেল। গিয়েওছিল সে, তার সবচাইতে ভাল সাজ করে, কনের সঙ্গে হাসিমুখে প্রচুর কথা বলে, তারপর অদূরে বসে থাকা নীরা আর অত্রির কাছে গিয়ে অবশেষে হাঁপ ছেড়েছিল। এত সবের মধ্যেও কি পড়ার বইয়ের একটা লাইনও বোধগম্য হত তার? তবু সে নীরাকে দেখে মনের জোর পাচ্ছিল। অত্রিকে দেখেও। ওদের মধ্যে যে একটা বিশাল ফাটল তৈরি হয়েছিল, তাকে প্রতিদিন একটু একটু করে বুজিয়ে আনতে কত পরিশ্রম করতে হয়েছে তাদের — আর কত যন্ত্রণা পেতে হয়েছে তার হিসেব কে রাখে! তবু তো স্বাভাবিকভাবেই বাঁচছে ওরা। তাহলে মৃণালিনী কেন পারবে না?
তিলোত্তমার কাছে এই শেষ কটা মাস ছিল কুরুক্ষেত্রের চূড়ান্ত পর্বের মতো। একাধারে তার পরিবার প্রায় প্রত্যক্ষভাবেই আক্রমণ শুরু করেছিল তাকে। অন্যদিকে ছিল পরীক্ষা, যার ফলাফলের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবু ধৃতিমান প্রতি মুহূর্তে তার সঙ্গে ছিল; না হলে এ যুদ্ধে জেতা যে আরও কত কঠিন হয়ে দাঁড়াত!
ভাগ্যিস শরণ্যা পরীক্ষার পর ছোটমাসির বাড়ি যাওয়া ঠিক করেছিল। বাকিদের মনের অবস্থাটা সে বুঝতে পেরেছিল বলেই একদিন সবাইকে প্রস্তাব দিয়েছিল, “শান্তিনিকেতন যাবি তোরা?”
মা-বাবারা কেউই সেরকম আপত্তি করলেন না। আসবার সময় মৃণালিনী অবাক হয়ে ভাবছিল, তারা কি তবে সত্যিই বড় হয়ে গেল? ...
নীরা হাসিমুখে বলল, “পরীক্ষা দিয়ে কি কিছু বোঝা যায় ছোটমাসি? রেজাল্ট বেরোলেই সব বোঝা যাবে!”
এখানকার গ্রীষ্ম কলকাতার মতো নয়। ঘরের ভিতর থেকে বাইরের কাঠফাটা দুপুর-রোদের দিকে তাকালে এক সময় নিজেকে কেমন যেন নেশাগ্রস্ত মনে হতে থাকে। চারিদিকে অসংখ্য আগনের হল্কার মতো কৃষ্ণচূড়া, অমলতাশ, গুলমোহর — এখনও দু-একটা অশোক-পলাশ টিকে আছে। গাছের পাতাগুলো উগ্র সবুজ; সব মিলিয়ে মনে হয় কেউ যেন চোখ-ঝলসে দেওয়া রঙ নিয়ে তাণ্ডবনৃত্য করে বেড়িয়েছে সারা বাগান জুড়ে। হু-হু করে ছুটছে তপ্ত লু হাওয়া; তাতে বাষ্পের ছিটেফোঁটাও নেই। তবু সবকিছু এত অসহ্য সুন্দর! বারান্দার থামে ঠেস দিয়ে বসে শরণ্যার ঝিম্ ধরে যাচ্ছিল।
“এই গরমে বসে থাকলে মাথা গরম হয়ে যাবে যে!”
কখন যেন ছোটমাসি এসে দাঁড়িয়েছে। সে অবশ্য ভিতরে যেতে বলে না, বরং নিজেই একখানা মোড়া টেনে নিয়ে বসে পড়ে। শরণ্যা বলে, “গরমকাল যে এত সুন্দর হয় তা কে জানত?”
“ঘরের ভিতরে বসে দেখলে সুন্দর বৈকি,” ছোটমাসি হেসে ওঠে, “তবে, মাঝে মাঝে আমিও এরকম বেলা তিনটের সময় সাইকেল নিয়ে এক চক্কর মেরে আসি। ও, ভাল কথা! তোদের ঘোরার জন্য আরও কয়েকটা সাইকেল আনিয়ে রেখেছি। ওরা চড়তে পারে তো?”
“উপলা আর তিলোত্তমা পারে।”
“ওতেই হবে। বাকিরা না হয় পিছনে বসে যাবে।”
অনেকদিন পর দেখা হল ছোটমাসির সঙ্গে। আর, এই বাড়িতে আসা তো আরও পরে। আগেরবারের সেই ক্লাস নাইনের মেয়েটার সঙ্গে এখনকার শরণ্যার খুব কি মিল আছে? মাঝে মাঝে নিজেকে দেখে খুব অবাক হয়ে যায় সে। ছোটমাসিরও কি এমন হয়?
“সানা যেন কবে আসবে বলল?”
“জুন। ওর স্কুলের চাকরিতে জয়েন করবার আগে অবধি থাকবে জানিয়েছে।”
“বাঃ। তাহলে তোদের সমস্যা মিটল, বল্?” ছোটমাসি হাসিমুখে বলে।
“কে জানে!” শরণ্যা উদাসভাবে জবাব দেয়, “কোনো সমস্যারই কি পাকাপাকি সমাধান হয় কখনো?”
“এই কথাটা তো বেশ বড়দের মতো বললি।”
শরণ্যা হাসল। বড় হওয়ার বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করল না। খানিক পর ছোটমাসি জিজ্ঞেস করে, “দিদির কি খবর?”
“বেটার। ড্যাডের সঙ্গে ঝগড়া করা কমিয়েছে বোধহয়।”
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ভাবনাগুলো একটু গুছিয়ে নিয়ে শরণ্যা আবার বলে, “মমের এই ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারতাম না। আমাদের সাথে যা হয়েছিল, নোবডি ওয়াজ রেস্পন্সিব্ল ফর দ্যাট। তাহলে বারবার ড্যাড্কে দোষ দেয় কেন?”
ছোটমাসি চুপচাপ কি যেন ভাবল খানিকক্ষণ। তারপর যেন আপনমনেই বলতে লাগল, “দিদি ঠিক দোষ দেয় না। জামাইবাবু না বলতেই পুরো দায়টা নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে বলে ওর রাগ হয় ঠিকই, তবে সেটা দোষ দেওয়া নয়। কিন্তু সানার আলাদা হয়ে যাওয়াতে ও সত্যিই খুব হার্ট হয়েছিল। ওর মনে হয়েছিল যে বিপদের দিনে একটা পরিবারের একজোট হয়ে থাকাটা খুব দরকার। সানাকে জামাইবাবু আসতে জোর করল না একবারও, তাতে করে ওর রাগটা যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল। ... আসলে, আলাদা হয়ে যাওয়া, ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা ত