১
ধূসর সময় পার করে হঠাৎ দেখা হওয়া মানেই ব্যাধের চরণধ্বনি। স্মৃতি এক নির্মম শিকারি। নিঃশব্দে সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে। পান থেকে চুন খসলেই শরসন্ধান করতে উদ্যত হয়। নিশানাও বলিহারি! সোজা বুকে এসে বেঁধে। তিমির থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই চারদিকে পাখপাখালি, হলুদ বসন্ত। উল্টো দিকে অবলীলায় সরে যাচ্ছে রাস্তা-ঘাট, দোকান-পশার, মানুষের ভিড়। একটা ঝরা ফুল কৃষ্ণচূড়া উড়ে গেল হাওয়ার বিপরীতে। যেতে যেতে লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া। লাল রং বিপজ্জনক। বিহু কি তাকে দেখতে পেয়েছে?
বেশি দিন নয়, বছর পাঁচেক আগেকার কথা। সেদিন একটা বোটনেক কামিজ পরে এসেছিল বিহু। খোলার সময়ই বলেছিল, “আমার শরীরে কিন্তু একটা দাগ আছে।”
প্রথমবার দু’জনে ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল। তিমিরের এক বন্ধু কৌশিকের বাড়িতে, নতুন মুম্বাইয়ের একটা নোডে। কৌশিকের বৌ বাচ্চা হওয়ার জন্য কলকাতা গিয়েছিল, বাপের বাড়ি। কৌশিক সেদিন তিমিরের হাতে বাড়ির চাবি দিয়ে অফিসে চলে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে মুচকি হেসে বলেছিল, “দেখিস বাড়াবাড়ি করিস না যেন।”
বিহুরা থাকত চেম্বুরে। খাড়ি-ব্রিজ পার হয়ে ফাঁকা ঘরে আসতে বিহু আপত্তি করেনি। দুটো পরিবারের মধ্যে কথাবার্তা চলছে, আর ক’দিন পরেই বিয়ে। সত্যি বলতে কী বাবা-মা আত্মীয়-পরিজনের সম্মতি নিয়েই ওদের মেলামেশার শুরু। সম্বন্ধটা এনেছিলেন বিহুর মায়ের এক বান্ধবী। তিনি আবার ছেলের দূর সম্পর্কের পিসি। ভদ্র সচ্ছল পরিবার। ছেলে দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালি, নতুন মুম্বাইতে নিজেদের ফ্ল্যাট। সেখানেই জন্ম-কর্ম, বড় হয়ে ওঠা। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে সবে চাকরিতে ঢুকেছে। ভবিষ্যতে ম্যানেজমেন্ট করার ইচ্ছা আছে। আচমকা দাগের কথা শুনে বিহুর কোমরের ওপর তিমিরের হাত থেমে গিয়েছিল, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “দাগ মানে? কীসের দাগ?”
বিহু তখন জে জে স্কুল অভ আর্টস থেকে ইন্টিরিওর ডেকোরেশন নিয়ে ডিগ্রি করছে। একটা ফার্মে ইন্টার্নশিপ করতে ঢুকেছে। ক’দিনের মাত্র আলাপ, সেই তুলনায় তিমিরকে বোধহয় একটু বেশিই ভরসা করে বসেছিল। আসলে নির্ভরতা এক আশ্চর্য অনুভূতি। দু’জন মানুষের কাছাকাছি আসার জন্য হয়তো প্রেম-ভালবাসার থেকেও বেশি অপরিহার্য হয়ে ওঠে কখনও কখনও। কালো বুকবাঁধনের হুক খুলে বিহু দেখিয়েছিল ডানদিকের স্তনবৃন্তের ঠিক ওপরে একটা লম্বা সাদা দাগ। ফিসফিস করে বলেছিল, “দাগটা দিনদিন বাড়ছে, জানো।
কোনও মেয়ের সঙ্গে প্রথম মিলনের সময় আদেখলের মত তার শরীরের খুঁটিনাটি খুঁজে দেখাই নিয়ম। তিমির সেসব ছেড়ে দাগের চরিত্র নির্ণয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে ডাক্তার নয়, তবু মনে হয়েছিল দাগটা যেন শরীরের আর পাঁচটা কাটাছেঁড়া যোগবিয়োগ-গুনভাগ স্বস্তিকা চিহ্নর মত সাধারণ নয়, যে মলম লাগালে মিলিয়ে যাবে। দাগটা যদি বিহুর বুকের চূড়া থেকে তুষারধস হয়ে নামে? এমন তো নয় আর কিছুদিনের মধ্যেই বিহুর সমস্ত শরীর বরফে ঢেকে যাবে! সারাটা জীবন তিমির কি এক তুষার-কন্যার সঙ্গে ঘর করতে পারবে? তিমিরের শীত করে উঠেছিল। সে সরে বসেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, “আগে বলনি কেন?”
বিহু বলেছিল, “এই তো বললাম।”
দু’জনেই বুঝেছিল দাগের কথাটা জানানো জরুরি ছিল। অন্তত শারীরিক ভাব-ভালবাসার আগে এই বিষয়ে একটা ফয়সালা হয়ে যাওয়ার নিতান্তই প্রয়োজন ছিল। বিহু আবার পোশাক পরে নিয়েছিল। তিমিরও। তিমির জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমার বাবা-মা জানেন না?”
কথাটার মধ্যে অন্য ইঙ্গিত ছিল কি? বিহুর বাবা-মা মেয়ের দোষ লুকিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন। পাত্রপক্ষকে জানাননি। বিহু বলেছিল, “জানবে না কেন? ডার্মাটোলজিস্টের কাছে নিয়ে যাচ্ছে আর জানবে না? তোমাদেরও জানাতে বলেছিলাম। বাবা-মা গা করছিল না। তাই আমিই বললাম। মনে হল তোমায় বললে তুমি বুঝবে।”
তিমির জিজ্ঞেস করেছিল, “ডাক্তার কী বলছে?”
বিহু একটু চিন্তিত গলায় বলেছিল, “বলছে ওষুধ লাগালে কমবে। কিন্তু কমার তো কোনও লক্ষণ দেখছি না।”
দু’-চারটে টুকরো-টাকরা কথা বলার পর সেদিন কথা ফুরিয়ে গিয়েছিল, দু’জনেরই। তিমির ভাবছিল বাড়িতে কী করে জানাবে। বাবাকে নিয়ে ভয় নেই। তিমির যা বলবে মেনে নেবে। সব থেকে বড় দুশ্চিন্তা হল মা কীভাবে রিঅ্যাকট করবে? মানুষের রূপ নিয়ে মা ভয়ানক খুঁতখুঁতে। দিদি, জামাইবাবু? কে জানে শুনে কী বলবে! তিমিরের অস্থির লাগছিল। সে নিজেই কি নিশ্চিত, কী করা উচিত! বিহু একটা জোর ধাক্কা দিয়েছে। অসময়ে। বিয়ের দিন স্থির হয়ে গেছে। রিসেপশনের জন্য হল ভাড়া নেওয়া হয়ে গেছে। নিমন্ত্রণপত্র ছাপতে চলে গেছে। এখন এই উপদ্রব!
বিহু ভাবছিল সম্পর্কটা নিয়ে বোধহয় আর একটু ভাবনা-চিন্তা করার দরকার ছিল। বিহুর স্বভাবই হল চট করে সবাইকে বিশ্বাস করে ফেলা। অনেক সময় পরে পস্তাতে হয়েছে। তাও শিক্ষা হয় না। ভেবেছিল তিমির বন্ধুর মত সহানুভূতি দেখাবে। তার নিজের কাছে এই দাগ-টাগ মারাত্মক কোনও সমস্যা নয়। মানুষের শরীর। রোগ-জ্বালা থাকবেই। লড়তেই যদি হয় দু’জনে মিলে লড়বে। ভুল ভেবেছিল? কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বিহু উঠে পড়েছিল। তিমির পিছু ডাকতে গিয়েও ডাকেনি।
তিমির দেখল বিহু সেকটর ওয়ান মার্কেটের দিকে যাচ্ছে, অন্যমনস্ক পায়ে। একটা আটপৌরে শাড়ি পরেছে, এলোমেলো। শাড়ির কুঁচি পায়ে জড়িয়ে হোঁচট খেল একবার। বিহুকে কি শাড়ি পরে আগে কোনওদিন দেখেছে তিমির? গত পাঁচ বছরে বিহুর চেহারা বিশেষ বদলায়নি। হয়তো সামান্য একটু পৃথুলা হয়েছে, কোমরে একটা ভাঁজ বেড়েছে। তার বেশি কিছু নয়। তিমিরকে লক্ষ করেনি, যেন ঘুমের মধ্যে হাঁটছে।
আজকেও কৌশিকের বাড়ি এসেছিল তিমির। কৌশিকের এখন ভরা-ভর্তি সংসার। মেয়ের কোলে ছেলে, তার এক বছরের জন্মদিনে দু’-চারজন কাছের বন্ধুবান্ধবকে ডেকেছিল কৌশিক। তিমির এখনও ‘বকো যথা’, বাকি বন্ধুরা যে যার মত পাতিহাঁস হয়ে গেছে। তারা বৌ-বাচ্চা নিয়ে এসেছিল। বাচ্চাগুলো প্যাঁক-প্যাঁক করে আড়াই কামরার ফ্ল্যাটটা মাথায় তুলে রেখেছিল। যথারীতি কেক কাটা, হাততালি দিয়ে নেচে নেচে ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ গান গাওয়া শেষ হলে তিমির বেরিয়েছিল সুখটান দিতে। ডিনারের দেরি আছে। তা সত্ত্বেও আর কোনও বন্ধু সঙ্গে আসেনি। তাদের ধূমপানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। তিমিরকে শাসন করার কেউ নেই। সে এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। সিগারেট ধরিয়েই বিহুকে দেখতে পেয়েছিল।
বিহু সেক্টর মার্কেটে ঢুকল না। ডান দিকে যে রাস্তাটা পাহাড়ের দিকে গেছে সেটা ধরল। আরব সাগর আর পশ্চিমঘাট পাহাড়ের মাঝের এক ফালি জায়গায় নতুন মুম্বাই শহরতলী, রেলওয়ে লাইনের পশ্চিমে মধ্যবিত্ত মানুষজনের জন্য সারি সারি সিডকোর বাড়িঘর, পাহাড় কেটে বানানো খানকতক প্রাইভেট সোসাইটি, পার্ক, খেলার মাঠ। পশ্চিমঘাট পাহাড় এই নোডটাকে যেন একদম কোলে করে বসে আছে।
একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে বিহুর পিছন পিছন হাঁটছিল তিমির। এদিকটায় লোক চলাচল কম। ফিরে দেখলে বিহু হয়তো চিনতে পারবে। দেখল বিহু একটা বাংলো বাড়ির গেট ঠেলে ঢুকল। দু’-মিনিট অপেক্ষা করে তিমির এগোল। কাছে গিয়ে দেখল গেটের পিলারের গায়ে পাথরের ফলকে নাম লেখা রয়েছে - নিরাশ্রয় নিকেতন। গেটের সামনে একজন সিকিউরিটি গার্ড চেয়ারে বসে ঢুলছিল। তাকে ঠেলা দিয়ে তুলে জিজ্ঞেস করল কার বাড়ি, মালিক কে? সে এক চোখ খুলে জানাল বাড়িটা একটা অনাথ আশ্রম। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বলে দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না, ভিতরে অনেকটা খোলা জায়গা, গাছপালা। গেট থেকে একটা পাথরে বাঁধানো রাস্তা গিয়ে উঠেছে বাংলোর সিঁড়িতে। ক’ধাপ সিঁড়ি ভেঙে রেলিং ঘেরা বারান্দা, পার হয়ে ঘর, জানলায় আলো জ্বলছে। বিহুকে কোথাও দেখতে পেল না।
দু’-তলা বাংলোর ডানদিকে একটা পুকুর, জল চিকচিক করছে। এ তল্লাটে প্রাকৃতিক জলাশয় কম, স্যুইমিং পুল বেশি। বাংলোটা তৈরি হওয়ার সময় পুকুরটা হয়তো ওখানেই ছিল। বাংলো যিনি বানিয়েছিলেন, পুকুর বুজিয়ে তার ওপর প্রাসাদ গড়তে চাননি। পুকুরটাকে নিজের মত থাকতে দিয়েছেন। তাঁর বিষয়বুদ্ধি কম ছিল বোধহয়, না-হলে কি আর এত বড় প্রপার্টি অনাথাশ্রমকে দান করে দেন! তিমির ফিরে আসছিল, একটা রিনরিনে গলার ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। দেখল বন্ধ লোহার গেটে গাল ঠেকিয়ে একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাটা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল - আঙ্কল, চলে যাচ্ছ? ভিতরে আসবে না?
তিমির জবাব দিল - অন্য এক দিন আসব রে, আজ নয়।
বাচ্চাটা গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, “গড প্রমিস!”
তিমির ঝুঁকে পড়ে তার হাত ছুঁল, হেসে বলল, “জেন্টলম্যানস প্রমিস!”
২
মা বলেছিল, “খুঁতো মেয়েকে বিয়ে করিস না তিমির।”
দিদি বলেছিল, “তোর জামাইবাবু খোঁজ নিয়েছে, ওই ধরনের দাগ সারে না। তোদের ছেলেপুলেরও যদি… ”
বলতে বলতে থেমে গিয়েছিল। তিমিরের পছন্দ-অপছন্দ আলাদা করে সেভাবে কেউ জানতে চায়নি। সম্বন্ধ করে বিয়ে। ছেলের মতামতের দাম সব থেকে কম। যে পিসি সম্বন্ধটা এনেছিল তিনিও হাত উল্টে বলেছিলেন, “আগে জানলে কি আর বলতুম? ভাগ্যিস…”
সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিহুর সঙ্গে তিমিরের বিয়ে না হওয়াটাই সঙ্গত। সেই কথা বিহুর বাবা-মাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা স্বভাবতই খুশি হননি। বিহুর মা দু’কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। দুটো পরিবারের মধ্যে নির্মীয়মাণ সেতুটা ভেঙে পড়েছিল। একমাত্র তিমিরের বাবাই কিছু বলেনি। চুপ করে ছিল। চুপ করে থাকতে থাকতেই বাবা চিরকালের মত চুপ করে গেল। সেও হয়ে গেল বছর চারেক।
ওই ঘটনার পর বিহু আর যোগাযোগ করেনি। হয়তো অভিমান করেছিল। তিমিরও প্রথম দিকে ফোন করেনি, সঙ্কোচে। ফোন করে কী বলবে? একটা অপরাধবোধ তৈরি হয়েছিল মনের মধ্যে। কাউকে না জানালেই পারত। বিয়ের পর লোক জানাজানি হলে তখন দেখা যেত। একটা মেসেজ করেছিল, সাধারণ মেসেজ, বিহু কেমন আছে, ইন্টার্নশিপ কেমন চলছে ইত্যাদি। বিহু জবাব দেয়নি। মাস ছয়েক পর, ব্যাপারটা থিতিয়ে গেলে একদিন অফিস থেকে বিহুর নম্বর ডায়াল করেছিল। ফোন বেজে বেজে থেমে গিয়েছিল, বিহু ধরেনি।
তিমিরের অনুশোচনা হয়েছিল। যে মেয়ে অনায়াসে বুক খুলে দেখায়, কতখানি আঘাত পেলে সে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়! বিহুর বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করার সাহস হয়নি। অফিস কেটে দু’জনে চেম্বুরে ডায়ামন্ড গার্ডেনের কাছে একটা চাইনিজ রেস্তরাঁয় আড্ডা দিতে যেত মাঝেমাঝে। বিহু চাইনিজ খেতে ভালবাসত। একদিন দুপুরে সেখানে গিয়ে বসল। অবচেতনে বোধহয় আশা ছিল বিহুও তার মত মনখারাপ করে সেদিন ওই রেস্তরাঁয় এসে বসবে। স্তিমিত হলুদ আলোর মধ্যে ওয়েটার খাবার এনে দিয়েছিল, চিলি চিকেন, হাক্কা নুডল… বিস্বাদ লাগল, মুখে তুলতে পারল না। প্লেট সরিয়ে রেখে, বিল মিটিয়ে উঠে পড়েছিল।
দিদি বোধহয় ভাইয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিল। জোর করেনি কখনও। কিন্তু মা আবার মেয়ে দেখতে শুরু করেছিল। তিমির মাকে বলেছিল, “এত তাড়াহুড়োর কী আছে? একটু গুছিয়ে নিতে দাও। তারপর না-হয়...”
মা বলেছিল, “তোর ভালর জন্যই…”
তিমির বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “অনেক হয়েছে। আর আমার ভাল দেখে কাজ নেই।”
মায়ের গোঁসা হয়েছিল। মেয়ে দেখায় সাময়িক ক্ষান্তি দিয়েছিল। তারপর তো বাবা চলে গেল। ওলট-পালট হয়ে গেল সব। মা এমনিতেই সাজগোজ করতে খুব ভালবাসত। বাবার মৃত্যুর পর ব্যাপারটা মানসিক রোগে দাঁড়িয়ে গেল। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে সারাদিন আয়নার সামনে বসে থাকত। চুল বাঁধত, আবার খুলে ফেলত। নতুন করে বাঁধত। গালে রং, চোখে কাজল লাগিয়ে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকত। তিমির ঘরে ঢুকলে জিজ্ঞেস করত, “কেমন দেখতে লাগছে রে আমায়?”
বয়সের ছাপ পড়ছিল মায়ের মুখে। গালের চামড়া শিথিল হয়ে গাঢ় দাগ কেটে বসছিল ঠোঁটের দু’পাশে। মায়ের প্রশ্নের কী উত্তর দেবে তিমির ভেবে পেত না। অবশ্য মা তিমিরের উত্তরের অপেক্ষা করত না। আবার আয়নার দিকে ফিরে বসে নিজেকে নিরীক্ষণ করত। তিমির সারাদিন অফিসে থাকে। দিদি নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। মাকে সারাদিন দেখাশুনো করার জন্য একজন কাজের লোকের দরকার হয়ে পড়েছিল। দিদি কোন এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে আয়া লাগিয়েছিল। কিন্তু মা কোনও বাইরের লোককে সহ্য করতে পারত না। গালাগালি করত, ভাতের থালা ছুড়ে ফেলে দিত। কোনও আয়া টিঁকত না।
মুম্বাইয়ের বৃষ্টি বড় সাংঘাতিক। মেঘেদের দল আরব সাগর থেকে উঠে এসেই পশ্চিমঘাট পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়ে, বিরামহীন, বিশ্রামহীন। দু’-তিন মাস সূর্যের মুখ দেখা যায় না। বছর দুয়েক আগে এক বর্ষার সন্ধ্যায় তিমির অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখেছিল, সদর দরজা হাট করে খোলা, মা নেই। পুলিশে খবর দিয়েছিল। পুলিশ খুঁজে বার করতে পারল না। এক সপ্তাহ পরে মায়ের বডি পাওয়া গেল পাহাড়ের নিচে একটা নালার মধ্যে। হাইওয়ে পার হয়ে মা যে কেন পাহাড়ের দিকে চলে গিয়েছিল কে জানে? পাহাড়ের গায়ে একটা দেবী মন্দির আছে। হয়তো সেই মন্দিরে যাওয়ার জন্য পাহাড়ে চড়তে গিয়েছিল। ক্যাচমেন্ট এরিয়ায় বেশি বৃষ্টি হলে আচমকা পাথর ফাটিয়ে জল নেমে আসে। পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে আসা জলের তোড়ে নালায় ভেসে গিয়েছিল সম্ভবত।
সেই থেকে তিমির একদম একাবোকা হয়ে গেছে। রোজ বাড়ি থেকে অফিস যাওয়া আর অফিস থেকে বাড়ি ফেরা, এই গতানুগতিক যাতায়াতের মধ্যেই জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। অফিস পার্টি এড়িয়ে যায়। বাড়ি ফিরে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকে। দিদির বাড়ি যায় কালেভদ্রে, আচারে অনুষ্ঠানে। অনেকদিন পর গত সপ্তাহে কৌশিকের বাড়ি গিয়েছিল, বারবার যেতে বলেছিল বলে। সমস্যা হয় ছুটির দিনগুলোয়। কী করে সময় কাটাবে বুঝতে পারে না। যেমন আজকে, সকালে ঘুম থেকে উঠে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখেছিল ঝকঝকে একটা দিন। অথচ কোথাও যাওয়ার নেই। পরমুহূর্তে মনে পড়ে গেল, আছে একটা জায়গা। একটা বাচ্চা ছেলেকে যাবে বলে ‘প্রমিস’ করেছিল, নিরাশ্রয় নিকেতনে, পাহাড়ের নিচে পুকুর পাড়ে নির্জন একটা বাংলোয়।
সকালের জলখাবার খেয়ে বেরোতে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গেল। জানুয়ারি মাস, অল্প ঠান্ডা পড়েছে ক’দিন। ছুটির সকালে আড়মোড়া ভেঙে শহরতলী জাগছে। দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। নতুন মুম্বাইয়ের নোডগুলোর মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি নয়। বাস কিংবা অটো রিক্সা ধরে চট করে পৌঁছে যাওয়া যায়। অটো নেওয়ার আগে লোকাল বেকারিতে ঢুকে একটা বড়সড় চকোলেট কেক কিনল তিমির। যেখানে যাচ্ছে খালি হাতে যাওয়া সমীচীন হবে না।
মিনিট পনেরো লাগল নিরাশ্রয়ে পৌঁছতে। আজকে গেটের সামনে অন্য একজন সিকিউরিটি গার্ড। তিমির তাকে জানাল, সে অনাথ আশ্রমের অফিসে যেতে চায়। গার্ডটি তিমিরের হাতের প্যাকেটের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে গেট খুলে দিল। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল বারান্দার এক ধারে অফিস। আশ্রমের অফিসে একজন সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক বসে ছিলেন। তিমিরের পরিচয় পেয়ে হাত ধরে চেয়ারে বসালেন। বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে জেনে খুশি হলেন। তাঁর ব্যবহার দেখে মনে হল তিমির যেন কতকালের চেনা। ভদ্রলোকের নাম কমলেশ বড়ুয়া। আসামের লোক, বাংলা বলতে পারেন। নিজেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জানালেন, বছর তিনেক হল আশ্রমটা খুলেছে, সাতজন বাচ্চা আছে, বয়স সকলেরই দশের নিচে। যে সংস্থা অনাথ আশ্রম চালায় তাদের লোকবল কম। মানুষজন স্বেচ্ছায় আসেন, কাজকর্মে হাত লাগান বলেই আশ্রম চালানো সম্ভব হয়। কমলেশবাবু নিজেও একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। আশ্রমে কাজ কম নেই, তিমিরও চাইলে যুক্ত হতে পারে।
তিমির একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “বিহু মানে অদিতি মিত্র নামে কোনও মেয়ে আসে কি?”
কমলেশবাবু আশ্চর্য হয়ে বললেন, “আপনি বিহুকে চেনেন? আসে বৈকি।”
কথায় কথায় জানালেন, বিহুরা চেম্বুরে কমলেশবাবুদের প্রতিবেশী ছিল। বিহুকে ছোট থেকে বড় হতে দেখছেন। মেয়েটা পাখির মত উড়ে উড়ে বেড়াত। বিয়ের কথা চলছিল। হঠাৎ একদিন কী হল ঘর থেকে বেরনো বন্ধ করে দিল। সারাদিন মুখ কালো করে বসে থাকত, কলেজ যেত না। বিহুর বাবা-মা মনোরোগ বিশেষজ্ঞর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। লাভ হয়নি। শেষে কমলেশবাবু বিহুকে টেনে নিয়ে এসে সংস্থার কাজে লাগিয়ে দিলেন। বিহু এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। তবু মন্দের ভাল, ডিগ্রিটা শেষ করেছে। নিয়মিত আশ্রমে আসে, রান্নাবান্নায় হাত লাগায়, বাচ্চাগুলোর সঙ্গে খুনসুটি করে, জোর করে পড়তে বসায়। তারা বিহু আন্টি বলতে অজ্ঞান।
তিমির বারান্দার দরজা পার হয়ে অফিসঘরে ঢুকেছিল। উলটো দিকে আর একটা দরজা, আশ্রমের ভিতরে যাওয়ার জন্য। লক্ষ করেনি সেই দরজায় ভিড় জমছিল। কমলেশবাবু বাচ্চাগুলোকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। তারা সন্ত্রস্ত পায়ে এসে কাছে এসে দাঁড়াল। কমলেশবাবু হিন্দিতে বললেন, “আঙ্কেল তোমাদের জন্য কেক এনেছে। খাবে তো?”
তারা হেসে ঘাড় নাড়ল। তিমির দেখল আগের দিন যে ছেলেটার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেও রয়েছে ভিড়ের মধ্যে। তিমির হাত বাড়িয়ে তার চুল ঘেঁটে দিল, বলল, “কী রে চিনতে পারলি না?”
ছেলেটার নাম বিড্ডু, তার মুখ উজ্জ্বল হল। এগিয়ে এসে তিমিরের আঙুল ধরে বলল, “আঙ্কেল, এসেছ? আজ আর তোমায় ছাড়ছি না। আমাদের সঙ্গে সারাদিন থাকতে হবে। তুমি লুকাছুপি খেলতে জান?”
তিমির মনে মনে বলল, জানি না আবার! গত পাঁচ বছর ধরে তোদের বিহু আন্টির সঙ্গে সেই খেলাটাই তো খেলছি। মুখে অবশ্য বলল, “জানি না তো। আমায় শিখিয়ে দিবি?”
বিড্ডু বলল, “এ মা এত বড়ো হয়ে গেছ, লুকাছুপি খেলতে জান না?”
ছেলেগুলোর সঙ্গে ভিতরে যেতে যেতে তিমির দেখল নিরাশ্রয় নিকেতনের লোহার গেট ঠেলে বিহু ঢুকছে।
৩
তিমির বাচ্চাপার্টির সঙ্গে পুকুর ধারে বসে ছিল। একটু আগে ভাগ করে কেক খাওয়া হয়েছে। লনে, ঘাসের ওপর বসে তিমির ওদের গল্প শোনাচ্ছিল, স্নো হোয়াইট আর সাত বামনের রূপকথা। বিড্ডু আঙুল গুনে বলল, “দেখো আঙ্কেল, আমরাও সাতজন।”
তিমির বলল, “আরেহ্ তাই তো!”
দেখল বিহু ওদের দিকে হেঁটে আসছে। কাছে এসে বাচ্চাগুলোকে বলল, “তোদের ভাত খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ভিতরে আয়।”
বাচ্চাগুলো বলল, “গল্পটা শুনেই আসছি।”
বিহুর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তিমির হাত নাড়ল। বিহু মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। বিহু তিমিরকে চিনতে চাইছে না। যেন আগে কোনওদিন দেখেনি।
গল্প শেষ করে তিমির বিড্ডুকে বলল, “তোরা পুকুরে নেমে সাঁতার কাটিস না?”
বিড্ডু বলল, “না গো, আমরা সাঁতার জানি না যে। বিহু-আন্টিও জানে না।”
তিমির বলল, “বাংলোর পাশেই পুকুর, কখন টুপ করে জলে পড়ে যাবি, সাঁতার শিখে রাখা উচিত। আমি শনি-রবিবার এসে শিখিয়ে যাব। দাঁড়া, কমলেশদাকে বলছি।”
বাচ্চারা হৈ হৈ করে উঠল। জলে নামতে পারবে, হুল্লোড় করতে পারবে সেই ভেবেই তারা আহ্লাদে আটখানা হল।
তিমির বিহুকে একা পেল দুপুরবেলা। বাচ্চারা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ার পর। কমলেশবাবু চেয়ারে বসেই ঢুলছিলেন। তিমির দেখল বিহু বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বিহু ঘাড় ফিরিয়ে বলল, “তুমি কি বাচ্চাগুলোকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাও?”
“কী যে বলো!” তিমির এক মুহূর্ত থেমে বলল, “ভুল করেছিলাম বিহু। শুধরে নেওয়ার সুযোগ দেবে না?”
“তুমি নয়, ভুল আমি করেছিলাম। আজও তার মাশুল দিচ্ছি,” বিহু ঘাড় নাড়ল।
তিমির চুপ করে রইল। কী বলবে? আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও অজুহাতই খুঁজে পেল না।
বিহু বলল, “দেখো, অনেক কষ্টে নিজেকে গুছিয়ে তুলেছি। তোমায় আমি চিনি। তুমি আবার সব নষ্ট করে দেবে,” কথা বলতে বলতে কখন দু’জনে বারান্দা থেকে নেমে এসেছিল নিজেরাই জানে না। পুকুরের পাড় ঘেঁষে হাঁটছিল। পায়ের কাছে অযত্নের ঝোপঝাড়। কোনকালে পাড় বাঁধানো হয়েছিল, ভেঙে পড়েছে। জলের দিকে তাকিয়ে তিমির বলল, “শাস্তি আমিও কম পাইনি বিহু। তোমার কাছ থেকে দূরে গিয়ে বুঝেছি তোমায় ছাড়া বেঁচে থাকা কতটা কষ্টকর।”
“কেন মিথ্যে বলছ?” বিহুর গলার কাছে দলা পাকাচ্ছিল। তিমির বলল, “বিশ্বাস করো। কতবার তোমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছি…”
বিহু নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিল না। কান্নাভেজা গলায় বলল, “তুমি চলে যাও তিমির। আর কোনও দিন ফিরে এসো না।”
তিমির ভাবল বিহুকে সময় দেওয়া দরকার। একদিনে কি সব পাপের স্খালন হয়? বলল, “তুমি বলছ বলে চলে যাচ্ছি। কিন্তু ফিরে যে আসব না, সে কথা দিতে পারছি না। তোমায় দেখার ইচ্ছে হলে আবার এখানে চলে আসব।”
তিমির বিহুকে ছেড়ে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল। ‘ঝুপ’ করে একটা শব্দ শুনল। পিছন ফিরে দেখল বিহু নেই। যেখানে দাঁড়িয়ে দু’জনে কথা বলছিল সেখানে এসে গলা তুলে ডাকল, “বিহু...”
একটা ভারী কিছু পড়ার জন্য পুকুরের জলে অনর্গল বৃত্ত তৈরি হচ্ছে। পরিধিতে বাড়ছে। পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও গাছের ডাল ভেঙে পড়ল? নাকি বিহু অসাবধানে পা ফসকে জলে পড়ে গেছে? অথবা এমন তো নয় তিমির কথা শোনেনি, ফিরে আসবে বলেছে বলে বিহু জলে ঝাঁপ দিয়েছে? পাগলি মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যায় না! তিমির শঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে ডাকল, “বিহু-উ… বিহু-উ…” কেউ সাড়া দিল না। বিড্ডু বলছিল বিহু সাঁতার জানে না। তিমির দেখল বিহুর ওড়নাটা জলে ভাসছে। তিমির আর কিছু না ভেবেই জলে ঝাঁপ দিল।
জল খেলে মনে হয় শরীর ভারী হয়ে যায়। টেনে-হিঁচড়ে বিহুর শরীরটাকে পাড়ে তুলতে তিমির হিমশিম খেয়ে গেল। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে কমলেশবাবু, আশ্রমের অন্য দু’একজন কর্মচারী এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বাচ্চাগুলোও ঘুমচোখ মুছতে মুছতে এসে দাঁড়াচ্ছিল। তিমির বিহুকে চিত করে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিল। তার চোখ বন্ধ। নিথর শরীর। নাকের কাছে আঙুল নিয়ে পরীক্ষা করে দেখল শ্বাস পড়ছে কি পড়ছে না বোঝা যাচ্ছে না।
মুখে মুখ লাগিয়ে বিহুর মুখে পাঁচবার নিজের ফুসফুস থেকে শ্বাস ভরে দিল তিমির। তারপর বিহুর ঘাড় অল্প কাত করে দুই হাত জড়ো করে বিহুর বুকে চাপ দিতে শুরু করল। দশ-পনেরো বার চাপ পড়তেই গলগল করে খানিকটা জল বেরিয়ে এল তার নাক-মুখ দিয়ে। বুকের ওঠাপড়াও শুরু হল। বিহু চোখ মেলে তাকাল।
বাচ্চাগুলো এতক্ষণ আতঙ্কে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবার উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। বিহু কাশতে কাশতে উঠে বসল। কমলেশবাবু পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “জলে কী করে পড়ে গিয়েছিলি? সাবধানে চলাফেরা করবি তো? কিছু হলে তোর বাবা-মাকে কী জবাব দিতাম বল তো?”
দু’জনের পোশাক ভিজে জবজব করছে, তিমির বিহুর হাত ধরে বলল, “উঠতে পারবে? শুকনো জামাকাপড় আছে সঙ্গে? ভিতরে গিয়ে বদলে নাও। কমলেশদা, ওকে একটু গরম দুধ খাওয়াতে পারলে ভাল হত।”
বিহুর মাথা টলছিল। কোনও মতে তিমিরের হাত ধরে আশ্রমের ভিতরে গিয়ে একটা ডিভানে এলিয়ে পড়ল। আশ্রমের একজন মহিলা কর্মচারী এসে একটা টাওয়েল দিয়ে তার ভিজে চুল, গা-হাত-পা মুছিয়ে দিল। গায়ের ওপর একটা কম্বল টেনে দিল। গরম দুধ খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নেওয়ার পর বিহুর অনেকটা সুস্থ লাগল। ভিজে পোশাক বদলে এসে বসল। তিমিরের জামা গায়েই শুকোল। কমলেশবাবু তিমিরকে বললেন, “আমার আজ ফিরতে দেরি হবে। সন্ধেবেলা এক ভদ্রলোক আসবেন দেখা করতে। কিঞ্চিৎ ডোনেশন পাওয়ার আশা আছে। তুমি বিহুদের বাড়ি চেনো নিশ্চয়ই। বিহুকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবে?”
তিমির জবাব দেওয়ার আগেই বিহু বলল, “আমি নিজে চলে যেতে পারব।”
কমলেশবাবু শুনলেন না, বললেন, “তোকে আর পাকামি করতে হবে না। তিমির ছেড়ে দিয়ে আসবে বাড়ির দোরগোড়া পর্যন্ত।”
রেডিও ক্যাবের পিছনে বসে তিমির বিহুর হাত ধরল। বিহু গাড়ির জানলার দিকে চেয়ে বলল, “বাঁচালে কেন?”
তিমির বলল, “না-হলে আমার বেঁচে থাকার দরকার ফুরিয়ে যেত যে।”
বিহু বলল, “স্বার্থপর, কেবল নিজের কথাই ভাব।”
তিমির নিঃশব্দে হাসল। বিহুর হাতে চাপ দিল। বিহু বলল, “আমার বুকের দাগটা কিন্তু এখনও আছে। একটু বেড়েছেও। ওষুধ খেয়ে, মলম লাগিয়ে কোনওমতে আটকে রেখেছি। দাগটা সারা শরীরে ছড়িয়ে গেলে তখন আর আমার দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করবে না।”
তিমির হাতের বেড় দিয়ে বিহুকে কাছে টানল, “তুমি হলে আমার প্রিন্সেস স্নো হোয়াইট। পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর মেয়ে। অনেক কষ্টে তোমায় পেয়েছি। সারা জীবন তোমাকে আমার চোখের মধ্যে ধরে রাখব। দাগের ভয় দেখিয়ে আর আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারবে না।”
বিহু তিমিরের বুকে মাথা রাখল।
অসমাপ্তি
মুম্বাই নিবাসী প্রথিতযশা সাহিত্য-সেবক শ্রী তিমিরবরণ পাল এতক্ষণ মঞ্চে বসে গল্প পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন। গল্প শেষ করে দর্শক শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই নাগরিক রূপকথাটি এখানেই সমাপ্ত হল।”
উপস্থিত বাঙালি ক্লাবের সদস্য এবং অন্যান্য অভ্যাগত অতিথিরা সবাই করতালি দিয়ে তাদের মুগ্ধতা জ্ঞাপন করল। আমরা কয়েকজন প্রবীণ সাহিত্যিকের গুণমুগ্ধ নবীন অক্ষরকর্মী সামনের দিকে বসেছিলাম। এই সাহিত্য সভাটা ক্লাবের পক্ষ থেকে আমরাই আয়োজন করি। নবীনদের স্বভাবই হল বেহিসাবি কথা বলা। আমার পাশ থেকে এক ইয়ার্কিবাজ বন্ধু হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, “তিমিরদা, গল্পটা কি সত্য ঘটনা অবলম্বনে?”
গল্পের নায়কের নাম যদি লেখকের নামের সঙ্গে মিলে যায়, সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু জনসমক্ষে প্রশ্নটা করা বোধহয় ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করে। সভায় তিমিরবাবু সস্ত্রীক নিমন্ত্রিত ছিলেন। তিমির-গৃহিণী প্রথম পঙক্তি থেকে পিছন ফিরে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালেন। দেখলাম তাঁর দৃষ্টিতে ভর্ৎসনা আর বিরক্তি। সামান্য বেদনাও কি লেগে ছিল? তিমিরবাবু অবশ্য বিচলিত হলেন না। মৃদু হেসে বললেন, “ভাল মনে করিয়ে দিয়েছ। গল্পটা ছাপানোর জন্য পাঠাবার আগে নিচে লিখে দেব - সব ঘটনা কাল্পনিক। বাস্তবের কোনও সংশ্রব পেলে কাকতালীয় ভেবে নিতে হবে।”