রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দ: পত্রের দর্পণে
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। উনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। রামানন্দ বাঁকুড়ার পাঠক-পাড়ার সন্তান, রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ঠাকুরবাড়ির প্রতিভা। বাঁকুড়া জেলা স্কুলে পড়ার সময় অঙ্কের শিক্ষক কেদারনাথ কুলতীর আকর্ষণে রামানন্দ ব্রাহ্মধর্ম বিষয়ে আকৃষ্ট হন, স্থানীয় ব্রাহ্মমন্দিরে সাপ্তাহিক উপাসনায় যোগ দিতে শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের বিখ্যাত নেতা, পিতৃসাহচর্যে রবীন্দ্রমানসে ব্রাহ্মধর্মাদর্শ সঞ্চারিত হয়। রামানন্দ এন্ট্রান্স ও এফ.এ. পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখার পর প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে আসেন, বি.এ. পড়ার সময় বিভিন্ন ব্রাহ্মনেতার সঙ্গে পরিচয় ঘটে এবং শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হন। ১৮৮৯-তে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন, ১৯১০-এ ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সম্পাদক হন, এবং ১৯২২-এ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সভাপতি। এরপর সিটি কলেজে অধ্যাপনা, ব্রাহ্মসমাজের ইংরেজি মুখপত্র ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার নামক সাপ্তাহিকের সম্পাদনা--তারপর ইন্ডিয়ান মিরর, সঞ্জীবনী পত্রিকার সঙ্গে যোগ ঘটে। মানব সেবা ও জীবে প্রেম আদর্শে রামানন্দ ‘দাসী’ পত্রিকাও সম্পাদনা করেন, তবে স্বল্পকাল। এরপর এলাহাবাদ যাত্রা, কায়স্থ পাঠশালার অধ্যক্ষতা, এবং ‘প্রদীপ’ পত্রিকা ও ‘কায়স্থ সমাচার’ পত্রিকার সম্পাদনায় যুক্ত হন। ‘শিশু পত্রিকা’ ‘মুকুল’ স্থাপন করেন, সম্পাদক অবশ্য শিবনাথ শাস্ত্রী। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ প্রথাগত স্কুল কলেজ শিক্ষায়, ইংল্যান্ডে শিক্ষার্জনে আগ্রহ দেখাননি, যদিও গৃহশিক্ষকের কাছে দাদাদের কাছে বহু বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথ বালক, ভারতী, সাধনা প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদনায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, পরিণত বয়সেও এ প্রয়াস অব্যাহত। ব্রাহ্মসমাজ চালনা, ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা, ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা, বিভিন্ন ব্রাহ্মব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলাপ রবীন্দ্রজীবনে ছিল। রামানন্দ ইংরেজি কাগজ মডার্ন রিভিউ প্রকাশ করেন, হিন্দী পত্রিকা ‘বিশাল ভারত'–ও সম্পাদনা করেন, লীগ অফ নেশনস কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে ইউরোপ যান। বাংলা ভাষায় অর্থনীতি আলোচনার সূত্রপাতের কৃতিত্ব তাঁর। রামানন্দের কর্ম প্রণোদনা নানা ধরনের। তিনি নিজস্ব ব্রেইল প্রথার উদ্ভাবক। এলাহাবাদ প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের মূল সভাপতি, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, সেকেন্ডারি এডুকেশন রিফর্ম কমিটির সদস্য, নির্ভীক সাংবাদিকতা, ভারতীয় পদ্ধতি অনুসারে চিত্রকলার প্রকাশ প্রভৃতি--এ-বিষয়ে কয়েকটি উল্লেখমাত্র। রবীন্দ্রনাথের কর্মোদ্দীপনার প্রধান দিক নানাবিধ সাহিত্যরচনা, ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন, বিশ্বভারতী স্থাপন ও মুক্তশিক্ষা প্রচলন, শ্রীনিকেতন মারফৎ নানাবিধ কুটির-শিল্প রচনা। একসময় শিলাইদহ, পতিসর প্রভৃতি অঞ্চলে জমিদারি পরিচালনা, ধর্মগোলা ও সমবায় স্থাপন করেছেন। পাঠ্যপুস্তক রচনা ও শিক্ষাদর্শগত নব্যতার ধারণা প্রচার ও প্রয়োগ, নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন, গ্রামীণ সংস্কৃতির বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতা, জলাশয় সংস্কার, চাষবাসের শ্রীবৃদ্ধিতে উৎসাহদান প্রভৃতিতে তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকা বহু আলোচিত হয়েছে। ১৮৯৭ সালের ডিসেম্বরে রামানন্দ ‘প্রদীপ’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা ছিল, নাম— ‘প্রবাসী’। এছাড়া বেরিয়েছে—অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসুর প্রতি, বিদায়, প্রভৃতি কবিতা। নেপালচন্দ্র রায় এবং যোগেশচন্দ্র বাগল দুজনেই বলেন প্রদীপ পত্রিকার সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দের সাক্ষাতের সূচনা ঘটে। রামানন্দ-কন্যা শান্তাদেবী বলেন—‘প্রদীপের যুগ হইতে প্রবাসীর যুগ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সহিত রামানন্দের আলাপ আলোচনা চলিত, দুইটি কাগজেই কবিতা প্রভৃতিও প্রকাশিত হইত।’ লেখালিখি ছাড়াও যোগসূত্রের আর এক কারণ ব্রাহ্মধর্ম। রামানন্দ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত, ‘ধর্মবন্ধু’ এবং ‘মেসেঞ্জার’ যে-দুটি কাগজের তিনি সম্পাদক ছিলেন সে দুটিই ব্রাহ্মসমাজের। রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন এবং বিবাহ দুটিই ব্রাহ্মসমাজপদ্ধতি অনুসারে ঘটেছিল। এই দুই মহাত্মার জীবনাদর্শ ছিলেন রামমোহন রায়। দুজনেরই চিন্তাজগৎ আধ্যাত্মিক ভাবধারায় পরিপূর্ণ। রামানন্দ রবীন্দ্রনাথকে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সম্মানিত সভ্য করার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেন। তাছাড়া ব্রাহ্মসমাজের কোনও উৎসব বা স্মৃতিসভা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে রামানন্দ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার আয়োজন করেন। কোনো কোনো আলোচকের মতে ‘জীবনের আদর্শের বিচারে, রামমোহনের প্রতি ভক্তির বিচারে রামানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারা অভিন্ন।’ তবে ভিন্নতাও ছিল যেমন—স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারে, মাদকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে, নানা সংঘ, পরিচালনায়। মডার্ন রিভিউ-তে Mr. Lehar Singh Mehta বলেন— ‘The friendship between Mr. Chatterjee and Tagore was conspicuous ... They were as inseparable as Castor and Pollex or Dr. Johnson and Boswell or David and Jonathon.' (১৯৪৩-সালের কোনো একটি সংখ্যায়) রামানন্দবাবু রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে The Golden Book of Tagore নামে একটি বিরাট বই সম্পাদনা করে রবীন্দ্রনাথের প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রদ্ধার ডালি রচনা করেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ এই উচ্চ আদর্শবাদী, কঠোর পরিশ্রমী রামানন্দবাবুকে আশ্রম বিদ্যালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন কিছুকালের জন্য এবং 'রবীন্দ্রনাথের বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদের অনুপ্রেরণা এসেছিল প্রথম রামানন্দের কাছ থেকেই’। রবীন্দ্রনাথ বলেন—‘এই প্রতিষ্ঠানের বাল্যদশা থেকে রামানন্দবাবু যেভাবে এর প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর পত্রিকাগুলির মধ্য দিয়ে চেষ্টা করে গিয়েছেন, তার ঋণ পরিশোধ করবার নয়। .... চিরকালই প্রবাসী, মডার্ন রিভিউকে শান্তিনিকেতনের প্রধান মুখপত্র বলে লোকে জেনে এসেছে’। রামানন্দ রবীন্দ্র বাংলা গ্রন্থের হিন্দী অনুবাদের অধিকার বিশ্বভারতীকে দেন, মুক্তধারা বইটি বিশ্বভারতীকে উপহার দেন স্ব-ইচ্ছায়। রবীন্দ্র অবমাননা দেখলেই রামানন্দ তার বিরোধিতা করে লিখতে কখনও কুন্ঠিত হননি। রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দ দুজনেই দুজনের ব্যক্তিগত নানা সমস্যা বিনিময় করেছেন। ২/১ টি উদাহরণ দেওয়া যাক — (ক) ‘মাতা শান্তার শরীর এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয় নাই শুনিয়া দু:খবোধ করিতেছি — তাঁহার এই অস্বাস্থ্যের জন্য আমাদের আতিথ্য যদি কোনো অংশে দায়ী হয় তবে সে আমার পক্ষে অত্যন্ত পরিতাপের কথা’। (রবীন্দ্রনাথ রামানন্দকে, ২৩ মে, ১৯১১)লেখা প্রবাসী বা মডার্ন রিভিউকে দেওয়া না-দেওয়া সম্পর্কে রামানন্দ একদা অভিমান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রতি। তার উদাহারণ — ‘আমি আপনার লেখা পাইবার জন্য কখনও কাড়াকাড়ি করি নাই। ... অতএব আপনার নিকট আমার বিনীত প্রার্থনা এই যে, আপনি অত:পর আমাকে বাংলা বা ইংরেজী কোন লেখা দিবেন না। আমি জানি, আপনার লেখা না পাইলে আমার কাগজ দুটির গৌরব হ্রাস পাইবে।’ রবীন্দ্র রচনা কোন্ পত্রিকায় যাবে, কোন্ পত্রিকায় যাবে না এ নিয়ে সেক্রেটারিরা অনেক সময় পরামর্শ দিতেন কবিকে। সেই সব নিয়ে অভিমান। রবীন্দ্র রচনা ও তার মূল্যায়ন নিয়ে দুজনের পারস্পরিক কিছু মতামত চিঠিপত্রে পাওয়া যায়। যেমন — (ক) অজিতেরই লেখার অনুবৃত্তিরূপে এই জীবনস্মৃতির উপযোগিতা কতকটা পরিমাণে আছে। (রবীন্দ্র, ২৭ মে ১৯১১)তাছাড়া আছে অন্য লেখকদের রচনা সম্পর্কে মতামত। যেমন — (ক) শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের (বিদ্যাসাগর) প্রবন্ধটি সুগম্ভীর চিন্তাপূর্ণ — পাঠ করিয়া যথার্থ উপকার পাইলাম বলিয়া ধারণা হয়। নগেন্দ্রবাবুর গল্পটি অত্যন্ত মনোরম হইয়াছে। ইহার মধ্যে তাঁহার অসামান্য ভাষা নৈপুণ্য এবং প্রতিভা স্ফূর্তি পাইয়াছে’। (রবীন্দ্র, ১৮৯৮)কখনও আছে পত্রিকা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পরামর্শ। যেমন — (ক) হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রবন্ধটি ছাপার পর চার পয়সা দামে বিক্রয় করলে ‘খরচটা বিক্রয়ের মূল্য হইতে তুলিয়া লইতে পারিবেন’। (খ) এনাটোল ফ্রাঁসের একটি বক্তৃতা ইহাতে (নেশন পত্রিকা) বাহির হইয়াছে তাহা Modern Review তে উদ্ধৃত করিবার যোগ্য। রামানন্দ লেখেন — ‘আপনি প্রবাসীকে crush করিবার ষড়যন্ত্রে কাহারও সহিত যোগ দিবেন, ইহা অসম্ভব — কাল আপনাকে তাহা মৌখিক বলিয়াছি। রামানন্দ জানান — আমার কাগজ দুখানার সম্পাদকীয় কতক ভার বুবার উপর পড়িয়াছে। ভবিষ্যতে আরও বেশী করিয়া পড়িবে। সে প্রতি বৎসর মডার্ন রিভিয়্যুর চারিটা বিশেষ সংখ্যা বাহির করিতে চায়।'আছে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় সম্পর্কে পরামর্শ— (ক) নূতন ছাত্রদের বেতন কুড়ি টাকা করা সম্বন্ধে একবার আলোচনা করিয়া দেখিবেন এবং পুরাতন ছাত্রদের অভিভাবকদের কাছেও একবার দরবার করিবার কথা ভাবিয়া দেখিবেন।রবীন্দ্রনাথ এবং রামানন্দ দুজনেই ভারতবর্ষীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে সচেতন ছিলেন, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের মতামত ছিল সদৃশ। যদিও একথাও স্বীকার্য তাঁরা দুজনেই কেউই রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। কয়েকটি উদাহরণ হাজির করা যাক। রবীন্দ্রনাথ রামানন্দকে লিখছেন — (ক) ‘আমাদের বিদ্যালয়ের পরেও এতদিন পরে গোপনে রাজদণ্ডপাত হইয়াছে। হঠাৎ পূর্ব্ববঙ্গের রাজকর্মচারীদের ছেলেরা বিদ্যালয় হইতে সরিতে আরম্ভ করিতেছে। .... এই প্রকার ভীরু প্রণালীতে প্রজাদের সমস্ত হিত চেষ্টাকে দলন করিবার উদ্যোগের মত এমন হীনতা এবং দীনতা কি আছে। .... গবর্মেন্টের এই গুপ্ত ছুরির আঘাতে কি পরিমাণে আমাদের রক্তশোষণ করিতে পারে তাহা আর কিছুদিন গেলে বুঝিতে পারিব’। (৯ নভেম্বর, ১৯১১) রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা অবশ্য বহুবিধ প্রবন্ধ, ভাষণ ইত্যাদিতে আছে। এই রামানন্দ রবীন্দ্র পত্রাবলী তার পরিপূরক মাত্র। এই পত্র দুই মনীষীর চিন্তা চেতনার প্রতিফলক। একদা রবীন্দ্রনাথ রামানন্দকে লেখেন — ‘আমাকে ভুল বুঝবেন না, বুঝলে অন্যায় হবে। কারণ প্রবাসীর প্রতি মমত্ব ও আপনার প্রতি শ্রদ্ধাবশতই আমি অনেক কঠিন বাধার সঙ্গে লড়াই করে এসেচি’। (১০ মে, ১৯২৬) অন্যদিকে রামানন্দ লেখেন — ‘আপনি আমাকে বন্ধু মনে করেন, ইহা আমার পরম সৌভাগ্য ও গৌরব’। (১ জুলাই, ১৯২৭) এই পারস্পরিক বন্ধুত্ব, আদর্শ রক্ষায়, কর্মব্রতে পরস্পরের পাশে দাঁড়ানো থেকে দুজনে শুধু উপকৃত হননি, দেশবাসীও উপকৃত হয়েছে, পথ নির্দেশ পেয়েছে। এই উভয় সম্পর্কের গভীরতর অনুধাবন আজও যোগ্য কোনো গবেষকের অপেক্ষায় আছে। তথ্যসূত্র : চিঠিপত্র (খণ্ড ১২) : রবীন্দ্রনাথের পত্র রামানন্দ পরিবারের সঙ্গে এবং রবীন্দ্রনাথকে লেখা পত্রাবলী।
অলংকরণঃ উইকিপেডিয়া থেকে
পরবাস, ২২শে শ্রাবণ, ২০১৬
|