চিত্ররেখাডোর ও রবীন্দ্রনাথ

মাদের বাঙালিদের নিয়ে, বলা উচিত ছিল মস্ত, কিন্তু বলব মর্মান্তিক সমস্যা হল এই যে তারা যে কোন অভিব্যক্তির মধ্যেই একটা গল্প খোঁজে; আর সেই গল্প-মৃগয়া থেকে তারা রবীন্দ্রনাথ নামক সিংহশাবককেও বাদ দেয় না। সুতরাং অন্তত তাঁর সার্ধশতবর্ষে এমন একটা গুজব চালু হল যে তিনি চিরনূতনের পথিক বলেই চলচ্চিত্র নামের মাধ্যম-টিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন নির্দ্বিধায়। প্রথমত, এই দাবি সত্যি নয়। দ্বিতীয়ত, যদি মেনেও নেওয়া যায় তাহলেও দেখব রবীন্দ্রনাথের চলমান চিত্রমালা সম্পর্কিত অনুমান খুব আখ্যানুগামী নয় বরং আখ্যান অতিরিক্ত। ভাষাশিল্পী হিসেবে আজীবন-ই তিনি বিমূর্ততার পথিক; আমরা তাঁকে অনুপুঙ্খে গল্পের কথক হিসেবে ভাবতে চেয়েছি। 'ক্ষুধিত পাষাণ'-এ গল্প আর কতটুকু, একটু ইশারা, বাকিটা তো শব্দের অবিশ্রান্ত রহস্যযাত্রা। একমাত্র বাঙালিই পারে এই গল্প থেকে সুচারু প্লট আবিষ্কার করে উত্তম সৌমিত্রের গলায় সংলাপ বসিয়ে দিতে। 'ক্ষুধিত পাষাণ' রবীন্দ্র আখ্যান নিয়ে ছবি হতে পারে কিন্তু কোনক্রমেই রাবীন্দ্রিক নয়।

এই যে রবীন্দ্রনাথ লেখেন — 'লহো লহো করুণ করে॥' — এই বাক্‌প্রতিমাকে আমরা কিভাবে চলচ্চিত্রীয় প্রতিমায় রূপান্তরিত করব। ইংরেজ কবি এজরা পাউন্ড ও তাঁর সহযোগীরা ভাবতে চেয়েছিলেন ভিক্টোরিও রক্তহীন রোমান্টিকতা পরিহার করে ইমেজকে বস্তুনিষ্ঠ করা যাবে কি না। এই 'ইমেজ অবজেক্টিভিটি' প্রসঙ্গে তাঁর মনে হয়েছিল জাপানি হাইকুর কথা। কি অলৌকিক সমাপতন যে, রবীন্দ্রনাথ সে বছরই, সেই ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে হাইকু আঙ্গিকের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় প্রীতি ঘোষণা করেন। 'জাপানযাত্রী'তে তাঁর ছোট্ট মন্তব্য : 'জাপানি পাঠকের মনটা চোখে ভরা' আর রবীন্দ্রনাথ যে-তিনটি হাইকুর উল্লেখ করেছেন, তার একটিকে তেরো বছর বাদে চলচ্চিত্রতত্ত্বের প্রায় বিধাতাপুরুষ সের্গেই আইজেনস্টাইন ব্যবহার করবেন মন্তাজ সংক্রান্ত আলোচনায় — 'পচা ডাল/ একটা কাক/শরৎকাল'। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে যা 'রিক্ততা ও ম্লানতা'র ছবি, সেটাই আইজেনস্টাইনের মতে দ্বন্দ্ব-রচিত অনন্য সমাধান, সৌন্দর্যের সংহত মন্তাজ। রবীন্দ্রনাথ হয়তো বিশ শতকের শুরুতে সিনেমাকে প্রত্যাশিত গুরুত্ব দেননি; তখন সাহিত্যের কোন মহারথীই বা দিয়েছিলেন? না জয়েস, না প্রুস্ত, না গোর্কি। এমনকী ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে হলিউডের নটী মেরি পিকফোর্ডের জন্য জনসাধারণের উন্মাদনায় বিরক্ত বোধ করেছিলেন। আসলে রবীন্দ্রনাথের স্বভাবের আভিজাত্য এ ধরনের হুজুগ অনুমোদন করত না। তাঁর উপজীব্য ছিল যুথীগণের দীর্ঘশ্বাস, রাত্রির সরোবর অথবা তরুণীর রক্তকপোল যেখানে রহস্য। যথাযথ প্রতিচিত্রণের প্রতি তাঁর আগ্রহ থাকার কথা নয়। তিনি ঈর্ষাবোধ করেন সেই যুগের জন্য — 'যে যুগে রিপোর্টার ছিল না, মানুষ খবরের কাগজ বের করেনি। তখন মানুষের ভুলে যাওয়ার স্বাভাবিক শক্তি কোনো কৃত্রিম বাধা পেত না।' বিশ্বাসযোগ্য তথ্যে উদাসীন আর্টিস্ট সেখানে যেতেও পারে কিন্তু কোনো ক্যামেরাম্যানের সাধ্য নেই সেই স্বর্গোদ্যানে প্রবেশ করেন — 'দ্বারে দেবদূত দাঁড়িয়ে আছে জ্যোতির্ময় খড়গ হাতে।' সুতরাং রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করতে হয় আলোকচিত্রের নান্দনিক সম্ভাবনায়।

তবু এমন তো নয় যে তাঁর সর্বতোমুখী প্রতিভা চলচ্চিত্র বিষয়ে কোনো মৌলিক দিগন্ত উন্মোচন করেনি। সম্ভবত গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের ফরাসি চলচ্চিত্রের মতো তাঁর উপাস্য ছিল আলোর সূত্রে প্রকাশিত অনুভূতির ছন্দ। পুত্র রথীন্দ্রনাথকে তিনি জানিয়েছেন— 'সিনেমাতে আছে রূপের সঙ্গে গতি; সেই সুযোগটিকে যথার্থ আর্টে পরিণত করতে গেলে আখ্যানকে নাচে দাঁড় করানো চলে।' একইসঙ্গে আমরা মনে করতে পারি শিশির ভাদুড়ীর ছোট ভাই মুরারিকে লেখা তাঁর চিঠির গহন জিজ্ঞাসা— 'সুরের চলমান ধারায় সঙ্গীত যেমন বিনাবাক্যেই আপন মাহাত্ম্য লাভ করতে পারে তেমনি রূপের চলৎ প্রবাহ কেন একটি স্বতন্ত্র রসসৃষ্টি রূপে উন্মেষিত হবে না?' আমাদের খেয়াল করতেই হয় রবীন্দ্রনাথ চলচ্চিত্রের ভাষার সন্ধানে নৃত্য ও সঙ্গীতের দরজায় করাঘাত করছেন কিন্তু সাহিত্যপন্থা তাঁকে মোটেই প্ররোচনা দেয় না বরং তিনি মুরারিকে আক্ষেপ করে জানান— 'সাহিত্যের দাসত্ব বস্তুত ছায়াছবিকে আত্মমর্যাদাহীন করে চলেছে—তার কারণ কোন রূপকার, আপন প্রতিভার বলে তাকে দাসত্ব থেকে উদ্ধার করতে পারেননি।'

স্পষ্ট করেই আমি বলব, সাহিত্য বলতে এখানে রবীন্দ্রনাথ কাহিনি বোঝাচ্ছেন আর কাহিনি নির্ভরতা যে শিল্পের বাস্তবতাকে ভাষার কারাগার থেকে দূর নীলিমা ও নিবিড় সৈকতে অন্যরকম স্বাধীনতায় উৎকীর্ণ করে দিতে পারে না, এ বিষয়ে তিনি স্থির প্রত্যয়। রবীন্দ্রনাথ হয়তো বাংলা সিনেমার শব্দযুগ শুরু হওয়ার পরেও কতিপয় চলচ্চিত্র দেখেছিলেন কিন্তু সৌজন্য স্বীকৃতির বাইরে মুগ্ধতার কোনো পরিসর খুঁজে পাননি। প্রশ্ন উঠবে তাহলে রবীন্দ্রনাথ চলমান চিত্রমালার মধ্যে কোন সত্য দেখতে চেয়েছিলেন? দেখা যাবে, আজ চলচ্চিত্র সংস্কৃতি বলতে হলিউডির আধিপত্য এতটাই নিরঙ্কুশ যে ছবির সারাৎসার বলে পরিগণিত হয় আদিমধ্যঅন্ত্যযুক্ত আখ্যানভাগ। অন্যভাবে, অন্য আকারে যে সিনেমার কথা ভাবা যায় তা প্রায় অলীক মনে হয়। অথচ গত শতাব্দীর শুরুতে ফরাসি 'প্রথম তরঙ্গ' ও জার্মান অভিব্যক্তিবাদ তো চিত্রভাষাকে আলোর কারুবাসনা বলেই ভাবতে চেয়েছিল। যখন রবীন্দ্রনাথ মিলটনের 'পিওর ইথেরাল স্ট্রিম' শব্দগুচ্ছের অনুসরণেও আলোকচিত্রীর কাজকে আলোর সঙ্গে প্রণয়লীলা বা আলোকস্তোত্র বলেন তখন বোঝা যায় তিনি ফরাসি ধরনেই চাইছেন সিনেমা কাহিনির মুখোশ খুলে ফেলে সত্যের আলোকিত মুখ দেখাক। 'পুনশ্চ' কাব্যগ্রন্থে যখন তিনি লেখেন— 'কায়ামুক্ত ছায়া আসবে আলোর বাহুর হাত ধরে/ তোমার দৃষ্টি উৎসবে।' তখন বুঝতে পারি প্রাচ্যের এই আলোকসামান্য দ্রষ্টা পাশ্চাত্যে তাঁর সংখ্যালঘু সহকর্মীদের মতোই চেয়েছেন চলচ্ছবির জন্য বিকল্প এক অনুভূতির উদ্বোধন। সোভিয়েত নির্বাক চিত্রমালা, ফরাসি বিম্বধর্মিতা কিংবা জার্মান অভিব্যক্তিবাদের সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব। মার্কিন পুঁজিবাদ যেহেতু পর্দাকে মনে করে ও করাতে চায় জীবনের ছদ্ম প্রতিস্থাপন রবীন্দ্রনাথের সেহেতু আগ্রহ থাকে না সুগোল ও সুসমাপ্ত বাস্তবতার অবরোহী সংগতিতে। বাজার-চালু সিনেমার ইতিহাস এজন্যই ধরতে পারে না যে চলচ্চিত্র সবাক হল কি নির্বাক থাকল — রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তা বড় কথা নয়। তিনি স্বদেশে ক্রমাগত দেখে যেতে থাকলেন সুকাহিনির নামে পুঞ্জ পুঞ্জ সংলাপের স্তূপ — তাতে তাঁর উৎসাহের কোনো কারণ ছিল না। ছোটবেলায় যে দিন জল পড়েছিল ও পাতা নড়েছিল সেদিন থেকেই তিনি জানেন— 'সে আনন্দ বিশুদ্ধ কেন না সে নির্বস্তুক।' চলচ্চিত্রে সাহিত্যের যে নকলনবিশি রবীন্দ্রনাথের ঘোর অপছন্দের; সিনেমাতেও যা ভাষাজন্মের প্রতিবন্ধক তা দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলা ছবিতে রবীন্দ্রনাথকে বোঝার অন্তরায়। অধিকাংশ পরিচালক রবীন্দ্রসাহিত্যের, বলা ভালো গল্পাংশের ভীরু অনুগমন করেন ফলে যা আমরা পাই তা আংশিক 'অনুবাদ' কিন্তু পুনরাবিষ্কারের সৌন্দর্য নয়। যখন পৃথিবীতে ছবি প্রথম দেখানো হবে তার কয়েকমাস আগে 'মানভঞ্জন' নামক গল্পে রবীন্দ্রনাথ জনপরিসরের দেখা সম্পর্কে একটি মন্তব্য করেছিলেন— 'চারিদিকে এবং চিরকাল যেরূপ দেখিয়া আসিতেছি এ একেবারে হঠাৎ তাহা হইতে অনেক স্বতন্ত্র।' দুঃখের হলেও সত্যি যে, দৃষ্টির এই সংগঠন অদ্যাবধি সত্যজিৎ ও ঋত্বিকের দু'একটি নির্মাণ ছাড়া অন্যত্র উপস্থিত নয়। ঋত্বিকের 'সুবর্ণরেখা' রবীন্দ্রনাথের অসমাপ্ত 'শিশুতীর্থ' প্রকল্পটিকে ভিন্ন স্তরে ভাবতে চায়, 'চারুলতা'তে অপর দৃষ্টিকোণ থেকে একটি নারীকে আঁকার প্রয়াস আছে। কিন্তু তাঁর অন্যান্য উত্তর সাধকেরা মোটামুটিভাবে শাস্ত্রীয় উপাচারের সঙ্গে এতটাই যুক্ত যে আমাদের মনে হয় রবীন্দ্রনাথ নামক মুক্তধারা আজও অভিশপ্ত : চলচ্চিত্র তাকে কাহিনির জটাজালে বন্দী করে রেখেছে।


(প্রবন্ধটি ২০১৫ সালে রামপুরহাট কলেজে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে পঠিত)


এই লেখা আপনাদের কেমন লাগল?

Subscribe for updates to Parabaas:



©Parabaas 1997 - 2017. All rights reserved.