শান্তিনিকেতনে চিন ও জাপান
ঊনবিংশ শতাব্দীর ছয়-এর দশকের প্রথমদিকে একদিন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর চলেছিলেন বীরভূম জেলার রায়পুর জমিদারবাড়িতে তাঁর বন্ধু সিংহ-পরিবারের আমন্ত্রণে। যাবার পথে অতিক্রম করতে হত ভুবনডাঙার মাঠ। সেই মাঠে গাছপালা বিশেষ ছিল না। অনেকখানি শূন্যতার বিস্তারের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল একটি ছাতিম গাছ। দেবেন্দ্রনাথের মনের মধ্যে একটা আকর্ষণ তৈরি হল জায়গাটির জন্য। জমি কিনে নিলেন সিংহ পরিবারের কাছ থেকে; ছোটো একটি বাড়ি তৈরি করে নাম দিলেন ‘শান্তিনিকেতন’। ক্রমে সেখানে গড়ে উঠল আশ্রমের মতো একটি আবাস। প্রথমেই কোনো বিদ্যালয়ের পরিকল্পনা করা হয়নি। স্থির হয়েছিল মাঝে মাঝে দেবেন্দ্রনাথ সেখানে গিয়ে বিশ্রাম গ্রহণ করবেন; সৎ প্রসঙ্গ ও ধর্ম-আলোচনা হবে। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখে বুধবার সেখানে উপাসনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শান্তিনিকেতন আশ্রমের শুরু হল এভাবেই। প্রতি বছরই ব্রহ্মোৎসব অনুষ্ঠিত হত। রবীন্দ্রনাথ নিয়মিতই আসতেন। ক্রমে স্থানীয় দরিদ্র অধিবাসীদের খাওয়ানো ও বস্ত্র বিতরণ করা শুরু হল সেই উৎসবে। ছোটো করে মেলা আয়োজিত হতে লাগল ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে। মেলায় বসত যাত্রা-গানের আসর। তখনও কিন্তু বিদ্যালয়ের কোনো পরিকল্পনা ছিল না কারও মনে। বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব ওঠে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবার কথা ভাবতে থাকেন। শেষপর্যন্ত শান্তিনিকেতনের একাদশতম বাৎসরিক উৎসবে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয়ের উদ্বোধন হয়। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল — তা হল লেখাপড়ার সঙ্গেই সংগীত চর্চা, ছবি আঁকা এবং বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছিল একেবারে প্রথম থেকেই। তখনও ‘শান্তিনিকেতন’ নামের আশ্রমিক বিদ্যালয়টি ‘বিশ্বভারতী’ নামের বিশ্ববিদ্যাচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠেনি। তখন থেকেই শান্তিনিকেতনে চিন ও জাপান থেকে ছাত্র, শিল্পী ও কারিগরেরা আসতে শুরু করেছিলেন। এই অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ থেকে। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পরেও, একুশ শতক পর্যন্তও অব্যাহত আছে সেই প্রবাহ।
এসবের আগেই ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ওকাকুরা ভারতে এসেছিলেন ভারতের বৌদ্ধ তীর্থগুলি দেখবার জন্যে; অপর উদ্দেশ্য ছিল স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। এদেশে এসে ভগিনী নিবেদিতা এবং বাংলার শিক্ষিত সমাজ, সেই সঙ্গে দেশব্রতী বিপ্লবী তরুণদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। নিবেদিতাই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ওকাকুরার পরিচয় করিয়ে দেন। ওকাকুরা-র সঙ্গে সংযোগের ফলেই জাপান এবং পূর্ব-এশিয়া সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কৌতূহল জাগে। গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাছ থেকে প্রাচ্যের শিল্পকলা বিষয়ে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ওকাকুরা যখন ভারতে এসেছিলেন তখনও শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয় ভালোভাবে শুরু হয়নি। কিন্তু তিনি দেশে ফিরে গিয়ে জাপান থেকে একাধিক শিল্পী এবং ছাত্রকে ভারতে, বিশেষ করে জোড়াসাঁকোতে পাঠিয়েছিলেন। সেই সূত্রেই শান্তিনিকেতনে জাপান থেকে প্রথম ছাত্র এসেছিলেন শিতোকু হোরি (Hori Yoshinovih, ১৮৭৬ - ১৯০৩)। তিনি আশ্রমে পরিচিত ছিলেন হোরি সান নামে। শান্তিনিকেতনের প্রথম বিদেশি ছাত্র তিনিই। ওকাকুরা কাকুজো তাঁকে পাঠিয়েছিলেন।
তখনও শান্তিনিকেতনে তেমনভাবে বিদ্যালয়-শিক্ষা শুরু হয়নি। হোরি সান জাপান থেকে এরপর শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন এক দারুশিল্পী। তাঁর নাম কুসুমতো সান (Skusumato San)। জাপান থেকে বিদ্যার্জন ছাড়াও কারিগরি শিক্ষা এবং বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প শেখবার জন্য ভারতে ছাত্ররা আসতেন। তাঁদের অনেকেই আসতেন শান্তিনিকেতনে। জোড়াসাঁকো এবং শান্তিনিকেতনে ওকাকুরা-র সংযোগ-সূত্রে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদেরই একজন ছিলেন কাঠের কাজের কারিগর কুসুমতো। তিনি পৌঁছেছিলেন সরাসরি শান্তিনিকেতনে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ। অল্পদিনই তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন কিন্তু সেই সময়ের মধ্যেই ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিবাহ হয়েছিল কলকাতায়। পাত্রী এসেছিলেন জাপান থেকে। এটি একটি বিশেষ ঘটনা। কুসুমতো শেখাতেন কাঠের কাজ, সেই সঙ্গে শেখাতেন জুজুৎসু। এখানে উল্লেখযোগ্য, রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের আবাসিকদের, বিশেষ করে মেয়েদের শরীরচর্চার প্রশিক্ষণ দেবার কথা ভেবেছিলেন। সেই সূত্রে জাপানের এই জুজুৎসু — যা শিক্ষা করলে খালি হাতে আত্মরক্ষা করা সহজেই সম্ভব হয় তা তিনি শেখাতে চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে মেয়েদের। জুজুৎসু-বিদ্যায় জাপানের পারদর্শিতা সর্বাধিক। সেখান থেকেই এই শারীর-বিদ্যা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। জাপান থেকে যাঁরা শান্তিনিকেতনে আসতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন চার গোত্রের মানুষ। প্রথম, সাধারণ ছাত্র যাঁরা শিখতেন প্রধানত ইংরেজি ও বাংলা। দ্বিতীয়, বৌদ্ধধর্ম ও শাস্ত্র সম্পর্কে চর্চা ও আদান-প্রদানের জন্য আসতেন অনেকে। তৃতীয়, চিত্রশিল্পীরা বিশেষ আগ্রহের সঙ্গে আসতেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথ — দুইজনই ছিলেন জাপানি চিত্রকলার অনুরাগী। চিত্র-শিল্পীদের সঙ্গেই অন্য কারুশিল্পীদেরও ধরা যায়। চতুর্থ, জাপান থেকে শান্তিনিকেতনে এসেছেন একাধিক শরীরচর্চার শিক্ষক। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পাবার ফলে বিশ্বে তাঁর পরিচিতি অনেকটাই বৃদ্ধি পেল। বিশেষ করে এশিয়াতে এশিয়া-বাসী রূপে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর খ্যাতি। ওকাকুরা জাপান থেকে চিত্রশিল্পীদের এবং কারুশিল্পীদের আগেও পাঠিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব-সম্মান অর্জনের পর আরও বৃদ্ধি পেল এই যাওয়া-আসা। জাপানের চিত্রশিল্পী কাম্পো আরাই (Kampo Arai) কলকাতায় এসেছিলেন ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নভেম্বর। তিনি একটানা শান্তিনিকেতনে থাকেননি তবে মাঝে মাঝে শান্তিনিকেতনে গেছেন, কলকাতায় থেকেছেন; পুরী, কোনারক, রাঁচিতেও গেছেন। তিনি ছিলেন ওকাকুরা প্রতিষ্ঠিত জাপানের শিল্পসভার সদস্য। রবীন্দ্রনাথের জাপান ভ্রমণের সময় (১৯১৬) তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কলকাতায় এবং শান্তিনিকেতনে আসতে আমন্ত্রণ জানান। এ দেশের চিত্রশিল্পীদের জাপানি পদ্ধতির চিত্রঙ্কন-বিদ্যার সঙ্গে পরিচয় করানো ছিল রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য। কাম্পো আরাই-এর সঙ্গে এসেছিলেন আরও দুইজন সঙ্গী — কাতায়ামা এবং তাঁর জাপানি পাচক তাজিমা। কাম্পো আরাই লিখে গেছেন ভারতভ্রমণ সংক্রান্ত এবং দিনপঞ্জি। সেই দিনপঞ্জি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আর এক জাপানি রবীন্দ্র-অনুরাগী মনীষী কাজুও আজুমা। ‘ভারতভ্রমণ দিনপঞ্জি’ নামে এই নাতিদীর্ঘ ভ্রমণকথাটি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৩-এ প্রকাশিত। তাঁর এই দিনপঞ্জি থেকে জানা যায় যে, শান্তিনিকেতনের বৃক্ষলতা-শোভিত পরিবেশ এবং ছাতিমতলা তাঁকে মুগ্ধ করেছে। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে পৌষ মেলার সময়ও তিনি ছিলেন। মেলা দেখে তাঁর খুব ভালো লেগেছিল। দিনপঞ্জি থেকে জানা যায় কাম্পো আরাই কলকাতা ও শান্তিনিকেতন ছাড়াও পুরী, কোনারক রাঁচি এবং দার্জিলিং গিয়েছিলেন। বৌদ্ধধর্ম ও চিত্রকলা উভয় আকর্ষণেই তিনি গিয়েছিলেন অজন্তা গুহা পরিদর্শনে। চিত্রশিল্পী কাম্পো আরাই কলকাতায় বসেই জাপানি চিত্রাঙ্কন বিদ্যার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, সুরেন্দ্রনাথ কর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। খানিকটা পাঠ নিয়েছিলেন প্রতিমা দেবী, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মুকুল দে। এইভাবে জাপানের শিল্পরীতি ভারতীয় শিল্পচর্চা ও চিত্রাঙ্কন পদ্ধতির সঙ্গে মিশ্রিত হবার সেতু তৈরি হয়েছিল। তার ফলে শান্তিনিকেতনের শিল্পকলা চর্চায় উন্মোচিত হয়েছিল এক নতুন দিগন্ত। জাপান থেকে এসেছিলেন প্রখ্যাত জাপানি দারুশিল্পী কিম্তারো কাসাহারা (Kim Taro Kasahara, ? – ১৯২৭)। তিনি প্রথমে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এসেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির কাঠের কাজ করবার জন্য। মাঝে মাঝে স্বদেশে ফিরে গেলেও তিনি প্রধানত কলকাতাতেই থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনের পাশেই বিভিন্ন ধরনের কারুশিল্প চর্চার জন্য শ্রীনিকেতন গড়ে তোলেন তখন তিনি কাসাহারাকে শ্রীনিকেতনের দারুশিল্প বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করেন। পত্নী ও দুই কন্যাসহ কাসাহারা ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে আসেন এবং সেখানেই অতিবাহিত করেন বাকি জীবন। শ্রীনিকেতন গড়ে তোলবার কাজে এল্ম্হার্স্ট-এর প্রধান সাহায্যকারী ছিলেন কাসাহারা। কাসাহারার প্রশিক্ষণদানের আর একটি ক্ষেত্র ছিল উদ্যান-চর্চা। উদ্যান-চর্চা যে একটি শিল্প তা জাপানের সংস্কৃতিতে এক দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য। উদ্যান-বিদ্যায় কাসাহারার অভিজ্ঞতা ও শিল্পবোধ ছিল অসাধারণ। শান্তিনিকেতনের বৃক্ষলতার বিন্যাসে যে শৈল্পিক পরিকল্পনা ছিল তা সম্ভব হয়েছিল কাসাহারার চেষ্টাতেই। বিশেষভাবে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাছ থেকে উদ্যান-চর্চার প্রেরণা পেয়েছিলেন। শ্রীনিকেতনে তিনটি বটগাছকে স্তম্ভের মতো ব্যবহার করে ভূপৃষ্ঠের অনেকটা ওপরে শূন্যে একটি কাঠের ঘর বানিয়েছিলেন কাসাহারা। নাম ছিল ‘গাছবাড়ি’। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪-এর গোড়ার দিকে কিছুদিন এই ঘরে মাঝেমাঝে বাস করেছেন। এই ঘরে বসে লেখা হয়েছিল ‘পূরবী’-র বেশ কিছু কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথের অনেক গান। ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যের পূর্ণাঙ্গ রূপ এই ঘরে বসেই দেওয়া হয়। এই ঐতিহাসিক ‘গাছবাড়িটি’ এখন আর নেই। কাসাহারা শান্তিনিকেতনকেই স্বদেশ করে নিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর শ্রীমতী কাসাহারা শ্রীনিকেতনের শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিম্তারো কাসাহারা শান্তিনিকেতনে জাপান থেকে অতিথি শিক্ষকরূপে এসেছিলেন কিন্তু শান্তিনিকেতন হয়ে উঠেছিল তাঁর নিজেরই ঘর।
শান্তিনিকেতনে আগত আর এক জাপানি যুবকের নাম ছিল হাসেগাওয়া দেনজিরো তিনি ভালো ছবি তুলতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ সহ শান্তিনিকেতনের বেশ কিছু আলোকচিত্র তিনি তুলেছিলেন। ফটোগ্রাফি অনেকটাই তাঁর জীবিকা ছিল। বিশেষভাবে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি তুলতেন। পর্যটন-বিভাগের সঙ্গেও স্বদেশে যুক্ত ছিলেন তিনি। ফটো তোলবার জন্য তিব্বতেও গিয়েছিলেন। স্বদেশে ফিরে গিয়ে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে দেনজিরো পর্যটন ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের ফটোগ্রাফি সংক্রান্ত সংস্থা গড়ে তোলেন।
সু সি মো স্বদেশে ফিরে এলেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে এবং অচিরেই চিনা আধুনিক কবিতার আন্দোলনে এক প্রধান ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠলেন। ‘ক্রেসেন্ট্ মুন সোসাইটি’- নামে সাহিত্যচর্চার জন্য তিনি এক সংগঠন স্থাপন করলেন ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে চিন ভ্রমণে গেলে সু সি মো দ্রুত তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সু সি মো যখন আমেরিকা ও ইংল্যান্ড-এ ছিলেন তখনই তিনি রবীন্দ্রনাথের নাম শোনেন এবং অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সাক্ষাতে তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রগাঢ় অনুরাগী হয়ে ওঠেন। সমগ্র চিন ভ্রমণে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী। অনেকসময় তিনি রবীন্দ্রনাথের দোভাষীর কাজ করেছেন। কারণ তিনি ভালো ইংরেজি জানতেন। চিনের যুবকদের পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানাবার আয়োজন করেছিলেন সু সি মো; ‘ক্রেসেন্ট মুন সোসাইটি’তে তিনি রবীন্দ্র সাহিত্য আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরই ব্যবস্থাপনায় ১৯২৪-এর ৮মে তারিখে বহু বিশিষ্ট অতিথির উপস্থিতিতে বেজিং-এর (তৎকালীন পিকিং) নর্ম্যাল ইউনিভার্সিটির প্রেক্ষাগৃহে রবীন্দ্রনাথের ৬৪-তম জন্মদিন উদ্যাপিত হয়। পরবর্তীকালে সু সি মো পিকিং এবং শিঞহোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অধ্যাপক হয়েছিলেন। চৈনিক দর্শনের ইতিহাস বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। পাশ্চাত্য রোম্যান্টিক কবিতার সঙ্গে চিনা কবিতার সংযোগে আধুনিক চৈনিক কবিতার অন্যতম পথিকৃৎ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ যখন চিন দেশ থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরে এলেন তখন তাঁকে নানাবিধ চায়ের সরঞ্জাম এবং চা উপহার দেওয়া হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে একটি চা-চক্রের প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার নামকরণ করেন সু সি মো-র নামে। এই চা-চক্রের জন্য রচিত রবীন্দ্রনাথের কৌতুকগীতি— “চা-স্পৃহ-চঞ্চল চাতকের দল” যথেষ্টই পরিচিত। সু সি মো ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবার জন্য শান্তিনিকেতন এসেছিলেন। শান্তিনিকেতনে বাস না করলেও চিন দেশে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আগ্রহ জাগিয়ে তোলবার কাজে সু সি মো গ্রহণ করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সু সি মো পিকিং-এর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা শুনবার জন্য বিমানযোগে যাত্রা করেছিলেন ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর। পর্বতশীর্ষের সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়াতে সেই বিমান ভেঙে পড়ে এবং বিমান চালকদের সঙ্গেই সু সি মো-র মৃত্যু হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র চৌত্রিশ। কবিরূপে সু সি মো-র খ্যাতি ইউরোপ ও আমেরিকায় বিস্তৃত। তাঁর অনেক কবিতা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। তাঁর স্মরণে কেমব্রিজ-এর কিংস্ কলেজে ক্যাম নদীর সেতুর নিকটে মার্বেল পাথর নির্মিত একটি স্মৃতি-প্রস্তর স্থাপিত হয়েছে। তার ওপর খোদিত আছে তাঁর কবিতার পংক্তি। সু সি মো শান্তিনিকেতনে একবার মাত্র এসেছিলেন কিন্তু চিন ও জাপানের যে মানুষদের মনে রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের বিশেষ স্থান ছিল সু সি মো ছিলেন তাঁদেরই একজন।
অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য এক চিনা বিদেশি অতিথি শান্তিনিকেতনে আসেন ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে। তান য়ুন-শান ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে শান্তিনিকেতনে এসে কাজে যোগ দিলেন। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন কয়েকজন চিনা ছাত্র। কিছুকাল পরেই অধ্যাপক তান অনুভব করলেন তাঁর এই শান্তিনিকেতন বাস দীর্ঘকালীন হতে চলেছে। তিনি দেশ থেকে আনিয়ে নিলেন পত্নী মাদাম তান এবং দুই শিশু সন্তান — পুত্র ও কন্যাকে। প্রথমে চিনা ভাষা শেখাতে শুরু করলেন। কিছুদিন পরেই শিখতে শুরু করলেন সংস্কৃত। চিনের বিভিন্ন পত্রিকায় ভারত, বিশেষ করে শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন ধারাবাহিকভাবে। তিন বছর শান্তিনিকেতনে কাটিয়ে কিছুদিনের জন্য স্বদেশে ফিরে গেলেন তিনি। বড়োমাপের স্বপ্ন দেখবার মতো মনের জোর ছিল তাঁর; ছিল নিজের কর্মশক্তির প্রতি আস্থা। তিনি দেশে ফিরে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে নানকিং-এ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘চিন ভারত সাংস্কৃতিক সঙ্ঘ’। এই সঙ্ঘের সহায়তায় তিনি কিছু অর্থ সংগ্রহ করলেন। সেই টাকা এবং কিছু মূল্যবান গ্রন্থ নিয়ে ১৯৩৪-এ আবার ফিরে এলেন শান্তিনিকেতনে। সম্ভবত তখনই তিনি স্থির করে নিয়েছিলেন যে, শান্তিনিকেতনই হবে তাঁর দ্বিতীয় স্বদেশ। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ আর তান য়ুন-শান-এর আন্তরিক চেষ্টায় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল বিশ্বভারতীতে প্রতিষ্ঠিত হল ‘চিনা ভবন’। বিশেষভাবে শুরু হয় চিনা ভাষা ও চৈনিক সংস্কৃতির চর্চা। প্রধানত সমস্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছিল অধ্যাপক তান-এরই সংগৃহীত অর্থে। পরে চিনা সরকার থেকে প্রাপ্ত অনুদানে গড়ে ওঠে চিনা ভবনের গৃহ এবং নির্মিত হয় আসবাব ইত্যাদি। ভবনটি সাজিয়ে তোলেন চিনা ছাত্র ও শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকরা। চিনা ভবনের দেওয়ালে নন্দলাল বসুর আঁকা রবীন্দ্রনাথের 'নটীর পূজা'র চিত্র সুপরিচিত। অধ্যাপক তান শান্তিনিকেতনকেই স্বগৃহ করে নিয়েছিলেন। তাঁর পুত্র ও কন্যা আশ্রমেই অন্য বালক-বালিকাদের সঙ্গে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর কন্যা তান ওয়েন বিশ্বভারতীর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধিকার করেছিলেন প্রথম স্থান। ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে শ্যামার ভূমিকায় বিশেষ প্রশংসা অর্জন করেছিলেন তিনি। শ্রীমতী তান ওয়েন পরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন দীর্ঘকাল। অধ্যাপক তান য়ুন-শান সম্পর্কে আরও বলবার কথা এই যে, বিশ্বভারতীর আর্থিক সাচ্ছল্য ছিল না বলে এই পরিবার নিজেদের খরচ চালাতেন নিজেরাই। স্বদেশে তাঁদের কিছু ভূ-সম্পত্তি ছিল — মাঝে মাঝেই তার কিছু কিছু বিক্রি করে দিতেন। পরে চিনদেশে সমাজতন্ত্রবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর সম্পত্তি সরকার থেকে অধিগ্রহণ করা হয়। তখন তাঁরা হয়ে যান সম্পূর্ণ নিঃসম্বল। সেই সময়ে বিশ্বভারতী থেকে তাঁকে কিছু পারিশ্রমিক দেওয়া হত। অধ্যাপক তান য়ুন-শান ১৯৭৮-এ বিশ্বভারতী থেকে অবসর গ্রহণ করে চলে যান বুদ্ধগয়ায়। সেখানে তিনি স্থাপন করেছিলেন ‘বিশ্ব বৌদ্ধ সঙ্ঘ’। অধ্যাপক তান ও তাঁর পরিবার শান্তিনিকেতনের জন্য তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বলা যেতে পারে। বিনিময়ে এই দেশ তাঁকে অল্পই দিয়েছে। আজ আমরা তাঁকে কেবল শ্রদ্ধাই অর্পণ করতে পারি। কালানুক্রমিকভাবে এর পরে আবার শান্তিনিকেতনে অতিথি এলেন জাপান থেকে। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি আমন্ত্রিত বক্তৃতা দেবার জন্য গিয়েছিলেন কানাডা, সেখান থেকে ফেরবার পথে গিয়েছিলেন জাপান। আগেও আমরা দেখেছি শান্তিনিকেতনে বিদ্যাচর্চা, সঙ্গীতকলা, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য, কারুশিল্প এবং বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সঙ্গে শরীরচর্চার বিষয়টিকেও উৎসাহ দিতেন রবীন্দ্রনাথ। জাপানের নিজস্ব শারীরিক কৌশল জুডো এবং জুজুৎসু দেখে রবীন্দ্রনাথ নতুন করে মুগ্ধ হলেন। জাপানের এক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কুনিহিকো ওওকুরা ছিলেন সংস্কৃতি-মনস্ক এবং আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত। তাঁকে রবীন্দ্রনাথ একজন যোগ্য জুজুৎসু শিক্ষককে শান্তিনিকেতনে পাঠাতে অনুরোধ করলেন। সেই ব্যবস্থা অনুসারে শিন্জো তাকাগাকি (Shinzo Takagaki, ১৮৯৩ – ১৯৭৭) শান্তিনিকেতনে এলেন ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে। তিনি ছিলেন খুবই যোগ্য ব্যক্তি — জুজুৎসু পদ্ধতির উপাধিপ্রাপ্ত চিকিৎসক। ভারতে আসবার আগে জাপানের নিপ্পন বিশ্ববিদ্যালয়ে জুজুৎসু শিক্ষক ছাড়াও তিনি ছিলেন এই বিষয়ের সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উপদেষ্টা সমিতির সদস্য, শান্তিনিকেতনে আসবার ঠিক আগের বছর ১৯২৮-এ অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে তাকাগাকি জুডো পদ্ধতির প্রথম প্রচলন করে এসেছিলেন। তাকাগাকি ছিলেন পেশাদার, কাজেই তাঁকে নিয়ে এসে শান্তিনিকেতনে রাখবার জন্য যে পারিশ্রমিক দিতে হত তা বিশ্বভারতীর আর্থিক সঙ্কটের সময় দেওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট ব্যয়ভার স্বীকার করেও দু-বছর তাঁকে শান্তিনিকেতনে রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক অভিপ্রায় ছিল যে, শান্তিনিকেতনের ছাত্ররা, বিশেষ করে ছাত্রীরা এই শারীরিক আত্মরক্ষণ কৌশল শেখে। সেই ১৯২৯-৩০-এ মেয়েদের নিরাপত্তা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের এই দূরদর্শিতা বিস্ময়কর বলে মনে হয়। প্রথম প্রথম মেয়েরা শিখতে একটু সঙ্কোচবোধ করত। পরে তা অনেকটাই কেটে যায়। কলকাতার নিউ এম্পায়ার মঞ্চে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের জুডো ও জুজুৎসু প্রদর্শন হয়। সেই উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’ গানটি রচনা করেছিলেন বলে শোনা যায়। শান্তিনিকেতনে দু-বছরের বেশি তাকাগাকি-কে রাখা যায়নি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ভারতে রাখার জন্য যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে বিধানচন্দ্র রায়-কে এবং সুভাষচন্দ্র বসু-কেও চিঠি লিখেছিলেন, যাতে কলকাতা কর্পোরেশন থেকে তাকাগাকি-কে কোথাও প্রশিক্ষক রূপে নিযুক্ত করবার ব্যবস্থা করা যায়। তখন বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র। সুভাষচন্দ্র বসুও কলকাতা কর্পোরেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সেই চিঠি লিখিত হয়েছিল শান্তিনিকেতন থেকে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল। মাত্র দু-বছরের পরিচিত এক জাপানি শরীরচর্চার শিক্ষককে বঙ্গদেশে ধরে রাখবার জন্য রবীন্দ্রনাথের ব্যাকুলতা আমাদের বিস্মিত করে। যদিও তাঁর এই চিঠির কোনো ফল হয়নি। সেই চিঠি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র ভবনে রক্ষিত আছে। শান্তিনিকেতনে দু-বছর কাটাবার পর ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে তাকাগাকি আফ্রিকায় চলে যান। ক্রমে জুডো শিক্ষকরূপে তিনি হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী। ব্রহ্মদেশ, আফগানিস্তান, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, জাভা, সুমাত্রা এবং তাইওয়ান-এ তিনি জুডোর প্রশিক্ষকরূপে ভ্রমণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, পেরু, মেক্সিকো এবং কিউবাতেও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন জুডো শেখাবার জন্য। শিন্জো তাকাগাকি জুডো শিক্ষার প্রকৌশল সম্পর্কে একটি গ্রন্থও লিখেছেন। তাকাগাকি-র পত্নী শ্রীমতী মারি হোসি ১৯৩০-এর নভেম্বর মাসে শান্তিনিকেতনে আসেন। শান্তিনিকেতনেই তাঁর পুত্রের জন্ম হয় ১৯৩১-এ। ছেলের নাম রাখা হয় ‘আকিরা’। এই শব্দের অর্থ ‘উজ্জ্বল সূর্য’। তাকাগাকি ও তাঁর পত্নী দুজনেই শান্তিনিকেতনকে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু আর্থিক অসুবিধার কারণেই তাঁরা শান্তিনিকেতনে থাকতে পারেননি। ঠিক চিনদেশ নয়, কিন্তু সন্নিহিত অঞ্চল মোঙ্গোলিয়া থেকে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু সন্ন্যাসী ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। তাঁর নাম গে-শে-থুব-তেন (Ge-She-Thub-Ten)। কোন সূত্রে তিনি এসেছিলেন বা তাঁর অন্য কোনো পরিচয় জানা যায় না। এক বছরের কিছু কম সময় তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন। পালি ও সংস্কৃত ভাষা বিষয়ে তিনি কিছু কিছু পাঠদান করতেন। প্রধানত তাঁর কাজ ছিল বিধুশেখর শাস্ত্রীর সহায়তায় ত্রিপিটকের বিষয়বস্তু তিব্বতি ভাষায় লিপিবদ্ধ করা। এই বিষয়টি আমাদের কিছু বিস্মিত করে। শান্তিনিকেতন কোনো ধর্মচর্চার প্রতিষ্ঠান ছিল না। কিন্তু মাঝে মাঝেই বৌদ্ধ ধর্ম ও বৌদ্ধ সাহিত্য অনুশীলনের জন্য ভিক্ষুরা শান্তিনিকেতনে আসতেন। তাঁদের মধ্যে চিন ও জাপান ছাড়াও তিব্বত ও সিংহলের বৌদ্ধরাও ছিলেন। অথচ ভারতে সারনাথ, বুদ্ধগয়া ও নেপাল-সীমান্তে বৌদ্ধ ধর্ম-চর্চাকেন্দ্র ও মঠ ছিল একাধিক। রবীন্দ্রনাথ এঁদের প্রতি আতিথেয়তা-পরায়ণ ছিলেন; পঠন-পাঠনের কাজের সঙ্গে তাঁদের যুক্ত করবার চেষ্টা করতেন।
কোসেৎসু ১৯৩২-এ আবার ভারতে আসেন জাপান সরকারের তরফে একটি কাজের ভার নিয়ে। শ্রীলঙ্কার ভিক্ষু ধর্মপাল সারনাথে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি বৌদ্ধ বিহার। সেই বিহারের প্রাচীরগাত্রে ফ্রেস্কো আঁকবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কোসেৎসু-কে। কিন্তু ফ্রেস্কো আঁকবার পদ্ধতি খুব ভালোভাবে তাঁর জানা ছিল না। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং শান্তিনিকেতনের কলাভবন থেকেই ফ্রেস্কো অঙ্কন-পদ্ধতি ভালোভাবে শিক্ষা করেন। পরে তিনি চিনা ভবনের দেওয়ালেও কয়েকটি ফ্রেস্কো এঁকেছিলেন।
খ্যাতনামা জাপানি সাহিত্যিক এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব য়োনে নোগুচি (Yonejiro Noguchi, ১৮৭৫-১৯৪৭) রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়েছিল ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে যখন রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার জাপানে গিয়েছিলেন। যদিও সেই যাত্রায় জাতীয়তাবাদী প্রবণতাকে রবীন্দ্রনাথ যে সমালোচনা করেছিলেন তা জাপানের অনেকের কাছেই সমালোচিত হয়েছিল। রাজতন্ত্রের দেশ জাপান বিশ শতকের প্রথমার্ধে সাম্রাজ্যবাদের নীতিকেই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হয়েছিলেন নোগুচি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কও নষ্ট হয়নি। রবীন্দ্রনাথ আবার যখন ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে জাপানে যান তখন কোনো কোনো সময়ে রবীন্দ্রনাথের ট্রেন-যাত্রার সঙ্গী হয়েছিলেন নোগুচি। এই সময়ে তিনি কবি ও কথাসাহিত্যিক রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। পশ্চিমি সাহিত্যভাবনার সঙ্গে জাপানি সাহিত্যের সংযোগ ঘটিয়েছেন। ১৯১৪ থেকে ১৯২০-র মধ্যে প্যারিস, বার্লিন, মস্কো ঘুরে এসেছেন। আমেরিকায় দিয়েছেন বক্তৃতা। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে নোগুচি-র রাজনৈতিক চিন্তার কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল। তিনি বামপন্থী মতাদর্শ সমর্থন করতে শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে সরোজিনী নাইডু এবং জাপান-প্রবাসী বাঙালি বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পরিচয় ছিল। নোগুচি কিন্তু বামপন্থী আদর্শে স্থিত থাকতে পারেননি। কিছুকাল পরে আবার তিনি জাপানের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রনীতির সমর্থক হয়ে পড়েন। তিনের দশকে, যখন সমগ্র বিশ্বে ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদের মধ্যে সংঘাত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তখন তিনি ফ্যাসিবাদের দিকেই অনেকটা সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। ঠিক এই সময়টিতেই ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের শেষে নোগুচি রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবার জন্যই শান্তিনিকেতনে আসেন। শান্তিনিকেতনে তাঁর যথোচিত সমাদরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বোলপুর স্টেশন থেকে তাঁকে শান্তিনিকেতনে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসেন রথীন্দ্রনাথ। আম্রকুঞ্জে সম্বর্ধনা জানানো হয়েছিল তাঁকে। অল্পদিন তিনি আশ্রমে ছিলেন। বিশ্বভারতীর সমস্ত বিভাগ পরিদর্শন করেছিলেন এবং জেনেছিলেন শান্তিনিকেতনের বিদ্যাচর্চা এবং প্রাত্যহিক জীবনচর্যার পদ্ধতি ও বৈশিষ্ট্য। নন্দলাল বসুর সঙ্গে ভারতীয় শিল্পকলা নিয়েও তাঁর আলোচনা হয়েছিল। জাপানে ফিরে গিয়ে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তিনি একটি ইংরেজি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-য়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মতাদর্শের সংঘাত শুরু হয় ১৯৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে। সাম্রাজ্যবাদী জাপান অতর্কিতে অপ্রস্তুত চিনকে আক্রমণ করে। চিন-এর উপর জাপানের আক্রমণ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেরই সমর্থন পায়নি। ভারতেও জাপান-বিরোধী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট তীব্র দুটি কবিতা লিখেছিলেন। একটি কবিতার সঙ্গে উদ্ধৃত ছিল যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি রূপে জাপানি সৈন্যদের বুদ্ধ মন্দিরে প্রার্থনা জানাবার সংবাদ। কবিতাকে এভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত করা রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হত না। কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। এই আক্রমণকে নিশানা করেই লেখা হয়েছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতা ‘চিন ১৯৩৮’, যার প্রথম পঙ্ক্তি — “জাপ পুষ্পকে ঝরে ফুলঝুরি জ্বলে হ্যাঙ্কাও / কমরেড আজ বজ্রকঠিন বন্ধুতা চাও”। রবীন্দ্রনাথ সেই সময় সর্বপ্রকার ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। আশ্চর্য এই যে, নোগুচি জাপানকে সমর্থন করেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথেরও সমর্থন প্রত্যাশা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। চিন-এর নেতা চিয়াং কাই শেক-কে সহানুভূতিসূচক পত্র লেখেন রবীন্দ্রনাথ। নোগুচি তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন; কিছু লেখালিখি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। তখন থেকেই নোগুচির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের দূরত্ব স্থাপিত হয়। নোগুচি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী অক্ষশক্তিকে সমর্থন করায় সম্পর্ক জোড়া লাগবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা শান্তিনিকেতনের পক্ষ থেকে নোগুচির বিরুদ্ধে কখনও কিছু বলা হয়নি। তাঁর প্রতি কোনো অশোভন আচরণও করা হয়নি। তিনি শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে যাবার পরেই বিশ্বভারতীতে সাতজন সহ-সভাপতির পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেই পদের নাম ছিল ‘প্রধান’। নোগুচি-কে একজন প্রধান করা হয়েছিল, তিনি সেই পদে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তও আসীন ছিলেন। এই ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দেই স্বল্প সময়ের জন্য চিন দেশ থেকে দুজন অতিথি শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। তবে তাঁরা শান্তিনিকেতনের টানে আসেননি, এসেছিলেন অনেকটাই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ একজন বিশ্ব বিশ্রুত আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। হেং চি তাও (Heng-chi Tao, ?-?)। তিনি ছিলেন চিন দেশের বিশিষ্ট পণ্ডিত। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ১১ অগাস্ট তিনি শান্তিনিকেতনে আসেন এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। চিনদেশে থাকতেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। ওয়াই অইসা (Y Aisa, ?-?) ছিলেন চিনদেশের আইনসভার সদস্য। তিনি এবং জাতি সংঘের চিনের প্রতিনিধি এফ. এল. ওজবেক (F. L. Ozbek) ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে শুভেচ্ছা সফরে ভারতে এসেছিলেন। তাঁরা জওহরলাল নেহরু-র সঙ্গে বোম্বাইতে সাক্ষাৎ করবার পর ডিসেম্বর মাসের চার-পাঁচ তারিখে শান্তিনিকেতনে এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
তাই চি তাও (Tai chi-Tao. ?-?) ছিলেন চিনের ব্যবস্থাপক সভার বিশিষ্ট সভাপতি এবং চিনের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সভাপতি। তাই চি তাও উপরন্তু চিনা-হিন্দু সংস্কৃতি সমাজেরও সভাপতি ছিলেন। তার আগে তিনি ছিলেন বিপ্লবী সান ইয়াৎ সেন-এর সহযোগী। তিনি রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী ছিলেন এবং নিয়মিত রবীন্দ্রনাথের খবর রাখতেন। রবীন্দ্রনাথের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে ১৯৪০-এ চিনাভবনের অধ্যক্ষ তান-য়ুন-শানকে টেলিগ্রাম করেছিলেন। তাই চি তাও-এর নেতৃত্বে চিন দেশ থেকে একটি শুভেচ্ছা মিশন ১৯৪০ এর ১০ নভেম্বর ভারতে আসেন। সেই দলে ছিলেন চিন-এর প্রজাতান্ত্রিক সরকারের উপমন্ত্রী ড. টি. কে. সিংহ এবং সুন লিং। রবীন্দ্রনাথ তখন ছিলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তাই চি তাও তাঁর শয্যাপার্শ্বে গিয়ে তাঁর হাতে দিয়েছিলেন মার্সাল চিয়াং কাইশেক-এর একটি চিঠি এবং একটি কবিতা। তারপর সেই শুভেচ্ছা মিশন ৯ ডিসেম্বর তারিখে শান্তিনিকেতনে আসে। রবীন্দ্রনাথ তার আগেই নভেম্বর মাসে শান্তিনিকেতনে চলে এসেছিলেন। চিনা প্রতিনিধি দলকে সম্বর্ধনা জানানো হয়। রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ থাকায় সভায় আসতে পারেননি। তাই চি তাও তাঁর ঘরে গিয়ে দোভাষীর সাহায্যে কথা বলেন। সেই কথোপকথনের নোট অবলম্বনে সুধাকান্ত রায়চৌধুরী প্রবাসী পত্রিকার পৌষ ১৩৪৭ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ও তাই চি তাও সংবাদ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ চিয়াং কাইশেক-এর চিঠির উত্তর এবং নিজের আঁকা কয়েকটি ছবি উপহার হিসেবে তাই চি তাও-এর হাতে দেন। তাই চি তাও বিশ্বভারতীর পরিচালক বর্গের প্রধান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর নামে চিনাভবনে একটি গ্রন্থাগার গড়ে তোলা হয়। বিশ্বভারতীর চিনা ছাত্ররা — তাঁদের কেউ কেউ শিক্ষকতার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন – এই গ্রন্থাগারের দায়িত্বে ছিলেন।
সবশেষে কাজুও আজুমার নাম করতে হবে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে না দেখেও প্রগাঢ় রবীন্দ্র-অনুরাগী ছিলেন। ভারতে এসেছেন একাধিকবার। চিন ও জাপানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক মৈত্রী-বন্ধন গড়ে তোলার কাজে অন্যতম ভিত্তিভূমি ছিল শান্তিনিকেতন। সেই উৎস প্রাণধারার শক্তিতেই বর্তমানে চিন ও জাপানে রবীন্দ্রচর্চা তথা বাংলা চর্চার বিস্তৃতি ঘটেছে। সুযোগ্য এবং নিবেদিত সাংস্কৃতিক কর্মী ও বিদগ্ধজনের আদান-প্রদানে সেই পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ়তর হবে — এই প্রত্যাশা আজ আমরা করতেই পারি।
এই নিবন্ধের তথ্য প্রধাণত সংগৃহীত হয়েছে তিনটি বই থেকে —
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রচিত রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্র সাহিত্য প্রবেশক (১ম থেকে ৪র্থ খণ্ড)। বিশ্বভারতী। সেইসঙ্গে আন্তর্জাল থেকেও বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। বাঙালি আলোচকেরা এই বিদেশিদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের সংযোগকেই লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু এই অতিথিদের অনেকেরই যে নিজস্ব পরিচয় ছিল সেদিক থেকে সবসময় বিষয়টিকে দেখা হয়নি। আমি কেবল সেই দিকটিকেই একটু লক্ষ্য করতে চেয়েছি। ছবিঃ ইন্টারনেট এবং লেখিকার সৌজন্যে প্রাপ্ত
পরবাস, ২২শে শ্রাবণ, ২০১৯
|