আত্মভোলা বসন্তের উন্মেষ চিত্রিতা
১.১. ছবি, সে কি স্বপ্ন, সত্য না প্রতিফল-মাত্র? ছবি কি উদ্দেশ্য ও উদ্দিষ্টের ছায়া-মাত্র - যার অবস্থান, দৈর্ঘ্য ও বহিরাকার নির্ভর করছে আলোর স্রোতের নিরিখে? সে কোথায়, কতটা, কোন দিকে ঘনাতে পারল তার উপর? যখন নিষ্প্রাণ নির্বিকার বিচরণভূমি নিজেই একজন ছায়াকার - "হাসি মুখ সেজে ... স্ফটিক সে নির্বিকার"[১] তখন সেই ছায়াটির কিছুমাত্র যায় না খোওয়া; বাঁচিয়ে-সরিয়ে কিছু হয় না রাখা রোমন্থনের নিরিখে, সবটাই দেওয়া হয় ফিরিয়ে। কত রূপ রঙ্গ রস হয় অঙ্কিত আকাশের নির্বিকার পটে ও দিনশেষে কালভেদে হারিয়েও যায় তারা, মোছা হয়ে যায় সব শেলেটে; ইতিমধ্যে নিয়ম মাফিক সূর্য ওঠে সূর্য ডোবে, স্বনিয়মে চলে চাঁদ - কৌতুক, কৌশল সব থাকে বাদ। ফলত বিধেয়-বাক্যে শুধু থেকে যায় শূন্যতা; ছায়ার ছায়াগুলি, ছায়াদের ফিরে না আসার হাহাকার।
২.১.
২.৩. ![]() ৩.২. আশ্চর্যের কিছু নেই যে শিল্প-সর্জনে ও শিল্প-আন্দোলনের ভূমিকা নির্মাণে তখন উনি যে পরিমাণ সময় ব্যয় করেছেন যে ঠিক তখনই তাঁর ভিতরে ইচ্ছা জাগবে অন্য শিল্পীদের আঁকা চিত্র ও বিচিত্রের বিষয়ে উনি কিছু লিখিত ও ভাষিত প্রতিক্রিয়া রচনা করবেন। পরবর্তী সময়ে বিশেষ ক'রে ১৯৩৬-এ এসে দেখতে পারছি উনি যে শুধু নিজের শিল্প-ভাষা ও বিষয় নিয়েই কথা বলছেন তা নয়, উনি নিজেরই আঁকা মুখাবয়ব, অন্ধকার, প্রকৃতি ও বিভিন্ন জান্তব প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে কয়েক পংক্তি ক'রে ভাষায় (এবং তৎসঙ্গে ইংরাজি অনুবাদেও) অবিস্মরণীয় কিছু পংক্তিকে কাব্যধর্মে দীক্ষিত করে ছবির পাশাপাশি রাখছেন, বিশেষ ক'রে 'চিত্রলিপি/১' সংকলনে যার চূড়ান্ত প্রকাশে হয়তো আরও ক'বছর লেগে গেছে। মোদ্দা কথা হল, এ সেই সময় যখন মূর্ত ভাষা ও অমূর্ত ভাব তার সম্পর্ক কিংবা রঙ-রেখার প্রকাশভঙ্গী ও বাচনের প্রতিফলের মধ্যে দিয়ে কবি ও শিল্পী রবীন্দ্রনাথ বচন-বাচনের ভাষা এবং দর্শন-অঙ্কনের ভঙ্গীর একটা বিরল যুগলবন্দী রচনা করছেন। পরবর্তী কালে এক সময়ে শিল্পী রবীন্দ্রনাথ বলছেন ভাষার প্রতি অবিশ্বাসের কথা; বলছেন যা শব্দবর্ণের মধ্যে দিয়ে বলে ওঠা ওঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি, সেই ভাবই উনি প্রকাশে আনতে পেরেছিলেন ছবির ভাষায়। ৩.৩. এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে 'বিচিত্রিতা'-র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল রবীন্দ্রনাথ কৃত একটি দুর্লভ 'ভাষান্তর' - দর্শনের পৃথিবী থেকে বচনের দুনিয়ায় ভাব যে-ভাবে অনূদিত হয়ে এসেছে তার অনেক উদাহরণ অদ্যাবধি পাওয়া কঠিন। কবিতা এসেছে আগে, তারপর তারই প্রতিক্রিয়ায় ছবি - এমন উদাহরণ বাংলায় ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় আজ অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু ছবির বিবৃতিকে বাণীতে এঁকে ফেলার মতন 'আন্তর্সেমিওটিক অনুবাদ' (inter-semiotic translation) যে-কোনও ভাষা-সংস্কৃতিতেই আজও বিরল। অন্য বহু নব্যক্ষেত্রের মত এই ভূমিকাতেও এই মনচাষা অদ্ভুত ফসল ফলাতে পেরেছেন বলে আমার বিশ্বাস। যে সমালোচক বন্ধুরা এই কবিতাগুলিকে ছবিগুলি থেকে আলাদা ক'রে তাদের কাব্যগুণাগুণ ও ছন্দপক্কতার চুলচেরা বিচারে মনে করবেন ওজনে কম শুদ্ধ কবিতার রবীন্দ্রনাথের তুলনায়, আমার মনে হয় তাঁরা এই বিশাল মাপের সৃজনমানুষটির সৃষ্টির বোধ ও বোধের এই অস্পষ্ট অনুচ্চার পৃথিবীতে ঢুকতেই পারেন নি। ৩.৪. সত্যি বলতে, শব্দ থেকে শব্দে গতায়াতের একটা সূক্ষ্ম সূত্রাবলী আছে - যার দখল সবার থাকে না, তবে সেইসব দ্বিভাষী মানুষদের থাকে যাঁদের শব্দবোধ সুতীব্র ও সুগভীর। একটি বর্ণবন্ধকে কেমন ক'রে ভিন্ন সংস্কৃতির জিহ্বায় ও শ্বাসে-প্রকরণে আরেকটি একই রকম জিহ্বাকর্ষক বর্ণ-বিন্যাসে বাঁধা সম্ভব তার বেশ কিছু উদাহরণ কিছু কিছু কাব্যানুবাদে পাওয়া যায় যেখানে অলঙ্কারগুলির প্রতিও নজর দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এক ধরনের অনুপ্রাসের বদলে অন্য ধরনের অনুপ্রাস - সিলেব্ল সাজানোর বেলায় একটা তুলনীয়তা আনার চেষ্টা করা, বিভাষাতেও - এমনটা দেখা যায় বিখ্যাত কিছু কাব্যানুবাদে। তেমনি একই ভাবরাজি ভিন্ন ভিন্ন শিল্পরচনা-পদ্ধতি বিভিন্ন রূপ-সৌকর্য নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে, বিরল হলেও তার উদাহরণ এমনকি শিল্পী রবীন্দ্রনাথের আঁকাতেও পাওয়া যায়, এমনটা হালের একটি বক্তৃতায়[২২] অধ্যাপক রমণ শিবকুমার দেখিয়েছেন - যা আমার কাছেও বেশ নতুন তথ্য বলে মনে হয়েছে। মোদ্দা কথা, সম্ভাবনার পৃথিবীতে এসব ধরনের অনুবাদ অবশ্যই কঠিন, কিন্তু সম্ভব। তবে শিল্প ও কাব্য - এই দুই জটিল পৃথিবীতে অত্যন্ত সহজ বিচরণ থাকলে তবেই চিত্রের শব্দরূপে উত্তরণের এমন উদাহরণ প্রস্তুতি করা সম্ভব। পরবর্তী পর্যায়ে এমনই কিছু অনুবাদের প্রয়াস নিয়ে আরেকটু বিস্তারে যেতে চাইবো। ৪.১. রবীন্দ্রনাথ নিজে ছাড়া আর যে-কজন শিল্পীকে আমরা 'বিচিত্রিতা'-য় পাচ্ছি - যাঁদের মধ্যে রয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার, গৌরী দেবী (ভঞ্জ), নিশিকান্ত রায়চৌধুরী, প্রতিমা দেবী, মনীষী দে, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনয়নী দেবী ও সুরেন কর প্রমুখ, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ শিল্পীর মাত্র একটি ক'রে ছবিই অনূদিত হয়েছে - যাঁর মধ্যে ব্যতিক্রম নন্দলাল বসু (তিনটি), রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (দুটি), সুরেন্দ্রনাথ কর (চারটি), এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আটটি ছবির কাব্যানুবাদ। কবির নিজের ছবিও সংখ্যায় সাতটি রয়েছে। তুলনীয়তার সূক্ষ্ম প্রকরণে সম্ভবতঃ এই শেষোক্ত পাঁচজন শিল্পীর ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়বে কারণ স্পষ্টতঃই এই পর্যায়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে গগন ঠাকুর, নন্দলাল, সুরেন কর, রমেন্দ্রনাথ ও নিজের ছবিই কবিকে বহুবার ক'রে জাগিয়ে তুলতে পেরেছে অথবা চ্যালেঞ্জ করতে পেরেছে বর্ণকুশ পর্বত লঙ্ঘন করতে। দেখা যাক, অশ্বমেধের ঘোড়ার রশিকে কবি কেমন স্পর্ধায় কতটা অবলীলায় ধরে ফেলছেন। ![]() ৪.৩. এমন একটি ছবিকে কবি রবীন্দ্রনাথ কীভাবে দেখালেন কবিতার ভাষায়? একথা খুঁটিয়ে না দেখলে রহস্যের মতই মনে হয়। 'কালো ঘোড়া'-র পাঠককে খুঁজে দেখলে মনে হয় - এ এক এমন কালো ঘোড়ার কথা যার পায়ের গতিতে রয়েছে অধীরতা অস্থিরতা - "অসাধ্যের সাধনা" যার গতি মোহন মুক্তি পেয়েছে হঠাৎ নৈরাশ্যের আঘাত থেকে অকস্মাৎ দ্বার মুক্ত পেয়ে রাতে। বল্গাহারা কালো অশ্ব যেন কালো চিন্তামেঘের দলের মতই এক আত্মঘাতী ঝঞ্ঝার মতনও চলেছে, যার উদ্দেশ্য হল "বিস্মৃতির চির-বিলুপ্তির মধ্যে ... নিরঙ্কিত পথ ধেয়ে" চলতে থাকা ও নিয়ে যাওয়া ব্যর্থতাকে দুরাশাকে অন্ধ রাত্রির পরপারে যেখানে "অন্তিম শূন্যের মাঝে" কৃষ্টিহীনতার "নিশ্চল নির্বাক" পৃথিবীতে চলে যাওয়া যায়। এই অশ্ব যাকে পিঠে ক'রে নিয়ে এলো তিনি "ব্যথায় মূর্চ্ছিত মোর প্রিয়া" - যাঁকে নিয়ে যেতে চাইছে বিস্মরণের বিলোপ-লোকে যেখানে কবির মনে হচ্ছে "যাক্ ধেয়ে", মনে হচ্ছে "নিয়ে যাক" ভাষার বাহিরে কোনও পৃথিবীতে। কারণ, কবি জানেন বাণীর সীমাপারেই আসবে বিরহের আগুনে পোড়া, বহুবিধ শব্দরাজির বর্ষা পেরোতে পারলে তবেই আসবে অগ্নিস্নানে রৌদ্রস্নাত আশ্বিনের আলোক, এমন নির্মল মেঘ যাতে থাকবে না বৃষ্টির কণা; শোক থাকবে বিস্মরণ, ব্যর্থতা, বিরহের - কিন্তু তাও হবে নির্বাক দীপ্তিময়। এভাবেই "অন্ধ অভিলাষের" ঘটবে বাণীমোচন। এই যে ব্যক্তিগত প্রেম-বিরহ থেকে নৈর্ব্যক্তিকতার দিকে ধেয়ে চলা এই যে বাক্-এর পৃথিবী থেকে বৈবস্বতের বর্ণময় বিশ্বের দিকে চলে যাওয়া - এ যেন এই বিপুল নিরীক্ষারই একটা মূর্ত রূপ। আমার মনে হয় শিল্পী-কবি রবীন্দ্রনাথের এই দিকটিকে নিয়ে আরও গবেষণার সুযোগ রয়েছে। সন্দর্ভ: [১] 'আরশি' কবিতা থেকে উদ্ধৃত; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৩৩ ও ২০১১ প্রতিক্ষণ-বিশ্বভারতী সংস্করণ থেকে গৃহীত) পৃ. ১২।
[২] ঐ; পৃ. ১৩।
[৩] "তোমার পাখীর গানে
[৪] ঐ, পৃ. ১৪।
[৫] ঐ, 'ভীরু' কবিতা থেকে, পৃ. ৩৬।
[৬] ঐ, পৃ. ৩৬।
[৭] 'অনাগতা' থেকে, বিচিত্রিতা, পৃ. ৪৮।
[৮] ঐ, পৃ. ৪৮।
[৯] 'দ্বারে' কবিতা থেকে, পৃ. ৫৫।
[১০] ঐ, পৃ. ৫৬।
[১১] 'বেসুর' কবিতা থেকে, পৃ. ৪১।
[১২] ঐ, পৃ. ৪১।
[১৩] 'বিচিত্রিতা'র আখর-কবিতা নন্দলাল বসুকে উৎসর্গ-কবিতা 'আশীর্বাদ'।
[১৪] 'অচেনা' থেকে, বিচিত্রিতা, পৃ. ৪।
[১৫] ঐ, পৃ. ৪।
[১৬] 'বধূ' কবিতা থেকে, বিচিত্রিতা, পৃ. ৩।
[১৭] 'পসারিণী', পৃ. ৫।
[১৮] ঐ, পৃ. ৬।
|