তখন স্কুলের শেষ দিকে। সে সময় পাড়ায় পাড়ায় হত অনেক আবৃত্তি প্রতিযোগিতা (এখন খুব কমে গেছে)। সেই রকম এক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছিলাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী'। প্রকাশক বিশ্ববাণী প্রকাশনী। সে বয়সে, সদ্য কিছু 'আধুনিক' কবিতা-পড়া আমার কাছে এই বইটি ছিল এক বিস্ময়। এক প্রবল ধাক্কা। সেই বিস্ময় আজও কাটেনি। বইটির উৎসর্গ কবিতা, 'বাংলা চতুর্দশপদী-র প্রথম প্রণেতা মাইকেল মধুসূদনে'। মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সময় - অসময়ে মনে পড়ে—
"তুমি পারো মেলে ধরতে খোলা-বুকে স্বেচ্ছাচারী ভাষা
ডায়ারির বিষণ্ণ পাতা জড়ো করে পোড়াতে আগুনে
তুমি নও, দীর্ণ শীত-বিহ্বল সাঁওতাল, কৃষ্ণ চাষা
অথবা গুরুর গুরু, সংহতির গভীরে চৌচির!
তুমি কবিগান বেঁধে দোরে - দোরে অমন ঘুরো না
মুকুন্দদাসের মতো, ১৯৭০ — এই সালে
হৃদয় আমিষদষ্ট, রক্ত নষ্ট, কুকুর কি কালে
সত্যবান ভারতীয় পথিকের হাঁটবে পিছু - পিছু?"
আজ, এত বছরের দূরত্ব থেকে মনে হয়, "খোলা-বুকে স্বেচ্ছাচারী ভাষা" মেলে ধরা এই কবিতা শুধু কবি মধুসূদনকে উৎসর্গ করেই শেষ হয়ে যায় না — এই কবিতার প্রণেতা শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরও ছায়া পড়ে পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। বিশেষত, "স্বেচ্ছাচারী ভাষা" এবং "১৯৭০ — এই সালে" থেকে স্পষ্টতর হয় এই ইঙ্গিত। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৭০। প্রকাশক কবয়ঃ। নিজেকে কবি 'আমি স্বেচ্ছাচারী' বলেছেন অন্যত্র। মনে হয়, কবিতায় তাঁর অনন্যতা, একান্ত নিজস্ব শব্দ-চিত্রকল্প-ভাষা ছিল তাঁর 'স্বেচ্ছাচার'। আর জীবন তো কাব্যের সঙ্গেই জড়ানো।
প্রথম যখন এই বই হাতে পেয়েছিলাম, সেই বয়সে চতুর্দশপদী কিংবা সনেট কাকে বলে জানা থাকার কথা নয়। কিন্তু সে সব না জেনেও কবিতার স্বাদ পেতে কষ্ট হয়নি একটুও। পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি স্মৃতির ভিতর জেগে আছে আজও—
"ফুলের বিছানা দেখে মনে হলো শূন্যতা যাবার
সময় হয়েছে। কোনো ভয় নেই। পরশকাতর
শরীর আমার পানে জীবনের একান্ত পাবার
স্পর্শ, ঘরবাড়ি দরজা; এমনকি গুগ্গুল আতর
পাঞ্জাবি ভাসাবে। এই আতিশয্য মনে হবে ছার
শূন্যতার কাছে, যার জিহ্বা ছিল বিখ্যাত মেদিনী।
ফুলের বিছনা দেখে মনে হলো শূন্যতা যাবার
সময় হয়েছে। কোনো ভয় নেই। ফুলগুলি চিনি।"
(চতুর্দশপদী কবিতাবলী / ১)
এই কবিতার রসগ্রহণ করতে, পড়ে আনন্দ পেতে, ভেতরে ভেতরে বয়ে নিয়ে যেতে, তার টেকনিক্যাল দিকগুলো না জানলেও ক্ষতি নেই কিছু। অন্তত সেই স্কুল বয়সের 'আমি'-র ক্ষেত্রে তো বাধা হয়নি এর চতুর্দশপদী- বাঁধন।
কিন্তু কেন চতুর্দশপদী (ঠিকঠাক সনেট কি না সে বিচার করবেন বিশেষজ্ঞরা)? শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন তাঁর এক কবিতায়, 'ভাঙারও নিজস্ব এক ছন্দ আছে, রীতি প্রথা আছে'। কিন্তু 'ভাঙা'র আগে গড়ে তুলতে হয়। কবিপত্নী মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত 'পদ্যসমগ্র ৭'-এর গ্রন্থপরিচয় থেকে আমরা তাঁর চতুর্দশপদী রচনার সূত্র পেয়ে যাই—
"পরবর্তী কালের রচনাধারা পালটে সনেট রচনার মাধ্যমে তাঁর ছন্দের নিগর শিক্ষার ইতিহাস পর্ব চলেছে ১৯৬৪ সালের প্রারম্ভ পর্যন্ত। কবিজীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি লিখেছিলেন, 'অনুশীলনবাসী মাত্রের প্রতি আমার সাদর নির্দেশ হলো — অন্তত একশটা সনেট লিখুন। তারপর নিজের পথ চোখের সামনে খুলে যাবে।' (এই কাব্য ...)
কার্যত দেখি এ শুধু তাঁর কথার কথা ছিল না, সত্যিকারের কবি হয়ে ওঠার জন্য একের পর এক তিনি চতুর্দশপদী রচনা করেছেন শব্দ, অক্ষর মিলিয়ে মিলিয়ে, a b b a, c c a b b a a b b a, a b c, a b c এভাবে প্রতি পংক্তির পাশে লিখে লিখে পেত্রার্ক, মিলটন আর শেক্সপিয়রের আদর্শ সামনে রেখে তিনি শব্দ আর ছন্দের বাঁধনশিক্ষা করেছিলেন।"
কিন্তু এই 'বাঁধন' এর মধ্যে তাঁর কবিতা বাঁধা থাকেনি। মুক্তি পেয়েছে অলৌকিকে, অপ্রত্যাশিতের মধ্যে —
"তোমারে আবহমান কাল থেকে চেয়েছি জানাতে
আমি ভালোবাসি, আমি সবচেয়ে তোমারই অধীন—
রটেছে, শুনেছো কানে — প্রবঞ্চনা, চাতুরি ও হীন
নিশ্চিত শঠতা কত। আদালতে বোবা ও কানাতে
সাক্ষ্য দেয়, কাজি শুধু এ পাপের শাস্তি মরে খুঁজে,
পাপীর প্রতিভা চায় মুক্তি — আমি মুক্তি মানে বুঝি
তোমার বুকের পরে বসে-থাকা, গায়ে থাবা গুঁজি
তোমারে জাগাতে যেন কুমোরের মতন গম্বুজে।"
(চতুর্দশপদী ৭০)
একটা কথা এখানে উল্লেখ করা উচিত, শুধু 'পেত্রার্ক, মিলটন আর শেক্সপিয়র' নন — যাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন এই বই, সেই মধুসূদনকেও নিজের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন কবি। শুধু 'মধুসূদনে' বা 'তোমারে'-র প্রয়োগ নয় — মধুসূদনের কাব্যের প্রবল প্রাণশক্তি যেন সঞ্চারিত হয়েছিল চতুর্দশপদীর শক্তির রচনায়। তাছাড়া তিনি নিজের কবিতায় প্রয়োগ করেছিলেন হিমেনেথের কবিতার বিখ্যাত গাধা প্লাতেরোকে, একেবারে প্রত্যক্ষভাবেই —
"প্লাতেরো, এ্যাঙ্করহীন, ঘোড়ার অনুজ, সহোদর—
আজিকার দিনগুলি বৃথা যায় বহিয়া পবনে
ওঠো, ক্ষুর গাঁথি সব ব্যর্থতার বিরুদ্ধে দাঁড়াও
হাস্যকরভাবে বলো : দয়াময়ি, দয়া করো চিতে!"
কিন্তু এই প্লাতেরো শক্তির নিজের প্লাতেরো, হিমেনেথের নয়। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাই শঙ্খ ঘোষের বিখ্যাত রচনা 'এই শহরের রাখাল'-এ প্লাতেরোর প্রসঙ্গ—
"কিন্তু আবার, এই হল সেই সময়, যখন উনিশ শতকীয় বোদলেয়ার - র্যাঁবোর সঙ্গে সঙ্গে তরুণ কবিদের কাছে এসে পৌঁছেছে এই শতাব্দীর রিলকে অথবা হিমেনেথেরও নাম। প্লাতেরো আর আমি নামে হিমেনেথের মেদুর বইটির প্রথম ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হয়ে গেছে ১৯৫৭ সালে, আর তার অল্প পরেই কলকাতায় কাউকে কাউকে বিভোর করে ধরেছে সে - বই। রুপোলিধূসর একটা গাধাকে সঙ্গী করে নিয়ে, তাকে উদ্দেশ করে, যেন এক মোহময় স্বপ্নজগতের কথা বলে চলেছেন স্পেনীয় ওই কবি, বিষাদময় স্তব্ধতায় ভরা তাঁর লাইনের পর লাইনে। আর শক্তিও, তাঁর সচেতন ধাক্কা-দেওয়া কবিতাগুলির পাশে পাশে প্লাতেরো নামটিকেই সরাসরি টেনে নেন কবিতায়, লেখেন : 'প্লাতেরো আমার আর আমিও প্লাতেরো ছাড়া নই / আমাদের দেবতা কি পা ঝুলিয়ে বসেন পশ্চিমে?'"
(পদ্যসমগ্র ৭ / শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
তাঁর 'চতুর্দশপদী' রচনা কি শুধুই 'অনুশীলন'? এই বইটির স্বতঃস্ফূর্ত প্রবল বেগের সামনে দাঁড়িয়ে, অজানা সৌন্দর্যে মথিত হয়ে, কখনই তা মনে হয় না। নিজের জীবনকেই যিনি সম্পূর্ণভাবে নিবেদন করেছিলেন কবিতায় (যাকে তিনি বলতেন 'পদ্য'), 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী'ও সেই আত্মনিবেদনের ফসল। এর প্রত্যেক পাতায় যেন শোনা যায় কবির নিঃশ্বাস। তাঁর 'স্বেচ্ছাচারী' বেঁচে থাকার, নাগরিক - বাউল জীবনযাপনের রক্ত-ঘাম-অশ্রুমাখা পদাবলী যেন হাহাকার করে ওঠে—
"বারোটি বছর ম্লান কবিতার খাতাখানি খুলে
অনুধাবনীয়তার মাঝে বসে আছি, দেখা দাও।।"
এই হাহাকার, এক মহান শব্দ-সাধকের হাহাকার, এবং প্রার্থনা। সংসারের মধ্যে, বিশাল প্রকৃতির মাঝখানে কখনও প্রবল আসক্তিভরা কখনও উদাসীনে এই কবি সারাজীবন শব্দে শব্দে রচনা করে গেছেন তাঁর 'সমগ্র'। যিনি লিখবেন পরবর্তীকালে, 'তোমার সমগ্র নিয়ে আলোচনা হল না কখনো।' 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী' এই সমগ্রের আশ্চর্য এক অধ্যায়। যার পঙ্ক্তি থেকে পঙ্ক্তিতে গাঁথা আছে কবির জীবন — স্মৃতিমেদুর বিষাদ আর 'মুক্তি'র আনন্দ। যিনি লিখেছেন তাঁর কবিতায়, "কী হবে জীবন লিখে / এই কাব্য এই হাতছানি!" — মারাত্মক এই প্রশ্নে জর্জরিত কবি আবার ফিরে গেছেন শব্দের রহস্যময় জগতে। কবিতায় লিখে গেছেন নিজের 'জীবন'। 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী'-র 'হাতছানি' প্রবল সেই সমগ্রতার মধ্যে, তাঁর সারা জীবন ধরে লিখে চলা অপ্রত্যাশিত সব বিস্ময়ের একটি উজ্জ্বল 'অংশ' হিসেবে। কবি এই সমগ্রতার কথা লিখে গেছেন— "যে-কোনো লেখকের পদ্যই দীর্ঘকাব্য — তিনি লেখেন টুকরো টুকরো করে, এইমাত্র।"
আজ, কবির মৃত্যুমাসে, স্মৃতিধার্য হয়ে থাকে তাঁর 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী'-র এই চরণগুলো —
"কোথা যাবে? ঝ'রে ফুল মৃত্তিকায় আসিতে হবে না?(১৭ সংখ্যক)
কোথা যাবে? ঝ'রে ফল মৃত্তিকায় আসিতে হবে না?
সুগন্ধির পার আছে? সে-ও মম বক্ষে ঝরে পড়ে।"
যিশুর মতো কবিরও হয় রেজারেকশন। নতুন যুগে নতুন কবি-পাঠকের চেতনায় জাগ্রত হয়ে ওঠেন কবি। বারবার।