এগারোই জুলাই দুহাজার এগারো : বেলা একটা এগারো -
দুরন্তবেগে ছুট লাগিয়েছে দিল্লীর দিকে। পঞ্চবৃদ্ধপাণ্ডব চলেছি চাঁদপুকুরের পানে। নতুন দিল্লী থেকে শতাব্দীবাহিত হয়ে চণ্ডীগড়, তারপর চর্তুচক্রযানবাহিত হয়ে মানালি। তারপর শুরু মূল অভিযান।
বেলা দুটো -
মাঝেমধ্যে চলছিল বর্ষার বর্শার দুরন্ত আক্রমণ। সে সব সামলে হামলে পড়া গেল মধ্যাহ্নভোজের থালায়। চলনসই খানা।
সন্ধে সোয়া সাতটা -
দুরন্ত গতির দুরত্ন ছুটন্ত। উত্তরপ্রাদেশ ছুঁই ছুঁই। মাঝে কোডারমায় ভোঁদার মা হয়ে পৌনে ঘন্টা কাটিয়ে দিল। গয়ায় পিণ্ডি ছুঁইয়ে ভোঁ দৌড়। বাইরে আঁধারে আরো আঁধার গাছপালা পিছন বাগে ছুটছে। বিহারের পাহাড় জঙ্গলের মাঝ দিয়ে দৌড় মনে থাকবে। পরেশনাথও পরেশান করার সুযোগ পায়নি। সহযাত্রী মিত্রের বাড়ি ব্যারাকপুর, শ্বশুরবাড়ি দিল্লী, কর্মস্থল ধরমশালা - একেবারে দলাই লামার ঘাঁটিতে।
রাত আটটা পাঁচ -
শোন নদী পেরোবো। দুরন্ত গতিতে লাফ দেওয়া গেল।
আটটা তেরো -
পেরোনো গেল শোন।
আটটা পনেরো -
ডেহরি অন শোন।
ন-টা দশ -
কর্মনাশায় সময় নাশ।
রাত দশটা -
মুঘলসরায় সরে গেল।
রাত সাড়ে এগারোটা -
কাশীতে আধঘন্টার ফাঁসি।
বারোই জুলাই, ভোর সাড়ে চারটে -
দিল্লী দূর অস্ত।
সকাল সাড়ে ছ-টা -
হনুজ??? দিল্লী দূর অস্ত।
সকাল সাতটা -
লক্ষণের রাজধানীর ফটক পেরোতে কুড়ি মিনিট কাবার।
সকাল সাড়ে ন-টা -
লেটের কী ঘটা! আদৌ দিল্লী পৌঁছব তো!
সকাল দশটা -
'রসুইয়া' খবর দিল গাড়ি মাত্র দশ ঘন্টা লেট।
দশটা এগারো -
'বরেলি কে বাজার মে দুরন্ত তুরন্ত গিরা রে।
দশটা চল্লিশ -
গিরা তো গিরা, অ্যায়সা গিরা কে সম্ভলনে মেঁ আধাঘন্টা লগ গয়া।
বেলা বারোটা তিন -
ঠিক দুপ্পুরবেলা মোরাদাবাদ মেঁ মেলা।
বেলা সাড়ে চারটে -
বড়ী তকলীফ কে বাদ বিল্লী পহুঁচী দিল্লী। অব ক্যা হোগা? ভাড়া করা গাড়ি তো সকাল থেকে চণ্ডীগড়ে শিকড় গজাচ্ছে।
বিকেল ছটা দশ -
অবশ হয়ে সাড়ে তিন হাজার টাকার গাড়িগচ্চা - 'মিশন চণ্ডীগড়'।
রাত দুপুর -
নিঃশব্দে দুনিয়া তেরোই জুলাইয়ে পা রাখল। তেরোর গেরোয় কবে সত্যিকারের অভিযান শুরু হবে, কে জানে?
রাত দেড়টা -
পরওয়ানুতে হরিয়ানায় প্রবেশ।
ভোর ছ-টা দশ -
সারথি বদল। দেশরাজের রাজত্বের প্রজা এখন আমরা।
সকাল দশটা চব্বিশ -
ভারতের দীর্ঘতম টানেল ধরে (৪.৫ কি. মি.) লম্বা দৌড়।
বেলা এগারোটা -
কুলু। ভীড়ে ভীড়াক্কার।
বেলা সাড়ে বারোটা -
আলি রে আলি, মানালি আলি।
রাত আটটা -
দিনটা কাটল মানালির ভিড় ঠেলে।
চোদ্দোই জুলাই (বেলা আটটা) -
বেলা পৌনে ন'টা -
অবশেষে রোহতাং পাস। মাটি থেকে দু-ফুট ওপর মেঘের ছাদ থমকে রয়েছে। ওই দুর্ভেদ্য মেঘপ্রাচীর ভেদ করে একটা হলুদ রংয়ের আভাস দেখেই আমাদের প্রাণগুলো চা চা করে চ্যাঁচাতে লাগল।
বেলা নটা দশ -
হলুদ প্লাস্টিকের ছাউনির নিচে চা আর ডিমরুটির প্রলেপ দিয়ে পেটের দেওয়াল ঠাণ্ডা করে আবার রওনা হওয়া গেল। রোহতাং পেরোতেই আলোর আভাস। পথটা এঁকেবেঁকে হুড়মুড়িয়ে নেমেছে খোকসার পানে। চন্দ্রা নদী এখান থেকে রুপোলি ফিতে। পিছনে মোটাসোটা ঝরনারা বরফ মেখে ধাপে ধাপে ঝাঁপ মেরেছে নিচপানে। সামনে পাহাড়ের মাথা থেকে বরফের ধারাগুলো নদীর ধারে নেমে এসে থমকে রয়েছে।
দশটা পাঁচ -
পেরিয়ে এলাম গ্রামফু। চন্দ্রতালের পথকে 'পরে আসছি' বলে নেমে এলাম খোকসারে।
পৌনে এগারোটা -
'শিস্সু' পেরিয়ে দৌড়তে দৌড়তে গাড়ি এসে থামল 'তাণ্ডিতে'। চন্দ্রা আর ভাগার মিলন দেখতে দেখতে গাড়ি পেট ভরে তেল খেয়ে নিল। এরপর আবার তার খাওয়া জুটবে কালকে - এখানেই।
বেলা বারোটা দশ -
ভাগার ধার ধরে ছুটে পেরোলাম কেলং। লেডি অব কেলংয়ের পা ছুঁয়ে ছুটে চলল গাড়ি। পাহাড়ের গায়ে সবুজের আলপনা, মাথায় বরফের ছোঁয়া।
বেলা একটা -
জিস্পা। ভাগার ধারে দিব্যি জায়গা - ছোট্ট, কিন্তু সুন্দর।
বেলা সোয়া একটা -
বেলা সোয়া দুটো -
রাতে থাকার ব্যবস্থা করে, পেট ভরে রওনা হলাম সূরজতাল দেখার তালে। পুল পেরিয়ে আবার পাহাড় বাইতে লাগল গাড়ি। নির্জন আঁকা বাঁকা পথের সৌন্দর্যে দু চোখ ভরে নিতে লাগল পঞ্চপাণ্ডব।
বেলা তিনটে -
পথের ধারে নিঃশব্দ নিথর সবজে ছোট্ট দীপক তাল পাহাড়ের গা ছুঁয়ে শুয়ে রয়েছে। তার শান্তিভঙ্গ না করে, তাকে দু ঝলক দেখে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের পেরিয়ে গেল একটা বড় বাইক মিছিল।
তিনটে পাঁচ -
পাৎসেও। ১২৩০০ ফুট। কেয়াবাত!
তিনটে কুড়ি -
জিংজিংবার। ৪২৮৭ মি.???
বেলা সাড়ে চারটে -
বাইক বাহিনী একটা ঝরনার ধারে থমকে দাঁড়িয়ে। সকালের নির্ঝরিনী শেষবেলায় ভীমা জলপ্রপাত। তাকে পেরোবার আগে সাতবার ভাবতে হয় বই কী। তার স্রোতের তোড়ে হাতি না হলেও ঘোড়া ভেসে যেতেই পারে। এই রুদ্র জলধারাকে পেরোতে বাইকপিছু চারজনের সংগ্রাম দেখতে লাগলাম। এত করেও একটা বাইক হঠাৎ জলপ্রপাত ধরে ঝাঁপ দেওয়ার তাল করেছিল; বাড়তি দু-জন লাগল তাকে সামলাতে। এক এক করে বারোটা বাইক পেরোবার পর আমাদের পালা। নাচতে নাচতে ভীমধারা পেরোতে পেরোতে মনে হলো, ফেরার পথে আবার একে পেরোতে হবে। তখন এর রাগ যদি আরও বেড়ে যায়!
চারটে পঞ্চাশ -
বিকেল পৌনে সাতটা ???-
ফেরার পথেও ঝরনা আমাদের নির্বিঘ্নে পেরোতে দিল। সেই আনন্দে সাড়ে পাঁচটায় আমরা জিংজিংবারের তাঁবু-ধাবায় চা চাপালাম। তারপর সুবোধ বালকের মতো ফিরে এলাম দারচায়।
সন্ধে পৌনে আটটা -
সূর্যের শেষ কিরণ মেখে চাঁদ উঠল। অদ্ভুত এক মায়াবী আলোয় সেজে উঠল দারচা। ধীরে ধীরে গুড়ি মেরে এসে আঁধার বুড়ি কবজা করে ফেলল আকাশকে তার কোটি তারার ফুটোওয়ালা কালো চাদরটা দিয়ে।
রাত দশটা -
কালপুরুষের পাহারায় আমরা নিশ্চিন্তে নিদ্রা গেলাম।
রাত দেড়টা -
একটা বড় দল এসে জায়গা খুঁজছে টের পেলাম।
পনেরোই জুলাই, সকাল সাতটা -
আজ চন্দ্রা নদীর পালা। সকালের শুচিস্নিগ্ধ দারচার সারল্যে মুগ্ধ হওয়া গেল।
সকাল ন-টা পঞ্চাশ -
ফিরতি পথে পা, থুড়ি, চাকা রাখল গাড়ি।
সোয়া দশটা -
ভাগার সঙ্গে ভাগ করে দৌড়ে চলে এলাম তাণ্ডি। আবার গাড়ির পেট ভরার পালা। এর পরের পেট্রল পাম্প কাজায়।
ঠিক দুক্কুরবেলা -
খোকসারে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি আর চায়ের জুটিটা জমল ভালো। অবারিত খোকসারের একধারে চন্দ্রা গায়ে অসংখ্য অস্থায়ী হিমবাহের ছোঁয়া নিয়ে বয়ে চলেছে, অন্যধারে রোহতাং পাসের আকাশচুম্বী দেওয়ালের গায়ে হিমবাহ, ঝরনা আর ফুলের ফুলকারির মাঝে আঁকাবাঁকা পথ।
বেলা একটা দশ -
গ্রামফু থেকে নতুন পথে পা রাখলাম। চন্দ্রার উজানে উজিয়ে ছুট। আমরা ছাড়া প্রাণী বলতে ভেড়া ছাগলের দল আর তাদের সঙ্গী কুকুরেরা; তাদের মালিকেরা, ঘোড়া আর পাখির দল। এখানে সেখানে তুষারধারা এসে নেমে পড়েছে চন্দ্রার বুকে।
বেলা একটা পঞ্চাশ -
নির্জন পথ পেয়ে মেঘেরা এসে চেপে ধরেছে। গা ছমছমে পরিবেশে হঠাৎ একটা পুল। তাকে পেরিয়ে পথ ডাইনে মোচড় মেরেছে। সেই মোচড়ের মুখে তিন তাঁবুর গ্রাম কাম হোটেল ছতড়ু। এখানে আমাদের থামতে দেখে আকাশ কান্না জুড়ল। বুনো আগাছায় ঘেরা ছতড়ুর তাঁবুতে পেট ভরাতে ভরাতে বৃষ্টির দাপাদাপি দেখতে লাগলাম।
বেলা দুটো পঁয়ত্রিশ -
আমাদের নড়াতে না পেরে মেঘের দল কান্না থামিয়ে একটু সরে বসল। আমরাও রওনা দিলাম।
বেলা তিনটে -
নির্জন নিষ্প্রাণ 'পথ' ধরে ছুটে চলেছি। দু-পাশের পাহাড় থেকে পাথরের অনন্ত বাহিনী নেমে এসে চন্দ্রার বুকে ঝাঁপ মেরেছে। নিষ্প্রাণ, হিমেল উপলরাশি। কেউ নুড়ির মতো ছোট, কেউবা তিনতলা বাড়ির সমান। হরেক আকারের, রঙের, আকৃতির পাথরে গড়া এই প্রস্তর প্রান্তরের বুক চিরেই পথ। ভাবতে অবাক লাগে, এই পথ ধরে নিয়মিত বাস চলাচল করে!
বেলা সাড়ে তিনটে -
অবশেষে একটা নামের ফলক - 'ছোটাদড়া'। শুধুই ফলক। জনমনিষ্যি, ঘরবাড়ি, কিচ্ছুটি নেই। না, না, আছে! খানিক এগিয়ে তার দেখা মিলল। একটা রেস্ট হাউস - একা। বিবর্ণ, বিষণ্ণ।
বেলা সোয়া চারটে -
একটা বেশ জাঁদরেল হিমবাহকে কেটে পথের ব্যবস্থা হয়েছে। তাতে খানিক চড়ে খানিক ছেলেমানুষ হওয়া গেল।
বেলা চারটে কুড়ি -
হৈ দূরে পাহাড়ের দু-চারটে বাড়ির নিশানা। ওটাই বুঝি বাতল। ডানদিকে কড়চা নালা আত্মসমর্পণ করেছে চন্দ্রায়। সামনে গড্ডলিকা প্রবাহ (পাহাড়ী ছাগলকে কি গড্ডল বলা চলে?)।
বেলা চারটে পঁয়ত্রিশ -
'বিকেল' সাতটা -
সন্ধ্যার আগমনী গান এলো শীতের (চেহারা) নিয়ে। পারদ নামল ৭ ডিগ্রিতে। পাখির দল অদৃশ্য। ছাগলের দল রাতের বিশ্রামের আয়োজন করছে। আমরা ইগলুবন্দী হলাম।
ষোলোই জুলাই, ভোর পৌনে ছ-টা -
সকাল ছ-টা -
মেঘেরা আড়মোড়া ভেঙে একে একে চরতে বেরোচ্ছে। সূর্যদেব তুষারচূড়ায় টিপ পরালেন। ধীরে ধীরে সেই আলো পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে লাগল।
সকাল পৌনে ন-টা -
সবার পরে রওনা হওয়া গেল। অবশ্য আমাদের মাত্র চোদ্দো কিলোমিটার যাওয়া - চন্দ্রতাল। বাকিদের দূরের পাড়ি - কাজা।
সকাল ন-টা -
মূল সড়কের চওড়া ফিতেটা ছেড়ে চন্দ্রতালের সরু মেটে ফিতেয় চাকা রাখল গাড়ি। তণ্বী চন্দ্রার উজানে ছুটে চলা।
সকাল সাড়ে ন-টা -
সারথি কৃষ্ণ, থুড়ি, রাজের শরীর বিকল, ফলে গাড়ি অচল। নিচ থেকে চন্দ্রা আর ওপর থেকে শৃঙ্গের দল আমাদের ওপর উদ্বিগ্ন নজর রাখছে।
সকাল পৌনে দশটা -
সারথি চলনসই।
সকাল দশটা -
চন্দ্রাতালের 'বেস ক্যাম্প'। চাকাপথের শেষ, হাঁটাপথের শুরু। নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে তাঁবু-হোটলে রাজের বিশ্রাম আর আমাদের রসদ নেবার ব্যবস্থা হলো।
সকাল সাড়ে দশটা -
পঞ্চপাণ্ডব রওনা দিল, না, মহাপ্রস্থানের পথে নয়, চন্দ্রতালের পথে। ১৩৫০০ ফুট থেকে ১৪৪৫০ ফুটে পৌঁছতে হবে প্রায় তিন কিলোমিটার উজিয়ে। শুরুতেই 'ধর তক্তা মার পেরেক' চড়াই।
সকাল সোয়া এগারোটা -
চন্দ্রা এখন পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য। সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে আঁকাবাঁকা মেটে পথ। দু-পাশে প্রশান্ত তুষারশৃঙ্গের উঁকিঝুঁকি।
সকালে সাড়ে এগারোটা -
১৪৫০০ ফুট উঁচুতে পঞ্চবৃদ্ধপাণ্ডব। তুষার শৃঙ্গেরা এখন পড়শি। একটা বাঁক ঘুরতেই বাঁয়ে নিচে বালিকা চন্দ্রার ধারা।
বেলা এগারোটা পঞ্চাশ -
দুপুর সোয়া বারোটা -
দেবভূমিকে বেশিক্ষণ অপবিত্র না করে, বুকে একরাশ ভালোবাসা আর দুচোখভরা মুগ্ধতা নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।
বেলা একটা কুড়ি -
ফিরে এলাম 'বেস ক্যাম্পে'। সারথির শরীর এখনও বেজুত। অতএব দুটো তাঁবু পড়ল তাঁবু-হোটেলের পাশে।
বেলা পৌনে তিনটে -
হাঁউ মাঁউ খাঁউ, লাঞ্চের গন্ধ পাঁউ। দু-জন বিদেশিনী চন্দ্রতালের পথে রওনা দিল।
বিকেল পাঁচটা -
চারধারে আলস্য আমাদের শরীরেও। শুধু অলস চোখে অবলোকন, এটাই একমাত্র কাজ।
'সন্ধ্যা' পৌনে আটটা -
আকাশ তার তারার চুমকি বসানো কালো আলোয়ানতা গায়ে চড়াতে শুরু করেছে। তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রীতে নেমে বসে আছে।
সতেরোই জুলাই, ভোর পাঁচটা -
মেঘে ঠাসা আকাশের নিচে ৪-৫ ডিগ্রীর কামড়। প্রাণটা বড় চা চাইছে।
সকাল সাড়ে ন-টা -
সূয্যিদেবের ধমকে মেঘেরা ছত্রখান। চন্দ্রতালে রাত কাটিয়ে দুই বিদেশিনী এবার বাতলমুখী। সারথি চাঙ্গা। অতএব আজ কাজা জায়েঙ্গা। চন্দ্রভাগার দুই উৎসই দেখা হলো, উৎসাহে তাই ভরপুর।
সকাল পৌনে দশটা -
মূল সড়কে পড়ে বাঁয়ে মোচড় মেরে বাঁকে বাঁকে চড়চড়িয়ে চড়া।
সকাল দশটা -
কুনঝুম পাস। ১৫৫০০ ফুটে সুদৃশ্য চোর্তেন আর কুনঝুম দেবীর মন্দির ঘিরে রংবেরংয়ের প্রার্থনা পতাকার সমাহার। দুরন্ত বাতাসে সব ডানা মেলতে চাইছে - নেহাৎ একই সূত্রে বাঁধা, তাই ...।
সকাল দশটা কুড়ি -
নিঝ্ঝুম কুনঝুম গ্রাম।
বেলা পৌনে বারোটা -
স্পিতির প্রথম বসতি ২২৭ জনসংখ্যার লোসার। বেলা একটা কুড়ি - হঁসা, ক্য়াটো, পাংমো, হল পেরিয়ে এসেছি। এখন পেরোচ্ছি মোরং, যার বাসিন্দা ২৭ জন।
বেলা দেড়টা -
সুমলিং পেরিয়ে ক্যুরিক। স্পিতি নদীর ওপারে টংয়ে 'কী' গুম্বা।
বেলা একটা চল্লিশ -
রংরিক ১১৮০০ ফুট, স্পিতির ধার ঘেঁষে। পুল পেরিয়ে বাঁয়ে 'কী', ডাইনে 'কাজা'।
বেলা দুটো -
আঠারোই জুলাই - সকাল ন-টা -
আজ যাব 'নাকো', হেথায় থাকব নাকো।
সকাল পৌনে দশটা -
অওরগু। এখান থেকে নদী পেরিয়ে পথ গেছে পিন উপত্যকায়।
সকাল দশটা দশ -
শিচলিং। এখানে বাঁয়ে মোচড় মেরে সাড়ে আট কিলোমিটার টংয়ে উঠলে ঢাংকার গুম্বা।
সকাল দশটা পঞ্চাশ -
ঢাংকার গুম্বা আর দুই কিলোমিটার, গাড়ি বেঁকে বসল - আর যাবুনি। অনেক সাধ্যসাধনায় সে ফিরতে রাজি হলো - তার নাকি পাওয়ার স্টিয়ারিং ফেল করেছে।
বেলা পৌনে বারোটা -
কাজায় গাড়ির চিকিচ্ছে চলছে। রোগ বেশ গুরুতর - জনাচারেক তার তদ্বিরে লেগেছে।
বেলা পৌনে একটা -
জোড়াতালি দিয়ে গাড়িবাবাজীবনকে আবার পথে নামানো গেল।
বেলা আড়াইটে -
এসে পৌঁছেছি ১০৬৩৭ ফুট উঁচু তাবো-য়। এখানে রয়েছে ৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে তৈরি গুম্বা - পুরো মাটির তৈরি - এখনও অটুট। তাবোকে বলা হয় হিমালয়ের অজন্তা।
বেলা সাড়ে তিনটে -
এখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি! হাজার বছরের পুরোনো ফ্রেস্কো, তাও মাটির দেয়ালে! অসাধারণ সব মূর্তি - সব মাটির, রং এখনও উজ্জ্বল। অনাবৃষ্টির দেশ বলে অবিকৃত। বিস্মিত মন নিয়েই মোমোর বংশ ধ্বংস করা গেল।
বেলা ছ-টা -
সন্ধ্যা সাতটা -
নাকোর লেক পরিভ্রমণ করে সূর্যের শেষ আলোয় নাকোর গুম্বাও দেখে এলাম। হাজার বছুরে গুম্বা সামনে নবনির্মিত দলাই লামা করস্পর্শধন্য ঝকঝকে গুম্বা দিকচক্রবালে ছড়িয়ে দিচ্ছে অমৃতবাণী - 'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি'।
রাত সাড়ে ন-টা -
পাহাড়ী বৌদ্ধ কায়দায় ডিনার সেরে পাতি বাঙালী কায়দায় ঘুম।
উনিশে জুলাই, সকাল সাতটা -
আজ স্পিতি থেকে বিদায়। উপবাস ভঙ্গের খোঁজে কাজার নির্জন পথে পথে (পথ তো ছাই দুটো) 'হা আলুর পরোটা, হা আলুর পরোটা' করে পরিভ্রমণ।
সকাল সাড়ে আটটা -
একটা দোকানে আশ্বাস মিলেছে।
সকাল ন-টা -
অবশেষে পাতে আলুর পরোটার আগমন। দ্যাখ না দ্যাখ সাড়ে তিন মিনিটে সবার পাত খালি।
সকাল দশটা -
বিদায় কাজা; বিদায় লাহুল স্পিতি; বিদায় সুরজতাল; বিদায় চন্দ্রতাল।
বেলা এগারোটা -
জনহীন খাব। পুলে চড়ে পেরোলাম স্পিতি আর শতদ্রুর প্রমত্ত সঙ্গমস্থল।
বেলা সাড়ে বারোটা -
কানমখাড় পুল। এর ওপারেই কাল পথ নেমে গিয়েছিল শতদ্রুর গর্ভে। আজ সেখানে আবার পথরেখা। মা দুগ্গা বলে ঝুলে পড়ল গাড়ি, পেরিয়েও গেল ধ্বসা জায়গাটা।
বেলা একটা বাজতে পাঁচ -
বিকেল পাঁচটা -
চারপাশের অপরূপ দৃশ্য, দুরন্ত শতদ্রু সবকিছুই ভয়ানক বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। মেরামতি তো রামায়ণের সীতা উদ্ধার হতে চলেছে।
বিকেল সাড়ে ছ-টা -
অবশেষে পুলের ভাঙা কোমর জোড়া লেগেছে। প্রথম গাড়ি নড়েছে।
রাত পৌনে আটটা -
এবার আমাদের পুল পেরোবার পালা। এই আঁধারেও নিচে শতদ্রুর অশ্লীল উল্লাস বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে।
রাত ন-টা -
বুক-কাঁপানো আঁধার পথ পেরিয়ে এসে পৌঁছলাম রেকং পিও - কিন্নর জেলার সদর শহর।
রাত পৌনে দশটা -
নিঝঝুম পথ পেরিয়ে উঠে এলাম কল্পায়। আঁধার রাতে হোটেলের আলো যেন নরকের পর স্বর্গদ্বারের ইশারা। পরিক্রমা শেষ। এবার ফেরার পালা।
রাত সাড়ে দশটা -
বালিশে মাথা দিয়ে ডুবে গেলাম সুখস্বপ্নের অতলে। পঞ্চপাণ্ডবের পরিক্রমা পূর্ণ হলো।
(পরবাস-৪৯, অক্টোবর, ২০১১)