আমার প্রেমে কেন নীরব তুমি
সীমার মাঝে তাই তো অসীম তুমি
এই প্রথম তোমাকে জানাচ্ছি আমার অন্তরের কথা। তবু মানুষ কি একেবারে নিজের কথা লুকিয়ে থাকতে পারে? স্মৃতিকথার পাতাও যে আপনি হয়ে ওঠে ভারি। তাই আজ তোমার একশ' পঞ্চাশ জন্মদিনে আমার মনের সব কথা উজাড় করে দিচ্ছি। তোমাকে উপহার দেবার মত সাধ্য আমার নেই, আছে আমার মত এক সাধারণ নারীর জমিয়ে রাখা কিছু উক্তি। জানি তুমি অনেক চিঠি পাবে, সব চিঠি পড়া হয়ে গেলে যখন আর পড়ার কিছু থাকবে না, তখন না হয় অগোছালোভাবে আমার এই সরলভাষায় লেখা একটু পড়ে নিও।
চুপি চুপি বলে রাখি, কিশোরীবেলায় যখন প্রথম তোমার লেখা বই “গীতাঞ্জলি” পুরস্কার হিসেবে পেলাম, কি সে আনন্দ তা লিখে বোঝাতে পারব না, তোমার ছবি রাখলাম আমার হৃদয় মাঝারে রাখলাম চোখের সামনে পড়ার টেবিলে, আমার নিজস্ব সম্পদ করে।
“কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া।
চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি
গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালবাসি...”
আমার “প্রথম প্রেম” কেউ জিগেস করলে কাউকে বলতাম না তোমার কথা কেন জানো? লজ্জা পেতাম খুব, শুধু বলতাম আমার এক অসাধারণ প্রেমিক আছে। ভাবতাম ওরা যদি আমাকে হিংসে করে অথবা আমার প্রেমকে নিয়ে হাসাহাসি করে?
“ভেবেছিনু মনে মনে দূরে দূরে থাকি
চিরজন্ম সঙ্গোপনে পূজিব একাকী----
কেহ জানিবে না মোর গভীর প্রণয়,
কেহ দেখিবে না মোর অশ্রুবারিচয়।”
কত রাত তোমাকে স্বপ্ন দেখেছি আর ভেবেছি, তোমাকে যদি কাছে পেতাম অনেক কিছু জিগেস করতাম । আজও আমি তোমাকে ভাবি আর আমার এই ভালবাসার ডালি ভরে উঠে নানান ফুলের বিচিত্র সব গন্ধে।
আমি জানি, ভাল চিন্তায় বাস না করলে ভালর দিকে অগ্রসর হওয়া যায় না। চিন্তার ভালমন্দর গতি আমাদের আচার ব্যবহারের গতি নিয়ন্ত্রণ করে। চিন্তা সংযত না হলে আমাদের স্বভাব যথেচ্ছচারী ও শিথিল হয়ে পড়ে। আচ্ছা! কার চালনায় এই চিন্তাকে আমরা সংযত করি বলতে পারো? সেই সারথি বা কে? সেই সারথিই হচ্ছে জ্ঞান, তাই নয় কি? আর এই জ্ঞান আমি সংগ্রহ করেছি তোমার কাছ থেকে।
জানো তো? পৃ্থিবীতে আজকাল নারীদিবস মানা হয়। এই নারীদিবস-এর প্রকৃ্ত সংজ্ঞা আমার জানা নেই। আমি শুধু জানি কিছু অজ্ঞাতে থাকা নারীকে আজও অনাসক্ত স্বামীর প্রতি অভিমান বা নিজের বিবেকের আত্মদংশনেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়। নতুবা মুখ বুজে সহ্য করতে হয় তাদের পাশবিকতা। তোমার আদরের বৌঠান কাদম্বরীদেবীর মৃত্যুর পরে 'পুষ্পাঞ্জলি'তে তুমি লিখেছিলে, “যাহারা ভাল, যাহারা ভালবাসিতে পারে, যাহাদের হৃদয় আছে, সংসারে তাহাদের কিসের সুখ! কিছু না! কিছু না। তাহারা যন্ত্রের মতো, বীণার মতো -তাহাদের প্রত্যেক শিরা সংসারের প্রতি আঘাতে বাজিয়া উঠিতেছে। সে গান সকলেই শুনে, শুনিয়া সকলেই মুগ্ধ হয় - তাহাদের বিলাপধ্বনি রাগিণী হইয়া উঠে, শুনিয়া কেহ নিঃশ্বাস ফেলে না।”
বেশ বোঝা যায় এই বীণাটি আর কেউ নন, কাদম্বরী দেবী। আজও তাই কাদম্বরী দেবী আমার ঈর্ষার দেবী, যাঁর ছবি তোমার গল্পে, গানে, আঁকায়, যাঁর প্রেরণায় তোমার কবি-মন উজ্জীবিত হয়েছিল। এই তোমার বৌঠান-এর মতন এখনও অনেক নারী আছে যারা শুধু নীরবে চোখের জল ফেলে পাছে কেউ ঘৃ্ণা করে । কিন্তু তবুও বলবো উনি ছিলেন নির্ঝরিণী আর আমি হলাম ক্ষুদ্র এক নারী। তবু তোমার সাথে প্রেম করতে বাধা কোথায় বলো। এ তো শুধু অন্তরের এক তৃষ্ণা। তাই না?
আবারও কোথাও আছে, “পাষণ্ড নরাধম পাষাণ হৃদয় যে ইচ্ছা সেই ঝন্ঝন্ করিয়া চলিয়া যায়, ...আর মনে রাখে না। এ বীণাটিকে তাহারা দেবতার অনুগ্রহ বলিয়া মনে করে না- তাহারা আপনাকেই প্রভু বলিয়া জানে - এই জন্যে কখনো-বা উপহাস করিয়া, কখনো-বা অনাবশ্যক জ্ঞান করিয়া, এই সুমধুর সুকোমল পবিত্রতার উপরে তাহাদের কঠিন চরণের আঘাত করে...”
কবি বিহারীলাল তাঁর 'সাধের আসনে' পতিব্রতা কাদম্বরী দেবীকে বলছিলেন, --“আর এস না ধরায়" কারণঃ
"পুরুষ কিম্ভূতমতি চেনে না তোমায়।
মন প্রাণ যৌবন --
কি দিয়া পাইবে মন।
পশুর মতন এরা নিতুই নতুন চায়।”
সত্যি কিন্তু তাই। এখনো দেশে বিদেশে মেয়েরা যতই এগিয়ে যাক না কেন, এখনো ভাল করে দেখলে দেখা যাবে, যে সব নারী আদর্শকে ধরে রেখেছে তারা চিন্তার ফসল হয়েছে। তারা নিভৃতে শুধু হাহাকার করে, তাদের চোখের জল কেউ দেখতে পায় না।
তোমার অতীবসুন্দরী ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাদেবী সেকেলে রক্ষণশীলতা আর একেলে উগ্র আধুনিকতা দুইই বর্জনের পক্ষপাতী ছিলেন। সব জায়গাতেই তিনি উগ্রতাবিরোধী এবং মধ্যপন্থাবলম্বী । তাঁর নিজস্ব মতঃ
“সেকালের ধিরা-স্থিরাদের সঙ্গে একালের বীরা হতে হবে; অথবা সেকালের শ্রী ও হ্রীর সঙ্গে একালের ধী মেলাতে হবে - বঙ্কিমবাবু হলে যাকে বলতেন প্রখরে -মধুরে মেশা। এই সামঞ্জস্যই নারীজীবনের মূলমন্ত্র।"
আমি মনেপ্রাণে স্বীকার করি প্রভু। কিন্তু মুক্তিকামী তুমি বঞ্চিতা নারীদের ভীরুতা, লাজ-লজ্জা ত্যাগ করে নিজেকে প্রকাশ করতে বলেছো। 'ছিন্ন' করতে বলেছো 'রঙিন কুয়াশা', 'অবনত দৃষ্টি আবেশ'। সহজ সরল এবং স্বচ্ছ দৃষ্টি থাকলে তবে নিজের চারপাশে অর্থাৎ ঘেরাটোপের বন্দীজীবনের ছবিটা চোখে পড়বে, তবেই সেই বন্দীজীবন থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা থাকবে, তুমি বলেছিলে। বর্তমান নারী বিশ্বকে দেখতে চায়, জানতে চায় ও বুঝতে চায়। এই চাওয়ার মধ্য দিয়ে তার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়। নারী নিজেকে যখনই প্রকাশ করবে তখনই সে মুক্তিকে উপলব্ধি করতে পারবে। নিজেকে যদি প্রকাশ না করে তাহলে কোনদিন সে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারবে না, বিভিন্ন আচার সংস্কারের গণ্ডির মধ্যে থেকে বন্দীজীবনই যাপন করবে। মুক্তির দ্বা্র তার কাছে থাকবে রুদ্ধ। তুমি তো রুদ্ধ দ্বার ভেঙে মুক্ত হতে বলেছো। নিজেকে পূর্ণভাবে মুক্ত করতে বা প্রকাশ করতে না পারলে মুক্তি সম্ভব নয়, তাও তুমি বলেছো। সেইজন্য তুমি নারীকে পূর্ণভাবে প্রকাশিত হতে বলেছো এবং অবহেলিত নারীদের কাছে মুক্তির বাণী এনে দিয়েছিলে এইভাবে -
“ হে সুন্দরী,
মুক্ত করো অসম্মান, তব অপ্রকাশ-আবরণ।
হে বন্দিনী, বন্ধনেরে কোরো না কৃ্ত্রিম আভরণ।”
কিন্তু প্রভু! এবার আমার প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই, যখন একটা অসহায় মেয়ে মুক্তির জন্য রুখে দাঁড়ায় তখন তার পরিস্থিতি কেমন হবে? বাইরে স্বামীর ভালবাসার বহর দেখানো আর ঘরে সেই মেয়েকে মানসিক অত্যাচারে জর্জরিত করলে, সে কি সমাজের চোখে সুস্থ জীবন পেতে পারে, না - সেই একঘেয়ে আলোচনার শিকার হবে?
বলছি না আমি যে সংসার-স্বামী, সন্তান ছেড়ে নিজের সুখ কামনার জন্য পরপুরুষের কন্ঠলগ্না হতে হবে, স্বামীকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে চাতুরিকতায় নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখতে হবে--আমার মতে সে আদর্শ নারী নয়, সে নারী জাতির উপঢৌকনমাত্র, নারীজাতির অপমান। তা আমি স্বীকার করি মনে প্রাণে। সেই সব নারীদের কথা আমি বলছি যারা মুখ বুজে শুধু দিয়ে গেল অফুরন্ত, পেল না কিছু। যারা ঘরে বাইরে রয়ে গেল কেবলি পবিত্র, তাদের চিনল না কেউ, তারা শুধু নিজেদের রেখে দিল অন্ধকারে।
জানো তো---অনেক প্রশ্ন থাকে মনে যার উচিত উত্তর বা সমাধান আর পাই না আমি জেনে নিতে। তাই তোমাকেই আমি এইসব প্রশ্ন কোরলাম, তুমি হয়ত ভাববে এই আধুনিক যুগেও এইরকম অস্বাভাবিক মানুষজন আছে নাকি? হ্যাঁ আছে প্রভু, আছে।
পুরুষেরা নিজেরা নিজেদের বাইরে যতটা সম্প্রসারিত করুক না কেন--ঘরে তারা সেই আদিম যুগের ধারাবাহিকতাকে ধরে রেখেছে। মেয়েদের তারা খেলার পুতুল এখনও ভাবে। সত্যি কিছু পুরুষ যারা বাইরে মেয়ে-স্বাধীনতা বা মেয়েদের আশা ভরসা নিয়ে কিছু করার জন্য ব্যতিব্যস্ত, তাদের সাথে গলা মেলায় -- চিন্তান্বিত দেখায় নিজেদের। কিন্তু ঘরের মধ্যে যে নারী আছে তার কথা চিন্তা করার সময় তাদের নেই। নির্বিঘ্নে, শান্তভাবে তাদের মানসিক অত্যাচার করে চলে, তাদের আপনজনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে শুধুমাত্র স্নিগ্ধ সরলতার সুযোগ নিয়ে।
তাই বলি প্রভু, তুমি আজ থাকলে লিখে ফেলতে নারীদিবস-এর কাহিনি। আমরা লিখে, এঁকে, গান গেয়ে সমাজ বদলে দেব -– এ সত্যি এক ইউটোপিয়া। তা হলে তোমাকে পথে নামতে হত না, লিখতে হত না- “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে।”
তাই বলি, সময় পেলে একবার ঘুরে যাও প্রভু। জানো তো --তোমার মন খারাপ হলে, আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ি তোমার মন ভালো হয়, তোমার মন ভার হয় ক্রমে তোমার গলা ধরে আসে। আমার মন খারাপ হলে, আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ি আমি বুঝতে পারি, তুমি কখন আমায় ছেড়ে গেছ অক্ষরে অক্ষরে বহু দূর; কারণ আর কেউ থাকলে তো তিনি তোমার পাশে এসে গা ঘেঁষে এভাবে বসতেন না!
এই সব সময় আমি বড্ড ঈর্ষাপ্রবণ হয়ে উঠি !!!!
অনেক আবোলতাবোল লিখলাম, ভুল হলে ক্ষমা করে দিও তুমি। আগেই বলেছি তুমিই আমার প্রথম প্রেম। তুমিই আমার সান্ত্বনা।
(পরবাস-৪৯, অক্টোবর, ২০১১)