“শৃণ্বন্তু বিশ্বে”; রামপ্রসাদ সেন; প্রকাশকঃ এ মুখার্জী এণ্ড কোং, কলকাতা-৭৩; প্রথম প্রকাশঃ ভাদ্র ১৩৯০; ISBN no. নেই।
“পরবাস” পত্রিকার এই “গ্রন্থ-সমালোচনা”-বিভাগে আমরা যে কেবল নতুন প্রকাশিত গ্রন্থরাজির কথাই বলি, তা নয়। তেমন তেমন বাঙলা বই, যেগুলি কিনা ক্লাসিকের পর্যায়ে পড়ে, কিন্তু প্রচারের অভাবে আজ হয়ত বিস্মৃতির অতলে, তাদের কথাও স-মর্যাদা আজকের পাঠকের সামনে তুলে ধরায় আমাদের আনন্দ! এই ধারাতেই এই বিভাগে “খেরোর খাতা”, “স্থানাঙ্ক নির্ণয়” বা উল্লাসকর দত্তের জীবনীগ্রন্থের আলোচনা হয়েছে। সে-ক্ষেত্রে, অবশ্য “গ্রন্থ-সমালোচনা” না বলে, সশ্রদ্ধ “গ্রন্থ-পরিচয়” শিরোনামই অধিক উপযুক্ত।
এই ধারাতেই আসে বর্তমান আলোচিত এই গ্রন্থখানিঃ রামপ্রসাদ সেনের লেখা “শৃণ্বন্তু বিশ্বে”। ঊনিশশ’ চল্লিশের দশকে সজনীকান্তের উন্নাসিক “শনিবারের চিঠি”-তে ধারাবাহিক প্রকাশিত উপন্যাসখানি কলকাতার প্রকাশনালয় এ.মুখার্জী (“আমরা বই ছাপি না, বিষয় ছাপি”) গ্রন্থাকারে বের করেন তা-ও ত্রিশ বছর আগে। বর্তমানে বইখানি সহজলভ্য নয়।
না, এ’ ‘রামপ্রসাদ’ সে-‘রামপ্রসাদ’ নন। কারণ, ‘রামপ্রসাদ সেন’ বলতেই আমাদের “বল মা তারা দাঁড়াই কোথা”- মনে পড়ে কিনা! এনার এই একটিই মাত্র অতি সুপাঠ্য (ও সেকালে যথেষ্ট জনপ্রিয়) উপন্যাস ছাড়া অন্য কোনো লেখার হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে, এক অর্থে এই রামপ্রসাদও এক ‘সাধক’ বটেন, পথের সাধক, এক ‘পরিব্রাজক’, যদিও তাঁর পথ চলা হিমালয় বা নর্মদার কোনো তীর্থে-তীর্থে নয়। ১৯২০-৩০র দশকে নেহাতই পেটের দায়ে বোকাসোকা মুখ্যু ‘দামোদর’ ঘর ছাড়লো পঙ্গু বাপ, স্নেহশীলা মা ও জড়ভরত দাদার মুখে অন্ন জোগাতে। সেই যে শুরু হল বেচারির পথ চলা, কত ঘাটের কত জল খেয়ে, কত লাথি-ঝাঁটা-প্রেম-ভালোবাসা-রাজসম্মান সয়ে সেই চলা ও চলা ও চলা......পাঠকের মনে হয়, সে-চলা যেন আজও শেষ হয় নি!
বাপ ছিলেন সেকালের কলকাতার নামি ফোটোগ্রাফার, ‘সাহেব কর্মচারী’ খাটতো তাঁর দোকানে! তৎকালীন দেশীয় রাজ্যে রাজ্যে বছরভোর সপরিবার থেকে ফোটোগ্রাফির বরাত পেতেন পিতা চন্দ্রমোহন---সে-সবের মনোজ্ঞ বর্ণনা রয়েছে। দামুর বড় জ্যেঠা ছিলেন রাজপুতানার সূর্্যনগর রাজ্যের দেওয়ান, মেজজ্যাঠা হরমোহন মজুমদার সেকালের দিল্লির একমাত্র ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মালিক। ঊনিশশ’ বিশ-ত্রিশের দশকের দিল্লি-রাজপুতানার ইসলামি-বৃটিশ মেশানো সংস্কৃতি, মানুষের রহন-সহন, খানাপিনা, প্রেম-ভালোবাসা, বাঙালির উঁচু কদর---- এ’সব বড্ড সুখপাঠ্য, যত্রতত্র পড়ার সুযোগ মেলে না। অনিবার্য ভাবেই বাঙলার আরেক মহাগ্রন্থ “মহাস্থবির জাতক” মনে পড়বে। এ’দুই গ্রন্থের সময়ের ফারাকটা বছর বিশেকের বেশি নয়। কাহিনির গতি, তথ্য ও সুখপাঠ্যতায় “জাতক”-এর থেকে “শৃণ্বন্তু বিশ্বে” কিন্তু বড় একটা পিছিয়ে নেই, যদিও আজকের বাঙালি পাঠক এ’বইকে মনে রাখেনি।
দিল্লির জ্যেঠা-বাড়ির অনাদর ও ভাইসরিগ্যাল লজের মই-বওয়া বিজলিমিস্ত্রির নৌকরি হেলায় পায়ে ঠেলে পনের বছরের দামু পাড়ি জমালো টাটানগর হয়ে রৌরকেল্লা---বিশের দশকের ছ’-ছ’ দিনের রেলসফর, শেষের খণ্ডটি আবার আকরিক লৌহ-বওয়া মালগাড়ি, তথা হাতে-ঠেলা ট্রলিতে! রৌরকেল্লা সে-সময়ে এক নগণ্য গ্রাম মাত্র। সেখানে ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটানো শেখা থেকে এক কিশোরী না-আত্মীয়াকে বিবস্ত্র করে ‘চুমু খেতে গিয়ে’ পশ্চাদ্দেশে পদাঘাত প্রাপ্তি, ও ঠেলে এসে ওঠা শানদার দেশীয় রাজ্য জয়পুরে --- এ’সবের অকপট বর্ণনা রয়েছে! জয়পুরে নিজগুণে যুবরাজের ব্যক্তিগত দোস্তের দর্জা পাওয়া থেকে জুয়া-মদে ভেসে পথের ভিক্ষু হয়ে দিল্লির জামা মসজিদের সিঁড়িতে কুষ্ঠরুগীদের সাহচর্যে দিনাতিপাত---এনে দিয়েছে এক মহাকাব্যিক এন্টি হিরোর বাস! এর পাশাপাশি মানুষদেখার কাব্যি তো চলছেইঃ তাদের কেউ দয়ালু তো কেউ কপট, কেউ সমকামি, কোনো রাজা সারা বচ্ছর রাজকার্য ফেলে পোলো খেলেই চলেছেন। দিল্লির মানুষের সদা গালি টেনে কথা কওয়ার রীত, মানুষের কৃতজ্ঞতা-বেইমানি। আর সেই প্রবল প্রতাপান্বিত আই সি এস-জায়ার সঙ্গে দামোদরের...., যাঃ, সব বলে দিলে তো বইখানি খুঁজে নিয়ে পড়বার চাড়-ই চলে যাবে।
বইখানি পড়তে পড়তে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবেই, কোন্সে অতীত থেকে কোন্সে ইব্ন বতুতা থেকে আমাদের সুরেশ বিশ্বেস--- কী আকর্ষণে পথকেই ঘর করে নিয়েছিলেন? কী পান এ’সব ভাণ্ডারলুস্টেরা? ‘তাঁকে’ জানলে নাকি মৃত্যুকে অতিক্রম করা যায়। এই ‘তাঁকে’ কি পথে পথেই খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা? তিনিই না ধুলিবসন পরে ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় পদচিহ্ন রেখে যান! ‘শৃণ্বন্তু বিশ্বে’ আর কী পাওয়া যেতে পারে? রামপ্রসাদ সেনের এই বই তাই রসিক পাঠকের ব্যক্তিগত ভাণ্ডারে এক উজ্জ্বল সংযোজন হয়ে থাকবে।
প্রচ্ছদটিও দেখুনঃ কী চমৎকার হয়েছে, না? এঁকেছিলেন নামি ইলাস্ট্রেটর সুধীর মৈত্র।
নির্বাচিত রচনাঃ সুফিয়া কামাল; শ্যামলী গুপ্ত-আবদুস সাত্তার-গৌতম রায় সম্পাদিত। প্রকাশকঃ পুনশ্চ, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশঃ জুলাই ২০০৫; ISBN no. 81-7332-450-8
ও’পারে গঙ্গার কূলে ছিলেন আশাপূর্ণা, আশাপূর্ণা দেবী। আর এ’পারে পদ্মাকূলে সুফিয়াদি, ‘বঙ্গজননী’ সুফিয়া কামাল। যদিও সুফিয়াদিকে শুধু ‘পদ্মাপারের কবি’ বললে কিছুটা খাটো করে ফেলা হবে, কারণ, কলকাতার সঙ্গেও তাঁর নাড়ির টান ছিল। কোটীপতি নওয়াব-ঘরের মেয়ে নিজে মাথা তুলে দাঁড়ানোর তাগিদে ট্যাংরার কর্পোরেশন ইস্কুলে আট বচ্ছর মাস্টারি করেছেন! আসলে, এই দুই অগ্রগণ্যার মিলের স্থানটি একই ছিল কিনা। বাঙলার নারীমুক্তির আন্দোলনে কলমেরও ব্যবহার সেই যে বেগম রোকেয়া দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর আদরের ‘ফুলকবি’ সুফিয়া সারাজীবন সেই গুরুবাণীর অনুপালন করে গিয়েছেন।
অতুল বৈভবী শায়েস্তাবাদের (বরিশাল) নওয়াব পরিবারের দৌহিত্রী, সেখানেই জন্ম ও লালিতা। ধর্মভীরু, প্রজাবৎসল, দানবীর, বিদ্যোৎসাহী বংশ। কিন্তু স্ত্রীশিক্ষার ঘোরতর বিরোধী! এই পরিবেশে বাড়ির বিশাল লাইব্রেরি ঘেঁটে সুফিয়া শিখে নিলেন বিজ্ঞান, গণিত, ইংরিজি! পনের বছরের বালিকা সুফিয়ার প্রথম কবিতা বেরোল নামী ‘সাওগাত’ পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের আশীর্বাণী! সেই শুরু। সেই থেকে ভাষা-আন্দোলনের নেত্রী থেকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ‘তম্ঘা-ই-ইমতিয়াজ’ সম্মানলাভ (ও আয়ুব খানি জঙ্গীশাহীর প্রতিবাদে তা প্রত্যর্পণ), থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের কাণ্ডারী থেকে বিশ্বের কাছে স্বাধীন বাঙলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজদূত হিসেবে পরিচিতি। বর্ণময় জীবন! আর এ’সবের মধ্যেও, পারিবারিক বিপর্যয়ে বা রাষ্ট্রীয় উতর-চড়াইয়ে থেমে থাকেনি সুফিয়া কামালের কলম। তা থেকে যেমন বেরিয়ে এসেছে তাবৎ জাতিকে উদ্বুদ্ধকারী কবিতা “মোর যাদুদের সমাধি ’পরে”, তেমনি আছে “কেয়ার কাঁটা”-র মত মিষ্টি প্রেমকাহিনি, আবার “নূরজাহান”-এর মত নাটিকা। আর ‘শিশুসাহিত্য’ ভুললে চলবে কেন? “ইতল বিতল”-এর মত ছড়া তো রবি ঠাকুরের “গলদা চিংড়ি তিংড়ি মিংড়ি” মনে পড়ায়!
এ’হেন সুফিয়া কামালের রচনা পশ্চিমবঙ্গে সহজলভ্য ছিল না। বহুকালের এই খামতি মেটালেন কোলকাতার ‘পুনশ্চ’ প্রকাশনী। শ্যামলী গুপ্ত-আবদুস সাত্তার-গৌতম রায় সু-সম্পাদিত কেতাবখানি পশ্চিমবাঙালির ঘরে ঘরে ঠাঁই করে নিক। চমৎকার উপস্থাপনা, অসাধারণ প্রচ্ছদ (সরোজ সরকার কৃত), টেকসই বাঁধাই! আর চয়ন? কবি সিকান্দার আবু জাফর সাহেবের অনুরোধে সুফিয়া ৭৭ বছর বয়সে তাঁর ‘শিশুবেলা’-র গপ্প শুনিয়েছিলেন (১৯৮৮)। সেটি দিয়েই এ’-সংকলনের নান্দীমুখ। অসাধারণ! অসাধারণ!! রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা” বা সত্যজিতের “যখন ছোট ছিলাম” ছাড়া বাঙলাভাষায় এ’হেন ছোটবেলার গল্প বড় একটা লেখা হয়নি। তাঁর প্রখ্যাত “মোর যাদুদের সমাধি ’পরে” কাব্যগ্রন্থ অবধারিতভাবে স্থান পেয়েছে এই সংকলনে। রয়েছে অনন্য পত্রাচার-গদ্য “যে নদী মরু পথে হারালো ধারা” প্রভৃতি প্রতিনিধিস্থানীয় লেখাও। কেবল, ওনার প্রথম প্রকাশিত “বাসন্তী” কবিতাখানি এ’সংকলনে স্থান পেল না দেখে আশাহত হয়েছি। কবিতাখানি বোধহয় হারিয়েই গেছে, খুঁজেই পাওয়া যাবে না আর কখনও! দেশবিভাগের পরে পরেই প্রকাশিত ‘মায়া-কাজল’ কাব্যগ্রন্থও এতে নেই। তা না থাক, শ’ পাঁচেক পৃষ্ঠার মধ্যে সুফিয়া কামালকে গঙ্গাপারের পাঠক-পাঠিকাদের হাতে তুলে দেওয়া গেছে, এটা কম কথা নয়।
গ্রন্থপাঠ শেষে মনে হয়, সর্বশক্তিমানের কোন দোয়া থাকলে সুফিয়া কামালের মত প্রতিভার স্ফুরণ ও বিকাশ সম্ভব হতে পারে! এ’ বোধহয় তাঁর সংসারত্যাগী মক্কাবাসী পিতৃদেবের আশীর্বাদ, যা সদা তাঁর মস্তকে বর্ষিত হয়েছে।
আসলে, বেগম রোকেয়া, আশাপূর্ণা বা সুফিয়া কামালের মত মানুষ তো আর রোজ রোজ ঘরে ঘরে জন্মান না। তবু তাঁরা এসেছেন বলেই আজও চারপাশটায় এতো আলো দেখতে পাওয়া যায়!!
সত্যের সন্ধানে ৫১ পীঠ; হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়; প্রকাশকঃ দীপ প্রকাশন, কলকাতা-৬; প্রথম প্রকাশঃ ২০০৬; ISBN no. নেই।
ভারতের গল্প নয়।
এ’কাহিনি মিশরদেশের।
মৃত্যু (বা উত্তর-জীবনের ) দেবতা রাজা ওসাইরিস। রাণী তাঁর আইসিস, মাতৃত্বের দেবী। ঈর্ষাপরায়ণ ভ্রাতা সেত কপটে ওসাইরিসকে বন্দী করে ফেলে এক কফিনের মধ্যে! তারপর খণ্ড খণ্ড করে কেটে সে-কফিন ছড়িয়ে দেয় দেশের ছাব্বিশ প্রান্তে। কিন্তু এতো করেও রাজা ওসাইরিসের জনপ্রিয়তা বন্ধ করতে পারল না সেত, বরং তা বেড়েই গেল! সেই ছাব্বিশ স্থান যেখানে যেখানে দেবতার দেহাংশ পড়েছিল, তা ক্রমে পুণ্যতীর্থের দর্জা পেতে লাগল। আজও তথায় বন্দনা চলে প্রতি পূর্ণিমায়। অপরিসীম তাদের স্থান-মাহাত্ম্য!
সুধী পাঠিকার কি কোনো চেনা উপাখ্যান মনে পড়ছে? হ্যাঁ, ভারতীয় পুরাণের সতী কাহিনির কথাই বলছি। ‘প্রসাদ’-সম্পাদকের বর্তমান গ্রন্থখানি পড়তে পড়তে ঐ মিশরীয় কথা মনে পড়ে গেল।
ভারতীয় হিন্দুর কাছে সতীপীঠের মাহাত্ম্য অপরিসীম---যুগ যুগ ধরে। হিউয়েন সাঙ্-এর লেখায় ‘কুম্ভমেলা’-র পাশাপাশি ‘জলন্ধর’ সতীপীঠের বর্ণনা পাওয়া যায়। সতীপীঠের কথা সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজলের রচনাতেও রয়েছে। আর আছে হিন্দুর ধমনীতে ধমনীতে ছড়িয়ে সতীমায়ের আখ্যান।
সতীপীঠের সংখ্যা কত?
৪,৫১,৫২,৫৩,...এ’রকম একাধিক সংখ্যা নানান পুরাণে পাওয়া যায়। ‘৫১’-সংখ্যাখানিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য, এবং হিমাংশুবাবুও তাঁর বর্তমান পুস্তকখানির শিরোনামে ‘৫১’-সতীপীঠের কথাই লিখেছেন, যদিও একান্নখানি পীঠেরই ক্রমবর্ণনা দিতে বসেননি এই শত পৃষ্ঠার গ্রন্থে, যাতে সাহিত্য না হয়ে এটির একটি ‘ভ্রমণ-গাইড’ হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। তা হয়নি, তাই সাহিত্যমানেও উঁচু কয়েকটি নিবন্ধ পড়তে পাওয়া গেছে। “মহাতীর্থ কালীঘাট” রচনাখানি গুণমানে উচ্চ। প্রথম নিবন্ধ “ক্ষীরগ্রামের দেবী যোগ্যদা”-র পরিশিষ্টে তরু দত্তের ইং-কাব্য মুগ্ধ করেছে। তরু দত্ত-হেন সেকালের ‘অতি আধুনিকা’ কবি যে মা যুগাদ্যার শাঁখা পরার কাহিনি নিয়ে ইংরিজিতে দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন, জানা ছিল না; জেনে পুলকিত হওয়া গেল। ৫১-সতীপীঠের মান্য তালিকায় তারাপীঠের নাম আসেনা জানিয়েও চমৎকার মুন্সীয়ানায় এ’ মোক্ষতীর্থের গাথা গেয়েছেন হিমাংশুবাবু। এখানে ব্রহ্মাপুত্র বশিষ্ঠের চিন দেশে গিয়ে তপস্যা করার তথ্যখানি নূতন ও চমকপ্রদ, যদিও প্রামাণ্য সূত্র হিসেবে দু-এক তন্ত্র গ্রন্থের নাম রয়েছে মাত্র।
কয়েকটি পীঠের উল্লেখ / অনুল্লেখ আলোচনার দাবী রাখে। সিন্ধুর ‘করবীরপুর’ (করবীরপুর বর্তমান মহারাষ্ট্রের কোলহাপুর নয় তো?) বা বালুচিস্তানের ‘হিংলাজ’ নিবন্ধ দুটি অতি সংক্ষিপ্ত, যেমন “খুলনার নারায়ণী”ও। এবং এইসব পীঠে লেখকের পদার্পণও ঘটেনি। অতএব এদের উল্লেখ উহ্য থাকতে পারত---বিশেষতঃ, এই প্রথম খণ্ডে। অপর পক্ষে, এই বাংলার সেইসব সতীপীঠ, যাদের প্রচার বড় কম, যেমন আমতা বা খানাকুল বা তমলুক,---এদের ওপর আলোচনা পেলে অধিকতর পুলকিত হওয়া যেত।
মুদ্রণপ্রমাদ বহু চোখে পড়েছে। প্রচ্ছদখানি চমৎকার হয়েছেঃ রঞ্জন দত্ত কৃত। ডজনখানেক সাদাকালো ফোটো রয়েছে---মান মামুলি। তবে সার্বিক প্রচেষ্টাখানি সৎ। সেটাই আকর্ষণবিন্দু।
The Barn Owl’s Wondrous Capers; Sarnath Banerjee; Penguin India; First published 2007; ISBN No. 978-0-14400-108-8
মিকেলাঞ্জেলোকে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস যখন রোমের সিস্টিন গির্জার ভিতর-ছাদে বাইবেলের ছবি আঁকতে ডাকলেন, তিনি একটা পুরো সপ্তাহ সময় নিয়েছিলেন কেবল তার প্রেক্ষাপটখানি নিরীক্ষা করতে--- ১৩৩ ফিট বাই ৪৬ ফিট, ধনুকাকৃতি ছাদ। এইখানেই ছবি আঁকতে হবে? মুখটা যখন আঁকা হবে পদযুগল তখন ছাদের ও’প্রান্তে---দেখাই যাবে না। এরপর যখন সত্যি সত্যি ছবি আঁকা শুরু হল সেই বিশাল ‘ক্যানভাস’-এ, দড়ি বেঁধে ঝুলে ঝুলে আঁকার সময় টপ টপ করে রঙের ফোঁটা এসে পড়তে লাগল মিকেলাঞ্জেলোর চোখে মুখে। কই, অঙ্কন শুরু করার সময়ে এ-সমস্যাটা তো ভেবে রাখা যায় নি!
জানিনা, বর্তমান গ্রন্থখানি লিখতে নবীন শিল্পী ও লেখক শ্রীমান সারনাথকে এ’হেন সমস্যায় পড়তে হয়েছিল কিনা, কারণ এর প্রেক্ষাপটটিও সিস্টান গির্জার ছাদের চেয়ে কম বড় ও ট্যাড়া নয়। সপ্তদশ শতাব্দীর উত্তর জার্মানির লিবেক প্রাসাদে যে কাহিনির শুরু, অষ্টাদশ শতকের কলকাতার – ওয়ারেন হেস্টিংস-ফিলিপ ফ্রান্সিসের কিংবদন্তি ডুয়েল হয়ে উত্তর কলকাতার ঘিঞ্জি গলির ফড়ে ডিজিটাল দত্তের কিস্সা হয়ে সে-কাহিনি প্রলম্বিত...... প্রলম্বিত...... কোথায় শেষ তার? জানি না। এ’বই পড়ার / দেখার পর দিন তিনেক গুড়ুম হয়ে বসে বসে কাহিনির শেষ খুঁজতে হয়...... চোখে ভাসে ছবি ছবি ছবি। সুধী পাঠকের জাঁ লুক গদার মনে পড়ে যাবে। সারনাথ তাই কাহিনিকার, চিত্রী না বই-এর পাতায় সিনেমাটোগ্রাফার ---ধন্ধে পড়ি! যে-মুন্সীয়ানায় সারনাথ সাদাকালো ছবির সঙ্গে রঙিন চিত্রের সঙ্গে ফোটোগ্রাফের কোলাজ করেছেন---উনি চিত্রী না লেখক কোন্ভূমিকায় সফলতর, পাঠককে দ্বিধায় পড়তে হবেই। উপেন্দ্রকিশোরের পর কোন্বাঙালির এমন মৌলিক লেখায় ও রেখায় সমহাত ছিল, ভাবতে বসতে হবে। হোক্ না ভাষাটা ইংরিজি, ভারতের প্রথম সফল সচিত্র-উপন্যাসের (graphic novel) স্রষ্টা হিসেবে বাঙলি সারনাথ স্মরণীয় হয়ে থাকবেনই। আর সমস্ত কাহিনি জুড়ে কী অবলীলায় উনি নিজেকে, নিজের লণ্ডনবাসিনী প্রেমিকাকে, মা-কে পরতে পরতে জড়িয়ে ফেলেছেন---পুরনো জারানো আচারের স্বাদ এনে দিয়ে! লণ্ডনে বসে যেই মায়ের ফোন পেলেন, পরের শটেই মায়ের রান্নাঘরের ছবি গদারি চাল এনে দেয়! অনবদ্য।
সচিত্র-উপন্যাস ভারতে হালে লেখা হচ্ছে। সারনাথ তার একজন সফল পথিকৃৎ। ইরানের সেই ফরাসি-কিশোরির দুনিয়া-কাঁপানো চিত্র-উপন্যাস ‘পার্সিপোলিস’-এর কত নাম! ভারতের সারনাথ বাঁড়ুয্যে তার থেকে পিছিয়ে তো নন-ই, বরং মারযানে সাত্রাপির চেয়ে ‘বার্ন আউল’-কে অন্ততঃ বিশ প্রতিশত নম্বর বেশিই দেওয়া উচিৎ। সারনাথের পরবর্তী গ্রন্থ “হরপ্পা ফাইল”-ও হাতে এসেছে, চোখ বুলিয়েই মুগ্ধ হয়েছি। পরে বিস্তৃত লেখার ইচ্ছে রইল।
কালীপ্রসন্ন সিংহের "হুতোম প্যাঁচার নকশা", বা তার অপেক্ষাকৃত নতুন অনুবাদ The Observant Owl Hootum’s Vignettes of Nineteenth-century Calcutta যে এ বইটির প্রেরণা, তা নিশ্চয়ই এতক্ষনে ধরে ফেলেছেন। শেষে একটি কথাঃ উত্তর কলকাতার সাবেকি বাঙালি সংস্কৃতি এই ইঙ্গ-উপন্যাসে এতোটাই লীন হয়ে রয়েছে যে, অবাঙালি বা আন্তর্জাতিক পাঠক, এ’-সংস্কৃতি যাঁদের অগোচরে, তাঁরা এ’রস কতটা নিতে পারবেন, সেটাই দেখার।
সারনাথ কালে আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও স্বীকৃতি পাবেন --- এতে কোনো সন্দেহ রাখি না।
জয়স্তু!!!
পুনঃ – ওয়ারেন হেস্টিংস কিন্তু কোনদিনই ‘লর্ড’ ছিলেন না। বারবার লেখা হয়েছে। শুধরে নিতে হবে।
(পরবাস-৪৯, অক্টোবর, ২০১১)