আগুনপাখি: হাসান আজিজুল হক; দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা: এপ্রিল ২০০৮, ISBN 978-81-295-0820-1
হাসান আজিজুল হকের বয়স বর্তমানে বাহাত্তর। তিন বছর আগে, এ-বই প্রকাশের সময় তিনি প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই। যদি ধরে নিই এই লেখা তারও পাঁচ বা দশ বছর আগে লেখা, তবু বিস্ময় বিঘ্নিত হয়না। বর্ধমান-বাঁকুড়া অঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বধূর জবানিতে তারই বাগ্ধারায় যে উপন্যাসটি লিখেছেন এই ষাটোর্ধ্ব কথাশিল্পীটি, বহমানতায়, সততায়, নিরঙ্কুশ পবিত্রতায়, ক্ষুরধার চরিত্র-চিত্রণে তা হয়ে উঠেছে এক অতুলনীয় মানবিক দলিল।
দলিল বলছি, কেননা আমরা সমকালীন গ্রামের সমাজের একটি নিখুঁত ছবি এর মধ্যে পাই প্রেক্ষাপটে, আর তার সামনের মঞ্চে পাই একটি একান্নবর্তী মুসলিম পরিবারের উত্থানপতনের এক অনুপুঙ্খ বিবরণ। মানবিক বলছি, কারণ বড়-হয়ে-ওঠার-আগেই-বিয়ে-হয়ে-যাওয়া একটি সাধারণ মেয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা, মান-অভিমান, স্বপ্ন-সুখের যে নিরুপম blog আমরা 'আগুনপাখি'-তে পাই, তার বিশদ বিবরণ এখানে দেওয়া শুধু অসম্ভব নয়, বোধহয় অসঙ্গতও।
প্রত্যেক পরিবারেই কিছু কাহিনী থাকে, কখনও থাকে কলঙ্কও। পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও থাকে দু-একটি স্বার্থশূন্য চরিত্র, কিছু নীরব নিরুচ্চার ব্যাক্তিত্ব, এবং প্রবল কর্তৃত্ব-সম্পন্ন একটি মানুষ, হয়তো তারই সঙ্গে কিছু আশ্রিতজন, কিছু অলস, সুযোগ-সন্ধানী লোক - সবাইকে নিয়েই চলে পারিবারিক পরিক্রমা। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। কিছু জন্ম, কিছু প্রত্যাশিত, কিছু বা অপ্রত্যাশিত মৃত্যু; অথচ জন্মমৃত্যু যে অদৃশ্য এক সূতোয় গাঁথা, সেই সূতোটিও যেন ঘটনাস্রোতের আবর্তে দৃশ্যমান হয়।
উপন্যাস নাকি আজিজুল সচরাচর লেখেন না, অন্ততঃ বই-এর মলাটে তাই লেখা আছে। ছোট গল্পেই তাঁর অবাধ সঞ্চার। তাহলে কি বলবো, স্বল্পপ্রসূ লেখকের রচনায় উৎকর্ষের এক ন্যূনতম মান স্বতঃসৃষ্ট হয়ে যায়?
উপন্যাসের মূল চরিত্র অল্প কয়েকটি: মেতর বউ বা স্বয়ং নায়িকা। তার স্বামী, যাকে 'কত্তা' বলে উল্লেখ করা হয়েছে স্ত্রীর জবানিতে; 'কত্তা'র মা, বা মেতর-বউ এর শাশুড়ি, বা সংসারের 'গিন্নি'। 'কত্তা'র ভায়েরা এবং এক নিঃসন্তান বিধবা ননদ। প্রতিবেশী কিছু ছোট-বড় চরিত্র। লেখিকার বাবা, বা বাপজি; অল্প হলেও নাটকীয় একটি মুহূর্তে এক অমোঘ উচ্চারণে তাঁর এক অনন্য ভূমিকা রয়ে গেছে। কঠোর মানুষটির মাটিতে লুটিয়ে পড়ার দৃশ্যটিতে পাঠকের একই সঙ্গে হর্ষ-বিষাদের অনুভূতি হয়।
ছোট-বয়সে বিয়ে হয়েছিল মেয়েটার। অনেক কিছু বোঝবার আগেই। কিন্তু বিস্ময়-বোধের আশ্চর্য ক্ষমতা তাকে কখনও ছেড়ে যায়নি। তাই তার জীবন এত বর্ণময়, অনুভূতি-বোধ এত গভীরগামী। নতুন স্বামীকে নিয়ে যেমন তার মুগ্ধতার শেষ নেই, তেমনই সে চমৎকৃত তার শাশুড়ি-মার ব্যক্তিত্বে এবং নেতৃত্ব দেবার স্বাভাবিক ক্ষমতায়। আবার সংসারের জাঁতাকলে পড়ে তার বিরক্তির অভিব্যক্তিও অতি স্বাভাবিক। বহু-প্রসবিনী এই নারীর বাৎসল্যরসে শেষ পর্যন্ত কোনও ফাঁকি পড়েনি, ফাঁকি পড়েনি সাংসারিক কর্তব্যে। প্রথম সন্তানের অকাল মৃত্যুতে তার প্রতিক্রিয়া কি আমাদের সর্বজয়ার কাহিনী মনে পড়ায়? সর্বজয়ার কোনোরকম সহায় ছিল না, না স্বামী, না অর্থ, না চিকিৎসার। মেতর-বউ সেখানে শুধু গ্রামীণ অসুবিধা বা সমকালীন সমাজের ভরসাহীনতার শিকার। তীব্র শোক দু'জনকেই সাময়িকভাবে আপাত-বোধহীন করে চলে গেছে।
তবে একথা স্বীকারে তার আপত্তি নেই যে তার আগমনের পরে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে সংসারের: ধনে-জনে-শস্যে-সম্পদে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়েছে তাদের পরিবারটি। কিন্তু যে পরিবারকে সে দেখেছে সমৃদ্ধির প্রায় শিখরে পৌঁছোতে, সাম্প্রদায়িকতা এবং দেশভাগের করাল গ্রাসে সেই একান্নবর্তী পরিবারেই যখন ভাঙন শুরু হল, দুর্ভিক্ষের আক্রমণে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক দ্রুত শেষ হয়ে স্বার্থের দাঁত-নখ বেরিয়ে পড়লো, মেতর-বউ এর কাছে তা যে কী নিদারুণ বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়াল, তা প্রচ্ছন্ন রয়েছে গ্রন্থটির প্রায় ছত্রে ছত্রে --
(ক) "তাইলে সব্বোনাশ কি এমনি করেই শুরু হয়? চুলের মতন সরু একটো চিড় কোথা যেন ছিল, চোখে দেখতেই পাওয়া যেত না। পেথম দিন দেখে মনে হলো, কই, আগে কুনোদিন দেখি নাইত, পরের দিন দেখছি, ওমা, তার পাশে আর একটো চিড়, তারপর দেখতে দেখতে অ্যানেক অ্যানেক চিড় সব জায়গায় - কখন হলো, কি হলো, কেমন করে হলো ভালো করে কিছু ..... বোঝার আগেই একদিন বড় বড় ফাটল ধরে জিনিশটো চৌচির হয়ে ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সোংসারে ও কি তাই হতে যেচে?" (পৃ. ১৮৫)সমস্ত রচনাটিতে যে বেদনা বিধৃত, সেই সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব তাকে নিয়ত বিচলিত করেছে, বারেবারে বিষণ্ণ করেছে, হয়তো বিক্ষুব্ধ করেনি তেমন প্রকটভাবে। সংসারে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষপাতী নারীটি তার দ্বিধার কথা নিভৃতে তার স্বামীকে বলেছে, বুঝতে চেয়েছে প্রশ্ন করে করে; একটা সীমার পরে বুঝতে না পেরে ফিরে গিয়েছে নিজের পরিচিত গহ্বরে। কিন্তু "অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?" অথবা, এই বইয়ের ভাষায়, "আমি শুনছিনা, জানছিনা বলে কি দাঙ্গা বন্ধ হবে?"(খ) "সোংসারের ভেতরটো এইবার তাকিয়ে দেখতে প্যালম আর সোংসারের মধ্যে মানুষ কি, তা-ও দেখলম। কুকুরবেড়ালের ছেঁড়াছেঁড়ি দেখে রাগ করি, কিন্তুক মানুষ কুকুর-বেড়ালের চাইতে কিসে ভালো? মূলে টান পড়লে সবাই সমান। সেই মূল হচ্ছে প্যাট।" (পৃ. ১৯০)
এই আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটির USP (Unique Selling Proposition) এর ভাষা। বাংলা সাহিত্যের বা সংবাদ মাধ্যমের তৎসম থেকে অর্ধতৎসম ও তদ্ভব, তারপরে তদ্ভব থেকে চলিত ভাষায় অবতরণ (না কি উত্তরণ?) আমরা আমাদের জীবিতকালেই দেখেছি। বহুল-প্রচারিত বাংলা এক দৈনিক যেখানে এখনও সাধুভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে মাত্র সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায়, সেখানে গ্রামের বৌ-ঝিদের কথ্যভাষায় এই রচনা শুধু লেখকের সৎসাহসের পরিচয় দেয় না, মাটির সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগের কথাও বলে নীরবেই।
বাক্যাংশ বা শব্দসম্ভারের দিকে তাকালে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে:
বিশেষ্য: সামিগ্রি, ছেঁয়া (ছায়া), চিন্ন (চিহ্ন), আবস্তা (অবস্থা), অরম্ব (আরম্ভ), এগ্নে (অঙ্গনে), উচ্ছব, সোমায়।
বিশেষণ: কুনো (কোনো), ইসব (এসব), পোষ্কার (পরিষ্কার), নোম্বা (লম্বা), বেস্ত (ব্যস্ত), পেথম পেথম।
ক্রিয়া: যেচে (গিয়েছে), শুদুইলে (জিজ্ঞেস করলে), হচে (হচ্ছে), পেচি (পেয়েছি), পিঁদে (পরিধান করে), পেচে না (পাচ্ছে না)।
অন্যান্য: এগু (আগে), আচ্চয্যি, য্যাকনত্যাকন, কিন্তুক, মদ্যে (মধ্যে), ছামুতে (সামনে)।
এ'সব যদি প্রচলিত বাংলা শব্দের মেঠো রূপ হয়, তাহলে তার বাইরেও থেকে যায় প্রায় অপরিচিত কিছু শব্দসম্ভার, যেমন ঘুরুনি, ঘড্ডে, খরানি, উসারা, ল্যাতাজোবরা, ঢোকপিয়াসি ইত্যাদি। এ'জাতীয় দু'চারটি শব্দ অজানা-অচেনা হলেও বহতা স্রোতের মত ঘটনা পরম্পরা অনুসরণ করতে কোনো অসুবিধা হয় না।
বইটির ছাপা, বাঁধাই, প্রচ্ছদ দৃষ্টিনন্দন। ছাপার কোনও ভুলও চোখে পড়েনি। তবে গ্রন্থটির নাম 'আগুনপাখি' কেন হল, তার ঠিকঠাক ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। একেকবার মনে হয় আত্মশক্তিতে বলীয়ান্ নারীটি স্বামীর সদা অনুগত থেকেও যেভাবে সংসারটিকে ধরে রেখেছিল, শেষ পর্যন্ত নিজের সেই জেদে স্থির হয়ে মাটি আঁকড়ে রয়ে গেল এ'পার বাংলায়, তার সেই জেদ, ভেতরের সেই আগুনকেই কি লেখক গ্রন্থ-শিরোনামে গেঁথে দিয়েছেন? ভস্মস্তূপ থেকে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল ফিনিক্স পাখি, এখানে তো বরং তার বিপরীত চিত্রই দেখি! ভরভরন্ত সংসার ভেঙে ছারখার হবার সাক্ষী হয়ে রয়ে গেল মেতর-বউ। অনেক প্রশ্নের উত্তরই তার পাওয়া হল না।
যে অর্থে বাড়ির কাজের মেয়ে বেবি হালদারের "A Life Less Ordinary" (Penguin, 2006) (মূল হিন্দি গ্রন্থ "আলো আঁধারি")-কে Sub-altern autobiography বা নিম্নবর্গীয় আত্মজীবনী বলা যায়, 'আগুনপাখি'কে সে পদবাচ্য করা যায়না। কিন্তু বুদ্ধিহীন নিগড়বদ্ধ পরিশ্রমে, বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগহীনতায়, নিরক্ষরতায়, বা পুরুষপ্রধান সমাজের আধিপত্যে বোধহয় দুই জনই এক নৌকোতেই সঙ্গী হন।
কবিতায় কখনো-সখনো, গানে প্রধাণতঃ যেমন একটা চরণ বা একটি 'মুখড়া' ফিরে ফিরে আসে এবং গানের সম্পূর্ণতায় সহায় হয়, 'আগুনপাখি'র মধ্যে তেমনি পাঠক খুঁজে পান ব্যক্তিনিরপেক্ষ কিছু মৌলিক সত্য, যা অবশ্যম্ভাবীরূপে বইটির বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করে। পাঠক মাত্রই এই সত্যাবলীর সঙ্গে নিজেকে যোগযুক্ত করতে পারেন। দেখা যাক্ তার কয়েকটি উদাহরণ:
[১] চিরকাল কি সবাই কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকবে? দুনিয়াটাকে দেখে শুনে নিতে হবে না? (পৃ. ১০৭)
[২] মানুষের সোংসারে ঝড়-বিষ্টি আপদ-বিপদ আসবেই। চিরকাল কারুর সুখে যায় না, দুখেও যায় না। (পৃ. ৯৪)
[৩] মানুষের সংসারে নিয়মই এই, উঠতে উঠতে আকাশে উঠবে মাথা, তার পর পড়তে পড়তে একদিন মাটিতেই আশ্রয় .... নিয়তির পথ কেউ বন্ধ করতি পারবে না। (পৃ. ৪৩)
কী অদ্ভুত সমাপতন রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের সেই অবিস্মরণীয় শ্লোকের সঙ্গে!
"সর্বে ক্ষয়ান্তা নিচয়াঃ পতনান্তা সমুচ্ছ্রায়ঃ।
সংযোগ বিপ্রয়োগন্তাঃ মরণান্তং হি জীবিতম্।।"
সকল বৃদ্ধির শেষ ক্ষয়ে, সব উত্থানের শেষ পতনে, সকল মিলন শেষ হয় বিচ্ছেদে, আর জীবনের অমোঘ পরিণাম মৃত্যুতে!
মধ্যমপুত্র যখন তার মাকে শেষবারের মতো বোঝাতে এল কেন তার সবার সঙ্গে এদেশ ছেড়ে পাড়ি দেওয়া উচিত সীমান্তের ওপারে, তখন তার জিজ্ঞাসা প্রায় আর্তির স্তরে পৌঁছে যায় - "একই দ্যাশ, একইরকম মানুষ, একইরকম কথা, শুধু ধম্মো আলেদা সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদিন হয়? এক লাগোয়া মাটি, ইদিকে একটি আমগাছ একটি তালগাছ, উদিকেও তেমন একটি আমগাছ, একটি তালগাছ! তারা দুটো আলেদা দ্যাশের হয়ে গেল?" (পৃ. ২৪৯)
এই প্রশ্নের উত্তর মেজ খোকার জানা ছিল না। তার মা'র তো নয়ই। তার বাবারও নয়। যে'সব 'বুড়ো খোকারা' 'ভারত ভেঙে ভাগ' করেছিলো, তারা জানতে চায়ওনি। আমরা স্বাধীন ভারতে জন্মে রক্তের দাগ দেখিনি বটে, কিন্তু শুকিয়ে যাওয়া চোখের জলের দাগ দেখেছি বই কি?
'আগুনপাখি' আবারও আমাদের পৌঁছে দিল সেই ছিন্নমূল ইতিহাসের পদপ্রান্তে যেখানে;
"যাহাদের কথা ভুলেছে সবাই
তুমি তাহাদের কিছু ভোল নাই,
বিস্মৃত যত নীরব কাহিনী স্তম্ভিত হয়ে বও।"
(পরবাস-৪৯, অক্টোবর, ২০১১)