ISSN 1563-8685




গোবর্ধন

|| ১ ||

খনও নিয়ম করে ভোঁ বাজতো। ঠিক সকাল ন'টায়। যেন নাগরিক নহবত। একেকটা থানায় ছিল এই ব্যবস্থা। শব্দের উৎস কতোদূরে ঠিক বোঝা যেতো না। কোনোদিন মনে হতো, বাড়ির পেছনে যে পানাপুকুর, তার কচুরিপানার ভিতরে ঘাপ্‌টি মেরে বসে ছিল আওয়াজটা, তার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে একটা মাছ বা ব্যাঙ জলতল ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। কোনোদিন যেন কয়লাওয়ালার টিনের ঘরের পেছন থেকে আওয়াজটা হাঁ-মুখ দেখাল, তার ঘরের পাশের ক্ষুদ্র কচুবন আতঙ্কে শুয়ে পড়ল। একদিন দেবতীর্থ চলেছে দোকানে পাঁউরুটি কিনতে, ক'টা বাজে খেয়াল নেই, কোথা থেকে দম্‌কা হাওয়ার মতো ভোঁয়ের নিনাদ তাকে ধাওয়া করে এল। প্রাত্যহিক কালের পথরেখার মধ্যে এই ভোঁ যেন একটা মাইলস্টোন। আকারে এতোই বড়ো যে তাকে দিনের প্রহরী মনে হতো।

ভোঁ শুনলেই তীর্থ দু'হাত ছড়িয়ে দিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘুরতো বন্‌বন্‌ করে। সে তখন অনেক ছোটো; এটা ছিল তার প্রিয় খেলা। এক ডাক্তার আত্মীয় বললেন, এতো ঘুরেও ওর মাথা ঘোরে না, ওর নিশ্চয় চোখ-খারাপ আছে। সেই থেকে চোখে চশমা উঠল। একে বাবার এক-ছেলে, তায় চোখে চশমা। পাড়ার ঘরে ঘরে চার ছেলে ছয় মেয়ে, এক সন্তানের চল নেই; আর একরত্তি বালকের চশমা পরার ধৃষ্টতা, ও এই শ্যামল-কমলের জগতে দেবতীর্থ নাম - না, কেউ কখনও শোনে নি। পাড়ার লোকে যে-কোনো বিস্ময়েই বেসামাল, সামান্য কিছুতেই সকলে 'ইরি মাক্কালী' বলে ওঠে, কথার মধ্যে তথ্যজ্ঞানের চাইতে বিস্ময়ের মাত্রা বেশি। এখানে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালেও হৈ হৈ পড়ে যায়, ছেলেবুড়ো 'টেক্সি' 'টেক্সি' করে দৌড়ে আসে, কারণ যে-কোনো গাড়িই ট্যাক্সি; অনেকের মুখে দাঁতন, কারণ দাঁত-মাজাটা যে-কোনো প্রহরের কর্ম, নিভৃতে সারবার মতো প্রাতঃকৃত্য নয়; অনেকে গাড়ির বাম্পারের ওপরও বসে পড়ে। তারপর সেই নিয়ে বচসা বাধিয়ে 'বড়োলোক' আরোহীকে অপমান একটা নিত্যনৈমিত্তিক মোচ্ছবের মধ্যে পড়ে। কাজেই তীর্থ নিজের অজান্তেই জোড়া-বিস্ময় উৎপন্ন করে জোড়া-দোষে দোষী হয়ে পড়েছিল।


|| ২ ||

সেদিনও নিয়ম মতো ভোঁ বাজল, এবং বেলা গড়াতে গড়াতে সূর্য ঢলে পড়ল নবনির্মিত দূরদর্শন টাওয়ারের পেছন দিকে। বল্লভগড়ের বাড়ির উঠোনে ক্রিকেট খেলছিল তীর্থ ও জ্যেঠতুতো দাদা পঙ্কা। অবশ্যই আণ্ডার-আর্ম রীতিতে। তখনও এই উপনিবেশের বাড়িতে বাড়িতে ছোটো উঠোন, সামনের দিকে শৌচালয়, ও কোনো এক কোনায় শনিমণ্ডপ ও তুলসীগাছ। পঙ্কা হঠাৎ চীৎকার করে ওঠে, 'ওই দ্যাখ্‌ - সেজোকাকু।' দু'জনেই দৌড়ে যায় সেদিকে।

বাড়ির সামনে একটা ট্যাক্সি এসে থেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে জমেছে ছোটোখাটো জটলা। দুই ভদ্রলোক ধরাধরি করে বাবাকে নামিয়ে আনছেন গাড়ি থেকে। তাঁরা বলছেন, 'আমরা কলেজ থেকে আসছি। দেবোত্তমবাবুর জ্বর এসে গেছে।'

মা বলছেন, 'হঠাৎ কি হল? ওনার চশমাটা কোথায়?'

ওঁরা নিচু গলায় কিছু বললেন। 'মরিচঝাঁপি নিয়ে গণ্ডগোল' কথাটা শোনা গেল। পাড়ার লোকে 'পোপেসার ঝামালায় পড়্‌সে' বলতে বলতে চলে গেল।


|| ৩ ||

রামায়ণখ্যাত দণ্ডকারণ্য যে আজও বর্তমান, সেকথা জানতো না তীর্থ। আরও জানতো না একথা যে সেখানে বসতি করেন কোনো নির্বাসিত যুবরাজ ও যুবরানি নয়, সেখানে বস্তি গাড়েন পূর্ববঙ্গীয় শরণার্থীকুল। আর, সেই প্রায়-যাযাবর শত শত মানুষ একদিন সরে আসতে চান বাংলার মাটিতে, তরী ও ভেলায় ভেসে ওঠেন সুন্দরবনের কোনো দ্বীপে, বহু শ্রমে ও সহযোগিতায় গড়ে তোলেন একটি সম্পূর্ণ সমাজ। তারপর হানা দেয় পুলিস, লণ্ডভণ্ড করে এই জায়মান সমাজ, হত্যা করে পুরুষ, নির্যাতন করে নারীকে।

এর কোনো কিছুই জানতো না দেবতীর্থ।

সেদিনের ওই অপরাহ্ণটি মিলিয়ে গেল দু'টি ঝঞ্ঝার মাঝখানে দীর্ঘশ্বাসের মতো। এর কিছুকাল আগে বাবা ফিরেছেন তাঁর জন্মভূমি দর্শন করে। সেই গল্পেই এতোদিন মশগুল ছিলেন পিতাপুত্র। দুই বাংলার রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধিদের একজন ছিলেন দেবোত্তম। কোনো সরকারি উদ্যোগ নয়, এই আয়োজন করেছিলেন রবীন্দ্রপ্রেমিক বাঙালীরা। দেবোত্তম ছিলেন উদ্‌বেলিত। নাবালক পুত্রের কাছে তিনি বলতে থাকেন পূর্ববাংলার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগের কথা, যে-যোগ নাকি নিবিড় আনন্দবন্ধনের। সে-আনন্দ সর্বংসহা, ও কৃপণ প্রত্যহের চেয়ে বড়ো। এবং রবীন্দ্রনাথ যখন বৃহৎ বঙ্গে এলেন জমিদারির কাজ নিয়ে তখনই না তাঁর কাব্য এল - 'সকল আকাশ আকুল করে'। গল্পও এল। এবার সফর-কালে দেবোত্তম পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁর স্বগ্রামে। সেখানে রাতের অন্ধকারে আলের পথে তাঁর মুখে টর্চের আলো ফেলে এক গ্রামবাসী, ও বলে ওঠে: 'আফ্‌নে দ্যাবোত্তম না দ্বিজুত্তম?' তাঁর জ্যেষ্ঠ দ্বিজোত্তমের কথাও মনে রেখেছে এই মুসলমান কৃষক। তারপরে প্রায়-হুংকারের মতো সে বলে, 'আফ্‌নেরা যাইন্‌ (যেন) গেসুইন্‌ (গেছেন) গিয়া, হে তো ফুদাফুদি (শুধুশুধু) গেসুইন্‌ গিয়া।' আবার অন্য একটি শহরে 'ইণ্ডিয়া' থেকে তাঁদের আগমনের হেতু জানতে চায় এক ব্যক্তি, ও সব শুনে বলে: 'আইচ্ছা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? তো - তাইন্‌ (তিনি) তো শুদু আল্লাতাল্লার কথা কন্‌ নাই, তাইন্‌ তো মাইন্‌ষের মায়া-মহব্বতের কথা কইসিন্‌ (বলেছেন)।' এরপরে সেই ব্যক্তির সঙ্গে স্বেদসিক্ত বাহুপাশে আবদ্ধ হন দেবোত্তম। ফেরার পথে তাঁদের দল গান গাইছিল, তিনিও মিলিয়েছিলেন বেসুরো গলা ("ওদের 'সহস্রটি মন'-এর গানে আমি ছিলাম বৃদ্ধ রাজনারায়ণ", সোল্লাসে বলেন তিনি)। সীমান্ত পেরোনো মাত্র বন্ধ হল গান। - 'We hanged our harps upon the willows in the midst thereof - এই দেশ কি চায় না আমাদের গান? - How shall we sing the Lord's song in a strange land?' - গভীর জলে টল্‌মল্‌ করে ওঠে তাঁর চশমার কাচ। তাঁর কথার মধ্যে পুনরাবৃত্ত হতে থাকে তীর্থর অপরিচিত একটি শব্দবন্ধ - জননান্তরসৌহৃদানি।


|| ৪ ||

ই অস্বাভাবিক ভাবালুতার মধ্যে কোলকাতা ফিরে দেবোত্তম পেলেন বাইরে ওই বিক্ষত মরিচঝাঁপি, আর ভিতরে তাঁর পুনরাবর্তনশীল মানসিক অবসাদ। তাঁর অনেককালের পুরোনো রোগ, যা তাঁকে গ্রাস করে নিরালোক একটি অস্তিত্বের গহ্বরে। তাঁর বাক্যের স্পৃহা লুপ্ত হয়, ভালো লাগে না কোনো বই, বন্ধ হয় বিস্তার ও প্রসারণ, তিনি হয়ে ওঠেন নিশ্চুপ ও নিষ্ক্রিয়। শুধু কর্মের পৃথিবী অভিশাপের মতো জড়িয়ে থাকে তাঁর পায়ে পায়ে। নিজেকে ঠেলে ঠেলে তাঁকে করতে হয় বাজার, টুকিটাকি গেরস্থালি কাজ, কলেজের অধ্যাপনা। কাজের শেষে ও কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন অকাতরে; জাগরণের থেকে বেশি চলে নিদ্রা, ও সেইসঙ্গে প্রবল নাসিকাগর্জন। এই নিনাদে বিরক্ত হন সবাই; এবং তাঁর নিদ্রাতুর মূর্তিও দর্শনীয় নয়, কারণ শিথিল অধরের প্রান্ত বেয়ে গড়িয়ে আসে লালা। তাঁর সহধর্মিণী বিরক্ত হয়ে ঝাঁকিয়ে তোলেন তাঁকে, যেভাবে বদ্ধ মাতালকে 'ওঠ্‌ শালা' বলে নর্দমা থেকে হিঁচড়ে তোলা হয়। পত্নী বলেন, 'এই যে! মুখ থেকে লোল পড়ছে, ওঠো তো!' - আর তিনি চমকে উঠে ভগ্নকণ্ঠে বলেন, 'হাঁ'! এরই মধ্যে তাঁকে ছুটতে হয় আরোগ্যলাভের তাড়নায় - তিনি ঘোরেন মনোরোগ চিকিৎসকদের দোরে দোরে। এঁরা কেউ বলেন, মাথাটা হাল্‌কা রাখুন, হিন্দী সিনেমা দেখুন; কেউ বলেন, ফুটবলের মাঠে গিয়ে নাচানাচি করুন; কেউ বলেন, টানা দু'বছর ইলেকট্রিক শক্‌ নিন। সেই মতো পি.জি.-র আউটডোরে বৈদ্যুতিক শক্‌-প্রার্থী হয়ে তিনি নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন; ফিরে আসেন ঈষৎ-অব্যবস্থিত আশাহীন একজন মানুষ। একদিন হাসপাতালের বেঞ্চে বসে বসে তিনি লুটিয়ে পড়েন ঘুমে, তাঁকে সেই অবস্থায় দেখতে পায় এক তরুণ ডাক্তার, যে প্রি-মেডিক্যাল পর্বে তাঁর ছাত্র ছিল; সেদিনের মতো সে ব্যবস্থা করে তাঁর চিকিৎসার, ও সব শেষ হলে একটি ট্যাক্সি থামিয়ে তাঁকে বাড়ির পথে রওনা করিয়ে দেয়। ঘরে পৌঁছে তিনি শিশুর মতো বলতে থাকেন, 'আচ্ছা, ওরা আমাকে আজ শক্‌ দিল না কেন?' পত্নী এসে বলেন, 'চুপ করো তো।' শ্যালিকা বলেন, 'জাঁইয়ু, চুপ করেন।' পত্নী বলেন, 'চুপ করলেই তো আবার ঘুমাবে।' বাক্যের এই আবর্ত তাঁকে ধরতে পারে না। তিনি আপন কথার ঘোরে বলতে থাকেন, 'যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এল ছেলেটা, আমার জন্য সব করল। তারপর জনারণ্যে হারিয়ে গেল।'

তাঁর কলেজ-যাত্রার ধকলটাও প্রাণান্তকর। বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার হাঁটাপথে তিনি পৌঁছন স্টেশনে; বিলাসবিমুখ জীবনাদর্শের প্রভাবে রিকশায় চড়াকে প্রায় নৈতিক অধঃপতন বলে মনে করেন। সেখান থেকে মান্থলি টিকিটে লোকাল ট্রেনে শেয়ালদা; ভিড়ের চাপে তাঁকে খাবি খেতে হয় চশমাটা নিয়ে। তারপর সাউথ স্টেশন থেকে হন্‌হন্‌ করে মেন্‌-এ, সেইসময় তাঁর বসে পড়তে ইচ্ছে করে। আবার নৈহাটি লোকাল ধরে শ্যামনগর। সময়টা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসে। দৌড়ে দৌড়ে তাঁকে পৌঁছতে হয় জগদ্দল ঘাটে, ফেরি-লঞ্চে নদী পেরোলে তাঁর কলেজ। বাড়ি ফেরার পরে তাঁকে দেখা যায় জীর্ণ অবসন্ন। পাঞ্জাবিটা যখন মাথার ওপর দিয়ে গলিয়ে বহুকষ্টে খুলছেন তখনই তাঁর পুত্র কোনো সারস্বত ব্যাপারে প্রশ্ন করে বসে। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, 'দাঁড়াও, মুখহাতটা ধুই। এই জার্নি করলে দু'দিনে লম্বা হয়ে যাবে।' অবশেষে, নিজের অজান্তে তিনি এলিয়ে পড়েন ঘুমে।

অবসাদ ফুঁড়ে মাঝে মাঝে ঠেলে ওঠে উন্মাদ উত্তেজনা। সেদিন মরিচঝাঁপিতে সরকারি দমন প্রসঙ্গে কিছুটা অবান্তরভাবেই তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তাঁর কণ্ঠ। স্থানটা ছিল কলেজের ক্লাসরুম; উপলক্ষ্যটা রবীন্দ্রনাথের 'প্রশ্ন' কবিতা। এই উপলক্ষ্য ধরে তাঁর কণ্ঠে নেমে আসে রবীন্দ্রচিত্তের গভীর মন্যু। প্রথমে তিনি তীব্র ব্যঙ্গে বলতে থাকেন: 'আমি ছেড়েই দিতে রাজি আছি সুসভ্যতার আলোক / আমি চাই নে হতে নববঙ্গে নবযুগের চালক'; তারপর তীব্রতর ব্যঙ্গে তিনি বলেন, 'ছিঃ! ধিক্‌!' ছাত্রেরা স্তব্ধ হয়ে দেখে এই অপ্রকৃতিস্থ অধ্যাপককে যখন চড়ায় পৌঁছয় তাঁর স্বর, কম্পিত কণ্ঠে উৎসারিত হয়: 'সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ / হে ভৈরব শক্তি দাও ভক্তপানে চাহ'। ক্রমশ তিনি জড়িয়ে পড়েন তাঁর আবেগের মধ্যে, স্মৃতির জোয়ারে হয়ে ওঠেন দিশাহারা, এবং আবিষ্ট হয়ে বলতে থাকেন: 'আমি যদি গায়ক হতাম এ-গান আমি তোমাদের গেয়ে শোনাতাম। এই গান আমি শুনেছিলাম দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে, শ্রদ্ধানন্দ পার্কের খোলা মঞ্চে, ১৯৫২ সালে।' অচিরেই স্মৃতি ও ভাবনার চোরাপথে, ঝড়ের শিখরে চড়ে, চলে আসে মরিচঝাঁপির বিপজ্জনক প্রসঙ্গ। ক্লাসরুমের মহাভার স্তব্ধতার মধ্যে বাজে পীরিয়ড-শেষের ঘন্টা; শুরু হয়ে যায় ফিস্‌ফাস্‌। সে ধ্বনি বড়ো হয়ে ওঠে গুঞ্জনে, ছাত্রেরা নির্গত হয় অলিন্দে, কোলাহল ছাপিয়ে শোনা যায় কারও গলা: 'কোথায় রে মালটা? স্টাফরুমে?' তারপরে স্টাফরুমের সেই দৃশ্য। ছাত্র ইউনিয়নের প্রধান নেতা ডেকে বলছে: 'আমরা একটু এস্‌ছিলাম, স্যর। রাজনীতিটা একটু বেশি বুঝে গেছেন মনে হচ্ছে। না-না, শুনুন। গঙ্গাযাত্রা জানেন? আমাদের পাশেই গঙ্গানদী আছে, একেবারে গঙ্গাযাত্রা করিয়ে দেব। আপনার বেশি কষ্ট করতে হবে না।' হতবাক্‌ অধ্যাপক-কুল অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকেন। ওরা 'মার্‌ গুড়জল, ভালো দিলে মালটাকে, কৌশিকদা' বলতে বলতে বেরিয়ে যায়। দেবোত্তম বলেন, 'মার্‌ গুড়জল ব্যাপারটা কি?' প্রিয়তোষবাবু বলেন, 'ওটা এই শহরের ভাষা। এখানকার ছেলেরা কথায়-কথায় বলে।'

সেদিন কলেজে বসে থাকতে থাকতেই তাঁর জ্বর এসে গেল। কোলকাতাগামী সহকর্মীরা তাঁকে ধরাধরি করে রেলপথে নিয়ে এলেন হাওড়া, সেখান থেকে প্রিয়তোষবাবু ট্যাক্সি করে পৌঁছে দিলেন বাড়ি।


|| ৫ ||

দেবোত্তম একজন বিফল অধ্যাপক। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব উপাধি, গবেষণাপত্র বা পাঠ্যপুস্তক, তাঁর নেই। অধ্যক্ষ তাঁর সঙ্গে কথা বলেন ব্যঙ্গভরে, প্রতিটি ইলেকশন ডিউটিতে তাঁকে যেতে হয় উপদ্রুত জায়গায়। কেবল কোনো কোনো ছাত্রের চিত্তে তাঁর মৌন অভ্যর্থনা, যা তাঁর অগোচর রয়ে যায়। বাড়িতে তাঁর কোনো নির্জন কোণ নেই। একটা বারান্দায় মাদুর পেতে তিনি বই পড়েন, মাঝে মাঝে ঝিমুনি এসে যায়। মশার মেঘে তখন তাঁর শরীর ঢাকা পড়ে।

বল্লভগড়ের সমাজের সঙ্গেও দেবোত্তমের কোনো গভীর বোঝাপড়া গড়ে ওঠে না। শুধু পুত্রের সঙ্গে তাঁর যে-দেওয়ানেওয়া, তার বিবর্তন চলেছে জীবন জুড়ে। তীর্থও বুঝতে পারে, পৃথিবীর ক্ষুদ্রতায় লাঞ্ছিত অসম্পূর্ণ তার বাবার জীবন। তবু জিজ্ঞাসার তেপান্তর মাঠের যাযাবর তিনি, তীর্থও তাঁর পিছু নিয়েছে। বাবার সঙ্গে তার গল্পের শেষ নেই। তিনি শোনান ইতিহাস, জীবনচরিত, শব্দতত্ত্বের টুকরো কথা। এসবই ভালোবাসে তীর্থ; এ-ই তার কাছে সত্য আলাপ। বাবার কাছে শোনা কথায় তার মনের রঙমহল গড়ে ওঠে।

দেবোত্তম সেরে উঠলেন, ও ডাক দিলেন - 'এসো'। সেদিনও অপরাহ্ণ। পিতাপুত্রসংবাদে বারংবার অপরাহ্ণ অবশ্য নাটকীয়তার জন্যে নয়, একান্ত আপতিক। কারণ এই সময়েই তীর্থ স্কুল থেকে ফেরে। সূর্য অস্ত গেল। দেবোত্তম বললেন, 'ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে দিনের চিতা' - তারপর কি ভেবে বললেন - 'বাণ বলেছেন - তেজঃপতিপতনাচ্চিতানলমিব সন্ধ্যারাগম্‌।' সন্ধ্যা হল - লোডশেডিংও হল নির্দিষ্ট প্রহরে। দেবোত্তম ক্ষুদ্র পরিবেশ ভুলে বলতে যাচ্ছিলেন -

'এই ক্লান্ত ধরার শ্যামলাঞ্চল-আসনে
তোমায়    করি গো নমস্কার।
এই স্তব্ধ তারার মৌনমন্ত্রভাষণে
তোমায়    করি গো নমস্কার।'

এরকম তিনি প্রায়ই বলেন। তীর্থ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, 'না না, একটু আগে তুমি কি পড়ছিলে?' তিনি বললেন, 'শুনবে? শোনো -
অগ্নির্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো
রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব। ...
বায়ুর্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো
রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব।
একস্তথা সর্বভূতান্তরাত্মা
রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ।

তীর্থ আবার থামিয়ে দিয়ে বলে, 'এগুলো কি, বাবা?' - 'এটা উপনিষদ্‌।' তীর্থর কানে রণিত হচ্ছে 'রূপং রূপং'-এর অনুপ্রাস। সে বিমূঢ় হয়ে বলে, 'এতো সুন্দর!' তার মনে পড়ে যায়, সে বলে, 'আর এর আগে কি বলছিলে?' বাবা 'স্তব্ধ তারার মৌনমন্ত্রভাষণে' প্রভৃতি শুনিয়ে বলেন, 'ওই দ্যাখো সন্ধ্যাতারা। চুপ করে আছে। যেন সন্ধ্যার বন্দনায় কোনো মন্ত্র বলছে।' বলতে বলতে তিনি সিগারেট জ্বালিয়ে নেন। ভাষার সম্মোহনটা পেয়ে বসেছে তীর্থকে; সে আব্‌দার করে, 'বাবা, ভালো ভালো বাংলা বলবে?' তিনি বলেন, 'তবে শোনো - পতনে অভ্যুদয়ে বন্ধুর পন্থা, রবিকরোজ্জ্বল ঊষা, রজতনিষ্যন্দিনী জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি, মেঘের সিংহবাহনে সমাগতা বর্ষা, নববারিসিঞ্চিতযূথীসুগন্ধি পৃথিবী, বসুধাগন্ধসম্পর্করম্য বায়ু।' - 'এসব কি তোমার বানানো, বাবা?' - 'না না, অধিকাংশই রবীন্দ্রনাথের।' তীর্থর মনে হয়, জলস্রোতের মতো এই শব্দাবলী কল্লোল তুলে হারিয়ে যাবে। সে একটা খাতা নিয়ে বসে। - 'না না, এই লণ্ঠনের আলোয় তুমি লিখতে বোসো না, তীর্থ।' কিন্তু পুত্রের জেদ অবিচল। তখন তিনি প্রথমে বলেন, 'বিঘ্নকে তুমি করেছ সোপান', সেটাও লিখে নেয় তীর্থ। তারপর আসে একটি নতুন বাক্যবন্ধ: 'সুখে বিগতস্পৃহ দুঃখে অনুদ্বিগ্নমনা।' আর তাতে যেন নতুন জীবনভাবনার মর্মর লাগে তীর্থর চেতনায়।

কোনো অবকাশে তীর্থ জিজ্ঞেস করে: 'সেদিন কলেজে কি হয়েছিল, বাবা? মরিচঝাঁপি কি?'

দেবোত্তম হেসে বলেন, 'সে থাক্‌।'

সেদিনের অবোধ্য অপরাধের শাস্তি অপেক্ষা করে আছে অন্যতর রূপে, সেকথা না জেনেই তিনি হাসেন।


|| ৬ ||

দেবোত্তম প্রায়ই আবৃত্তি করেন, তেজো অসি তেজো ময়ি ধেহি, ওজো অসি ওজো ময়ি ধেহি, বীর্যম্‌ অসি বীর্য ময়ি ধেহি, মন্যুঃ অসি মন্যু ময়ি ধেহি। মন্যু, অর্থাৎ অন্যায়ের প্রতি যে-ক্রোধ, সেই ক্রোধ আমাকে দিয়ো। কেবল তিনি জানেন না, একাকী মানুষের পক্ষে কী বিষম বালাই এই ক্রোধ, কতো অরক্ষিত এই অনলে প্রদীপ্ত মানুষ, কতো নিঃসঙ্গ, কতো নিষ্ফল। শুধু তাঁর উদ্দীপনা তাঁর পুত্রের শোণিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সে ভাবে, এই তার ঐশ্বর্য, তার শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার।



দেবোত্তম ফিরে গেলেন তাঁর কর্মস্থলে। ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন হল। নতুন সরকার গঠন হবার পর এই প্রথমবার। উত্তেজনায় টানটান হয়ে রইল কলেজ। এবং, যেন দুর্দৈবের বশে, প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষ পেল একেবারে সমান সমান ভোট। টানটান ছিলাটা যেন সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কলেজ কাঁপিয়ে বোমা পড়ল, একটা দুটো তিনটে। একদল ছাদে একদল মাঠে। লক্ষ্যভ্রষ্ট ইট ঢুকে পড়ল স্টাফরুমে, গান্ধীজীর বাঁধানো ছবিটা খান্‌খান্‌ হয়ে লুটিয়ে পড়ল। নিক্ষিপ্ত বোতল চারিদিকে ভাঙতে লাগল ঝন্‌ঝন্‌ করে। 'শুয়োরের বাচ্চা' বলে রাক্ষসীর মতো চেঁচিয়ে উঠল একটি মেয়ে। সে বিবাহিতা, ও একটি দলের নেত্রী। সাইকেলের চেন শূন্যে ঘোরাতে ঘোরাতে দুদ্দাড় করে ছাদের দিকে উঠে গেল কারা। এর পর কি হবে? হঠাৎ জানালার বাইরে ওপরের কার্নিস থেকে ঝুলতে লাগল দু'টি পা। পরমুহূর্তে জলের পাইপ আঁকড়ে জানালার কাছে নেমে এল একটি ছেলে; কঁকিয়ে বলল, 'স্যর, আমাকে বাঁচান। স্যর, আমি সিপি-র দেবাশিস।' হা কাল! হা ধর্ম! আক্রান্ত ছাত্রও নিজের পরিচয়ে বলে আমি সিপি-র অমুক! মুহূর্ত মাত্র কুঞ্চিত হল দেবোত্তমের মুখ, কিন্তু নিমেষে সব ভুলে আর্তকে বাঁচাবার তাগিদে তিনি আত্মহারা হয়ে গেলেন। সেই সময় স্টাফরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিল কেউ। তৎক্ষণাৎ বিস্ফোরিত হলেন দেবোত্তম। পাগলের মতো ছুটে গেলেন দরজার দিকে, ফেনায়িত মুখ। কামানের মতো গর্জে উঠলেন, 'দরজা খুলুন! ছাদে খুনোখুনি হচ্ছে। আমাকে ওপরে যেতে দিন!' পথ আগলে দাঁড়ালেন অর্থনীতির ধীরেশবাবু, সঙ্গে আরও অনেকে। 'যাবেন না, দেববাবু। ওরা আপনাকে ছাদ থেকে ফেলে দেবে।' দেবোত্তম চীৎকার করে উঠলেন, 'দিক্‌ ফেলে। আপনাদের বিবেকের কাছে আবেদন, আমাকে যেতে দিন।' ঠিক তক্ষুণি কারা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল দরজার ওপরে, মড়্‌মড়িয়ে প্রবেশ করল তারা। ওদের পুরোভাগে সেই কৌশিক, তার পাশে শেফাতুল্লা গাজি। সুবক্তা গাজি চেঁচিয়ে উঠল, 'বিবেক! বুর্জোয়া বিবেক! কাউকে কোথাও যেতে হবে না। কমরেড, এরা শ্রেণীশত্রুদের দালাল। আমরা কাউকে বেরোতে দেব না।' সেই বিবাহিতা নেত্রীটি, যার অমৃতভাষণে তখন রণিত হয়েছিল কলেজ, সবার দিকে ফিরে বলল, 'কমরেড! এ-লড়াই নীতির লড়াই।' সঙ্গে সঙ্গে 'লড়াই লড়াই লড়াই চাই' ধ্বনিতে ফেটে পড়ল দশদিক, বিপ্লবী পদাঘাতে চেয়ারগুলো উল্‌টে ফেলতে ফেলতে সকলে বসে পড়তে লাগল মেঝেতে; কেউ কেউ সকৌতুকে অধ্যাপকদের ঘাড় ধরে জামার কলার ধরে নামিয়ে আনতে লাগল ভূমিতলে। শুরু হল অবস্থান ও পুনর্নির্বাচনের দাবী। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আজই করতে হবে নির্বাচন; নইলে চলবে সারা-রাতব্যাপী নিষ্প্রদীপ অবস্থান, কলেজে আলো জ্বলবে না।

অভ্যস্ত কোরাসে বিপ্লবী ধ্বনির ওঠানামা চলল। মাঝে মাঝে কোলাহল ও বিরতি। তখন শুধু কৌতুক। ঘর্মাক্ত অধ্যাপক খবরের কাগজ দিয়ে নিজেকে বাতাস করতে গেলে কোনো হাত এসে ছিনিয়ে নেয় সেই কাগজটা। তারপর হাতে হাত ঘুরে সেই কাগজ স্থাপিত হয় অধ্যক্ষের মাথায়। তিনি সেই আশ্চর্য মুকুট পরে বসে থাকেন। আবার চালু হয় ধ্বনি। কখন ঘড়িতে বাজে বারোটার ঘন্টা কেউ টের পায় না। উত্তেজনায় ঝিমিয়ে পড়েছিলেন দেবোত্তম। চমক ভাঙল নতুন গোলমালে। সেই বিবাহিতা নেত্রীটি, যার নাম নমিতা, আর তেজস্বিনী বলে যার খ্যাতি, ছাপিয়ে উঠেছে সবার ওপরে। সে এইমাত্র আবার বরাহনন্দন বলেছে, এবার স্বয়ং অধ্যক্ষকে। তার ভগ্নকণ্ঠে কৃত্রিম মাধুর্য। অধ্যক্ষ বোঝাতে চাইছেন, 'রি-ইলেকশন হবে, মা। সে আমার দায়িত্ব। - কিন্তু আজ -।' তাঁর কথার মাঝখানেই মুখ দিয়ে বাতকর্মের মতো শব্দ করে নমিতা, 'শোনো শোনো কমরেড। মা বলছে বে। নিয়ে আয় তো ওর বউকে। ম্যাডামকে ল্যাংটা করে নাচাই কমনরুমে।' নারী হয়ে আরেক নারী সম্বন্ধে এ- ইচ্ছা প্রকাশ করা যায় কিনা ঠিক জানেন না দেবোত্তম; আর ভাবতে পারছেন না তিনি। পকেটের কলমটা বাগিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন থর্‌থর্‌ করে, যেন সেনরাজসভায় খনিত্রহস্ত গোবর্ধন পণ্ডিতের মূর্তি, - সেইরকমই প্রদীপ্ত ইব মন্যুনা - ভিড় উজিয়ে তিনি যেতে চাইলেন নমিতার দিকে, কণ্ঠে হুংকার, 'অ্যাই নমিতা! দাঁত ফেলে দেব তোমার!' কয়েকটি হাতের টানে এক পলকে ছিঁড়ে গেল তাঁর পাঞ্জাবির পকেট, উতলা হল ধুতির বাঁধন, ধাক্কা মারল অন্য কয়েকটি হাত; তিনি লণ্ডভণ্ড হয়ে বসে পড়লেন। তারপরে কি হতো বলা যায় না, কিন্তু কোথা থেকে উঠে এল সুবক্তা গাজি, নাটকীয় রোমাঞ্চে সবাইকে আবিষ্ট করে বলল, 'এর মীমাংসা আজ নয় কমরেড। শ্রেণীশত্রুদের আমরা ছাড়ব না। আমরা ধৈর্য হারাব না বন্ধু! এখন শুধু আজকের লড়াইয়ের মর্যাদা রক্ষা করব।'

কয়েক দিন ঝিমিয়ে রইল কলেজ। একটা দুটো ক্লাস শুরু হল; যেন ভাঙা দেউলের নির্জন প্রদীপ। এবং অবশ্যই এই পুরোগামী অধ্যাপকদের মধ্যে রইলেন দেবোত্তম। কিন্তু কে করে তাঁর ক্লাস? তাঁর বিষয় যে বাংলা। তবু গুটিকয়েক ছাত্রছাত্রী নিয়েই তিনি পরমোৎসাহে পড়াতে লাগলেন কখনও রবীন্দ্রনাথ কখনও জীবনানন্দ। পাঠ্যবস্তু অতিক্রম করে তিনি স্পর্শ করতে লাগলেন দেশ ও কালের, ন্যায় ও ধর্মের অনেক সূক্ষ্ম ক্ষুরধার প্রসঙ্গ। তাঁর ছাত্রশ্রোতাদের শূন্যদৃষ্টি, ক্ষুদ্র ধী ও ক্ষুদ্রতর চিত্ত তাঁর নজরে পড়ল না। আত্মগত হয়ে চলল তাঁর কথা। বিশেষ করে এল মানব ও দানবের দ্বৈরথ, দমন ও বশ্যতা, ক্ষমতা ও স্বাধিকারপ্রমত্ততার আলোচনা। হিতৈষী অধ্যাপকেরা সংবাদ পেয়ে বললেন, 'একটু বুঝে সুঝে ক্লাস নিন, দেববাবু। কলেজের অবস্থা এখনও ভালো নয়।' তবে এঁরা প্রবীণ; এঁরা মোটের ওপর রইলেন উদাসীন। কেবল নির্লিপ্ত থাকতে পারলেন না রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নীলোৎপল সেন। দেবোত্তমের থেকে বয়সে প্রায় এক প্রজন্মের ব্যবধান, ষাটের দশকের ছাত্র-রাজনীতির হাওয়ায় লালিত নীলোৎপল। তাঁকে দেখা গেল ইউনিয়নের অফিসে; ছাত্রনেতাদের তিনি বুঝিয়ে এলেন, 'কেউ কেউ প্রতিক্রিয়াশীল কথাবার্তা বলছেন ক্লাসে। আগেও মরিচঝাঁপির ব্যাপার নিয়ে এইরকম হয়েছিল। এ-নিয়ে কোনো নীতি ঠিক করেছ তোমরা?' - এরপর একদিন ক্লাসে ঠিক এগারো জন ছাত্রছাত্রী জমল। আজ অবধি সর্বাধিক। ক্ষীণদৃষ্টি দেবোত্তম ঠাহর করতে পারলেন না মুখগুলো। হেসে বললেন, 'আজ যে দেখছি একেবারে ফুটবল টীম।' এবং এই দিন প্রথম তারা যোগদান করল বিদ্যাচর্চায়। গ্যালারি থেকে প্রশ্ন আসতে লাগল। প্রথমে শব্দার্থ নিয়ে, পরে পঙ্‌ক্তিবিশেষের গূঢ়ার্থ, তারপরে লেখকের অভিপ্রায়। সবচেয়ে সক্রিয় একটি ছাত্রী। সে নমিতা। তাকেও ঠাহর করতে পারলেন না দেবোত্তম, বরং প্রীত হলেন তার অকপট জিজ্ঞাসায়। এমনি করে, যেন অলক্ষ্যে, আলোচনা পৌঁছে গেল প্রথমে শিক্ষা, শিক্ষার উদ্দেশ্য, মাতৃভাষায় শিক্ষা হয়ে সরকারি শিক্ষানীতির কিনারায়। আর, নিয়তির মতো কেউ বলে উঠল, 'সহজ পাঠ-এর কি কোনো প্রয়োজন আছে বলে আপনি মনে করেন?'

স্থিরদৃষ্টিতে তাকালেন দেবোত্তম। এ তো সেই বিষয় যা তাঁকে মথিত করেছে গত এক বছর। তিনি পত্র লিখেছেন কাগজে; ছাপা হয় নি। তিনি ছুটে গেছেন সভায়, কেউ তাঁকে ভাষণ দিতে ডাকে নি। তিনি সই দিয়েছেন ইস্তাহারে, জানেন না সে-লিপির গতিপথ ও গন্তব্য। তবু তাঁর ধিক্কার খণ্ডিত হয় নি। এবং কোনো ধিক্কারেই ফিরে আসে নি বিদ্যালয়ের 'সহজ পাঠ'। তিনি ভাবলেন এক মুহূর্ত। ধীরে ধীরে বললেন, 'কে বললে কথাটা?' তারপর জাগ্রত হল তাঁর বাক্যের কুণ্ডলিনী, নিনাদিত হল রোষ। ওরা রুদ্ধশ্বাসে শুনতে লাগল।

অতঃপর যা ঘটেছিল তা স্মরণযোগ্য নয়। কারা তাঁকে ডেকে এনেছিল 'সহজ পাঠ' প্রসঙ্গে? কি ছিল তাদের অভিসন্ধি? দেবোত্তম জানতেন না, 'মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি’। কাজেই সফল হল তাদের ষড়যন্ত্র। দেবোত্তম ভূলুণ্ঠিত, ছিন্নবস্ত্র ও পদাহত হলেন।



(পরবাস-৪৯, অক্টোবর, ২০১১)