ISSN 1563-8685




তৃতীয় নারী

'আমি ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছি মহান টাকা-পয়সার দেশে
এই দুনিয়া সর্বনেশে
এরা সাগর ডিঙিয়ে বোমা ফেলে আসে বীরপুরুষের বেশে।'

গানওয়ালা সুমনের সেই পুরোনো গানগুলোই ওর এখনো বেশ লাগে।

ভোরবেলা। ট্রপিকানা হোটেলের এই ঘরটা সতেরো তলায়, এখান থেকে সুন্দর দেখা যায় দুধারে ছড়িয়ে-থাকা শহর, ক্যাসিনো, বোর্ডওয়াক আর সমুদ্র। আটলান্টিক সিটি এখনো রাতের খোঁয়াড়ি ভেঙে পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। রঞ্জনার ছুটির দিনেও সকালে ওঠা অভ্যেস, স্নান সেরে ও জানলার পাশে কফি নিয়ে বসেছে। রজত এখনও গভীর ঘুমে, এলোমেলো বিছানায় কোলবালিশ আঁকড়ে শুয়ে আছে। এরকম সময়ে ওকে একদম বাচ্চাদের মতোই সরল, অগোছালো আর নিষ্পাপ মনে হয়।

'মহারাজা এবার উঠুন, কফিটা খেয়ে উদ্ধার করুন এবার।'

রঞ্জনার মুখটা থমথমে, কাল রাত্তিরে ঝগড়ার জের। রজত কাঁচুমাচু মুখ করে কফির কাপটা নিল। 'কাল সন্ধ্যাটা শুধু শুধু নষ্ট করলাম। আজ আর তর্কাতর্কি নয়, সুন্দর দিনটা এনজয় করি দুজনে। জানো কাল রাত্রে স্বপ্ন দেখেছি আমরা দুজনে বেশ ঝন্টুদার দোকানের রোল খাচ্ছি, আর ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তর্ক করছি। সেই ঝন্টুদার দোকানের প্রেমিকভোগ্য চা আর কুকুরের মাংসের রোল।'

রঞ্জনা হেসে গড়িয়ে গেল। গুমোট পরিবেশ হালকা করে দিতে রজতের জুড়ি নেই। কুকুরের মাংসের থিসিসটা পুরোপুরি ওর। ও নাকি লক্ষ্ করে দেখেছে যে মাসের প্রথম দিকে হাসপাতালে একটু মোটাসোটা গোছের কুকুরগুলো ঝপ করে উধাও হয়ে যায়, আর ঝন্টুদার বিখ্যাত মাটন রোল সুস্বাদু হয়ে ওঠে। তারপর মাস যত এগোয়, রোলে ততই মাংসের পরিমাণ কম আর পেঁয়াজের পরিমাণ বেশি হয়। মাসের শেষ নাগাদ আশপাশের পাড়া থেকে নতুন কুত্তাদের আমদানি হয়, হাসপাতালের আস্তাকুঁড়ে খাবার যেহেতু অঢেল। তারপর আবার রোল খেয়ে পাবলিক আহা আহা করতে থাকে। ও নাকি দস্তুরমত কুত্তাদের ল্যাজে মারকিউরোক্রোমের দাগ মেরে, ডাটা জোগাড় করে, গ্রাফ বানিয়ে দেখেছে।

পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে রঞ্জনার মনটা ভালো হয়ে গেল। কোথায় সেই মেডিক্যাল কলেজের প্যাংলা ছোকরা রজত আর কোথায় আজকের এই সফল, নাক-উঁচু আমেরিকান নিউরোসার্জন। ভালো-খারাপে মেশানো এই পরিবর্তন না হয়েও তো উপায় ছিল না রঞ্জনাই কি সেকথা মাঝে মাঝে ভুলে যায়। নাকি এটা অয়নদার সঙ্গে এরকম হঠাৎ দেখা হয়ে যাবার প্রতিক্রিয়া। অথচ এই একটা উইকএণ্ড তো হঠাৎ দেখা হবার জন্যই। উত্তর আমেরিকা বঙ্গ-সম্মেলনের এই তো মাত্র আড়াইটা দিন, বছরে একবার ওরা সকলে পুরোনো গান শুনে, বাংলায় আড্ডা মেরে, কলেজের মেজাজে ফিরে যায়। বিরাট এই দেশটার নানা শহরে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুরা জড়ো হয়, অনেকদিনের হারিয়ে যাওয়া লোকজনের সাথেও দেখা হয়ে যায় মাঝে মাঝে। কিন্তু তা বলে অয়নদার সঙ্গে দেখা হবে এটা সত্যিই ও আশা করেনি।

লবিটায় রংবেরঙের শাড়ি আর কুর্তা-পাজামার মেলা বসে গেছে। চারদিকে চেনা মুখের খোঁজ 'এই যে গুরু কেমন আছো', 'আরে তোর সেই মেয়ে কত বড়ো হয়ে গেছে' বা 'তোর শাড়িটা কি সুন্দর' এইরকম সব দেশজ চেঁচামেচি। হোটেলের দুচারটে কর্মচারী ভ্যাবাচাকা মুখে কাজ করার চেষ্টা করছে। এই আজব ভাষায় সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলে কিন্তু তাতে কারো কথা বুঝতে কষ্ট হয়না - এই ব্যাপারটা ওদের কাছে রহস্য বইকি। একদিকে মস্ত বাজার আর খাবার জায়গা, একগাদা বুটিক আর গয়নার দোকান সেখানে ঝাঁপ খুলে বসেছে। অন্যদিকে মঞ্চে গানবাজনার আসর, সামনের চেয়ারগুলোতে লোকজন ইচ্ছামত চাদরটাদর বিছিয়ে পরিবারের জন্য জায়গা রিজার্ভ করে বসে আছে। খুচখাচ ঝগড়াও লেগে গেছে এখানে সেখানে। একসঙ্গে এতজন অভ্যাগত শিল্পী, দেশি এবং সাহেব ভিআইপি আর সবার উপরে বঙ্গদেশীয় পাবলিক সামলাতে সামলাতে অর্গানাইজারদের প্রাণ ওষ্ঠাগত।

অয়নের সাথে রঞ্জনার দেখা হল দুপুর নাগাদ, একটা জুয়েলারি দোকানের সামনে।

'কেমন আছো অয়নদা?'
'ভালো আছি। গয়নাটা তো বেশ দেখতে। কিনলি নাকি?'
'উঁহু, আমি গয়না দেখি কিন্তু কিনি না। আরেকজন উলটো, না দেখেই কিনে ফেলে। সোনা হলেই হলো'।
'তোর রিসার্চ কেমন চলছে?'
'ওই একরকম। সংসার সামলে যতটুকু হয়। তোমার কথা বলো অয়নদা। কোথায় আছো এখন।'
'সরকার বাহাদুর তো আর চাকরিতে রাখলেন না তাই বাধ্য হয়ে নিজেই একটা সংস্থা খুলেছি, সেই সূত্রেই আসা।'

রঞ্জনা বসে রয়েছে অনেকক্ষণ, হাসছে, টুকটাক কথা বলছে, কিন্তু ওর মনটা একেবারে উধাও। অয়ন যাকে বলে ওদের কলেজের চ্যাম্পিয়ন ছাত্র। ইউনিয়নের জি এস এদিকে লেখাপড়ায় দুর্দান্ত, বামপন্থী ছাত্র রাজনীতি থেকে গ্রুপ থিয়েটার, কলেজে অয়নদাকে ছাড়া কিছুই হবার যো ছিল না। মেয়েরা অয়নদা বলতে অজ্ঞান কিন্তু দিলের ব্যাপারে ও ছিল যেমন চার্মিং তেমনি পিছল, টোপ গিলেও গিলতো না। পাশ করার পর ওরা যখন ইনটার্ন, অয়ন তখন রঞ্জনার ইউনিটের সিনিয়র হাউস-স্টাফ। তিন বছরের নিবিড় যোগাযোগ, সংখ্যাহীন বিনিদ্র রাত, গল্প, হাসিঠাট্টা, গভীর আলোচনা, প্রথম কাজ করার রোমাঞ্চ, হাসপাতালের সেইসব সাররিয়াল দিনরাত্রি আর কুকুরের মাংসের রোল।

এক একটা দিন সারা জীবনের ওপর ছাপ রেখে যায়। সেই দশ বছর আগের বিকেলবেলাটা যেমন।

'আরে খবর না দিয়ে চলে এলি যে? এখানে মেয়েদের থাকার ভালো ব্যবস্থা নেই।'
'মেয়েদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা লাগবে কেন অয়নদা। ও বুঝেছি - সবাই একসঙ্গে ডাক্তারি পড়বে, অ্যানাটমি মুখস্ত করবে এই অবধি বেশ চমৎকার। কিন্তু আসল দুনিয়ায় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হবে বাছাবাছি আর ডিসক্রিমিনেশন, তাইনা। ছেলে না মেয়ে, পয়সা বা খুঁটির জোর আছে না নেই, ভালো দেখতে না কুচ্ছিৎ। শোবার ঘরে মানাবে না গুদামঘরে।'
'সেটাই আসল দুনিয়ার নিয়ম, অবাক হবার তো কিছু নেই।'
'কেউ কেউ অন্যরকম হতে চায়। যেমন তুমি অয়নদা, বিদেশে গেলেনা, এম-ডি পড়া শেষ করলেনা, পাবলিক হেলথ আর এইডস রিসার্চ নিয়ে পড়ে আছো।'
'সেটা আমার চয়েস। এখানে ভালোমন্দের প্রশ্নই আসেনা।'
'চয়েস তো সবারই থাকা উচিত, তাই না। আছে কি?'
'তুই এতদূরে লোকাল ট্রেন ঠেঙিয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে এলি নাকি?' অয়ন হাসছে।

ঝগড়া করতে ও আসেনি। বরং এসেছে সাহায্য চাইতে, গভীর এক মানসিক সংকট থেকে নিষ্কৃতি পেতে। রজত আলটিমেটাম দিয়েছে; ও এই বছরেই বিয়ে-থাওয়ার ঝামেলা শেষ করে আমেরিকা পাড়ি দিতে চায়। দু' বাড়ি থেকেই রঞ্জনার ওপর চাপ, অথচ ও কিনা সবে হেলথ সার্ভিসের চাকরিটা পেয়েছে এম-ডি পড়াটাও শেষ করা হয়নি। অথচ এরই মধ্যে রজতের এক পা এয়ারপোর্টের দিকে বাড়ানো, কোথায় রেসিডেনসি করবে তাও ঠিকঠাক। রঞ্জনা কিছু নিয়ে প্রশ্ন তুললে ও হেসে উড়িয়ে দেয়। ওর ভবিষ্যতের প্ল্যানে কলকাতার জন্য কোনো গল্প নেই। অথচ রঞ্জনা খাঁটি কলকাত্তাইয়া, ভাবুক, একটু বা ঘরকুণো, পাবলিক হেলথ, প্রিভেন্টিভ মেডিসিন, ইত্যাদি নিয়ে ওর অনেক চিন্তাভাবনা আছে। অবাক কাণ্ড এই যে প্রেম করার সময় এগুলো কোনো বাধা হয়নি। রজত যাকে ভালোবাসে, যার জন্য সারারাত জেগে থাকতে পারে সে এক কালো চোখের উজ্জ্বল, ছিপছিপে তরুণী। কিন্তু সেই তরুণীই আবার এক শিক্ষিত প্রফেশন্যাল, তার আছে নিজস্ব ইগো, উচ্চাশা, মতামত। এই দ্বিতীয় মেয়েটিকে রজত পাত্তা দিতে চায়না। আজকাল রঞ্জনা টের পায় যে ওর মগ্নচৈতন্যে কোনো এক তৃতীয় তরুণীর আনাগোনা টের পাওয়া যাচ্ছে। সে ফাস্ট, বেপরোয়া, নীতিবোধহীন অসামাজিক, ভালো মেয়েরা তাকে দেখলে হিংসে করবে। সেই মেয়েটাই রঞ্জনাকে টেনে এনেছে এখানে, এই নিরিবিলি হেলথ সেন্টারে।

'চা খাবি?' -- অয়ন দুটো কাপ হাতে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। হেলথ সেন্টার প্রায় ফাঁকা এখন। স্টাফ কোয়ার্টারের পিছনে একসারি নারকেল গাছে পাতার ঝিরঝিরানি। দ্রুত ফুরিয়ে আসছে বিকেলবেলা। রঞ্জনা কোন কথা না বলে কাপটা হাতে নেয়।

অয়ন ওর পাশে মোড়াটা টেনে আনে। ওর মুখে সেই ইউনিয়ন রুমের মনভোলানো হাসি - 'তো এবার শুরু থেকে শুরু করা যাক। আন্দাজ করছি, বিয়ে আর আমেরিকা যাওয়া নিয়ে রজতের সাথে ঝগড়াঝাঁটি করেছিস, বাড়ির লোকেরাও তোকে খুব একটা সাপোর্ট করেনি। এই তো? মাথা গরম করে চলে এসেছিস।'

রঞ্জনার মুখচোখে রাগ আর কান্না থমথম করছে, - 'কি এসে যায় অয়নদা। তুমি তো পত্রপাঠ তাড়িয়ে দিচ্ছিলে। সরি তোমাকে বিরক্ত করলাম।'

'সে আর নতুন কি। সেই তো সেকেণ্ড ইয়ার থেকেই করছিস। চল কোযার্টারে গিয়ে বসি। অয়ন আলতো করে ওর পিঠে হাত রেখেছে। ওইটুকুতেই বাঁধ ভেঙে গেছিল রঞ্জনার।

'আরে আরে করিস কি? এখানে তোর মতো সুন্দরী মেয়েকে বসে কাঁদতে দেখলে গ্রামের লোকে সিনেমার শ্যুটিং হচ্ছে মনে করে ভিড় জমাবে।'
'কিছু হবে না আমি ফিরে যাচ্ছি অয়নদা।'
'চিন্তা করিস না আমি পৌঁছে দিয়ে আসব তোকে। লাস্ট ট্রেনের দেরি আছে, একলা ফেরা সেফ হবে না। আমি এমনিতেই কলকাতায় ফিরতাম রে, ভালোই হলো তোর সাথে গল্প করতে করতে ফেরা যাবে।'

সেদিন দশটার আগেই বাড়ি পৌঁছে গেছিল রঞ্জনা। তারপর যথারীতি বাবা-মা কে একরাশ মিথ্যে বলে, চা-মিষ্টি খেয়ে, রঞ্জনাকে আমেরিকা যাবার জন্য অনেক অনেক কংগ্রাচুলেট করে উঠে পড়েছিল অয়ন। তখনও ওর মুখে সেই মনভোলানো হাসি, রঞ্জনার কানে কানে বলে গেছিল 'হাকুনা মাটাটা - ডু নট ওরি।' ওই মন্তর নিয়েই কখন যে গড়াতে গড়াতে চলে গেল দশটা বছর।

রাত্রি। অডিটোরিয়ামে কোন এক স্বনামধন্য বাঙালি প্লেব্যাক গাইয়ের অনুষ্ঠান চলছে, রঞ্জনা আস্তে আস্তে হোটেলের বাইরে বোর্ডওয়াকে এসে দাঁড়ালো। চারিদিকে রেস্তোরাঁ, স্যুভেনিরের দোকান আর ক্যাসিনোগুলোয় নিয়ন আলোরা জ্বলছে নিভছে, দূরে অন্ধকারে যেন ঝিম মেরে বসে আছে আটলান্টিক।



'চল সমুদ্রের দিক দিয়ে একটু হেঁটে আসা যাক।'

রঞ্জনা একটুও অবাক হলো না। ও যেন জানতো এটাই হতে চলেছে। এই লোকটা জাদুকর, ঠিক সময়ে হাজির হবে, আবার উধাও হয়ে যাবে।

বালির একটা ঢিবি তার উপরে বেঞ্চি পাতা। এখান থেকে স্পষ্ট শোনা যায় সমুদ্রের কল্লোল, ঢেউগুলোর যেন ক্যাসিনোর আলোয় মাখামাখি তরল ক্যানভাস।

'বিয়েটিয়ে করেছো? ছেলেমেয়ে?'
'না রে হয়ে ওঠেনি। এমন লক্ষ্মীছাড়া, পুয়োর, হাংরি ডাক্তারকে কে বিয়ে করবে বল।'
'আমরা দুজনেই কি বোকা অয়নদা।'

অয়ন একটু চমকালো।

'বিয়ের আগে নার্ভাস মেয়েটা তোমার কাছে একলা চলে এল। মেয়েটা আমেরিকা যেতে চায়নি, নিজের খেয়াল, নিজের মতো কাজ নিয়ে থাকতে চেয়েছিল। তোমার মতো তারও পথ হতে পারতো ওয়ান দ্যাট ওয়াজ লেস ট্রাভেলড বাই। মেয়েটা চেয়েছিল তার জীবনের কাটা খালে একটা তরঙ্গ তুলতে, চেনা হিসাবের খাতায় হিজিবিজি কেটে দিতে। জানতে চেয়েছিল জীবনে অন্ততঃ একবার আউটরেজিয়াস কিছু একটা করলে কার কি রকম রিয়্যাকশন হয়? সেই চূড়ান্ত ভালনারেবল মেয়েটা তখন তোমার বিছানার কাছে। সে হয়তো আশা করেছিল যে তুমি তাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে। হয়তো তার হালকা রঙের শাড়িটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে তাকে কোনো এক বেপরোয়া খাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। সে হয়তো ভয় পেতে চেয়েছিল, অসহ্য আনন্দের শীৎকার হয়তো তার গলায় আটকে ছিল। আর তুমি? ওয়াও মহাত্মা অয়ন! তুমি কিনা মেয়েটাকে বিছানা থেকে তুলে হাত ধরে স্টেশনে নিয়ে গেলে। এই তো দেখো কি চমৎকার সংসার আমার, একেবারে বইয়ের পাতা থেকে তুলে দেওয়া তাই না? সেদিন থেকে আমি একেবারে সোজা রাস্তায় চলেছি, অ্যাণ্ড ইউ নো হোয়াট - আফটার দ্যাট ডে আই কুড নেভার বি কোয়াইট কনফিডেন্ট অ্যাবাউট মাই সেক্সুয়ালিটি।

রঞ্জনার গলা কাঁপছে, শালীনতার সীমা কতটা ছাড়িয়ে গেছে সেটাও ওর বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু জমানো আবেগ ঠেলে উঠছে আটলান্টিকের বুকে হারিকেনের মতো। হাওয়ায় এলোমেলো হচ্ছে ওর কাঁধ অবধি খোলা চুল। অয়ন ওর হাত ধরে একটা বেঞ্চিতে বসাল।

'সব কথা বলা হয়েছে তোর। এবার শুনবি?'
'শুনে আর কি হবে অয়নদা। আমি খারাপ মেয়ে এই তো?'
'রঞ্জনা, আই অ্যাম গে।'
'কি!'
'আই অ্যাম গে। তুই কেন, কোনো মেয়ের প্রতিই আমার আকর্ষণ নেই। হোস্টেলে থাকার সময় আমি আর তন্ময় ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম। যে কারণে বিয়ে করিনি, কলকাতায় প্র্যাক্টিস করার বদলে আদিবাসীদের মধ্যে এনজিও চালাই, পূর্ব-ভারতে এইডস নিয়ে কাজ করি। আমার জীবনটা অন্যরকম বটে কিন্তু নট কোয়াইট বাই চয়েস। আসল কারণটা খুব কম লোক জানে, আজকে তাদের সংখ্যা আরেকজন বাড়লো। আমাদের সাবধানে থাকতে হয় জানিস তো, যাকে বলে আলমারির মধ্যে জীবন।'
'তার মানে - তার মানে এতদিন সব ভুল ভেবে এসেছি। প্লীজ বলো তুমি ঠাট্টা করছো।'
'কেন তুই হোমোফোবিক বুঝি?'
'মোটেই নয়। কিন্তু তাই বলে তুমি?'
'গেস হু ইজ কামিং ফর ডিনার। লিবারেল কিন্তু নিজের গা বাঁচিয়ে, কেমন? নারে আমি সত্যিই গে। আমার পার্টনারও আছে।'
'তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ। কিন্তু কি ভুল, কি ভুল!'
'তবেই দ্যাখ। বাইরে থেকে দেখে যা মনে হয় তার অনেকটাই ভুল। পল গগ্যাঁর ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ায় আঁকা ছবিগুলোর মতন। আদিম, খোলা বুক, একসোটিক মেয়েরা বৃষ্টি অরণ্যের মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে, গগ্যাঁ ওইসব কোথাও দেখেননি। টাহিটি তখন পুরোদস্তুর ফ্রেঞ্চ কলোনি, ক্যাথলিকরা সবাইকে ঘাড়ে ধরে ক্রিশ্চান বানিয়েছে। সক্কলে দরকারের বেশি কাপড়জামা পরে থাকে। কিন্তু শিল্পীর ওই মনগড়া একসোটাইজড ছবিটাই সারা ইউরোপে বিখ্যাত হয়ে গেল। এখনও লোকে টাহিটি বলতে ওইসব ভাবে।'

একমাত্র এই লোকটাই হাজার মলম নিয়ে কথা শুরু করে রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শেষ করতে পারতো। রঞ্জনা ভাবলো। এদিকে অয়ন বলে চলেছে -
'তোর কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে শুধু এটাই নয় আরো অনেক কিছু ভুলভাল ভাবনাচিন্তা আছে তোর মাথায়। ওইজন্য মাথাটা গরম হয়ে থাকে।'
'তাই বুঝি? দু একটা বুঝিয়ে বলো দেখি। জলের মতো করে, যেমন অ্যানাটমি বোঝাতে।' রঞ্জনা এতক্ষণে একটু হেসেছে।
'যেমন তুই ভাবিস আমেরিকার মার্কেট ক্যাপিটালিজম একটা জঘন্য শয়তানি কারখানা, দুনিয়ার সবরকম লুটপাট খুনোখুনির পয়লা কারণ। তুই এও ভাবিস যে তোর বরও সেই কারখানার ফোরম্যান বনে গেছে, আদর্শ খুইয়েছে। রজত নিজে ওর প্র্যাকটিস চালায়, দেখাই যাচ্ছে পয়সাকড়ির ব্যাপারটা ও ভালোই বোঝে। এদিকে তুই নিজেকে আইডিওলজিক্যালি কোণঠাসা মনে করছিস, নিজেদের জীবনের ছন্দটাকে ভালোবাসতে পারছিস না। দুনিয়ার যাবতীয় হাঙ্গামার জন্য আমেরিকা নামক একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট সত্ত্বার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদেরও দোষী ঠাউরে বসেছিস। আসল সত্যের ছবিটা তোর কাছে ঝাপসা।'
'ওঃ অয়নদা। আসল সত্যটা কি তাহলে একটু শুনি? আর আমেরিকা মোটেই অ্যাবস্ট্রাক্ট সত্তা নয়, একটা হাড়বজ্জাত সাম্রাজ্যবাদী দেশ।'
'তাই না কি? আর আমরা একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা! তাহলে দেশে শপিংমল আর নাইট-ক্লাবের এট বাড়বাড়ন্ত কেন। কলকাতার চারদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো রিসর্ট গজিয়ে ওঠার দরকার ছিল কি? আরবান ইণ্ডিয়ার যেদিকে তাকাবি বাজার তোকে হাঁ করে গিলতে আসবে। আমরাই অতি আগ্রহে এই ভোগবাদী দর্শন মাথায় তুলে নিয়েছি, কেউ আমাদের জোর করে এখানে নিয়ে আসেনি।'
'আরবান ইণ্ডিয়ার কথা আমি ধরছি না।'
'গ্রামে-গঞ্জেও ওই একই ছবি, যে পারে সেইই গোগ্রাসে গিলতে চায়। গরীব আর ডিপ্রাইভড হলেই মানুষ মহৎ বনে যায় না, বাধ্য হয়ে খিদে চেপে রাখা মানেই নির্লোভ হওয়া নয়। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। জিম্বাবওয়ে দেশটার দিকে তাকিয়ে দেখ মুগাবে কি হাল করেছে।'
'তাই বলে দুনিয়াজোড়া এই কর্পোরেট ইম্পিউনিটি মুখ বুজে হজম করতে হবে।'
'সিস্টেমকে বদলাতে হলে আগে মানুষগুলোকে বদলানো চাই, তার আগে কিছু হবার নয়। আমার ধারণা লড়াইটা বহুমাত্রিক এবং পারসোনাল, একজনের লড়াই আরেকজন লড়তে গেলেই মুশকিল। বাকিটা সময়, শিক্ষা আর এভোলিউশন। খারাপ শোনাল?'
'মানুষের এইরকম ডেস্ট্রাক্টিভ বুদ্ধি কেন হয় কে জানে?'
'ডায়াবিটিস বা গেঁটে বাত কেন হয়? কজ ইজ আননোন। ওয়েস্টার্ন ক্যাপিটালিজমকে নন্দ ঘোষ বানিয়ে তো অনেকদিন গেল। সেঞ্চুরি বদলে গেছে, এবার একটু অন্যরকম ভাব।'

রঞ্জনা চুপ। কজ ইজ আননোন ওর খুব চেনা বাক্য। অসুখবিসুখের কারণ নিয়ে যখনই কেউ বেয়াড়া প্রশ্ন করতো, ওদের এক স্বনামধন্য অধ্যাপক ওই বাক্যটি ব্যবহার করতেন ওঁর ট্রেডমার্ক বাঙাল অ্যাকসেন্টে। অয়ন সেটা হুবহু নকল করতে পারে।

'তোকে বলা হয়নি আমাদের মতো এনজিও গ্রুপগুলোকে যারা সাপোর্ট করছেন, যাদের ছাড়া হয়তো নর্থ-ইস্ট ইণ্ডিয়ায় এইডস মহামারী হয়ে যেত, প্যারালিটিক পোলিও নতুন করে দেখা দিত, তারাও তোর মতো আমেরিকান। সেই লিস্টে বিল গেটস থেকে শুরু করে তোর পুঁজিবাদী বরটাও আছে। ঝাড়খণ্ডে, মাওবাদী এরিয়ায় আমাদের স্কুল আর হাসপাতালটাও এভাবেই চলে। ওর জন্যই প্রজেক্টটার কথা সবাইকে জানাতে পেরেছি। এটা সামান্য একটা উদ্যোগ, কোনো প্যানাসিয়া নয়, কিন্তু রজত না থাকলে খুবই অসুবিধা হতো।'

অবাক হওয়ার একটা মাত্রা আছে। তার মধ্যেও রঞ্জনা ফোঁস করে উঠালো।
'তাই নাকি? তো মহারাজ আমাকে কিছু বলার দরকার মনে করেন না। তা আমার মনোবিকলন কি উনিই করেছেন?'
'তোকে কাল রাত্তিরে বলতে গেছিল, তুই নাকি খুব ঝগড়া করেছিস। আর মনোবিকলনে ভুল বিশেষ কিছু নেই বোধহয়।'
'ওঃ আর পারি না। দুটো কথা বললেই বাবুর মেজাজ চড়ে যায়। তুমি যাই বলো অয়নদা, এই সমাজটা যান্ত্রিক আর বিবেকহীন, এখানে থাকতে আমার ভালো লাগেনা।'
'বিশ্বাস কর সব জায়গারই এক হাল। সবাইকে নিজের নিজের কমফর্ট জোন গড়ে নিতে হয়। যাকে বলে ওয়েসিস। কোথায়, কিভাবে সেটা খুঁজে পাবে সেটা খানিকটা ভবিতব্য, খানিকটা চয়েস। যেমন আমি ভাবছি তোকে এবার তোর বরের কাছে পৌঁছে দিয়ে এখানকার গে ঠেকগুলো একটু চেক করে আসব। ঠাট্টা করছি।'
'তোমার পক্ষে সবই সম্ভব। সরি অয়নদা অনেক উলটোপালটা বকেছি।'
'অ্যাপোলজি অ্যাকসেপ্টেড। যদি কথা দিস রজতের সঙ্গে ঝগড়া করবি না।'
'এইটা গণ্ডগোল হয়ে গেল অয়নদা। নিজের বরের সঙ্গে ঝগড়া করবো না তো কি লোক ভাড়া করে ঝগড়া করতে যাব।'

আবার ভোর। রজত তৃপ্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে। রাতের খেলাটা ও আশা করেনি তাই ওকে বেশ একটু অপ্রস্তুত মনে হয়েছিল। কার্পেট থেকে জামাকাপড় তুলতে তুলতে রঞ্জনার মনে হলো ওর ভিতরের সেই তৃতীয় নারী বোধহয় কাল রাত্তিরে বিদায় নিয়েছে। হয়তো সে চলে গেছে আটলান্টিক সিটি থেকে সাও পাওলো, মেঘালয় থেকে মুকুটমণিপুর, পল গগ্যাঁর সেই বৃষ্টি অরণ্য আর নীল সমুদ্রের পথে।

সে যাকগে। ওকে ছাড়াও চলে যাবে রঞ্জনার।



(পরবাস-৪৯, অক্টোবর, ২০১১)