ISSN 1563-8685




প্রসঙ্গ: ইয়ের্জি গ্রোটোভ্‌স্কি

কলকাতার সঙ্গে ইয়ের্জি গ্রোটোভ্‌স্কির সম্পর্ক বহু বছরের পুরোনো। আশির দশকে ছাত্রাবস্থায় আমরা যখন ইয়ের্জি গ্রোটোভ্‌স্কির 'Towards a Poor theatre' পাঠে অনুপ্রাণিত, তখনই জেনেছিলাম কলকাতা ইয়ের্জি গ্রোটোভ্‌স্কি চর্চায় অনেক আগে থেকেই নিমজ্জিত।

ষাটের দশকে কলকাতা তথা বাঙলায় IPTA বা নবনাট্য আন্দোলনের জোয়ারে বাম রাজনীতি তার সাংস্কৃতিক দিশা খুঁজে নিচ্ছিল। পাশাপাশি চলছিল আরও বহুমাত্রায় সংস্কৃতি চর্চার ইঙ্গিত। মুখ্য উদ্দেশ্যঃ খুঁজে নিতে হবে বলার কথাকে ভাবনাকে, দেখতে হবে কতটা দৃঢ়সংবদ্ধভাবে, নিবিড়ভাবে তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। আর বলতে হবে মানুষের কথা তার সমকালীন সংকটের কথা, আন্তর্জাতিক বা আবিশ্ব মোহ চক্রান্তের কথা! এ সবের মধ্যেই তৈরি হচ্ছিল চলচ্চিত্র, নাটক, সঙ্গীত ইত্যাদির বহু ভঙ্গিতে গণপ্রকাশ! ছাত্রাবস্থায় শুনেছি, সেই সময় এক কলকাতাস্থিত মার্কিন দূতাবাসকর্মী জিম হ্যাচ মালবাহী জাহাজে করে আনিয়েছিলেন "Towards a poor theatre" এর একটিমাত্র কপি। পোল্যাণ্ডের Wrocław শহরে গ্রোটোভ্‌স্কির থিয়েটার ল্যাবরেটরিয়ম (Theatre Laboratorium) তখন প্রায় কিংবদন্তীতুল্য থিয়েটার জগতে। মনে রাখতে হবে, গ্রোটোভ্‌স্কি যখন তাঁর অ্যাক্রোপলিস, শকুন্তলা, বা দ্য কনস্‌ট্যান্ট প্রিন্-এর মতো দ্বিগ্বিজয়ী নাট্যপ্রদর্শন করছিলেন, তখনও তাঁর ঐ বিখ্যাত বইটি প্রকাশিত হয়নি, তাঁর ভাবনাচিন্তা মূলত সম্বলিত ছিল "Teksti" বা বিভিন্ন ছোট পুস্তিকায়। পরে গ্রোটোভ্‌স্কি অনুপ্রাণিত ইয়ুজেনিও বারবা তাঁর Odin Theatre-এর প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশ করেন "Towards a poor theatre", যার একটিমাত্র কপি হাতে হাতে ঘুরছিল কলকাতার নাট্যপ্রেমী মহলে, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বা সংস্কৃতিপ্রেমী জগতে। ঐ একটিমাত্র কপির মাধ্যমেই ঘটেছিল কলকাতায় গ্রোটোভ্‌স্কির বিপ্লবী, জেহাদী নাট্যভাবনার প্রকাশ।

গ্রোটোভ্‌স্কি যোগাযোগ আরও একটু নিবিড় হলো কলকাতার সঙ্গে, যখন ষাটের দশকের শেষে বাঙলার থার্ড-থিয়েটার-এর জনক শ্রী বাদল সরকার ইওরোপ যান নবনাট্য আন্দোলনের বিভিন্ন দিকগুলির সঙ্গে পরিচিত হতে বা বলা ভালো, একেবারে কাছের থেকে, নিজের চোখে দেখতে। আগেই বলেছি গ্রোটোভ্‌স্কির থিয়েটার ল্যাবরেটোরিয়াম তখন সারা বিশ্বের নাট্যপ্রেমীদের কাছে একটি পীঠস্থানস্বরূপ। বাদলবাবুর মুখ্যসূচিতে গ্রোটোভ্‌স্কির সঙ্গে সাক্ষাৎকার লিখিত না থাকলেও শ্রী সরকার ঘটনাচক্রে পোল্যাণ্ডের ভ্রোত্‌স্লভ শহরে গ্রোটোভ্‌স্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং থিয়েটার ল্যাবরেটোরিয়াম পরিদর্শনের সুযোগ পান। একেবারে কাছের থেকে দেখেন তাঁর কাজের পদ্ধতি। গ্রোটোভ্‌স্কি তখন ব্যস্ত ছিলেন ভারতীয় মহাকাব্য শকুন্তলার নাট্যরূপায়ণে। একইসঙ্গে বাদলবাবুর নজরে এল, Rena Mirecka, Ryszard CieslakZigmunt Molik প্রভৃতি বিশিষ্ট অভিনেতাদের অভিনয়কৌশল। এখানেই একথা বলে রাখা ভালো Towards a Poor Theatre-এর ধারণা কিন্তু বাদলবাবুর থার্ড-থিয়েটার-এর মূল দর্শন থেকে মূলগতভাবে পৃথক। গ্রোটোভ্‌স্কি যেখানে জোর দিচ্ছিলেন থিয়েটারের মূল শক্তির উপর, যা একান্তভাবেই নির্ভর করে আছে অভিনেতার নাট্যদর্শনের উপর, সেখানে থার্ড-থিয়েটার পৌঁছতে চেয়েছে আঙ্গিকগতভাবে দর্শকের বা মানুষের কাছে। কিন্তু একটি ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এর পর থেকে গ্রোটোভ্‌স্কির সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ আরও একটু নিবিড় হল, আরও কাছে এল।

এর পরের আখ্যান আশির দশকে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সবে শেষ হয়েছে আমাদের। নাট্যভাবনার সম্পৃক্ত এবং সাহিত্যের ছাত্র হবার সুবাদে আবার আমার তখন বিশেষ আকর্ষণ বাঙলার লোকসংস্কৃতির প্রতি। বিশেষত বাউল সম্প্রদায়ের উপর গবেষণাধর্মী কাজে তখন আমি নিমজ্জিত। নাট্যচর্চায় সেই লোকসংস্কৃতির উপাদান কতটা গভীর বা কীভাবে তা একে অপরকে অনুপ্রাণিত করছে সেই অনুসন্ধানেই রত আমি। ঐ রকম সময়েই বন্ধু মারফত খবর পেলাম স্টিভ ওয়েন্‌স্টাইন নামক এক গ্রোটোভ্‌স্কি-অনুচর কলকাতায় পৌঁছেছেন এবং তিনি বিশেষভাবে আগ্রহী বাউল গান শোনার। শুধু সঙ্গীতকুশলতা নয়, যে ভ্রাম্যমান বাউল প্রত্যক্ষভাবে তাঁর শিল্প-সাধনা দর্শন নিয়ে ক্রমাগত নিরীক্ষা করছেন, ভাঙছেন-গড়ছেন এবং মানুষের কাছে পৌঁছোতে চাইছেন তাঁরই নিজস্বতা নিয়ে সেইসব বাউলদের সম্বন্ধেই স্টিভ-এর উৎসাহ। বীরভূমের বাউল গৌরখ্যাপার এক রাতের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা গেল, দক্ষিণ কলকাতার এক বাড়ির একতলায়। বলা বাহুল্য গৌরখ্যাপাও তখন আমাদের নাট্যচর্চার একজন সক্রিয় উৎসাহী। তবে তাঁর অনুদান 'বাউল খ্যাপা'র আদ্যন্ত পরিচয়ে। অনুষ্ঠান শেষে স্টিভ জানালেন গ্রোটোভ্‌স্কির আগমন বার্তা। বিশেষত বাঙলার যুবনাট্য আন্দোলন এবং বাউল সংস্কৃতির সঙ্গে একটি মুখোমুখি চর্চা করতে চান তিনি।

সেইসময়, ৮০ সালে গ্রোটোভ্‌স্কির থিয়েটার জগৎ থেকে প্রস্থান এক চরম বিতর্ক তুলেছে সারা বিশ্বের নাট্যমহলে। ১৯৬৯ সালের পর গ্রোটোভ্‌স্কি আর 'Theatre of Production'-এর ধারায় আর কোনও নাটক পরিচালনা করেননি। Apocalypsis cum Figuris-ই তাঁর শেষ নাট্যপরিচালনা। দর্শক ও অভিনেতার মধ্যে ভেদাভেদ প্রায় ঘুচে আসছিল, গ্রোটোভ্‌স্কির নাট্যপরিচালনাগুলিতে থিয়েটার উপকরণ আর বাহুল্যমাত্র নয়, প্রায় একই তলে অধিষ্ঠান দর্শক ও অভিনেতাদের, কোনও উপর-নীচ ভেদাভেদ নেই। আলো বলতে এখন শুধু মোমবাতির ব্যবহার, খুব বেশি হ'লে মেঝেতে রাখা দুই একটি জোরালো স্পট লাইট। কী বলতে চাইছেন গ্রোটোভ্‌স্কি তাঁর নাট্য পরিচালনাগুলিতে? দর্শক-অভিনেতা সবাই এক বিশেষ ভাবনার অভিযাত্রী (বিশেষ ভাববার এখানে যে "টেক্সট"-কে ধরে নাটকটি অভিনীত হচ্ছে), সে নিরপেক্ষ দর্শকমাত্র নয়। ক্রমশ দর্শকের "আইডেনটিটি" হয়ে উঠছে তাঁর নাট্যপরিচালনাগুলিতে একজন সহযাত্রী বা পার্টনার-এর। কিন্তু প্রোডাকশন-এর বাধ্যবাধকতা অনুসারে দর্শক তাঁর নিষ্ক্রিয় (passive) জায়গা থেকে বেরোতে পারছিলেন না, ফলে নাটকে দর্শকদের অংশীদারিত্ব ছিল নিতান্তই গৌণ, কেবলমাত্র শারীরিক উপস্থিতিটুকুই, ব্যস। এই সময় থেকেই গ্রোটোভ্‌স্কির 'Theatre of Participation'-এর ভাবনা শুরু--সবাইকে অংশ নিতে হবে নাট্যযজ্ঞে, যেমনটি হত আদ্যিকালের "রিচ্যুয়াল"গুলিতে, যেমনটি হত বিভিন্ন জনজাতির আদিম জীবনে। ১৯৭৬ পর্যন্ত চলে এই থিয়েটার অব্‌ পার্টিসিপেশনের অভিযাত্রা। দর্শক যেখানে দর্শক নয়, অভিনেতা নয় শুধু অভিনেতা, নাটকের কোনও ধরাবাঁধা নির্দিষ্ট কাহিনিও নেই, শুধু আছে খেই ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এক বিষয়ের প্রস্তাবনা। অভিনেতা তাঁর মূল সুতোটিকে ছেড়ে দেন সমবেত জমায়েতকারীর মধ্যে, তারপর সবাই মিলে এগিয়ে নিয়ে চলে সেই ঘটনাপ্রবাহকে। গানে, নৃত্যে বা কখনও তীক্ষ্ণ দুই একটি সংলাপবাক্যে সেই ঘটনাপ্রবাহ এগিয়ে চলে। মূল কাঠামোটি ধরে রাখতে সাহায্য করেন অভিনেতারা। ঠিক যেমনটি হয় আদিম জনগোষ্ঠীর রিচ্যুয়াল-এর বেলায়। পুরোহিত বা 'ভরে পাওয়া' মধ্যমণি শুরু করে দেন একটি কর্মকাণ্ড, আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দেন সবার মধ্যে--যারা জমায়েতে এসেছেন, তারপর সবাই নিজের নিজের মতো করে সেই ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়েন, আর সারা রাত ধরে চলে তার নির্মাণকার্য, যার মূল লাঠিটি-ধরা অবশ্যই পুরোহিতের হাতে।

১৯৭৬ সাল থেকে ইয়ের্জি গ্রোটোভ্‌স্কি শুরু করেন এক নতুন কর্মযজ্ঞ - Theatre of Sources (উৎসের থিয়েটার)। থিয়েটার অব্‌ পার্টিসিপেশন থেকে এক ধাপ উত্তরণ, এই উৎসের থিয়েটার-এ। থিয়েটার অব্‌ পার্টিসিপেশন-এ যেখানে মূলত বদ্ধ ঘরেই চলত কর্মকাণ্ড, উৎসের থিয়েটার-এ কিন্তু গ্রোটোভ্‌স্কির প্রেক্ষাপট উন্মুক্ত প্রকৃতি। এই উন্মুক্ত প্রকৃতির উৎসের মধ্যে নিমজ্জিত রহস্য, শক্তি, তার আলো-আঁধারি সবই এসে যায় উৎসের থিয়েটার প্রকল্পে। এবং প্রকৃতির সীমাহীনতার মতোই গ্রোটোভ্‌স্কি এর কলাকুশলী কাজে বেরিয়ে পড়লেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে।

১৯৮০ সালে, গ্রোটোভ্‌স্কি যখন কলকাতায় এলেন থিয়েটার অফ সোর্সেস-এর তখন মধ্যপর্ব চলছে বলা যায়। কিন্তু চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছানো তখনও বাকি। উৎসের থিয়েটার-এর বিভিন্ন প্রকল্প তখন ইওরোপ, আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা বা হাইতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

১৯৮০ সালে কলকাতায় তাঁর অনুচর হিসেবে সঙ্গে ছিলেন ফ্রান্স, জার্মানী, হাইতি এবং পোল্যাণ্ডের কয়েকজন সহচর। আমাদের নাটকের কাজকর্ম দেখার পর এক সারারাতের মুখোমুখি আলোচনায় গ্রোটোভ্‌স্কি খতিয়ে বললেন নাটক সম্পর্কিত তাঁর ধ্যান-ভাবনা। সেই প্রসঙ্গেই গ্রোটোভ্‌স্কি জোর দিলেন উৎসের থিয়েটারকে থিয়েটারের উৎস ভাবা খুব ভুল হবে। নাটকের উৎস নয়, উৎসের নাটক নিয়েই তিনি গবেষণায় মগ্ন। এবং এ কোনো তাত্ত্বিক গবেষণা নয়, একদম হাতে কলমে পরীক্ষাই এর মূল লক্ষ্য, এটি অত্যন্ত প্র্যাগ্‌মাটিক। উৎস হিসেবে অবশ্যই এখানে গ্রোটোভ্‌স্কি বেছে নিয়েছেন প্রকৃতির সীমাহীনতা কিন্তু এ কোনো মায়াবী রোমান্টিক প্রকৃতি নয়, বরঞ্চ প্রকৃতির মধ্যে যে শক্তির উৎস রয়েছে সেই উৎসের মুখোমুখি দাঁড়ানোই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। সেই একই উৎসের অসীম বিকাশ মূর্ত হচ্ছে, আমাদের অর্থাৎ মানুষের মধ্যেও। আর যুক্তিহীন প্রাণী (irrational animal), লিঙ্গভেদহীন মানুষ প্রকৃতির সেই উৎসের মুখে দাঁড়িয়ে নিজেরও বিকাশ ঘটাবে, প্রকৃতির অসীম শক্তির সামনে মানুষ তার নিজের অমিত শক্তির দ্বারোদ্‌ঘাটন করবে, উৎসমুখের সন্ধান নেবে। এক অর্থে যে ritual এর সূত্রপাত হয়েছিল Theatre of Participationএ, তারই এক ব্যপ্তি এই Theatre of Sources-এ।

এই মহানাটকের কুশীলব সবাই। প্রকৃতির অসীম চত্বরে সবাই মিলে তৈরি করে স্বতোৎসারিত এক নাট্য-মহাকাব্য। তবে rules of the art এর নিয়ম মেনে সেখানেও রয়েছে এক সংগঠন, structure । সে কথায় পরে আসছি।

সারা রাত আলোচনার পর গ্রোটোভ্‌স্কি আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন ওঁর সদস্যদের সঙ্গে বীরভূমের উপকণ্ঠে কেঁদুলি যাবার জন্য। সাতদিনের এই ওয়ার্কশপে জানতে পারলাম আমাদের সঙ্গে থাকছেন বীরভূমের প্রধান বাউল রামানন্দ দাস এবং অবশ্যই গৌরখ্যাপা। কাজের ধরন নিয়ে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করতে না করেছিলেন গ্রোটোভ্‌স্কি এবং এটাও ওঁর কাজের ধরনের মধ্যে পড়ে। কৌতূহল যে এক ধরনের 'pre-occupied idea' তৈরি করে, যা নিঃসন্দেহে নাটকের দর্শককে, নাটককে তার 'essence' থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, গ্রোটোভ্‌স্কি বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে একথা বলেছিলেন। আর সত্যি কথা বলতে এখানে এই Theatre-এ তো সবার অংশীদারি রয়েছে। সমানভাবে। এবং যা তাৎক্ষণিক, উপস্থিতির (presence) পূর্ণ মাত্রায় তার চরম (sublimal) রূপ।

কেঁদুলির যাত্রার দিনটি ছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। স্বভাবতই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে যানবাহন চলাচলে তার প্রভাব পড়ে ভালোই। আমরাও আটকে পড়ে গেলাম ইলামবাজারের কাছে বিকেলবেলায়। আমরা খানিকটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কীভাবে পৌঁছানো যাবে জয়দেব কেঁদুলিতে সেইদিন। কিন্তু গ্রোটোভ্‌স্কি এই সূর্যগ্রহণের সময়কে তাঁর ওয়ার্কশপে কাজে লাগাতে চাইছেন। আমাদের হাইতীয় সঙ্গী মিকাভোকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বসে পড়লেন দূরে এক গাছের তলায়। এখানে বলে রাখি, মিকাভো একজন 'ভুডু' সম্প্রদায়ের পুরোহিত। 'ভুডু' (voodoo) ritual-এ Mambo র আবির্ভাব হয়, যার বাহ্যিক আবহ, ঝড়, বাদল বা গ্রহণএর মতো কিছু বিশেষ সময়, voodoo priest সংক্রামিত (transmission) করেন সেই আবহ সমবেত জমায়েতে। 'ভর'এর শক্তি তখন আরোপিত হয় কারুর কারুর উপর। তিনি তখন পরিচালিত হন এক বিশেষ শক্তির দ্বারা, পরিচালনা করেন সেই বিশেষ শক্তিকে তাঁর চারপাশে। Ritual সেখানেই জন্ম নেয় যখন সেই 'Opus flow' (স্রোতস্বিনী) উপস্থিত সবার মধ্যে এক রূপান্তর ঘটাতে সাহায্য করে যা বাহ্যিক (Behaviovral) এবং চারিত্রিক (Psychological)। কিন্তু তার জন্য চাই প্রস্তুতি। Rehearsal নয়, initiation (দীক্ষা)। সূর্যগ্রহণের সময়কে সেই দীক্ষাদানের উপযুক্ত ক্ষণ হিসেবে বেছেছিলেন গ্রোটোভ্‌স্কি।

কেঁদুলিতে সেই ৭ দিনের ওয়ার্কশপকেও আমি Initiation to the Theatre of Sources হিসেবে অভিহিত করতে পারি। চারপাশের প্রকৃতির উৎস সম্বন্ধে অবহিত হওয়া, পর্যবেক্ষণই শুধু নয়, নিজেকে সেই পরিমণ্ডলে অন্বিত করা ছিল তার মূল লক্ষ্য। বীরভূমে আমি এর আগেও গেছি, সাহিত্যের ছাত্র হবার সুবাদে শান্তিনিকেতন আমার অন্যতম প্রিয় জায়গা সুতরাং তার প্রকৃতি আমার তো প্রিয় হবেই। তবে মূল পার্থক্য ছিল, তখন দেখেছিলাম প্রকৃতিকে রোমান্টিক চোখে 'মোহ-অঞ্জন' নেত্রে। আর এখন প্রকৃতির মুখোমুখি হতে হল এক primordial force এর মধ্যে থেকে, আমারও মধ্যে তার উপাদানের উৎসমুখ খুলে দিতে। এখানে হয়তো ফরাসী নাট্যবিদ Antonin Artaud এর সঙ্গে অনেকে গ্রোটোভ্‌স্কির তুলনামূলক আলোচনা টেনে আনতে চান - Artaud -এর Solar Theatre এবং Lunar Theatre এর প্রেক্ষিতে রোম বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রোটোভ্‌স্কির সুবিখ্যাত "Original Technique of an Actor" এর বক্তৃতামালায় এই প্রশ্নেরও মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এই সেদিনও UNESCO আয়োজিত Grotowski Year (2009) - এ কয়েকজন সুইডিশ যুব নাট্যকর্মীও এই তুলনা টেনে আনেন। কিন্তু এই তুলনা বিভ্রান্তিকর। থিয়েটার জীবনের গোড়াতেই গ্রোটোভ্‌স্কি Artaud-কে তাঁর থিয়েটার আদর্শর সঙ্গে জড়াতে নারাজ। পোল্যাণ্ডে ষাটের দশকে প্রকাশিত 'He was not entirely himself' প্রবন্ধে (যা আদতে Artaud র Theatre of Cruelty র সমালোচনা) গ্রোটোভ্‌স্কি বিশদে দেখিয়েছেন Artaud-এর থিয়েটার-ভাবনার সীমাবদ্ধতা; রোম বিশ্ববিদ্যালয়েও গ্রোটোভ্‌স্কি ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁর নাট্য ভাবনায় জড়িয়ে আছে eros-caritas, যেখানে Artaud অনেক বেশি নিমজ্জিত 'eros' এর গূঢ় প্রকাশে। তবে ritual-এর মধ্যে নাট্যভাবনার গতিপ্রকৃতি নিরীক্ষণে গ্রোটোভ্‌স্কি যে Artaud -র কাছে ঋণী এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

কেঁদুলির ওয়ার্কশপে প্রকৃতির সঙ্গে মেলামেশার সময়ে শরীরের প্রসারণও যে সম্পৃক্ত ছিল সেটা মনে রাখা দরকার। গ্রোটোভ্‌স্কি তাঁর Poor Theatre-এ অভিনেতাদের দিয়ে শারীরিক ভাস্কর্য তৈরি করেছেন, আর এ প্রসঙ্গেই আসে তাঁর 'via negativa' তত্ত্ব। Psychosomatic block গুলিকে পেরিয়ে শরীরের জাগরণ। মনে রাখতে হবে অভিনেতা তাঁর কাছে একজন Marty র (প্রসঙ্গত গ্রোটোভ্‌স্কি অভিধা: Holy Theatre) সমতূল্য। Ritual-এর প্রাসঙ্গিকতায় থিয়েটার হয়ে ওঠে এক আত্মনিবেদী, সীমানা-অতিক্রমকারী (transcending) অনুষ্ঠান। 'ভরে পড়া' সেই অভিনেতা কিন্তু এক নির্দিষ্ট প্রণালী (গ্রোটোভ্‌স্কি অভিনেতা Ryszard Cieslak যাকে বলবেন "score", গ্রোটোভ্‌স্কির ভাষায় "confronting the dramatic text") বেয়ে পৌঁছতে চলেছে এক চরম নাট্য উপলব্ধির দিকে। এই সমস্ত উপাদানগুলিই আমরা চর্চা করেছিলাম কেঁদুলির ওয়ার্কশপে, তবে কোনো নির্দিষ্ট টেক্সট ছাড়া।

কেঁদুলির ওয়ার্কশপ শেষে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম কলকাতার দিকে। সারাটা পথ বাসের উপরের ছাদে গ্রোটোভ্‌স্কির পাশে বসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আর সারা পথ জুড়ে আলোচিত হয়েছিল নানা প্রসঙ্গ। সারা বিশ্বজুড়ে একধরনের নাট্যমাতব্বরিতার সোচ্চার সমালোচনা ছিল গ্রোটোভ্‌স্কির। তাঁর ভাষায় Hitler Jugend। অভিনেতা যে একজন নিবেদিতপ্রাণ, মাতব্বরিতার কোনো জায়গা নেই সেখানে গ্রোটোভ্‌স্কি বারে বারে তা উল্লেখ করেছিলেন। 'Theatre of Sources' - এই আন্তর্জাতিক প্রকল্পরও উল্লেখ শুনি সেখানে। জানতে পারি যে বিভিন্ন দেশের ও সংস্কৃতির থিয়েটারমনস্ক, তাত্ত্বিক, অভিনেতা, সমাজকর্মী সবার সম্মিলনে এক মহাসংগঠনের আয়োজন করতে চলেছেন পোল্যাণ্ডে। ভারতবর্ষ থেকে আমার আমন্ত্রণ আমার পক্ষে এক আশাতিরিক্ত পাওয়া। ভাবতেই পারিনি গ্রোটোভ্‌স্কি সান্নিধ্যে আমার নাট্য (সংস্কৃতি) চর্চার সুযোগ ঘটবে।

উৎসের থিয়েটারকে অনেকেই ভুল করে 'থিয়েটারের উৎস' হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। 'Wandering towards Theatre of Sources'- এ গ্রোটোভ্‌স্কি সবিস্তারে জানিয়েছেন এই সমীকরণ ভুল। এমনকি 'উৎসের থিয়েটার'কে তথাকথিত থিয়েটার এর genre চিহ্নিতকরণ নিয়েও অনেক তর্কবিতর্ক আছে। গ্রোটোভ্‌স্কির উল্লেখে - উৎসের থিয়েটার কী সেটা বলার চাইতেও, আমি বলতে পারি সেটা কী নয় সেই কথা। প্রশ্ন তো থাকবেই - স্বপ্নের যেখানে শেষ, প্রশ্নের শুরু সেখানেই। উৎসের থিয়েটার প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন আবর্তিত হতেই পারে, এটাকে কি থিয়েটার গবেষণারই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে? নাকি এটা শুধুমাত্রই একটা নাম (গ্রোটোভ্‌স্কির ভাষায় code-name), যার বীজ আদতে লুকিয়ে আছে 'থিয়েটার ল্যাবরেটোরিয়াম' -এর (Wrocław, Poland) On The Road to Active Culture' বইয়ে উদ্ধৃত কর্মকাণ্ডে।

এটা নিশ্চিত যে থিয়েটার অব্‌ পার্টিসিপেশন-এর পরবর্তী পদক্ষেপ উৎসের থিয়েটার। সেই হিসেবে নাট্যগবেষণার অঙ্গীভূত হতেই পারে এই বিশেষ প্রকল্পটি। কিন্তু সাধারণ মানসে থিয়েটার বলতেই যে বিশেষ মাধ্যমটি ভেসে ওঠে উৎসের থিয়েটার-এ তার প্রাসঙ্গিকতা অনেক বিস্মৃত। তাই এখানেই গ্রোটোভ্‌স্কি সচেতনভাবে এই প্রশ্ন করতে চেয়েছেন যে শুধু 'থিয়েটার' শব্দটি নিয়ে গতানুগতিক ধারণায় ব্যতিব্যস্ত না থাকতে।

এই প্রসঙ্গেই একটি বিশেষ উদাহরণ দেবার লোভ সামলাতে পারছি না। ১৯৮২ সালে মুক্তি পায় লুই ম্যাল পরিচালিত 'My Dinner with Andre' চলচ্চিত্রটি। চলচ্চিত্রটির বিশেষত্ব এই যে এটি শুধুমাত্র দুজন মানুষের কথোপকথনের উপর তৈরি। একজন আঁদ্রে গ্রেগরি, থিয়েটার নির্দেশক, অভিনেতা আর একজন ওয়ালি শন, নাট্যকার ও অভিনেতা। চলচ্চিত্রটির শুরুতেই আমরা দেখি, আঁদ্রে গ্রেগরি জানাচ্ছেন তাঁর থিয়েটার জীবনের এক বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা। সত্তর সালের মাঝামাঝি যখন তাঁর কাছে গ্রোটোভ্‌স্কি নিয়ে এসেছিলেন একটি 'থিয়েটার ওয়ার্কশপ' নেওয়ার প্রস্তাব, তখন আঁদ্রে ঝটিতি জানিয়েছিলেন তাঁর চিন্তাভাবনা। আঁদ্রের ভাষায় 'আমি আর গ্রোটোভ্‌স্কি ফিফ্‌থ অ্যাভেন্যু ধরে হাঁটছি, হঠাৎই গ্রোটোভ্‌স্কি উল্লেখ করলেন একটা ওয়ার্কশপ করো না কেন? আঁদ্রে উত্তর দিলেন করতে পারি। তবে তার জন্য আমার দরকার ৪০ জন ইহুদী রমণী যারা কেউই ইংরেজি অথবা ফরাসী জানেনা, এবং তারা দীর্ঘদিন যাবৎ নাট্যশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কিন্তু থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসতে চায় যদিও তার কারণ জানে না, অথবা সেই সব যুবতী অভিনেত্রীরা থিয়েটারকে ভালোবাসে আবাল্য প্রাণপণ কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো থিয়েটার দেখেনি, যা তাদের ভালো লেগেছে আর সেইসব অভিনেত্রীরা যদি ট্রাম্পেট্‌ বা হার্প বাজাতে পারে, আর আমি কোনো বনে বা অরণ্যে ওয়ার্কশপ করতে পারি, তবেই আমি যাব পোল্যাণ্ডে ওয়ার্কশপ করতে। আঁদ্রে অবশ্য পরে এক মাস ধরে করেছিলেন ওয়ার্কশপ পোল্যাণ্ডের বনে, কিন্তু সে অন্য কাহিনি।

কিন্তু মুখ্য ব্যাপার হচ্ছে যে, এই যে থিয়েটার নামক মাধ্যমটিকে conditioning করা, তার নিহিত জীবনশক্তিকে যাচাই করা, জীবন ও থিয়েটারকে সমান্তরাল যাত্রাপথে ফেলে তার উপাদানগুলি একে অন্যের পরিপূরক করা, আদিজন গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে থিয়েটারী উদ্ভাস নিয়ে কাজ করা, এসব কিছুই সত্তরের দশকে ইওরোপ - আমেরিকায় বিস্তার লাভ করে, যার মূল নিহিত আছে গ্রোটোভ্‌স্কির প্যারা থিয়েটার (Para Theatre) কর্মকাণ্ডে।

উৎসের থিয়েটার প্যারা থিয়েটারের সীমানাকে আরও বাড়িয়ে দিল। প্যারা থিয়েটার মূলত ছিল একই জনগোষ্ঠীর উদ্ভুত আচার। উৎসের থিয়েটার সেখানে আন্তর্জাতিক 'Trans-Cultural Programme'। বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ এই প্রকল্পে অংশগ্রহণ করেছে, কিন্তু কোনো বিশেষ একটি ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে নয়। যেমন একটি উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যায়, যেটি গ্রোটোভ্‌স্কি ১৯৮১ সালে টরোন্টোয় ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ব্যবহার করেছিলেন। ভুলভাবে যাতে ব্যাখ্যাত না হয়, তার জন্যই আমি গ্রোটোভ্‌স্কির ভাষা ব্যবহার করব। হয়তো উদ্ধৃতিটা একটু লম্বা, কিন্তু জরুরী: In the group of the Theatre of Sources each participant is allied to a technique of sources close to him, traditional for him. But this is not shared. That is very important. Though a colleague of mine is a Japanese Buddhist priest, he is neverthless not doing something that is of his religion. He knows that is not part of the Theatre of Sources. He is studying Zen Buddhism but he knows that he won't be doing sitting meditation with anyone of the others in the group. He has a very full life and also practises the Zen martial arts. He is a very good teacher of this, a specialist, but he never proposed to any of us to work with him on it. We don't share the technique of sources. There is a Latin American Indian who has been with us for a long time. We began working with him long before the name Theatre of Sources was used. There is also an Indian Brahmin (bhakta). He is deeply rooted in his own traditions but is also keenly aware of the contemporary world. The three of them, the Latin American Indian, the Brahmin and the Japanese man work together but they do nothing that belongs to only one tradition. They look for a simple action, evident in its consequence for all three. That means it works for all three without any difference of cultural context.

এই 'simple action'ই পরে 'impermeable' (অভেদ্য) হিসেবে অভিহিত হয়েছে গ্রোটোভ্‌স্কি অভিধায়। এই হিসেবে উৎসের থিয়েটারকে কেউ যদি পরিশোধন প্রক্রিয়া (filtration process) হিসেবে দেখতে চান, তবে সে হিসেবেও ভাবা যায়। কিন্তু সেটা কোনো শৈল্পিক (artistic) প্রক্রিয়া নয়, বরঞ্চ থিয়েটারের যে সব উপাদান অপরিহার্য - অভিনেতা, তার শরীর, তার স্বর, তার সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো এই সমস্ত কিছুর মৌল উপাদান নিয়ে কাজই উৎসের থিয়েটার করতে চেয়েছে। পরিশোধন প্রক্রিয়ার চেয়েও জরুরী এখানে আদ্যাশক্তি। আদিম উপাদানের ব্যবহার। প্রকৃতির তাই এক জরুরী অবস্থান - এই উৎসের থিয়েটারে। আর ছিল নৈঃশব্দ। শব্দেরনিহিত উপাদান খুঁজে বের করার জন্যই অনর্থক শব্দের অপচয় কাম্য নয়। উৎসের থিয়েটারে তাই একটি মূল শর্ত ছিল নৈঃশব্দ। প্রয়োজন ছাড়া উচ্চারিত শব্দ সেখানে অনুপস্থিত। তবে মনে রাখতে হবে, এই প্রকৃতির প্রেক্ষিতে যা ঘটছে, তা কিন্তু আত্ম / একাত্ম প্রকাশ। পরে এই উদ্ঘাটন যাতে প্রকৃতি-নিরপেক্ষভাবে করা যায়, তার জন্য একই 'অ্যাকশন' (প্রতিটি অনুষ্ঠানের এই নাম ছিল উৎসের থিয়েটারে) আমরা চেষ্টা করেছি বদ্ধ পরিবেশে করতে।

আর একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে আমি এইবারের মতো এই প্রসঙ্গে আলোচনা শেষ করব। উৎসের থিয়েটারকে এক হিসেবে কোনো শৈল্পিক উদ্যম (artistic project) হিসেবে নিলে একটু ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে। আমি আগেই বলেছি। থিয়েটার শব্দটি এর সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এটির সঙ্গে সর্বদাই থিয়েটারের সাধারণ আঙ্গিকগত সম্পর্ক খুঁজলে ভুল করার সম্ভাবনা। যে কারণে উৎসের থিয়েটারে যোগদানের ব্যাপারে দেখি বিভিন্ন প্রকাশমাধ্যমের শিল্পী, বিভিন্ন পেশার লোক এবং তারা অবশ্যই বিভিন্ন দেশের। আর এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় শৈল্পিক উদ্যম এবং জৈবিক উদ্যম-এর প্রসঙ্গ।

উৎসের থিয়েটারের লক্ষ্য জৈবিক প্রক্রিয়া। আর এই জৈবিক প্রক্রিয়া 'প্র্যাগ্‌মাটিক', শুধু তাত্ত্বিক আলোচনা দিয়ে এর মর্মে প্রবেশ করা যাবে না। এতে সবার অংশীদারি সমান, শুধুমাত্র দরকার de-conditioning। একজন শিল্পী যখন কিছু নির্মাণ করেন তখন তাঁর 'pre-condition' হিসেবে কাজ করে শৈল্পিক শর্তাবলী। এই শর্তগুলি অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর নিজস্ব উপলব্ধির জগতে পৌঁছাতে। অর্থাৎ শিল্পের কাজ কখন কখনও হয়ে দাঁড়ায় কৃত্রিম, শিল্পীর নিজের কাছে এবং তিনি যা নির্মাণ করতে চাইছেন তা আর খাঁটি (authentic) থাকে না। (আমি এখানে অথেন্‌টিক বলতে কেবল ইতিহাসগত বা তথ্যের হিসেবে বোঝাতে চাইছি না।) আমরা সেই নির্মাণকার্য মেনে নিতে পারিনা।

এটা ঠিক সব শিল্পেরই কিছু শর্ত থাকে এবং সেটা মানা জরুরী। কিন্তু যিনি শিল্পী তার নিজস্ব প্রস্তুতি আরও জরুরী। অর্গ্যানিক বা জৈবিক পদ্ধতিতে শিল্পী নিজের সঙ্গে কাজ করবেন এবং শেষ পর্যায়ে ফুটে উঠবে কোনো শিল্পের উদ্ভাস। এবং তখন বিভিন্ন শিল্প আঙ্গিকের নিয়ম মেনে তৈরী করা যেতে পারে বিভিন্ন মাধ্যমের বিভিন্ন শিল্প। কিন্তু এর গোড়ায় রয়েছে অথেন্‌টিসিটি, একেবারেই নিজেকে বা নিজের জীবনে চারপাশকে বাজি রেখে প্রশ্ন করে উপলব্ধির তাগিদ নিয়ে এই সব নির্মাণ। উৎসের থিয়েটারের কার্যকাল ছয় বছর (১৯৭৬-১৯৮২)। এর পরবর্তী প্রকল্প হিসেবে গ্রোটোভ্‌স্কি বেছে নিয়েছিলেন 'Objective Drama' এবং 'Art as a Vehicle' - যেখানে শিল্প নিজেই নিজের চালকশক্তি হয়ে ওঠে, জীবন থেকে ধার করা নয় বা জীবনের কৃত্রিম দর্পণমাত্র নয়।



(পরবাস-৪৯, অক্টোবর, ২০১১)