ইতিহাস ও কথাসাহিত্যকে পৃথক করার আগ্রহ অনেকদিনের, কিন্তু এই সীমানা রক্ষা ভঙ্গুর হওয়াই ছিল অনিবার্য। কারণ এ দুটোরই অন্বিষ্ট বাস্তব জীবন, যার মধ্যে আছে বিশেষ ও নির্বিশেষ। যেমন ধরা যাক ওয়াটারলুর যুদ্ধ, ফরাসী ঔপন্যাসিক স্তাঁদাল যা ব্যবহার করেছিলেন তাঁর উপন্যাস The Charterhouse of Parma (1839) তে, নায়ক ফাব্রিস্-কে কেন্দ্রে রেখে। কখনো ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ব্যক্তি হয়ে ওঠে উপন্যাসের প্রধান, কখনো একটা কাল ছড়িয়ে পড়ে উপন্যাসের পরিসরে। এইভাবে আমাদের নান্দনিক অভিজ্ঞতা constitutes a common culture, automatically including us in a historical community of shared values.[১] মার্ক্সের কাছে অতীত-অনুধাবন ঘটনা পরম্পরাকে কিভাবে রাখা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর বলে মনে হয়েছিল।[২] ইতিহাসকে যখন সাহিত্যে প্রত্যক্ষতঃ ব্যবহার করা হয় তখন পাঠক শনাক্ত করেন limited perspectives এবং partial interests যা বিবরণকে করে তুলবে tendentious. যাঁরা সাংস্কৃতিক বস্তুবাদী তাঁরা জোর দেন চারটি বিষয়ে—ইতিহাসের context-কে উন্মোচনে, তত্ত্বপ্রণালী প্রয়োগে, রাজনৈতিক দায়বদ্ধতায়, পাঠ্যবিশ্লেষণে যুক্তি সাজানোয়। আর যাঁরা সাহিত্যের সমাজতত্ত্বে আগ্রহী তাঁরা লক্ষ্য রাখেন সাহিত্যের সমাজতত্ত্বীয় সচেতনতায়, সাহিত্যকে সমাজতত্ত্ব হিসাবে ব্যবহার বিষয়ে, উদ্দিষ্ট সাহিত্যের কেন্দ্রীয় সমস্যার সামাজিক উত্থান প্রসঙ্গে। তাঁরা সাহিত্যকে বুঝতে চান সামাজিক উৎপাদন এবং সামাজিক force হিসাবে, সাহিত্য সমাজবিকাশের প্রক্রিয়ায় কিভাবে সমাজে প্রভাব বিস্তার করছে সেই দিকে।[৩] এইখানে বলে নিই, কখনো ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ব্যক্তি হয়ে ওঠে উপন্যাসের প্রধান, কখনো একটি কাল ছড়িয়ে পড়ে উপন্যাসের আকাশে। প্রথমটির উদাহরণ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'শাহাজাদা দারাশুকো' এবং দ্বিতীয়টির উদাহরণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সেই সময়'।
রাঙ্কে মন্তব্য করেন, ঐতিহাসিকের কর্তব্য আসলে কালটা কি রকম ছিল তা-ই দেখানো। সেখানে তথ্য সংগ্রহ, তথ্য নির্বাচন, তথ্য পরিবেশন, তথ্য ব্যাখ্যান ঐতিহাসিকের মানসিকতারই পরিচয় দেয়। ঔপন্যাসিকের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। তিনি কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার কোন্ তথ্য জোগাড় করছেন, কোন্টা পরিবেশন করছেন, কিভাবে ব্যাখ্যা করছেন তার ভিত্তিতে পাঠকের কাছে ইতিহাস হাজির হয়, ঔপন্যাসিকের মানসিকতাও বোঝা যায়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস পাঠ করার ক্ষেত্রেও এই কথাগুলি আসে। লেখক কোন্ কোন্ তথ্যে গুরুত্ব দিচ্ছেন, কোথায় দিচ্ছেন না, তাতে ইতিহাস চিত্র আলাদা হয়ে যায়।
আর একটি কথা। ক্রোচে বলেছিলেন—সব ইতিহাসই সমসাময়িক ইতিহাস।[৪] এই দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ কেউ তারাশঙ্করের রাধা, অরণ্যবহ্নি প্রভৃতি উপন্যাসের বিচারে প্রবৃত্ত হয়েছেন। ক্রোচের এই মন্তব্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ই.এইচ. কার বলেছেন—'ইতিহাস মূলতঃ বর্তমানের চোখ দিয়ে ও তারই সমস্যার নিরিখে অতীতকে দেখা আর ঐতিহাসিকের আসল কাজ নথিকরণ নয়, বরং মূল্যায়ন।'[৫]
এইসব কথার অবতারণা করতে হল, কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক পশ্চিমবঙ্গের দুটি উপন্যাস নিয়ে কিছু কথা বলব আমরা। মুক্তিযুদ্ধ একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা উপমহাদেশের ক্ষেত্রে। এর মূল্যায়ন নিয়ে দুই বঙ্গেই কিছু মতপার্থক্য রয়েছে, নানা ধরনের sentiment কাজ করে যায়। আর ঘটনাটি নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক, তাই ইতিহাসের উপস্থাপনই অন্বিষ্ট। আমরা প্লট, ভাষা, দৃষ্টিকোণ, প্রেক্ষণ ইত্যাদি আঙ্গিকগত দিকগুলিকে একেবারেই প্রাধান্য দেব না।
এক বিদেশী ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছিলেন—'The Liberation War of 1971 was the delta's third big shock of the twentieth century.'[৬] শেণ্ডেল পূর্ববর্তী দুটি ধাক্কা হিসেবে ১৯৪৩-৪৪ এর দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৪৭ এর দেশভাগকে চিহ্নিত করেছিলেন। সঙ্গত ভাবেই ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে multilayered story বলেছিলেন। এ কাহিনীর মূল ব্যাপারটি হল—পাকিস্তানী সশস্ত্র সৈন্যদের সঙ্গে পূর্ব বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের সশস্ত্র সংগ্রাম। কিন্তু জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে আরো অনেক ব্যাপার—কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর শিকার হয়ে পড়া (নারী, হিন্দু, ethnic minorities), অঞ্চল বিশেষের সমস্যা, ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থ, বিভিন্ন বর্ণের জাতীয়তাবাদীদের পারস্পরিক সম্পর্ক, হিংসা ও ধ্বংসের আঞ্চলিক ফারাক, জনতার স্থানান্তকরণ, ব্যক্তিক শৌর্য ও আত্মাহুতির সহস্র কাহিনী। এর সঙ্গে জড়িত ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব, এবং শীতলযুদ্ধের বৃহৎ শক্তিগুলির দ্বন্দ্ব। এ মন্তব্যও আমার নয়, পূর্বোক্ত শেণ্ডেল-এর।
বলা বাহুল্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে যে ব্যাপক অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, অনেক অনবদ্য উপন্যাস, ছোট গল্প রচিত হয়েছে তা পশ্চিমবঙ্গে আশা করা যায় না। কারণ, ঐতিহাসিক এ ঘটনার আনন্দ ও দুঃখ বাংলাদেশী সমাজজীবনে যে প্রত্যক্ষতা ও তীব্র উদ্বেলতার সৃষ্টি করেছে তা তো পশ্চিমবঙ্গে ঘটে নি। তবু দু দেশের ভাষা এক, শরণার্থীসূত্রে দুয়ের মধ্যকার সম্পর্ক উদ্বেল, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা এবং নস্টালজিয়া—এ সব তো আছেই। আর, বিবেকবান কথাসাহিত্যিক অনেক সময়ই তার কালের ও স্বদেশের সীমানা অতিক্রম করে যান, বিদেশে এর প্রচুর উদাহরণ আছে, স্বদেশেও যে একেবারে নেই তা নয়। আপাততঃ আমরা আলোচ্য করছি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'একটি কালো মেয়ের কথা' (১৩৭৮) এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'পূর্ব-পশ্চিম' (১৩৯৬), এই দুটি উপন্যাস।
তারাশঙ্করের এই ছোট উপন্যাসটির মুখ্য বিষয়টি কি? পূর্ববাংলা থেকে পালিয়ে আসতে থাকা লক্ষ মানুষের একজন ডেভিড বা মনসুর সীমান্ত অতিক্রম কালে ধরা পড়ে। কয়েকজন উৎসাহী তরুণ তাকে গুপ্তচর সন্দেহে ধরে এনে পুলিশের হাতে দেয়। সঙ্গে একটি রুগ্ন কালো মেয়ে (নাজমা)। জিজ্ঞাসাবাদের সময় মার খেয়েও লোকটা চিৎকার করে বলতে থাকে সে গুপ্তচর নয়। ধর্মে সে ক্রিশ্চান, তালতলায় বর্ধিত, বাবা ছিল রেলের ইয়ার্ড অফিসার, মা নার্স। ডেভিড পশ্চিম পাকিস্তানে অনেকদিন থেকেছে, ভালো উর্দু জানে, পূর্ব পাকিস্তানে ও দশ বছর। বাল্যাবধি তার ঝোঁক ছিল গান ও বিদ্যুতের কাজে। নয় বছর এক বড় ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার্স ফার্মে (১৯৫২-৬২) কাজ করেছে। চরিত্রটিকে তারাশঙ্কর সচেতনভাবে বহুগুণান্বিত, বহু দেশস্থ করে তোলেন। তার জবানবন্দী থেকে জানা যায় পূর্ব পাকিস্তানে আয়ুব খাঁর নিয়ন্ত্রণ ও সেখানে পশ্চিম পাক ব্যবসায়ীদের আগমন, দেশটা বহু আরাম ও মজা লুটবার দেশ (পৃ. ৬০-৬১)। সে ঢাকা যশোর রাজশাহী রংপুর কুমিল্লায় ছিল ৮ মাস। ঢাকায় বিয়ে হয় ছায়ার সঙ্গে, যে ছিল অবিভক্ত পার্টিতে ভাসানীর চীনা পন্থীদের সঙ্গে (পৃ. ৭০), ভাসানী, ছায়া সংগৃহীত গানের খাতা ছাপিয়ে দেবেন বলেছিলেন। ডেভিডের ভাসানী ও মুজিব দুজনকেই ভালো লাগে। ইতিহাসের আর যেসব কথা আছে তা হল ৬৪তে পূর্ববাংলায় বাংলাভাষার দাবি, সুয়েজ খালের ঝগড়া, মুজিব প্রসঙ্গ, পুরোনো পল্টনে শ্রমিক ফেডারেশনের মিটিং, বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ, ভুট্টোর ঘাড় হেঁট করে ফিরে যাওয়া (পৃ. ৭৫), লীগের পাণ্ডারা, জামাতে উলেমার দালালরা চারদিকে (পৃ. ৯১), আওয়ামি লীগ-পন্থীদের কোতলের প্রস্তুতি, রাজশাহীতে জামাতের পাণ্ডারা। ডেভিড মুজিবকে দেখল ঢাকায়, উনি বাংলা ভাষার কথা বললেন। আছে দেশে মার্শাল ল জারি, টিক্কা খাঁর কথা, মুজিব নগরে বাংলাদেশ গভর্ণমেন্ট তৈরির (পৃ. ৯০) কথা। তারাশঙ্কর রাজনীতি, বিভেদ, ইত্যাদিকে বেশী আনেন নি, কিছু ভুল তথ্যও আছে। যেমন—গুজবে টিক্কা খাঁর মৃত্যুর কথা, প্রকৃতপক্ষে ২৫ মার্চ, ৭১ অপারেশন সার্চলাইটের নায়ক, বাঙলার ঘাতক আখ্যার পর সেপ্টেম্বরে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে এনে ভুট্টো কর্তৃক ১৯৭২-এ আর্মি চিফ করে দেওয়া হয়, ১৯৮৮-এ করা হয় পাঞ্জাবের গভর্নর। আছে নির্বাচনে আসানুল্লার জয়, বাংলাদেশের পতাকা ওড়া, কলকাতা রেডিয়োর খবর (পৃ. ৯৩)। অন্যদিকে প্রাধান্য পায় ২৫ ও ২৬ মার্চ নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা, রাইফেল মেশিনগানের শব্দ, আওয়ামী লিগের 'দিগন্ত' কাগজের অফিস পোড়ানো, আগুন, ঢাকার আশ্চর্য চেহারার কথা। '২৫শে বিকেল বেলা থেকেই সারা ঢাকা শহর একেবারে আগুন দেওয়া বোমাবাজির মত পলতেতে জ্বলতে জ্বলতে বোমটার দিকে এগুচ্ছে। শোনা গেছে চট্টগ্রাম নাকি জ্বলছে। এখানে প্রেসিডেন্ট খান সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ সাহেবের কথা হচ্ছে। চব্বিশ দিন ধরে অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলছে। আশ্চর্য সে আন্দোলন! একটা দুর্দান্ত প্রচণ্ড বলশালী জন্তু যেন পঙ্গু পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে। ..... ঢাকার সে এক আশ্চর্য চেহারা।' (পৃ. ৭৪-৭৫) (১৬-২৩ মার্চ, ১৯৭১ ইয়াহিয়া মুজিব আলোচনা ব্যর্থ হয়, ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে পাক জাতীয় পতাকার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালত সহ সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন হয়। ২৬ মার্চ পাকিস্তান বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারাশঙ্কর হয়তো এই সময়টার কথা বলেছেন।) পাচ্ছি সরকারী বিল্ডিং এ মিলিটারি পাহারা, ট্রাক, বোমা, রাইফেল, গুলি, মার, লুঠের কথা (পৃ. ৮০), সারা দেশ মার খেয়ে মুহ্যমান। তারাশঙ্কর অবশ্য আওয়ামি লিগের সদস্যদের প্রতিরোধ প্রস্তুতির কথা বলেছেন (পৃ. ৮৫), হাজি ও অন্য পুরুষরা পাল্টা লড়াই দিচ্ছে, আওয়ামি লিগের ঝাণ্ডা উঁচু করা হাজি সাহেবকে খুঁজছে পাক সৈন্যরা। মুসলিম লিগ জামাতে ইসলামের সমর্থকদের পৃষ্ঠপোষক ব্যবসায়ী জাফরউল্লা খাঁকে গুলি করে মারেন হাজিসাহেব, বাংলাদেশের ঝাণ্ডা ওড়ানো হয়। (পৃ. ১১১) হাজিসাহেব ও তার ছেলেদের লড়াই দেবার কথায় telling আছে, showing কম। ডেভিড মুক্তিযোদ্ধা নয়, রাজনৈতিক ভাবে সম্পৃক্ত নয়। ভাসানী বা মুজিবের উল্লেখ আছে কিন্তু তাদের রাজনৈতিকতা নেই, চরিত্রায়ন-ও নেই।
শিল্প বিচারে বড়ো ত্রুটি—দীর্ঘ জবানবন্দী এবং ধৈর্য ও সহানুভূতির সঙ্গে সেনাপতির শোনা—যেন গল্প বলার জন্য, এটা অবাস্তব। ডেভিডকে ধর্মনিরপেক্ষ বানানোর চেষ্টা আছে। তবে ৭১ এর আবহ অনেকটা এসেছে। ইতিহাসকে তিনি খানিকটা বুঝে নিয়েছেন, বিশ্লেষণের গভীরে যান নি।
'রাধা' উপন্যাসের সময় থেকেই ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাসে তিনি ব্রতী, বাংলাদেশে খান সেনাদের অত্যাচার এবং পশ্চিমবঙ্গের অস্থির আবহকে ধরতে চেয়েছেন, হিন্দুমুসলমান হানাহানি নিয়ে লিখেছেন। তাঁর প্রবণতা হিন্দুমুসলমান সমন্বয়ের দিকে। ইতিহাসে তারাশঙ্কর আগ্রহী, তবে দলিল ও জটিল টানাপোড়েনে নয়, বরং স্মৃতির ইতিহাসে, কথকের উচ্চারণে উত্থাপনে আগ্রহী। 'অরণ্যবহ্নি' এই সায়াহ্ন পর্বের সার্থক নিদর্শন, 'রাধা'য় যার সূচনা। পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকেই তারাশঙ্কর এক বিনষ্টির অন্ধকারে বর্তমানের চলে যাওয়ায় বেদনার্ত। [৭] একটি কালো মেয়ে ধর্ষিতা হয়, যা উপন্যাসে নাজমা, প্রথমে ও শেষে এই কালো মেয়ের কথা। যদি প্রতীকী অর্থে দেখি তাহলে বাংলাদেশ ধর্ষিত—এ অর্থও হতে পারে। বিখ্যাত সাংবাদিক Anthony Mascarenhas এর The Rape of Bangladesh নামক বিখ্যাত বইটির কথা মনে পড়ে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'পূর্ব-পশ্চিম' উপন্যাসটির এলাকা বিরাট, তার সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ভূগোল অনেক ব্যাপ্ত, অনেক জটিল সমস্যা সেখানে ভিড় করে আছে। তার মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটা বড়ো স্থান পেয়েছে। সুনীল এক সাক্ষাৎকারে বলছেন—'পূর্ব-পশ্চিম লেখার সময় আমার মাথায় ছিল দেশভাগ এবং দুদিকের বাঙালিরা। তারা যে ভাগ হয়ে গেছে এটা। এইটা একটা পূর্ব-পশ্চিম, আরেকটা পূর্ব-পশ্চিম হচ্ছে ১৯৬০ থেকে ৭০-এর দশকে শুরু হল। এদেশের যারা ভাল ভাল ছেলে মেয়ে তারা সব পশ্চিমে চলে যেতে লাগল, বাবা মাকে ফেলে। সেখানেও একটা পূর্ব-পশ্চিম ভাগ হয়ে যায়। এটাই ছিল থিম।'[৮] বাঙলা উপন্যাসের একালীন পাঠক মাত্রেই জানেন, সুনীলের কথাসাহিত্য রচনা পরম্পরায় ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত আশির দশক থেকে—সেই সময়, পূর্ব-পশ্চিম, প্রথম আলো—যে তিনটি উপন্যাস এ ব্যাপারে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। 'সেই সময়' ২ খণ্ডে তিনি উনবিংশ শতাব্দীর মধ্য পর্যায়কে ধরেন যা নবযুগ নামে খ্যাত। এ উপন্যাসে, লেখকের কথায় 'মূল নায়কের নাম সময়।' এ প্রবন্ধের শুরুতে লেখকের / ঐতিহাসিকের নিজস্ব ব্যাখ্যানের কথা বলেছিলাম। সুনীল-ও বলছেন—নবীনকুমার চরিত্রায়নে তিনি অনেক স্বকল্পিত উপাদান সংযোজন করেছেন, যা নিয়ে মতভেদ হতে পারে। 'সেই সময় সম্পর্কে যদি আমার নিজস্ব কিছু ব্যাখ্যা দিতে চাইব, তা হলে আর আমি এত বড় একটি গ্রন্থ রচনা করলাম কেন?' 'পূর্ব-পশ্চিম' উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের শেষে সুনীল বলছেন—'এই উপন্যাসের পশ্চাৎপটে আছে সমসাময়িক ইতিহাস, বেশ কিছু রাজনৈতিক পালাবদল, কিছু আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে উপস্থিত করা হয়েছে সরাসরি।' অনেক পত্র-পত্রিকা ও গ্রন্থ এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করেছে। ইতিহাসের সত্য যে কল্পনার লীলাভূমির অন্তরালে কিভাবে কাজ করে যায় সে প্রসঙ্গে তিনি অন্যান্য প্রসঙ্গের বইপত্রের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গের অনেকগুলি বইয়ের নামোল্লেখ করেছেন। এইভাবে ঢুকে পড়েছে পাঠকের aesthetic experience এর মধ্যে এক historical community.
'পূর্ব-পশ্চিম' ২খণ্ডে বিন্যস্ত ১৩৭৮ পৃষ্ঠার উপন্যাস, যার কালসীমানা ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭, উপন্যাসের চলিষ্ণুতায় তা ১৯৩৭ এ গেছে ৫২ ও ৭৫ এর মধ্যবর্তিতা যুক্ত হয়েছে। মামুন, প্রতাপ ও বিমানবিহারীর পরিবার পরিজন, তারা নিজেরা উপন্যাসে বড় ভূমিকা নিলেও গৌণ চরিত্রের সংখ্যা কম নয়। প্রথম খণ্ডে যেমন কলকাতার উনিশ ও বিশ শতকের সমাজগঠনের কথা আছে তেমনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ফাটল, জেনারেল গোলাম মহম্মদ ও ফজলুল হকের বৈরিতা, চল্লিশের শেষে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর পশ্চিমবঙ্গে আগমন, প্রতাপ ও মামুনের কলকাতার ছাত্রজীবন, হোস্টেল, অধ্যাপকবৃন্দ, কবিতা সম্পর্কে তৎকালীন তরুণদের মনোভাব, কবিগুরুকে প্রণাম করে আসার ভাবনা, মালখান নগরের গাছগাছালি, অট্টালিকা, পারিপার্শ্বিকতা, ত্রিকুট পাহাড়ে প্রতাপদের সপরিবার বেড়াতে যাওয়া, তার মুন্সেফগিরি, মামুনের মাদারিপুরের বাড়ি, জীবনানন্দ পাঠ, বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ, রাজনৈতিকতায় মামুনের আগ্রহ, দিলীপ গুপ্তের সিগনেট প্রেস, বঙ্কুবিহারীর ইংরেজ স্ত্রীর ভারতপ্রেম ও ইয়েটস ভক্তি, মোতাহার হোসেন, শহীদুল্লা, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ, নজরুল, কল্লোল, আবদুল ওদুদ, মামুন ও প্রতাপের কমন প্রেম, সাংসারিকতা, দিনকাল পত্রিকায় সম্পাদকত্ব, কারাবাস প্রভৃতি নানা ঘটনা পরম্পরায় এই দুটি চরিত্রের গড়ে ওঠা দেখানো হয়। ১ম খণ্ডে স্বদেশ বৃত্তান্ত (পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ) ২য় খণ্ডে য়ুরোপ ভূখণ্ড বড়ো হয়ে ওঠে। আর জড়িয়ে থাকে নকশাল পর্ব ও মুক্তিযুদ্ধ।
উপন্যাসে প্রতিফলিত ইতিহাসের বড়ো সময়টুকুকে দেখা। (এ প্রবন্ধে নকশাল কাণ্ড বাদ দিচ্ছি।) ১ম খণ্ডে সুনীল জানান ১৯৩৭ সালে বাংলাদেশে মুসলমানদের মধ্যে নতুন আশা ও উদ্দীপনার জোয়ার আসে নির্বাচন কেন্দ্র করে। পঞ্চাশের দাঙ্গা, ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে-র পর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী প্রসঙ্গ। ভাসানী বেরিয়ে আসছেন আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে (১৯৫৭) গড়ছেন ন্যাপ, হয়ে উঠছেন ইসলামিক বামপন্থীদের মুখ্য আদর্শ। (পৃ. ১৪৫, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭৬, পৃ. ৩৪৫, ৩৮৯) আলতাফ ও মামুন ভাসানীর দলে জড়িয়ে যায়, ভাসানীর কাগমারি সম্মেলনের বক্তৃতায় মার্কিন সমর জোট ও সোরাবর্দীকে আক্রমণ (পৃ. ২২৫) এরপর আসছে ১৯৫৮-র ৭ অক্টোবর, কণ্ঠরোধ সামরিক আইন (পৃ. ৩১৫,৩৪১), আয়ুব সংবিধান। জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (পৃ. ৩৪২), আয়ুব কর্তৃক নির্বাচনের দিন ঘোষণা (পৃ. ৪৬৬)। বাবুলের দৃষ্টিতে শেখ মুজিব—একসময় ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দির যুগল ছত্রছায়ায় 'তাঁর চেহারা ছিল বেশি প্রশ্রয় পাওয়া ধনী ব্যক্তির নাতির মতন। এখন তাঁর কণ্ঠস্বরে পৃথক ব্যক্তিত্ব।' (পৃ. ৪৭৫) বাবুল কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক, মঞ্জুর স্বামী, মামুন মঞ্জুর মামা। বাবুল রাজনীতিতে জড়িয়ে যায়। নির্বাচনে ফতেমা জিন্নার পরাজয়, আইয়ুবের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় রাষ্ট্রপতিত্ব। এ ঘটনা ১৯৬৫-র ২ জানুয়ারী। ঢাকা শহরে ধরপাকড়, আওয়ামি নেতারা গ্রেপ্তার, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি, গভর্নর মোনেমের প্রতিবেদন, আইয়ুবের লাইসেন্স বিতরণ, ছাত্র ধর্মঘট, মুজিবের গ্রেপ্তার (পৃ. ৬১১), তার ৬ দফা প্রস্তাব (পৃ. ৬৪৭) ইত্তেফাক ও নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বন্ধ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে প্রথম খণ্ড শেষ। ২য় খণ্ডের শুরুতে পুনরায় ইয়াহিয়ার নির্বাচন ঘোষণা, ছাত্রদের স্বাধীন বাংলা ঘোষণা, স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ, স্বাধীন বাংলা শ্রমিক পরিষদ, ছাত্রদের ১১ দফা, (একটু পিছিয়ে) ছাত্রলিগের জঙ্গী বাহিনী, ইয়াহিয়ার পলায়ন, ভুট্টোর পলায়ন প্রসঙ্গ আছে। ফাঁকে ফাঁকে গুলি, ট্যাঙ্ক, হত্যা, (সমান্তরালে নকশাল প্রসঙ্গ), মুক্তিবাহিনীর জয়, বীরত্ব, কুমিল্লার ঘটনা, পাক সৈন্যদের এগিয়ে আসা, আওয়ামী নেতা এবং পূর্ব পাকিস্তান বুদ্ধিজীবী অধ্যাপকদের কলকাতায় আশ্রয়—এসব আছে। মুজিবনগর ও সরকার গঠনের কথা, যাতে সবাই আওয়ামী লিগের (পৃ. ৮৮)। কলকাতার থিয়েটার রোডে মুজিবনগর, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের এক বাড়িতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, যে বাড়িটা ছিল মুজিব সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের দফতর, বেলাল মহাম্মদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বেতার কর্মীদের অভ্যর্থনা, (যারা বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন, মেজর জিয়াউর রহমান মুজিবের নামে স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপনের বাণী ঘোষণা করেন) ২৭৯ ও ৩৩১ পৃষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধ সেনানীদের গোপন বৈঠক মুজিবনগরে, মুক্তিবাহিনির কথা, পশ্চিমবাংলার মানুষের প্রতিক্রিয়া, ভারত সরকারের স্বীকৃতি (পৃ. ৩৩১-৪৭১) প্রধান পরম্পরা কিছুই বাদ দেন নি। লেখক বিশদ বলেছেন—'ভারতের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশ বাহিনী। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ বাহিনী অনেকটা সংগঠিত হয়েছে, রয়েছে কে-ফোর্স, এস-ফোর্স আর জেড-ফোর্স নামে তিনটি বিগ্রেড। ৯টি সেক্টরে ২০ হাজার সশস্ত্র বাঙালী সৈনিক। এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত এক লাখ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা।' (পৃ. ৪৬৯) এবং পাক নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে 'ভারতীয় টাস্ক ফোর্সের বিমানবাহী জাহাজ, ডেস্ট্রয়ার ও ফ্রিগেট। ১৪টি সী হক, ২টি সী কিং, ২টি সাবমেরিন, একটি মাইন সুইপার।' (পৃ. ৪৬৮) এবং 'ঝিনাইদহে প্রচণ্ড লড়াইয়ে ভারতীয়পক্ষ খুব মার খাচ্ছে।' (পৃ. ৪৬৯) এবং যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী করতে চায় নি ভারত, তাতে নানা সমালোচনা হবে, ভারতকে বলা হবে পররাজ্য আক্রমণকারী। তাই ভারত সিদ্ধান্ত নেয় যুদ্ধ শেষ করতে হবে 'ঝড়ের বেগে', নিযুক্ত হবে 'সর্বশক্তি'। (পৃ. ৪৭০) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা নিয়ে শঙ্কর ঘোষ এর 'হস্তান্তর' সালাম আজাদের Contribution of India in the war of liberation of Bangladesh ছাড়াও অসংখ্য পত্র পত্রিকায়, বাংলা ও ইংরাজিতে অনেক লেখালিখি হয়েছে। সুনীল যেহেতু উপন্যাস লিখছেন তাই সামান্যই ব্যবহার করেছেন, যদিও ইতিহাস-চেতনা তাঁর যথেষ্ট। ২য় খণ্ডে আছে গভর্নর মোনেম খান খুনের কথা (পৃ. ৩৭৭), মুজিব খুনের কথা (পৃ. ৫৬৯-৭০) একটি নিপুণ অনুচ্ছেদে ২য় মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। জেলে তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম নিহত হবার কথা আছে (পৃ. ৫৭১), কারা এর জন্য দায়ী? তারা 'ক্ষমতালোভী'। পরবর্তীকালে এ ব্যাপারটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। মনে পড়ছে জাহানারা ইমাম গঠন করেছিলেন a public people's court as a symbolic condemnation of war criminals and collaborators in 1992. আরও বই আছে। সুনীল উল্লেখ করেছেন—মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' বইটি। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, গোবিন্দ দেব, মনিরুজ্জামান হত্যা, সাংবাদিক অধ্যাপক ছাত্র হত্যা, এফ. আর. খান, শরাফত আলী হত্যার (পৃ. ১২৫ / ৩০) কথা আসে ন্যারেশনে, চরিত্রের সংলাপে শাজাহান বলে, পঁচিশে মার্চ রাত্রেই ঢাকা শহরে অন্তত হাজার খানেক মানুষ মারা গেছে (পৃ. ৯৪) রুমী বলে—'বুড়িগঙ্গা দিয়ে হাত পা বাঁধা ছেলেদের লাশ ভেসে যায়, আমরা প্রত্যেকদিন দেখি'। (পৃ. ১২৬) এসব তো তথ্য সমর্থিত। জাহানারা ইমাম ও বাসন্তী গুহঠাকুরতার স্মৃতিকথা অনেক বইয়ের মধ্যে মাত্র ২টি।
হত্যার পাশে থাকছে শরণার্থী শিবির প্রসঙ্গ। পৃ. ১৬৫ ও পৃ. ২৭১ এ কিছু কথা আছে। শিবিরে কলেরা, ব্লিচিং, খিচুড়ি রান্নার গন্ধ, জলের সমস্যা, চোখের অসুখ—এসব আছে। সীমান্তে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ লক্ষ মানুষের স্রোত (পৃ. ২৭৪)—'দুবেলা আহার না জুটলেও মানুষ নিজের ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে যেতে চায় না, তবু এরা যাচ্ছে নিছক প্রাণ বাঁচাবার আশায়, এরা চোখের সামনে জ্বলতে দেখেছে গ্রাম, গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখেছে দলে দলে মানুষকে, স্বামীর সামনে ধর্ষিতা হয়েছে স্ত্রী, ভাইকে খুন করে কেড়ে নিয়ে যেতে দেখেছে বোনকে, এমনকি শিশুর শরীরও ছিন্নভিন্ন হয়েছে বেয়নেটে।' (পৃ. ৩২৯) স্বভাবতই বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গ মানুষের বড়ো অংশ 'আবেগে উত্তাল', যদিও কেউ কেউ বিরক্ত। ইতিহাস জানাচ্ছে—'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ নিহত এবং তিন লক্ষ নারী নির্যাতিতা হয়েছিলেন।' এবং জানা যাচ্ছে ১৯৬৪ থেকে ২০০১ এ মোট নিরুদ্দিষ্ট হিন্দুর সংখ্যা ৮১ লক্ষ। অন্য হিসাব ১৯৬৪ থেকে ১৯৯১-এ দেশত্যাগী হিন্দু ৫৩ লক্ষ। আবুল বারাকাতের গবেষণা গ্রন্থ অনুযায়ী হিন্দু জনসংখ্যা যথেষ্ট কমেছে, মুসলমান জনসংখ্যা যথেষ্ট বেড়েছে। [৯] ইতিহাসকে পাশে রেখে এই উপন্যাসটি পড়লে উপন্যাস কাঠামোর অন্তরাল থেকে ইতিহাসের সত্য পাঠকের কাছে হাজির হবে।
২য় খণ্ডের শেষে লেখক বলেছেন—'বেশ কিছু রাজনৈতিক পালাবদল, কিছু আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে উপস্থিত করা হয়েছে সরাসরি।' এবং 'কোনো কোনো আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি দিয়েছি ....।' শেখ মুজিব, ভাসানী, ইন্দিরা গান্ধী, ৬ দফা ঘোষণা, ইত্তেফাক নিষিদ্ধ, নির্বাচনে কারা জয়ী, কারা পরাজিত, ইয়াহিয়া, ভুট্টো—এসব চরিত্র ও প্রসঙ্গ তো আছেই সরাসরি। এই সূত্রে বলে নেওয়া যাক অপারেশন জ্যাকপট (পৃ. ৩৪৪,৩৪৬), ফ্রান্স ইণ্ডিয়া দিবস (পৃ. ৪৫২), মেলাঘর ক্যাম্প, কসবা ক্যাম্প, (পৃ. ৪৫৪), The Rape of Bangladesh এবং লিয়ন ইউরিসের মাইলা ১৮ বইদুটির উপন্যাসের মধ্যেই উল্লেখ প্রভৃতি। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামন, শান্তি কমিটির পাণ্ডারা তো সরাসরি ইতিহাসের কৃষ্ণগহ্বর থেকে স্বনামেই এসেছে। এখানে আমি দুজনের প্রসঙ্গ আলাদা করে উল্লেখ করতে চাই। ২য় খণ্ডের ১৬ নং অধ্যায় জাহানারা ইমাম-এর পারিবারিক আবহে স্থিত। মুক্তিযোদ্ধা রুমীর জন্য প্যান্ট সেলাই করছেন মা, রুমী ইঞ্জিনিয়ারিং এর কৃতী ছাত্র, আমেরিকায় পড়তে যাবে। শহরে কারফিউ না থাকলে জাহানারা সাহস করে গাড়ি নিয়ে শহর ঘুরে আসেন, পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। ক্রমে নিজের চেনাশুনা আত্মীয় স্বজনদের মৃত্যুসংবাদ কানে আসতে লাগল। মায়ের সঙ্গে রুমীর কথাবার্তায় ফুটে ওঠে সংকট পরিস্থিতি। দেশ চলেছে নাৎসী অত্যাচারে। মায়ের জন্মদিনে দুই ছেলে মাকে সারপ্রাইজ গিফট দেয়, মজা করে। পঁচিশে মার্চের পর বাড়ি সার্চ হওয়ার ভয়ে অনেক পত্রপত্রিকা ইস্তাহার পুড়িয়েছে রুমী, মার্কস, মাও, রবীন্দ্রনাথ, গুয়েভারার বই বস্তাবন্দী করেছে। মাকে উপহার দেয় লিয়ন ইউরিসের মাইলা ১৮ পোলাণ্ডে নাৎসী অত্যাচার ও প্রতিরোধের স্মরণীয় আখ্যান। জাহানারা ছেলের কাছে তাদের গুপ্ত যুদ্ধযাত্রার কথা শোনে। ১৯নং অধ্যায়টিও জাহানারা পরিবারকে নিয়ে। সারামুখে ঝলমলে হাসি ও ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে রুমী মায়ের কাছে খেতে চায়। হাত না ধুয়েই খেতে শুরু করে। শুকনো লঙ্কা অল্প আঁচে পুড়িয়ে আনতে বলে কাজের লোকটিকে। কথায় কথায় ওঠে আর দুজন ছাত্র নেতাকে নিয়ে ধলেশ্বরী পার হয়ে সৈয়দপুরে যাবার কথা, সে সিরাজুলের সাহসের কথা বলে, মন্তব্য করে—'দেশের জন্য যুদ্ধে যোগ দিয়ে যারা ডেজার্ট করে তাদের দোজখেও স্থান হয় না ...।' (পৃ. ১৪৯) মা জানায় অধ্যাপক বাবুল চৌধুরীকে গুলি করেছে। ভাসানীর চীনের কাছে বাংলাদেশ লড়াইকে সমর্থন আবেদনের কথা ওঠে। সুলতানাকে রুমীর ফিরে আসার কথা জানাতে গিয়েও দ্বিধা করে, কারণ—এ 'এক সন্দেহের সময়।' জাহানারা আহত বাবুলকে দেখতে যায়। এরপর ৩৭ নং অধ্যায়। অবিরাম বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি, মাংস, ফজলি আম। রুমীর চিঠি এসেছিল গোপন স্থান থেকে। তারপর রুমী হাজির, ছোটভাই জামী সহ খাবার টেবিলে শঙ্কা ও আনন্দ। খাওয়া দাওয়ার পর পরিতৃপ্ত রুমী সিগারেট ধরায়, এক অজ্ঞাত কবির কবিতা আবৃত্তি করে। রুমী আসে ও যায়। রুমীরা রাস্তায় কয়েকজন মিলিটারী পুলিশকে খতম করে। তারপর ঘরে ফেরা। অস্ত্র পাচার, অস্ত্র আনা—জাহানারা বিহ্বল—এইসব তিনি বইতে পড়েছেন, সিনেমায় দেখেছেন। একদিন 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি' গান শুনে রুমী চমকে ওঠে, ভাই দাদার প্রিয় জিম রীভসের রেকর্ড চালাতে চায়। সে রাত্রেই মিলিটারি পুলিশ এসে রুমী, জিমি, তাদের বাবা শরীফকে তুলে নিয়ে যায়। ঔপন্যাসিক এতটুকু আবেগতাড়িত না হয়ে এই প্রসঙ্গ আর বিস্তার করেন না। জাহানারা আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। ১৯৯৪-এ ক্যান্সারে মারা যান এই বীরাঙ্গনা। রুমীকে গুলিতে হত্যা করেছিল পুলিশ, স্বামী শোকে প্রয়াত। কিন্তু বীরাঙ্গনা জাহানারা একাত্তরের মর্মান্তিক ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেন, ঘাতকদের বিরুদ্ধে জন আদালত গড়ে তোলেন। যদি কেউ এসব না জানে তাহলে উপন্যাসে স্নেহশঙ্কিত জননীর আবহটি তাকে বিচলিত করবেই লেখনীর গুণে। আর যদি ইতিহাস জানা হয়, তাহলে উল্লিখিত অধ্যায়গুলিতে ভাস্বর হয়ে উঠবে ব্যক্তিগত থেকে বিশ্বগতের টানাপোড়েন।
দ্বিতীয় যে ঐতিহাসিক চরিত্রটির উল্লেখ করতে চাই তা হল কাদের সিদ্দিকি। তাঁর অবিশ্বাস্য বীরত্বের কথা আছে পৃ. ৪৭৩, ৪৭৯, ৪৮৭ তে, টাঙ্গাইল শত্রুমুক্ত করার কথা ৪৭৯ তে। এ লড়াই সত্যই অবিশ্বাস্য—মুক্তি বাহিনীর এই কমাণ্ডার অবশ্য ব্যক্তি হিসেবে বহুমাত্রিক হয়ে ওঠেননি, কিন্তু পাঠক যদি কাদের সিদ্দিকির মুক্তিযুদ্ধের ডায়েরি ২টি খণ্ড পড়েন তাহলে দলিলীকৃত বিবরণের সঙ্গে ৫৯ ও ৬০ অধ্যায় দুটি মিলিয়ে নেওয়া যাবে। ৫৭২-৭৩ পৃষ্ঠায় মামুনের ভাবনায় জানানো হয়—কাদের সিদ্দিকি দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে, মুজিবের ডাকে সদলবলে অস্ত্র ত্যাগ করে ছিল। মামুনের মনে হয়—এ যেন এদেশের গ্যারিবল্ডী। একটা ফ্যান্টাসির আশ্রয় নিয়ে লেখক দেখান মামুন গাঁদাফুলের ঝাড়ের কাছে কাদের এবং জাহাজমারা হাবীবকে দেখতে পান। এই দুজন যথাযোগ্য সম্মান পান নি। কাদের বলে (কল্পনায়)—'সহজে মরবো ভেবেছেন? আবার ফিরে আসবো এই দেশে।' (পৃ. ৫৭৩) এ হল ইতিহাসের হতাশ্বাস প্রসঙ্গ।
সুনীল ইতিহাসের প্রতি যথাসম্ভব বিশ্বস্ত থেকে মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্যর্থক দিকের গাল্প শুনিয়েছেন পাঠকদের। মুক্তিবাহিনীর জয় জয়কারের কথা আছে (৬৩), তরুণরা জাতীয় সম্ভ্রম রক্ষার জন্য জীবনপণ লড়ছে (পৃ. ৭৯), কুমিল্লা রণাঙ্গনের বিবরণ (পৃ. ৭৯), মুক্তিবাহিনীর বিচ্চুদের কথা মামুনের কথায় (পৃ. ২৩৪), ছেলেরা লড়ছে রোমান্টিক যুদ্ধের স্বপ্ন চোখে নিয়ে, প্রত্যেকেই কোনো না কোনো অ্যাকশনে যেতে চায় (পৃ. ২৭২), মুক্তি সেনানীর গোপন ক্যাম্পের কথা আসে (পৃ. ২৭৯,৩৩১), ২৫ মার্চের পর স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ সংগ্রাম থমকে গেলেও শক্তি সংহত করে তারা ছড়িয়ে যায় (পৃ. ২৭৮), মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় ট্রেনিং এর কথা আছে, সিরাজুলের আক্রমণ ও আত্মাহুতি (পৃ. ৩৪৯), বিভিন্ন ক্যাম্পের কথা, টাঙ্গাইলে সাফল্য—ন্যারেশনে, সংলাপে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি লেখকের শ্রদ্ধার দিকটি পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। লেখক কোথাও কিন্তু আবেগ বিহ্বল হয়ে ওঠেননি। বাস্তববাদী ঔপন্যাসিকের নিস্পৃহ কলম চালিয়ে গেছেন। ইতিহাসের প্রতি নিস্পৃহতার থেকেই তিনি শেখ সাহেবের শাসনের মৃদু সমালোচনাও করেছেন (পৃ. ৫৭২-৭৩)। যেমন শেখ সাহেবের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টির কথা, খাঁটি বীরদের যথাযোগ্য সম্মান না দেওয়ার কথা। ইতিহাস বড় নির্মম। যদি আমরা sentimental হই তাহলে এসব অংশ ভালো লাগবে না, কিন্তু যদি ইতিহাসনিষ্ঠ হই, তাহলে ঔপন্যাসিকের এই সমালোচনা আমাদের মনে করিয়ে দেবে সেই গোড়ায় বলা রাঙ্কে বা কারের কথা। ঔপন্যাসিক ইতিহাসের তথ্যসামগ্রীকে কিভাবে ব্যাখ্যা করছেন সেটা পাঠকের মনে রাখাটা জরুরী। পাঠক যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে চান, তাহলে ইতিহাস বা ইতিহাসনিষ্ঠ উপন্যাস যেটাই হোক তার কাছে নতজানু হতে হবে। হতে হবে আত্মরক্ষার্থে, ভবিষ্যতের কথা ভেবেই।
পূর্বসূরী তারাশঙ্কর বাংলাদেশের এই অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান ও মুক্তিসংগ্রামের জন্য আত্মোৎসর্গকে উপন্যাসের বিষয় করেছেন নিজের মতন করে। সেখানে ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ততা আছে, তবে ইতিহাসের ব্যাপ্তি ও জটিলতার পরিবর্তে আছে বিপন্ন আবেগের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপার। প্রকাশের পরই তাই এই ছোট উপন্যাসটি উভয়বঙ্গে সমাদৃত হয়েছে। সুনীল বাংলাদেশের এই স্মরণীয় ইতিহাসের পর্যায়গুলি দেখেছেন নিজের চোখে, একাধিকবার বাংলাদেশ গেছেন, অসংখ্য প্রাসঙ্গিক বইপত্র পুস্তিকা পাঠ করেছেন। তাছাড়া পূর্ব-পশ্চিম-এ অন্য সমস্যাও আছে। তবু মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ, আত্ম উৎসর্গের নানা ঘটনা, সন্দেহ নেই, উপন্যাসটিতে মুখ্য হয়ে উঠেছে। ইতিহাসের বড় সময়, ছোট সময়, ব্যক্তিগত সময়—এই তিনের সার্থক সমন্বয় ঘটেছে এখানে।
[১] Historicism - Paul Hamilton, 2007, Pg. 75.
[২] মার্ক্স এ মন্তব্য করেন তাঁর Eighteenth Brumaire বইতে
[৩] The Sociology of Literature : Theoretical Approaches, Ed. Jane Routh and Janet Wolff, 1977, Pg.
[৪] বেনেদেত্তো ক্রোচে, History as the story of Liberty, ইং সংস্করণ ১৯৪১, পৃ. ১৯
[৫] কাকে বলে ইতিহাস, ই. এইচ. কার, ২০০৬, পৃ. ১৩
[৬] A History of Bangladesh—Willem Van Schendel, Cambridge University Press, South Asian Edition, 2009, Pg. 161.
[৭] উপন্যাস রাজনৈতিক : তারাশঙ্কর—পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০০০, পৃ. ৮০।
[৮] সাক্ষাৎকার, বিনোদন বিচিত্রা, জুন ১৯৯৮ সংখ্যা।
[৯] দেশভাগ সংখ্যালঘু সংকট বাংলাদেশ—কঙ্কর সিংহ, ২০১১, পৃ. ১৬২, ২৪৩।
(পরবাস-৪৯, অক্টোবর, ২০১১)