ISSN 1563-8685




দ্বৈরথ

ভিব্যক্তির প্রকাশ ভুলে গেছে অমরা। সবসময় একটা চাপা-উদ্বেগের ভাব তার সারা মুখমণ্ডলে খেলা করছে। মনের মধ্যে একটা অধরা আতঙ্কের অশরীরী ছায়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আতঙ্কটি ধরা দিচ্ছে না, উদ্বেগটিও প্রকাশিত হচ্ছে না। একেবারেই 'ন যযৌ ন তস্থৌ' অবস্থা। বুক-মুখ-শরীর জুড়ে একটা অনিশ্চয়তার লম্বা আঁচড় অমোচনীয় কালির মতো এমন লেপ্টে রয়েছে যে, অমরাকে দেখলেই টের পাওয়া যায়, এই মেয়ে এই জগৎ-সংসারে নেই; অন্য কোথাও হারিয়ে গেছে-অন্য কোনো জীবনে চলে গেছে। প্রতিটি দিন অমরার শুরু হচ্ছে অভিব্যক্তিহীন-বোবা-চেহারাকে সঙ্গে নিয়ে। দিনগুলো কী করে ভালো হতে পারে রাতগুলো ভালো না হলে!

প্রতিমাঝরাতেই কোনো প্রতারক-স্বপ্ন কিছু না-লিখে ফাঁকা সাদা পাতা রেখে চলে যাওয়ার মতো নিঃসীম শূন্যতাভরা ব্যথা ছড়িয়ে ঘুমটুকুও হনন করে পালিয়ে গেলে বুকের হু হু খালি উতলা একাকীত্ব সঙ্গে নিয়ে কেউই বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে না; এই রকম হন্তারক রাত শেষে দিনটিও ভালো কাটাতে পারে না। অমরার প্রতিটি শেষও রাত কাটে সতেরো তলার ঝুল বারান্দার অন্ধকার আসমানে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভয়-ভয় একটা চাদর অস্বস্তিতে তার শরীর দখল করে রাখে। অমরা তখন ঢুকে পড়ে এক অসমাপ্ত ক্যানভাসে। হাতড়ে বেড়ায় ইজেল, তুলি, রং। তলিয়ে যায় কোনো অতলান্ত খাদে, কোনো অতল গহ্বরে। দেখতে পায় কী ভীষণ অন্ধ-অন্ধকার যার সমস্ত অস্তিত্ব ঘিরে শুধু কালো রং। আস্তে আস্তে এক সময় যে দেখতে থাকে আঁধার আর আলোর অঘোষিত যুদ্ধ। যুদ্ধের গর্ভে ক্রমে ক্রমে জন্ম নিচ্ছে একটি নতুন দিন; অথচ তার কাছে নতুন দিনটিও ক্লান্ত-অবসন্ন-অভিব্যক্তিহীন-মনোটোনাস। অমরা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে ঘুর্ণায়মান চৈতন্য-বলয়ের উদ্বেগ আর আতঙ্কের দাবদাহের দাউদাউ লেলিহান দহনে পোড়া রাতের শিউরে; রাত থেকে দিনের পাটাতনে - ক্লান্ত-অবসন্ন-অভিব্যক্তিহীন-মনোটোনাস।

শুরুর দিকে অথৈ আঁধারের রাত-সমুদ্রে শঙ্কার প্রলয়ঙ্করী ঢেউমালা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত অচেনা অনেক জায়গায়। সে ভয়ে আলো জ্বেলে লক্ষ্য করেছে কালোর বিস্তারের কাছে ক্ষুদ্রের কোনো অস্তিত্বই নেই। কোনো আলোই সুউচ্চ আকাশের চতুর্দিক ঘিরে আসা অরণ্য-গভীর অন্ধকারকে স্পর্শও করতে পারছে না। বরং ঘরে কম-আলোর একটি সেড-লাইট জানান দিত যে এই এপার্টমেন্টে কেউ একজন জেগে রয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর আশেপাশের আরও কিছু ফ্ল্যাটের আলো জ্বলতে থাকে। দেখা যায় আবছায়ার মধ্যে থেকে অলক্ষ্যে তাকে সনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। অন্ধকারের চইয়ে ঘৃণ্য এইসব অনাহুত পর্যবেক্ষকের নজর এড়ানোর জন্য এখন আর ভুলেও বাতি জ্বালে না অমরা। দৃষ্টিহীন-জন্মান্ধ অন্ধকার বরং ভালো কামনা-না-করা চোরা বেয়াদব দৃষ্টির চেয়ে।

কোনো মানুষের পক্ষেই একান্ত কিছু হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা সহজে ভুলতে পারা যায় না। এই যে ঘুম হারিয়ে ফেলেছে সে, প্রতিদিনই মাঝরাতের পর থেকে ভোর পর্যন্ত মাহেন্দ্রক্ষণটুকুতে ঘুমোতে পারছে না, এ যন্ত্রণা বললেও চাপা দেওয়া যায় না। ঘুমহীনতায় অবসাদ বাড়তে থাকে-ভয়, উদ্বেগ আর আতঙ্ক বাড়তে থাকে। সব সময় একটা গুপ্তভয় চেপে থাকে মগজে, কোষে, স্নায়ুতে, তন্ত্রীতে, মনে, চেহারায়, শরীরে দিনে এবং রাতে 'এই বুঝি আরও কিছু হারিয়ে গেল!'

হারানোর স্মৃতি অমরার নতুন নয়। এক জীবনে মানুষ যা কিছু হারাতে পারে, তার সবগুলোই খুইয়ে এসেছে সে। বরং অনেক বেশিই হারিয়েছে। ছয় বছরের একটি শিশুকন্যা কি জানতো কক্সবাজারের পথে সে সব কিছু হারিয়ে ফেলবে! আবছা মনে আছে দুর্ঘটনাটির রক্তাক্ত এলোমেলো ঝাঁকুনি আর একাকী-নিসঃঙ্গ হয়ে যাওয়ার কথা। তাদের গাড়িটিকে ট্রাক পিষ্ট করে খাদে ফেলে দেয় কিন্তু সে বেঁচে যায় মা, বাবা, ড্রাইভারের মৃতদেহের পাশে। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল 'শিশুর অলৌকিক বেঁচে যাওয়া' সম্পর্কে। না-মরে মিরাক্যলে বেঁচে যাওয়ার মতোই স্বাভাবিক বেঁচে থাকাও যে কত অলৌকিক-আশ্চর্যজনক অমরার চেয়ে ভালো আর কে জানে! অ্যাক্সিডেন্টে না মরলেও অবহেলা, অনাদর আর অভিভাবকত্বহীনতায় সে মরে যেতে পারতো। যে অনাথ শিশুর তথাকথিত আত্মীয়রা সহায়-সম্পত্তি বাঁটোয়ারার পর পরই সঙ্গোপনে সটকে যায়, তার তো বেঁচে থাকার কথা নয়! তথাপি সে বেঁচে গেছে। বেঁচে গেছে মিরাক্যলে,অলৌকিক আশ্চর্যজনকভাবে। আত্মীয়তা বা রক্তসম্পর্কহীন একটি আশ্রয়ে। সীতাকুণ্ডের সেই আশ্রমটিই পৃথিবীর একমাত্র জায়গা যেখানে সে নির্দ্বিধায় যখন তখন যেতে পারে বাড়ি ফেরার আনন্দ-আবেগে। চোখ বন্ধ করে নিজের কোনো ঠিকানার কথা ভাবলেই অমরা তাবৎ পৃথিবীর মধ্যে এই একটি মাত্র জায়গাকেই দেখতে পায়। পৃথিবীর বিশাল মানচিত্রকে মনে হয় অচেনা আফ্রিকার ধূ ধূ সাহারা, যার মধ্যে একটিই সবুজ মরুদ্যান 'অমরাবতী আশ্রম'। কোনো রক্তসূত্র না থাকলেও অমরা নামটির সঙ্গে মিলেমিশে আশ্রমটিও তারই জীবনের মাটিতে বিশাল ছায়াবিস্তারী দৃঢ়মূল মহীরুহের মতো শিকড় বিছিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

তবু 'অমরাবতী আশ্রম' সাময়িকভাবে হলেও হারাতে হলো। জীবনের নদীটির মাতাল স্রোত তাকে ছাড়ল না। টেনে নিয়ে এল চট্টগ্রামে। কলেজের উন্মাতাল জীবনে। "জীবন যাকে টানবে মৃত্যুও তাকে দখল করতে পারবে না। কিন্তু এক সময় মৃত্যু যখন বুকে জড়িয়ে নেবে জীবনের টান তখন ব্যর্থ দর্শকের মতো বিমূঢ় চেয়ে দেখবে শুধু। তোমার এখন বেঁচে থাকবার সময়। চরৈবেতি। তোমাকে চলতেই হবে মা।" আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক মাসিমার এই কথায় কাঁদতে কাঁদতে অমরা চলে আসে কলেজের নতুন জীবনে। সেখানে এসে আরও এগিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্রের সঙ্গে হারিয়েছেও অনেক কিছু। সেইসব বান্ধবী, যাদের সঙ্গে একান্তে পাঠ করতে শুরু করেছিল আদি ও অকৃত্রিম জীবন গ্রন্থের দুঃখের পাতাগুলো, তারাও হারিয়েছে, কলেজ পেরিয়ে একেক দিকে ভর্তি হয়ে চলে গেছে যে যার বিবরে। আর ঝাঁকড়া চুলের সেই ছেলেটি! যে প্যারপল কালারের একটি অভিনব ফতুয়া গায়ে ভিড়াক্রান্ত কলেজ ক্যাম্পাসে একাকী নিঃসঙ্গ-নীরবে আসা-যাওয়া করত। আর কখনও কি এদের সঙ্গে এই জীবনে দেখা হবে! এদের সঙ্গে ধীরে ধীরে খুলে বলার কথাগুলো না-বলার বুদ্বুদ হয়ে বুকের শূন্য আকাশে উদাস উড়াউড়ি করে চলেছে। নিজের বিক্ষত হৃদয়ের কষ্ট-ভারাক্রান্ত বৃত্তটি যে দিনে দিনে আরও কতটুকু পরিব্যাপ্ত হতে থাকবে - অমরা নিজেও জানে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মহার্ঘ্য সুযোগটুকুও নিতে চায়নি অমরা, ফিরে এসেছিল একমাত্র আশ্রয় আশ্রমে - আবারও হারিয়ে যেতে চায়নি সে:
"মাসিমা ঢের পড়াশোনা হয়েছে। বাকি জীবনটুকু ঠিক করেছি তোমাদের পাশে থেকে আশ্রমের কাজকর্ম আর শিশুদের দেখাশোনা পড়াশোনা করিয়েই কাটিয়ে দেবো।"

মাসিমা মৃদু হাসলেন:
"তা তুমি সব সময়ই পারো। তুমি আশ্রম-কন্যা। এখানে তোমার প্রাকৃতিক অধিকার। তোমাকে কেউ কোনোদিন এখান থেকে চলে যেতে বলবে না, বলতে পারবে না। আমার বাবা এই আশ্রমে সর্বস্ব দান করার সময় একটিই শর্ত দিয়েছিলেন - এই আশ্রমের মালিকানা হবে আশ্রমবাসীদের। তোমার অমোঘ ভাগ্যের মতো স্থায়ী ঠিকানাটুকুও এখানেই লেখা হয়ে গেছে। কিন্তু আমি চাই তুমি জীবনকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা কর। নিজের একটি নিজস্ব জায়গা অর্জন করার জন্য আরও চেষ্টা কর, এগিয়ে যাও। তোমার যে সম্ভাবনা ও সুযোগ রয়েছে সেটা সকলেই পায় না। তুমি বৃত্তি নিয়েই তোমার উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করতে পারবে। সেই অনাগত-প্রতিষ্ঠিত জায়গা থেকে তুমি তোমার নিজের আশ্রমকে আরও সাহায্য করতে পারবে। আর ভালো না লাগলে যেকোনো সময় কিংবা শেষ বয়েসে চলেও আসতে পারবে এখানে।"

আবার পায়ের নিচের নিজস্ব ভূমি হারাল অমরা। আবার সাময়িকভাবে হলেও আশ্রয়হীন হল অমরা। নতুন জায়গা পেল গেরুয়া মাটির মায়ারহস্যময় লাল প্রাগৈতিহাসিক ভবনের মধ্যে সবুজ ক্যানভাসের নীল টলোমলো উদাসী হ্রদের মণ উচাটন জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে।

এখানে এসেই আবার হারানোর পালা শুরু হল। প্রথমেই অমরার ঘুম হারিয়ে গেল। রাতে আর ঘুমোতে পারছে না সে। জানলার পাশের শীতের অতিথি পাখি-দম্পতির চাপা-কোলাহলে ঘুম ছুটে যাচ্ছে। ঘুম হারিয়ে যাচ্ছে পাতাদের বিষন্ন নড়াচড়ায়; হু হু বাতাসের অস্ফূট কান্নার মর্মরে। অমরার গায়ে কাঁটা দেয়, শীতমাখানো রোমাঞ্চ জাগে। মনে হয় কেউ যদি আমাকে আমূল জড়িয়ে ধরতো চিরসাথীর আস্থা ভালোবাসা আবেগ ও প্রশ্রয়ে! পাগলের মতো লাগে তার, দম বন্ধ হয়ে আসে। অন্ধকারে নিরবয়ব হয়ে ঘুমহীন কেউ রাত কাটাতে পারে না। তার স্বপ্নে চলে আসে কলেজের ঝাঁকড়া চুলের সেই ছেলেটি - প্যারপল কালারের একটি অভিনব ফতুয়া গায়ে ভিড়াক্রান্ত কলেজ ক্যাম্পাসের স্মৃতিপথের একাকী-নিঃসঙ্গ-নীরবে আসা-যাওয়ার মতো সেই ছেলেটি অমরার স্বপ্নে আসা-যাওয়া করতে থাকে। অমরা ভাবে 'হি ইজ ফর মি, হি শুড বি মাইন।' একটি প্রবল অধিকারের সাবিতে সে প্রত্যাশা করে ছেলেটিকে। যে প্রত্যাশা ব্যক্ত করতে পারেনি একদা, সেটা রোমাঞ্চকর প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রণোদনায় তীব্র আকুতি পায় কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বহুদূরের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ঠিকই তো, সে নিশ্চয় ডিজার্ভ করতেই পারে যে, তার একজন নিজস্ব কেউ থাকবে। থাকবে একজন একান্ত পুরুষ। প্রতিটি রাতে খোলামেলা আর অবারিত হুয়ার পর অমরা রাত, আঁধার, ঘুম বা স্বপ্ন নয়, দেখে ঝাঁকড়া চুলের সেই ছেলেটিকেই যে প্যারপল কালারের একটি অভিনব ফতুয়া গায়ে ভিড়াক্রান্ত কলেজ ক্যাম্পাসে নয়, একাকী-নিঃসঙ্গ-নীরবে আসা-যাওয়া করছে তারই অন্তরের গভীর-গহীন-নিজস্ব-একান্ত অন্তর্মূলে। মুদ্রার অন্য পিঠে দ্বন্দ্ব এসে হানা দেয়। যুদ্ধ চলে নিজের সঙ্গে। অমরা আশ্রমকন্যা। একটি প্রায়-ব্রহ্মচারীর পরিমিত জীবনের ধারায় সে বেড়ে উঠেছে। সে নিজে নিজে রুখে দাঁড়ায় 'ওই উঠতি যৌবনের হাতছানি আমি কেন রোধ করতে পারি না!' আবার মনে হয়, 'আমার জীবনে শখ আছে, আহ্লাদ আছে, আমার সব চাই, আজ চাই, এক্ষুনি চাই, আই ওয়ান্ট টু বিট দ্য ওয়ার্ল্ড উইথ সামওয়ান কমপ্লিটলি মাইন।' ক্লাসে গেলে মাথা আরও বিগড়ে যায়। ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাস মানেই রোম্যান্টিক দ্যোতনা। জন ডান যখন পড়ানো হয়, মনে গেঁথে যায় দু'টি লাইন: "Hold your tongue / And let me love." আরও আচ্ছন্ন হতে হয় টি এস এলিয়টের "Let us go then, you and I/When the evening is spread out against the sky/Like a patient etherized upon a table" পড়তে পড়তে। জীবনানন্দ দাশ যে সন্ধ্যাবেলাকে অনুবাদ করেছেন 'শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা আসে', সেটাই তীব্র দ্বৈরথের মধ্য দিয়ে অমরাকে নিয়ে চলে ক্লান্তিকর-সীদ্ধান্তহীন-ঘুমহীন-স্বপ্নবিহীন জাগ্রত রাতের নিথর শরীরে জমে থাকা তার অবিমিশ্রিত যৌবনের প্রগাঢ়-থরথর-কম্পমান অস্তিত্বে।

এভাবেই যখন প্রেমের মুকুল ধরল অমরার দ্বিধাগ্রস্থ মনে, তখন যৌনচেতনায় সে আচ্ছন্ন হয়ে রইল নিজের অন্তরঙ্গে, তখন সে বহিরঙ্গে হরিণীর লাজুক-নয়নে উঁকি-ঝুঁকি দিল চারদিকে এবং শামীমকে দেখতে পেয়ে কেঁপে উঠল আকাঙ্খার নৃত্যরত শিখায়। মনে হল এই অচেনা সদ্য দেখা ছেলেটি আর কেউ নয় - ওরই ভেতরের বাসিন্দা। আর দশজনের চেয়ে আলাদা, রুটিন মতো ক্লাসে না-যাওয়া, নির্মাণাধীন সালাম বরকত হলের দক্ষিণমুখী বি-ব্লকের নীচতলার একটি নিঃসঙ্গ রুমে আটকে থাকা আর কিছু নয় - তারই জন্য অপেক্ষা। মনে হলো অনির্ধারিতভাবে গোধূলির আবির মেখে প্রান্তিক গেট হয়ে অচেনা-অনিশ্চিত গন্তব্যে চলে যাওয়ার ধূসর পথ দিয়ে কলেজের সেই ঝাঁকড়া-চুলের পারপল ফতুয়ায় ভর করে শামীম এসে অমরার কাছে হাজির হয়েছে।

শামীমের কাছে সুপ্ত-প্রেমিকার পরিচয় গোপন রেখে অমরা এগিয়ে এসে সে নিজেকে দেখতে পেল অন্য রকমের এক অদ্ভুত পরিচয়ে - মনোবিদের ভূমিকায়। কাকলি, মিলা, শাম্মী, লাকি এবং আরও অনেকেই সাবধান করে দিয়েছিল, 'ও জ্বলন্ত আগুন, যাসনে ওর কাছে, পুড়ে মরবি।' অমরা খানিক ভেবেছে। আশ্রমকন্যারূপে শুশ্রুতার একটি নৈতিক দায়িত্ব সে এড়াতে পারেনি। সে যখন দেখতে পায় সাহায্যপ্রার্থী হয়ে একজন তার সামনে উন্মুখ, উদগ্রীব ও উৎকণ্ঠিত চিত্তে সহমর্মিতার আশা নিয়ে অপেক্ষমান, তখন মানবিকাবোধই জয়ী হল। আশ্রমে মাসিমাকে চিঠি লিখে পরিস্থিতি যতটুকু জানানো যায়, জানিয়েও ছিল; অমরার সে চিঠির সংক্ষিপ্ত উত্তর এসেছে, "যা করবে, নিজেকে রক্ষা করেই তবে করবে"। সারা জীবনে ত্যাগের একটির পর একটি পরীক্ষার মতো সে তার নবযৌবনের নবউত্থিত বাসনাটিকেও লুকানো নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে শামীমকে উদ্ধারের কাজে নিজের গরজেই লিপ্ত হল।

শামীমকে নিয়ে মূল সমস্যা হল সমাজ ও পারিপার্শ্বের মধ্যে সে একটি ছাড়া-ছাড়া ও গন্ডীবদ্ধ সীমিত পরিধিতে ঘুরে বেড়ায় নিশ্চুপ ও নির্বিকারভাবে। অবিশ্বস্ত চোখে সবাইকে দেখে। সবার সঙ্গে তো নয়ই, যে দু'চারজনের সঙ্গে মেলামেশা করে, তাদেরকেও সে গভীরভাবে ছুঁতে দেয় না নিজেকে। শুধু অমরাকে কেন জানি একান্তে বলেছে, "জানো, মানুষের জীবনে পাহাড় ডিঙানোর সুযোগ একবারই আসে। আমি সে সুযোগ একবারই মাত্র পেয়েছি এবং হারিয়েছি। অফন দেয়ার ইজ ন সেকেণ্ড চান্স। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, বিশ্বাস ভাঙলে আর জোড়া লাগে না।"

অমরা কাউকে বিশ্বাস করে এখন পর্যন্ত নিজেকে কোথাও সমর্প্ন করেনি এটা ঠিক। এবং এটাও ঠিক যে, সে এমন একজনকে বিশ্বাস করে সবকিছু খুলে দিতে চেয়েছে, যে কিনা নিজেই বিশ্বাসভঙ্গের বেদনায় জর্জরিত! মেয়েটির নাম কখনও শামীম বলেনি। ওকে হারিয়ে সে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে নেশার একটি ফিরতে না-পারা নীল জগতের চক্রবৃত্তে। বিশেষ কিছু ভাবার শক্তি পায় না অমরা। সবচেয়ে আগে শামীমকে উদ্ধার করতে হবে। তারপর অন্য কিছু। বেঁচে থাকলে আশাও থাকবে। কিন্তু শামীম যেভাবে মৃত্যুর দিকে ছুটে চলেছে, তাকে তো বাঁচানো মুস্কিল। সে কোনো চিকিৎসা কিংবা প্রতিষেধকও নেবে না। ভীষণ যন্ত্রণায় পড়লো অমরা। ছেড়েও আসতে পারছে না মানবিক-শাশ্বত নারী চেতনার কারণে। আবার ওর সঙ্গে লেগে থেকে পড়াশোনা, ক্লাস এমন কি নিজের মানসিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ ও ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। এইসব হাতছাড়া-উদ্ভ্রান্ত-সিদ্ধান্তহীন দিনের শেষে রাতগুলো ঘুমহীন হাতুড়ি দিয়ে নিষ্ঠুর আঘাত হানে অমরাকে। হায়! শামীমের সমান্তরালে সেও যে নিত্য ভাঙছে!

এরই মাঝে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান একদিন ডেকে পাঠালেন, "আমরা অনেক কথাই শুনতে পাচ্ছি। যদিও স্ক্যাণ্ডাল বা তেমন কিছু আপত্তিকর খবর আমি পাইনি। তবে এটুকু সাবধান তোমাকে করা দরকার বলেই বলছি, অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেকে শেষ কর না। তোমার রেজাল্ট ভালো। প্রচণ্ড স্ট্রাগলের মধ্য দিয়ে তুমি উতরে এসেছো। আমরা ভেবে রেখেছি তোমাকে বিভাগে শিক্ষকতায় নিয়ে নেব। অতএব তোমার সম্ভাবনাটুকু নস্যাৎ করো না।" মাসিমার কথাগুলোও মনে পড়ে গেল, "যা করবে, নিজেকে রক্ষা করেই তবে করবে"।

অমরা আর বিলম্ব করে না। শামীম যাক বা না যাক, তার আর ঝুলে থাকা চলবে না। সাত পাঁচ ভেবে সে নিজেই ওর চিকিৎসার একটি বন্দোবস্ত করে ফেলে। ঢাকার শেরে-বাংলা নগরের মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালটি একটি মিনি পাগলাগারদ - যেন বা পাবনার হেমায়েতপুরের মিনিয়েচার। রোগীদের চলতি ভাষায় পাগল বলা হলে খুব একটা ভুল বলা হয় না। নানাভাবে মানসিক দিক দিয়ে পীরিতদের ভিড় ঠেলে সে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ডা. ফাহমিদ-উর রহমানের সঙ্গে। সদ্য অস্ট্রেলিয়া ফেরত এই তরুণ চিকিৎসক আগ্রহ নিয়ে পুরো বিবরণ শুনে বললেন, "আসলে আমরা তো রোগী না দেখে চিকিৎসা করি না। তবে আপনি যদি রোগীর পুরো কেস হিস্ট্রি বিশ্বস্ততার সঙ্গে বলতে পারেন, তবে সাহায্য করা যেতে পারে। মনে রাখবেন, এ ধরনের মানসিক অসুবিধায় কেবল ঔষধ নয়, আচরণগত থেরাপিই প্রধান এবং এজন্য রোগীর খুব কাছের এবং আস্থাভাজন কাউকে বিশেষ সময় দিতে হবে। আপনি ভেবে দেখুন পারবেন কিনা। যদি রাজি থাকেন তাহলে পরশু আসুন রোগীর সব তথ্য নিয়ে।"

মাঝখানের পুরো দিনটি ভেবে ভেবে কাটালো অমরা। শামীমের কাছ থেকে যতটুকু জেনেছে তা নোট করে নিল। দু'টি মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতো, ফোন করে সেখানে জানিয়ে দিল, সে আর আসতে পারবে না। কাকলি, মিলা, লাকি, শাম্মীদের বললো "আমার কিছু ক্লাস মিস হতে পারে। তোরা প্লিজ আমার জন্য ক্লাস-নোট রাখিস।" বন্ধুরা বিভ্রান্ত চোখে দেখলো যে এই অনাথ মেয়েটি কী অসীম সাহসে অনিশ্চিত-বিপদের আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে!

ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের দিন সারাটা সকাল শামীমের সঙ্গে কাটালো অমরা। ওর সম্পর্কে যে নোটগুলো নিয়েছে সেগুলো যাচাই করে নিল এবং ডা. ফাহমিদকে জানানোর মতো আরও কিছু তথ্যও সে পেয়ে গেল। নিবিড় আলাপের জন্য ক্যাম্পাসের চেনা জায়গাগুলোতে না গিয়ে আরও খানিকটা দক্ষিণে সাভারের চিরায়ত গ্রামের কাছাকাছি চলে এল ওরা। ওখানে মাওলানা ভাসানীর নামে ছেলেদের আবাসিক হল তৈরি হচ্ছে। এরই প্রাথমিক কাজ চলছে। তত হৈ চৈ নেই। নিরিবিলি একটি জায়গা দেখে ওরা বসে পড়লো। বসেই সরাসরি মূল কথা চলে এল অমরা:

"শামীম তোমাকে বাঁচতে হবে।"
শামীমের নৈর্ব্যক্তিক পাল্টা প্রশ্ন:
"আমাকে বাঁচতে হবে কেন! আর তুমিই বা আমাকে বাঁচাতে চাইছ কেন!"

অমরা ঠিক করেছে কিছু কথা স্পষ্ট ও খোলামেলা হয়ে যাওয়া দরকার:
"আমি মৃত্যুকে জয় করে বেঁচে চলেছি। আমি জানি শত কষ্টেও মানুষের বেঁচে থাকা কত সুন্দর আর আনন্দের। এ কথাটিই আমি তোমাকে ভাবতে বলছি।"

শামীম আলতোভাবে অমরার একটি হাত টেনে নিল। প্রথম বারের মতোই টেনে নিল। শরীরেরও যে একটি অস্তিত্ব রয়েছে, উপস্থিতি রয়েছে, শামীম এই প্রথম সেটা অমরাকে জানতে দিল। হাত টেনে নিয়ে কিছুক্ষণ ওর আঙুলের সঙ্গে অদ্ভুত খেলা খেলতে লাগলো। অমরার শরীরে তখন বিদ্যুতের আসা যাওয়া। গভীর মুঠোর মধ্যে হাত নয় যেন সম্পূর্ণ অমরাকে জড়িয়ে নিয়েছে শামীম:
"তুমি আসলেই আমাকে বাঁচাতে চাও?"
মুখ না তুলে সলাজ সায় দিল অমরা:
"হ্যাঁ চাই। অবশ্যই চাই।"

শামীম বেশ অবাক দৃষ্টিতে অমরার দিকে নীরবে মুখ তুলে তাকালো। সে যেন আরও অনেক কথা শুনতে চায়। অমরা এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে বলতে থাকে:
"তুমি ভেঙে পড়ো না। অবশ্যই তুমি আগের মতো সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবেই বাঁচতে পারবে। এজন্য দরকার তোমার নিজের ইচ্ছা আর আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচকতা। আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচকতা যে একজন মানুষের বাস্তবতাকে কিভাবে বদলে দেয় সেটা তোমাকে একটু খুলে বলি।" কিছুটা সময় নিয়ে অমরা বলে :
"একটু বয়স হয়ে গেলেই আমরা ভাবতে থাকি বয়স বাড়ছে, এখন আর আগের মতো কিছু মনে থাকে না, ভালো লাগে না ইত্যাদি। তার মানে একজন মানুষ নিজেই নিজেকে বৃদ্ধ করছে; নিজের শরীরের যন্ত্রগুলোকে নিজেই দুর্বল করে দিচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞান বলে অন্য কথা। বিজ্ঞানের সূত্রানুযায়ী আঠাশ বছর বয়স থেকে মানুষ শরীরবৃত্তীয় নিয়মেই স্মৃতিশক্তি হারাতে থাকে এবং আটান্ন বছরের মধ্যে স্মৃতিশক্তির জীবনচক্র শেষ হয়ে যায়। ফলে এর পর থেকে বার্ধক্যের লক্ষণগুলো ফুটে উঠতে থাকে। প্রায়ই মানুষ তখন ভুলে যাওয়ার প্রবণতার শিকার হয়। কিন্তু একজন সচেতন মানুষ বা আত্মশক্তিসম্পন্ন ইতিবাচক মানুষের ক্ষেত্রে তা ঘটে না। এর কারণ হল বিজ্ঞানের আরেকটি সূত্র তখন সক্রিয় হয়ে যায়। সেটা হল, আটান্ন বছরের পরে একজন আত্মবিশ্বাসী ইতিবাচক মানুষের সেকেণ্ডারি মেমোরি গরে ওঠে। কেননা মানুষটি তার স্মৃতিকে কর্মক্ষম রেখে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা আর দক্ষতার মধ্যে আস্থা-বিশ্বাস-ইতিবাচকতার মাধ্যমে নিজেকে তরতাজা ও জীবন্ত রেখেছে। কিন্তু যারা নেতিবাচক চিন্তা ও হতাশাইয় বেশি সময় ব্যয় করেছে, তারা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় স্মৃতিহীন ও অকেজো হয়ে গেছে। আসল কথা হল নিজের আত্মশক্তি ও ইতিবাচকতা। পিকাসোর কথা তো জানোই। তিনি জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন; পরিণত বয়সে সন্তানের জনকও হয়েছিলেন। কাজে মগ্ন মানুষের মধ্যে অসাধ্য সাধনের ক্ষমতা রয়েছে। তোমার তেমন কোনো বয়স হয়নি; তেমন কোনো স্থায়ী ক্ষতিও হয়ে যায়নি। তুমি অবশ্যই বেঁচে থাকতে পারবে তোমার অনিন্দ্যসুন্দর নতুন জীবনে।"

অনেকক্ষণ ধরে অমরার মুখের দিকে অনঢ় চোখে তাকিয়ে থেকে সব শুনলো শামীম। তারপর চমকে দিয়ে বলল :
"তাহলে চলো তোমার আশ্রমে চলে যাই।"

অবাক চোখে তাকালো অমরা শামীমের দিকে। অনেক দিন নয়, অনেক বছর বাদের যেন ঘুম ভেঙে কথা কইছে একটি যুবক। সে বরং কথা না বলে চুপ থেকে এই আত্মঘাতী যুবককে জাগিয়ে দিতে চাইল :
"আমি শুনেছি এবং এখন দেখতেই পাচ্ছি, তুমি আমার জন্য খুবই ভাবছো। কিছুরই প্রয়োজন হবে না যদি তুমি নিজে আমার চিকিৎসক হও।"

কিভাবে যেন মুখ ফসকে কাঁপা ও রোমাঞ্চিত গলায় বলে ফেললো অমরা :
"আমি আছি, থাকব। আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।"

শামীম একটি লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে থাকে :
"যাকে পেয়েছিলাম, তার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ না-দেওয়ায় হারিয়েছি। তোমাকে যদি পাই, তাহলে চিরজীবনের জন্যই যেন পাই। রাজি থাকলে চল আশ্রমে গিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিই। সীতাকুণ্ডের ঢেউ খেলানো পাহাড় আর সমুদ্রের গর্জনের মাঝখানে নিজেদের সঁপে দিই।"

অমরার খুব ভালো লাগলো। মনে মনে সে এমন একজনকেই খুঁজছিল। সে তো আসলে শামীমের ভিতরেই লুকিয়ে ছিল। কিংবা শামীম ওর ভেতরে। আজ তার খুবই আনন্দের দিন। খুবই অর্জনের দিন। যে স্বপ্ন ও আকাঙ্খা চাপা ছিল মনের গোপনে আজ তা স্বমহিমায় প্রকাশিত হয়েছে। শামীমের কাঁধে নিশ্চিন্তে মাথা রেখে অমরা বলল :
"চল আগে পড়াশোনাটা শেষ করি। তারপর তুমি যেমন চাইবে তেমনভাবেই আমরা নিজেদের গুছিয়ে নেব।"

শামীম হো হো করে হেসে উঠল। আশেপাশের নীরবতা ভেঙে গেল সেই হাসিতে। চমকে উঠল অমরাও। হাসি থামিয়ে সে মৃদু কণ্ঠে জানালো :
"পড়াশোনার পর তো সেই চাকরি আর ব্যস্ততা। আমার সেসবে কাজ নেই। তুমি জানো যে আমার পুরো পরিবারই কানাডা চলে গেছে। ব্যাঙ্কে যে টাকা আর যে ব্যবসার শেয়ার রেখে গেছে তা দিয়ে আমরা চোখ বন্ধ করে চলতে পারবো। তুমি শুধু আমার সঙ্গে থাক বাকি সব চিন্তা আমার। আমার আর তোমার মাঝে আমি প্রকৃতি ছাড়া তৃতীয় কোনো পক্ষকে দেখতে চাই না।"

অমরা বুঝে উঠতে পারে না কি উত্তর দেবে। ডা. ফাহমিদের সঙ্গে কথা বলা দরকার। শামীমের চিকিৎসা কিছুটা এগিয়ে যাক। তারপর মত দেওয়া যাবে। ভাবনার সব কথাগুলো অবশ্য শামীমকে বলা ঠিক মনে করে না সে :
"আচ্ছা দেখা যাবে, চলো এখন উঠি।"

সে নিজে উঠে দাঁড়ায়, শামীমকেও হাত ধরে তুলে দাঁড় করায়। অন্য ব্যস্ততার কথা বলে ফিরে আসতে থাকে। ঢাকায় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথাটাও সে চেপে যায়। আগে শুরু হোক চিকিৎসা, তারপর ধীরেসুস্থে সব বলা যাবে। শেষ পর্যন্ত ওকে লুকিয়ে রেখে তো আর চিকিৎসা চলবে না। পরিবেশ তৈরি করে তাকেও তো নিয়ে যেতে হবে। প্রথম দিনই আর অগ্রসর হওয়া ঠিক নয়। শামীমের আবেগ কোথায় কোনদিকে চলে যায় কে জানে! সে নিজেও এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। অতএব ধীরে। অমরা শামীমকে হলে পৌঁছে দিয়ে ফুরফুরে মেজাজে ঢাকার বাসে চেপে বসে।

ডা. ফাহমিদ কথামতো প্রচুর সময় দিলেন। খুশি মনেই দিলেন। অমরাকে দেখে তিনি বুঝতে পারলেন চিকিৎসায় যথেষ্ট আশার আলো দেখা যাচ্ছে। ধৈর্য্য ধরে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন। আজকের সকালের ঘটনাটি যখন অমরা জানালো তখন তিনি খুবই খুশি আর আশাবাদী হলেন। সম্ভবত নিজে এই রোগির চিকিৎসায় বেশ আগ্রহ পাচ্ছেন বলেই অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে সময় নিয়ে অমরার সব কথা খেয়াল করলেন। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চিকিৎসকরা সাধারণত এতটুকু সময় ও আগ্রহ রোগিদের ক্ষেত্রে দেখান না। সব শুনে তিনি সাগ্রহে বিস্তারিতভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে লাগলেন :

"অমরা, এই যুবকের চিকিৎসার ক্ষেত্রে দু'টি রাস্তা আমাদের সামনে বের হয়ে এসেছে। একটি রাস্তা খানিকটা কঠিন। ছেলেটির জীবনে প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা জীবন্ত ও অটুট রেখেই বিচ্ছেদ মেনে নিতে সাহায্য করা। জীবনের পরবর্তী পদক্ষেপগুলোতে সে যেন ইতিবাচক প্রায়শ্চিত্ত করে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে, সেভাবে তাকে আস্তে আস্তে প্রস্তুত করে তোলা যেতে পারে। যদি তাকে এই রাস্তায় হাঁটানো সম্ভব হয়, তাহলে একদিন যুবকটি নিজের প্রতি নিজেই শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে। বিচ্ছেদের যন্ত্রণাকে মেনে নিয়েও সে অতীত অভিজ্ঞতাকে সম্মান জানাতে শিখবে। ব্যথা জীবনেরই অঙ্গ। একে অস্বীকার নয়, স্বীকার করেই সে জীবনমুখী পথ খুঁজে পেতে পারবে। অন্য পন্থাটি সংক্ষিপ্ত ও শর্টকাট। তার প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাটিকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ও ছোট করে দেখানো। তাকে এ কথা বোঝানো যে, মেয়েটি এসেইছিল চলে যাবার জন্য। জীবনের একটি ভ্রান্তি সে। মনের চেতনা জগতে নিজেকে বড় আর প্রেমিকাকে ছোটো করে দেখানো গেলে প্রেম ও বিচ্ছেদজনিত আঘাত বুকে আর বাজবে না। ব্যথা সহ্য করতে যারা পারে না, মনোচিকিৎসা শাস্ত্রে তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে চড়া মাত্রায় অ্যানাসথেটিক। এই পথ আদর্শ নয় বটে কিন্তু এ পথেও চলতে হয় কখনো কখনো।"

অমরা লক্ষ্য করল, শামীমের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত দু'টি পথ ঠিক একই জায়গায় গিয়ে পৌঁছাচ্ছে না। কোন পথ বেছে নেবে, সে পছন্দের স্বাধীনতা ও অধিকার তার নয়, শামীমের। চরিত্র বদল বা গঠন করা ব্যক্তির একান্ত নিজের ফোর্সের কাজ। বাইরে থেকে সে সেটা কতটুকু করতে পারবে! আর শামীম তো স্বজ্ঞানে কোনো পছন্দের কথাই জানাচ্ছে না, আজ সকালের সিদ্ধান্তটি ছাড়া। মূলত সে কেবল ধীর পায়ে আত্মহননের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পণে এগিয়ে চলেছে। ডা. ফাহমিদ ঠিকই বলেছেন যে, ওর চিকিৎসা আসলেই সফল হতে পারে যদি অমরা লেগে থাকে এবং ধীরে ধীরে তাকে জীবনের পথে সঙ্গে থেকে থেকে এগিয়ে নিইয়ে যেতে পারে।

ডাক্তারের চেম্বার, টুকটাক কাজ এবং পুরো পরিস্থিতিটি ভাবতে ভাবতে কোনদিক দিয়ে যে সময় গড়িয়েছে অমরা সেটা খেয়াল করেনি। রাত নটার বিশ্ববিদ্যালয়গামি শেষ বাসটিও চলে গেছে। এখন প্রায় দশটা। অমরা একটি সিএনজি নিয়ে গাবতলী পৌঁছে পাবলিক বাসে যখন ক্যাম্পাসে এল তখন রাত প্রায় পৌনে বারোটা। ডাইনিং বন্ধ হয়ে গেছে। খাওয়াও হল না এবং ডাইনিং-এর জম্পেস আড্ডায় কারো সাথে দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তাও হল না। এবং এর ফলেই সে জানতেও পারল না যে, শামীম তাকে বেশ কয়েকবার খুঁজে গেছে। খবরটি জানানোর জন্য কেউই আজ অমরার দেখা পায়নি। অমরা রাতের নিস্তব্ধতায় চুপিসারে তিন তলার কোনায় নিজের সিঙ্গেল রুমে এসে বিস্কিটের কৌটো বের করল। ক্লান্ত শরীরে কোনোভাবে ওই খেয়েই গভীর অবসন্নতায় বিছানায় কাঠ হয়ে পড়ে গেল। আজ অনেক দিন পর, অনেক নতুন অভিঘাতের আনন্দ-শিহরণে অমরার চোখে মহার্ঘ্য ঘুম নেমে এল। যে জানতেও পারলো না, শামীম তাকে বেশ কয়েকবার খুঁজেছে - কেন খুঁজেছে!

ভোরের দিকে ঘুম যথারীতি ভেঙে গেল তার। উঠেই টের পেল, নতুন নতুন জটিল ভাবনায় মগজের স্নায়ুগুলো তছনছ হয়ে যাচ্ছে। সে বারান্দার খোলা চত্বরে এসে দাঁড়ালো। প্রকৃতিঘেরা ক্যাম্পাসের দিন শুরুর তাজা-তরুণ-বিশুদ্ধ বাতাসে শরীর ও মনের ধকল অনেকটা কেটে গিয়ে চনমনে একটি ভাব চলে এল। সে ভাবছে কিভাবে শামীমের উত্তরণের কাজটি শুরু করা যায়। আরম্ভটি করবে কিভাবে! এরই মাঝে মানসিকভাবে সে তৈরিও হয়ে গেছে ওকে প্রচুর সময় ও সঙ্গ দেওয়ার জন্যে। এখন শুরুটা করা গেলেই হল। গতকালই ওর সঙ্গে প্রথম-একান্ত কথোপকথনের পর একটি অন্ধ-কালো-অন্ধকার ট্যানেলের শেষ মাথায় সামান্য আলোর ইঙ্গিত দেখে সে মনে মনে পুলকিত ও আশ্বস্ত বোধ করছে। আজকের সকালটি অমরার কাছে সে কারণেই অনেক আলাদা, অনেক আনন্দের, অনেক বৈশিষ্ট্যে ভরা। এমন সময় তার খেয়াল হল সকালটি আরেকটি কারণে অন্যরকম। এতো সকালে ক্যাম্পাসে সচরাচর শব্দমালার স্রোত তৈরি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আজকে দূর থেকে চাপা গুঞ্জরণ আর গাড়ির শব্দ ভেসে আসছে। শব্দসমূহের পরিধি আর শক্তিও ক্রমে বেড়েই চলেছে। কোথাও কি কিছু হল! কিছুটা উদ্‌গ্রীব হয়ে অমরা নেমে আসে নিচতলার কমনরুমে। সেখানে আগে থেকেই কয়েকজন মেয়ে জটলা পাকিয়ে অস্বাভাবিক আওয়াজের উৎস সন্ধান করছে। কাকলি, মিলা, শাম্মী, লাকিরাও চএল এসেছে। কেউ কেউ স্থিরভাবে বলছে যে ছেলেদের হলে সংঘর্ষ হয়েছে। রাতের দিকে মারামারি টের পাওয়া যায়নি। সকালে আহতরা মেডিকেলে এসে উঠেছে। পুলিশও এসে গেছে। এগুলো খুবই সাধারণ আর নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। লক্ষ্য করে দেখা গেল, শব্দের উৎস মেডিকেল। অতএব জটলা আর আড্ডা বেশিক্ষণ টিকলো না। মেয়েরা নাস্তা খেয়ে ক্লাসে যেতে তৈরি হতে লাগল। অমরা ভাবল অনেকদিন ক্লাস কামাই হয়ে গেছে, সকালের কয়েকটি ক্লাস করে বাকি দিনটুকু শামীমকে সময় দেওয়া যাবে। ওর সঙ্গে চিকিৎসা আর জীবনের ছকটিও কেটে নেওয়া যাবে। সকালের এই শব্দমণ্ডলীকে ঘিরে সৃষ্ট জমাট উত্তেজনায় অমরাকে কেউই জানায়নি, বিকেলে শামীম ওকে ব্যস্ত-সন্ত্রস্তভাবে কয়েকবার খুঁজে গেছে। ওকে খুঁজতে শামীমের বার বার আসার খবরটি না জেনেই অমরা শামীমকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ক্লাসের জন্য তৈরি হতে লাগল।

হল থেকে বেরিয়ে বিটপীছাওয়া পথে ফ্যাকাল্টির দিকে কিছুদূর যেতেই বোমা ফাটার মতো খবরটি অমরার কানে এল। এনামুল ওকে দেখে দৌড়ে এসে চিৎকার করে উঠল :
"তুই মেডিকেলে না গিয়ে ক্লাসে যাচ্ছিস!"
"কেন! ক্লাসেই তো যাওয়ার কথা।"

শামীমের সঙ্গে অতিমাত্রায় মেলামেশার কারণে বন্ধুদের ইঙ্গিতপূর্ণ ভ্রুকুটি দেখতে দেখতে অভ্যস্থ অমরা সাদামাটা উত্তর দেয়।

এনামুল নিমেষেই বলে ফেলে :
"ও, তাহলে তুই খবরটা পাসনি। শামীম সুইসাইড করেছে। আমরা মেডিকেলে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরেই সব ক্লাস সাসপেণ্ড হয়ে যাবে। তোর আর ক্লাসে যাওয়ার দরকার নেই।"

সঙ্গে সঙ্গে ভূমিকম্পের সুতীব্র কম্পনে অমরার সমস্ত শরীর আর অস্তিত্ব কেঁপে কেঁপে নিথর হয়ে গেল। মনে হল প্রকাশ্য দিবালোকের এই ভরা ক্যাম্পাসে সে ধরাশায়ী হয়ে যাবে। পেছন থেকে ততক্ষণে মিলা এসে ওকে না ধরলে নিশ্চয় অমরা নির্ঘাত ভূপতিত হয়ে যেত। মিলার গায়ে শরীর এলিয়ে দেওয়ার আগে সে বলতে পারল :
"আমাকে হলে নিয়ে চল।"

পর পর সাত দিন রুম থেকে বেরলো না অমরা। শামীমকে শেষবারের মতো দেখতেও গেল না। তার টেবিলে পড়ে রইল একটি 'সুইসাইড নোট' - তাকে লেখা শামীমের প্রথম এবং শেষ চিঠি :
"অমরা, তুমি জানো এবং সবাই জানে, আমার মৃত্যুর জন্য কেউই দায়ী নয়; তুমি তো নয়ই। আসলে ভয় থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছি। জীবনের কিছু মূল ভাবনাকে অসীমের পটভূমিতে স্থাপন করে দেখলে কিছু অন্ধ ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়। এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, মৃত্যুভয়। ব্যক্তিবিশেষের মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু যখন ব্যক্তিকে অতিক্রম করে বিশ্বের প্রতি প্রসারিত দৃষ্টিতে তাকাই তখন দেখি প্রাণের প্রবাহ নিরন্তর এগিয়ে চলেছে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। অসীমের প্রেক্ষাপটে বিচ্ছেদ শেষ কথা নয়, নিত্য প্রবহমানতাই গভীরতর সত্য। আর এই বিচ্ছেদবেদনায় আছে প্রেমের শুদ্ধ স্বীকৃতি। আপাতদৃষ্টিতে বিপরীত তবু প্রেমেরই দুটি প্রকাশ মান্যতা পেয়েছে যুগে যুগে, একটি বিরহে বিধৃত এবং অন্যটি মিলনে উদ্ভাসিত। অতএব লোভ ও ভয় থেকে মুক্ত সপ্রেম দৃষ্টিতে বিশ্বকে গ্রহণ করাই মূল কথা। ভয়ে আমরা অপরকে দূরে ঠেলে দিই; লোভে তাকে নিজের দখলে রাখতে ব্যস্ত হই। এইভাবে শুধু বিচ্ছেদ দৃঢ় হয়। এই সবের বাইরে আছে অন্য এক সম্পর্ক, একের সঙ্গে অপরের, ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বের-নির্ভয় ও নির্লোভ মিলন। এই নির্ভয় ও নির্লোভ মিলনেই আমাদের মুক্তি। শুধু যুক্তি দিয়ে এই মিলন ঘটে না। যখন ঘটে তখন কিন্তু যুক্তিরও বিশেষ প্রয়োজন হয় না। আমি মহামিলনের পথে চলেছি।"

কঠিন বাস্তবতার পাথুরে মাটি ভেঙে আসতে আসতে কবে শেষ কেঁদেছে অমরার মনে নেই। আজকাল আয়নার সামনে দাঁড়ালে অমরা দেখতে পায়, অশ্রু-প্লাবিত চেহারাতেই তাকে বেশ মানাচ্ছে। কি আশ্চর্য! এই জীবনে এত অশ্রু জমে গেছে, চারিদিকে এত মৃত্যু এত চোরাবালি এসে গেছে, সে টেরও পেল না! অনুভবের পুরোটা আবেগ দিয়ে সে বুঝতে পারল, কোনো কাজ নয়, কোনো কথা নয়, তার এখন অনেক কান্নার প্রয়োজন। প্রয়োজন জোছনার আলোঝুরি মাঠে মেঘের চাদর গায়ে সোহাগি কান্না - শিরীষের মগডালে বসা কান্নার হলুদ দুপুর। অমরার রাত সমুদ্রে শুধু ভাসে প্রিয় সাম্পান - ভাঙা পিলসুজ - কান্নার নাও। প্রতিটি মুহূর্তে অমরার গায়ে আলতো হাতে বিলি কাটছে কান্নার জলমগ্ন আঙুল!

কান্না তার বিরাট উপকার করেছে, বেদনার পুঞ্জিভুত স্তুপ ভাসিয়ে দিয়েছে, অব্যক্ত কথা তলিয়ে দিয়েছে - অমরা এখন বেশ হাল্কা - আবেগ ও অভিব্যক্তিহীন। সবাই দেখল, আগের সেই অমরা আর নেই - একটি পাথরের নির্বাক মূর্তি যান্ত্রিক পায়ে হেঁটে যাচ্ছে - ক্যাম্পাসে, ক্লাসে, লাইব্রেরির নিভৃত কোণে, পরীক্ষার হলে।

তারপর আবারও হারানোর স্মৃতি। কলেজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ও হারিয়ে যায় - অমরা নির্বাক পাথর-দৃষ্টিতে সব কিছু দেখে; সব কিছু মেনে নেয়। সেও এক সময় হারিয়ে যায় জীবনের কংক্রিট মাঠে। নিজেকে আর খুঁজে পায় না। না অফিসে, না বহুতল এপার্টমেন্টের ঘরে। মনে হয়, ওর মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, বলবার মতো আর কোনো ভাষা নেই। হাতে তুলি নেই। চোখে জলও নেই। বুকে চেপে রয়েছে আদিম পাথর আর কেবলই দমবন্ধ অন্ধকারের অন্ধ-কল্লোল। তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যায়। চারিদিকে জলহীন হাহাকার তৃষ্ণার্ত অমরাকে কালো সমুদ্রের অতল তলদেশের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে। সে কোনো রঙের জীবন যাপন করতে পারে না - সে যাপন করে বিবর্ণ-বিচ্ছিন্ন দিন-যাপনের গ্লানির মধ্যে ক্লান্ত-অবসন্ন-অভিব্যক্তিহীন-মনোটোনাস-বসবাস , যেখানে চারদিকে শুধু রাতকালোর একক উৎসব। মনে হয় অসমাপ্ত ক্যানভাসে সে লেপ্টে রয়েছে সুতীব্র জল পিপাসায়। এই পিপাসা নিয়েই বাকিটা জীবন তাকে বেঁচে থাকতে হবে।

অমরা জানে, এসব কথা কাউকে বলা যায় না। বললে হয়তো তারই চিকিৎসা শুরু করে দেবে। বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে নানাবিধ দাক্তারি তথ্য তার খুব ভালো জানা নেই। কিন্তু তার নিজের তো ডিমেনশিয়া বা এই রকম কোনো রোগ নেই। তবু প্রতি রাতে এ রকম হচ্ছে কেন! তবে কী সে অন্য একটা জীবন অন্য কোথাও যাপনের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে! সেখানে মৃত্যু কিংবা ধারাবাহিক হারানোর চলিষ্ণু চালচিত্র নেই। যেখানে সীতাকুণ্ডের জঙ্গলের কাঠ খোঁজার স্মৃতি পিছে পড়ে আছে; যেখানে দূরের টিলাতে লেগে থাকা মেঘগুলো উড়ে গেছে; যেখানে পারপল-কালারের শার্ট বাতাসে উড়ছে কিংবা শামীম বসে আছে অমরাবতীর আঙিনায়। সেখানে, সেই অন্য একটা জীবনে, সে অমরা নয়, অন্য নামের অন্য পরিচয়ের অন্য কোনো একজন।

গভীরতম কালো রাতের অতিমূর্ত ক্যানভাসে অপেক্ষমাণ ঝুলন্ত অমরার কখনো কখনো মণ কেমন করে সেই অদেখা অন্য জীবনের জন্য। সে জানে হিরন্ময় পাত্রে সত্য নিহিত। কিন্তু সেই পাত্রটির ঠিকানাটুকু সে জানে না। অমরা খেয়াল করল, আজকাল সে প্রায়ই বিড় বিড় করে : "হে সূর্য, তুমি পাত্রের ঢাকনা সরাও, যাতে আমি তাকে দেখতে পারি। আমি তো জেনেই গেছি, হিরন্ময় পাত্রে সত্য নিহিত। তবে আর আড়াল কেন?"



(পরবাস-৫০, ফেব্রুয়ারি, ২০১২)